1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

চিলেকোঠা

ছবি : ইন্টারনেট

 চিলেকোঠা

শম্পাশম্পি চক্রবর্তী

     বয়স যখন দশ কী বারো তখন থেকেই নিজেদের মানিকতলা এলাকায় প্রায় দু'শো বছরের পুরনো বাড়িটার ছাদের দক্ষিণ কোণে চিলেকোঠা ঘরটির প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতো রেবতী ‌। বাবা,কাকা বা জ্যাঠামশাই এমনকি বাড়ির আর সকলে  ছাদের দক্ষিণ কোণে ওই চিলেকোঠা ঘরের ধারেকাছে ঘেঁষা তো দূর তাকানোতে বারণ করেছিল ,কিন্তু কেন তা রেবতী সহ বাড়িতে তার সমবয়সী বা ছোটরা বা বড়রাও কেউ জানতো না। রেবতী 'র তুতো ভাইবোনেরা ওই ঘরের ধারে কাছে না ঘেঁষলেও রেবতী'র মন কোথায় যেন বাধা পড়ে থাকতো ওই ঘরের বন্ধ দরজার দিকে। কী আছে ওই ঘরে? এই প্রশ্ন ছাদে উঠলে তো বটেই অনেক সময় অন্য কাজের মাঝেও তার মনে আসতো। মুখে অবশ্য  কারোকে সে কথা কখনো বলেনি রেবতী কেবল তার মা সবিতা কে ছাড়া। মাঝে মধ্যে স্বপ্নও দেখতো সে অদ্ভুত সব যা ওই ঘরকে কেন্দ্র করে। ওই ঘরের মধ্যে রয়েছে রাশি রাশি সোনাদানা, রত্ন পাথর আর সে সেই সব রত্নরাশির মধ্যে যেন ডুবে যাচ্ছে চিৎকার করে উঠত সে ভয়ে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতো, তখনি মায়ের কাছে ছুটে চলে যেত পাশের ঘরে ,মায়ের পাশে শুয়ে পড়ে মা কে জড়িয়ে ধরে বলে উঠতো---" মা আমাকে চেপে ধরো। আমার খুব খুব ভয় করছে"। মা সবিতা রাগ করতো কারণ সে জানতো মেয়ের মন মাঝে মধ্যেই ছুটে বেড়ায় এই বাড়ির ওই চিলেকোঠা ঘরের দিকে যেটি প্রায় পনেরো বছর ধরে বন্ধ পড়ে আছে। 

       ভাসুর অমরনাথ বাবু' ই হঠাৎ করে বছর পনেরো আগে এক দোল উৎসবের পরের দিন চিরতরে বন্ধ করে দেন ঘরটির দরজা। কিন্তু কেন তা কারোকে বলেন না। পুরনো আসবাব পত্রে ঠাসা ঘরটি হঠাৎ করে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কারো ভালো লাগেনি বটে কিন্তু বাড়ির বড়কর্তা অমরনাথ বাবু কঠোর স্বরে সকলের উদ্দেশ্যে বলে দিয়েছিলেন যে কথাগুলি --" তাঁর জীবদ্দশায় এই ঘরের দরজা কোনো ভাবে যেন খোলা না হয়। তাহলে তিনি আত্মহত্যা করবেন।" সকলকেই অবাক করে সাথে ভীতও করে তাঁর কথাগুলি। তাই বলা যেতেই পারে খানিক ভয় নিয়েই একটা পুরনো আসবাবে ঠাসা ছোট আকারের  ঘর বন্ধ থাকলো কী খোলা তাতে কেউ তেমন ভাবে গুরুত্বও দেখালোনা। ওই ঘরের দরজা বন্ধ থাকবে কেন তার উত্তর ও আর কেউ চাইলো না , কেবল মাত্র রেবতীর মনেই সেই ছোট্ট বয়স থেকেই ওই ঘরটিকে নিয়ে ছিল নানা প্রশ্ন। মা সবিতা বিরক্ত হতো, বলে উঠতো "-- ওই আবার আবোল তাবোল চিন্তা ভাবনা মনে এনেছিস তাই স্বপ্ন দেখেছিস আর তার জন্যই ভয় পেয়েছিস। যা জল খেয়ে শুয়ে পর গিয়ে। " 

 --" আচ্ছা মা কেন আমি স্বপ্ন দেখি?" 

"-- সারাদিন ধরে অবচেতনে কিছু ভাবিস। আর সেটাই স্বপ্নে আসে তাই দেখিস । "

"--- জানো মা ওই চিলেকোঠা ঘরটা আমাকে যেন কিছু বলতে চায়। আমি ওই ঘরের দরজার সামনে যখনি গিয়ে দাঁড়িয়েছি কে যেন আমাকে বলতে চেয়েছে আমি বন্দী আছি আমাকে মুক্তি দাও। আচ্ছা মা ওই চিলেকোঠা ঘরের মধ্যে কী আছে ?" 

"--- রেবতী তোকে আগেও বলেছি ওই চিলেকোঠা ঘর সম্পর্কে কোনো কথা আমি কেন তুই এই বাড়ির কারো কাছে জানতে চাইবি না। ওই ঘরের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে যখন, তখন বন্ধই থাক্। কিছু থাকে যা অতীতের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাওয়াই ভালো। জোর করে তা বর্তমানে টেনে তুলে আনা বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। হয়তো কোনো কারণে বা কোনো কারণ ছাড়াই ওই ঘরটাকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন তোর জ্যাঠামশাই যা আমাদের  কারো জানা হয় নি তাই আমার পক্ষে বলা কঠিন। আর একটা ছোট্ট ঘর কোনো কাজে লাগে না সেই ঘরের প্রতি অতো কৌতুহল দেখিয়ে কী হবে ? এখন তুই বরং শুয়ে পর গিয়ে। চিলেকোঠা সম্পর্কে কোনো আলোচনা আর কোনোদিন নয়। " রেবতী জানে শুধু মা কেন বাড়ির সকলেই প্রায় চিলেকোঠা সম্পর্কে কোনো আলোচনা শুনতে রাজি নয়। কেবল একবার মনে পড়ে অনেক বছর আগে জ্যেঠিমা নলিনী দেবী'র বাড়ির পুরনো চাকর রাঘব কাকার উদ্দেশ্যে বলে যাওয়া কথাগুলি যা হঠাৎ করেই কানে এসেছিল এক দুপুর বেলায় রেবতীর"--- রাঘব তুই এখনো বিশ্বাস করিস তোর মেয়ে চম্পা এই বাড়িতেই আছে‌  ? থাকলে পনেরো বছর ধরে লুকিয়ে আছে? আমরা কি ওকে লুকিয়ে রেখেছি? তাহলে পুলিশ ডেকে বাড়ির প্রত্যেকটি ঘর খুঁজে দেখ্ । আমরা তো কোনো ঘর বন্ধ করে রাখিনি। তুই এতো বছরের চাকর, তোর মেয়ে এ বাড়িতে আমাদের ছেলে মেয়েদের সাথেই থেকেছে। আর তুই তো জানতিস আমি চম্পাকে আমার সন্তানদের মতোই ভালোবাসতাম, বলতে গেলে সে রাতে হঠাৎ করে তোর মেয়ে চম্পার উধাও হয়ে যাওয়া তোর কাছে যেমন বিস্ময়কর ঘটনা আমাদের কাছেও তেমনি। আজও তোর বড়কর্তা মেয়েটার জন্য থানায় গিয়ে খোঁজ করে যে মেয়েটা হঠাৎ করে কোথায় গেল? কোনো খোঁজ পাওয়া গেল কী না? কিন্তু পুলিশ খুঁজে পেল না মেয়েটাকে। তাই আমাদের  অবিশ্বাস করিস না। আমরা তোর বা তোর মেয়ের কেউ শত্রু নই।" শুধু এইটুকুই। রাঘব কাকা জ্যেঠিমার কথাগুলির প্রত্যুত্তর দেয়নি। বরং সময়ের সাথে সাথে মেনে নিয়েছিল যে তার চম্পা কোথাও হারিয়ে গিয়েছে বা স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছে। আচ্ছা কোথায় গেল চম্পা? এর উত্তর রাঘব কাকা তার জীবদ্দশায় পায়নি কারণ তার কয়েক বছর বাদে রাঘব কাকা তার দেশ মল্লিকপুরে চলে যায় ও সেখান থেকেই একদিন খবর আসে রাঘব কাকার মৃত্যু হয়েছে হার্ট অ্যাটাকে।


           এরপর অনেকটা সময় কেটেও গেছে। রেবতী আর তার সম্পর্কের ভাইবোনেরা এখন সকলেই বড় হয়ে গেছে আর যে যার মতো করে জীবনে এগিয়ে চলেছে। রেবতীর এখন বয়স চব্বিশ। একটি বেসরকারী স্কুলে ইংরেজি পড়ায় সাথে সাথে এম এ পড়ছে। বেশ আধুনিকা ও যুক্তিবাদী। কোনো বিষয়কে সামান্য বিষয় ভেবে দূরে সরিয়ে রাখা তার স্বভাবের বাইরে। আর এই স্বভাবের জন্যই হয়তো তার জানার আকাঙ্ক্ষা বা কৌতুহল যা ই বলা হোক্ না কেন  অতিরিক্ত ছিল ফলস্বরূপ একদিন সে চিলেকোঠা ঘরটিকে দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে বন্ধ করে রেখে দেওয়ার রহস্য টা কি , তা সে উদ্ঘাটন করেই ফেলল এবং তা যে তাদের মানিকতলার রায়চৌধুরী পরিবারের পক্ষে খুব মঙ্গলজনক ছিল তা মোটেও নয়। বরং রায়চৌধুরী পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল চরম সত্যটা সামনে আসার সাথে সাথে।

     সেদিন ছিল কোনো এক উৎসবের রাত। প্রতি বছরের মতো রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা সকলেই প্রায় গিয়েছিল তাঁদের দেশের বাড়ি মানিকগঞ্জে সেই উৎসবটি পালন করতে। সেখানে মহা সমারোহে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে রায়চৌধুরী পরিবারে উৎসবটি পালন হয়ে আসছে। প্রতিবছর রেবতীও তার বাবা মায়ের সাথে ওই উৎসবে যায় আর তখন মানিকতলা বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব থাকতো আগে রাঘবের ওপর পড়ে রাঘব  মারা গেলে নকুলের ওপর যে ছিল মানিকগঞ্জের'ই লোক। রাঘবের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর রেবতী'র ছোট কাকা নির্মল দেশের থেকে নকুল  কে নিয়ে আসে। অবিবাহিত নকুল  তারপর থেকে সমগ্র রায়চৌধুরী পরিবারেরর বিশালাকার বাড়ি দেখাশোনা করার সাথে সাথে সকল সদস্যদের দেখাশোনাও করতে থাকে। আর এই নকুল  আর ঝি সরলা'র ওপর রেবতীর দায়িত্ব দিয়ে বাড়ির সকলেই চলে গিয়েছিল মানিকগঞ্জে পারিবারিক উৎসব পালনে যোগ দিতে। অবশ্য রেবতী 'র না যাওয়ার কারণ ছিল একটাই আর তা হলো তার তখন সামনেই এম. এ পরীক্ষার ফাইনাল। 

       সকালবেলাতেই বাড়ি খালি করে সবাই চলে গিয়েছিল। রেবতী সরলাকে দিয়ে নিজের মনের মতো কিছু খাবার বানিয়ে নিইয়ে নিজের ঘরে বসে ইংরেজি সাহিত্যের বইখানি নিয়ে পড়ায় ব্যস্ত। রেবতী মাঝে চা কফি যা যা খেতে চেয়েছিল সরলা তাই করেও দিয়েছিল। রেবতী আপনমনে চা বা কফি পান করেছে আর পড়ায় মনোযোগ বসিয়েছে। সকাল  থেকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নেমেছে। রেবতী পড়ায় মনোযোগ বসিয়েছে তত। রাত  কটা হবে বলা মুশকিল,হঠাৎ কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দে চমকে উঠেছিল রেবতী। শব্দটা কোথায় হল ঠিক বুঝতে পারলো না। পুনরায় শব্দ। নকুল বা সরলা ওরা থাকে প্রধান বাড়ি থেকে একটু দূরে তাই শব্দ টা শোনা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়, আর রইল দারোয়ান রাম সিং যে প্রধান দরজায় বসে ঝিমোচ্ছিল। অগত্যা কারো কে ব্যস্ত না করে রেবতী টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে ঘরের টিউব লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে হাতে মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে মোবাইল ফোনের টর্চ লাইটটা জ্বালিয়ে  ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে চললো তিনতলায় উঠে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে। কারণ শব্দটা যেন তিনতলার ছাদের থেকেই এসেছে বলে তার মনে হয়েছিল। 

        এক ধাপ ,দু ধাপ প্রায় খান দশেক সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে সে এসে দাঁড়িয়ে ছিল ছাদের দরজার সামনে। দরজার খিল খুলে ছাদে পা রাখতেই অদ্ভুত ঠান্ডা জোলো হাওয়া তার শরীর কে স্পর্শ করে যেতে বেশ শিহরণ খেলে গেল । হাওয়ায় ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। হয়তো আরো রাতের দিকে বৃষ্টি হতে পারে তার পূর্বাভাস। সে থামলো না। কোনো এক তীব্র আকর্ষণ তাকে যেন এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো বাড়ির ছাদের দক্ষিণ প্রান্তের ছোট আকারের চিলেকোঠা ঘরটার দরজার দিকে। এমন আকর্ষণ সে আগেও উপলব্ধি করেছে কিন্তু জ্যেঠামশাই ও বাড়ির বড়দের ভয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি। বাড়ি ফাঁকা। এগিয়ে চললো সে এক পা এক পা করে । মাত্র হাত খানেক দূরত্ব। রেবতী চিলেকোঠা ঘরের দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে বন্ধ থাকা দরজাটার দিকে তাকালো এবার বুঝতে অসুবিধা হল না দরজাটার পাল্লাদুটো হাওয়ার দাপটে কোনো ভাবে খুলে গিয়েছে আর তারই আছাড়ি পিছাড়ি খাওয়ার শব্দ তার কানে গিয়ে পৌঁছেছে। সে দরজার পাল্লা দুটো আটকে শিকল তুলে দিতে গিয়ে খানিক থমকালো। এতো বছর যে দুর্নিবার আকর্ষণ সে বোধ করে আসছিল এই ঘরটিকে কেন্দ্র করে হঠাৎ সেই আকর্ষণ আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে সে দরজার পাল্লাদুটো ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে হাতে ধরা মোবাইল ফোনের টর্চের আলো ফেলতেই আঁতকে উঠল। "এ কে" ? ভয়ে তার শরীর কেঁপে উঠল। সারা শরীর জুড়ে পুনরায় হালকা শিহরণ খেলে গেল মুহূর্তের জন্য। বাকরুদ্ধ তার । তার চোখের সামনে  এক নরকঙ্কাল যা চিলেকোঠা ঘরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় দুলছে। কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড একটা চড় তার গালের ওপর পড়তেই সে ছিটকে সরে যেতেই কেউ তাকে ধরে ফেলল। আর তখনি দেখলো বাড়ির চাকর নকুল কে তার দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। রেবতী কিছু বলতে যাওয়ার আগেই এক মহিলা কন্ঠস্বর তাকে বলে উঠল "-- কেন তুমি এখানে এসেছ রেবতী দিদি? তুমি জানো না এই ঘরটা কেউ খোলে না। আর তুমি কি না এখানে এসে ঘর খুলে দাঁড়িয়ে আছো?  ভাগ্যিস নকুল ছাদে এসেছিল নইলে আমরা কেউ জানতেই পারতাম না তুমি এই চিলেকোঠা ঘরের মধ্যে! এতো রাতে একা তোমার এখানে আসা  উচিৎ হয় নি। বড়কর্তা বা বাড়ির বড়রা জানলে কি হবে বলো তো?"

  "--- কিন্তু আমাকে চড় মারার অধিকার তোমাকে কে দিল নকুল কাকা? আমি তোমাকে কিছু বলতে চাইনা তবে ভবিষ্যতে এই ভুল কখনো কোরোনা নকুল কাকা। তাছাড়া এই মুহূর্তে এই ঘরের মধ্যে যা আমি দেখ্ছি তা তো মিথ্যা নয় তুমি বা সরলা দি দু'জনেই দেখ্ছ নিশ্চয়ই । ওই তো আমাদের তিনজনের চোখের সামনে একটি কঙ্কাল ঝুলছে, আমি নিশ্চিত এই কঙ্কাল ঝুলন্ত অবস্থায় এই ঘরের মধ্যে বন্দী, আর এই পনেরো বছর ধরে এই ঘরের মধ্যে থাকা এই সত্যটাকে লুকানোর জন্যই জ্যেঠামশাই এই ঘরটি বন্ধ করে রেখেছিলেন। সত্যিটা বুঝেছো তোমরা? কিন্তু কেন তিনি এমন করলেন ? যদি এই বাড়ির কোনো সদস্য এই ঘরে আত্মহত্যা করেই থাকে যা আমি বা আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা তবে সেই সদস্যের  সৎকার করা হয় নি কেন ? অবশ্যই করা উচিৎ ছিল। এভাবে ঘরের মধ্যে তার মৃত্যু কে লুকিয়ে রাখার অর্থ কী ? সরলা দি তুমি বা নকুল কাকা হয়তো আগে থেকেই জানো এ সত্যিটা কিন্তু আমাকে বলতে চাইবে না আমি বুঝে গেছি ,তবে জেনে রেখে দাও আগামী কাল এই বাড়ির সকল সদস্যদের সামনে আমি এই সত্যিটা আমি আনবোই আনবো। বছরের পর বছর ধরে এই ঘরের দরজা বন্ধ রেখে সত্যিটাকে জ্যেঠামশাই কেন লুকিয়ে রেখে গেছেন তা আমি কেন এই পরিবারের সকলে জানবে। আমাকে আটকে বা চড় মেরে থামাবার বৃথা চেষ্টা তোমরা আর কোরো না। " রেবতী কিছু সময় আগে নকুলের অতর্কিত আক্রমণে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে গিয়েও পড়ে না সরলা ধরে ফেলাতে। কিন্তু মোবাইল ফোন টা তার পড়ে যায়। সেটি ঘরের এক প্রান্তে পড়ে থাকায় সরলার আনা টর্চের আলোয় তা খুঁজে নিয়ে বেশ রুঢ় স্বরে কথাগুলি বলে দ্রুত চিলেকোঠা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছাদ পেরিয়ে দোতলায় নিজের ঘরে চলে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। আর সেই মুহূর্তেই কাকে যেন উদ্দেশ্য করে নকুল তার নিজের ফোন থেকে নিচু কন্ঠস্বরে বলে গিয়েছিল কয়েকটি কথা "--- বাবু রেবতী দিদি সব দেখে ফেলেছেন। এতো বছর ধরে যা আপনি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন তা আর লুকিয়ে রাখা আপনার হল না। বাবু আপনি আর বড় গিন্নীমা আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি থাকা সত্ত্বেও রেবতী দিদি কেমন করে যে এই চিলেকোঠার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল জানা নেই। আশ্চর্যের বিষয় রেবতী দিদি এই ঘরের তালা খুললো কী করে ? যার চাবি আপনার কাছ ছাড়া আর কারো কাছে থাকে না! আমার মনে হচ্ছে হাওয়ায় কোনো ভাবে দরজা টা খুলে গেছে। কিন্তু  তালাটা তো কোথাও পড়ে থাকবে তাও তো দেখছি না।" ফোনের অপরপ্রান্ত কি উত্তর দিয়েছিল জানা নেই তবে সেই রাতেই রায়চৌধুরী বাড়ির বড়কর্তা অমরনাথ বাবু সবার অলক্ষ্যে তাঁদের দেশ মানিকগঞ্জের  বাড়ির শেষ প্রান্তের ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করেন। মৃত্যুকালে তিনি কয়েকটি  কথা লিখে রেখে যান "--পনেরো বছর আগে করা এক ঘৃণ্য অপরাধে অপরাধী আমি। তাই আজ আমার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী।"

        এরপর কয়েকদিন কেটে গিয়েছিল। রেবতী'র জন্য রায়চৌধুরী পরিবারের সকলের কাছে আর অজানা থাকলো না তাদের মানিকতলা বাড়ির ছাদের দক্ষিণ প্রান্তের চিলেকোঠা ঘরের মধ্যে ঝুলন্ত নরকঙ্কালের কথা। কিন্তু কার ওই কঙ্কাল দু' তিন দিন অজানা থাকে সকলের‌ কাছে । বলা যায় এক প্রকার বাধ্য হয়ে পুলিশ ইন্সপেক্টর অরবিন্দ সামন্তের  জেরার মুখে পড়ে পরিবারের বয়জ্যষ্ঠা নলিনী দেবী যিনি রেবতী ও তার খুড়তুতো ভাই বোনদের  সকলের সম্মানীয়া জ্যেঠিমা অনেক কষ্টে সত্যিটা বলেছিলেন যা ছিল তাঁর পক্ষে তো বটেই তাঁর পরিবার তথা সমগ্র রায়চৌধুরী পরিবারের পক্ষে কলঙ্কিত। 

"--- বলুন নলিনী দেবী ওই নরকঙ্কাল সম্পর্কে যা জানেন বলুন। আমি এখানে পুলিশ ইন্সপেক্টর হয়ে আসার পর শুনেছি এই পরিবারের এক পরিচারিকা নাম চম্পা পনেরো বছর আগে কোনো এক দোল উৎসবের রাতে উধাও হয়ে যায়। তার বাবা  রাঘব যে আপনাদের পুরনো চাকর ছিল আপনাদের সহায়তায় অনেক খোঁজাখুঁজি করে নিজের মেয়ের, কিন্তু তার কোনো হদিস মেলে না। পরে রাঘব হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় তার দেশের বাড়িতে । মনে করা হয় সন্তান হারিয়ে যাওয়ার বেদনা সহ্য‌ করতে না পেরেই এই মৃত্যু। এখন আপনিই একমাত্র সাক্ষী যিনি বলতে পারেন সবটুকু। অবশ্য এই পরিবারের আরো সকলের এ বিষয়ে জানার কথা কিন্তু কেউ তো কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। আমার ধারণা এই পরিবারের বড়কর্তা অমরনাথ বাবু ই এমন কিছু ঘটিয়ে ছিলেন যা আপনি জানেন নইলে চিলেকোঠা ঘরের দরজা বন্ধ রাখার নির্দেশ উনি কেন দেবেন আর সেই সময় আপনিও ওঁনার সিদ্ধান্ত কে সমর্থন করেছিলেন তা রেবতী ম্যাডামের কাছেই আমি জেনেছি তাছাড়া আরো একটা বিষয় আমাকে ভাবাচ্ছে যেটা হ'ল অমরনাথ বাবু সুইসাইড নোটে তাঁর মৃত্যুর জন্য তাঁর একসময় করা কোনো এক ঘৃণ্য অপরাধকে দায়ী করে গেছেন। আমার ধারণা অমরনাথ বাবু নিজের অপরাধ লোকাতে বা নিজেকে লোকাতে বা আরো বললে ভালো হয় নিজের সম্মানহানির আশঙ্কায় ভীত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন। আমি আপনাদের চিলেকোঠা ঘরে পাওয়া কঙ্কাল এবং অমরনাথ বাবুর সুইসাইড এই দুটোর মধ্যে কোথায় যেন লিঙ্ক খুঁজে পাচ্ছি‌। সত্যিটা আপনি বলুন নলিনী দেবী, কারণ আমি নিশ্চিত স্বামীর কোনো এক অপরাধ সম্পর্কে আপনি খানিকটা অবগত ছিলেন এখন সেই সত্য আর নিজের মধ্যে লুকিয়ে না রেখে ব্যক্ত করুন। তাতে আপনার শাস্তি কিছুটা হলেও কম হবে কারণ যিনি অন্যায় করেছেন তিনি যেমন দোষী আর যিনি এতো বছর ধরে অন্যায়টা লুকিয়ে রেখেছিলেন কারোকে জানতে পর্যন্ত দেননি তিনিও দোষী। যাইহোক এখন ওই অস্থি করোটি পরীক্ষা করে যা দেখা গেছে ওটি একটি পনেরো ষোলো বছরের কিশোরীর। আর ওটি বছর পনেরো আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উদাহরণ। করোটিতে আঘাত করা হয়েছিল কোনো ভারি বস্তু দিয়ে তাতেই মৃত্যু হয়েছিল মেয়েটির তাও বোঝা গেছে। আমার বিশ্বাস আপনাদের এক সময়ের চাকর রাঘবের মেয়ে চম্পা যে ঠিক পনেরো বছর আগে এই পরিবার থেকে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়, হাজার খোঁজাখুঁজির পরও যাকে খুঁজে পাওয়া যায় না তারই কঙ্কাল ওইটি নইলে আর কারই বা হবে? আপনি সত্যিটা বলতে পারবেন। বলুন নলিনী দেবী আর লুকিয়ে লাভ নেই। সত্য কোনো দিন চাপা থাকে না ম্যাডাম তা তো আপনার মতো বয়জ্যোষ্ঠার জানা আছে।" প্রায় এক নিঃশ্বাসে অরবিন্দ সামন্ত কথাগুলি বলে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফ্যালেন। রায়চৌধুরী বাড়ির দোতলায় নলিনী দেবীর নিজস্ব ঘরটিতে নেমে আসে ক্ষণিকের নীরবতা। 

 নলিনী দেবী  আরাম কেদারায় বসে ইন্সপেক্টর অরবিন্দ সামন্তর বলে যাওয়া কথাগুলি মন দিয়ে শুনছিলেন উপস্থিত আর সকলের সাথে। ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রায়চৌধুরী পরিবারের সকলের গিন্নীমা, বড়কর্তা অমরনাথ রায়ের সহধর্মিণী সেইদিন একান্ত বাধ্য হয়ে যে কাহিনী শুনিয়ে ছিলেন তা মুহূর্তের মধ্যে মানিকতলার রায়চৌধুরী পরিবারের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছোট থেকে বড় সকলেই তাদের পরিবারের বয়জ্যোষ্ঠ মৃত অমরনাথ বাবু 'র উদ্দেশ্যে একরাশ ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়েছিল সাথে নলিনী দেবীর উদ্দেশ্যেও। আর রেবতী, অসহায় হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল তার আদরের জ্যেম্মা নলিনী দেবীর মুখের দিকে। একজন নারী যিনি স্বামীর করা চরম অপরাধ লোকাতে এতোবড় অন্যায় করেছিলেন যার সত্যি কোনো ক্ষমা নেই, আর তারপরও এতো বছর ধরে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তিনি নির্দ্ধিদায় বলে গিয়েছেন চরম মিথ্যাও --" চিলেকোঠা ঘরে কেউ কোনো দিন যাবে না তোমরা ওই ঘর বন্ধ থাকবে আজীবন। যদি কেউ আমার বা আমার স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে ওই চিলেকোঠা ঘরের প্রতি কৌতুহল দেখাবার কোনো রূপ চেষ্টা করো তাহলে তার চাইতে মন্দ আর কিছু হবে না। " দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল রেবতী সেই অসহায় মেয়েটির উদ্দেশ্যে যার মৃত্যুর জন্য দায়ী তার জ্যেঠামশাই আর জ্যেম্মা যাঁদেরকে এই পরিবারের প্রত্যেক সদস্য সম্মান করে আসছে, আদর্শ মেনে আসছে । হায় রে নারী শরীর লোলুপ সেই শ্বাপদসম সেই পুরুষ যে রায়চৌধুরী পরিবার থেকে এই সম্মানের যোগ্যই ছিল না।

         নলিনী দেবী যা বলেছিলেন রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্য এবং ইন্সপেক্টর অরবিন্দ সামন্তের উপস্থিতিতে তা এমনটাই"-- চম্পা ছিল এই রায়চৌধুরী বাড়ির পুরনো চাকর রাঘবের একমাত্র মেয়ে। হঠাৎ করে ম্যালেরিয়াতে রাঘবের বউ পূর্ণিমা দেশের বাড়ি কালিকাপুরে মারা গেলে কিশোরী মেয়ে চম্পাকে নিজের কাছে কলকাতায় নিয়ে আসে রাঘব, ও আমাদের এই মানিকতলার রায়চৌধুরী বাড়িতে তার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে তোলে। বেশ কয়েক মাস কেটেও যায়। বাবার সাথে সাথে চম্পাও এই পরিবারে কাজ করতে থাকে। সকলেই বিশেষ করে আমার স্বামী ছাড়াও ,মেজো, ছোটকর্তা ও আমরা ওর গিন্নী মায়েরা ,আমাদের সকলের মন জয় করে ফেলেছিল  চম্পা রাতারাতি। আমি  আবার সকলের থেকে চম্পাকে একটু বেশি ভালোবাসতাম কারণ  চম্পার বয়সী আমার একটি মেয়ে ছিল যে মারা যায় ক্যান্সার রোগে। তাই বলতে পারেন চম্পাকে কাছ ছাড়া খুব একটা করতে চাইতাম না আমি । অনেক সময় দুপুরে বা রাতে আমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়েও পড়তো কিশোরী চম্পা। আমার আরো দুটি সন্তান  যারা চম্পার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট তারা চম্পাকে নিজের দিদি'র  মতো ভালোবাসত সেই কারণেই চম্পা যখন তখন আমার ঘরে আসতো আর আমার দুই ছেলের সাথে খেলাধুলাও করতো। এছাড়া বাড়িতে আরো পাঁচ ছ'টি ছোট ছেলেমেয়ে ছিল যারা আমার দেওরদের ছেলেমেয়ে তারা যেমন রেবতী ,চিনু সকলের মনের মধ্যে চম্পা একটা জায়গা করে নিয়েছিল আর তাতে হল তারা সকলেই আমার ছেলে দুটির মতো চম্পাকে বড় দিদি বলে মনে করতো ও সেভাবেই ভালোবাসা দিতো। আর এভাবেই কয়েক মাসের মধ্যে চম্পা রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্যা হয়ে যায়। রাঘব তো খুব খুশী কিন্তু এতে চম্পা কতোটা খুশী হয়েছিল তা বলা কঠিন ছিল। কারণ ওর চোখেমুখে মাঝে মধ্যেই খেয়াল করতাম ভয়। মাঝে মধ্যেই আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করতো কিন্তু তা বলে উঠতে পারতো না। তার কারণ ওই ভয়। আমি ভাবতাম অল্প বয়স,মা মরা মেয়ে , অপরের বাড়িতে আশ্রিতা ভয় তো একটা থাকবেই। আমি তাই ওর ভয় কাটাতে ওকে আরো নিজের করে নিতে লাগলাম। যেখানেই যেতাম ও আমার সাথে যেতো। হয়তো ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকলে ভালো হতো কিন্তু তা থেমে থাকলো না। 

        প্রতিবছর রায়চৌধুরী পরিবারে মহা ধুমধাম করে দোল উৎসব পালন করা হয়। আর সে বছরও তার ব্যতিক্রম হল না। কুলদেবতা রাধা মাধবের পূজা সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে এই পরিবারে শুরু হয়ে যায় দোল খেলা। আর সে দোল খেলা কেবল আবীর আর রঙে সীমাবদ্ধ ছিল না তার সাথে ওই একটি দিনের জন্য যুক্ত হতো সিদ্ধি ও দামী বিদেশী মদ। আর এই বিদেশী মদ আনাতেন পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠ অমরনাথ  মানে আমার স্বামী নিজে নামী দোকান থেকে। ছোটরা বাদ দিয়ে পরিবারের কর্তারা মদ্যপান করলেও  গিন্নীরা সাধারণত সিদ্ধি খেত অল্পস্বল্প।আর তারপর তারা দেদার দোল খেলায় মেতে উঠতো। দিন গড়িয়ে সন্ধে নামলে খেলা শেষ করে যে যার মতো সামান্য খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরে ঢুকে  সুন্দর একটা ঘুম দিতো। তবে বলে রাখা ভালো বিদেশী মদ ওই একটি দিনের জন্য সকল পুরুষেরা পান করতো যা ওইদিন এই বাড়িতে আসা অতিথিরাও কেউ অন্যায়ের চোখে দেখতেন না বরং দীর্ঘ কয়েক বছরের রীতি বলেই মেনে নিতো ও তাঁরাও  সেই আনন্দ নিতেন যা আমার স্বামীর  ইচ্ছেতেই হতো। বলা যায় পুরুষদের মধ্যে কেউ যদি এক চুমুক মদ পান না করতেন তা নিয়ে ব্যাপক হাসিঠাট্টাও চলতো।

       সেবার ও তাই হয়েছিল। সকলেই প্রায় সিদ্ধি ও মদ পান করে দেদার দোল খেলে যে যার ঘরে চলে গিয়েছিল। বাচ্চারাও সারাদিন এতোটাই রং আর আবীরের মধ্যে কাটিয়েছিল যে তারাও মা,বাবার কাছে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল অন্য রাতগুলোর তুলনায় আগে ভাগেই। সমগ্র রায়চৌধুরী পরিবার নিস্তব্ধ।

         রাত তখন ন'টা। আমি আর সকলের তুলনায় কমই রং মাখি ও সিদ্ধি খুব নামমাত্র পরিমাণে পান করি প্রতিবছর। সেবারও তাই করেছিলাম। বলা যায় সেই কারণে রাতে একটু তাড়াতাড়িই যখন সকলেই খাওয়া সেরে নিজ ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিল আমি তখনো না ঘুমিয়ে রান্নাঘরে কিছু কাজ করছিলাম। হঠাৎ কাজের মধ্যে মেয়েলি কন্ঠস্বরের ক্ষীণ গোঙানীর শব্দ কানে যেতেই আমি বেশ অবাক হলাম। রাঘব বা সরলাকে ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না কারণ সারাদিনের ধকল ওদের ওপর দিয়ে বেশি গিয়েছে বলে ,তাছাড়া ওদের থাকার ব্যবস্থা ছিল আমাদের প্রধান বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। কিন্তু এমন গোঙানী কোথা থেকে আসছে? সকলেই তো যে যার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। চৈত্র মাস। হালকা শীতের আমেজ তখনো রয়েছে। বিশাল বাড়ি। কুড়িটা মতো ঘর। কোন্ ঘর থেকে এমন শব্দ আসছে ? ঠিক ভেবে পেলাম না। আমার  দুই ছেলে দু'দিন হল তাদের মামার বাড়ি গিয়েছে। আমার স্বামী অমরনাথ বাবু একটু বেশি মাত্রায় মদ্যপান করে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছেন অকাতরে আমি নিশ্চিত। তাছাড়া এ তো মেয়েলী কন্ঠস্বর। তাহলে কে হতে পারে? মেজো বা ছোট জায়েদের মধ্যে কেউ? অতিরিক্ত সিদ্ধি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর তার জন্যই গোঙাচ্ছে পেটের ব্যাথায়। মনে মনে বেশ রাগ হলো সিদ্ধি ও মদ ওই দুটি পানীয়ের প্রতি । কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারলাম না ঘটনাটা কী ? অগত্যা  বিষয়টিকে লঘু দেখে সারা দিনের ক্লান্তি, চোখে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে আমি ওপর তলার  যখন নিজের ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালাম আমার কানে তীব্র ভাবে প্রবেশ করলো মেয়েলী কন্ঠস্বরের গোঙানী। আমি ভেজানো দরজা ঠেলতেই দরজার পাল্লা দুটো খুলে গেল। এ কী দেখছি!  নীল রাতবাতির আলোকে! আমার পালঙ্কের ওপর এক পূর্ণ নগ্ন চম্পা'র শরীরের ওপর আমার স্বামী অমরনাথ উলঙ্গ শরীর নিয়ে যথেচ্ছ অত্যাচার করে চলেছেন। চম্পা নিজেকে ছাড়াবার প্রবল চেষ্টা করছে কিন্তু অতিকায় আমার স্বামীর চেহারার কাছে ও নিতান্তই শিশু। চম্পা গোঙাচ্ছে। ওর মুখে চাপা রয়েছে আমার স্বামীর ডান হাতের চেটো।

              বেশ কিছু সময় কেটে গিয়েছিল। আমার স্বামীর কামতৃপ্ত শরীরটা বিছানায় নেতিয়ে পড়লো আর এই সবকিছু স্থবিরের ন্যায় দাঁড়িয়ে দেখলাম আমি । আমার স্বামীর মদে আসক্তি জানতাম।বিয়ের পর থেকে তাঁর লুকিয়ে লুকিয়ে মদ খাওয়া দেখে আসছি কিন্তু ওঁর যে নারী শরীরের প্রতিও আসক্তি ছিল তা জানতাম না। আর এমনতর আসক্তি তো আমার কল্পনার বাইরে। কিন্তু এখন কি করা যায়? ওই মেয়েতো এই পরিবারের সকলকে বলে দেবে তার ওপর অত্যাচারের কথা যা আমার স্বামী হয়তো মদের নেশা কেটে গেলে ভুলেই যাবেন। না আমাকেই কিছু করতে হবে। এই বাড়ির মানসম্মান বাঁচানোর সাথে সাথে নিজের স্বামী কে বাঁচাতে সর্বোপরি নিজের দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আমি সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। দ্রুত ঘরে ঢুকে গেলাম। আলনা থেকে নিজের একটি শাড়ি নিয়ে চম্পার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলাম "--- চম্পা উনি বুঝতে পারেননি হয়তো আমি ভেবে তোকে,,,,"

---" বড় মা বড় মা তুমি এতো দেরী করে এলে? জানো উনি ইচ্ছে করে এসব করেছেন। সকাল থেকেই আমার শরীরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। শুধু আজ নয় আমি এ বাড়িতে আসার পর থেকেই উনি আমাকে কাছে ডেকে গালে, ঠোঁটে চুমু খান জোর করে। রাতে তোমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে অনেক সময় ঘুম ভেঙে জেগে উঠে দেখেছি উনি আমার বুকে হাত বোলাচ্ছেন। আমি বাধা দিতে গেলে  ফিসফিস করে বলে উঠেছেন --" তুই এ বাড়ির চাকরের মেয়ে রে হারামজাদী,তোর শরীরের ওপর আমাদের এ বাড়ির সকলের অধিকার আছে। বাধা দিলে তোর বাবা আর তোকে চোর অপবাদ দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেবো। তোর বড় মা কিচ্ছু করতে পারবে না।" অসহ্য লাগলেও চুপ করে থেকেছি। হাত দিতে দিয়েছি আমার শরীরে। ভয়ে তোমাকে বলতে গিয়েও কিছু বলতাম না। কিন্তু আজ উনি যা করলেন আমি সবাই কে বলে দেবো। উনি আমাকে বললেন--" আমি টলছি আমাকে একটু ঘরে নিয়ে চল্ চম্পা" । আমি কষ্টকরে ওনাকে ধরে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিতে গেলে উনি আমাকে চেপে ধরেন। তারপর জামা কাপড় ছিঁড়ে আমাকে বিছানায় ফেলে ,,,,। আমি চিৎকার করতে গেলে ভয় দেখান --" তোর বাপটা'র মরন আমার হাতে বুঝলি রে মেয়ে।" আমি কি করবো বড় মা??" হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে চম্পা। আমি সব শুনলাম। আবারো চিন্তা করলাম। কিন্তু স্বামীর ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তি হোক্ তা না চেয়ে তার পরিবর্তে এই পরিবারের মানসম্মান রক্ষা আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিল সেই মুহূর্তে। তাই ভয় পেলাম এই মেয়ে যদি সত্যিটা বলে দেয় সকলের সামনে তাহলে??? আমি তখনি চম্পার ডান হাতটা চেপে ধরে বললেন চল্ ছাদে চল্ ওখানে গিয়ে সব বলবি আমি শুনবো। 

---" বড় মা আমি বাবার কাছে যাবো। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আর এ বাড়িতে থাকবো না। বাবা কে নিয়ে দেশে চলে যাবো। " 

"--- যাবি। কিন্তু তার আগে তুই ছাদে চল্ তোর সাথে কথা আছে। " 

--" না আমি বাবার কাছে যাবো। তুমি আমাকে বাবার কাছে যেতে দাও। " আমি বুঝলাম চম্পা যদি কোনো ভাবে ওর বাবা রাঘবের কাছে চলে যায় আর তার ওপর করা অত্যাচারের কথা বলে দেয় তাহলে আর বাকি কিছু থাকবে না এই বাড়ির সম্মানের। ভেঙে  শেষ হয়ে যাবে মানিকতলার রায়চৌধুরী পরিবার। আমি এবার কঠোর হলাম। এক সময় যাকে নিজের মৃত মেয়ের আসনে বসিয়েছিলাম তাকেই সজোরে একটা গালে চড় মেরে বললাম "--আমি এই বাড়ির গিন্নীমা। তোর বড় মা। তোর ভালোর জন্যই বলছি ছাদে চল্। " পনেরো বছরের চম্পা ভয় পেলো আমাকে। নিজেকে আমার দেওয়া শাড়িতে মুড়ে নিয়ে আমার পিছু পিছু  তিন তলার ছাদে গিয়ে উপস্থিত হল। আকাশে তখন পূর্ণ জ্যোৎস্না। হঠাৎ আমার মাথায় খেলে গেল অদ্ভুত এক বুদ্ধি। আমি চম্পা 'র হাতটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলাম চিলেকোঠা ঘরের কাছে। কঠোর স্বরে বললাম "--- তুই এখন থেকে এই ঘরে থাকবি। তোদের বড়কর্তা তোকে যাতে আর ছুঁতে না পারে তার জন্য আমি এই ব্যবস্থা নিলাম। আমি সময় করে করে তোকে বার করে নিয়ে যাবো যখন বড়কর্তা বাড়িতে থাকবে না। ও তোর ওপর আবার অত্যাচার করতে পারে। একবারে ওর তোর শরীরের প্রতি খিদে মেটেনি আবার তোকে ছুঁতে পারে। তাই তোকে বাঁচাতে আমাকে এভাবে তোকে লুকিয়ে রাখতে হবে। এখন তুই বলছিস দেশের বাড়ি চলে যাবি ,বড়কর্তা তা জানলে তোর বাবাকে মেরে ফেলতেও পারে। তাই আজ থেকে এই ঘরে তুই থাকবি। চল্ দরজা ভেজানো আছে খুলে ঢুকে যা। " চম্পা বলে ওঠে"-- না আমি এই ঘরে থাকবো না। দমবন্ধ হয়ে যাবে এই ঘরে থাকলে। আমি বাবার কাছে যাবো। তুমি আর বড়কর্তা দু'জনেই খারাপ। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি চিৎকার করবো নইলে।" 

"--- তোর এতোবড় সাহস "! চম্পা কিছু বোঝার আগেই আমি চিলেকোঠা ঘরের দরজার ধার ঘেঁষে পড়ে থাকা থানিইঁট টা দিয়ে সজোরে আঘাত করলাম চম্পার মাথায়। অসহ্য যন্ত্রনায় চম্পা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তেই আরো একবার ইঁটটা দিয়ে আঘাত করলাম  চম্পার মাথার পেছনে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো চম্পার খর্বাকায় শীর্ণ দেহটা। আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম ওর দিকে কিছুক্ষণ। নিজের মৃত মেয়ের মুখটা ক্ষণিকের জন্য ভেসে উঠল ওর মুখের মধ্যে। নিজেকে বোঝালাম এখন আর ও আমার মেয়ের জায়গায় বসার যোগ্য নয়, আমার স্বামীর ভোগ করা একটা মেয়েমানুষের শরীর ওটা। লজ্জায় অপমানে নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা জাগলো। রাগ জন্মালো ওই ছাদের ওপর পড়ে থাকা রক্তাক্ত মেয়েটার শরীরটার দিকে। আর তখনি আরো একটা চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।" নলিনী দেবীর কথাগুলি শেষ হওয়ার পূর্বেই ইন্সপেক্টর অরবিন্দ সামন্ত বলে উঠলেন --"নলিনী দেবী সেই চরম সিদ্ধান্ত হ'ল আর আপনি অপেক্ষা করলেন না। দোল পূর্ণিমার রাত, চাঁদের আলোয় যতটুকু দেখা যায় তাতে আশ্রয় করে নিজেই টানতে টানতে চম্পার শরীরটা চিলেকোঠা ঘরের মধ্যে এনে চম্পার শরীরে কিছু সময় আগে জড়িয়ে দেওয়া নিজের শাড়িটা খুলে ফাঁস তৈরি করেন ও তারপর যথারীতি মেয়েটির গলায় তা বরমালার মতো পরিয়ে দিয়ে নিজের শরীরে যথাসম্ভব শক্তি সঞ্চয় করে মেয়েটিকে তুলে কড়িকাঠ থেকে ঝুলিয়ে দেন। যেহেতু চিলেকোঠা তাই তার কড়িকাঠ বেশ নিচু আপনার পক্ষে এক শীর্ণকায়  মেয়েকে  শাড়ির ফাঁস গলায় পরিয়ে ঝুলিয়ে দিতে এতোটুকু অসুবিধা হয় না তাই তো নলিনী দেবী?" ইন্সপেক্টর অরবিন্দ সামন্তের প্রশ্নে নীরব থেকে যান নলিনী দেবী। 

      কিছু দূরে বসে নলিনী দেবীর বলে যাওয়া প্রত্যেকটি কথা এতোক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল তাঁর'ই দুই ছেলে সুজয় আর রণজয়। দীর্ঘ পনেরো বছর আগে তারা ছিল নিতান্তই বালক। আজ তারা যুবক। মায়ের জবানবন্দিতে বাবা অমরনাথ বাবু এবং মা নলিনী দেবী'র উভয়ের মিলিত অন্যায় যা এক অসহায় মেয়ের জীবন কেড়ে নিতেও বাধেনি শুনে স্তম্ভিত তারা। বাবা ও মায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণায় তাদের দু'জনেরই মুখ রাগে, অপমানে রক্তিম হয়ে উঠল। বড় ছেলে সুজয় ই মায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা বর্ষিয়ে বলে উঠেছিল"--- ছিঃ মা ছিঃ বাবার অন্যায় ঢাকতে তুমি এমন ঘৃণ্য অপরাধ করে বসলে যা আমি কেন এই পরিবারের কেউ কখনো তোমাকে ক্ষমা তো দূর তোমার প্রতি তীব্র ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দেবেনা। আজ আমার তোমাকে মা বলতে লজ্জা করছে। এ কেমন মা তুমি যে একটি মেয়েকে নিজের মৃত মেয়ের আসনে এক সময় বসিয়ে তাকেই হত্যা করলে? ধন্য তুমি। তোমার কাছে এই পরিবারের সম্মান আর স্বামীর অন্যায়কে সমর্থন করে তাঁর সম্মান রক্ষা করা এসব তুচ্ছ  বিষয় গুলো বড় হ'ল যার জন্য একটি নিরপরাধ মেয়ের জীবন কেড়ে নিলে ? কেন পারলে না মা তুমি বাবাকে সেই রাতে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে তাঁর অন্যায়ের শাস্তি দিতে? তাহলে তো এতোবড় অন্যায় তোমাকে করতে হতো না। আমরা চলে যাচ্ছি মা। তোমার এই অবস্থার জন্য তুমি নিজে দায়ী তাই সেই দায় তুমি একা বহন করো।" সুজয় আর রণজয় আর দাঁড়ায় নি। দু'জনেই নলিনী দেবীর দিকে চোখের দৃষ্টিতে এক ঝলক ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলে ইন্সপেক্টর অরবিন্দ সামন্ত বলে উঠেছিলেন"--- বুঝছি আপনার এখন মনের অবস্থা কেমন। সন্তানের থেকে এমনতর ব্যবহার মন কে ভারাক্রান্ত করে। কিন্তু ওদেরও এক্ষেত্রে দোষ দেওয়া যায় না। এমন নির্মমভাবে হত্যা করেছেন যে নারী একটি সন্তানতুল্য কিশোরীকে সেই নারীর সন্তান ওরা এ ভাবতে ওদের কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই । এখন আপনি বলুন নলিনী দেবী আপনি যে মেয়েটির মাথায় দু'বার আঘাত করেছিলেন তাতে তো প্রচুর রক্তপাত হওয়ার কথা কিন্তু,,,,"

       ছেলেদের আচরণে তাঁর প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেতে দেখে দুটি চোখ নলিনী দেবী 'র ভরে উঠলো নোনা জলে। আঁচলের প্রান্ত দিয়ে চোখের কোণ দুটি মুছে নিয়ে অরবিন্দ সামন্তের কথাগুলি শেষ হওয়ার পূর্বেই বলে উঠলেন ---"হয়েছিল। কিন্তু চাঁদ ঢেকে দিয়ে কিছু সময়ের মধ্যে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সে রাতে। আর তাতেই যেটুকু রক্ত ছাদে পড়েছিল তা ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। "

        অরবিন্দ সামন্ত পুনরায় প্রশ্ন করেন ---" আচ্ছা আপনি কি করে বুঝলেন চম্পা পুরোপুরি মৃত,ওকে এবার ওই ঘরে বন্ধ করে রেখে চলে যাওয়া যায় ! আর আপনার কী একবার ও মনে হল না কিছুদিনের মধ্যেই ওর শরীর থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে যা সকলকেই জানান দেবে যে চিলেকোঠা ঘরে কোনো বড় ধরনের ইঁদুর বা ওই জাতীয় জীব মরে গিয়েছে যার পচা গন্ধ ছড়াচ্ছে বাড়ির সর্বত্র ? কারণ কারোর তো স্বপ্নেও ভাবা সম্ভব ছিল না যে ওই ঘরের ভেতরে চম্পা কে মেরে আপনি ঝুলিয়ে দিয়েছেন অথচ সেই চম্পাকে খুঁজে বেড়ানোর মিথ্যা অভিনয় করে গিয়েছেন আপনি ও আপনার স্বামী অমরনাথ রায়চৌধুরী। যাইহোক আরো একটা ব্যাপার আমার মাথায় আসছে না ঘরের তালাটা কে দিয়েছিলেন ? আপনি না অমরনাথ বাবু? কারণ অমরনাথ বাবুর কাছে ওই ঘরের চাবি থাকতো তা আমরা জেনেছি নকুলের কাছে। আরো অবাক বিষয় বাড়ির কেউ যেখানে ওই ঘরটি বন্ধ থাকার রহস্য কী তা জানতো না সেখানে নকুল একজন চাকর হয়ে কী করে জানলো, তার সাথে সরলা?" 

 --" চম্পা কে হত্যা করে আমি ওই ঘরে ঝুলিয়ে দেওয়ার পর নিচে নেমে আসি ও একটি বড় মাপের তালা নিয়ে পুনরায় ওপরে উঠে চিলেকোঠা ঘরের দরজায় আটকে দিয়ে তার চাবি বড়কর্তার কাছে দিয়ে দি পরের দিন সকাল হতেই, গতরাতে তাঁর পাপ লুকোতে আমি কি অপরাধ করেছি তার সবটুকু জানাই ওঁনাকে। ওঁর তাতে কোনো অনুশোচনা দেখিনি। বরং আমাকে কঠোর স্বরে বলে উঠেছিল "-- যা ঘটে গেছে তা ভুলে যাও। মনে রেখো এটা রায়চৌধুরী বাড়ি। আমাদের পরিবারের একটা সম্মান আছে। তুমি তা কখনোই নষ্ট করতে পারো না। বরং সবটুকু ভুলে যাওয়াই ভালো। আর আজ থেকে ওই ঘরের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ থাকবে আমি সকলকে তা জানিয়ে দেবো। তুমি আমার সিদ্ধান্ত কে সমর্থন করবে শুধু, যদি জেলে যেতে না চাও।" আমি নীরব থেকে ওঁর কথাগুলিকে সমর্থন জানাই। আর আপনি ঠিক'ই বলেছেন ইন্সপেক্টর গন্ধ ছড়িয়ে পড়া খুব স্বাভাবিক ছিল আর সেই সময় যেহেতু চম্পাকে পাওয়া যাচ্ছিলো না তাই কারো সন্দেহ না হলেও রাঘবের হতো। কিন্তু প্রকৃতি আমাকে সাথ দিয়েছিল, ওই দিন থেকে  পরবর্তী তিনচার দিন টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। এই বাড়ির কেউ বড় একটা ছাদে যায় না। সরলাই যেত জামাকাপড় মেলতে‌। বৃষ্টির কারণে সরলার ও যাওয়া বন্ধ হয়। তাই হয়তো মৃত শরীর থেকে নির্গত পচা গন্ধও কারো নাকে সেভাবে আসেনি। এবার আপনার প্রশ্ন নকুল জানলো কি করে ? নকুল জেনেছিল বড় কর্তার থেকে যখন বড়কর্তা তাকে ডেকে বলেছিলেন --" চিলেকোঠা ঘরের ত্রিসীমানায় কেউ যেন না আসে তা যেন লক্ষ্য রাখিস"। কারণ কী তা নকুল জানতে চাইলে বড়কর্তা সত্যিটা বলে ফেলেন এবং সেই সত্যি জানার পর নকুল বেশ ভয় পায় এবং কাজ ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু বড়কর্তা বলেন সে যদি কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে ভিটেমাটি ছাড়া করবেন তিনি। বেচারা সহজ সরল মানুষ আমাদের দেশের লোক। ওদের বাড়ি ঘরদোর আমাদের মানিকগঞ্জের জমিদারির অন্তর্ভূক্ত। তাই ওকে ভিটেমাটি ছাড়া করার জন্য বেশি সময় লাগতো না বড়কর্তা'র তাই নকুলের ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। ফলে কারোকে কিছু বলতে না পেরে সরলাকে বলে ফেলেছিল সবটুকু। সরলা তাকে বোঝায় বড় বড় বাড়িতে এমন ছোটখাটো ঘটনা ঘটে থাকে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সরলার কথায় সাহস সঞ্চয় করে, তারপর থেকে নকুল সবটুকু মানিয়ে নিয়ে চলতে থাকে আমাদের সাথে। সরলা সেকথা আমাকে জানিয়েছিল।"

   ---"যাই বলুন নলিনী দেবী আপনার অন্যায়কে ঢাকতে প্রকৃতিও আপনাকে সাথে দিয়েছিল ভাবতে অবাক লাগছে। নইলে একটানা বৃষ্টিতে প্রমাণ লোপাট! উফ্ ভাবা যায় না।" পুলিশ ইন্সপেক্টর অরবিন্দ সামন্তের নলিনী দেবীর প্রতি ব্যঙ্গক্তি ছুঁড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালে নলিনী দেবী বলে ওঠেন "--- আমাকে আ্যারেষ্ট করবেন না স্যার? আমি এতো বড় অন্যায় করলাম।" 

      "--- অবশ্যই করা হবে। এতোবড় অন্যায় করেছেন অথচ শাস্তি পাবেন না আপনি এমন হয় ! আর এই সবকিছু সম্ভব হল রেবতী ম্যাডামের জন্য। এতো বছর ধরে যে অপরাধ লুকিয়ে রাখা হয়েছিল আপনাদের চিলেকোঠা ঘরের মধ্যে তা রেবতী ম্যাডামের জন্যই প্রকাশ পেল। ধন্যবাদ রেবতী ম্যাডাম।"কথাগুলি রেবতীর দিকে তাকিয়ে ইন্সপেক্টর অরবিন্দ সামন্ত বলে উঠলে প্রত্যুত্তরে ম্লান হাসি হেসেছিল রেবতী, কারণ সে আর যাইহোক রায়চৌধুরী পরিবারের এমন পরিণতি স্বপ্নেও আশা করে নি। 

"--- তাহলে আমাকে এখনি নিয়ে চলুন স্যার। এই বাড়িতে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি এই বাড়িতে এক মুহূর্ত থাকতে চাই না। আমার সন্তানেরা আমাকে ঘৃণা' র চোখে দেখছে! আমার আপনজনেরা আমার উপস্থিতি সহ্য করতে পারছে না, সব আমি  বুঝতে পারছি আমাকে নিয়ে চলুন। " কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন নলিনী দেবী। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কেউ নলিনী দেবীর চোখের জল মোছাতে এগিয়ে আসেনি সেই  মুহূর্তে, বরং সকলের চোখের দৃষ্টিতে ছিল তাঁর প্রতি তীব্র ঘৃনা।

      এরপর কয়েকদিন নলিনী দেবী'কে কারাবাসে থাকতে হয়েছিল । শোনা যায় ওঁনার ওপর শাস্তি জারি হওয়ার আগেই ওঁনার মৃত্যু হয় হার্ট অ্যাটাকে। তবে মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই উনি কেবল একটি কথাই পাগলিনী'র ন্যায় বলে যেতেন যা অনেকেই শুনেছে --" পাপ পাপ করেছিরে চম্পা‌। আজ সেই পাপ আমার সন্তানদের থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিলো। আজ আমার শরীর জুড়ে শুধু পাপের গন্ধ বের হচ্ছে। পচা দুর্গন্ধ। উফ্ কি গন্ধ রে। পাপেরও গন্ধ হয় রে চম্পা !"

      আর রেবতী'র কথা বলতে গেলে সে  আজও ভাবে সে রাতে চিলেকোঠা ঘরের দরজার পাল্লা দুটো খুলে গিয়েছিল হাওয়ার দাপটে যা আশ্চর্য জনক, আর তার চাইতেও আশ্চর্য জনক হলো দরজায় যে মোটা পুরনো আমলের লোহার তালাটা লাগানো ছিল তা গেল কোথায়? অনেক খোঁজাখুঁজি করা সত্ত্বেও তা খুঁজে পাওয়া যায় নি আজও। 

আশ্চর্য!!!"

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment