1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 12, 2022

পাপলুর ইন্টারভিউ

ছবি : ইন্টারনেট


 পাপলুর ইন্টারভিউ 

অনিন্দ্য পাল 


"কি রে বুকলি? অঙ্কটা হল না এখনও? একটা সিম্পল যোগ করতে এতটা সময় লাগে কারও?" 

পাপলুর কথায় ক্লাস থ্রি এর বুকলি খাতাটা বাড়িয়ে দেয়। লালকালির পেনটা দিয়ে খাতাটা সবে দেখা শুরু করেছে কি করেনি, বাইরে বাজখাঁই গলা

-- এই পাপলু একটু বাইরে আয়! তাড়াতাড়ি আয়। 

পাপলুর বুকটা ধক করে ওঠে। এতো ছকুদার গলা। পাড়ার দাদা গোছের লোক। একটু গুণ্ডা টাইপের। কিন্তু তার মত একটা কাঠবেকার মরা গরিবের কাছে ছকুদা কেন আসবে সেটাই মাথায় আসছে না পাপলুর। কী অপরাধ করলো - সেটাই বুঝতে পারছে না সে। তড়িঘড়ি লাল কালির পেনটা বুকলির খাতার উপরে রেখে ভয়ে ভয়ে উঠে পড়লো মেঝে থেকে। 

জনা কয়েক কাচ্চাবাচ্চা পড়িয়ে আর এটা ওটা করে কোন রকমে চলে পাপলু, তার দিদি দুপুর আর অসুস্থ বাবা দ্বিজপদর। 

পায়ে পায়ে বাইরে এল পাপলু। স্পষ্ট বুঝতে পারছে বুকের ভিতর ধুকপুকানিটা বেশ বেড়ে গেছে। মনে মনে বললো, কি ফ্যাকড়া রে বাবা! 

ভাঙাচোরা দরজার চৌকাঠটা পেরিয়ে বাইরে এল পাপলু। ঘড়ঘড়ে গলায় বললো

-- ও ছকুদা তুমি! বলো। 

ছকু দরজার পাশে একটু দূরে কিছু একটা দেখছিল। পাপলু সে দিকে তাকিয়ে দেখলো, দিদি দুপুর ওখানে কিছু একটা করছে। 

পাপলুর ডাক শুনে ছকু মুখটা ঘুরিয়ে পাপলুর দিকে তাকাল। শুকনো, রোগা রোগা চেহারার ছেলেটাকে দেখে দয়া হয় না বরং বিরক্ত লাগে ছকুর। এ পাড়ায় এদের চেয়ে গরিব আর কাউকে পাওয়া যাবে না। পাপলু পড়াশুনো করেছে কিন্তু এখনও কোনো চাকরি পায়নি। পঞ্চাশ একশো টাকা মাইনেতে টিউশন পড়িয়ে বেঁচে আছে। যত্তসব শিক্ষিত অকম্মা! কতবার বলেছে পার্টিতে আয় -- কোথা থেকে আয় ইনকাম হবে, কি ভাবে পকেট ভরে যাবে বুঝতেই পারবি না। কিন্তু এসব ভদ্দর সন্তান -- তো নে না খেয়ে মর... 

-- এই নে তোর নামে এসেছে। 

ছকু একটা মুখ ছেঁড়া সাদা খাম পাপলুর হাতে তুলে দিল। 

পাপলু হতভম্ব হয়ে সেটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে ছকু। তারপর বলে

-- ভাবছিস ছকুদা আবার কবে থেকে পিওন হয়ে গেল তাই না? আরে না না! আসলে হয়েছে কি, তোর আর আমার ভাইয়ের, মানে বুটুর ভালো নাম একই, "কমল" আবার সারনেমটাও একই। পোস্টম্যান কাল এটা আমার হাতে দিয়েছিল। ভেবেছিল হয়তো ভাইয়ের। ভাই বাড়ি নেই তাই আমিই খুলেছিলাম খামটা। দেখলাম একটা চাকরির ইন্টারভিউ লেটার। বুঝলাম এটা আমার ভাই বুটুর হতে পারে না-- ফোর পাশ ছেলের তো আর... যাই হোক দেখ চাকরিটা জোটাতে পারিস কি না! 

কথাগুলো বলে পিচ্ করে একগাল গুটকার থুতু দরজার পাশে ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল ছকু। 

২.

গরম গরম ফেনাভাত আর নুন তেল দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধ গোগ্রাসে গিলে উঠে পড়লো পাপলু। দুপুর রহমতের দোকান থেকে তার জামা-প্যান্ট ইস্তিরি করিয়ে এনেছে। তিন বছরের পুরোনো জামাটা একটু রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেলেও ইস্তিরি করার পর বেশ জেল্লা দিচ্ছে। পরশুদিন প্ল্যাটফর্মের পিছনে মধুর দোকান থেকে জিনসের পুরোনো প্যান্টটা কিনে এনেছে। মধু পঞ্চাশ টাকা চেয়েছিল, তিরিশ টাকা দিয়েছে, বাকিটা পরে দেবে বলেছে। মধু তার ক্লাসেই পড়ত, ক্লাস এইটে দুবার ফেল করার পর আর স্কুলের পথে যায় নি, ব্যবসায় ঢুকে গেছে। সবজি, মাছ এমনকি ট্রেনে হকারিও করেছে মধু। এখন এই পুরোনো জামা কাপড়ের ব্যবসায় থিতু হয়েছে। বিয়েও করেছে কয়েক মাস আগে। পাপলু জানে মধু আর ওই টাকা চাইবে না, আর তারও হয়ত শোধ করা হবে না। 

অসুস্থ বাবাকে আর দিদিকে প্রণাম করে বেরিয়ে এল পাপলু। এখন রাজুর কাছে যেতে হবে, জুতো নিতে। সু  পরে না গেলে ঢুকতেই দেবে না, চিঠিতেই লেখা আছে। রাজুর কাছে একটা সু চেয়েছে। পাপলুর কোন সু নেই। অস্পষ্ট মনে পড়ে, অনেক ছোটবেলায় একটা কালো রঙের বুট জুতো ছিল, সেটা ছিঁড়ে যাবার পর আর কখনও পা ঢাকা জুতো পরার সৌভাগ্য হয় নি পাপলুর। হাওয়াই চপ্পল আর প্ল্যাস্টিকের স্যান্ডেল পরেই কেটে গেছে এত বছর। 

হাঁপাতে হাঁপাতে রাজুদের বাড়ির সামনে পৌঁছালো পাপলু। বিরাট বড়লোক, প্রচুর পয়সা, বিরাট একটা চারকোনা বাড়ি। তিনতলা বাড়িটার দোতলার ঘরে থাকে রাজু। ক্লাসের পরীক্ষায় পাপলুর খাতা টুকেই পাশ করতো রাজু। 

কয়েক সেকেন্ড রাজুর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটু থিতু হয়ে চেঁচালো পাপলু

-- রাজু, এই রাজু। আছিস? এসে গেছি রে। জুতো। 

দোতলার দিকে মুখটা উঁচু করে কথাগুলো বলে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকলো পাপলু। 

বিছানায় শুয়ে হিসেব করছিল রাজু। বাবার কন্সট্রাক্সন ব্যবসায় এখনি সে রীতিমত হাল ধরেছে, গতকাল একটা বড় সাপ্লাই দিয়েছে, এখন সেটাই দেখছিল কতটা প্রফিট ঘরে ঢুকছে। 

পাপলুর ডাকে বিরক্ত হল রাজু। হিসেবের মাঝ পথে ছেড়ে যেতে খুব রাগ হচ্ছে রাজুর। একবার জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলো

-- ওহ্ ! সেই ভিখারীটা! কি যেন একটা চেয়েছিল? মনে করতে পারলোনা রাজু। বিরক্ত মুখে জানালা থেকে জিজ্ঞাসা করল

-- কি বলছিস? এখন ব্যস্ত আছি। 

রাজু জানালা থেকে মুখটা সরিয়ে নেওয়ার আগেই নীচ থেকে পাপলু বলল

-- সেই জুতোর জন্য এসেছি রে। দিবি

পাপলুর গলায় একটা অদ্ভুত বিপন্নতা ছিল। রাজু রাগ আর বিরক্তি সত্ত্বেও সেটাকে অতিক্রম করতে পারলো না। 

ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির চাতালে রাখা কাঠের তিন তলা জুতোর বাক্সটা খুললো রাজু। কোনটা দেবে বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ রাজুর মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। বাবা সেদিন একটা লাল রঙের বুট জুতো নীচে সিঁড়ির ঘরে ফেলে দিয়েছে। জুতোটার সোলের একটা দিকের পেস্টিং খুলে গেছে তাই বাবা বাতিল করেছে। কথাটা মনে হতেই রাজু দুদ্দাড় করে নেমে গেল সিঁড়ির ঘরে। 

একটা পলিথিনে বাবার ছেঁড়া লাল বুট জোড়া মুড়ে নিয়ে এল পাপলুর কাছে

-- এই নে। 

পলিথিনে মোড়া জুতো জোড়া তুলে দিল পাপলুর হাতে। তারপর একটা বাঁকা হাসি হেসে বললো

-- যা, চাকরিটা তোর বাঁধা! 

রাজুর মুখের বাঁকা হাসিটা দেখতে পায়নি পাপলু, সে তখন জুতোর ব্যাগটা নিতে ব্যস্ত ছিল, তারপর হয়ে গেলে বললো

-- থ্যাংকু রে রাজু। আচ্ছা আমি যাই বুঝলি, দেরি হয়ে যাবে নয়তো। 

পাপলু চলে যেতে রাজু নিজের মনে হেসে ওঠে

"হা হা - শালা ভিখারীর বাচ্চা! যা ওটা পরগে যা। তোর ইন্টারভিউয়ের -- মেরে দিলাম। 

৩. 

বাস থেকে নেমে দৌড়তে শুরু করলো পাপলু। পাশের বাড়ির শিবুর থেকে চেয়ে আনা হাতঘড়িতে দেখলো ন'টা পঞ্চান্ন। পেটটা গুড়গুড় করে উঠলো পাপলুর। রিপোর্টিং টাইম দশটা! 

পকেট থেকে ভাঁজ করা ইন্টারভিউ লেটারটা বের করে ঠিকানাটা একবার দেখে নিল পাপলু। নাহ্, এটা যে কোথায় সেটা জানা তার পক্ষে সম্ভব নয়। 

এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা পানের দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করাই সুবিধাজনক মনে হল পাপলুর। 

-- কাকু, এটা কোথায়

খদ্দের ছেড়ে পানের দোকানদার তার ইন্টারভিউয়ের কাগজটা দেখে কিছু বুঝতে পারলো না, বললো 

-- মালুম নেহি। 

পাপলু ঠিকানাটা এবার জোরে জোরে একবার পড়লো। দোকানদার এবার একটা দিকে দেখিয়ে বললো

-- উস বিল্ডিং কে আসপাস হোগা। উঁহাপর জাকে পুছিয়ে। 

পাপলু দেখলো, রাস্তার ওপাশের একটা বেশ বড় ফ্ল্যাটের দিকে দেখাচ্ছে পানের দোকানদার। তড়িঘড়ি সেদিকে কিছুটা গিয়েও আবার ফিরে এল পাপলু। পানের দোকানদারকে বললো

-- থ্যাংকু কাকু। 

আবার দৌড়ালো পাপলু। রাস্তা পেরিয়ে ওপাশে যেতে হবে। সিগন্যাল অফ হতেই দৌড়ে রাস্তার ওপাশে পৌঁছালো। কিন্তু ডান পায়ের তলাটা বেশ জ্বালা করছে পাপলুর। পা-টাকে একটু সরিয়ে এদিক ওদিক করতেই আবার একটা কিছু খ্যাঁচ করে ঢুকে গেল ঠিক পায়ের নীচে। 

-- উহ্! ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো পাপলু। তারপর নীচু হয়ে ডান পায়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। একি? জুতোর সোলটাই খুলে বেরিয়ে গেছে কখন? পরার সময় দেখেছিল, ডানপায়ের জুতোর সোলটা একটু ছেড়ে গেছে। কিন্তু এভাবে খুলে বেরিয়ে যেতে পারে, তা একেবারেই বুঝতে পারে নি পাপলু। 

চোখ তুলে রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখলো, মাঝ রাস্তায় খুলে পড়ে আছে সোলটা। 

কি করা যায়? কিছুই মাথায় আসছিল না পাপলুর! হাতঘড়িতে দেখলো দশটা বাজে। তবে কি পৌঁছুতেই পারবে না? পাপলু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত! 

তখনি হঠাৎ একটা বুদ্ধি মাথায় এল পাপলুর। গাড়ি গুলোকে পাশ কাটিয়ে একছুটে গিয়ে সোলটা তুলে নিয়ে এল পাপলু। তারপর বাম পায়ের জুতোর সোলটাও একটানে খুলে নিল। দু'টো পায়ের নীচেই এখন মাটি, থুড়ি পিচের রাস্তা। 

        পাপলু সোল দুটোকে ফেলে দিতে গিয়েও রেখে দিল ব্যাগের মধ্যে। রাজুকে ফেরত দিতে হবে। তারপর  ছুটলো ইন্টারভিউ দিতে। 

৪. 

জনা দশেক চাকরি প্রার্থীর পরে পাপলুর সিভি জমা পড়েছে। ঠিক তার সামনে বসে থাকা কচ্ছপের মত লোকটা বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা ঘড়ঘড় শব্দ আসছিল সেখান থেকে। পাপলু আনমনা হয়ে দেখছিল সেদিকে। নিজেও যেন সম্মোহিত হয়ে গেছিল খানিকটা। 

"কমল মোদক কে আছেন?" 

কালো কোট পরা লোকটার ডাকে চমকে উঠলো পাপলু। তারপর তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলো

-- ইয়েস স্যার! আছি! 

-- আসুন! 

পাপলুর দুটো পায়ের নীচে বেশ জ্বালা করছিল। তবু মনটা শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো। জামা-প্যান্ট একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে এগিয়ে গেল। 

-- আসবো স্যার

দরজাটা ঠেলে মুখটা বাড়িয়ে বললো পাপলু। 

-- আসুন। ঘরের ভিতর থেকে কেউ একজন বললেন। 

ঘরের মধ্যে ঢুকে চোখ দাঁড়িয়ে গেল পাপলুর। এরকম সুন্দর ঘর আগে দেখেনি পাপলু। 

-- বসুন। 

ইন্টারভিউ বোর্ডের তিন সদস্যের একজন পাপলুকে একটা চেয়ারের দিকে ইশারা করে বসতে বললেন। 

পাপলু একটু থতমত খেয়ে ধপ করে সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লো। 

-- আপনার ডকুমেন্টস

পাপলু ব্যস্ত হয়ে ব্যাগের ভিতর থেকে ফাইলটা বের করে টেবিলের উপর রাখলো। একজন ইন্টারভিউয়ার ফাইলটা নিয়ে দেখতে লাগলো। আর একজন ইন্টারভিউয়ার চা এর কাপে চুমুক দিতে দিতে পাপলুকে জিজ্ঞাসা করলেন

-- চা খান

পাপলু তড়িঘড়ি বললো

-- বাড়িতে খাই না, টিউশন বাড়িতে দিলে খাই। 

-- আপনি টিউশন পড়ান? কোন বিষয়

-- আজ্ঞে সব বিষয়। 

-- সব বিষয়? সেই ইন্টারভিউয়ার অবাক হয়ে একটু বিদ্রূপ করে বললেন

-- আরে আপনি তো পণ্ডিত মানুষ তাহলে! তা কোন কোন ক্লাস পড়ানো হয়

-- ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াই। 

এতক্ষণ আর একজন ইন্টারভিউয়ার চুপ করে ছিলেন, এবার তিনি প্রশ্ন করলেন 

-- আচ্ছা বলুন তো, একটা শহরের নিয়ম হল, কেউ নিজের চুল নিজে কাটতে পারবে না। এখন শহরে মাত্র একজন নাপিত আছে, সে সবার চুল কেটে দেয়। প্রশ্নটা হল, নাপিতের চুল কে কাটে

প্রশ্ন শুনে পাপলুর ভিরমি খাওয়ার যোগাড় দেখে যে ইন্টারভিউয়ার তার ফাইল দেখছিলেন, তিনি একটু মিচকি হেসে বললেন

-- নিজেকে নাপিতের জায়গায় ভাবুন! 

হঠাৎ পাপলুর মাথায় একটা বুদ্ধি এল, সে প্রায় চেঁচিয়ে বললো

-- নাপিতের মাথায় টাক ছিল, তাই সে ওই শহরে এসেছে। কারণ তার চুল নেই তাই কাটতেই হয় না! 

পাপলুর উত্তর আর উত্তর দেওয়ার ভঙ্গি দেখে তিন জনেই এক সঙ্গে হো হো করে হেসে উঠলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। 

হাসতে হাসতেই পাপলুর একেবারে ডানদিকে বসা ইন্টারভিউয়ার কেমন খিঁচুনি দিয়ে চুপ করে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়লেন নীচে, মেঝের উপর। 

পাপলু হতবাক হয়ে চেয়ে রইল সেদিকে। অন্য দুজন ইন্টারভিউয়ার তখনো হাসছিলেন, চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার শব্দে সেদিকে ফিরেই আঁতকে উঠলেন একেবারে! 

দুজনেই চেয়ার ছেড়ে উঠে সেখানে চলে এলেন। পড়ে থাকা লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলেন

-- বাদলবাবু -- ও বাদলবাবু? শুনতে পাচ্ছেন? আরে কি হল আপনার

অনেকবার ডাকার পরেও যখন কোন সাড়া পাওয়া গেল না, তখন একজন বললেন

-- শুনেছিলাম বাদলবাবুর মৃগী আছে, কিন্তু এভাবে অফিসে সেটা চেপে ধরবে তা তো বুঝতে পারি নি! কি হবে এখন

দু'জন মিলে বাদলবাবুকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে ঘরের ভিতর রাখা সোফায় শুইয়ে দিলেন। 

পাপলু এতক্ষণ চুপচাপ এই সব কাণ্ডকারখানা দেখছিল। তার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। বেশ কয়েক বছর আগে তার এক ছাত্র দ্বীপের জন্মদিনে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেছিল। সেখানে দেখেছিল রানা ও ঠিক এভাবেই পড়ে গেছিল। সবাই যখন মৃগী রুগী বলছিল, তখন দ্বীপের বাবা কোথা থেকে একটা জুতোর সোল এনে শুঁকিয়ে দিতেই কয়েক মুহুর্তের মধ্যে রানা উঠে বসেছিল। 

পাপলু কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিল। তারপর ব্যাগের ভিতর থেকে খোলা সোল দুটো বার করে ছুটে গেল সোফায় পড়ে থাকা ইন্টারভিউয়ার এর কাছে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই সোল দুটো চেপে ধরলো শরীর খিঁচে থাকা অজ্ঞান মানুষটার নাকের উপর। পাপলুর এই কাণ্ড দেখে একজন ইন্টারভিউয়ার তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে গেলেন, কিন্তু টাইলসের মসৃণ মেঝেতে পিছলে তিনিও পপাত ধরনীতলে! তৃতীয় ইন্টারভিউয়ার তাকে মেঝে থেকে টেনে তুলতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। 

পাপলু সোল দুটোকে চেপে ধরেই ছিল, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই-- কি আশ্চর্য! বাদলবাবু চোখ পিটপিট করে উঠে বসলেন সোফার উপর। পাপলু তখনও সোল দুটো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাদলবাবু একটু ধাতস্থ হয়ে পাপলুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। পাপলুও মুখে বিজয়ীর হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ। 

গল্পটা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো, কিন্তু সেটা হল না। পাপলুকে বসে থাকতে হল ঠায়। 

ঘন্টাখানেক পর : 

-- বাদলবাবু আপনাকে ডাকছেন। 

পাপলু বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছিল। কি হতে পারে তার? এতক্ষণ সময় ধরে কেন শুধু তাকেই বসিয়ে রাখা হল, সেটাই তার মাথায় ঢুকছিল না। সে কি কোন অন্যায় করে ফেললো? একটা চোরা টেনশনে পাপলুর মুখটা চুন হয়ে গেছে। এই নভেম্বরের হাল্কা ঠাণ্ডায় ও পাপলু ঘামছে। 

পিওনের ডাকে ভাবনাগুলো থমকে যায় পাপলুর। বুকটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করে তার। চুপচাপ পিওনের পিছু পিছু চলে আসে বাদলবাবুর রুমের সামনে। 

-- আসবো স্যার

-- আরে এসো, এসো! ইয়াং ম্যান! ইউ সেভড্ মাই লাইফ। বসো বসো! 

পাপলুর হাতটা ধরে বসালেন বাদলবাবু। তারপর খুব খুশি হয়ে বললেন

--তোমার জন্য একটা সুখবর আছে! 

পাপলু চেয়ারে বসে খুব উৎসুক হয়ে তাকিয়ে ছিল। তার বুকের মধ্যে তখনও বেশ ধুকপুকানি চলছে। 

বাদলবাবু একটা বড় সাদা খাম তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

-- এটা নাও। তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। এটা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে, এখন বলো, জুতোর সোল দুটো তোমার কাছে এল কি ভাবে

বাদলবাবু উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন, পাপলু একটু লজ্জায় পড়ে গেল, তারপর পুরো ঘটনাটা 

খুলে বললো। সমস্ত ঘটনা শুনে বাদলবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাপলুর হাতটা ধরে বললেন

-- গরীব হওয়া কোন অপরাধ নয়। আর তুমি তো আসলে গরীব নও। তোমার মধ্যে একটা খুব ভালো মন রয়েছে, তুমি নিজেই জানো না তুমি খুব ধনী। একটু থেমে আবার বললেন

-- আমাদের বোর্ড অব ডিরেক্টর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তোমাকে আমাদের রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ব্রাঞ্চের ম্যানেজার করা হবে। আগামী কাল থেকে তোমার ট্রেনিং শুরু। দু-মাস ট্রেনিং এর পর তুমি একেবারে পার্মানেন্ট হয়ে যাবে। এখন ট্রেনিং পিরিয়ডে তুমি মাসে পাঁচ হাজার করে পাবে। পার্মানেন্ট হলে মাসে টোয়েন্টিফাইভ, প্লাস পার্কস। একটু হেসে বললেন

-- কি খুশি তো ইয়াংম্যান! 

চোখ দু'টো জলে ভরে উঠছে পাপলুর। পায়ের দিকেই তার চোখ, সোল খোলা লালবুট দুটো তখনও তার পায়ে রয়েছে। পায়ের উপরটাই যা ঢাকা আছে, পায়ের তলায় ঠাণ্ডা মেঝে। হঠাৎ রাজুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় পাপলুর মনটা ভরে উঠলো। ভাগ্যিস রাজু তাকে ছেঁড়া, সোল খোলা জুতোটা দিয়েছিল তাকে, তাই আজ এই চাকরিটা তার ভাগ্যে জুটলো। বাদলবাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল পাপলু। ঘরের বাইরে বেরোতেই পিওন তার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললো

-- স্যার, এটা বাদলবাবু আপনার জন্য কিনে এনেছেন। আপনি খুব ভালো মানুষ। কাল এটা পরে অফিসে জয়েন করবেন। 

বয়স্ক সেই পিওনকে কি বলবে বুঝতে না পেরে পাপলু কৃতজ্ঞ মুখে বললো

-- আশীর্বাদ করবেন কাকু। যেন কাজটা ঠিক করে করতে পারি। 

বাইরে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পাপলু ব্যাগটা খুলে দেখলো। ব্যাগের মধ্যে একটা বাক্সে একজোড়া একদম নতুন লাল রঙের বুট জুতো।

        দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা 
                       biltupal2009@gmail.com

                                    

No comments:

Post a Comment