![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
ঈগল প্রাসাদে আচমকা
ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়
এখন তো লক ডাউন চলছে। করোনার কৃপায় ঘরবন্দী
জীবন। আর এমনিতেই সারাদিন ধরে ঝরছে ছিঁচকাঁদুনী আকাশের কান্না। একটু থামল তো অমনি
আকাশের মুখভার। কোথা থেকে দলে দলে ছুটে এল কালো মেঘের দল। ছিঁচকাঁদুনী আকাশ অমনি
উঠল কেঁদে। তাই ঝর ঝর বাদর মুখর দিনে ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর উপায় কি?
কিন্তু ঘরে বসে বসে আর অফিসের ওয়ার্ক ফ্রম
হোম করে করে পিঠের শিরদাঁড়া ব্যথা হয়ে গেছে শুভব্রতর। এক্ষুণি
যদি এর একটা ব্যবস্থা না হয় তো তার ঘাড় হয়ত চিরদিনের জন্যেই বেঁকে যাবে বলে
বিশ্বাস তার।
সন্ধ্যে তখন হয়ে এসেছে। দোতলার
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল শুভ। এই মাত্র মিনিট দশেক আগে
অফিসের বড় সাহেবের সঙ্গে তার জুম মিটিং শেষ হয়েছে। ওয়ার্ক
ফ্রম হোম হলেও কেতা কিন্তু রাখতে হবে অফিসের। যেন
তুমি তোমার অফিসের টেবিলেই বসে আছ। তেমন ভাবে সর্বদা ‘ইওর ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্টের’ মত মুখ করে।
মিটিং শেষ হয়েছে। বড়
সাহেব বড় মুখ করে জানিয়েছেন আজ আর কোনও মিটিং হবে না। আগামী
কাল বেলা সাড়ে নটা পর্যন্ত যে যার বাড়ির মত থাকতে পারে। বেলা
একটায় লাঞ্চ আর তিনটেতে ফিরে আসা। তিনটে থেকে সাড়ে পাঁচটা
পর্যন্ত অফিসের কাজ আর এর মধ্যেই রয়েছে ভিডিও মিটিং।
শুভব্রতর হাউসিং কমপ্লেক্সের ঠিক পাশ দিয়েই
চলে গেছে ট্রেনের লাইন। আর মাত্র মিনিট পাঁচসাত হাঁটলেই স্টেশন। এই জানলার সামনে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দূরের ফাঁকা লাইনগুলো দেখতে দেখতে জোরে জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুভ।
আহা আগে তো আধঘন্টা অন্তর অন্তর ট্রেনের আওয়াজ পাওয়া যেত। তখন তার বিরক্ত লাগলেও
এখন যেন আওয়াজটা কত মধুর বলে মনে হচ্ছে। আবার কবে পাওয়া যাবে এই আওয়াজ?
অফিস করতে করতে একঘেয়ে লাগত তার। আর শুধু মনে
হত ইস কাজগুলো যদি সব বাড়ি থেকেই করা যেত। এই ডিজিট্যাল ওয়ার্ল্ডে কি এটা এতই
অসম্ভব? সেই একই
কম্পিউটার আর নেট সিস্টেম তো বাড়িতেও আছে। চেয়ারটাই নাহয় শুধু পালটে যাবে। বেশ
একটু আয়েশ করে বিছানায় বসে কোলে ল্যাপটপ নিয়ে কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে গান শুনতে
শুনতে কাজ করা যাবে।
তা অতিমারি এসে দেখিয়ে দিয়েছে হ্যাঁ তাও
সম্ভব। করোনা আগের অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে দিয়েছে। কথায় বলে, ঠেলার নাম বাবাজী। কিন্তু
অফিসের বেয়াড়া অফিসিয়াল প্রোটোকল যে এই ওয়ার্ক ফ্রম হোমেও চালু হবে তা কি আর সে
জানত?
মন তার উৎসুক হয়ে ভাবছে আহা এখন যদি বেজে ওঠে
একটা ট্রেনের ভোঁ। শোনা যায় তার আসার বা চলে যাওয়ার ঘড় ঘড় ঘটাং ঘটাং আওয়াজ। আহা কি
মিষ্টি যে লাগবে না। গায়ের পায়ের ঘাড়ের সব ব্যথা সে ভুলে যাবে। এমন কি ভুলে যাবে
মনের ব্যথাও। আহা কতদিন উইক এন্ডে কোথাও যাওয়া হয় নি। আসলে বাইরেটা যে কেমন দেখতে
তাও ভুলে গেছে। কেমন যে আকাশের রঙ আর বাতাসের গন্ধ- গাছ, ফুল, পাতা,
পাখি এরা কেমন করে পাতা বা পাখা নাড়ে, কোন
ফুলের বা কি গন্ধ- হায় রে সব এখন অতীত। কম্পিউটারে বসে বসে জুম মিটিং করতে করতে
জুম ইন হয়েছে শুধু মিটিংটাই। জুম আউট হয়ে গেছে বাকি সব।
ভুল শুনল নাকি? হ্যাঁ হ্যাঁ ভুল তো বটেই।
নাহলে আর এই ঘোর লকডাউনের সন্ধ্যায় একটা ট্রেনের মিষ্টি ভোঁ আর সুমধুর ঘড়ঘড় আওয়াজ আসবে
কোথা থেকে। লকডাউনের এই নিষিদ্ধ নরকে অমন আওয়াজের অনুপ্রবেশ পর্যন্ত যেখানে একটা
অপরাধ সেখানে শুভব্রত সেটা শুনবে কি করে?
আওয়াজ শুধু শুনলই না দেখতেও পেল শুভ। দোতলার
জানলা থেকে ট্রেন দেখাও যায়। সন্ধ্যের অন্ধকার যদিও এখন বেশ ঘন তবু সে ঠিক দেখেছে।
কিন্তু সমস্যা হল ট্রেন ঢোকার আওয়াজ সে শুনল বটে কিন্তু ছাড়ার তো নয়? অথচ প্রায় মিনিট তিনেক হয়ে
গেল। কোনও লোকাল ট্রেন তো এতক্ষণ দাঁড়ায় না। বড় জোর কুড়ি কি তিরিশ সেকেন্ড এর বেশি
নয়। পুজো বা অন্য কারণে খুব ভীড়ের জন্যে বড় জোর এক থেকে দেড় মিনিট। কিন্তু লকডাউনে
আর ভীড় কোথায়?
তার মানে ট্রেনটা তাদের স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে? কিন্তু কেন? এটা কি কোনো স্পেশাল ট্রেন? স্পেশাল ট্রেন আছে সে
শুনেছে যারা অনুমতি সাপেক্ষে বিশেষ লোকেদের নিয়ে যায়। কিন্তু এ লাইনে তেমন কিছুই
যায় না। এখান দিয়ে এখন মালগাড়িও যায় না।
মনের মধ্যেটা যেন কেমন ছটফট করছে। আপাতত
অফিসের কাজ আর নেই। এইবেলা একটু ঘুরে এলে মন্দ কি? স্টেশনের ওই ট্রেনের ভোঁ
ডাকটা তাকে বড় টানছে। গাড়িটা মনে হয় এখনও স্টেশনেই দাঁড়িয়ে আছে। কেন দাঁড়িয়ে আছে
সে ব্যাপারে তার কৌতূহল তেমন না থাকলেও ট্রেনটার চেহারা দেখার কৌতূহল তার বিস্তর
আছে।
একটু আগে অফিসের ভিডিও কল এটেন্ড করতে হয়েছিল
বলে অফিসের জামাকাপড় পরাই আছে। চট করে মুখে বেঁধে নিল মুখোসটা। ছোট্ট
স্যানিটাইজারের বোতলটা পকেটে পুরেই সে বেরিয়ে পরল।
ট্রেনটা স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল। ট্রেনের টিকিট
কাউন্টার বন্ধ। ট্রেনই নেই তো টিকিট আর কে কাটবে? কিন্তু এই ট্রেনে যারা
যাচ্ছে অথবা যাবে তারা কি টিকিট কাটবে না? হয়ত স্পেশাল ট্রেন
তাই টিকিটও নেই।
তা আপাতত যাওয়ার কোনও বাসনা নেই শুভব্রতর।
অনেক দিন পরে যেন এক পুরোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে এমনি ভাবে চলে এসেছে
ট্রেনের কাছে। ট্রেন তো তার পুরোন বন্ধু বটেই। কিন্তু সারা ট্রেন তো ফাঁকা। কেউ
নেই মানে একটাও যাত্রি নেই। আশ্চর্য এ কেমন কথা।
সত্যি কি যাত্রি নেই? দরজা দিয়ে উঁকি পাড়ল সে।
অনেক দূরে ওপাশের জানলার ধারে গুটি সুটি মেরে একজন বসে আছে। এখন তো শীতকাল নয় তবু
গায়ে একটা কাল চাদর জড়িয়েছে। খানিক আগে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে বাতাস ভিজে
স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে আর লোকটি হয়ত ঠান্ডা আকেবারে সহ্য করতে পারে না তাই চাদর
জড়িয়েছে।
কিন্তু কোথায় যাবে সে? হয় ট্রেনেই এসেছে অথবা এই
স্টেশন থেকেই উঠেছে। দ্বিতীয় সম্ভাবনা যদি ঠিক হয় তো বেশ ঝামেলার। ট্রেনটার অবস্থা
দেখে মনে হচ্ছে এটা আর কোথাও যাবে না। হয়ত যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই ফিরে যাবে।
তার মানে এই লোকটিকে হয়ত ভুল রাস্তায় যেতে হবে। একে
তাড়াতাড়ি নামতে বলা দরকার।
-আপনি কোথায় যাবেন? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল
শুভব্রত।
লোকটি কিছু বলল না জবাবে। হয়ত শুনতে পায় নি।
এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখল শুভব্রত। না কোনও পাশেই সিগন্যাল সবুজ নেই আপাতত। সে ঊঠেই
পড়ল ট্রেনে। লোকটাকে নামান দরকার। এখানে না নামলে হয়ত খুব বিপদে পড়তে পারে।
দ্রুত লোকটির কাছে চলে গেল। বিরাট এই কামরায়
একটা মাত্র লোক। তাও চাদরে আপাদমস্তক ঢাকা। সে প্রশ্ন করল, কোথায় যাবেন?
লোকটা তাকাল তার দিকে। চাদরে মোড়া মুখ। চোখে
কাল চশমা। লোকটার চোখ খারাপ নাকি? নইলে এই রাত্রে কেউ কাল
চশমা পরে? শুভ
আবার বলল, শুনছেন
এ ট্রেন কোথায় যাবে? আপনি
কি ট্রেনে করে এসেছেন নাকি এখান থেকে উঠলেন?
কাল চশমাটা সামান্য একটু এদিক ওদিক নড়ে উঠল। সম্ভবত
তার মানে কোথায় যাবে তা জানে না। সে আবার প্রশ্ন করল, আপনি কোথায় যাবেন?
আবার একই ঢঙে উত্তর এল। ট্রেনটা
যেন এবার একটু নড়ে উঠল। সে উদ্বেগের সঙ্গে বেশ একটু জোরে বলে উ্যঠল, এটা কিন্তু আবার যেখান
থেকে এসেছিল সেখানে চলে যেতে পারে।
এবার চশমা নড়ল না কিন্তু ট্রেন আবার নড়ে উঠল। আগের
থেকে বেশ একটু জোরে। ট্রেন যেদিকেই যাক শুভকে তো নামতেই হবে। চুলোয়
যাক এই লোকটাকে নিয়ে আপাতত আর মাথা ঘামাচ্ছে না। দৌড়
দিল গেটের দিকে। বাইরে দুদিকে উঁকি পেড়ে দেখল ট্রেন যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকেই সবুজ
সিগন্যাল। কি সব্বনাশ! কিন্তু ট্রেনের গতি বেশ বেশি। নামা যে খুব বিপজ্জনক।
প্ল্যাটফর্ম প্রায় শেষ হয়ে এল। এখন নামতে গেলে বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। সে মারাও
যেতে পারে। তার চেয়ে পরের স্টেশনে নামাই নিরাপদ। এর পরের স্টেশন মাত্র তিন
কিলোমিটার দূরে। ফিরতি ট্রেন হয়ত পাবে না। পাবে না অটো টোটো বা অন্য গাড়ি। তবে
সেখানে তার এক বন্ধুর বাড়ি। তাকে বললে হয়ত বাইকে করে পৌঁছে দিতে পারে তাকে বাড়িতে।
ট্রেনের গতি তখন বেশ বেড়ে গেছে। শুভব্রতর এখন
বেশ ভালই লাগছে। বাবা কত দিন পরে আজ ট্রেনে চাপল। দরজা দিয়ে আসা ট্রেনের বাইরের
হাওয়া কেমন প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। বৃষ্টির জন্যে বাতাস একটু ঠান্ডা মনে হলেও তার
বেশ ভাল লাগছিল।
যদিও বাইরে অন্ধকার তবু আন্দাজে মনে হল পরের
স্টেশন আসতে চলেছে। কিন্তু গাড়ির গতি কমছে না কেন? প্ল্যাটফর্মের সীমানায়
স্পর্শ করেছে ট্রেনটা তবু গতি কমে নি এতটুকু। এক সময় ডিঙ্গিয়ে চলেও গেল। তবু থামল
না। এ ট্রেন কি তবে গ্যালপিং কিংবা থ্রু নাকি? তার যতদূর মনে
পড়ে এই লাইনে এমন গাড়ি তো চলে না। তবে আজ কেন চলবে?
পরের স্টেশন চলে গেল। আর যে গতিতে চলছে তাতে
পরের স্টেশন এক্ষুনি এসে হাজির হবে। গাড়ির গতি কিন্তু ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে। এক এক
করে তিন চারটে স্টেশন পার হয়ে গেল গাড়ি থামার নাম নেই। এরপর সম্ভবত একটা জংশন।
জংশনে ওঠার মুখে সিগন্যালে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে এই ট্রেন।
হতাশ হয়ে সে ফিরে এসে বসল একটা সিটে আর ভাবতে
লাগল জংশন স্টেশনে নেমেই বা কিসে করে বাড়িতে ফিরবে? সেখানে তো তার কেউ বন্ধু
নেই। এদিকে বাড়িতে কাউকে তো কিছু বলা নেই। তারা চিন্তা করবে। সঙ্গে সঙ্গে ভাবল
চিন্তার কি আছে পকেটে যার মোবাইল থাকে? এতক্ষণ দুশ্চিন্তায়
মোবাইলের কথা তার মনেই ছিল না।
পকেট থেকে মোবাইল বার করে বাড়ির নম্বর টিপল।
না যোগাযোগ হচ্ছে না। সম্ভবত টাওয়ার পাচ্ছে না। সব্বনাশ এবার কি হবে? গাড়ি তো চলেই যাচ্ছে আর চলেই
যাচ্ছে। জংশন স্টেশনের আগে সিগন্যালে থামার কথা ছিল তার তো কোনও লক্ষণ নেই। তবে কি
সেই সিগন্যাল পেরিয়ে চলে গেছে? কিন্তু এদিকের আশপাশটা কেমন
অজানা অচেনা লাগছে কেন? তাহলে কি সোজা না গিয়ে জংশনের বাঁ
দিক দিয়ে বেলপুরিয়ার রেললাইন ধরে চলে গেছে? বেলপুরিয়ার দিকে
কোনও কিছুই তার জানা নয়।
এদিকে গাড়ির গতিবেগ প্রচন্ড বেড়ে গেছে। একটা
লোকাল গাড়ির গতি কি করে একটা সুপার ফাস্ট গাড়ির মত হয় সে বুঝতে পারল না। কিন্তু এত
গতির জন্যে সে টলমল করছে। নিজেকে সামলে রাখা দায়। অনেক কষ্টে ধরে ধরে ভেতরে এসে সে
সিটে বসে পড়ল।
জানলা দিয়ে তাকাল বাইরে ধোঁয়া ধোঁয়া। কিছুই
দেখা যায় না। শুধুই জমাট বাঁধা অন্ধকার। জানলা থেকে ভেতরে চোখ ফেরাল। এদিক ওদিক
করতে করতে চোখ গিয়ে পড়ল সেই লোকটির ওপর। এতক্ষণ তার কথা ভুলেই ছিল। বলতে গেলে সেই
লোকটির কথা ভেবেই তো তার এই গাড়িতে উঠে পড়ে আর নামতে না পারা।
লোকটা একদৃষ্টে তার দিকেই চেয়ে আছে। তবে
লোকটা ঠিক নয় তার চশমাটা। আপাদমস্তক ঢাকা লোকটার শুধু এই চশমাটাই যেন খোলা। কিন্তু তার দিকেই বা চেয়ে
আছে কেন? ভয়ে নাকি
কৌতূহলে?
ভীষণ রাগ হল তার। এর জন্যেই তো এত বিভ্রাট।
চোখ ফিরিয়ে নিল শুভব্রত। এর আগেও সে সাবধান করতে এসেছিল লোকটাকে। কিন্তু কোনও কথাই
বলে নি সে। তাই আর নিজে থেকে কথা বলতে মন চাইল না।
কিছুক্ষণ পরে অভ্যাস বশে চাইল আবার। লোকটা
সেই আগের মতই চেয়ে আছে। না না চেয়ে আছে তার কাল চশমাটা। যার আড়ালে থাকা দৃষ্টি
থেকে তার মনের ভাব আন্দাজ করা কঠিন তার পক্ষে। তাই তার মনে হল যেন ফ্যাল ফ্যাল করে
তাকিয়ে আছে।
চোখ ফিরিয়ে নিল শুভ। পকেট থেকে মোবাইল বার
করল। রাত সাতটা পঁয়ত্রিশ। ঠিক একঘন্টা আগে সে ট্রেনে উঠছে। এত গতিতে কোথাও না থেমে
ট্রেনটা তাহলে কত দূর চলে এল আন্দাজ করে মনে মনে চমকে উঠল। এখন যদি এ ট্রেন থামেও
তবে ফিরতি ট্রেন না পেলে ফেরা খুব মুশকিল।
মোবাইলে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল।
কিন্তু বারবার ব্যর্থ চেষ্টা। প্রায় দশ পনের মিনিট কেটে গেল। বিরক্তিতে আর আশংকায়
নাক মুখ কুঁচকে বসে রইল। এমন বিপদেও লোকে পড়ে?
একটু ঘুম লেগে গিয়ে থাকবে হয়ত। হঠাৎ একটা
ঝাঁকুনিতে সেটা ভেঙ্গে গেল। চমকে তাকিয়ে দেখল গাড়িটা হঠাৎ থেমে গেছে। জানলার বাইরে
ঘন অন্ধকার। তার মানে এটা কোনও স্টেশন নয়। চোখ পড়ে গেল সেই লোকটির দিকে। আরে সে
কোথায় গেল? নেমে গেল
নাকি? কিন্তু কোথায় নামল? এ তো কোনও
স্টেশন নয়? নাকি তার ঘুমের মধ্যেই আর কোনও স্টেশনে থেমেছিল
আর সে এই সুযোগে নেমে গেছে? ইস কেন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল। এই
বিচ্ছিরি বেলাগাম ট্রেন থেকে সে মুক্তি পাওয়ার সুযোগটাও হারাল।
চুলোয় যাক লোকটার ভাবনা। আসলে এই লোকটার
জন্যেই তো তার এই শাস্তি। এখন মনে হচ্ছে হাতে পেলে লোকটাকে বেশ দু’ঘা বসিয়ে দিত।
মোবাইল বার ঘরে সময় দেখল। ইস রাত এখন দশটা বেজে পঁয়ত্রিশ। তার মানে টানা তিনঘন্টা
ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সে?
পেট চুঁই চুঁই করছে। বাড়িতে কি মনে করছে কে জানে। রাত সাড়ে নটায়
অফিসের বসের কাছ থেকে একটা ফোন আসার কথা ছিল। তড়িঘড়ি মোবাইলের কল লিস্ট ঘাঁটতে
লাগল সে। না কোনও ফোন তো আসে নি। বাড়িতে আবার ডায়াল করে দেখল সেটা লাগল না।
যান্ত্রিক উত্তর ঢুকল কানে, এই অঞ্চল সমস্ত নেটওয়ার্ক
পরিষেবার বাইরে।
এবার লোকটার কথা মনে হল তার। আচ্ছা সে কোথায়
গেল? এ তো একটা
লোকাল ট্রেন। এতে বাথরুম নেই যে লোকটা বাথরুমে যাবে। আর যদি যায়ও তবে একটা মানুষ
কতক্ষণ বাথরুমে থাকতে পারে? অন্তত কুড়ি মিনিট কেটে গেছে
ইতিমধ্যে। বাথরুমে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে অবশ্য একটা কথা।
ওরে বাবা কেঁপে উঠল শুভ। সত্যি যদি তেমন হয়
তো কি করবে সে এই নির্জন জায়গায় একটা অসুস্থ মানুষকে নিয়ে? মানবিকতার খাতিরে ফেলে তো আর
আসতে পারে না?
ধড়মড় করে উঠে পড়ল। এদিক ওদিক দেখে নিশ্চিন্ত
হল এই ট্রেনের কোনও জায়গায় বাথরুম বলে কোনও কিছুই নেই। তবে কি প্রকৃতির ডাকে লোকটা
ট্রেন থেকে নেমে মাঠেই চলে গেল নাকি?
হঠ্যাৎ নিজের তলপেটটাও কেমন মোচড় দিয়ে উঠল
শুভর। একি সর্বনাশ। শেষে কি এই মাঠে ঘাটেই করে ফেলতে হবে নাকি? এদিকে ট্রেনের তো চাকা বেঁধে
দিয়েছে কে যেন। উপায় না দেখে লাফিয়ে নেমে পড়ল নিচে। অন্ধকারে লাইনের ধারে পড়ে থাকা
এবড়ো খেবড়ো পাথরে ধাক্কা লেগে পায়ে একটু কেটে গেল বটে। কিন্তু কি আর করা যাবে।
ভাল করে সিগন্যাল পোস্ট লক্ষ করে দেখে নিল।
না সেগুলো এখনও লাল চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জলত্যাগ করতে না করতে দূর থেকে
দেখতে লাগল সিগন্যাল সবুজ হয়ে যায় কিনা। লাল দেখে নিশ্চিন্ত হল।
চারিদিকে জঙ্গলে ঘেরা। বেশির ভাগ নাম না জানা
আগাছা হলেও কিছু বড় গাছও আছে। গাছের ফাঁক দিয়ে গোল চাঁদটাকে দেখে বেশ ভাল লাগল
তার। এদিক ওদিকে জঙ্গলের ওপর সাদা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে। যেন কেউ হালকা হলদে আর
সাদা রঙ মেশান পাউডার ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাতাস তাই কেমন ঈষৎ ধোঁয়া ধোঁয়া যেন। ভাল লাগে
আবার কেমন যেন গা ছমছম করে।
কাজ শেষ করে পেছন ফিরল শুভ। আর ফিরেই
জ্যোৎস্না রাতেই তার মাথায় যেন একটা বাজ এসে পড়ল। একটু দূরে রেল লাইনের ওপর থেকে
ট্রেনটা বেমালুম উধাও। কোনও চিহ্ন নেই সে ট্রেনের। যেখানে সেটা দাঁড়িয়েছিল সেখানে
এখন লোহার লাইনটা চাঁদের আলোয় চকচক করে যেন হাসছে তার দিকে তাকিয়ে।
কোথায় গেল ট্রেনটা? আর কখনই বা গেল। চুপি চুপি
তো একটা ট্রেন চলে যেতে পারে না? আওয়াজ তো হবেই। এই তো খানিক
আগেই মাঠের ওপর দিয়ে ছুটছিল গাড়িটা তখন গাঁক গাঁক করে কি বিকট আওয়াজ হচ্ছিল। এতদিন
পরে এই আওয়াজ তার মনে অবশ্য বেশ আনন্দই দিচ্ছিল।
বেশ মনে পড়ছে তখন সিগন্যাল লাল দেখে সে
নিশ্চিন্ত হয়েছিল। সবুজ দেখলেই সে দৌড়ে এসে উঠে পড়তে পারবে। যদিও লোকাল এমু
কোচগুলোতে সিঁড়ি থাকে না। বেশ কসরত করে ঝুঁকি নিয়ে উঠতে হয়। তবে সে হয়ত পারত ঠিক।
কিন্তু কখন যে সিগন্যাল সবুজ হল আর গাড়ি স্টার্ট হল তার মাথাতেই ঢুকছে না।
যখনই যাক আর যেমন ভাবেই যাক গাড়িটা যে চলে
গেছে এটা তো ঠিক। স্টেশন হলেও নাহয় কথা ছিল কিন্তু এ যে জনমানবহীন এক দিগন্ত
বিস্তৃত মাঠ। জায়গাটার নামও সে জানে না। আর এখন রাত অন্তত সাড়ে দশটা এগারটা হবে।
পেট খিদেয় চুঁই চুঁই করছে আর বুকটা ভয়ে ধড়ফড়
করছে। ভূতটুতের ভয় শুভর কোনোকালেই নেই। কিন্তু অজানা জায়গায় এত রাতে এসে পড়াটা
ভয়ের তো বটেই। যদিও তাড়াতাড়ি করে এসে পড়ায় তার পকেটে একটি পয়সাও নেই। থাকার মধ্যে
আছে সাড়ে আঠার হাজার টাকার এই মোবাইলটা। এটা যদি ছিনতাই হয়ে যায় তো ওই কটা টাকার
জন্যে শোক মোটেই করবে না সে। কিন্তু শোক করবে অন্য জিনিসের জন্যে। কারণ একটি মাত্র
সবেধন নীলমণি এই মোবাইল যে তার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। যদিও একটু আগে পর্যন্ত
নেটওয়ার্ক সে খুঁজে পায় নি তাই বলে কখনও তা খুঁজে পাওয়া যাবে না তা তো আর নয়।
তাছাড়া এই মোবাইলে রয়েছে অফিসের কত গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট। সেগুলো খোয়া গেলে তাকে
খুব মুশকিলে পড়তে হবে। সেগুলো কারোর হাতে পড়ে গিয়ে অফিসের ক্ষতি হলে অফিস কি তাকে
ছেড়ে দেবে?
ভাবল প্রথমে একটা ঠিকানা খোঁজা দরকার। সবচেয়ে
ভাল ঠিকানা হল রেলের একটা স্টেশন। লাইন ধরে হাঁটা যাক খানিক দূরে নিশ্চয় একটা
স্টেশন পড়বে। সমস্যা হল এগিয়ে বা পেছিয়ে যেকোনো দিকে গেলেই স্টেশন পাওয়া যেতে
পারে। কিন্তু কথা হল কোন স্টেশনটা আগে হবে।
মনে মনে একটা হিসেব করল সে। এখানে থামার
প্রায় মিনিট দুয়েক আগে জানলা দিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া একটা স্টেশন যেন সে পেরিয়ে যেতে দেখেছিল।
তার মানে যে স্টেশন সে ছেড়ে এসেছে সেটা বেশ দূরে। হয়ত কাছের হবে সামনেরটা। এই
লাইনে স্টেশনগুলি বেশি দূরে দূরে হয় না।
হাঁটছে তো হাঁটছেই। লাইন ধরে হাঁটা কম কষ্টের
নয়। আবার কখনও এই বুঝি পেছন থেকে ট্রেন এস যায় এই ভয়ে লাইন থেকে নেমে জমিতে পাতা
স্লিপার কিংবা এবড়ো খেবড়ো পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। লক্ষ করছে সামনেটা কিন্তু
সর্বদা সে কান খাড়া করে আছে কোথাও ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে কিনা। পেছন থেকে হঠাৎ
ট্রেন এসে পড়লেই তো মহা ঝামেলা।
খুব বিরক্ত লাগছিল শুভব্রতর। সজাগ কান কিন্তু
হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠল। বনের মধ্যে কোথা থেকে যেন হঠাৎ একটা হাওয়া উঠল শন শন করে।
সেই হাওয়াতে ডান দিকের গাছের পাতাগুলো সরে সরে যেতেই ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ল একটা
জিনিস। একটা বিরাটা বড় পুরোন বাড়ি। চাঁদের আলো পড়ে বেশ চকচক করছে।
কৌতূহল হল শুভর। এই নির্জন জায়গায় রেললাইনের
ধারে এতবড় একটা বাড়ি?
বাড়ি তো নয় যেন প্রাসাদ। থাকতেই পারে। বহু জায়গায় বহু পুরোন জমিদার
বাড়ি বা রাজবাড়ি কত আছে। সে আর কতটুকুই বা জানে? কিন্তু
আপাতত এই প্রাসাদ নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। এটা দিনের আলোয় ঊজ্জ্বল জায়গা নয় যে
ভ্রমণের নেশা পূরণ করবে।
সোজা হেঁটে যাওয়া যাক লাইন ধরে। মনে হচ্ছে দশ
পনের মিনিট হাঁটলেই একটা স্টেশন চলে আসবে। স্টেশন এলেই তার নামও দেখা যাবে। তখন
গুগুল সার্চ করে বিস্তারিত জানা যাবে এই প্রাসাদটার। কোথা দিয়ে কিভাবে আসা যায়
এখানে সে হদিসও অবশ্যই থাকবে।
হঠাৎ কেমন ছায়া ছায়া হয়ে আসতে লাগল
চারিপাশটা। কেমন যেন অন্ধকারময়। সন্দেহ হতে আকাশের দিকে তাকাল সে। আকাশে ছেঁড়া
ছেঁড়া কালো কালো মেঘ জড় হচ্ছে। সবাই যেন শুভর মাথার ঠিক ওপরে ভিড় জমানোর
প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে।
শুভর মনেও ভয়ের কাল মেঘ জড় হতে লাগল। কি
সব্বনাশ যদি বৃষ্টি হয়?
এই তো সন্ধ্যের একটু আগেই মুশলধারে বৃষ্টি হয়ে গেল। কিন্তু তখন ঘরে
বসে ল্যাপটপে বসে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছিল বলে সেই বৃষ্টির আওয়াজ তার কানে মধু
ঢালছিল। কিন্তু এখন যদি নামে অমন জল? এই কাঁটাঝোপ আর আগাছা
ভরা মাঠে মাথার ওপর এক চিলতে ঢাকনা খুঁজে পাওয়া ভার। নেহাত ট্রেন দেখতে আসার
উন্মাদনায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার স্টেশনে আসা। সঙ্গে নেই ছাতা বা রেনকোট কিছুই।
লাইন দিয়ে ছোটা বিপজ্জনক। সামান্য যা ফোঁটা
ফোঁটা জল পড়েছে তাতে এমন পেছল লাইনের ওপর ছুটতে গেলে পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙতে পারে।
আর পাশের পাথর বা ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে তো আরও অসম্ভব। এদিকে জলের ফোঁটাগুলো তো
যেমন বড় হচ্ছে তেমনি তাদের গতিও বাড়ছে। এলোমেলো হাওয়াও ছুটে এল যেন কোথা থেকে।
না আর এগোন যাবে না। এই মুহুর্তে মাথার ওপর
একটা ছাউনি দরকার। কিন্তু আশপাশে কোথাও কোনও বড় গাছ পর্যন্ত নেই। তবে একটা আশ্রয়
একটু কষ্ট করে হয়ত পাওয়া যেতে পারে। তা হল জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই
প্রাসাদটা।
সেদিকেই হাঁটা দিল অগত্যা। এখানে সিঙ্গেল
লাইন। তার মানে বেশি গাড়ি চলে না। লাইন থেকে নেমে ডানদিকে
মাঠে নামল সে। এবার জঙ্গলের দিকে এগোবার মুখে সে একটু থামল। নির্জন এই প্রাসাদে
তার জন্যে আর কোনও বিপদ অপেক্ষা করছে কিনা কে জানে। তার চেয়ে একটু অপেক্ষা করলে হয়
না? মেঘটা মনে
হয় পাতলা হচ্ছে। বৃষ্টিটা থেমেও তো যেতে পারে?
কিন্তু থামল না পরিবর্তে আরও বেড়ে গেল। মাথার
দুই হাত চেপে ধরে মাথার ওপর জল পড়াটা কোনও মতে আটকানো গেল। কিন্তু জামা প্যান্ট
ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া ছুঁচের বিঁধছে যেন। সে বড়
অস্বস্তিকর অবস্থা। পরিণতি না ভেবেই সে ছুটল ঝোপের দিকে।
ঝোপের মধ্যে দিয়ে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে
হচ্ছে তাকে। বাড়িটার ক্রমেই কাছে এসে পড়ছে সে। এমন সময় বৃষ্টিটা ধরে গেল। থমকে
গিয়ে শুভ একবার ভাবল আবার লাইন ধরে সে হাঁটা দেবে কিনা। কিন্তু লাইন এখন এত দূরে
যে সেখানে যেতে না যেতে আবার একবার জল নেমে আসতে পারে। তার চেয়ে বাড়িটা বরং অনেক
কাছে। মাত্র যেন দুই বা একশ ফুট দূরে। আগের মত জ্যোৎস্না আর নেই বটে। সাদা চাঁদের
আলোটা ময়লা হয়ে ছিটকে পড়ছে ভাঙ্গা প্রাসাদের গায়ে।
দূরে তিনতলা উঁচু প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে তার
গা ছমছম করে উঠল। আড় ময়লা আলোয় কেমন ভূতুড়ে মায়াপুরী বলে মনে হচ্ছে। একভাবে তাকিয়ে
দেখলে মনে হয় যেন অনেক ছায়া এদিক ওদিক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনও কোনও ছায়া আবার
যেতে যেতেই যেন একটু দাঁড়িয়ে পড়ে অন্য ছায়ার সঙ্গে কিছু কথা সেরে নিচ্ছে।
দূরে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল এ
বাড়িতে সে ঢুকবে কি ঢুকবে না। সে খুব একটা ভীতু নয়। ভূতের ভয় তার কোনোকালেই নেই।
তবে এখানে লুকিয়ে থাকতে পারে চোর-ডাকাত-গুন্ডা-বদমাশ বা কোনও সাংঘাতিক অপরাধী। তার
তার কাছে এই মুহূর্তে মোবাইল ছাড়া আর কিছু না পেলেও তাকে লুকিয়ে রেখে বাড়ি থেকে
মুক্তিপণ আদায় করতে পারে।
অথবা এই খুব পুরোন বাড়ির ভেতরে শেয়াল, বুনো কুকুর বা অন্য কোনও
হিংস্র বা বিষাক্ত জীবজন্তু বা পোকামাকড় থাকতে পারে। তাই এখানে ঢোকার আগে একটু
ভেবে নেয়া ভাল। এদিকে মনের মধ্যে একটা অ্যাডভেঞ্চারের নেশা প্রবল হয়ে উঠছে। এই
বাড়িতে রাত কাটিয়ে কাল সকালে বাড়ি ফিরে গিয়ে এই ভয়ংকর রাতের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার
কথা বলতে পারবে সবাইকে। দরকার হলে তার তোলা ছবি দিয়ে
ইউ টিউবে কোনও ভিডিও ছে্ড়ে দিতে পারে। লোম খাড়া করা এই ভিডিওর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে
ভিউয়ারের দল। ভাল বিজ্ঞাপনও পেয়ে যেতে পারে চ্যানেলটার জন্যে।
তাই প্রাসাদের দিকেই যাওয়া যাক। দূরের ট্রেন
লাইন থেকে একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোনও আওয়াজ আসছে না। তার মানে ট্রেন
আসার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাছাড়া এখন সাড়ে এগারটা বেজে গেছে।
ট্রেন চালু থাকলে লাস্ট ট্রেনও এতক্ষণ চলে যেত।
দ্বিধা নিয়ে পায়ে পায়ে এগোতে লাগল শুভ। মাঝে
মাঝে নিজের ছায়াটাকেও তার যেন অন্য কারোর ছায়া বলে ভুল হতে লাগল। আবার
সেই সঙ্গে একটা ভুল ভেঙ্গেও যেতে লাগল যে আগে সে যেমন দেখেছিল ছায়ামূর্তিরা চলাচল
করছে আসলে তা নয়। আকাশে মেঘগুলো ধীরে ধীরে আসছে আবার কোনও বড় মেঘের মধ্যে মিশে
যাচ্ছে। তাদের ছায়াই অমন ছায়ামূর্তির মত মনে হচ্ছিল তার কাছে। ভুল
ভেঙ্গে গিয়ে বেশ মনের ভেতরটা হালকা মনে হতে লাগল তার।
প্রাসাদের প্রাঙ্গনে যখন প্রবেশ করেছে তখন
মেঘ আরও বেশি করে ঢেকে এসেছে আকাশে। তার মানে এক্ষুনি বৃষ্টি আবার নামবে। ইতস্ততত
পায়ে সে এগিয়ে চলেছে মরচে ধরা আর একপাশে এলিয়ে পড়া লোহার বড় গেটটার দিকে। গেটটা
একেবারেই আধুনিক নয়। ধাঁচ দেখে অন্তত দু তিনশ বছরের পুরোন মনে হয়। গেটের মাথায়
একটা বিরাট খিলেনের দেওয়াল ছিল। তার মাঝে একটা অদ্ভুত ঈগল আঁকা ফলক। অবশ্য ঠিক
আঁকা নয়। সাবেক কাল তাই চুন-সুরকি দিয়ে কাজ করা হয়ত। সেই দেওয়াল আর ঈগল আঁকা ফলক
অটুট থাকলেও গেট এলিয়ে পড়েছে দুদিকে। ঈগলের মূর্তিটা চটে চটে গেছে এদিক ওদিক।
কোথায় যেন দেখেছে দেখেছে বলে মনে হল শুভর এই গেটটা। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল
না।
গেট ডিঙ্গিয়ে ঢুকে পড়েছে ভেতরে। আবছা
অন্ধকারে চলতে একটু কষ্ট হচ্ছে। একবার মনে হল মোবাইলের টর্চ জ্বেলে নেয়। পরক্ষণেই
মনে হল এর ভেতরে এখনও রহস্য ছাড়া আর কিছু আছে কিনা তার জানা নেই। তাই মোবাইলের আলো
জ্বেলে ভেতরের অধিবাসীদের তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ করে দেবার কোনও মানে হয় না।
ভেতরে ঢুকে পড়েছে শুভ। ভেতরে অন্ধকারটা বেশ
ঘন। একটু গিয়েই পাওয়া গেল একটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি ধরে উঠতে লাগল সে।
এক-দুই-তিন-চার---। মাত্র চার ধাপ ওঠার পরেই একটা চাপা আওয়াজ ধরা পড়ল তার কানে।
মনে মনে উল্লসিত হয়ে উঠল সে। তার মানে একেবারে পরিত্যক্ত এই প্রাসাদ নয়। মানুষ আছে
কিছু। প্রাসাদের কেয়ারটেকার জাতীয় কিছু হবে হয়ত। অতএব আজ রাতটা কাটাতে তেমন
অসুবিধে হবে না।
মাঝে একবার মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে দেখে নিল
সে। একটু আন্দাজ পেলেই বাকিটা উঠে যাওয়া যাবে। ল্যান্ডিং-এ পৌঁছে আবার একটু টর্চ
জ্বেলে দেখে নিল সে। টর্চ নিভিয়ে কান খাড়া করে শুনে নিল ভেতরে বিপদের কিছু আশংকা
আছে কিনা জানতে।
আবার উঠতে শুরু করেছে সে। একসময় উঠে গেল যেটা
তার মনে হল একটা বারান্দা গোছের। সম্ভবত সিঁড়িটা ওপরের বারান্দায় গিয়ে পড়েছে।
বারান্দাটা খোলা। বাইরে আকাশ দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে কালো মেঘের জটলার মধ্যে
থেকে উঁকি পাড়া একটু চাঁদের আলোর। সেই আলো মনের ভয় তার বেশ একটু কমিয়ে দিল।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত ভাবতে হল কোন
দিকে সে যাবে। বেশ কিছু দূর থেকে হালকা একটা শব্দ ভেসে এল। অনেকক্ষণ কান খাড়া করে
শুনে সে বুঝল এটা একটা চাপা কান্নার আওয়াজ। চমকে উঠল সে। কে কাঁদে আর
কেনই বা কাঁদে?
পকেট থেকে আবার মোবাইল বার করে দেখল রাত এখন বারটা কুড়ি। এতটা রাত
হয়ে গেছে বোঝাই যাচ্ছিল না। কোথা দিয়ে যে সময়টা কেটে গেল।
এগোতে গিয়েই বাধা। কিসে যেন পা আটকে গেল তার।
হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল। অতিকষ্টে সামলে নিল। কিন্তু কিসে পা আটকাল? মেঝেতে কি পড়ে আছে? মোবাইলের টর্চ সাবধানে জ্বালল সে।
একেবারে লাফিয়ে সরে যেতে হল তিনহাত। একটা লোক
শুয়ে আছে। আরে আশ্চর্য তো মানুষটা? শুভ তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল তবু চেতনা হল
না? এই বারান্দা কি শোবার জায়গা? কিন্তু
এততেও ঘুম ভাঙল না কেন সেটা একটা প্রশ্ন।
তবে কি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে? এ কি তারই মত কৌতূহলী হয়ে
এসেছিল এই প্রাসাদে? ভূত দেখার উৎসাহ নিয়ে নয়তো? অনেকেই আসে তবে শেষ পর্যন্ত সাহস আর ধরে রাখতে পারে না। অমনি বুক আবার দূর
দূর করে উঠল শুভর। এখানে উল্টোপাল্টা কিছু কিছু দেখে কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে?
তার মানে উল্টোপাল্টা হয়ত কিছু আছে। অথবা লোকটার বুকের পাটাই একটু
উল্টোপাল্টা- একেবারে সমতল নয়।
শুভর সাহস বেশ। সে ভাবল এই লোকটার জ্ঞান
ফেরান যায় কিনা দেখা উচিত। ফিরলে তার থেকে এই বাড়ির বিষয়ে কিছু জানা যাবে। সে এবার
হাত দিয়ে লোকটাকে ঠেলা দিল। কিছুই হল না। লোকটা নড়ল না পর্যন্ত। এবার সে তাকে চিত
করে শুইয়ে দিল।
লোকটার বুক রক্তে ভিজে। সারা বুকটা। তার মানে
কেউ লোকটাকে গুলি করেছে অথবা ছুরি মেরেছে। কিন্তু রক্তটা এখন লাল। কালচে জমাট
বাঁধা হয় নি। তার মানে খুনটা বেশিক্ষণ হয় নি।
বারান্দা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে একটু দূরে আবার
উলটে পড়ছিল। আবার একটা লাশ। আবার খানিক দূরে। সারা বারান্দাটায় অন্তত চার পাঁচটা
লাশ। এবার তার কিন্তু বেশ ভয় করতে লাগল। এখানে কি একটু আগে গণহত্যা হয়ে গেল নাকি? রেললাইনের ধার থেকে এর
কিছুমাত্র আঁচ তো সে পেল না? টুঁ শব্দ পর্যন্ত করে নি কেউ?
এবার সেই চাপা কান্নার আওয়াজ বেশ জোরদার
হয়েছে। তার মানে নিকটেই কেউ কাঁদছে। কান্নার আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে যে কাঁদছে সে
একটা মেয়ে। তার মানে আবার একজন খুন হতে যাচ্ছে। কিন্তু শুভব্রতর চোখের সামনে খুনটা
হতে দিলে সেটা কি তার চরিত্রে কাপুরুষতার একটা ছাপ লেগে যাবে না? নিজেকে কাপুরুষ ভাবতে খুব
খারাপ লাগে শুভব্রতর। এককালে নিয়মিত ক্যারাটে চর্চা করে বিভিন্ন রঙের বেশ কয়েকটা
বেল্ট সে কোমরে বেঁধেছে। দুষ্টু লোকের মাথার প্যাঁচে সে ঘায়েল হতে পারে কিন্তু
শরীরের প্যাঁচে নয়।
দ্রুত পায়ে যেতে লাগল যেদিক থেকে কান্নার
শব্দটা ভেসে আসছিল সেদিকে। ঘরটার দরজার ফাঁক দিয়ে যে দৃশ্য দেখা গেল তাকে রোমহর্ষক
আখ্যা দেবে কিনা তা ভাবার সময় এখন নেই শুভর হাতে। সেই
ঘরের এক কোণে রাখা একটা কাঠের টেবিলের ওপরে একটা ল্যাম্প জ্বলছে। খুব
হালকা একটা আলো আসছে সেখান থেকে। ল্যাম্পটা কাঁচের আর ভারি
অদ্ভুত ডিজাইনের। এমন ডিজাইন হাল আমলের হতেই পারে না। তার ভেতরে রাখা তেলের জ্বলছে
একটা সলতে। সেই মৃদু আলোকে দেখল সুসজ্জিত খাটে এক সুবেশা সুন্দরী শুয়ে আছে।
রাজকন্যার মত দামি জরির পোশাক আর সারা গা মোড়া জড়োয়া গয়না। হয়ত এই প্রাসাদের রাণী।
আর তার সামনে উদ্যত এক ধারাল ছুরি। সেই ছুরিটা যার হাতে সে আপাদমস্তক কালো কাপড়ে
ঢাকা। সে উল্টোদিকে ফিরে তাই মুখ দেখা যাচ্ছে না।
সুন্দরীর ভীত সন্ত্রস্ত বিস্ফারিত চোখের দিকে
তাকিয়ে সে ভেবেই পেল না এরপর কি করতে হবে। মাথায় বুদ্ধির প্যাঁচ কষবে কি হাতে
ক্যারাটের প্যাঁচ কষবে ভেবে পেল না। তবে তার বাস্তব বোধ বলল বাইরে যতগুলো লোককে
খুন করেছে সে যদি এক এই লোকটা তবে একে কব্জা করা খুব সহজ কাজ হবে না।
ঝট করে পকেটে হাত ঢোকাল মোবাইল বার করার জন্যে।
তার মনে হল পুলিশে ফোন করাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কাজ। কিন্তু এই জঙ্গলে ঘেরা
প্রাসাদে পুলিশ যে কতক্ষণে এসে পৌঁছবে তাও তো বুঝে উঠতে পারছে না। তাতে এই ঘোর
দুর্যোগ। এই প্রাসাদ থেকে বেরোবার বা এই প্রাসাদে ঢোকার কোনও রাস্তা বা সড়ক এখনও
পর্যন্ত চোখে পড়ে নি।
মোবাইলে হাত ঠেকিয়েই তার মনে হল এ অঞ্চলে তো
টাওয়ার থাকেই না। এর আগেও বাড়িতে ফোন করার কত চেষ্টা করেছে। ফোন করে বৃথা খানিকটা
সময় নষ্ট করার চেয়ে এই মহিলাটিকে সাহায্য করা খুব দরকার।
একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিল মহিলাটির দিকে
এগোতে। হোঁচট খেতে হল কি যেন পায়ে লেগে। আরে
আবার একটা মানুষ মনে হচ্ছে। তার পায়ের ধাক্কায় সে
লোকটা উলটে গেছে। আর তখুনি দেখল তার বুক লালে লাল। তার
মানে আবার একটা মৃতদেহ? একটা
মাত্র খুনী এতগুলো খুন একাই করছে কি করে? এ তো সাংঘাতিক খুনী। এই
ভয়ংকর লোকের সঙ্গে কি সে একা এঁটে উঠতে পারবে?
কিন্তু তার পায়ের এই শব্দে খুনী তার দিকে
ফিরল। যদিও সেই ল্যাম্পের অতি মৃদু আলো। তাতে আলোটা
পড়ছে দেওয়ালের দিক থেকে এদিকে। তার মানে খুনীর মুখ অন্ধকার। তবু খুনীর মুখ এতক্ষণে
একেবারে পরিষ্কার দেখতে পেল শুভ। মাথাটা ঘুরতে লাগল তার বোঁ বোঁ করে। মাথা ঝিম ঝিম
করছে। চোখের দৃষ্টিতে চারপাশ আবছা হয়ে আসছে।
পুরোপুরি অন্ধকার হওয়ার আগে সে খুনীর মুখটা
ভাল করে দেখতে পেয়েছিল বৈকি। হয়ত ল্যাম্পের আলো পড়ে ঝকঝক করে উঠেছিল ছুরিটা আর সেই
আলোতেই মুখটা সে দেখেছিল।
রক্তমাংস ছাড়া কতগুলো হাড় সাজানো করোটির
গর্তে দুটো আগুনের ভাঁটা বসান ছিল। রক্তমাংস না থেকে হাড়সর্বস্ব হলে সে মুখের ভাব
বোঝা মুশকিল হত। তবে সেই ভাবের অভাব পূর্ণ করেছিল লাল ভাঁটার মত ক্রুর দৃষ্টিটা।
গল্পের বইয়ের পাতা থেকে কোনও এক দক্ষ শিল্পীর আঁকা একটা নারকীয় ছবি যেন তড়াক করে
লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে শুভর সামনে। এমন একটা ছবি যেটার দিকে মাত্র কুড়ি সেকেন্ডের
বেশি তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয় শুভর মত সাহসী যুবকেরও।
ছুরি সমেত সেই হাতটা এবার এগিয়ে আসছে তার
দিকে। এতক্ষণ চোখে পড়ল। ছুরি ধরা সেই মুঠিটাও সম্পূর্ণ হাড় দিয়েই তৈরি। ছুরিটার
দিকেও চোখ পড়ে গেল এবার বেশ ভাল ভাবে। ছুরিটা থেকে টকটকে লাল রক্ত টসটস করে গড়িয়ে
পড়ছে।
মাথা ঝিমুনিটা কেটে গেল শুভর। মানে কাটাতেই
হল। মুহূর্তে সজাগ আর সতর্ক হতে হল। আর দেরি না করে তাকে পালাতেই হবে। বন্দুকের
গুলি নয় যে দূর থেকে ছুঁড়ে দেওয়া যাবে। তবে ছুরিও যে দূর থেকে ছোঁড়া যায় না তা তো
নয়। যে লোক এতগুলো লোককে খুন করতে পারে ছুরি দিয়ে সে তো কম দক্ষ ছুরিবাজ নয়।
পেছনে ফিরেই সে দৌড় লাগানোর চেষ্টা করল। সেই
বিশ্রী খুনীটা বীভৎস হেসে উঠল হা হা করে। শুভর মনে হল হা হা নয় যেন খট খট করে
আওয়াজ হচ্ছে। মানে হাড়ে হাড় লেগে যেমন আওয়াজ ওঠে আর কি।
তখনও সেই রাজকন্যা কেঁদে কেঁদে চিৎকার করছে, আমাকে বাঁচাও হে আগন্তুক।
আমাকে বাঁচাও। আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। সবাইকে মেরে ফেলেছে। আমার খুনী দাদার হাত
থেকে আমাকে বাঁচাও।
দরজা দিয়ে ছুটে বাইরের বারান্দায়। এক অমিত
শক্তিধর হয়ে উঠেছে যেন আজ সে। মৃত্যুভয় হল জগতের সবচেয়ে বড় ভয়। সেই ভয়ই তাকে এক
প্রচন্ড শক্তি দিয়েছে। বারান্দাটা অন্ধকার। একটু আগে মেঘটা মোটামুটি কেটে গিয়েছিল।
এখন আবার জমেছে। হয়ত বাইরে বৃষ্টিও পড়ছে। বৃষ্টির আওয়াজ তার কানে না এলেও মেঘের
ডাক আর বাজ পড়ার শব্দ তার কানে এসে লাগছে।
কড় কড় শব্দ করে একটা বাজ পড়ল কোথাও। হয়ত খুবই
কাছে। প্রচন্ড আলো ছিটিয়ে দিয়ে গেল সে সারা বারান্দায়। ক্ষণস্থায়ী সেই তীব্র আলোয়
সে দেখল বারান্দার মেঝেতে এখানে ওখানে কংকাল পড়ে আছে। আগে যেগুলোকে সে লাশ দেখেছিল
এখন দেখা গেল সেগুলো সব দাঁত বার করা কংকাল।
ছুটতে গিয়ে কংকালে বার বার তাকে হোঁচট খেতে
হল। তবু এগিয়ে যেতে পারল সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত। এখন সিঁড়ির ধাপগুলোই যা বাধা। সে
বাধা অতিক্রম করে তরতর করে নেমে গিয়ে দাঁড়াল নিচের বারান্দায়।
বাইরে এখন মুশলধারে বৃষ্টি পড়ছে। রাতের
অন্ধকারের সঙ্গে যোগ হয়েছে কালো মেঘের অন্ধকার। এখন কি করবে সে? বৃষ্টিটা না পড়লেও নাহয়
লাফিয়ে লাফিয়ে আবার সেই ট্রেন লাইনে গিয়ে পড়তে পারত।
এক মুহূর্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে হাঁপাতে
লাগল। হাঁপ একটু কমে এলে ভাবতে বসল এবার সে কি করবে। আবার ভাবতে লাগল অসহায়
মেয়েটার কি হবে। কি নিষ্ঠুর দাদা। পরিবারের সবাইকে খুন করে একা এই বিশাল সম্পত্তি
ভোগ করবে। এ কি কোনও মানুষ নাকি কোনও শয়তান?
এমন সময় খট খট করে মাথার পেছনে সেই বিশ্রী
অট্টহাসিটা এসে হাজির। মাথা ফিরিয়েই দেখল ছুরিটা উদ্যত রয়েছে ঠিক তার মাথার ওপর।
ছুরির নিচে অস্তিত্ব নেই কোনও হাতের। চোখের নিমেষে সে ছুরি তীব্র বেগে নেমে এল তার
শরীরের অভিমুখে।
প্রচন্ড শব্দ করে বাজ পড়ল এই সময়। আর
ক্ষণিকের সেই উজ্জ্বল আলোর ঝলক মিলিয়ে যেতেই চারিদিকে শুধু আলকাতরার গোলায়
মাখামাখি।
আর দেরি নয়। নিজের ক্ষমতার ওপর রাগ হতে লাগল
শুভর। এতবড় অন্যায় যদি সহ্য করে হয় তো কি দরকার এই শক্তির? মুহূর্তে সক্রিয় হয়ে উঠল সে।
আর সবলে সেই অন্ধকারেই আন্দাজ করে ঝাপিয়ে পড়ল লোকটার ওপরে। হাতের ছুরিটা কেড়ে নিয়ে
বসিয়ে দিল তার বুকে।
ক্ষণিকে খেয়াল হল সেই রাজকুমারীর কথা। তাকে
গিয়ে বলতে হবে সে এবার নিঃশত্রু হয়েছে। তরতর করে উঠে গেল ওপরে। ভয়ার্ত রাজকন্যা
বিছানায় শুয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছে আর বলছে, হে আগন্তুক তুমি কোথায়? আমাকে এই খুনী দাদার হাত থেকে উদ্ধার কর।
-এই যে রাজকন্যা তোমার আর কোনও ভয় নেই। তোমার
খুনী দাদাকে আমি নিজে হাতে মেরে দিয়েছি।
বাইরের আওয়াজ শুনে শুভর মনে হল বৃষ্টিটা
সামান্য হলেও কমেছে। তার মানে সে মরে নি অজ্ঞান হয়ে আছে? লোকটাকে ছুরি মেরেছিল তার
মানে সে খুনী। কিন্তু সেই রাজকন্যার কি হল? সে কি বাঁচল?
অজ্ঞান হয়েছিল কিংবা মারা গিয়ে সে এখন এই প্রাসাদের ভূতের সঙ্গে
মিলে গেছে সে এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে ঠিক শেষ মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকেছিল জোরে
আর সেই আলোয় হামলাকারীর মুখ তার স্পষ্ট মনে আছে।
না কোনও কংকালের মুখ নয়। মুখটা সেই ট্রেনের
মুখঢাকা যাত্রীটার যাকে সাবধান করতে গিয়েই এই অদ্ভুত ট্রেনে তার উঠে পড়ে আর এই ভূত
দর্শন। তার মানে ভূত সত্যি আছে। ভূতে
খুন করেছে নাকি খুন হওয়ার পর ভূত হয়ে গেছে?
চোখ আপনি খুলে গেল তার। ভোরের আলো ঢুকেছে
ঘরে। আকাশে এখনও রোদের দেখা নেই। মনে হচ্ছে সারারাত বৃষ্টি পড়েছে। কিন্তু সে
বেঁচে গেল কি করে?
বুকটা কেমন ভিজে ভিজে লাগছে। তবে ছুরিটা এখনও—
ধড়মড় করে উঠে বসল। না না ছুরি তার হাতে নেই।
তার মানে সে দিব্বি বহাল তবিয়তে আছে। কিন্তু সেই রাজকন্যা? তার কাছে সে পৌঁছেছিল বটে
কিন্তু তারপর তো আর তার কিছু মনে পড়ে না।
চোখ গিয়ে পড়ল বিছানায়। একটা বই ভাঁজ করে
ওল্টানো। সামনের মলাট থেকে এখনও ভয়ংকর দাঁত বার করে ঝকঝকে ছুরি উঁচিয়ে আছে একটা
লোক। আপাদমস্তক ঢাকা হলেও মুখ দেখা যাচ্ছে। নির্জন ট্রেনের সেই ভূতূড়ে
প্যাসেঞ্জার।
এই বইটাই সে পড়ছিল গত রাতে। সব ঘটনাই তো তার
স্বপ্নের সঙ্গে মিলে গেল। শেষ কয়েক পাতা অবশ্য তার পড়তে বাকি ছিল। ঘুম এসে গিয়েছিল
বলে পড়া হয়ে ওঠে নি। রাজকন্যার পরিণতির কথাটা পড়া বাকি আছে। জানতেই হবে তার কি হল।
দ্রুত সেই পাতাগুলো পড়তে লাগল সে। রাজকন্যাকে
এস সে বলেছিল,
-এই যে রাজকন্যা তোমার আর কোনও ভয় নেই। তোমার খুনী দাদাকে আমি নিজে
হাতে মেরে দিয়েছি।
এরপর রাজকন্যা আশ্বস্ত হয়েছিল ঠিক। কিন্তু
পরক্ষণেই সে কেঁদে উঠল,
সবাই যখন চলে গেছে তবে আমি আর বেঁচে কি করব?
বলেই শুভর হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে নিজের
বুকে সবলে বসিয়ে দিয়েছিল সে।
বিখ্যাত থ্রিলার রাইটার অমরেশ বর্মনের
থ্রিলার ‘ঈগল প্রাসাদে আচমকা।‘
পড়তে পড়তে কখন যে কাহিনীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে
গিয়েছিল জানে না। হবে না?
রাইটার অমরেশ বর্ধন কি আর এমনি এমনি বিখ্যাত থ্রিলার রাইটার হয়েছেন?
No comments:
Post a Comment