1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

ভাবনা


ছবি  : ইন্টারনেট 

ভাবনা
পল্লব পত্রকার

      কৃষ্ণসায়রের পাশে ঝাঁকড়াচুলো গন্ধরাজ গাছটায় পাখিদের আজ  জমজমাট আড্ডা। প্রত্যেকেই  বেশ উত্তেজিত। একজনের কথা শেষ না হওয়া মাত্র আর একজন কথা বলতে  উৎসাহী।
 টিয়া বলল, 'আজকের আকাশ দেখেছিস! কি দারুণ ! একেবারে ময়ূর-পেখমের মতো নীল!' 
   দোয়েল কারণটা ব্যাখ্যা করে। 'হবেনা? এই প্রথম একটানা এতদিন ধোঁয়া উগরানো সব গাড়ি বন্ধ রেখেছে মানুষ! ট্রেন, এরোপ্লেন কিচ্ছু চলছে না!...'

  'একদম ঠিক বলেছিস।' মাছরাঙা তাকে সমর্থন করে। 'কি সুন্দর বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছি!' 

   কোকিলের গলায় বিষন্নতা। 'কবে থেকে মানুষকে সাবধান করছি, তোমাদের সবকিছু কু! একটু সমঝে চল। কিছুতেই আমার কথা গ্রাহ্য করে না!' 

  বুলবুলি জিজ্ঞেস করে, 'হঠাৎ সুমতি হল কি করে বলত? আমি তো নয়ই, আমার বাপ ঠাকুদ্দাও কক্ষনও এরকম দেখেনি!' 

    চড়াই বলল, 'সত্যি তাই! এরকম আগে কোনওদিন হয়নি! রাস্তার ধারে যে বটগাছটায় থাকি, ওখানে তো রাত্তিরে ঘুমানোই যায় না! বিশাল একটা বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে সারা রাত ধরে ঝলমলে আলো। মাত্র কদিন হল, আলো জ্বলছে না। শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারছি।'

   ফিঙে জানায়, 'শব্দদূষণও একদম কমে গেছে। চারিদিকে শুধু শান্তি আর শান্তি।'

   গন্ধরাজের পাশে ঝুপ্পুস পিয়ারা গাছটার  নিচে একটা খরগোশ মর্নিং ওয়াক করছিল। ইদানিং ব্লাড সুগারটা তার বেড়েছে। আর একটা কাঠবেড়ালি পেয়ারা গাছের ডালেই বারবার ওঠানামায় ব্যস্ত ছিল। ডাক্তারবাবু তাকে অতিরিক্ত ফ্যাট ঝরাবার পরামর্শ দিয়েছেন। পাখিদের আলোচনায় তারা অংশ না নিলেও মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে কান পেতে সব শুনছিল। 

   একটু দূরে তেঁতুল গাছের মগডালে বসে একটা বাঁদর মন দিয়ে তেতুঁলপাতা চিবাচ্ছিল। সায়রের পাশে কিছুদিন হল যে বিশাল বহুতল বাড়িটা হয়েছে, তার একটা ফ্ল্যাটে তার যাতায়াত। ভিতরে না ঢুকলেও ফ্ল্যাটের মালকিন যখন টিভিতে নিউজ শোনে বা সেলফোন খোলে সে জানলার ধারে চুপটি করে বসে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। 

   বাঁদরটা হঠাৎ ফুট কাটল। 'তোরা দেখছি কোনও খবরই রাখিস না! একদল ভাইরাস এইসান কামড় বসাচ্ছে যে পৃথিবী জুড়ে মানুষ থরহরি কম্পমান! রোগীদের ছুঁলেই রোগ হয়ে যাচ্ছে!'

   'তার মানে!' সবিস্ময়ে সবাই বাঁদরের দিকে তাকায়। 

   'অত ডিটেলে বলতে পারব না। টিভি দ্যাখ, সোশ্যাল মিডিয়ায় থাক, সব জানতে পারবি। তবে এটুকু বলতে পারি, বড্ড বাড় বেড়েছিল মানুষগুলো। সব লম্ফ ঝম্প বন্ধ হয়ে গেছে! আরে বাবা, পৃথিবীটা কি শুধু তোদের একার! আমাদের কোনো অধিকার নেই এখানে? যা খুশি তাই করবি! বন কেটে সাফ করে দিবি! নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে স্রোতের গলা টিপে ধরবি! খনিজ তোলার নামে পৃথিবীকে ঝাঁঝরা করবি ...!'

   এবার কাঠবেড়ালি পিয়ারা গাছের ডালে ওঠানামা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। গলা ছেড়ে বলে, 'শুধু কি তাই! নিজেরাও একটু শান্তিতে কাটাতে শেখেনি। সবাই সবাইকে অ্যাটম বম্ব মেরে উড়িয়ে দেবার রোয়াব দেখাচ্ছে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে জমির আটন আগলাচ্ছে। ধম্ম ধম্ম করে পরস্পরকে ঘেন্না করছে!…'  

   খরগোশও ততক্ষণে তার মর্নিং ওয়াকে যতি টেনেছে। দুহাত জোড় করে বলে, 'অভয় দেন তো আমিও দু কথা কই!  মানুষের মধ্যে কেন যে  এত লোভ কিছুতেই বুঝতে পারি না! একদল শুধু ফূর্তিতে কাটাবে, আর একদলের জীবনে দুবেলা দুমুঠো অন্নও জুটবে না! এরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিশাল বিশাল মূর্তি বানাবে, স্কুল কলেজ তৈরি করবে না। বড় বড় মন্দির মসজিদ গির্জায় কালো টাকার পাহাড় বানাবে, হসপিটালের সংখ্যা বাড়াবে না! কোটি কোটি টাকার অস্ত্র কিনবে, সচেতনতা বাড়াতে, কুসংস্কার দূর করতে এক পয়সা খরচ করবে না! ভাবা যায় কি বুদ্ধু আর ভয়ংকর…' 

   সবাই ঘাড় নেড়ে স্বীকার করে খরগোশের কথা। 

   শেষ কথা বলে বাঁদর। 'দেখো, এই কদিনে এদের যদি একটু শিক্ষা হয়! বুঝতে পারে, হিংসা বিদ্বেষ ছড়িয়ে কখনোই শান্তি পাওয়া যায় না! শাঁখে ফু দিয়ে, ঘণ্টা বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না! তার জন্য চাই বিজ্ঞানীর কঠিন সাধনা!....' 

   বেলা গড়িয়ে প্রায় দুপুর হতে চলল। তাই সবার বাড়ি ফেরার তাড়া। হাতঘড়ি দেখার ধুম। টিয়া বলল, 'আজ এইটুকুই থাক। পারলে বিকেলে সবাই এসো। আবার আলোচনা শুরু করা যাবে। আমরা তো আর লক ডাউন বা কার্ফুর আওতায় পড়ি না! তাই আড্ডা দিলে মহাভারত, কোরআন, বাইবেল কোনোটাই অশুদ্ধ হবে না।' 

   পশু পাখি কীট পতঙ্গরা মানুষের মতো হৃদয়হীন নয়! তাদের জন্যে মানুষ সেভাবে না ভাবলেও, মানুষের জন্যে তারা ভাবে। তাই প্রত্যেকের মন আজ বিষন্ন, ভারাক্রান্ত। ধীর পায়ে সবাই বাড়ির পথ ধরে।
pallabkumarparui@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment