1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

ফেসবুকের বান্ধবী

 

ছবি  : ইন্টারনেট 
ফেসবুকের বান্ধবী
ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়


        রোজ সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে মেলটা একবার চেক করা চাই সন্দীপের। নাহলে যেন সারাদিনের খাওয়া হজম হয় না। এরপর একে একে খুলবে ফেসবুক, টুইটার এসব। আজও খুলেছে। একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। ফেসবুক থেকে। এই রিকোয়েস্ট এসেছে একটা মেয়ের কাছ থেকে। ছবিটা বিশেষ আকর্ষণীয় নয়। তাছাড়া আকারেও বেশ ছোট হওয়ায় কিছু তেমন আন্দাজ করা যাচ্ছে না। আন্দাজ মানে সৌন্দর্যের আন্দাজ আর কি।

ফ্রেন্ডের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। সন্দীপ জানে এরা কেউ ফ্রেন্ড নয়। সব ভুসিমাল। এর অর্ধেক হয়ত ভুয়ো। ফেসবুকে ভাষায় ফেক। এমন কি এরা টাইম লাইনেও আসে না। অনেকে আবার গভীর রাতে নেটে কাজ করার সময় কিড়িং কিড়িং করে মেসেঞ্জারের ঘন্টি বাজিয়ে বিরক্ত করে।

এদের মধ্যেই কারোর কারোর আবার ফ্রেন্ডের সংখ্যাটা তিন হাজার চার হাজার বা তারও বেশি। তাতে খুব গর্বিত তারা। সত্যিই তো এক জীবনে কয়েক হাজার বন্ধু পাওয়াটা তো শুধু স্বপ্নের নয় কারোর কারোর আবার দুঃস্বপ্ন। মাঝরাতে মেসেঞ্জারের ঘন্টি বাজানোর মতই দুঃস্বপ্ন।

আবার অনেকের বন্ধুর থেকে ফলোয়ারের সংখ্যা বেশি। যার যত বেশি ফলোয়ার তার তত বেশি গর্ব। ফলোয়ার মানে তো ফ্যান মানে ভক্তিতে যারা গদগদ হয়। কিন্তু ফলোয়ার একটাও নেই সন্দীপের। ফেসবুকে সেই অপশন রাখে নি সে।

তাছাড়া ফ্যান রেখে কি হবে? এমন কিছু কৃতি পুরুষ নয় সে। শিল্পী, কবি, নাট্যকার, অভিনেতা এসব তো কিছু নয় যে তার গুণ গাইবার জন্যে লোক খুঁজতে হবে। মাঝে মাঝে দু এক কলি গান গাইতে পারে এই যা। মাঝারি মাপের একটা চাকুরে মাত্র। তার ফ্যান বলতে অফিসের বাইক রাখার গ্যারেজের ছেলেটা। মাঝে মধ্যে তার গুণ গেয়ে একটা হাত দিয়ে আর একটা হাত চুলকোয়। খুব খুশি হয়ে কুড়ি তিরিশ বা পঞ্চাশ টাকা দিয়েও দেয়। তার এই গুণ গাওয়ার একটি মাত্র লোক যেন বিগড়ে না যায়। তা দুধের বদলে ঘোলের স্বাদ অনেক সময় মন্দ হয় না যখন দুধ তেমন পাওয়া যায় না। তাই ফেসবুকে একটু পা ফেলা আর কি। খুব চলতি একটা কারণে ‘টাইম পাস’।

অন্য অনেকেই মতই মেয়েদের কাছ থেকে রিকোয়েস্ট পেলে সে খুব খুশি হয়। হাজার হলেও রক্তমাংসের মানুষ তো। আর একেবারে তিরিশ বছরের তরতাজা যুবক। রোজ আয়নায় নিজের খোলা শরীর নিজেই দেখে মুগ্ধ হয়। আর হাঁ হুতাশ করে এই ভেবে যে অন্যকে মুগ্ধ করার মত কেউ জোটে নি এখনও পর্যন্ত।

অনামিকা দস্তিদার। নামটা ছদ্ম সেটা নামই বলে দিচ্ছে। এটাও হয়ত ফেসবুকের আশিভাগ ভুয়ো আইডির একটা। অনেকেই তো ছদ্ম নামে আইডি খোলে স্রেফ মজা করার জন্যে। বা অন্যকে হ্যানস্থা করার জন্যে। সামনা সামনি যার সঙ্গে খারাপ কিছু করা যায় না তার সঙ্গে এই ফেক আইডির সাহায্যে তাকে নাস্তানাবুদ করা যায়। অনেক অশ্লীলতা, অনেক নোংরামী হয় তা কাগজে পড়েছে বা টিভিতে দেখেছে।

মেয়েটির প্রোফাইল খুলল। ছবিটা এখানে একটু বড়। তবে খুব অস্পষ্ট। যেন ইচ্ছে করেই এটা এমন করা হয়েছে। হয়ত এই মেয়েটি তার খুব চেনা লোকের কাছ থেকে ফেসবুকে নিজেকে লুকোতে চাইছে তাই এমন অস্পষ্ট ছবি দিয়েছে।

ছবিটা দেখে খুব একটা খুশি হল না সন্দীপ। মেয়েটি শুধু অসুন্দরই নয় বরং কুৎসিত বলা চলে অনায়াসে। সন্দীপের অনেক সুন্দরী বান্ধবী আছে। আশা তার ম্যাট্রিমনিয়াল কালামে লেখা সিঙ্গেল কথাটা দেখে কোনও সুন্দরী যদি তার প্রেমে পড়ে। এ তো অনেকেই করে। এতে আর দোষ কোথায়? ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে গিয়ে মেয়ে খুঁজলেই যে সঠিক পছন্দের মেয়ে পাওয়া যাবে আর ফেসবুকে খুঁজলে তা পাওয়া যাবে না কেন? 

ফেসবুকের আশিভাগ ইনফরমেশনের মত আশিভাগ ছবিও তো ভুয়ো হয়। কেউ গাছপালা, ফুলফল, পশুপাখী দিচ্ছে তো কেউ দিচ্ছে বড় বড় সিনেমা আর্টিস্ট আবার কেউ অবলীলায় দিচ্ছে মহাপুরুষদের ছবি। তবে কেউ নিজের ছবি এমন বিদিকিচ্ছিরি করে বসিয়েছে এটা সে এই প্রথম দেখল। তবে এতে মনে হচ্ছে মেয়েটা সৎ। তার দেওয়া তথ্যগুলোর ওপর ভরসা করা চলে।

ছবি নিয়ে গবেষণা করার পর মেয়েটির প্রোফাইলে মন দিল। লেখাপড়া? লবডংকা। মাধ্যমিক পাশ। ঠিকানা নেই। নেই ফোন নম্বর। ধরতে গেলে কিচ্ছু নেই। তবু শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে মাধ্যমিক পাশ খবরটা ঘটা করে কেন দিল সেটা বুঝতে পারল না। কেউ তো সচরাচর দেয় না। তবে সন্দীপ দিয়েছে।

তবু রিকোয়েস্টটা গ্রহণ করে নিল সন্দীপ। একে নিয়ে প্রেম করা না গেলেও মজা তো করা যাবে। ডিনারের পর এক দেড় ঘন্টা বেশ কাটবে খুশিতে। মুর্গি জবাইতে কি কম আনন্দ পাওয়া যায় নাকি?

বন্ধুর সংখ্যা মাত্র ছটা অনামিকার। সবকটা মেয়ে। সন্দীপকে নিয়ে তার মোট বন্ধুর সংখ্যা হল সাকুল্যে সাত। ফ্রেন্ড লিস্ট লক করা নেই। প্রাইভেসির জাঁতাকলে আটকানো নেই। টাইম লাইন দিব্বি খোলা। অনামিকার নিজের পোস্ট খুব কম। যে কটা আছে সব শেয়ার করা। কিন্তু বাকি সব বন্ধুরা উজাড় করে তাদের বান্ধবীর টাইম লাইন ভরিয়ে দিয়েছে। সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চারটে কলি লিখে দিল সন্দীপ। নে ঠেলা সামলা। তুই রবীন্দ্রসঙ্গীত বুঝিস কি বুঝিস না সে পরীক্ষা হয়ে যাবে। তবে সে রকম সাংস্কৃতিক সাংস্কৃতিক চেহারা তো নয় মেয়েটার। গানের বোঝদার মেয়েদের একটা বিশেষ আলাদা চেহারা হয় এই ধারণাই পোষণ করে সন্দীপ।

পরের দিন ভুলেই গেছে অনামিকাকে। মনের রাখার মত তো ওর প্রোফাইলে তেমন কিছু নেই। ফেসবুকে অন্য বন্ধুদের নিয়ে মেতে আছে এমন সময় একটা নোটিফিকেশন এলঃ অনামিকা রিপ্লায়েড টু ইওর পোস্ট ইন হার টাইম লাইন।  অনামিক গতকাল তার করা পোস্টের একটা জবাব দিয়েছে।

পাতা উলটে তার পাতায় গেল সন্দীপ। দেখল তার লেখা গানের কলির উত্তরে অনামিকা একটা নজরুল গীতি কটা কলি লিখে দিয়েছে। আর ভারি সুন্দর সে গানটা। জনপ্রিয় তো বটেই আবার বহুল প্রচলিতও বটে। সন্দীপও সময় পেলেই সেটা মাঝে মাঝে গুনগুন করে গায়।

তার উত্তরে সন্দীপ লিখলঃ গান জানো দেখছি।

খানিক পরেই অনামিকা লিখলঃ তুমি কি ভেবেছিলে?

উত্তর আর দিল না সন্দীপ। ঐ তো চেহারা মেয়েটার। দু কলি গান জানে তাতে আর কি এমন মাথা কিনে নিয়েছে?

অন্য পাতায় চলে গেল। মশগুল হয়ে রইল অন্য বন্ধুদের সঙ্গে। সুপ্রিয়া, বাসন্তী, কাকলি, নীলিমা, প্রশান্ত, রঞ্জিত, বাপ্পা, আগুনের পরশ এই সব। এদের কেউ পোস্ট করেছে ছবি, কেউ জানিয়েছে তাদের বেড়াবার খবর, কেউ বাড়ির কারো বিয়ের ছবি আবার কারোর বা অন্নপ্রাশনের।

শেষ রাত্রে ঘুম ভাঙ্গল। হঠাৎ মনে হল ইস কাল তো অনামিকার উত্তরটা দেওয়া হয় নি। কিছু মনে করল নাকি? উঠতে গিয়েও উঠল না। অত মাতামাতি ভাল নয়। এমন করলে পেয়ে বসবে আর নয় ভাববে তার কোনও মতলব আছে।

কিন্তু একটা তাড়না তাকে সকাল সাতটায় ফেসবুক খোলার দিকে নিয়ে গেল। দেখল একটা মেল এসেছে তার চ্যাট বক্সে। সময় দেখল গতকাল রাত সাড়ে তিনটের সময় করা। ভাবল কি বেহায়া মেয়ে। এমনটা সে করলে হয়ত স্ক্রিন শট টাইম লাইনে দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিয়ে তার মানহানি করত।

মেসেজ বক্সে কিন্তু অনামিকা কিছু লেখে নি। শুধু একটা লিংক দিয়েছে। লিংক বেয়ে গিয়ে পৌঁছল ফেসবুকে অনামিকার টাইম লাইনে। গতকাল তার পোস্টের উত্তরে মেয়েটা আবার লিখেছেঃ আমার মত অসুন্দর মেয়ের কথার আর কেই বা জবাব দেয়। গানটা কি নজরুলের  বলে ভাল লাগে নি?

ভাষাটা কেমন যেন অভিমানের। হয়ত সন্দীপের উত্তর না পাওয়ার জন্যেই এই অভিমান। একটু অপরাধ বোধ তাকে পেয়ে বসল। ইস সত্যিই তো সে সুন্দর নয় বলেই উত্তর না পেয়ে এমন অভিমান।

মেয়েটা ঝগড়া করতে চাইছে। সে ভাব করতে চাইল। টাইম লাইনে নয় মেসেজ বক্সে লিখলঃ আমি নজরুল গীতিও খুব ভালবাসি। 

একটু পরেই উত্তর এলঃ তাই বুঝি?

এপাশ থেকে সন্দীপ লিখলঃ আচ্ছা প্রোফাইল পিকচারটা তোমার নিজের নাকি অন্য কারোর?

এর কোনও উত্তর নেই। মিনিট দুয়েক পরে ঘন্টা বাজিয়ে মেসেজ এলঃ দেখতে খারাপ বলে অন্য কারোর ভাল ছবি লাগাব আমি এমন বাজে মেয়ে নয়। জানি আমি বাজে দেখতে। তবে তুমি বন্ধু করলে কেন?

লজ্জা পেল সন্দীপ। লিখলঃ আরে না না তা নয়। আমি এমনি জিজ্ঞেস করেছি।

ওপার থেকে লেখা ছুটে এলঃ বন্ধুই তো বৌ তো আর নয়। এত খোঁজ নিচ্ছ কেন?

বাপরে কি কথার ঝাঁঝ। যেমন বিচ্ছিরি দেখতে তেমন বদখচ মেজাজ। স্টাইলটা একবার দেখ। দুদিন ভয়ে ফেসবুক খুলল না। কি জানি কি মেসেজ আবার পাঠিয়েছে কে জানে।  আবার মেজাজ হারিয়ে তার উত্তরে সন্দীপ কড়া করে যদি কিছু লিখে ফেলে? তার চেয়ে এই ঝঞ্ঝাট না রাখাই ভাল। আনফ্রেন্ড করে দেওয়াই মঙ্গলের। সেটা করতে গেলে তো ফেসবুক খুলতেই হয়। খুলেই চলে গেল অনামিকার পাতায়।  তখন রাত সাড়ে তিনটে। অনামিকা আধঘন্টা আগে স্ট্যাটাস দিয়েছেঃ কেন যে ঘুম আসে না কে জানে।

হাত নিসপিস করতে লাগল কিছু লেখার জন্যে। কিন্তু এত রাতে একটা মেয়ের স্ট্যাটাসের উত্তরে কিছু লেখাটা তেমন ভদ্রতা হবে বলে মনে হয়। কিন্তু কিছু লেখার জন্যে ছটফট করতে লাগল সে। শুধু কিছু লেখার নয় একটা দুষ্টুমী করার জন্যেও অস্থির হয়ে উঠল। লিখব কি লিখব না করতে করতে লিখেই ফেললঃ এসব আজেবাজে চিন্তা ছাড়লেই তো হয়?

ফেসবুক বন্ধ করে মোবাইল বন্ধ করে দিল সন্দীপ। কে জানে মেয়েটা রেগে গিয়ে আবার কি লিখবে। চিন্তা নিয়ে কিছুক্ষণ জেগে থাকার পর ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন সাতটায় ফেসবুক খুলল। উত্তর কি লিখেছে তা দেখতে কৌতূহলী হল। কিন্তু কিছুই লেখে নি সে। একটা কথা লেখার ইচ্ছে তার প্রবল হল। কিন্তু এটা তো খোলা টাইম লাইনে লেখা ঠিক নয়। তাই সে মেসেজ বক্সে লিখলঃ কাল রাতে কেমন ঘুম হল?

সঙ্গে সঙ্গে অনামিকা উত্তর দিলঃ তোমার যেমন হল।

আরে মেয়েটিকে যত বোকা ভেবেছিল ততটা বোকা তো সে নয়। কাল রাতে সন্দীপ যে জেগেছিল সেটা কেমন করে টের পেল মেয়েটা? তারপর ভাবল বোকা তো সে ই। রাত সাড়ে তিনটের সময় টাইম লাইনে লেখা মন্তব্যের পাশে যে সময়টাও লিখে দেয় ফেসবুক। ভাবল বাবা ফেসবুকে তো কোনও কিছুই গোপন থাকে না দেখছি। একটু ভয় হল মনে। রাত সাড়ে তিনটের সময় লেখা মন্তব্যের জন্যে মেয়েটি যদি কমপ্লেন করে দেয়?

ভয়ে ফেসবুক বন্ধ করে দিল। এ মেয়ে তো খুব বিপজ্জনক। একে নিয়ে তো কোনও মজা করা যাবে না। বড্ড চাঁচাছোলা স্বভাবের। মজা কিছু বোঝে বলে তো মনে হয় না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা কথাও মনে এল। রবীন্দ্র-নজরুল গানের ভক্ত কেউ কি এমন বেরসিক কাঠখোট্টা হতে পারে?  

পরের দিন রাত্রে অভ্যাস বশে অনামিকার পাতাটা খুলল। তেমন কিছু নেই। অন্য কয়েকটা বান্ধবী কি ছাইপাঁশ শেয়ার করেছে হাবিজাবি। ধুস! অন্য পাতায় মন দিল। কয়েকটা মেসেজ ছিল। একজন আবার তার অফিসের স্টাফ এ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি। জরুরী মিটিং-এর চিঠি। সেটাতে মনোনিবেশ করতেই হল।

কিন্তু করা গেল না। অনামিকার মেসেজের নোটিশ যেন ছুটে এল পর্দায়। ভাবল দরকারী মেসেজ পড়ার অছিলায় ওটাকে কাটিয়ে দেবে। কিন্তু ওই যে বলে কৌতূহল বাঁধ মানে না। অনামিকার মেসেজ খুলল সে।

-বোকা হাঁদারাম একটা।

ব্যাস আর কিছু নয়। নিতান্ত বেরসিক একটা মেসেজ। বিরক্ত হল সন্দীপ। গেঁয়ো ভূত কোথাকার। ফেসবুকে একাউন্ট খোলার শখ কত। অথচ সহবত জানে না।

আবার সেক্রেটারির মেসেজে মন দিল। পরশু বিকেলে মিটিং। তার ওপর কিছু ডোনেশন তোলার ভার দিয়েছে সেক্রেটারি। চাকরি যারা করে এ ঝামেলা তো তাদের নিতেই হয়।

পড়া শেষ করে কমপিউটার বন্ধ করতে যাবে এমন সময় অনামিকার লেখা কয়েকদিন আগের একটা স্ট্যাটাসের কথা মনে পড়ল। গভীর রাতে অনামিকা লিখেছিলঃ আমার ছবি সবাই সবাই উলটে দেখে- আমার কিনা যাচাই করে। কিন্তু আমার মেসেজ কেউ পড়ে না।

তার নিচে তার অন্য বন্ধুরা নানা কমেন্ট লিখেছে। নানা মুখরোচক কমেন্ট। কিন্তু সন্দীপ বুঝল এই স্ট্যাটাসের লক্ষ সে নিজে। কারণ সে অনামিকার ছবিটা তার নিজের কিনা জিজ্ঞেস করেছিল। এই পাঁচদিনে পঞ্চাশ জন বান্ধবী হয়েছে অনামিকার। তারাই কমেন্ট করেছে। কেউ দিয়েছে সান্ত্বনা তো কেউ করেছে রসিকতা। একজন মজা করে লিখেছেঃ ছবির কন্ট্র্যাস্ট একটু বাড়া। তবে তো হৃদয়ের গভীরতা বোঝা যাবে।

এটাতে হাসির রিয়াকশন দিয়েছে অন্তত দশজন। হঠাৎ বেশ রাগ হয়ে গেল সন্দীপের। খোলা টাইম লাইনে এমন স্ট্যাটাস কেউ দেয়? কেন মেসেজ বক্সে শুধু তাকে এটা মেসেজ করতে পারত না? এই সময় কত আবাগময় উত্তর তার মাথায় আসছে। ইস মেয়েটাকে চালাক ভেবেছিল এখন তো বিরাট বোকা মনে হচ্ছে। একটু প্রেম করতে কি দোষ? সব প্রেম কি প্রেম হয় নাকি নিয়ে যেতে পারে রেজিস্ট্রি অফিসে? তবু একটু মজায় দোষ কি?

বেশ রাগ হল তার। আর অভিমানও। হয়ত মেয়েটিরও অভিমান হয়েছে। ওই স্ট্যাটাসের উত্তরে কিছু সহানুভূতি তো সে নিজেও জানাতে পারত নাকি? তার প্রতি সন্দীপের কি অনুভব সে তো বোঝাতে পারত?

নিজের মনের মধ্যে সন্দীপ একটু ছটফট করতে থাকে। এটাকে তার যেন প্রেমের আগের পর্ব বলে মনে হতে থাকে আর এই অনুভূতিতে মনে একটা রোমাঞ্চ বোধ করতে থাকে। কেমন যেন গায়ে একটা কাঁটা দেওয়া পুলক। দেখতে ভাল হলেই কি প্রেম হয়? প্রেম কি দেহের সঙ্গে হয় নাকি হয় মনের সঙ্গে। নিজের মনের মধ্যে অসংখ্যবার প্রশ্নগুলো উঁকি পাড়ে আবার মিলিয়ে যায়। কেমন একটা অদ্ভুত অস্থিরতা। সেই সঙ্গে সে ভাবতে থাকে তার সমস্ত বন্ধুদের বৌ কি সুন্দরী? বরং ঠিক উলটো। বেশীর ভাগ তো অসুন্দরী। তবে কি সেই বন্ধুরা এখন অখুশি? প্রেম নেই জীবনে? ডিভোর্সের কথা ভাবছে? কিন্তু ওদের মুখ দেখে তো তেমন কিছু মনে হয় না?

মনটা অস্থির। আজ খুলে বার করল সেই স্ট্যাটাসটা। এতদিনে পনেরটা কমেন্ট জমা পড়ে গেছে বাক্সে। পনেরটা কমেন্টের পরে সে লিখলঃ কটা দিন ব্যস্ত ছিলুম। সময় পাই নি। কিছু মনে কর না বন্ধু।

তার নিজের মনটা এখন আবেগে আর দরদে নরম। লেখায় যেন একটা অনুশোচনার সুর। ভাবল অনামিকা এর পিঠে একটা উত্তর দেবে। কিন্তু দিল না। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করেও এল না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। অনামিকা হয়ত তার ওপর খুব বিরক্ত। দেখতে খারাপ হোক বা ভাল তাকে যখন বন্ধু করেছে তখন তার মনে দুঃখ দেওয়াটা হয়ত সন্দীপের ঠিক হয় নি।

অনেকক্ষণ কোনও উত্তর নেই। ফেসবুক বন্ধ করে দেবে ভাবছে। এমন সময় মেসেজ বক্সে মেসেজ উড়ে এল অনামিকারঃ এত সংকোচ কেন বন্ধু? কাজের ব্যস্ততা ছিল জানতে পেরেছি তো। কাল রাতে আমার ঘুম হয় নি। তোমার হয়েছে তো?

গতকাল রাতে সত্যি ঘুম হয় নি সন্দীপের। একবার ভাবল এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া একটু কঠিন। উত্তর হ্যাঁ হলে অনামিকা ধরে নেবে সন্দীপ সত্যি তার প্রেমে পড়েছে। আর না হলে ধরবে সন্দীপ তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে।

ভাবতে একটু সময় নিল। কারণ হ্যাঁ আর না-এর মাঝামাঝি উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটি আর কোনও কিছু লেখে নি। সন্দীপ ভাবল মেয়েটির মেসেজের উত্তর দিলে ক্ষতি কি? সে লিখলঃ না হয় নি। কিন্তু তোমার কেন হয় নি?

মনে আশা নিয়ে বসে আছে। আশায় বুক ধড়ফড় করছে। অনামিকা নিশ্চয় এর পরে লিখবেঃ ঘুম হবে কি করে? তোমার কথাই ভাবছিলুম যে।

সারা গায়ে একটা অসম্ভব রকমের পুলক মিশ্রিত শিহরণ। অনামিকার এখনও না লেখা মেসেজটার কি উত্তর দেবে সেটা সে ভাবছে তন্ময় হয়ে। এমন সময় অনামিকার মেসেজ আবার উড়ে এলঃ আমার স্পন্ডিলাইসিস আছে ঘাড়ে। রাতে বড্ড কষ্ট দেয়। ঘুম কি করে দেবে গো?

উত্তরের প্রথমাংশ আর শেষের ওই ‘গো’ সুরের আন্তরিকতার ইঙ্গিতে মিশ্র অনুভূতি হল সন্দীপের। উত্তরের প্রথম দিক হতাশা জাগালেও শেষের এই ‘গো’ ডাকটা বেশ মিষ্টি লাগল। এমন ভাবে ডাকে কে? বৌ আর নয়ত প্রেমিকা।

শরীরটায় একটা ঝড়ের ইঙ্গিত। হতাশা আর আশার দোদুল্যমানতা। শেষে হতাশাটা মিশে গেল সহানুভূতিতে। ছিঃ এত স্বার্থপর কি করে হয়ে গেল সন্দীপের মত এক শিক্ষিত চাকুরে? বন্ধুর এত বড় অসুখের খবরেও প্রত্যুত্তরে কিছুই বলবে না সে?

লিখলঃ এটা তো ভাল কথা নয় বন্ধু। ভাল করে ডাক্তার দেখাও। আমার একজন ডাক্তার বন্ধু আছে। ঠিকানা বা ফোন নম্বর পেলে তার সন্ধান দিতে পারি।

অনামিকা লিখলঃ ধন্যবাদ।

আর কিছু লিখল না। সবুজ আলো নিভে গেল। সন্দীপ ভাবল আর অপেক্ষা কিসের জন্যে?

পরের দিন অনামিকার দিক থেকে কোনও মেসেজ নেই। তার পাতা খুলে দেখল টাইম লাইনে কোনও পোস্ট নেই। অন্যের শেয়ার করা বা ট্যাগ করা কিছু হাবিজাবি পোস্ট।

মনে চিন্তা ঢুকল। মেয়েটা অসুস্থ নাকি? ঘাড়ের ব্যাথা কি খুব বেড়েছে? ইস ডাক্তারের ঠিকানাটা মেসেজে লিখে দিলেই হত। ভাবতে ভাবতেই ফেসবুক আবার খুলল সে। কিন্তু খুলতে না খুলতেই পেটটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে এল। সেই সঙ্গে প্রচন্ড জ্বালা। কদিন ধরেই জ্বালাটা টের পাচ্ছে তবে গা দেয় নি। ডাক্তারের কাছে যায়ও নি।

চেয়ার থেকে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। কোনোমতে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই প্রচন্ড বেগ। ভীষণ লুজ মোশন। সারা রাত ধরেই হল। ছুটে এল ভাইপো, দাদা, বৌদি। কিন্তু এত রাতে ডাক্তার কোথায় পায়। দাদা মোবাইল নিয়ে বলল, অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করছি। হাসপাতালে নিয়ে যাই চল। রাত সাড়ে চারটের সময় বেগ একটু ধরল। সন্দীপ বলল, এখন থাক কাল সকালেই ডাঃ সেনগুপ্তর কাছে গেলেই হবে।

ডাক্তার সেনগুপ্তকে ফোন করতে তিনি পাঠিয়ে দিলেন নার্সিং হোমে। লক্ষণ দেখে খারাপ বলেই মনে হচ্ছে। অনেক পরীক্ষা করাতে হবে। তাই নার্সিং হোমই সবচেয়ে ভাল।

নার্সিং হোমে এন্ডোস্কোপি করে দেখা গেল স্টম্যাকের আলসার এতদিনে পূর্ণতা লাভ করেছে। তবে চিন্তার কিছু নেই। এখন কিছুদিন নার্সিং হোমে ওষুধ আর যত্নে থাক। পরে অপারেশন করিয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে। 

দিন দশেক পরে বাড়ি ফিরে একটু ফেসবুক খুলতে ইচ্ছে করল। মেল চেক করা তার প্রথম কাজ। এতদিন নার্সিং হোমে তাকে মোবাইল ব্যাবহার করতে দেওয়া হয় নি। দেখল অনেক মেল জমে আছে। যেমন গুগলি মেল তেমনি ফেসবুকের মেসেজ।

তা অন্তত গোটা কুড়ির ওপর মেসেজ। বেশির ভাগ তো ধানাই পানাই। স্ক্রল করতে করতে অনামিকার বাক্সে গিয়ে থামল। তা মেসেজ নেহাত কম নয়। প্রত্যেকটা মেসেজেই তার শরীর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মেয়েটা। আশ্চর্য তার দীর্ঘ অনুপস্থিতি যে সাধারণ কারণ না হয়ে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে ঠিক ধরেছে মেয়েটা। বেশ ভাল লাগল। অচেনা একজন তার শারীরিক দুরবস্থার জন্যে দুশ্চিন্তা করছে এটা ভাবতে বেশ তৃপ্তি আসে।

এবার কিন্তু আর চাঁচাছোলা ভাবে নয়। বেশ সুন্দর করে প্রথমে তার শরীর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার জন্যে ধন্যবাদ দিল অনামিকাকে। তারপর তার রোগ আর তার চিকিৎসার বিষয়ে বিস্তারিত বলল। শেষে লিখলঃ এখন ভাল আছি বন্ধু। তুমি আর উদ্বিগ্ন থেক না।

একটা মেলে অনামিকা জানিয়েছে ফেসবুকে সন্দীপের প্রোফাইল থেকে পাওয়া মোবাইল নম্বরে অনেক বার সে ফোন করেছে। কিন্তু পায় নি। পাবে কি করে সুইচ অফ করা ছিল যে। একটু ভাল হতে তাকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল বটে তবে সে ধরে নি অজানা নম্বর বলে।

ভাগ্য ভাল যে এই নম্বরগুলো সব একই আর ল্যান্ড ফোনের। তার মানে ডাইরেক্টরি থেকে মালিকের ঠিকানা বার করা সহজ কাজ। ভাবল আগে তো এই নম্বরে রিং ব্যাক করা যাক। কিন্তু সেই নম্বর থেকেই আবার ফোন এল।

-অনামিকা বলছি। ভাল আছ তো বন্ধু? এখন শরীর সুস্থ আছে তো? ওঃ যা দুশ্চিন্তায় ফেলেছিলে।

কথা বলতে বলতে বলতে সন্দীপ ভাবতে লাগল ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে অনামিকা নাও বলতে পারে। তবে ফোনটা শেষ হলেই সে ডিরেক্টরি দেখে ঠিকানাটা বার করবে। তারপর-

বলল, ভাল আছি বন্ধু। তোমার ঘাড়ের ব্যথাটা কেমন? আমার একজন ডাক্তার বন্ধু আছে। ভাবছি তোমার বাড়িতে নিয়ে যাব।

-আমার বাড়িতে? ঠিকানা পেয়েছ?

সঙ্গে সঙ্গে খিলখিল করে জলতরঙ্গের মত হাসি।

একটু থমকে গেল সন্দীপ, এই নম্বরটা তোমার নয়?

আবার সেই খিলখিলে হাসি। হাসির সঙ্গে গলাটাও বেশ মিষ্টি।

-না বন্ধু না। এটা তো একটা বুথের নম্বর। আমার বাড়ির থেকে অন্তত দেড় কিলোমিটার দূরের। আজকাল বাড়িতে বাড়িতে ল্যান্ড ফোন রাখার চল উঠে গেছে।

চালাকিটা এবার বুঝল সন্দীপ। পাছে ল্যান্ড ফোন থেকে বাড়ির ঠিকানা পাওয়া যায় তাই এই চালাকি। জায়গাটার নাম ডিরেকটরিতে পাওয়া গেলেও দেড় কিলোমিটার ধরে কি কেউ খুঁজতে পারে?

বাপরে বাপ! এই অনামিকাকে আন্ডার এস্টিমেট করেছিল সে? তার সঙ্গে নিছক মজা করবে বলে ফেসবুকে তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করেছিল?

এরপর আবার দিন তিনেক অনুপস্থিত অনামিকা। ফেসবুক থেকে তো বটেই এমন কি ভদ্রতার খাতিরে একবার মেসেজ করেছিল তার কোনও উত্তর দেয় নি। চতুর্থ দিন উত্তর দিল অনামিকা। তবে আবার সেই বুথ থেকেই। ঘাড়ের ব্যথায় বেশ কাতর হয়েছিল সে। তাই ফেসবুক খুলতে পারে নি আর যেতে পারে নি সেই বুথেও। তবে এখন

নিজের মোবাইল থেকে ফোন করে না সে। খুব সতর্ক। তবু বলল, তোমার মোবাইল নম্বরটা কি পাওয়া যায় না?

-কি করবে? আমি এখন সুস্থ আছি তো? আর তুমিও।

হায়রে! নারীর মন চিরকালই অধরা। একটু অভিমান মিশিয়ে বলল, তোমার আর কি। আমি এদিকে চিন্তায় মরি আর কি।

-আমার মত একটা মাধ্যমিক পাশ কুৎসিত মেয়ের জন্যে?

কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই খিলখিলে হাসি। বেশ অপ্রস্তুত হল সন্দীপ। সত্যিই তো এর কোনও উত্তর তো তার কাছে নেই। মনে মনে ভাবল এ সে কি করছে? এখন হয়ত একটা আবেগের বশে সে বলছে। কিন্তু চাক্ষুস দেখা হলে এই আবেগ থাকবে তো? বিশ্বাস ভঙ্গের দায়ে পড়বে না তো? আর মেয়েটাকে দেবে না তো বিশ্বাস ভঙ্গের বেদনা?

খুব বিরক্ত হল সে। রেগে গিয়ে বলল, তোমাকে আমি আনফ্রেন্ড করে দেব।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মেয়েটা তাকে একটা নম্বর বলে দিল। বেশ সতর্ক মেয়ে। মেসেজে লেখে নি নম্বরটা। ফোনে বলেছে। পাছে মেসেজের লেখাটা চিরকালের জন্যে একটা ডকুমেন্ট হয়ে যায়। অনামিকা মুছে দিলেও সন্দীপ যদি না মোছে? আর যদি বা মোছে তবে ফেসবুক বলে তৃতীয় একটা পক্ষের খাতায় যে ধরা থাকবে সেটা চিরকালের জন্যে।

-ভাল থাকলে আজ বিকেল পাঁচটায় এই টাওয়ার ভিউয়ে গিয়ে এই নম্বরে একটা মিস কল দেবে। আর শরীর খারাপ থাকলে যেতে না পারলে সেটাও জানিয়ে দিয়ো প্লিজ।

বলেই কট করে কেটে দিল সেটা। রিং ব্যাক করলেও লাভ নেই। কেউ সাড়া দেবে না।

এ যেন একটা পরীক্ষা। মনে মনে চেয়েছিল একবার দেখা হোক। কিন্তু আবার ভাবে তার মত একজন ফার্স্ট ক্লাস এম-এস-সি পাশ করা ছেলে একটা মাধ্যমিক পাশ করা অসুন্দর মেয়েকে বিয়ে করলে লোকে কি বলবে? আবার ভাবল এতদূর এগিয়ে যাওয়া হয়ত ঠিক হয় নি। মেয়েটার দুর্বলতাকে হয়ত প্রশ্রয় দিয়েছে সে। খুব অন্যায় করেছে। ব্যর্থ হলে মেয়েটা যদি কিছু করে বসে?

সাতপাঁচ ভেবেও সমাধান কিছু হল না। সেদিন রবিবার অফিস বন্ধ। বিকেল পাঁচটায় টাওয়ার ভিউয়ের পাশের রাস্তায় অনামিকার নম্বরে ডায়াল করল। কিন্তু কেউ ধরল না। কিছুক্ষণ পরে আবার করল। এবারও কেউ ধরল না। এ আবার কি অসভ্যতা। মেয়েটা তবে কি তাকে নিয়ে মজা করেছে? হতেই পারে। এমন অর্ধশিক্ষিত মেয়েরা এটা করতেই পারে। রাগে গরগর করতে লাগল মনে মনে।

সেই নম্বরে ডায়াল করে রেস্টুরেন্টের দিকে একটু একটু এগোতে থাকে। খানিক পরেই মনে হল রিং-এর আওয়াজ যেন দোকানের ভেতর থেকেই আসছে। আওয়াজের সূত্র ধরে এগোতে থাকে। কয়েকটা টেবিল পেরিয়ে প্রায় পেছনের দিকে একটা কেবিনের ভেতর থেকে আসছে আওয়াজটা।

এগিয়ে চলল সে কেবিনের দিকে। হ্যাঁ আওয়াজ কেবিনের ভেতর থেকেই আসছে বটে। উঁকি পাড়ল ভেতরে। পেছন দিকে মুখ করে একটা মেয়ে বসে আছে। মনে হল শালোয়ার কামিজ আর ওড়নায় আপাদমস্তক ঢাকা।

সাহসে ভর করে সে আরও এগোল। রিং শেষ হয়ে গিয়েছিল। আবার ডায়াল করল সন্দীপ। এবার বাজছে জোরে আর খুব কাছ থেকে। হ্যাঁ সেই উল্টোদিকে মুখ করা মেয়েটার ব্যাগের ভেতর থেকেই। আশ্চর্য এতবার ফোন বাজছে তবু সে তো মোবাইল বার করে নি ব্যাগ থেকে।

এদিকে বেশ সংকুচিত সন্দীপ। বেশ ভয় আর দ্বিধা। যদি এটা সেই মেয়ে না হয়? একই সঙ্গে দুটো মোবাইলে তো রিং হতেই পারে। হয়ত সে যাকে ডায়াল করেছে সে আছে অন্য কোথাও?

-এস ন্ধু এস।

শক খেল সন্দীপ। মেয়েটা পেছন ফিরে হেসে বলছে কথাটা। আর অবাক কান্ড এই কি তবে অনামিকা? এত সুন্দর! ধবধবে ফরসা রঙ। চোখমুখ টিকালো, কোঁকড়ানো কালো চুল। কপালে কি সুন্দর রঙীন একখানা টিপ। যা সে খুব পছন্দ করে। অপূর্ব লিপস্টিক তার সুন্দর ঠোঁটে। তার মনে হল আকাশ থেকে উড়তে থাকা কোনও পরী হয়ত রেস্টুরেন্টের সুখাদ্যের ঘ্রাণ পেয়ে নেমে এসেছে।

বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে সন্দীপ।

-হাঁ টা বুজিয়ে ফেল। মশা মাছি ভাইরাস কত কিছু ঢুকে যেতে পারে।

বলার শেষে আবার সেই জলতরঙ্গ হাসি। হ্যাঁ এই হাসি তো ফোনে আগেই অনেকবার শুনেছে সন্দীপ। ভুল হবার তো কথা নয়?

হাতটা আলতো করে ধরল মেয়েটি। থরথর করে কেঁপে উঠল সন্দীপের শরীর।

-হাঁ হয়ে দেখছ কি হাঁদারাম? আমিই অনামিকা দস্তিদার ওরফে ঋতুপর্ণা দাসগুপ্ত। আর মাধ্যমিক পাশ নয়। এম-এ পাশ ইকোনোমিক্সে। সরকারের অর্থ দপ্তরে কাজ করি। পোস্ট যে বেশ উঁচু তা নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছ? তুমি যে ফার্স্ট ক্লাস এম-এস-সি তা যে জেনেছি হয়ত তুমি জান না। যেমন করে জেনেছি তোমার অসুখের খবর। একদিন একটা ফুলের গোছা আর ফলের প্যাকেট নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়েছিলুম। দূর থেকে দেখেছি তোমায়। বেশ ভ্যাবলাকান্তর মত লাগছিল বটে।

কথাটা বলেই আবার সেই হাসি।

অবাক সন্দীপ ভাবছিল নার্স একদিন তাকে এই উপহার পৌঁছে দিয়েছিল বটে। বলেছিল সৌহার্দ দাস বলে তার এক বন্ধু এটা দিয়ে গেছে। কিন্তু সে ভেবে পেল না তার এই নামে কোনও বন্ধু আছে নাকি। 

খুব সুন্দর হাসি ফুটল সন্দীপের মুখে। বলল, সব প্রেমিকার কাছেই প্রেমিকেরা ভ্যাবলাকান্ত গো। আমার মনে হয় এই ভ্যাবলাকান্ত টাইটেল খানা উৎকৃষ্ট একটা সার্টিফিকেট।

দুমিনিট ধরে বয়ে চলা হাসির জলতরঙ্গ থামল ওয়েটারের আগমনে।

chattopadhyayarun@gmail.com
হুগলি 


No comments:

Post a Comment