ছবি : ইন্টারনেট |
শ্যাডোগ্রাফি
নুজহাত ইসলাম নৌশিন
পৌষের তীব্র শীতে মানুষ ঘামে না। তবে ঘাম ঝরানোর মতো খবর হলে রাত তিনটা একুশে ঘামতেই হয়। সেই সাথে ভয় পাওয়াটা ও অন্যায় হবে না তেমন।
রাসেল দুইটা ত্রিশে নুসরার ঘুম ভাঙিয়ে পৌষ শীতে ঘাম ঝরানো খবরটা দিলো। এই খবর যদি দুপুর দুইটা ত্রিশে দিত তাহলে মোটেই এত ভয় লাগত না। ঘাম ও ঝরত না। রাতের এই একটা ব্যাপার অল্পতেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভয় লাগে।
পানির গ্লাসটা চার্জ শেষ হওয়া ফোনের আবছা আলোতে কোনমতে হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়েও রেখে দিল টেবিলে। বিছানার সাথে লাগোয়া টেবিল বলে রক্ষে, নয়তো এই অন্ধকারে হেঁটে ডাইনিং অবধি যাওয়া অসম্ভব। টুকটাক সব পড়ার টেবিলেই ফেলে রাখে।
ফেলে রাখা শব্দটাই যুৎসই। যেমন ফেলে রেখেছিল সাদিবকে। টেবিলে সাদিবের দেওয়া মরচে ধরা আংটি পড়ে আছে। এটা কে এখনি ফেলে দিতে হবে। না,মরচে ধরা বলে নয়। মাত্র যার আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে এবং তার সাথে ভালোই বিশেষ অন্তরঙ্গ সম্পর্ক – তার জিনিস নিজের টেবিলে রাখা মানে –
রাতটা শেষ হবে কখন – দ্বিতীয় বারের মতো গ্লাস হাতে নিয়ে নামিয়ে রাখল। পানি খেলেই তো বাথরুম চাপবে। এই শীতে – না, ভয়ে বাথরুম অবধি গিয়ে তার ভেতরের দরজা লাগানো সম্ভব হবে না। ওফ্ফ –
তিনটা একত্রিশ! রেডিয়াম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নুসরা হতাশ হলো। মাত্র দশ মিনিট গেলো। ভয়াবহ বিপদে সময় কি থমকে যায় নাকি! আর বিপদের খবর গুলো কেন রাতেই আসা লাগে? অন্ধকার মানেই কি বিপদ ডেকে আনা – মাথার শিরা দপদপ করছে। পেট গুলিয়ে বমি আসছে।
সাদিব! মৃত। এরচেয়ে বড় পরিচয় আর কি হতে পারে – শেষ কথা হয়েছিল তিনমাস আগে, এক গুমোট দুপুরে। তাদের ব্যক্তিগত ঝগড়ার চেয়ে আশেপাশের মানুষ নিয়েই ঝামেলা হতো বেশি। কোন অনা না কি নামে একটা মেয়ে এসেছে – সে ক্যাম্পাসে কেন ওড়না পরে ঘুরে না তা নিয়ে তর্কের শুরু এবং শেষে নুসরা সিদ্ধান্ত দেয়, “ তোর শালা চরিত্রই খারাপ... “ তিন মাস আগে গুমোট দুপুরে এই কথাটাই ছিল শেষ কথা।
নুসরা ফোন হাতে নিল। ম্যাসেঞ্জারে টুংটাং শব্দে রাতের নিরবতা একটু পর পর ভাঙছে ।চেনা – অর্ধ চেনা সবার এক জিজ্ঞেসা সাদিব কেন মরল? ব্রেকাপ? না, আরো কিছু!
সতের পারসেন্ট চার্জ নিয়ে সবার উত্তর দেওয়া সম্ভব না। উচিত ও না। প্রেম ভাঙনের তিন মাস সে সত্যি কোনো খবর রাখেনি সাদিবের। তার নিজের বাসায়ই চলছে হরদম অশান্তি, তার বাবা সেদিন রাগে তার মাকে দুই তালাক দিয়েছে – ব্যাপারটা এমন কারো সাথে শেয়ার করার ও উপায় নাই। কি বলবে মানুষকে, আমার বাবা রাগে আমার মাকে দুই তালাক দিয়েছে, তাদের বিয়ে কি এখনো বৈধ?
নুসরার জানামতে তিনতালাক দিলে বিয়ে ভাঙে – যেহেতু দুই, সেহেতু আপাতত ওটা নিয়ে না ভাবলেও চলবে।
সাদিব আর যেমনই ছিলো, কিন্তু সুইসাইড করার মতো ছিল না। মরল তো মরলই, নুসরাকে দায়ী বানিয়ে মরল হয়তো । দুনিয়া শুদ্ধ মানুষ তো দাবি করবে – নুসরা দায়ী এর জন্য। কোনো খবরের কাগজে হয়ত নিউজ পর্যন্ত বের হতে পারে, ‘ ছলনাময়ী নুসরা ধ্বংস করল যুবকের স্বপ্ন। “ এর কারণে হবু ডাক্তারের সাথে বিয়েটা যদি ভাঙে, বাজে একটা অবস্থার সৃষ্টি হবে। শালা, সব ডুবিয়ে দিল মনে হচ্ছে।
জানালার বাইরে একটা নালার মতো ড্রেন আছে, এই কনকনে শীতে জানালাটা খোলে ড্রেনে আংটিটা ছুঁড়ে দিল। শীতের ভয়ের চেয়ে, নিজেকে রক্ষা করা এখন বেশি দরকার।
কাপুরুষ একটা। ঘড়ির দিকে চতুর্থ বারের মতো তাকিয়ে বিড় বিড় করে ‘কাপুরুষ’ শব্দটা কয়েকবার উচ্চারণ করল।
ভাঙন তো একদিনে ধরেনি। ধীরে ধীরে শুরু হয়ে একদিন দেখা গেল সম্পর্কটা নামেই খোলস ভেতরটায় কিচ্ছু নেই। মুক্তিটা নুসরার বেশি রকম দরকার ছিল, চার বছরের প্রেম – অথচ প্রকাশ করার মুরোদ নেই। আর শরীর তো আছেই, এটাই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা লাগত। প্রথম প্রথম যা স্বপ্ন মনে হতো তা ধীরে ধীরে দুঃস্বপ্ন আর আতঙ্কে রূপ নিচ্ছিল।
সত্যি বলতে সাদিবের মৃত্যুতে একটুও খারাপ লাগছে না। বরং বুক থেকে ভারী পাথর নেমে গেছে। সে চাইছিল সাকিব দূরে সরে যাক, কিন্তু দশ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ুক তাও চায়নি।
টুংটাং – রাসেলের ম্যাসেজ।
দোস্ত, তুই সেফ জোন।
নুসরা চোখবুঁজে কিছুক্ষণ ভাবল। নাহ্, মরার আগে নুসরাকে অন্তত তাহলে ফাঁসিয়ে যায়নি। বেচারা সাদিব, এই ব্যাপারটা নিজেও খুব ভয় পেত, কেউ পিছনে মেয়েবাজ বলে কি না, অথচ নারী শরীরের প্রতি কী তীব্র লোভ কিন্তু পাওয়ার যোগ্যতা ছিল না।
নারী শরীর পাওয়ার মতো চেহারা, অর্থ কোনটাই ঠিকমতো সাদিবের ছিল না। আহা, মৃত সাদিবের জন্য বেশ করুণাই লাগছে। কিছু একটা পোস্ট করা দরকার, কি লেখা যায় - “ অসময়ে কি অভিমানে চলে গেলে। আবারো ঝরে গেল একটি তরুণ স্বপ্ন। “
ভোরের বাতাসের মৃদু ঝলক মুখ, গালে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সারা রাত জাগার ক্লান্তি ধীরে ধীরে বশ মানা কুকুরের মতো ঝিমিয়ে পড়ছে। এক জনের মৃত্যুতে যদি বাকি জীবন নিশ্চিত থাকা যায় তাতে ক্ষতি নেই তেমন।
বেঁচে থাকার জন্য যোগ্যতা লাগে, সে যোগ্যতাটাই বেচারার ছিল না। আহারে।
No comments:
Post a Comment