1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

বেনুগোপালের খোঁজে স্বপ্নভঙ্গ

ছবি : ইন্টারনেট 

বেনুগোপালের খোঁজে স্বপ্নভঙ্গ

সঞ্জয় কুমার মুখোপাধ্যায়  

 

পুলিশ ট্রেনিং কলেজ আন্দামান শেষদিনের কুচকাওয়াজ চলছে । আজকের ইন্সপেক্টর অর্জুন উপর দায়িত্ব নতুন ট্রেনিদের এতোদিনের ট্রেনিং সমাপ্ত হবার অনুষ্ঠানে কুচকাওয়াজ করাবার। ট্রেনিং শেষে নতুন ট্রেনিদের এবার কর্মজীবন শুরু হবে । তাই শেষ শপথ বাক্যের পরে অর্জুনকে সবাইকে বলতে বলা হল যেখানেই তাদের পোস্টিং হোক দেওয়া হোক, তারা সব সময় তৈরি থাকবে এবং সবকিছু মোকাবিলার জন্য বিনা কোন প্রশ্নে এগিয়ে যাবে।সেদিনকার প্যারেড শেষ হয়ে যাওয়ার পরে অর্জুনকে তার কমান্ডিং অফিসার ডেকে বললেন-" আগামীকাল থেকে সমস্ত অফিসার এবং বাকি ট্রেনিরা কাজে যোগ দিতে চলে যাবে সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই হোস্টেল, কলেজ ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে যাবে। তাই তুমি প্রধান ফটকে কর্মরত থাকবে।"আদেশ শুনে অর্জুন তার উর্দ্ধতন কতৃপক্ষেকে সন্মতি দিয়ে তার নিজের কোয়ার্টারে চলে এলো। অর্জুনের থাকে অবিবাহিত দিদির সাথে আর অর্জুনের মা এবং স্ত্রী থাকে শহরে। স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, তাই পারিবারিক বাড়িতেই তার মায়ের কাছে স্ত্রীকে রেখে দিয়েছে এসেছিল অর্জুন।পরের দিন ডিউটি অ্যালটমেন্ট হবার পরে অর্জুনের বন্ধু কৌশিক একসাথে ক্যান্টিনে খেতে বসেছে এমন সময় কৌশিক বলল -"শুনলাম তোর মেন গেটে ডিউটি পড়েছে, প্রচণ্ড চাপের ব্যাপার তো চারিদিকে শুধু ধুধু প্রান্তর আর কাকপক্ষীও নেই একা একা বসে থকাতে হবে, করবি টা কি?"অর্জুন বলল -"কিছু করার নেই আমাদের তো সবসময় বলেই দিয়েছে সদা প্রস্তুত থাকো যে কোনো অবস্থায় নিজেকে প্রমাণিত করো।" কথাটা শুনে কৌশিক হাসলো বললো - জানিস তবে তো একবারে মন্দ লাগবে না, সকাল-বিকেল তুই অদ্ভুত সুন্দর বাঁশির আওয়াজ শুনতে পাবি।"অর্জুন একটু কৌতূহলবশত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল-" বাঁশির আওয়াজ কি করে এখানে বাঁশি বাজাবে কে ?" কৌশিক বলল -"সকাল-বিকেল ওই পথে একটা ছেলে ছাগল চড়াতে আসে, খুব সাদামাটা ছেলে । আমার ডিউটির সময় মাঝে মাঝে ওকে জল পিপাসা পেলে জল দিতাম। তার বদলে ও শোনাতো অদ্ভুত সুন্দর বাঁশির সুর।"কথাটা শুনে অর্জুনের মনটা একটু ভালো হল‌, ভাবলো যাই হোক আর কিছু নয় ওকে এই ছেলেটির সাথে দেখা করতেই হবে ওর বাঁশির সুর শুনতেই হবে।পরের দিন সবাই চলে গেলে যথারীতি তার কেটে ডিউটি শুরু করলো সকাল বাঁশির সুর কানে এলো অর্জুন চেয়ার ছেড়ে উঠে পরল। সে যেন এক মোহিত করা বাঁশির সুর, মনে পড়লো বহু বছর আগে অর্জুন এরকম পাশে তার বাড়ি কাছে শুনতে পেতো। অর্জুন গেটের কাছে এগিয়ে যেতে দেখল একটি ছেলে একপাল ছাগল নিয়ে প্রধান ফটকের পাশ দিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলেছে।দিন তিনেক বাদে একদিন অর্জুন ছেলেটিকে ডাকল ছেলেটি এসে অর্জুনের চেয়ারের নিচে বসে একটু জল চাইতে অর্জুন জল দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল -"কি নাম তোমার? কোথায় থাকা হয়?"ছেলেটি বলল-" আমার নাম বেনুগোপাল, থাকি এই পাশেই যে চামড়া কারখানা আছে, তার মালিকের বাড়িতে ।" অর্জুন জিজ্ঞেস করল-" তুমি কি প্রথম থেকেই এখানে আছো?  কথা বলার মধ্যে ছেলেটির অদ্ভুত এক বিষন্নতা, ওর করুন মুখ দেখে অর্জুনের মনে বড্ড মায়া লাগছিল।"বেশ কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন অর্জুন বেনুগোপালের ফিরবার সময় বলল -"তুমি আমাকে তোমার সব কথা বলো বড্ড জানতে ইচ্ছে করে।" বেনুগোপাল বলল - "আসলে এখন আর এখন আর আমার মনে পড়ে না আমি কোথায় ছিলাম , তবে আমার গ্রামের ছবিও আমার স্মৃতিতে এখনো অস্পষ্ট। গ্রামের বাড়িতে বাবা, মা,ভাই আমি একসাথে থাকতাম আমরা গরীব হলেও আমাদের সংসারে শান্তি ছিল, ভালোবাসা ছিল । কিন্তু শুধু ভালোবাসা দিয়ে তো আর সংসার চলে না, তাই বাবা রোজ কাজে বেড়োতেন। ক্ষেত মজুরের কাজ করতেন,মা ছোট ভাইটিকে নিয়ে বড় রাস্তার পাশে ভুট্টা বিক্রি করতেন। কোনদিন বিক্রি ছিল, কোনদিন নয়। তাই আমিও ভাবতাম কিছু করে আমার পরিবারকে সাহায্য করতে পারলে কিছুটা সবার সুরাহা হয়। কিছু করতে হবে, বড্ড ইচ্ছে ছিলো আমার মাকে একটা লাল পেড়ে শাড়ি কিনে দেবো  আর এক গাছা লাল চুড়ি।যেমন ভাবা তেমন কাজ, গ্রামের প্রতিপত্তি সম্পন্ন জমিদার ছিলেন দেবনারায়ন বাবু সবাই তাকে কর্তা হুজুর বলে সম্মোধন করত। আমি তার কাছে কি আবদার করলাম তার জমিতে যদি তিনি কিছু কাজ দেন। আমাকে কি কি কাজ জানি সে সব জিজ্ঞেস করতে আমি একটু অপ্রস্তুত পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর বললাম যা কাজ আছে শিখিয়ে দিলে আমি সব পারবো কর্তা হুজুর আমায় বলেছিলেন রতনকে বলতে যে কর্তা হুজুর পাঠিয়েছেন, রতন হুজুরের খাস চাকর তাকে বললে সে আমায় কাজ দেখেশুনে দেবে। রতনের কাছে যেতে বলাতে  আমার মনে তখন খুব আনন্দ হয়েছিল‌ ভাবলাম, এবার আমি মায়ের জন্য একগাছা চুড়ি আর লাল পাড় শাড়ি বাবার জন্য ফতুয়া, ভাইটির জন্য নতুন জামা নিশ্চয়ই কিনতে পারব। তাই কাজে যোগ দিয়ে রোজ ক্ষেতে কাজ করতে শুরু করলাম একদিনও কামাই দিতাম না। বাকিরা যখন বসে থাকতো আমি মন গিয়ে কাজ করতাম। তবে দুপুরের সময় রতনদা ক্ষেতে কাজ দেখাশোনা করতে আসাতো আমাদের সবাইকে চারটে করে রুটি আর একটু গুড় দিত।রাতে বাড়ি ফিরে যখন বাবা-মা ভাইয়ের সাথে খেতে বসতাম তখন বাবা বলতেন মন‌ দিয়ে  কাজ করলে দেখবি ভালো নাম হবে,টাকা পাবি ,কাজের অভাব হবে না । বাবার সেই কথাটা আজও মনে পড়ে।মাস শেষ হলে ক্ষেত মজুরদের রতনদা টাকা পয়সা হিসেব বুঝিয়ে দিত। আমি ভেবেছিলাম মাসের শেষে আমি ডাক পাব, কিন্তু সবাই টাকা নিয়ে চলে গেলেও আমার ডাক এলো না ! আমি রতনদা কে জিজ্ঞেস করলাম -" রতনদা আমি টাকা পাবো না ?" রতনদা আমাকে বলল-" তোকে তো কর্তা হুজুর সরাসরি কথা বলে রেখেছেন, তুই ওনাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর‌, আমাকে কিন্তু কর্তা হুজুর কিছু বলেননি। " কথাটা শুনে আমি একটু অবাক হয়ে গেছিলাম তারপর হুজুরের বাড়িতে গিয়ে ডাক দিলাম অনেক ডাকার পর কর্তা হুজুর বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন -"কি ব্যাপার, তুই এখানে কী দরকারে এসেছিস?” প্রশ্নগুলো শুনে আমার মনটা ভারি হয়ে গিয়েছিল। আমি বললাম-" কর্তা হুজুর আমি তো আপনার ক্ষেতে কাজ করেছিলাম, এবারে সবাই যখন টাকা পেল, আমি তো পাইনি । রতনদা বলল সে কিছু জানে না। তাই আপনার কাছে এলাম আমার টাকাটা পেতে।" কর্তা হুজুর বললেন-" তোকে দুপুরবেলার খাবার দেয়নি? আমি বললাম -হ্যাঁ কর্তা হুজুর   দিয়েছে ।" তখন কর্তা হুজুর  বললেন- “ দেখ বাবা, তোর তো কোনো কাজ ছিল না, আমি কাজে লাগিয়েছি দুপুরবেলা খাচ্ছিস‌। ব্যস্ এখন মন দিয়ে কাজ করে যা। ” কথাগুলো যেন আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল... আমি নিজের মনকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । কাঠফাটা রোদে গা পুড়িয়ে এক মুহুর্তে অন্যদের মতো আলসেমি না করে কাজ করতাম। কিন্তু মজুরি চাইতে গিয়ে যে কথাগুলো আমি শুনলাম, তাতে আমার মনে একটা অস্থিরতার এনে দিল। আমি কর্তা হুজুর  কে বলেছিলাম-" হ্যাঁ কিন্তু বাকিরা তো আমার চেয়ে কম পরিশ্রম করেছে পুরো মজুরি পাচ্ছে কর্তা হুজুর, আমি কেন পাব না? " কর্তা হুজুর একটু মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে হাতে দশটা টাকা দিয়ে বললো -"যা ভাগ এখান থেকে এটা নিয়ে খুশি থাক।" আমার কাছে দশ টাকার মূল্য তখন অনেক পৃথিবীর এই সুখ যেন এক মুহূর্তে আমাকে অনেকটা বড় করে দিল।পরের দিন গ্রামের হাট বসেছে টাকাটা নিয়ে ছুটলাম। কিন্তু চাহিদার কাছে যোগান ছিল অনেকটা কম, তাই শুধু মায়ের জন্য একগাছা লাল চুড়ি আর ভাইয়ের জন্য কিছু উড়াবার জন্য ঘুড়ি ছাড়া আর কিছু কেনাকাটা গেল না। তবু ওই চুড়ি আর ভাইয়ের খেলবার ঘুড়ি কিনে বুকটা চওড়া করে বাড়ি এসে দাঁড়ালাম। মাকে দিতেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরল আর ভাই তখন আনন্দে মেতে আত্মহারা। ঘুড়ি কটা নিয়ে ও এক ছুটে চলে গেল মাঠে। মা বিক্রির একটা ভুট্টা থেকে একটা ভুট্টা ছাড়িয়ে লেবু মাখিয়ে খেতে দিল আর দুই চোখে আনন্দাশ্রু নিয়ে বলেছিল -"আজ আমি খুব খুশি।"এরপর প্রায় দুমাস কেটে গেছে আমি কিন্তু খেতে কাজ করে চলেছি বিনা মজুরিতে গত দু'মাসে সবাই টাকা পেয়েছে কিন্তু আমার টাকা আসেনি। রতনদা কে জিজ্ঞেস করতে কেউ কিছু বলেনা বিরক্তি প্রকাশ করে। রক্ত পুড়িয়ে শ্রম করে এইভাবে আর কতদিন তাই আমার বিরক্তি এসে গেল ছুটলাম হুজুরের বাড়ি অনেক ডাকাডাকির পর কর্তা হুজুর এসে বলল -" তোকে তো সেদিন দশ টাকা দিয়েছিলাম, এরপরেও টাকা চাস কেন? " আমি বললাম-" রক্ত পুড়িয়ে একনাগাড়ে প্রতিটা দিন ছুটি না নিয়ে কাজ করেছি কর্তা হুজুর  শুধু একটাই নিয়ে কাজে আসা মাসের শেষে মজুরি পেলে বাড়িতে কিছু দিতে পারব।" শুনে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে কর্তা হুজুর  আমাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন।সেবার আমার মাথায় তখন রক্ত উঠে গেছিল, আমি ছুটে গেলাম আমাদের ওখানকার থানায়। বাবা বলেছিল আশেপাশের সব গ্রামের কারুর কোন অসুবিধা হলে ওখানে নাকি জানালে ওরা সব ঠিক করে দেয় । আমি তাই একছুটে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলাম। পেছনে বসেছিলে থানার দারোগা বাবু আমার কথা শুনে উনি বললেন-"তোর কথাগুলোর কি কোন প্রমাণ আছে? তোর কাছে কাজ করার কোন কাগজ আছে? তোকে তো কোনো মারধোর কেউ করেনি । প্রমান নেই তাই আমাদের তো কিছু করার নেই। হুজুরের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে প্রমাণ চাই।"দারোগা বাবুর কথা শুনে আমার মাথা পাগল পাগল অবস্থা। আমি আবার ছুটলাম হুজুরের বাড়িতে এবার বাড়ির সামনে গিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলতে শুরু করলাম। চেঁচামেচি শুনে কর্তা হুজুর   বেরিয়ে এসেছিলেন। তারপর রীতিমতো আমাকে মারধর করেন। হুজুরের দারোয়ান আমাকে মারে । আমার ঠোঁটের কোন তখন রক্ত বেরোচ্ছে আর হাতে পায় কালশিটে দাগ । এতো মার খেয়ে আমার যেন ব্যথার সাথে আনন্দ উঁকিঝুঁকি মারছে । একটাই ইচ্ছে এবার থানার বড়বাবু ব্যবস্থা নেবেন। থানার বড়বাবুকে গিয়ে দেখাতে সেবার বড়বাবু কিন্তু কর্তা হুজুর  কে একদিনের জন্য হাজতবাস করালেন‌ ।এরপর পরের দিন দুপুর বেলা থেকে হঠাৎ পাশের মুস্তাফা চাচা আর বাবা বললেন ছুটে এসে বললেন-"যে হুজুরের লোকজন আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি দেখলাম ওরা বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছেন। বাবা বললেন-"তুই পালা । ওরা যদি তোকে ধরে, নয় মেরে ফেলবে, নয়তো জন্মের মতন পঙ্গু করে দেবে। সেদিন মায়ের ও ভাইয়ের মুখ দেখেছিলাম। কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করবো।তারপর ছুটেছিলাম মাইলের পর মাইল । অজান্তে আমি কখন যে আমি কোথায় পৌঁছে গেছি নিজেই জানতাম না। অজানা আতঙ্কে আমার জন্য শরীরে বিনা খাবার ও পানীয় না থাকলেও কখন যে কতটা ছুটে চলে এসেছি নিজেই জানতাম না। এরপর হঠাৎ খেয়াল হলো বড় রাস্তায় বাস চলছে উঠে পড়লাম। বাস কনডাক্টর টিকিট চাইতে আমি বললাম আমার কাছে টাকা পয়সা কিছু নেই শুধু পাঁচ টাকা আছে যতটা এই টাকায় যাওয়া যায় শুনে কন্ডাক্টর অবাক হলো... আমাকে একটা টিকিট দিল। একটা বড় বাস স্টেশন এসে থামল। আমি নামলাম একটা অজানা জায়গায়। চারিপাশে সবাই অচেনা, পাশের একটি দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে বলল জায়গাটার নাম চন্দনপুর। এদিকে আমার হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই। পাশে দেখলাম একটা ছোটখাটো ধাবা সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় এক অচেনা দাদা জিজ্ঞেস করল -"এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?" আমার তখন তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে, একটু জল চাইলাম তারপর একথা সেকথা হতে হতে দাদাকে সব বলতে দাদা জিজ্ঞেস করল- “তুই এই ধাবায় কাজ করবি ? তাহলে আমি আমার মালিককে বলতে পারি।“ তারপরে সেই থেকে আমার আর সুজনদা’র বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওই আমাকে ওই ধাবায় কাজ  ঠিক করে দেয়, আমরা একসাথে থাকতাম। মালিক আমাদের উপর খুশি ছিলেন প্রায় এক বছর কেটে গেল । আমি আস্তে আস্তে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে লাগলাম। খালি ছোট ভাইটার মুখ আর মায়ের কথা মনে পড়তে লাগলো । সুজনদা’কে সব বললাম সুজনদা বলল -"দেখ ওখানে গিয়ে লাভ নেই, তুই যদি ওখানে যাস হয়তো দেখবি ওরা এখানে নেই কিংবা তোকে আবার ওখানে ধরে পুলিসের কাছে দিয়ে দেবে,তোকে অসুবিধায় ফেলবে। তার চেয়ে আমার কাছে একটা বড় কাজের সন্ধান আছে আমার কাছে সব কথাবার্তা হয়ে গেছে আমি এখানকার কাজ ছেড়ে আন্দামান যাচ্ছি, তুই যদি বলিস তোর কথা বলে রাখব তুই আমার সাথে আসতে পারিস । ওখানে মালিক খুব বড় হোটেল করেছে নিশ্চয়ই তোর একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবো । তারপর কিছুদিন ওখানে থাকার পরে তুই আবার ফিরে আসতে পারিস।আমি শুনে বলেছিলাম-"এখান থেকেই আমার দেশ কত দূরে কিছুই মনে পড়ে না,তারপর তুমি বলছে সমুদ্রের কাছে একটা দ্বীপে আমরা কাজে যাব । সেখান থেকে কি আমি আর ফিরতে পারব সুজনদা বলল -"নিশ্চয়ই পারবি।" আমাদের সব টিকিটের ব্যবস্থা মালিক করে দেবে এখান থেকে ট্রেনে যাব কোলকাতা কোলকাতা থেকে জাহাজে আন্দামান।রাজি হয়ে গেয়েছিলাম। সত্যি বলতে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না কারণ অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বাসটা শুধু সুজনদার উপরে টিকে ছিল। আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম তারপরে এই আন্দামানে আসা। এতক্ষণ অর্জুন অবাক হয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কথা শুনছিল, তারপর জিজ্ঞেস করল-“তুমি কি এখন ওখানে আছো কবে এসেছিলে আন্দামানে?” বেনুগোপাল বলল-“যে বার চারিদিকে সেই মাটি কেঁপে উঠেছিল, সমুদ্র এক ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তার এক বছর আগে এসেছিলাম। ” তারপর বলতে লাগলো জানিনা কেমন ভাবে আমি বেঁচে গিয়েছিলাম, আমাদের যে হোটেল সেটিও পুরো ভেঙে পড়েছিল। আমিও সুজনদা সবাই ভেসে গেছিলাম। প্রায় দুদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার পরে ক্যাম্পে জ্ঞান ফিরলে সুজনদা আর হোটেলের মালিককে খুঁজে আমি আর পাইনি। আমি পড়াশোনা করিনি তাই কিছু করতে পারিনা। কাজের খোঁজ জিজ্ঞেস করতে করতে যখন প্রায় পিঠ ঠেকে গেল পেটের তাগিদে এই চামড়ার কারখানায় কাজ পেলাম। তারপর মালিকের ছাগলগুলোকে খাবার দেওয়া চড়িয়ে নিয়ে আসি। অর্জুন জিজ্ঞেস করল-“ বেনুগপাল তোমার গ্রামের নাম একবারও মনে পরেনা?” শুনে বেশ কিছুক্ষন ভেবে বেনুগোপাল বলল-“ না।” অর্জুন বললে একটু ভেবে তবুও দেখো বেনুগোপাল । বেনুগোপাল একটু ভেবে বলল –“ যেটুকু মনে পড়ে গ্রামের নাম ছিল দেবানন্দনগর, এর বেশি আর কিছুই মনে পড়ে না।” অর্জুন জিজ্ঞেস করলো "তোমার জেলা রাজ্য কিছুই মনে পড়ে না ?" বেনুগোপাল বলল-" না কিছুই মনে পড়ে না।"সেদিন রাতে ফোনে অর্জুন বউকে সব কথা জানালো, দিদিকে সব বলল । সব শুনে তারা বলেছিল-" দেখো না যদি ওকে ঘরে ফিরে দেওয়া যায়! শুনলেও কেমন লাগে একটা বারো বছরের ছেলে আজ তিরিশ বছর বয়স, তবু তার ঘরের ফেরার আর হয়ে ওঠেনি।” এরমধ্যে অর্জুনের দিদি আন্দামানের পুলিশ কোয়াটার পাশেই এক মন্দিরে রোজ পুজো দিতে যায় । সেখানকার পুরোহিত মা ভবতারিণীর পুজো করেন, তাকে এইসব ঘটনাটি বলতে তিনি অর্জুনের দিদিকে বলেন "আমি মায়ের কাছে পুজো দেবো যাতে বেনুগোপাল ওর পরিবার ফিরে পায়।" অর্জুন অফিসে এসে গুগল ম্যাপের সাহায্যে সেখানে টাইপ করে দেখল “দেবানন্দনগর” কিন্তু কিছুই দেখালো না। অর্জুন আন্দামান থেকে কলকাতা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিজের পরিচয় দিয়ে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো পশ্চিমবঙ্গে দেবানন্দনগর বলে কোন গ্রাম আছে কিনা । হেডকোয়ার্টার আধিকারিক কদিন বাদে তাকে জানাবে বলল। কৌশিক অর্জুনের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে করতে হঠাৎ বলল-আচ্ছা এমনও তো হতে পারে বেনুগোপাল গ্রামের নাম ঠিক মতন মনে পড়ছে না ওটা দেবানন্দনগর না হয় দেবানন্দপুর ও তো হতে পারে । কথাটা শুনে অর্জুনের মাথায় বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠলো সে উঠে পড়ল । আবার গুগল ম্যাপের সাহায্যে দেখলো দেবানন্দপুর একটি জায়গা পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলায় আছে সেখানে একটি ব্যাংকের শাখা আছে। অর্জুন ভাবলো আশেপাশের সব গ্রামের লোকেদের কারো না কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এই ব্যাংকে থাকবে সুতরাং যদি কারো অ্যাকাউন্ট থাকে তাহলে হয়তো সেই লোক এদের পরিবার সম্বন্ধে কিছু খবর দিতে পারবে। এত নিরাশার মধ্যেও সামান্য আশার আলো খুশির মুহূর্ত এনে দিল। সে ফোন করে যোগাযোগ করলো ওই ব্যাংকের ফোন নাম্বারে। ওখানকার ম্যানেজার ফোন ধরতেই অর্জুন ম্যানেজার বাবুকে সব বিষয়টা জানাতেই ম্যানেজার বললেন-    “ একদম ঠিক দেবানন্দপুরে তাদের হেড ক্যাশিয়ার থাকেন, আমি তাকে বলে কিছু খবর জোগাড় করতে পারবো।” অর্জুনকে ক্যাশিয়ার বাবুর সাথে কথা বলিয়ে দিলেন। ক্যাশিয়ার বাবু বললেন অর্জুন যেন দুদিন বাদে ফোন করে। অর্জুন মনে মনে খুব খুশি হয়েছিল ব্যাপারটা কৌশিক বাড়ির সবাইকে জানাতে তারাও বেশ উৎসাহিত হল। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় অর্জুন হঠাৎ দেখে তার মোবাইল ফোন বাজছে ফোনটা ধরতেই ওপার থেকে ব্যাংকের হেড ক্যাশিয়ার বাবুর গলা ! হেড ক্যাশিয়ার বাবু বললেন-“পেয়েছি নিন কথা বলুন বেনুগোপালের ভাইয়ের স্ত্রী কমলার সাথে। অর্জুন ফোনে সব কথা বলতেই আবেগতাড়িত হয়ে কমলা বলল অর্জুনের ভাই উত্তম কাজ করেন কলকাতায়, সপ্তাহের শেষে বাড়ি আসে সে আসলেই তাকে সব জানাবেন আর ব্যাংকের ক্যাশিয়ার বাবুর ফোনে কথা বলাবে। এদিকে অর্জুনের আশাবাদী তাই সে ছুটে গিয়ে কৌশিককে সব জানাল পরের দিন ভোর বেলায় বেনুগোপালের অপেক্ষায় বসে রইল বেনুগোপাল আসতেই ওকে সব বলতেই,দুই চোখ বেয়ে জল খালি বলতে লাগল- “দাদা, আমি আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারব আমার মাকে দেখতে পাবো অর্জুন বলল অবশ্যই পাবে । বেনুগোপাল আনন্দের সাথে ফিরে গেল অর্জুন ঠিক করল সপ্তাহের শেষে ছুটির দিনে বেনুগোপালের ভাইয়ের সাথে কথা বলাবে। এদিকে বেনুগোপাল বাড়ি ফিরে যেতে চামড়ার কারখানার মালিক আর তার বউকে সব জানালো। মালিক কিছুটা সময় ভেবে বলল এত বছর পর সত্যি তোমার বাড়ির খবর পাওয়া গেছে হয়তো দেখো তোমাকে না ভুলভাল বুঝিয়ে প্রথম পাঠিয়ে দেয় এখানে যেমন নিজের মতো আছো সেখানে গেলে বিপদে পড়তে পারো। পরের দিন সবাই যখন অপেক্ষা করছে বেনুগোপাল আসবে। এদিকে বেনুগোপালের দেখা নেই অর্জুন, কৌশিক একটু অবাক হয়ে গেল তিন দিন কেটে গেলেও বেনু গোপালের কোন খোঁজ নেই । তার বাঁশির সুর কানে শোনা যায় না। সবাই অবাক হয়ে ভাবছে কি ঘটতে পারে? এদিকে অর্জুন আর কৌশিক অপেক্ষা না করে খোঁজ করতে শুরু করল। কে সেই চামড়া কারখানা মালিক? তার কারখানা কোথায়? ওরা নানাভাবে কাছাকাছি যতগুলো চামড়া কারখানা ছিল তাতে খোঁজ করল । তাদের মধ্যে কলেজের কাছাকাছি একটি কারখানার মালিকের নাম জানা গেল মহাবির সিংহ। কৌশিক অর্জুন বেরিয়ে পড়ল কারণ তারা বেনুগোপালের মুখে একবার শুনছিল চামড়া কারখানা মালিকের নাম মহাবির সিংহ। মহাবির সিংহ বাড়িতে পৌঁছে তাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল-“ দুদিন আগে বেনুগোপাল বেরিয়ে গেছে দেশে যাবে বলে । অর্জুন জিজ্ঞেস করল- “আপনাকে বলে গেছে কোথায় গেছে দেশে যাবে বলে কার কাছে গিয়েছে?” মহাবির সিংহ বললেন-“ না আমি ওর পাওনা-গণ্ডা বুঝিয়ে ছেড়ে দিয়েছি।” কিন্তু কৌশিকের দিলাম সন্দেহ হলো সে ছাগলদের চিৎকারে গোয়ালে দেখল বেনুগোপাল হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। অর্জুন কৌশিক বুঝতে পারল তারই দশার কারণ কি বিনা পারিশ্রমিকে লোক পাওয়া এখানে দুষ্কর বেনুগোপাল চলে গেলে ছাগল চড়ানোর কাজ থেকে শুরু করে চামড়ার কারখানার কাজ অনেকটাই ব্যাহত হবে। তাই এই সিংহ দম্পতি চাইনি বেনুগোপাল চলে যাক এখান থেকে নিজের ঘরে সেটা চান নি, তাই এই কান্ড। অর্জুন আর কৌশিক রীতিমত পুলিশি ব্যবস্থার হুমকি দিয়ে বেনুগোপাল কে নিয়ে তাদের ক্যাম্পাসে কোয়ার্টারে চলে এলো।এদিকে কৌশিকের অর্জুন কিভাবে ওকে নিজের গ্রামে পাঠাবে সেই ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়েছিল। এমন সময় তার দিদি বলে একটা ভালো খবর আছে মন্দিরের পুরোহিত মশাই তার মেয়ের সাথে দেখা করতে বর্ধমান যাচ্ছেন, তাকে বলতে তিনি রাজি হয়েছেন অর্জুনকে তোর বাড়ি পৌঁছে দিতে। পরের দিন অর্জুনকে আন্দামান থেকে কলকাতার বিমান টিকিট কাটলো। অর্জুনের স্ত্রী খবরটি পেয়ে খুবই আনন্দিত অর্জুনের দিদি একটি লাল তার শাড়ি লাল চুড়ি আর ভাইয়ের জামা ভাইয়ের বউয়ের শাড়ি সব কিছু কিনে বেনুগোপালের হাতে তুলে দিলেন। বেনুগোপাল হাতজোড় করে বলল-“ জানিনা আবার কবে দেখা হবে, তবে এটা ঠিক যে আমি কোনদিন ভগবানের পুজো করিনি, তবে তোমাদের পূজা করবো। অর্জুন বেনুগোপালের দুই হাত ধরে বলল –“ না না সেরকম কিছু না তুমি তোমার বাড়ি পৌঁছে ফোন করবে যোগাযোগ রাখবে।” এরপর পুরোহিত রাজনারায়ণ বাবু বেনুগোপাল কে নিয়ে কলকাতায় এসে হাওড়া স্টেশনের এদিকে যাত্রা করলেন। হাওড়া স্টেশনে বেনুগোপালের ভাই উত্তম আর বৌমার আসবার কথা। ওরা দুজনকে নিয়ে দেশের বাড়ি যাবে।এদিকে ট্রেন হাওড়া ষ্টেশনের নতুন প্ল্যাটফর্মের ট্রেন  ঢুকতেই বেনুগোপালের ভাই আর বৌমা তাড়াতাড়ি স্টেশনের সামনে এসে থাকল আর রাজনারায়ণ বাবুর ফোনের অপেক্ষা করতে লাগলেন। বেনুগোপাল ভাই উত্তম চারিদিকে তাকিয়ে রয়েছে যেন খুঁজে চলেছে হারানো শৈশবের স্মৃতি। হঠাৎ চোখ পরল এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে যুবক দাঁড়িয়ে হাতে বাঁশি। উত্তম তার স্ত্রী’কে বলল-“ওই তো আমার বেনুদা আর কিছু না হোক হাত থেকে বাঁশি কোনদিন ছাড়বে না। ” তারপর কাছে গিয়ে সরাসরি সামনে দাদা বলে সম্বোধন করতেন বেনুগোপাল প্রথমটা একটু অবাক হয়ে তাকালো । তারপর ভাই স্ত্রীর গলা শুনে, বেনুগোপাল উত্তম পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল। উত্তম স্ত্রী বেনুগোপালকে প্রণাম করলো। রাজনারায়ণ বাবু আন্দামানের ফোন করলেন অর্জুনকে সাথে উত্তমের কথা হল, উত্তম বলল-“ আমি আমার দাদাকে ফিরে পেলাম আপনাদের জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ থাকব।” অর্জুন বলল-" বারো বছর বয়সে একটি ছেলে যখন হারিয়ে যায় রোজ বাবা,মা,ভাইয়ের কথা মনে করতে করতে জীবনের ৩০ বছর কেটে যায়, সেই ব্যথা আমি অনুভব করেছিলাম। দূরে থাকার ব্যাথা আমরা খুব বুঝি। এই সামান্য কাজ করতে পেরে আমি নিজেই ধন্য মনে করছি। পুরোহিত রাজনারায়ণ বাবু এরপর বর্ধমানে তার মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।উত্তম আর তার স্ত্রী তাদের বেনুদা’কে নিয়ে এগোতে লাগলো দেবানন্দপুর বসে থাকা তার মায়ের চোখের জল মোছাতে, বড় ছেলে বেঁচে আছে সে কথা শোনার পর থেকে না খেয়ে দেয়ে ঠায় বসে আছেন। অপেক্ষায় রয়েছে গ্রামের সব লোকজন। তাদের কাছে এটা যেন এক অলৌকিক ঘটনা।বেনুগোপাল ট্রেনে যেতে যেতে ভাবছে মায়ের কথা, বাবার কথা, তার ভাইয়ের কথা তাদের হাতে তুলে দেবে জিনিস গুলো । তবে উত্তম কিন্তু তখন কিন্তু তার দাদাকে বলেনি তাদের বাবার চলে যাওয়ার কথা…আর সেই কর্তা হুজুরের অত্যাচারের কথা কারণ সেটা শুনলে বেনুগোপাল হয়ত বাঁশি বাজানো ছেড়ে চক্র তুলে নেবে তার ওই নিস্পাপ হাতে। আসলে বেনুগোপালের ভাই দাদার স্বপ্ন ঘরে ফেরবার আগে ভাঙতে চাই নি। বলতে পারেনি তার নিয়ে আসা লাল শাড়ি আর একগাছা লাল চুড়ি  আর কোনদিন তাদের মা'কে পরাতে পারবে না তার বেনুদা।

sanjukolm@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment