1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

অন্তরাল

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

অন্তরাল
 বুমা ব্যানার্জী দাস

                                       

         পারাদ্বীপ থেকে ২৫ কিমি পশ্চিমে ছোট্ট নুলিয়াদের গ্রাম। জনবসতি বিশেষ নেই। ওই কয়েক ঘর নুলিয়াই যা আছে। প্রায় শেষরাত। হঠাৎ ঘন অন্ধকার আকাশ চিরে উজ্জ্বল গোলাপী, নীল আর বেগুনী মেশানো তীব্র একটা আলো খেলে গেল। আলোর রেখা যেন গ্রামের দক্ষিণ দিকে জঙ্গল আর আগাছাতে ঘেরা পোড়ো জমিটার দিকে মিলিয়ে যায়। পরদিন সন্ধ্যের দিকে নুলিয়াদের দেখা যায় গ্রাম ছেড়ে জিনিসপত্র নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে।

কলকাতার একটি বিখ্যাত বাংলা নিউজ চ্যানেলের টীম সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল দুপুর নাগাদ। পুঁটলি মাথায় বয়স্ক একজন নুলিয়াকে তারা পাকড়াও করে। - আপনারা এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কেন একটু বলুন- মাইক্রোফোনটা এগিয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে প্রতিবেদক। বৃদ্ধ নুলিয়া প্রথমে থতমত খেয়ে যান। তারপর আঙুল তুলে জঙ্গলের দিকে দেখিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বলেন - অপদেবতা, অপদেবতা এসে বাসা বেঁধেছে। কাউকে রাখবেনা।- এগিয়ে যায় নুলিয়া দলটি। ক্যামেরা নিয়ে নিউজ চ্যানেলের টীম এগিয়ে যায় জঙ্গলের দিকে। পরদিন হুলুস্থুল পড়ে যায় কলকাতায়। দূরদর্শনে প্রত্যেকটি বাংলা চ্যানেলে একটিই ব্রেকিং নিউজ - তিনজন নুলিয়া সহ একটি বিখ্যাত নিউজ চ্যানেলের দুজন প্রতিবেদকের মৃতদেহ পারাদ্বীপের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের জঙ্গলে পাওয়া গেছে। কারুর দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আরো সাতদিন কেটে যায়।আশ্চর্যজনকভাবে এই অদ্ভুত ঘটনা সম্পর্কে আর কোন তথ্য জানানো হয়না জনসাধারণকে। কোনও রাষ্ট্রীয় চ্যানেলেও এই খবর প্রচার করা হয়না।ধীরে ধীরে ভুলে যায় সবাই। 

 ছয় মাস পর।

সৌম্যদর্শন কিন্তু চিন্তিত এক প্রৌঢ়কে সূর্যাস্তের সময় সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়। ইনি স্বনামখ্যাত প্রাণীবিদ পরমেশ উপাধ্যায়। তাঁর কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ। ক্রমে সন্ধ্যের অন্ধকার ঘিরে ধরে। উপাধ্যায় দক্ষিণের জঙ্গলের আড়ালে মিলিয়ে যান। আর দেখা যায়না তাঁকে। তিনি খেয়াল করেননা জঙ্গলের আড়াল থেকে আর একটি ছায়ামূর্তি তাঁকে অনুসরণ করে চলেছে। দুটি ছায়ামূর্তিই একসময় জঙ্গলের ওপারে মিলিয়ে যায়।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী সত্যব্রত বসুর ঘুম ভাঙ্গে শেষরাতে বিশেষ একটি শব্দে। তাঁর একটি চূড়ান্ত গোপনীয় ইমেইল অ্যাড্রেসে মেইল এলে তাঁর ফোন এই নোটিফিকেশন শব্দটি করে। মুহূর্তে সজাগ হয়ে ওঠেন তিনি। মেইল খুলে দেখেন। একটি ভয়েস রেকর্ডিং এসেছে মেইলে। সেটা শোনার পরমুহুর্তেই তিনি দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

মুম্বাই। ভারতবর্ষের কিছু বাছাই করা বিজ্ঞানীদের নিয়ে আলোচনায় বসেছেন ইসরো অধিকর্তা। বলা বাহুল্য চরমতম গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। তাঁর মেইলে পাওয়া ভয়েস রেকর্ডিংটা এই নিয়ে বোধহয় সাতবার চালালেন ডক্টর সত্যব্রত বসু। আবার শোনা গেলো সেই হিসহিসে শব্দ, তারপর পরমেশ উপাধ্যায়ের আবছা কণ্ঠস্বর। হাঁফাতে হাঁফাতে বলছেন - অল ডেড। তারপর খানিক চুপচাপ। আবার ঘড়ঘড়ে গলায়, প্রায় শোনা যায়না এমনভাবে আর একটি মাত্র শব্দ - ব্লাইন্ডস। ইসরো অধিকর্তা বলেন - ডক্টর বসু, স্বাভাবিভাবেই আমরা আর কাউকেই এই ব্যাপারে জড়াতে পারবোনা এবং সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা আমাদের সকলের দায়িত্ব।আপনি যে কোন মূল্যে আপনার সেরা টীম প্রস্তুত করুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। উই নিড টু ক্লীন আপ দিস মেস।

কলকাতার শান্ত বিকেল।জীববিজ্ঞানী অরুন্ধতী মিত্র ল্যাব থেকে বেরোনোর মুখে একবার নতুন কোন মেইল এসেছে কিনা দেখে নিল। জৈব রসায়নবিদ দিলীপ কাকোদকারকে কিছু টেস্ট রেজাল্ট পাঠিয়েছিল সে। সেগুলোর বিশ্লেষণ আসার সময় হয়ে গেছে। ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠতে যাবে, টুং শব্দ করে নতুন একটা মেইল ঢুকলো। ভ্রূ কুঁচকে ওঠে অরুন্ধতীর। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। -মা, আজ রাতে আমাকে মুম্বাই যেতে হবে।- হ্যাঁ আজই। কবে ফিরবো এখুনি বলতে পারছিনা গো। - একটু খাবার রেডী রেখো, আমি ফিরে কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাবো। - আজ রাতের ফ্লাইট, হ্যাঁ টিকেট পেয়ে গেছি, মেইলে এসেছে।- কয়েক ঘণ্টা পর চেন্নাই থেকে পদার্থবিজ্ঞানী শঙ্কর রঙ্গরাজ, মধ্যপ্রদেশ থেকে জৈব রসায়ানবিদ দিলীপ কাকোদকার, কেরালা থেকে পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানী অচ্যুত শিভাঙ্কার আর ওড়িশা থেকে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সুছন্দা পানিগ্রাহী একইভাবে মুম্বাই যাওয়ার জন্য রওনা হলো। এদের কেউই বাড়িতে জানাতে পারলনা তাদের গন্তব্যস্থল কোথায়। অবিশ্যি তারা নিজেরাও জানতো না। শুধু জানতো কোনও বিশেষ কাজের জন্য তাদের মুম্বাই যেতে হবে। ফ্লাইটের টিকেট তারা ইমেইলে পেয়ে গিয়েছিল। এছাড়া সাতদিনের মত জামাকাপড় ও তাদের নিজেদের ক্ষেত্রের কাজ স্বম্বন্ধীয় অন্যান্য জিনিসপত্র নেওয়ার নির্দেশ তারা পেয়েছিলো। নির্দেশ অনুযায়ী কাজ না করার কথা তাদের কারুর মনে আসেনি।ইসরো থেকে ডাক এলে উপেক্ষা করা চলেনা।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে অরুন্ধতী এদিক ওদিক তাকায়। লোক থাকার কথা এখানে। ডক্টর অরুন্ধতী মিত্র লেখা বোর্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে অবাক সে। - আরে দিলীপ?- তার কলেজের বন্ধু দিলীপ কাকোদকার। হাসিমুখে এগিয়ে যায় সে। দিলীপ আরো তিনজনের সাথে আলাপ করিয়ে দেয় তার। অবাক হয়ে প্রত্যেকেই ভাবতে থাকে - বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখা থেকে বিজ্ঞানীদের প্রয়োজন কি কারণে হতে পারে। বিশেষ করে পানিগ্রাহীর উপস্থিতি সামান্য অস্বস্তিতে ফেলে সকলকে। বোর্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকটি এবার তাদের এগিয়ে নিয়ে যায় এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল গাড়িটার দিকে।

- ছয়মাস আগে পারাদ্বীপ থেকে সামান্য দূরে এক নির্জন নুলিয়া গ্রামের ধারে জঙ্গলে উল্কাপাত হয়। পরদিন সকালে সেই এলাকার লোক জঙ্গল থেকে গোলাপী আভা দেখে ভয় পায়। তাদের মধ্যে সাহসী তিনজন জ্বালানী কাঠ আনতে তাও জঙ্গলে ঢোকে। দুপুর হয়ে গেলেও তারা ফিরছে না দেখে আরো পাঁচ সাতজনের একটা দল তাদের খুঁজে দেখতে যায় ও তাদের মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। কারুর দেহে কোনরকম আঘাতের চিহ্ন কিন্তু ছিলনা। উল্কাপাতের ব্যাপার, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ডিপার্টমেন্টের আওতায় আসছে এটা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই তখন গোলাপী আলো আর নেই। - পাঁচজনের জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে বলে চলেন ডক্টর সত্যব্রত বসু - কিন্তু যেটা পাই সেটা নিয়েই এই ঘটনার সূত্রপাত। উল্কার মধ্যে জৈব পদার্থের উপস্থিতি। বুঝতেই পারছো, বহির্বিশ্ব থেকে আসা এই জৈব পদার্থের গুরুত্ব কতখানি। - ডক্টর বসু যেন অনেক বছর আগের নিজের অধ্যাপক জীবনে ফিরে যান। ঠিক পড়ানোর ভঙ্গিতে বলে চলেন - অপরিসীম গোপনীয়তা রক্ষা করে সেখানে অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি তৈরী করা হয়। বিখ্যাত প্রাণীবিদ পরমেশ উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে চারজন বৈজ্ঞানিকের একটি দল সেখানে কাজ শুরু করে। ওই জৈব পদার্থ বিশ্লেষণ করতে পারলে মহাজাগতিক প্রাণ সম্পর্কে অনেক ধারণা পরিষ্কার হতে পারে- বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ডক্টর বসু , পাঁচজন বিজ্ঞানীর চোখেও নিজের উত্তেজনা প্রতিফলিত হতে দেখেন। - দুইদিন আগে উল্কাপাতের ঠিক ছয় মাস পূর্ণ হয়। সেইদিন রাতে উপাধ্যায়ের কাছ থেকে এটা আমি পাই।- ডক্টর বসু ভয়েস রেকর্ডিংটি পুনরায় চালান। খানিক নিঃস্তব্ধতা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন ডক্টর বসু - উপাধ্যায়ের সাথে সেই শেষ যোগাযোগ।

অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটা আসে অরুন্ধতীর কাছ থেকে - ব্লাইন্ডস মানে? -খানিক চুপ করে থাকেন ডক্টর বসু।  - সেটা বুঝতেই তো তোমাদের ডাকা। তোমাদের সবার ব্রিলিয়ান্ট অ্যাকাডেমিক রেকর্ড। তাছাড়া  চরিত্রের জোর, মানসিক স্বচ্ছতা সমস্ত বিচার করে তোমাদের পাঁচজনকে বাছা হয়েছে। তোমাদের সবারই মার্শাল আর্টে দক্ষতা আছে সেটাও আমার অজানা নয়।সেখানে গিয়ে কি দেখবো আমরা, কিসের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের কোন ধারণা নেই।

রঙ্গরাজের যেন হঠাৎ করে ঘোর কাটে - স্যার আমরা কি কেউ আর বেঁচে নেই ধরে নিয়েই এগোবো? মাথা নাড়েন ডক্টর বসু - ধরে নাও তাই।আর সে মৃত্যুর কারণ উল্কাস্থিত জৈব পদার্থ হওয়া অসম্ভব নয়। যদি তা না হয়, তাহলে অবিশ্যি অন্য কথা। কিন্তু উপাধ্যায়ের কথা শুনে এটা মনে হচ্ছেনা যে বাইরে থেকে এসে কেউ তাদের আক্রমণ করেছে। - একটানা কথা বলে থামেন ডক্টর বসু। সামনে রাখা কফি ততক্ষণে একেবারে ঠান্ডা। সেটাই ভুল করে মুখে তুলে মুখ কুঁচকে বলেন - খুব স্বাভাবিভাবেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে তোমাদের উপস্থিতি অত্যন্ত প্রয়োজন। আমাদের সব কিছুর জন্যই তৈরী থাকতে হবে। পানিগ্রাহীর ভূমিকা নিশ্চই পরিষ্কার সবার কাছে। মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করা আমাদের প্রথম কাজ হবে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন ডক্টর বসু।  - আধঘন্টা সময় নাও তোমরা। নিজেদের কাজের সরঞ্জাম যদি কিছু লাগে আরও, সেটা জানাও। আর - গলা সামান্য কেঁপে ওঠে প্রবীণ বৈজ্ঞানিকের - যদি কেউ ভয় পেয়ে থাকো, কেউ অনিচ্ছুক থাকো এই অভিযানে সামিল হতে, সেটা বল। এর পরে আর সেই সুযোগ আসবে না। তবে গোপনীয়তা রক্ষার কথা আশা করি কাউকে মনে করাতে হবেনা। একটু অপেক্ষা করেন তিনি। পাঁচজনের দিকে এক এক করে তাকান। নাহ্ ভুল তাঁর হয়নি। পারলে এরাই পারবে। - আর দুই ঘণ্টার মধ্যে আমরা বেরোচ্ছি - দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান তিনি। ওদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে দেওয়া দরকার।

মধ্যরাত। নিঝুম অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ল্যাবরেটরি। দূর থেকে সমুদ্রের অবিশ্রান্ত ঢেউ ভাঙার শব্দ কানে আসছে। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে অন্ধকার পোড়ো বাড়ি। বন্ধ দরজার এক কোণে ছোট্ট একটি সমান চ্যাপ্টা প্যাড। তার উপর নিজের বুড়ো আঙুল রাখলেন ডক্টর বসু। দরজা ভিতর দিকে মসৃণভাবে খুলে গেলো। একে একে ঢুকলেন ছয় বিজ্ঞানী। ভিতরে চাপা সবুজ আলো। কয়েক পা সাবধানে এগিয়েই চাপা আর্তনাদ করে উঠল রঙ্গরাজ। সেই সঙ্গে ভয়ানক দুর্গন্ধে শিউরে উঠলো সবাই। সামনের দৃশ্য দেখে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে যায় দলটা। শুধু দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যায় সুছন্দা। চারটি মৃতদেহ। চারজনেই নিজেদের চেয়ারে মন দিয়ে কাজ করার ভঙ্গিতে বসে। অথচ চারজনেই মৃত। পচন ধরতে শুরু করেছে।

- কারুর কোনরকম রক্তক্ষরণ হয়নি। সুছন্দার গলা ভেসে আসে।- নিশ্চিতভাবে বলতে পারবোনা, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে কোনো তীব্র বিষক্রিয়ায় এদের মৃত্যু হয়েছে। -নিজের রুকস্যাক থেকে লাম্বার পাংচার সিরিঞ্জ আর অন্যান্য সরঞ্জাম বের করে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সুছন্দা। বাকিরা ভিতরের দিকে এগিয়ে গেলো।

উপাধ্যয়ের মৃতদেহ খুঁজে পেতে দেরী হলনা। ঠিক বাকি চারজনের মতোই। কিন্তু পুরো ল্যাবরেটরি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না পাঁচটি মৃত্যুর কোনো কারণ। আরো আশ্চর্য, উল্কার অংশ পাওয়া গেলেও জৈব পদার্থটির কোনও নমুনা দেখতে পাওয়া গেলনা। ডক্টর বসু চিন্তিত গলায় বললেন-  রঙ্গরাজ, কাকোদকার তোমরা উপাধ্যায়ের কাগজপত্র ও ল্যাপটপ খুঁজে দেখ। এই প্রকল্পে ব্যবহার করা সমস্ত ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড আমার নিজেরই দেওয়া- তিনি নিজে অরুন্ধতী আর শিভাঙ্কারকে নিয়ে বসলেন ব্লাইন্ডস শব্দের রহস্য ভেদ করতে।

অরুন্ধতী নিজের মনেই যেন বলে চলে- কী বোঝাতে চেয়েছেন উনি? কে বা কারা ব্লাইন্ড? মৃত্যু আসার আগে কী সাময়িক অন্ধত্ব এসেছিল তাঁদের? নিজেদের চেয়ার থেকে তাই সরার চেষ্টাও তাঁরা করেননি বিপদ বুঝেও? ডক্টর বসু বলেন- সেটাই সবচেয়ে আশ্চর্য লাগছে ,ওরা বিপদ বুঝেও নড়ল না কেন? নাকি বিপদ আসছে, মৃত্যু আসছে সেটা বুঝতেই পারেনি? সেটাই বা কেন?- শিভাঙ্কার যোগ করে - আর ব্লাইন্ডসই বা কেন? ওই শেষের ‘স‘ টা উনি যোগ করলেন কেন? নাকি মৃত্যুযন্ত্রণা বা ভয়জনিত ভুল? আমরা ‘স‘ টা ধরে নিয়ে ভাববো, না বাদ দিয়ে?

হঠাৎ বিকট আর্তনাদ করে ওঠে রঙ্গরাজ। -কাকোদকার ইস ডেড- বিকট এই চিৎকারের মানে বুঝতেই কেটে গেলো পুরো দুই মিনিট। হুড়মুড় করে ছুটে গেল সবাই ওদের দিকে। অন্য ঘর  থেকে ছুটে আসে সুছন্দা।হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে রঙ্গরাজ। তোতলাতে শুরু করেছে সে। - আ আমি ওদিকে ঘুরে  কাগজপত্র নোটস দেখছিলাম, কথা বলে উত্তর না পেয়ে সন্দেহ হয়,কাছে এসে দেখি - দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে রঙ্গরাজ। - আমরা কী করতে পারি - ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে রঙ্গরাজ - আমরা তো বিজ্ঞানী, গোয়েন্দা নই। রহস্য সমাধান আমরা কী করে করব? সামনে দিয়ে কে মেরে গেল ওকে, কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না। ও নিজেও কিছু টের পেয়েছিল বলে মনে হয়না। - সবাই স্তব্ধ হয়ে থাকে। কেউ কারুর দিকে তাকাতেও যেন পারেনা।হঠাৎ ধীর পায়ে এগিয়ে যায় অরুন্ধতী। রঙ্গরাজের কাঁধে শান্তভাবে দুই হাত রাখে।- ঠিক বলেছ, আমরা গোয়েন্দা নই, বিজ্ঞানী। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানী বলেই আমাদের মত রহস্যের সমাধান আর কেউ করতে পারেনা। রহস্য সমাধান করাই তো বিজ্ঞানীর কাজ। - ইস্পাতের মত কঠিন হয়ে আসে অরুন্ধতীর গলা-   আমরা ছ‘জন কে হারিয়েছি। এ রহস্য সমাধান না করে কী আমাদের চলে যাওয়া উচিত রঙ্গরাজ?

 হঠাৎ চমকে ওঠে শিভাঙ্কার। এদিক ওদিক তাকায়।- কিছু একটা আন্দোলন হল ওইদিকে, যেন কিছু পিছলে সরে গেল,কেউ দেখলে কি? নাহ আমারই ভুল, নাকি? - বিভ্রান্ত দেখায় শিভাঙ্কারকে। আর তো কেউ কিছু টের পায়নি। কী দেখল সে? কয়েক মিনিট কেটে যায়। ডক্টর বসু হাত মুঠো করে প্রচণ্ড জোরে টেবিলে ধাক্কা মারেন। - ওহঃ কী বোকা আমি, বয়স হচ্ছে যে। ওটা ব্লাইন্ডস নয়, ব্লাইন্ড স্পট… পুরোটা বলার আগেই ও শেষ হয়ে গেছিল। সুছন্দা  জিজ্ঞেস করে - ব্লাইন্ড স্পট? কাগজ টেনে নিয়ে আঁকতে থাকেন ডক্টর বসু। উত্তেজনায় হাত অল্প কাঁপছে তাঁর। আমাদের রেটিনাতে কী থাকে? আলোক সংবেদনশীল কোষ, অর্থাৎ দ্রষ্টব্য বস্তু সংক্রান্ত তথ্য যারা ব্রেন পর্যন্ত পৌঁছে দেয় অপটিক নার্ভের সাহায্যে। ফলে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু অপটিক নার্ভ যেখানে রেটিনার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে, সেখানে কোনো আলোক সংবেদনশীল কোষ থাকে না, অর্থাৎ আমাদের সবার দৃষ্টিপথে একটা খুব সামান্য অংশ থাকে যেখানে আমরা কিছু দেখতে পাইনা। তাকেই বলে ব্লাইন্ড স্পট। কিন্তু আমরা সেটা বুঝতে কেন পারিনা তাই তো? কারণ আমরা দুই চোখ একসাথে খুলে রাখি। একে অন্যের ব্লাইন্ড স্পটকে তারা ওভারল্যাপ করে। সুছন্দা আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, হাত তুলে থামিয়ে দেন ডক্টর বসু।- জিজ্ঞেস করবে এক চোখ বন্ধ করেও অন্য  চোখে আমরা পুরোই দেখতে পাই, এমন তো হয়না যে কোনও অংশ দেখতেই পাচ্ছি না? বাকিরা নিশ্চই জানো, ব্রেইনের এক অদ্ভুত খেলা এটা। যে অংশটা  সে দেখতে পাচ্ছে না, সেটা ভরে দেয় আশপাশে যা দেখতে পাচ্ছে সেই তথ্য দিয়ে। একে বলে ফিলিং ইন। আমরা টেরও পাইনা যে আমরা খানিক অংশ দেখতে পাচ্ছিনা। এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে সামান্য থামেন ডক্টর বসু। ঠান্ডা গলায় বলেন, আমার ধারণা হত্যাকারী যাকে আক্রমণ করছে তার এক চোখের ব্লাইন্ড স্পট থেকে আর এক চোখের ব্লাইন্ড স্পটে সমানে সরে গিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। কোনো অদ্ভুত ক্ষমতায় প্রত্যেক মানুষের ব্লাইন্ড স্পট নিখুঁত ভাবে হিসেব সে করতে পারে। অরুন্ধতী বলে ওঠে - কিন্তু স্যার, এক চোখের ব্লাইন্ড স্পটে থাকার সময় অন্য চোখ তো সেটা দেখতে পাবে?- আমি সেটা ভেবেছি - ডক্টর বসু বলেন। আমাদের চোখ কোনো কিছু দেখে সেটা বুঝতে সময় নেয় .২৫ সেকেন্ড। এই প্রাণী অথবা অপ্রাণী ওই .২৫ সেকেন্ডের মধ্যে অন্য চোখের ব্লাইন্ড স্পটে চলে যায়। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পাঁচজন বিজ্ঞানী। রঙ্গরাজ এতক্ষণে উঠে দাঁড়ায়। কী যেন মনে পড়েছে তার। -স্যার দেখুন। উপাধ্যায়ের নোটস। বলছেন জৈব পদার্থগুলো আসলে ডিম।ইনকিউবেশন পিরিয়ড ছয় মাস।

 -কিন্তু আমরা বাঁচবো কি করে?সুছন্দা এতক্ষণে ধাতস্থ হয় বোধহয়।-একটাই উপায়- অরুন্ধতী এগিয়ে আসে- একে অন্যের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হবে। তোমার ব্লাইন্ড স্পট ধরে যে আসবে, তাকে আমি দেখতে পাবো ভাইসি ভারসা। - কিন্তু তারপর? দেখতে পেলে তো হলনা, মারবে কি দিয়ে? - শিভাঙ্কার মানসিকভাবে সব কিছুর জন্য তৈরী। - সেটা উপাধ্যায় লিখে গেছেন বলে মনে হচ্ছে - রঙ্গরাজ কঠিন মুখে বলে- তাপ এদের কিছু করতে পারেনা, কিন্তু  ঠান্ডা এরা সহ্য করতে পারেনা। উনি কিছু জৈব পদার্থ মানে ওই ডিম রেফ্রিজারেটরে রেখেছিলেন,সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছিল।

মাঝখানে তাদের স্যারকে রেখে চারজন বিজ্ঞানী একে অন্যের দিকে এগিয়ে আসে। প্রত্যেকের হাতে ঠান্ডা জলের স্প্রে বটল।একটা করে ইনসুলেটেড স্প্রে বটল সবার ব্যাগেই ছিল, শুধু বরফ ঠান্ডা জল ভরে নেওয়া। শুরু হয় এক ধৈর্য্যের পরীক্ষা, মহাজাগতিক অজানা প্রাণী বনাম মানুষ। কেউ কারুর দিক থেকে চোখ সরায় না। যেই আসুক, যেভাবেই আসুক এই ব্যুহ ভেদ করতে পারবে না।

আধ ঘন্টা কেটে যায়। খালি নিঃশ্বাসের শব্দ। ধীরে ধীরে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে সুছন্দার। কিছু ভুল হচ্ছেনা তো তাদের। কতক্ষন এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে তারা? হাত যেন ভারী হয়ে আসে তার। একদৃষ্টিতে শিভাঙ্কারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তার দিকে লক্ষ্য রাখার কথা রঙ্গরাজের। সেটা সে করছে তো? হয়তো ঝিমুনি মতো এসে থাকবে। হঠাৎ কানের পাশ দিয়ে বরফ ঠান্ডা জলের ঝাপটা লাগে। আর তার পায়ের কাছে কিছু একটা ছিটকে পড়ে। কিন্তু না, দেখার উপায় নেই। দৃষ্টি সরানো যাবেনা।

অরুন্ধতী একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল ডক্টর বসুর দিকে। এই মানুষটিকে সে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে। কাকোদকারের কাছে এনার বিষয়ে অনেক কিছু শুনেছিল সে। ওনার সাথে কাজ করার কখনো সুযোগ হবে সে ভাবতে পারেনি। কাকোদকার তার অনেকদিনের বন্ধু। তার এমন অহেতুক মৃত্যুর জন্য যে বা যারা দায়ী তাদের সে এমনি ছেড়ে দেবে না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ধাঁধিয়ে আসে অরুন্ধতীর। হঠাৎ কানের পাশ দিয়ে ঠান্ডা জলের ঝাপটা লাগে, সঙ্গে শিভাঙ্কারের অস্ফুট চাপা গলা ভেসে আসে। মুহুর্তের জন্য অন্যমনস্ক হতে গিয়েও চমকে ওঠে অরুন্ধতী। ওটা কী যাচ্ছে ডক্টর বসুর প্রায় কান ঘেঁষে!! একবার ডানদিক একবার বাঁদিক ধরে উজ্জ্বল নীল প্রায় ময়ূরকণ্ঠী রঙের একটা ফিতের মতো পাতলা, হিলহিলে কিছু ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তাঁর নাক লক্ষ্য করে। তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছেনা। নির্ভুল লক্ষ্যে ঠান্ডা জলের স্প্রে আঘাত করে বস্তুটিকে। এক, দুই, তিন, চার ঠিক পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় নীচের দিকে নেমে যায় ফিতেটা। তাকিয়ে দেখার অসীম আগ্রহকে কোনমতে সামলে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে অরুন্ধতী ডক্টর বসুর দিকে।

ঠিক পৌনে দুই ঘণ্টার মাথায় আবার স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়ায় সবাই। শেষ আধ ঘণ্টা আর কিছু চোখে পড়েনি। টনটন করতে থাকা হাত আর কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সবার আগে নীচের দিকে তাকায় সবাই। পা কাঁপছে তাদের। গোল হয়ে বসে পড়ে তারা।

এক মাস কেটে গেছে। তুমুল করতালির মধ্যে সামনের ছোট্ট পোডিয়ামে উঠে আসে অরুন্ধতী, সুছন্দা, রঙ্গরাজ, শিভাঙ্কার আর ডক্টর বসু। অবিশ্যি বাইরের লোক কেউই নেই। পৃথিবীকে চরম বিপদের হাত থেকে বাঁচালো যে মানুষগুলো, তাদের দেখতে পেলো শুধু কিছু বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। এ খবর সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক এটা কখনোই কাম্য নয়। প্রথমে উপাধ্যায় ও তাঁর সহকর্মীদের আর কাকোদকারের জন্য নীরবতা পালন। তারপর এগিয়ে আসেন ডক্টর বসু। তাঁর গমগমে গলায় ভরে ওঠে হলঘর - কোনও এক গ্রহ থেকে জৈব পদার্থ বয়ে এনেছিল এক উল্কাপিণ্ড। - চলতে থাকে দীর্ঘ বক্তৃতা।পোডিয়ামের পেছনে পর্দায় ফুটে ওঠে সেই ফিতের মতো হিলহিলে ময়ূরকণ্ঠী রঙের প্রাণীর ছবি। - আয়তনে বড়োজোর ছয় ইঞ্চি। এদের শারীরিক গঠন পৃথিবীর কোনও প্রাণীর শারীরিক গঠনের সাথে মেলেনা। মাথা বলে যেখানটা ধরে নেওয়া যেতে পারে, সেখানে আছে একটা ছোটো চৌকো খোপ। দুইপাশে দুটো চোখ। সেই খোপ থেকে গন্ধ ও বর্ণহীন তীব্র বিষ বের হয়ে আসে। এদের শারীরিক গঠন এখন আমাদের গবেষণাধীন। হয়তো একদিন আমরা বুঝতে পারবো কিভাবে এই প্রাণী তার সামনের মানুষের ব্লাইন্ড স্পট বা অন্ধ বিন্দু নির্ভুলভাবে বের করে ফেলতে পারে। অবশেষে শেষ হয় ডক্টর বসুর সুদীর্ঘ বক্তৃতা। তিনি পোডিয়াম থেকে নেমে এলে তাঁকে ঘিরে ধরে সবাই। এক তরুণ বিজ্ঞানী জিজ্ঞেস করে - ডক্টর বসু, এই প্রাণীর কোনও নাম ঠিক করেছেন? -মৃদু হাসেন প্রবীণ বিজ্ঞানী। - আপাতত আমি একে

ফর্মিডিলোসাস্ অকিউলাস বলে ডাকছি। ডাকনাম একটা তোমরা সবাই মিলে দাও।- বেরিয়ে যান শ্রান্ত বিজ্ঞানী। সত্যি বড়ো ক্লান্ত তিনি। ঘুম দরকার।

কিছু একটা অস্বস্তি হচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে অরুন্ধতীর। কী যেন একটা ভুলে যাচ্ছে সে। খুব দরকারী। অস্বস্তিটা মনে নিয়েই এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দেয় সে। অন্যমনস্ক ভাবেই ফ্লাইটে ওঠে, একসময় ঘুমিয়েও পড়ে। আচমকা শিরদাঁড়া শক্ত করে উঠে বসে সে, ঘামে শরীর ভিজে যায় আতঙ্কে। কী বলেছিলেন উপাধ্যায়? ইনকিউবেশন পিরিওড ছয় মাস না? যেগুলোকে তারা ধ্বংস করলো, তারা যদি ডিম পেড়ে থাকে কোথাও? এদের জীবনচক্র সম্বন্ধে তো কিছুই জানা নেই।সবে এক মাস গেছে।

দিন কাটে ধীরে ধীরে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে চার বিজ্ঞানী। আর ভাবে মানুষ কি মানুষের থেকে, একে অন্যের থেকে বড়ো বেশি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল? বড়ো বেশি কেবল নিজের দিকে তাকিয়ে দিন কাটাচ্ছিল? তাই কি এই শাস্তি ভবিষ্যতের মানুষের? স্থির দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে, একে অন্যকে রক্ষা করাই মানব সভ্যতার বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়?


banerjee.buma@gmail.com
কেনেডা 

1 comment: