1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

জিজ্ঞাসাবাদ

 

ছবি  : ইন্টারনেট 
জিজ্ঞাসাবাদ
ড: দেবদ্যুতি করণ


-  নাম কী? বাড়ি কোথায়?

মেয়েটি উত্তর করল না। ফুঁফিয়ে কাঁদছে।

 এই নাম কি তোর? - ঝাঁঝালো গলায় আবার প্রশ্ন আসে। 

 -কি রে কথা বলতে পারে না? বোবা নাকি রে?

অঝোরে কেঁদে চলেছে মেয়েটি। দেখে ভারী মায়া হয় না? সবার হয় কি! মুখটা কিন্তু ভারী মিস্টি। কার ঘরে আলো করে এসেছিল কে জানে। এই যে কাঁদছে, দেখে মনে হয় যেন নিখুঁত করে কান্নাটা ওর মুখে কেউ বসিয়ে দিয়ে গেছে। সবাই কি নিখুঁত করে হাসতে পারে? সবাই কি নিখুঁত করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে? সবাই কী নিখুঁত করে সমস্ত অভিব্যক্তি গুলোকে তুলে ধরতে পারে? পারে না। কিন্তু এই মেয়েটির নিখুঁত অভিব্যক্তি দেখে ঝানু দারোগাটিরও মনে প্রশ্ন জাগে; মেয়েটিকে কেউ গুছিয়ে অভিনয় শিখিয়ে পাঠায় নি তো? কোনও স্মাগ্লিং দলের নতুন কোনও চাল নয়তো? থানার মধ্যে বাচ্চা মেয়েটিকে দিয়ে হয়তো কোনও কুকর্ম ঘটাতে চাইছে। পুলিশ অফিসার মহিলা কনস্টেবলকে ডাকিয়ে প্রথমে ওর জামাটা ভালো করে সার্চ করালো। তারপর মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। ধাতব অস্ত্র বা অগ্নেয়াস্ত্র নেই শরীরে। অফিসার মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকায়: মেয়েটির নিষ্পাপ মুখ তাকে আবার ধ্বন্ধে ফেলে। এই মেয়েটি যেন কারোর দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে তা ভাবনার অতীত।

অফিসার মহিলা কনস্টেবলকে ডেকে বলেন;- একে নিয়ে যান তো, দেখুন এর নাম, বাড়ির ঠিকানা কিছু জানতে পারেন কিনা! এ মরতে যে শুধুই কাঁদে। - একটু থেমে বললেন,- বদমায়েশ হলে চাবকে পেটের কথা বের করতে পারতাম; এইটুকু বাচ্চা মেয়েটা! - দরদে ভরে যায় পুলিশের মুখখানি।- পেট থেকে কীকরে নাম ঠিকানা বের করব তা বুঝতে পারছি না। 

মহিলা কন্সটেবলটি যদিও নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না এই বাচ্চার মুখ থেকে কীকরে কথা বের করবে।  সেটা তো আর বড়সাহেবকে বলা যায় না। তাই নিয়ে গেল মেয়েটিকে। আরও কিছুক্ষণ মেয়েটি কাঁদল। মহিলা কনস্টেবল সামনে বসে বসে দেখলেন কিছু সময়। ধমক দিলেও কাজ হচ্ছে না; আরও কাঁদে। কোনও কথা জানা না গেলেও বড় সাহেবকে কী জবাব দেবে! উত্তরে সাহেব একটা কিছু খোঁচা দিয়ে কথা বলবে। সেইগুলো খুব গায়ে লাগে। মহিলা ভাবতে লাগলেন। মেয়েটিকে নিখুঁতভাবে লক্ষ্য করতে লাগলেন। এই কান্নার মধ্যে কোনও গোপন অভিসন্ধি আছে কিনা! এই মেয়েটিকে দিয়ে কেউ কী করাতে চাইতে পারে? মেয়েটিকে পুলিশ রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছে। সে নিজে থেকে থানায় আসে নি বা কোনও কুকর্ম করতেও তাকে দেখা যায়নি।

          ***

দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজো মণ্ডপ থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধার করা বলতে যা বোঝায় তা অবশ্য করতে হয়নি। কোনও মেয়ে প্রাচারকারী দলের খপ্পরে যে পড়েছিল তা নয়। পতিতা পল্লীতে কোনও দালালের হাতেও বিক্রি হয়ে যায়নি। তাহলে উদ্ধার বলা কেন? 

আসলে ও কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে একা হাঁটছিল। বয়স এই ধরুন সাত আট হবে। এই বয়সের একটা মেয়ে পুজোর সময় কলকাতার রাস্তায় একা হাঁটা তো কাজের কথা নয়। যা ভিড় তাতে পদপৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া কিছু আশ্চর্য নয়। তাই যে পুলিশের চোখে পড়েছিল তিনি মেয়েটিকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন বাড়িতে দিয়ে আসার জন্য। হয়তো মা বাবার হাত ছেড়ে এই বিভ্রান্তি। তারা খুঁজে দিশেহারা। ভিড়ের মাঝে তাদের থেকে ছিটকে অনেক দূর চলে এসেছে। কিন্তু মেয়েটা জানায় তার মা বাবা কেউ নেই। তাহলে কি কোনও হোমে থাকে? সেই হোম কোথায়?

মেয়েটি জানায় সে হোমেও থাকে না। তাহলে কোথায় থাকে? বড্ড ঝামেলায় পড়ে ট্রাফিক পুলিশটি। সঠিক উত্তর না পেয়ে স্থানীয় থানায় পাঠান। সেই থেকে মেয়েটি কেঁদে চলেছে। কখনও ফুঁফিয়ে, কখনও অশ্রু ভাসিয়ে চলেছে। পুলিশের মধ্যেও কেউ মা, কেউ বাবা আছেন। মেয়েটিকে দেখে কেমন যেন মায়া পড়ে যায়। আট বছরের মেয়ে নাম ঠিকানা বলতে পারবে না এটা অস্বাভাবিক। তবুও মায়ায় জড়িয়ে পড়ে মনে হয় কী এমন বা বয়স! ভুলে যেতেও তো পারে। 

কনস্টেবল মহিলাটি মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। স্বর নরম করে জিজ্ঞেস করে;- বল না সোনা। তোর নাম কী?

- মিলি।-- ফুঁফিয়ে ওঠার মাঝখানে সংক্ষিপ্ত উত্তর। 

মহিলার মায়া হয়। তার যদি এত সুন্দর একটা মেয়ে থাকত। বাচ্চাটির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, - সোনা তোর বাড়িতে কে কে আছে? 

- কেউ নেই... আর কেউ নেই। কেউ নেই... মিলি দুহাতে মুখ ঢেকে দেয়। 

- আর কেউ নেই?... মহিলার কণ্ঠ আড়ষ্ঠ হয়ে আসে।- মা বাবা?

- কেউ নেই... কেউ নেই!

- তারা সব কোথায়?

- মা ছিল। গত বছর ... মিলির কথা আটকে আসে। কান্নায় ভেঙে পড়ে।

- মা ছিল এখন কেউ নেই! তাহলে তুই থাকিস কার সাথে?

মেয়েটি চোখ আবার জলে ভাসে। উত্তর আসে না। মহিলা আবার ওর মাথায় হাত বোলায়। আদর করে জানতে চান। মিলি কান্নায় ভেঙে পড়েছে। মুখ চোখ ফুলে গেছে। উত্তর পাবার আশা খুব কম। এই অবস্থায় কোনও মেয়ের মনের অবস্থা কেমন থাকে তা মহিলাটি জানেন। ওকে আর প্রশ্ন করল না। ওর জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তিনি বড় সাহেবের কানে কথাটা তোলার জন্য উঠে যায়।

                               (২)

পুলিশের হেড অফিসে বসে আছে মেয়েটি। এর মাঝে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। স্থানীয় থানায় মিলির জন্য কোনও ব্যবস্থা করতে পারে নি। তাকে হেড কোয়েটারে পাঠানো হয়েছে। এখান থেকেই কোনও চিলড্রেন হোমে তাকে পাঠানো হবে। কিন্তু তার আগে অজ্ঞাত কুলশিল এই মেয়েটিকে ভালোকরে নিরীক্ষণ করা প্রয়োজন। তাই এই ব্যবস্থা। এখন সে কাঁদছে না। হয়তো চোখের জল শুকিয়ে গেছে। সে বসে আছে একটা চেয়ারে। এরপর পুলিশ অধিকর্তা তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবেন; তারই অপেক্ষায়। মেয়েটি রাস্তা থেকে উঠে এসে বলছে তার মা বাবা কেউ নেই; কেমন অদ্ভুত না! তারা কোথায় কিভাবে কবে মারা গেছেন তা জানা দরকার। 

 একজন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল;- এসো, সাহেব তোমাকে ডাকছেন।

মিলি কোনও কথা না বলে উঠে গেল। সাহেব বেশ কিছু সময় তার মুখটা ভালো করে দেখলেন। মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারলেন কী? ঝানু আফিসাররা অনেক সময় মুখ দেখেই অনেক কিছু বুঝে যান বলে শুনেছি। মুখের অভিব্যক্তি, কথা বলার ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায় কে দোষী আর কে দোষী নয়। মিলি ছোট মেয়ে এত শত জানার কথা নয়। তবুও তাকে নিরীক্ষণ করার প্রত্যুত্তরে সেও তাঁর মুখের দিলে অনেক সময় তাকিয়ে থেকে দেখল ভালো করে। সে এই অফিসারের মুখ দেখে কী বুঝল? কে জানে! বাচ্চারা আবার এতসব বোঝে নাকি? তবে এই বয়েসেই মিলি সব হারিয়েছে; তাই জীবনে সব মানুষকেই ভালো করে দেখে চিনে নেওয়া দরকার। মিলির উপর দিয়ে তো কম ঝড় যায় নি। বাবা তো নেইই, এই বয়সে মাকেও হারিয়েছে! জীবনে আর বা কী হারানোর বাকি আছে!

ওকে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করল পুলিশ অধিকর্তা। মিলি আগের মতই ঠিকঠাক জবাব দিতে পারল না। বিরক্ত হয়ে তিনি উপর মহলে ফোন করলেন। রাতে বাড়ি ফেরার আগে অফিসে জানাল, মেয়েটিকে তিনি বাড়ি ফেরার সময় নিজের গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। ওকে চিলড্রেন হোমে নামিয়ে দিয়ে যাবেন। গতকাল রাত থেকে মেয়েটা পুলিশ স্টেশনে  আছে। কত ধকলই না গেছে! ওইটুকু বাচ্চা দেখেও সবার মায়া পড়ে যায়। এই রাতটা আর পুলিশ স্টেশনে থাকে কেন! ইনকোয়ারি যখন হয়েই গেছে ওকে হোমে পৌঁছে দেওয়াই ভালো। 

তিনি মাঝে মাঝেই ড্রাইভার বা গার্ড নেন না, একাই চালিয়ে যান। ঝানু অফিসার; এই বয়সেই বেশ নাম করেছেন। সব মহলেই তাঁর বেশ খাতির। নেতা মন্ত্রীদের সাথে ওঠাবসা। পুলিশের তো শত্রুর অভাব হয় না। কিন্তু তাঁর শক্রু আছে বলে কারোর শোনা নেই। অন্তত কেউ তেমনটা ভাবতেই পারেন না। একা ড্রাইভ করতে তাঁর অসুবিধে হয় না। মাঝে মাঝে একা ড্রাইভ করে বাড়ি ফেরেন। 

                              (৩)

গাড়িটা শহরের বাইরে একটা নির্জন জায়গায় এসে থামল। এখন পুজোর জন্য এত ভিড় কলকাতা শহরে প্রায় নির্জন জায়গা মেলে না বললেই চলে। তাও শহরের দারুন ভিড়, স্ট্রীট লাইট সবকিছু ডিঙিয়ে গাড়িটা একটা নির্জন জায়গায় এসে দাড়ালো। ঝাপসা কাঁচের ভেতরে দুটো মানুষ। ভেতরে কী হচ্ছে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। ভেতরের দুটো ছায়া মূর্তিই কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর বয়স্ক মানুষটি নড়ে চড়ে বসল। 

- তোর শিক্ষা হয়নি, না! -- কর্কশ গলায় ভেসে আসে কথাটি। প্রাপ্ত বযস্ক মানুষটার স্বর অদ্ভুত ভাবে বদলে গেছে। শান্ত নম্র পরিশীলিত ভাবটা আর নেই। মুখটা হিংস্র, ভয়ানক কোনও জন্তু যেন বেরিয়ে এসেছে জঙ্গল থেকে। যেন কেউ তার শান্তির ঘুমের বারোটা বাজিয়েছে কিংবা কোনও বিষাক্ত সাপ যেন রাগে ক্রোধে বেরিয়ে এসেছে গর্ত থেকে। কেউ কী গর্তাভ্যন্তরের নিরাপদ আশ্রয় কেড়ে নিয়েছে?

গাড়ির সামনের সিটে ওই ব্যক্তির পাশে বসে থাকা শিশুটি নির্বিকার। সেই নির্বিকার ভাব দেখে লোকটি আরও জ্বলে ওঠে। আরও কর্কশ ভাবে বলে;- আমার সাথে পাঙ্গা নিয়ে এই শহরে কেউ টেকেনি। - কয়েক মুহূর্ত হাসে, শয়তানির হাসি। - আমার কাজে যারা বাধা দিয়েছে তারা কেউ আর এই পৃথিবীতে নেই। ইভেন তোর জন্মের জন্য আমি দায়ী নয়। শেফালিকে বারবার বলেছিলাম পিলস্ খেতে। কেউ ওর মত বোকামি করেনি। 

- বোকামি কেন হবে! হাড় বজ্জাতি। ব্ল্যাকমেইল করে আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমার ওয়াইফকে সব বলতে গিয়েছিল। সেদিন কি ভাগ্যে অনিতা বাড়িতে ছিল না। আমার ফ্যামিলি আমার সামাজিক মর্যাদা সব তছনছ করে দিত। না না, ওকে মরতেই হত। ওর আর বাঁচার অধিকার ছিল না।- মিলি এতসময় ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল পুলিশ অধিকর্তা মিস্টার গুপ্তর দিকে। এই টুকু মেয়ের এমন চাহুনি দেখে তার গা জ্বলে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে- তুই আবার এলি কেন মরতে! সেবার পালিয়েছিলি। নাহলে সেবারই তোকে... 

বলতে বলতেই কোমর থেকে পিস্তলটা বার করে সে। মিলির দিকে তাক করে। বলে- বল; পালিয়ে যদি গেছিলি ফিরে এলি কেন? 

 একথার পরেও মিলি নির্বিকার। এই ভাব দেখে রাগে জ্বলতে থাকে। মিলি কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে। কেউ কি আসবে ওকে বাঁচাতে? লোকটি ধন্ধে পড়ে যায়। মুখ ক্রোধে লাল; বলে-- তোর মাকেও বলেছিলাম সব খরচ আমি দেব। অন্য কোথাও চলে যেতে। যায়নি বলে তাকে মরতে হল। তুইও এসেছিস যখন তোকেও মরতে হবে।

মিলি এই কথায় আলতো হাসে। এরমধ্যে কী কৌতুক থাকতে পারে ঝানু অফিসার ধরতে পারে না। ট্রিগারে আঙ্গুল বসিয়ে বলে;-- মর তাহলে। তোকে চাইলে আমি খুঁজে বের করে মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা চাইনি। হাজার হলেও তো আমারই...! সেকথা থাক। তুই ফিরে এসে বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়েছিস। মর এবার। -- আঙুলের চাপে ট্রিগারটা আস্তে আস্তে চেপে বসতে থাকে।

মুহূর্তেই শরীরটা যেন বেঁকে যায় ধনুকের মত। হাত থেকে সদ্য বের করা পিস্তলটা খসে পড়ে। আজ তিনি জীবনে প্রথমবার পিস্তল হাতে নিয়েও লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন পুলিশ অধিকর্তা। শরীরটা বেঁকে যেতে লাগল ধনুষ্টঙ্কার রোগের মত। মিলি তার জামার পেছন দিক থেকে একটা খুব ছোটো নিডল যুক্ত সিরিঞ্জ বের করে এনে বলল; - স্ট্রিকনিন! ভিড়ের মধ্যে গাড়ি চালানোর সময় যখন অন্যমনস্ক ছিলে। তখন পুষ করেছিলাম তোমার পিঠে। তুমি অন্য মনে মশা ভেবে চাপড় মেরেছিল। তাতে আরও গেঁথে যায়।

বেঁকে যাওয়া লোকটির চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। শেষ মুহূর্তেও তিনি এই ছোট্ট মেয়েটির বুদ্ধি এবং রিফ্লেক্স দেখে অবাক না হয়ে পারলেন না।

মিলি বলল; - তুমি যে চিলড্রেন হোমের নাম বললে সে রাস্তায় তো যাচ্ছিলে না। সে রাস্তা তো আমি চিনি। তোমার বাড়ির রাস্তাতেও নয়। 

এসপি সাহেব চোখ বন্ধ করার আগের মুহুর্তে শেষ বারের মত আর একবার বিস্মিত হলেন। এবং মৃত্যুর আগে জেনে গেলেন, তার ঔরসে জন্ম মেয়েটি অবৈধভাবে জন্মালেও বুদ্ধি এবং তৎপরতায় তাঁর উপযুক্ত হয়েছে। তিনি পঙ্গু হাতটি বাড়ানোর চেষ্টা করলেন মেয়েকে ছোঁয়ার জন্য। ছোঁয়ার আগেই মৃত্যু ঘটল।

                            (৪)


সাদা রঙের সেভেন সিটার গাড়ির ফ্রন্ট সিট থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো মিলি। এক্ষুনি যে এত বড় কান্ড করেছে তার কোনও রেশ ওর মুখে নেই। গাড়ির ভেতরে পড়ে আছে ধনুক-বাঁকা একটি মৃত শরীর। দেখে প্রাথমিকভাবে টিটেনাস রোগে মৃত বলেই মনে হয়। পোস্টমর্টেম হওয়ার হওয়ার আগেই মিলি অনেক দূরে পৌঁছে যাবে। এরকম উসকো চুল, চোখের নিচে কালি, লাল ধরা চোখ তাকে মুছে ফেলতে হবে। একদম স্বাভাবিক হয়ে যেতে হবে। কিছুদূর হেঁটে একটা টিউব ওয়েলে মুখ ধোয় সে। কোমরে লুকোনো রুমালটা দিয়ে মুখ মোছে। এর মধ্যেই মাইক্রো সিরিঞ্জে স্ট্রিকনীন রেখেছিল। পুলিশ কাপড় ভেবেই আমল দেয় নি। নিডিলের আকার সেফটিপিন এর মত। না বোঝাই স্বাভাবিক। মিলি এগিয়ে যেতে থাকে। কেউ তাকে আনতে আসবে। কেউ তার জন্যই অপেক্ষায় আছে। তার আগে চোখ মুখে জল দেবে সে।

 পিতৃপরিচয় অভাবে কেটেছে এতদিন। তার জন্মটা ক্ষণিকের ভুলে। সেই ভুলে চলে গেছে দুটি প্রাণ। সে বেঁচে আছে। তাকে বেঁচে থাকতেই হবে। গত বছর পর্যন্ত এরকমই অষ্টমীতে মায়ের সাথে অঞ্জলি দিয়েছে। এবার এখনও দেওয়া হল না। মিলি যদি পঞ্জিকা জানত, তবে বুঝত এখন সন্ধিক্ষণ। কোনও একটি নির্দিষ্ট মুহূর্ত থেকে শুরু হয়েছে এই ক্ষণ। যে সময়ে এসপি সাহেবের শরীরে বক্রতা দেখা দিল; সেই সময় থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে শুরু হয়েছে সন্ধিপূজা। 

মিলি পায়ে হেঁটে পাশাপাশির মধ্যে একটি পুজো মণ্ডপে গেল। তখন সন্ধি পুজো সবে শেষ হয়েছে। শহরতলীর পুজো বলে এতো রাতে তেমন ভিড় নেই। ও গিয়ে দেবী দুর্গাকে প্রণাম করল। পুরোহিত সদ্য নেভা হোমের ছাইয়ের টিপ পরিয়ে দিলেন। মিলি মাথায় ঠেকিয়ে মুখে নিল। তারপর দেবী মূর্তির যুদ্ধ বিরত শান্ত লাবণ্যময়ী মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংযত করল,। অঞ্জলি দিল তার এতদিনের জমে থাকা বিদ্বেষ।

 পুলিশ হবার শখ তার। বাবার মত না, ওই রকম পুলিশদের ডিপার্টমেন্ট থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য। কিছুক্ষণ অপরাধবোধে ভাবল, যে তাকে অনাথ করেছিল, সে তাঁকে মেরে তাঁর অন্য সন্তানকে অনাথ করেছে। অপরাধ বোধে চোখে জল আসে। কিন্তু এ ছাড়া আর যে কোনও উপায় ছিল না যে। এই মানুষটা বেঁচে থাকলে আরও শিশুকে হয়তো অনাথ হতে হত তার ঠিক নেই। এবার তাকে অনেক দূর যেতে হবে, কাজ যে অনেক বাকি। কেউ তার জন্য নিশব্দে অপেক্ষা করে আছে!

drdebadyuti.karan@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment