1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

সুরাসুর

 

সুরাসুর

তমাল দত্ত

বৃষ্টি জোরে শুরু হতেই সাগর বাইকটা রাস্তার ধারে পার্ক করে পাশের একটা বন্ধ দোকান এর ছাউনি তে আশ্রয় নিলো। অসময়ে বৃষ্টি, কখন থামবে কে যানে? রাত ভালোই হয়েছে, তারপর এই অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। রাস্তায় একটা কুকুর ও দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশের সব দোকানপাট ও বন্ধ। সাগর পকেট থেকে রুমালটা বের করে মাথা মুছতে মুছতে ফোন টা তুলে বলল, “ দিয়া শোনো আমি বৃষ্টিতে আটকে গেছি, একটু দেরি হবে তুমি ছেলেটাকে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দিও।”

ফোনটা রাখতেই একটা মিষ্টি সুর ভেসে এল সাগর এর কানে। কোথা থেকে আসছে সুর টা? আহা কি মধুর ধ্বনি। প্রান জুরিয়ে আসে। কতকটা কৌতূহল বসত সুর টার উৎপত্তি অনুসন্ধান করতে লাগলো সাগর। খুব একটা দূর থেকে আসছে না শব্দ টা। দোকানের পিছন থেকেই। কিছুদূর যেতেই সাগর এর চোখে পড়লো দোকানের পিছনের দেওয়াল এ হেলান দিয়ে একটা ছায়া মূর্তি বাঁশি বাজাছে। একটু কাছে গিয়ে ছায়ামূর্তিটাকে দেখে ভয় চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো সাগর এর। ছুটে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। তাড়াতাড়ি গাড়িটা স্টার্ট দিতেই মাথার পিছনে শক্ত কিছু একটার আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তার শরীরটা। সঙ্গে সঙ্গে লাল রক্তে ভেসে গেলো জায়গাটা। 

বাড়ির উঠানে একটা ইটের উপর খালি গায়ে,একটা নোংরা থান পড়ে বসে ছিল নন্দ। তাকে দেখে মোড়ল মশাই জিজ্ঞাসা করলেন, "কিরে নন্দ আজ মাঠে যাসনি কাজ করতে? এখানে কি করছিস?"

ইটের উপর থেকে উঠে মোড়ল মশাই এর দিকে এগিয়ে গিয়ে নন্দ বলল, "কাজেই তো গিয়েছিলাম কর্তাবাবু, কিন্তু এটার জন্যই আপনার কাছে আসতে হল।"

মোড়ল মশাই দেখলেন নন্দের হাতে গামছার ওপর একটা সদ্যজাত শিশু। কি ফুটফুটে মিষ্টি দেখতে। গায়ে হালকা ময়লা লেগেছে, হয়তো সেটা নন্দর গামছা থেকেই। বাচ্চাটার ডান পা টা অন্য পায়ের থেকে একটু ছোট এবং ব্যাকা। বাচ্চাটা কে দেখিয়ে মোড়ল মশাই জিজ্ঞাসা করলেন, "এটা কার বাচ্চা?"

" জানি না বাবু। আজ সকালে আমি আর বাবা জমিতে কাজ করতে যাই। রাস্তার ধরে আমার জমির উপর একটা ব্যাগ পড়ে ছিল। তার ভিতরে ছিল এই বাচ্চাটা। এখন আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা তাই আপনার কাছে এলুম। আপনি কিছু একটা উপায় বলুন বাবু।"

মোড়ল মশাই বেশ কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পর নন্দ কে বললেন, "বুঝলি নন্দ আমার যা মনে হচ্ছে এ কোন বড় ঘরের সন্তান। জন্ম থেকেই পঙ্গু দেখেছে তাই বাপ মা ফেলে রেখে গেছে। এর বাবা মাকে খুঁজে বের করা অসম্ভব। আর খুঁজে পেলেও কতটা তারা এই বাচ্চা কে স্বীকার করবে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। আর দারোগা ওই ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারবে না। উপরন্তু তুই খেটে খাওয়া মানুষ বেকার কাজবাজ ফেলে থানার চক্কর কাটতে হবে। তার থেকে বরং এক কাজ কর তোর বউটার পেট তো পরপর নষ্ট হয়ে গেছে, তা এই বাচ্চাকে তোরাই মানুষ করনা। নিজের সন্তানের মত।"

"কিন্তু বাবু।"

"কিন্তু কিসের? বউকি মানবে না?"

"তা না বাবু। সে তো এই বাচ্চাটাকে পেয়ে আর ছাড়তেই চায় না।"

"তাহলে?"

"বাবু এত পাপ!"

মোড়ল মশাই ধমক দিয়ে বললেন, " পাপ কিসের? পাপ  তো এর বাবা-মা করেছে। তুইতো পূণ্য করছিস।ভগবান কৃষ্ণ কেও কংসের হাত থেকে বাঁচাতে রাজা নন্দের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। ধরে নে ভগবানের এটা ই ইচ্ছা। এই শিশুকে বাঁচাতে তোর হাতে তুলে দিয়েছে ভগবান। একে খুব ভালোভাবে মানুষ করিস। এর পড়াশোনা সমস্ত খরচ আমার।"

নন্দর  চোখে জল চলে এলো। গামছার খোট দিয়ে জল মুছতে মুছতে মোড়ল মশাই কে প্রণাম করে নন্দ বলল, "আপনি ভগবান কত্তা, আপনি যা বলবেন তাই হবে।"

বাচ্চাটির মাথায় একবার হাত বুলিয়ে মোড়ল মশাই বললেন, " অনেক হয়েছে। এবার যা তাড়াতাড়ি ঘর যা। ধানগুলো কি আমার বাবা কাটবে?"

“স্যার আসবো?”  ঘরের এর বাইরে থেকে কনস্টেবল হালদার জিজ্ঞাসা করলো।

সকালের প্রাত্যহিক টা থেকে মাথা তুলে ওসি সৌম্য রায় উত্তর দিলো, “হ্যাঁ আসো।” 

“স্যার বাইরে একজন ভদ্রমহিলা এসেছেন তার স্বামির মিসিং রিপোর্ট লেখাতে। আপনার সাথে কথা বলতে চায়।”

“ভিতরে নিয়ে এসো।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই কনস্টেবল হালদার প্রবেশ করলেন ভদ্র মহিলাকে নিয়ে। মহিলার বয়স খুব একটা নয়। ওই ২৫-২৬ হবে। সুদর্শনা। স্বামির অন্তর্ধান এ শোকাহত। সৌম্য এর বলায় ভদ্রমহিলা মাথা নিচু করে সামনের চেয়ার এ বসলো। 

“হ্যাঁ বলুন কি হয়েছে আপনার?”

মহিলা চোখ মুছে উত্তর দিলো, “ আমার স্বামি সাগর রায়, আমাদের একটা রেস্তোরাঁ আছে। এই বাজার এর মুখেই। নাম 'Hunger Station' । আমরা বাড়িতেও খাবার পোঁছে দিয়ে থাকি। তাই পাশের পাড়ায় রাতের খাবার ডেলিভারি করতে গিয়েছিল। ফেরার পথে বৃষ্টি এসে যাওয়ায় কোথাও একটা দাঁড়িয়ে আমাকে ফোন ও করেছিল।"

“ফোন কি বললেন?”

“আমার ফিরতে দেরি হবে বৃষ্টি তে আটকে গেছি।”

“কোন আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি খোঁজ নিয়েছেন? মানে কারোর বাড়ি থেকে গেছেন হয়তো?”

“না। ওর কোন বন্ধু কাছাকাছি থাকেনা। আর আত্মীয় দের বাড়ি সবাইকে আমি ফোন করেছি সকালে, কোথাও নেই।”

“আপনার স্বামী মানে সাগর বাবু খাবার ডেলিভারি করতে কিভাবে গিয়ে ছিলেন?”

“ওনার নিজের বাইকে। কালো রঙের সাইন গাড়ি। নাম্বারটা WB58AD5466।”

কথাটা শেষ হওয়া মাত্র কনস্টেবল হালদার কিছু একটা ইশারা করলো সৌম্য কে। ইশারা বুঝতে পেরে সৌম্য মহিলা কে উদ্দেশ্য করে বলল, “ ঠিক আছে আপনি সাবধানে বাড়ি যান। আমরা দেখছি কি করতে পারি।”

মহিলা চলে যাবার পর হালদার বলল, “ স্যার আজ সকাল এ মহিলার বাড়ির থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা বাইক পাওয়া গেছে। আগুন লেগে গিয়েছিলো। পাড়ার লোকেরা মিলে জল ঢেলে আগুন নিভিয়েছে। গাড়ির নাম্বারটা এটাই WB58AD5466, হণ্ডা সাইন।”

“কিছু পাওয়া গেছে?”

“না মানে স্যার তেমন ভাবে দেখা হয়নি।”

“তাহলে এখানে কি করছ? এখনি যাও। আমিও যাচ্ছি।একবার খতিয়ে দেখা দরকার।”

ক্রাইম সিন এ ওসির গাড়ি টা থামতেই হালদার এগিয়ে এসে বলল, “স্যার খুব একটা বেশি ক্ষতি হয়নি। তাড়াতাড়ি লোকজনের চোখে পরে যাওয়ায় তারাই আগুনটা নিভিয়েছে। একটা রক্তের এর দাগ পাওয়া গেছে বাইকটার পাশে মনে হয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কাউকে।”

“বডি পাওয়া গেছে?”

“না স্যার। ব্লাড সাম্পেল টা ফরেন্সিক টিম নিয়ে গেছে।”

সৌম্য গাড়ি থেকে নেমে দূরে টেনে নিয়ে যাওয়া রক্তের দাগটার দিকে দেখিয়ে বলল, “ বডি যখন এখানে পাওয়া যায়নি তারমানে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোন গাড়ির ব্যবহার হয়েছে বোধহয়।”

একটু দূরে রাস্তার ধারে কিছু মুড়িয়ে যাওয়া ঘাসের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে সৌম্য বলল, “ দেখো হালদার এখানে একটা গাড়ি ছিল। চারচাকা। চাকার ছাপটা ফরেন্সিক কে নিয়ে নিতে বল। কাজে লাগবে। সম্ভবত এতে করেই সাগর বাবুকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু কোথায়? আর কিছু পাওয়া গেছে হালদার?”

“না স্যার আর তেমন কিছু না তবে গাড়িটার পাশে আধপোড়া একটা ফাঁপা লাঠি পাওয়া গেছে। দেখতে অনেকটা বাঁশির মতো। কিন্তু?"

"কিন্তু কি?”

“স্যার এতে বাঁশির মতো ওতো গুলো ফুটো নেই। একটাই রেয়েছে।”

“আচ্ছা তুমি ফরেনসিক টিমকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিপোর্ট দিতে বল আর খবর টা সাগর বাবুর স্ত্রীকে জানাতে হবে। চলো আমার সাথে।”

সাগর রায় এর বাড়ির নিচেই তাঁদের রেস্তোরাঁ। দরজায় কড়া নাড়তেই সাগর বাবুর স্ত্রী দিয়া দরজা খুললো। সৌম্য এর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো দিয়া। তাকে শান্ত করে ওসি সৌম্য রায় জিজ্ঞাসা করলো, “ আচ্ছা ওনার কারোর সাথে কোন শত্রুতা রয়েছে? কারোর সাথে কোন অশান্তি?”

দিয়া চোখের জল কোনোরকমে সামলে নিয়ে উত্তর দিলো, “না।সেরকম কেউ নেই। ছোটখাটো কথা কাটাকাটি তো হয়ে। তবে সেগুলো আবার পরে মিটেও যায়।”

“দেখুন সত্যি বলতে ফরেনসিক এর মতে ওখানে যে রক্তটা পাওয়া গেছে সেটা সাগর বাবুর এবং এত রক্ত বেরানোর পর বেঁচে থাকা টা কষ্টের ব্যাপার।তবে আপনি চিন্তা করবেন না।আমরা আপ্রান চেষ্টা করবো।”

সৌম্য একনজরে ঘরের চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে দিয়াকে জিজ্ঞাসা করলো, “ এখানে আপনারা কে কে থাকেন?”

“আমি, আমার স্বামী সাগর, আমাদের ছেলে দর্শন আর আমাদের রাঁধুনি দেবু।”

“দেবু কে দেখছিনা?”

“আসলে ও নিচেই থাকে। এখন বাজারে গেছে কিছু জিনিস আনতে।”

“নিচের রেস্তোরাঁ টা আপনাদেরই তো? বন্ধ দেখলাম।”

“হ্যাঁ। সেদিনের পর থেকে আর খুলিনি।”

“ঠিক আছে এবার আমাদের যেতে হবে। কিছু জানতে পারলে আমাদের জানাবেন। আর সবচেয়ে জরুরী সাবধানে থাকবেন।” 

কথা শেষ করে সৌম্য আর কনস্টেবল হালদার গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

“কি মনে হচ্ছে হালদার?”

“কিছু বুঝতে পারছিনা স্যার। সাগর বাবু নিজেই নিজেকে সরিয়ে ফেলেনি তো?”

সৌম্য একটু ভেবে উত্তর দিলো, “হুম হতে পারে। কিন্তু কেন?”

“হয়তো বিমা র টাকা?”

“মৃতদেহ না পেলে বিমার টাকা পাওয়া যাবেনা। আর ব্যবসা তো ভালোই চলছে হঠাৎ টাকার দরকার কেন?”

“স্যার অবৈধ সম্পর্ক না তো?”

“না সেটাও মনে হচ্ছেনা। সুখি দাম্পত্য জীবন। আশেপাশের কারোর থেকে কিছু শুনলে?”

“না স্যার। আমি লোক পাঠিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেছি। তেমন কোন খারাপ রেকর্ড পাইনি। শুধু একটু নেশা করতেন বেশি।”

“নেশা করে বউ কে মারধর করতেন কি?”

“না। স্যার।”

“হুম। আমার ও সেরকম কিছু মনে হল না। তাহলে কেন? কেন? কেন?”

আজ ঘুম থেকে উঠে কলেজে আসতে বেশ অনেক টাই দেরি হয়ে গেছে কৃষ্ণ র। কাল পরীক্ষার জন্য অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছে সে। যাক আর দুটো পরীক্ষা বাকি। আর রাত জাগতে হবে না। কলেজ এর পড়া এবারের মতো শেষ।ভেবে মনে মনে আনন্দ হলো তার। অনেক দিন পরে ফিরবে তার গ্রামের বাড়ি। এত আনন্দের মধ্যে ও কেমন একটা খারাপ লাগা ঘিরে ধরছে তাকে। আর তার বন্ধু দের সাথে দেখা হবে না। বন্ধু বলতে যদিও তেমন কেউ নেই, রিয়া ছাড়া। আর একজন আছে আকাশ, তবে সে যে শুধু নিজের স্বার্থেই বন্ধুত্ত্ব রেখেছে সেটা কৃষ্ণ ভালো করেই জানে। আসলে আকাশ, রিয়া কে ভালোবাসে সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে। তবে এখনও রিয়া কে সেভাবে কিছু বলে উঠতে পারেনি। রিয়ার সাথে বন্ধুত্ব ও হয়েছে অনেক কষ্টে, তাও কৃষ্ণর ই দয়ায়। আকাশ যে অপছন্দ থাকা সত্বেও কৃষ্ণর সাথে বন্ধুত্ব রেখেছে এটা রিয়ার ই দৌলতে। তাতে কৃষ্ণর ভালই হয়েছে, একে আকাশ কে কলেজে সবাই একটু মান্নিগন্নি করে। তারউপর আকাশের বাবা এলাকার বিধায়ক এবং কলেজে এর ট্রাস্টি বোর্ড এর সভাপতি। সুযোগ সুবিধা গুলো নেওয়া যায় আর কি। তবে আকাশ এর সাথে বিচ্ছেদের দুঃখ কৃষ্ণ র নেই। তাতে বরং ভালই হয়। কিন্তু দুঃখ যে রিয়ার থেকে দূরে যাবার। আসলে রিয়া কে কৃষ্ণ ও ভালোবাসে সেই প্রথম দিন থেকে। যেদিন কলেজে প্রথম ঢুকতেই তার খোঁড়া পা নিয়ে সবাই বিদ্রুপ করে। অবশ্য এ ঘটনা নতুন না। এই বিদ্রুপ এর শিকার তাকে ছোট থেকেই হতে হয়েছে। রিয়া কে সেদিনই প্রথম দেখে কৃষ্ণ, সমস্ত ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ এর প্রতিবাদ করতে। যেমনটা ঠিক তার মা ছোট বেলায় তাকে সমস্ত ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ থেকে রক্ষা করতো। রিয়া কে কৃষ্ণ খুব ভালোবাসে আর রিয়াও কৃষ্ণকে বিশ্বাস করে খুব। খুব তাড়াতাড়ি খুব গভীর বন্ধুত্ব ও হয়। কৃষ্ণ খুব ভালো দোতারা বাজায় আর তার এই গুনের একমাত্র পৃষ্ঠপোষক রিয়া। এই বন্ধুত্ত্ব ভাঙার ভয়েই সে এখনো পর্যন্ত রিয়াকে কিছুই বলে উঠতে পারেনি। আর বলেও কি লাভ? রিয়া র মত অত সুন্দরী, স্মার্ট, মডার্ন, পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়ে তার মতো একটা ছাপোষা, সাধাসিধে, গরীব গাঁইয়া ছেলে কে কেনই বা পছন্দ করবে? তার থেকে এই ঢের ভালো।

এক্সাম শেষ হবার পর রিয়া কে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করলো, "কি রে মনখারাপ কেনো এক্সাম ভালো হয়নি?"

"না রে খুব একটা ভালো হয়নি।"

রিয়াকে আশ্বস্ত করে কৃষ্ণ বলল, " তাতে কি হয়েছে পেপার তো টাফ ছিল। সবারই এক অবস্থা।"

রিয়া কৃষ্ণ র দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বলল, "সত্যিই তুই খুব সরল বুঝলি।"

কৃষ্ণ কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলো, "মানে?"

"আমাদের মধ্যে কার কার পরীক্ষা খারাপ হয়েছে?"

"কেনো মোটামুটি সবারই তো।"

"না সবার না। শুধু আমার, তোর, দিপা, রাহুল, অভি, শ্রদ্ধা, সৌভিক এদের।"

"তাহলে ভালো কাদের হয়েছে?"

"রোহান, প্রিয়াঙ্কা, আশীষ, পল্লব, রনি, ধার্মিক, অভয়, শ্রেয়া এদের।"

কৃষ্ণ হো হো করে হেঁসে উঠল, " তুই বলতে চাইছিস যারা কোনোদিন  বই খুলে পর্যন্ত দেখেনি তাদের পরীক্ষা আমাদের থেকে ভালো হয়েছে। আর এই রোহান তো আগের বছর এর সাপ্লি এখনও ক্লিয়ার করে উঠতে পারেনি।"

"তোর বিশ্বাস করার হলে কর, না হলে করিসনা।” , রেগে গিয়ে উত্তর দিলো রিয়া।

"আহা রাগ করছিস কেনো? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?"

"কারণ ওরা পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পেয়ে গিয়েছিলো তাই।"

"মানে?"

"মানে টা পরিষ্কার। কেউ বা কারা প্রশ্নপত্র লিক করেছে। আর সেগুলো চরা দামে বিক্রিও করছে।"

"কিন্তু এটা তো বেআইনি। তুই সিওর জানিস?"

"100 পার্সেন্ট। আগে কানাঘুষো শুনেছিলাম তেমন একটা পাত্তা দিইনি। তবে এখন মনে হচ্ছে এটাই ঠিক।"

"তাহলে আমরা যারা রাতের পর রাত জেগে পড়াশোনা করছি, তাদের কষ্টের তো কোনো দামই থাকবে না। কারা করছে এইসব?"

"নিশ্চিত জানিনা। তবে সন্দেহ হয়।"

"কারা?"

"তুই জেনে কি করবি?"

"কেনো আমরা প্রিন্সিপল কে কমপ্লেইন করবো।"

রিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপের সুরে কৃষ্ণকে বলল, "উম.....  কমপ্লেইন করবো। প্রমাণ আছে? অত নেতা হতে যেওনা বন্ধু। MLA আকাশের বাবা, তোমার বা আমার বাবা না। আর তিন দিন বাদে লাস্ট পেপার এর এক্সাম। নিজেও পড়তে বসো আর আমাকেও বসতে দাও।"

কৃষ্ণ এর মন যেনো কিছুতেই মানতে চাইলো না। এতবড় একটা অন্যায় এর খবর জেনেও চুপ থাকবে। এ শিক্ষা সে পায়নি তার মা এর কাছে। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। রিয়া বাড়ি চলে যাবার পরও একই ভাবে বসে রইলো কৃষ্ণ আর ভাবতে লাগলো কিভাবে এই অন্যায় কে আটকানো যায়।

সাগর রায় নিখোঁজ হবার পর প্রায় সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে। তার কোন খোঁজ পুলিশ এখনও পাইনি। কেস টা সবসময় ভাবাচ্ছে সৌম্য কে । একটা সাদা কাগজে পেন দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে সৌম্য কেস টা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে, এমন সময় তার ফোন বেজে উঠলো।

ফোনটা তুলে কানে দিতেই ফোনের ওপার থেকে বেশ তৎপর গলায় কনস্টেবল হালদার বলে উঠলো, “স্যার সাগর রায় মিসিং কেস এ একটা লিড পেয়েছি। আপনি থানায় আসবেন না আমি যাবো আপনার বাড়ি?”

“না তুমি থানায় থাকো। আমি ১০ মিনিটে আসছি।”

মিনিট দশেক এর মধ্যে সৌম্য পৌঁছাল থানায়। থানায় পোঁছে সবার আগে হালদারকে নিজের চেম্বার এ নিয়ে গেলো। 

“হালদার কি বলছিলে বল।”

কনস্টেবল হালদার একটা ফাইল নিয়ে টেবিলের উপর রেখে সৌম্য কে দেখিয়ে বলল, “স্যার সাগর বাবু র কেসটার মতো আরও দুটো কেস ঘটেছে। হুবহু একরকম।”

“কি বল? আরও দুটো?”

“হ্যাঁ স্যার। একটা উত্তরপাড়া থানার এবং অন্যটা পাইক পাড়া থানার আওতায় পড়ছে। প্রথম ঘটনা গত পরশু ভোরে উত্তরপাড়া স্টেশন এর পাশে একটা ছোটো ডোবার মধ্যে একটা সাদা মারুতি পরে থাকতে দেখা যায়। লোকাল লোকজন থানায় খবর দেয়। গাড়িটা উত্তরপাড়া হসপিটাল এর হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অগ্নি সেন এর। কিন্তু গাড়িতে সেদিন তাঁর স্ত্রী ছিলেন শ্রীমতী রেখা সেন। উনিই মিসিং।  গাড়ির মধ্যে একটা ফাঁপা বাঁশির মতো লাঠি পাওয়া যায় যাতে দুটো ফুটো করা।”

“আর দ্বিতীয় টা?”

“দ্বিতীয় ঘটনাটা পাইক পাড়ার বাগদেবী বিদ্যাপীঠ এর। স্কুলের ইংলিশ টিচার গায়িত্রি দত্তরাজ, ওয়াস রুম থেকে গায়েব। সেখান থেকেও একটা বিশেষ বাঁশি পাওয়া যায়, যাতে তিনটে হোল রয়েছে।ঘটনাটা ঘটে গত কাল দুপুরে।”

সৌম্য চেয়ারে বসে টেবিলের উপর মাথা রেখে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, “ উত্তরপাড়া থানায় ফোন কর হালদার।বল আমরা এখনি যাচ্ছি ওখানে।”

উত্তর পাড়া থানা থেকে গাড়ি করে প্রায় মিনিট পনেরো গেলেই উত্তরপাড়া স্টেশন। স্টেশনের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে যেটা কিছুদূর গিয়ে মেন রোডে মিশছে।স্টেশন থেকে একটু দূরে এই রাস্তার ধারেই রয়েছে একটা ডোবা। 

গাড়ি থেকে নেমে সৌম্য একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “এই সেই ডোবা ইন্সপেক্টর ?”

উত্তরপাড়া থানার ওসি ইন্সপেক্টর পাল উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ স্যার। এই সেই পদ্মপুকুর। এখানেই গত পরশু ভোরে স্টেশনের একজন হকার গাড়িটা পুকুর এ পরে থাকতে দেখে।”

“মহিলা র বাড়ি কোথায়?”

“এখানেই মানে ওই হসপিটাল এর আশেপাশেই।”

“বাড়ির লোকের সাথে কথা হয়েছে?”

“হ্যাঁ। মানে ওনার স্বামী ডাক্তার অগ্মি সেন এবং বাড়ির সবাই বলছিলেন যে উনি আগের দিন রাতে ডাক্তার বাবুর গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছিলেন নিজের মা এর কাছে যাবার জন্য।”

“কিন্তু সেখানে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আচ্ছা ওই বাঁশি মতো বস্তুটা ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেছে?”

“না স্যার। আমরা সারা এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।”

“আমরা একবার ডাক্তার সেন এর সাথে কথা বলতে চাই।”

“হ্যাঁ। অবশ্যই। এখন উনি হসপিটালেই আছেন। চলুন আমি নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের।”

হসপিটাল এ পোঁছে ডাক্তার সেন এর চেম্বারে কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর তাঁর দর্শন মিলল। নিজের চেয়ার টায় বসে সৌম্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমি ডাক্তার অগ্নি সেন। রেখার কোন খবর পেলেন?”

সৌম্য চেয়ার এ ঠিক করে বসে নিয়ে উত্তর দিলো, “এখনো পর্যন্ত না। তবে খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করবো। তবে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?”

“করুন।”

“আচ্ছা আপনার স্ত্রী যাচ্ছিলেন কোথায়?”

“আমারা শ্বশুর বাড়ি। আসলে আমার শাশুড়ি মা এর হঠাৎ করে শরীর টা একটু খারাপ হয়। আমিও যেতাম কিন্তু আমার সেদিন একটা সার্জারি পরে।তাই রেখা আমার গাড়ি নিয়ে একাই চলে যায়।”

“কারুর উপর সন্দেহ?”

“না সেরকম তো কারুর কথা মনে হচ্ছে না।”

“টাকা চেয়ে কোন ফোন এসেছিলো?”

“না সেরকম কোন ফোন এখনও আসেনি।”

“বৈবাহিক জীবন কেমন ছিল?”

“মানে ছোটোখাটো ঝামেলা তো সব সম্পর্কেই থাকে। তেমন বড় কোন অশান্তি ছিল না।”

“শ্বশুর বাড়ি কোথায়?”

“ডানকুনি।”

“ডানকুনি?”

নিজের ফোনটা থেকে সাগর এর ছবি টা ডাক্তার সেন কে দেখিয়ে সৌম্য বলল, “এনার নাম সাগর রায়, দেখুন তো চেনেন কিনা?”

ডাক্তার সেন ভ্রু কুচকে বলল, “না, চেনা তো মনে হচ্ছে না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। কিছু দরকার পরলে আবার বিরক্ত করবো। আজ চললাম।”

হসপিটাল এর বাইরে বেরিয়ে সৌম্য ইন্সপেক্টর পাল কে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনার কি মনে হয়?”

ইন্সপেক্টর পাল গা ঝারা গোছের একটা উত্তর দিয়ে ফেললেন, “কি আবার। অন্য কারোর সাথে সম্পর্ক আছে মহিলার। তাঁর সাথেই পালিয়েছে দেখুন।”

সৌম্য কি যেন একটা ভাবতে ভাবতে বির বির করে বলল, “তাহলে বাঁশি টা কি করছে ওখানে?”

“কিছু বললেন?” শুনতে না পেয়ে ইন্সপেক্টর পাল জিজ্ঞাসা করলেন।

“না কিছু না। আপনি কেস এর ফাইল টার একটা কপি আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। আমাদের এখন একটু বিদায় নিতে হবে। ধন্যবাদ।”

পাইক পাড়া থানায় পৌঁছেতে পৌছতে ওদের সন্ধ্যে হয়ে গেলো। প্রথমেই থানায় ঢুকে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার এর সাথে সাক্ষাৎ হল। ইন্সপেক্টর খান, সৌম্য এবং কনস্টেবল হালদার কে চেয়ার এ বসতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “চা বলি?”

সৌম্য পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে উত্তর দিলো, “না আজ না। আজ এর থেকেও কিছু জরুরী কাজ রয়েছে।”

সিগারেট টা ধরিয়ে নিয়ে সৌম্য জিজ্ঞাসা করলো, “গায়ত্রী দত্তরাজ। কেস টা একটু ডিটেলস এ বলবেন?”

ইন্সপেক্টর খান নিজের টেবিলের দেরাজটা টেনে একটা কালো রঙের ফাইল বের করে বলল, “মিস দত্তরাজ এখানকার একটা স্কুলের বাংলা শিক্ষিকা। এখানেই একটা ফ্ল্যাট এ একাই থাকেন। পরিবার বলতে কেউ নেই। একটি ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। ফ্ল্যাট এও আসে মাঝে মধ্যে। তবে ঘটনার পর থেকে ছেলেটা বেপাত্তা। তাই আমাদের অনেকের মনে হয় এরা দুজনে পালিয়েছে। কিন্তু?”

“কিন্তু কি?”

“আসলে আমার কেন জানিনা এটা সাধারন মনে হচ্ছে না। দেখুন কারোর যদি পালানোর থাকে তাহলে সব জিনিসপত্র ছেড়ে যাবে কেন? অন্তত টাকা পয়সা, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড অথবা কোন পরিচয় পত্র তো নিয়ে যাবে।”

“কিচ্ছু নেয় নি?”

“না। সবই তো পরে রয়েছে। তারওপর একটা বাঁশি র মতো জিনিস। সেটা ওখানে কেন?”

“সেটাই তো প্রশ্ন।”

“এছারাও আমার মাথায় এটা ঢুকছে না। এরা পালাতে যাবে কেন? দুজনেরই বাড়ির কেউ নেই। এমনিও কারোর আপত্তি তো হবার কথা না।”

“ঘটনা টা কি হয়েছিলো?”

“লাঞ্চ টাইমে খাওয়া সেরে গায়ত্রী দেবী ওয়াস রুম এ চলে যান। ক্লাস এর সময়ও যখন ফিরে আসলেন না, তখন সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। ওয়াস রুম এ গিয়ে খোঁজা শুরু করলে দেখা যায় যে দরজা ভীতর থেকে বন্ধ। দরজা ভেঙে ভিতরে কাউকে পাওয়া যায় না। শুধু মেঝে তে ওই বাঁশির মতো আজব জিনিস টা পরে। পিছনের জানলাটা ভাঙা ছিল। সম্ভবত ওটা দিয়েই......”

“একবার মিস দত্তরাজ এর ফ্ল্যাট এ যাওয়া যাবে আজ?”

“হ্যাঁ চলুন।”

ফ্ল্যাট এর ভীতর তেমন কিছু পাওয়া গেলো না। যথেষ্ট পরিপাটি করে সব কিছু গোছানো। বাথরুমে রাখা সেভিং কিট টা দেখে এটা পরিস্কার যে এখানে একজন পুরুষ ও থাকেন। হঠাৎ করে দেওয়াল এ টাঙানো একটা ছবি দেখে সেটাকে নামিয়ে নিয়ে সৌম্য বলল, “গায়ত্রী দেবীর পাশে এই মহিলা কে?”

ইন্সপেক্টর খান দেখে বললেন, “স্কুলের এক সহ শিক্ষিকা বলেছিলেন যে ইনি নাকি গায়ত্রী দেবীর কলেজের বন্ধু। নাম টা যেন কি ছিল?”

“রেখা সেন।”

“হ্যাঁ। রেখা। আপনি চেনেন?”

ছবিটা পাশের টেবিলে রেখে সৌম্য বলল, “আজই আলাপ হয়েছে। এনিও একি ভাবে মিসিং।”

“ও মাই গড।”

“আমি একবার স্কুলে দেখা করতে চাই।”

ইন্সপেক্টর খান বলল, “হ্যাঁ কোন ব্যাপার না। তবে কাল তো মে দিবস। ছুটি। পরশু সকালে চলে আসুন একবার।”

ইন্সপেক্টর খান এর কথামতো সৌম্য আর কনস্টেবল হালদার সকাল সকাল পৌঁছে গেলো পাইক পাড়া থানায়। সেখানে খান ওদের জন্য সামান্য চা জল খাবার এর আয়োজন করেছিলেন।খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা তিনজনেই বেড়িয়ে পড়লো বাগদেবী বিদ্যাপীঠ এর উদ্দেশ্যে। স্কুলে পৌঁছেই আলাপ হল গায়ত্রী দেবীর এক সহ শিক্ষিকার সাথে। 

“আপনার নাম?” গায়ত্রী দেবীর সহ শিক্ষিকাকে জিজ্ঞাসা করলো সৌম্য।

 “লিপিকা চ্যাটার্জি।” উত্তর দিলেন সহ শিক্ষিকা।

“আপনি কিছু জেনে থাকলে আমাদের বলতে পারেন। আমরা শুনেছি রাজেশ নামে কোন একটা ছেলে র সাথে গায়ত্রী দেবীর সম্পর্ক ছিল। এব্যাপার এ আপনি কিছু জানেন?”

“জানি। তবে রাজেশ এখানে নেই।”

“কোথায়?”

“জানিনা।”

“ওনার সাথে কারোর কোন শত্রুতা?”

“না তবে। একটা ছেলে। মানে ছাত্র। ১০ বি তে পরে। নাম অনিকেত পাল।বেশ কয়েকদিন আগে গায়ত্রী কে প্রেম পত্র দেয় ছেলেটি। বিরক্তও করছিলো ওকে। ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে ছেলেটির নামে কোন কমপ্লেইন ও করেনি। যেখান থেকে গায়ত্রী মিসিং হয় সেখানে প্রথম ওকেই দেখা যায়।”

“ছেলেটিকে ডেকে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।”

হঠাৎ ইন্সপেক্টর খান বললেন, “সৌম্য বাবু রাজেশ কে পাওয়া গেছে। থানায় বসে। বলছে তো মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলো ব্যবসার কাজে।”

অনিকেত কে আসতে দেখে সৌম্য বলল, “আগে এই প্রেমিক কে সামলাই, তারপর অন্যজন কে দেখছি।”

অনিকেত স্টাফ রুমে ঢুকেই অত্যন্ত নম্রতার সাথে জিজ্ঞাসা করলো, “আমাকে ডেকেছিলেন?”

লিপিকা দেবী সৌম্য কে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ। এনারা তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চান।”

সৌম্য চেয়ার থেকে উঠে অনিকেত এর কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “গায়ত্রী কোথায় অনিকেত?”

প্রশ্ন শুনে অনিকেত এর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে বলল, “আ....আমি জানিনা।”

“ঠিক আছে যখন তুমি সোজা ভাবে উত্তর দেবে না তখন তোমার বাবাকেই জানাতে হবে। তিনিও জানুক তাঁর ছেলে পড়াশোনা না করে কি করে বেড়াচ্ছে।”

এবার অনিকেত রীতিমতো ভয়ে কেঁদে ফেলেছে। ধপ করে সৌম্যর পায়ের কাছে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “স্যার বিশ্বাস করুন আমি কিছু জানিনা। আমি শুধু ম্যাডাম কে দেখছিলাম। ওনাকে ওয়াস রুমে ঢুকতে দেখে আমি চলে আসি।”

“ওখানে অন্য কাউকে যেতে দেখেছিলে?”

“না। তবে বাইরের বারান্দায় একটা লোককে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম ওয়াস রুমের দিকে। মনে হচ্ছিল ক্লিনিং এর জন্য এসেছিলো।”

“দেখতে কেমন?”

“মুখ দেখিনি। তবে লোকটার একটা পা এ মনে হয় গণ্ডগোল ছিল।”

“কিরকম গণ্ডগোল?”

“সম্ভবত ওনার ডান পা টা খোঁড়া।কেমন একটা পা টেনে টেনে হাঁটছিলেন।”

“আর কিছু?”

“না আর কিছু না।”

“ভালোভাবে ভেবে বল।”

অনিকেত কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, “আর হ্যাঁ মনে পড়েছে। ওখান থেকে বেরিয়ে আসার পর একটা খুব মিষ্টি সুর শুনতে পাচ্ছিলাম।মনে হয় সেটা ওয়াস রুম এর ভিতর থেকেই আসছিলো।”

“কিসের সুর?”

“যতদূর মনে হচ্ছে বাঁশি। তবে সুর টা খুব সুন্দর। আগে কখনও আমি এরকম সুর শুনিনি।”

সৌম্য আবার নিজের চেয়ার এ বসে অনিকেত এর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “সামনে মাধ্যমিক। মন দিয়ে পড়াশোনা টা করো। এসব করার অনেক সময় পাবে। এখন তুমি আসতে পারো।”

সৌম্য, ইন্সপেক্টর খান ও কনস্টেবল হালদার স্কুল থেকে নিজেদের কাজ শেষ করে থানায় পৌঁছে দেখল রাজেশ বাইরের বেঞ্চ এ বসে। ওদের আসতে দেখে তাড়াতাড়ি করে উঠে এসে জিজ্ঞাসা করলো, “গায়ত্রীর কোন খবর পেলেন? আজ দুদিন ধরে ওর ফোন বন্ধ। আমি তাই তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম।”

সৌম্য জিজ্ঞাসা করলো, “কোথায় ছিলেন?”

রাজেশ একটু ইতস্তত হয়ে উত্তর দিলো, “এই মুর্শিদাবাদ। বিজনেস এর কাজে।”

“আসুন ভিতরে আসুন” বললেন ইন্সপেক্টর খান।

টেবিলের পাশে রাখা একটা চেয়ার দেখিয়ে খান রাজেশের উদ্দেশ্যে বলল, “গায়ত্রী দেবী কোথায়?”

“আমি কি করে জানবো। সেটা তো আপনাদের জানার কথা। এক মিনিট আপনারা কি আমাকে সন্দেহ করছেন? আমাকে সন্দেহ করে কোন লাভ....”

“আপনারা কিসের বিজনেস?” রাজেশ এর কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই প্রশ্ন করলো সৌম্য।

“হোটেল আছে মুর্শিদাবাদ এ। আসল বিজনেস টা বাবার ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর এখন আমিই দেখি।”

“আপনার সাথে গায়ত্রী দত্তরাজ এর সম্পর্ক টা কি?”

রাজেশ চোখের জল মুছে উত্তর দিলো, “এই বছর এর শেষ আমাদের বিয়ের কথা ছিল।”

“ওনার পরিবার এর কেউ নেই?”

“না আসলে আমাদের দুজনেরই নিজের বলতে কেউ ছিলনা।”

“আপনি বাঁশি বাজাতে পারেন? বা অন্য কোন বাদ্যযন্ত্র ?”

“না।”

“আচ্ছা আপনি এখন আসতে পারেন। দরকার পরলে আবার ডেকে পাঠাবো। আর পুলিশকে না জানিয়ে শহর ছেড়ে যাবেন না।”

পাইক পাড়া থেকে কেস এর ফাইল নিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। সৌম্য একটা চা আর সিঙ্গারা অর্ডার দিয়ে নিজের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে চোখ বুজে ভাবতে বসলো।

“স্যার আমরা কি রাজেশ কেও সন্দেহ করছি?”

সৌম্য চোখ বোজা অবস্থাতেই উত্তর দিলো, “আমরা এখন অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি হালদার, কাউকেই বাদ দেওয়া চলে না।”

“কিন্তু স্যার রাজেশ যদি গায়ত্রী কে সরিয়ে থাকে তাহলে বাকি দুটো কে করলো। মানে রাজেশ এর সাথে সাগর বাবু এবং রেখা দেবীর তো কোন যোগসূত্র পাচ্ছি না।”

“সেটাই তো ভাবাচ্ছে। আর যদি গায়ত্রী কে রাজেশ ই সরিয়ে থাকে তাহলে ওই খোঁড়া লোকটি কে?”

“স্যার আপনি ওই খোঁড়া লোকটাকেও সন্দেহের তালিকায় রাখছেন?”

“হালদার আগেই বলেছি কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না, এমনকি ক্লাস ১০ এর ওই ছাত্রটি কেও না।”

সৌম্য ঠিক করে চেয়ার এ উঠে বসলো। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে একটা সুখ টান দিয়ে বলল, “তোমার চেনা কেউ আছে যে গানবাজনা নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল?”

“সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ?”

“হলে মন্দ হয়ে না।”

“না। তবে খুঁজে দেখতে হবে। কিন্তু কেন?”

“আমার মন বলছে এই মিসিং কেস গুলোর সাথে কোথাও না কোথাও মিউসিক এর যোগ রেয়ছে।”

“স্যার এটা কি আপনি ওই বাঁশি র জন্য বলছেন?”

“হ্যাঁ। তাছারাও ওই বাঁশির সুরটা যেটা অনিকেত শুনেছিলো। যদি ওটা কোন ইঙ্গিত হয়।”

“স্যার আপনার কি মনে হয় ওই বাঁশির মতো বস্তু গুলো কি?”

“আপাত দৃষ্টিতে তো এটাই মনে হচ্ছে যে ওটা কতকগুলো অপরিনত বাঁশি, ধাপে ধাপে পরিণত হচ্ছে। আর প্রত্যেকটা ধাপ হল এক একটা ভিকটিম। বাঁশির প্রত্যেকটা হোল এক একটা ভিকটিম এর সংখ্যা।”

“বাঁশি তে ফুটো কটা থাকে স্যার?”

“আমি যতদূর জানি ৭ টা।”

“তারমানে এখনও চারটে?”

“তার আগে আমাদের এটাকে আটকাতে হবে। নাহলে আমাদের আর চাকরি থাকবে না।”

“কিন্তু কিভাবে স্যার?”

“সেটাই তো আসল প্রশ্ন। কিভাবে? কেস টা আসতে আসতে কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। হালদার এক কাজ করো সাগর, রেখা আর গায়ত্রী এদের ব্যাকগ্রাউনড চেক করো। এদের মধ্যে কোন না কোন লিঙ্ক তো আছেই।”

“স্যার আপনি এতটা নিশ্চিত কিভাবে?”

“কারন রেখা ও গায়ত্রী কলেজের বন্ধু, রেখার বাপের বাড়ি ডানকুনি এবং সাগর ও ডানকুনির বাসিন্দা। হোক না হোক এদের মধ্যেকার যোগসূত্রই এই কেসের সব জট খুলবে। তোমাকে যে কাজ গুলো দিলাম সেগুলো আগে করো।”

“ওকে স্যার।”

মে মাসের প্রায় শেষ। খুব গরম পড়েছে। রোদের ঝলকানিতে খালি চোখে আকাশের দিকে তাকানো দুস্কর। শরীর টা ঠিক নেই। তাই ম্যানেজার কে যাহোক করে বুঝিয়ে একটা হাফ ডে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়েছে মহেন্দ্র। তাতে আর কি লাভ? আজ নাকি বাস এর স্ট্রাইক। প্রায় আধ ঘণ্টা হয়ে গেলো একটা ট্যাক্সি ও আসেনি। অগত্যা রাস্তায় কাঠফাটা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল মহেন্দ্র। গরম হচ্ছে খুব। জামার উপরের বোতাম টা খুলে গলার রুদ্রাক্ষের মালাটা পিঠের দিকে ঝুলিয়ে পকেট থেকে রুমালটা বের করে একবার গলার ঘামটা ভালোভাবে মুছে নিলো সে। দূর থেকে একটা হলুদ ট্যাক্সি আসতে দেখে অবশেষে স্বস্তি পেল মহেন্দ্র চৌধুরী। ট্যাক্সি টাকে দাঁর করিয়ে মহেন্দ্র ড্রাইভার কে জিজ্ঞাসা করলো, “দাদা শোভা বাজার যাবেন?”

ট্যাক্সি ড্রাইভার পানের পিক টা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে উত্তর দিলো, “যাবো। তবে আগে এনাকে ছাড়বো কলেজ স্ট্রিট।”

এতক্ষণে ট্যাক্সি র পিছন সিটে বসা পাঞ্জাবি পরা ভদ্র লোককে লক্ষ করলো মহেন্দ্র। এই দুঃসময় একটা ট্যাক্সি জুটেছে, বাড়ি পৌঁছতে পারলেই হল। পিছনের দরজাটা খুলে ট্যাক্সির সিটে নিশ্চিন্তে বসে পড়লো মহেন্দ্র। পাশের লোকটির কোলে একটা ব্যাগ, তার উপর লোকটি দুহাতে ধরে রেয়েছে একটি বাঁশি।

“আপনি বাঁশি বাজান?” লোকটির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো মহেন্দ্র।

ট্যাক্সি রাস্তা ফাঁকা পেয়ে বেশ ভালো জোরেই চলছে। “হ্যাঁ। শুনবেন আপনি?” ভদ্রলোক একগাল হেঁসে বলল।

শরীর ভালো নেই। মাথা ধরেছে। এসময় সঙ্গীত চর্চা পোষাচ্ছে না। তাই মানা করাই শ্রেয় হবে।কিন্তু তার মানা করার আগেই বাঁশিতে হাওয়া ভরে দিয়েছেন ভদ্রলোক। বাঁশির সুর শুনে মানা করতে ইচ্ছা করলো না মহেন্দ্র এর। আহা কি মিষ্টি সেই সুর। যেন নিমেষের মধ্যে সব কষ্ট দূর করে দেবে। সুরের সাথে ভাসতে ভাসতে একসময় তার চোখ বুজে এলো। নিজের অজান্তেই কখন যেন গভীর নিদ্রা তাকে গ্রাস করে নিলো।

আজ সৌম্যকে বেশ উদ্বিগ্ন লাগছে। কেস এর ফাইল গুলো একটার পর একটা উল্টেপাল্টে কি একটা খুঁজছে। হঠাৎ করে ঘরে প্রবেশ করলো কনস্টেবল হালদার। 

“স্যার একটা কথা ছিল।”

“বল।” ফাইল থেকে মাথা না তুলেই উত্তর দিলো সৌম্য।

“একজনকে পেয়েছি।তবে সঙ্গিতজ্ঞ না হলেও, গানবাজনা নিয়ে পড়াশোনা আছে। আমাদের পাড়ায় ওনার একটা গানের স্কুল আছে। ওনাকে ডাকবো?”

“ডাকো।”

“আর একটা কথা ছিল স্যার। সাগর বাবুর স্ত্রী এসেছেন। আপনার সাথে দেখা করতে চান।”

“ভিতরে আসতে বল।”

হালদার বাইরে যেতেই ঘরের ভিতরে এসে পোঁছালেন সাগর বাবুর স্ত্রী দিয়া। সৌম্যর ইসারা পেয়ে সামনের চেয়ার টাকে টেনে নিয়ে তাতে বসলেন দিয়া। 

“বলুন মিসেস রায়। কি বলবেন?”

“আসলে আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। আমার স্বামী আমাদের কারবারের জন্য তাঁর এক বন্ধুর থেকে বেশ কিছু টাকা ধার করে।”

“তারপর?” প্রশ্ন করলো সৌম্য।

“তারপর বিশেষ কারন বশত আমাদের একটু টাকা ফিরত দিতে দেরি হয়। এটা ওনাকে অনেক বার সাগর বুঝিয়েছিল। কিন্তু...”

“কিন্তু কি?”

“উনি সাগর কে মারার হুমকি দেয় সবার সামনে।”

“কি নাম ওনার?”

“পার্থ সরকার।”

“এখন আর আসেনা?”

“না। সেটাই তো সন্দহের কারন। সাগর মিসিং হওয়ার পর থেকে আমাদের বাড়ি ছাড়ুন, এলাকাতেও ওঁকে দেখা যায় নি।”

“কোথায় থাকেন?”

“ওই তো লিচুবাগান মোড়ে। নারায়ণী এপার্টমেন্ট, সেকেন্ড ফ্লোর।”

নারায়ণী এপার্টমেন্ট এর সিঁড়ী দিয়ে উঠে তিন তলার কোনের ফ্ল্যাট টা পার্থ প্রতিম সরকার এর। দরজার পাশে কালো রঙের নেম প্লেট এ বড়ো বড়ো করে লেখা রয়েছে পি. পি.  সরকার। দরজায় বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেবার পরও যখন ভীতর থেকে কেউ দরজা খুলল না, তখন বাধ্য হয়ে দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করতে হল।

ফ্ল্যাটের ভিতর টা খুব একটা গোছানো না হলেও পরিস্কার। সব মিলিয়ে দুটো ঘর আর সামনে একটা মাঝারি ডাইনিং সমেত রান্নাঘর।দেখে মনে হচ্ছে পার্থ সেখানে একাই থাকে। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পাওয়া গেলো না। দেওয়াল আলমারির বই গুলো নেড়েচেড়ে দেখছে সৌম্য, তখনই ভিতরের একটা ঘর থেকে কনস্টেবল হালদার বলল, “স্যার একবার এদিকে আসুন।”

সৌম্য সঙ্গে সঙ্গে শোবার ঘরে ঢুকে দেখল বিছানায় বালিশের উপর পড়ে রেয়েছে একটা ধনলক্ষ্মীর লকেট সহ সোনার হার। যেটা সম্ভবত পার্থরই, একটু আগে দেওয়াল এ লাগানো একটা ছবিতে দেখেছে সৌম্য। আর যে জিনিসটা রয়েছে সেটা ওদের সবারই  খুব পরিচিত। একটা অসম্পূর্ণ বাঁশি।

থানায় ফেরার পথে কনস্টেবল হালদার ও সৌম্য দুজনেই খুব চিন্তায় পড়ে গেলো। কেস টা যেন একটা কিনারায় আসতে আসতেও আসছে না। যখনই মনে হচ্ছে এই বুঝি একটা রাস্তা খুলল, ঠিক তখনও যেন অন্য রাস্তা গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি চালাতে চালাতে বেশ খানিকক্ষণের নীরবতা ভেঙে হালদার বলল, “স্যার কেস টা দিন দিন আরও পেঁচিয়ে যাচ্ছে।”

সৌম্য কোন উত্তর দিলো। চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবছে। হালদার আবার প্রশ্ন করলো, “স্যার আমরা যে ভাবছিলাম বাঁশির ফুটো গুলো মিসিং কেস এর সিরিয়াল নাম্বার নির্দেশ করছে, সেটা তাহলে ভুল?”

এতক্ষণে সৌম্য মুখ খুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, “কারন?”

“কারণ কি আবার। এই যে পার্থ সরকার এর ঘরে যে বাঁশি টা পাওয়া গেছে সেটা তে সর্বমোট পাঁচটা হোল। কিন্তু আমাদের হিসাব অনুযায়ী চারটে হবার কথা। আর কোন মিসিং কেস তো ঘটে নি।”

গাড়ি টা থানার কাছে এসে থামতে সৌম্য একটু নেড়েচেড়ে বসলো। তারপর হালদার এর দিকে তাকিয়ে বলল, “ঘটে নি? না আমরা জানিনা? একটু ভালোভাবে খবর নাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”

থানায় ঢুকেই সৌম্য জানতে পারলো এক ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে এবং ভিতরে অপেক্ষা করছে। থানার ভিতর একটা বেঞ্চ এর উপর ভদ্রলোক বসেছিলেন। সৌম্যকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে করজোড়ে নমস্কার করলেন।

“নমস্কার। আমার নাম মহেশ দাস। আজ সকালে আমাকে এখান থেকে ফোন করা হয় এবং ইন্সপেক্টর সৌম্য রায় এর সাথে দেখা করতে বলা হয়।”

“হ্যাঁ। আমিই সৌম্য রায়। আচ্ছা আপনিই কি গানবাজনা নিয়ে পড়াশোনা করছেন?”

ভদ্রলোক সগৌরবে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ। আসলে এটা আমার সখ।”

“আপনার একটু সাহায্য লাগবে।”

“বলুন কি সাহায্য করতে পারি?”

“আসলে বেশ কয়েকদিন ধরে এলাকায় অনেকগুলো মিসিং এর ঘটনা ঘটেছে। আমাদের ধারনা এই ঘটনা গুলোর সাথে কোন না কোন ভাবে মিউসিক এর যোগ আছে। তাই আপনার সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। আপনি আমার সাথে ভিতরে আসুন আপনাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি।”

সৌম্য কেস টা সমন্ধে মহেশ কে সমস্তটা বুঝিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কি এবার বুঝলেন কেন আপনাকে আমাদের এত প্রয়োজন?”

মহেশ ফাইল টা মন দিয়ে পড়ছিল। সৌম্যর প্রশ্নে মাথা তুলে বলল, “সবই তো বুঝলাম। তবে আপনার কেন মনে হচ্ছে যে এই কেস গুলোর সাথে মিউজিক এর কোন কানেকশান আছে?”

“ওই বাঁশির সুর।”

“সেটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়ও হতে পারে।”

“মানছি। কিন্তু ওই অসম্পূর্ণ বাঁশি গুলো। বাঁশি ছাড়া তো অন্য কিছুও ব্যবহার করা যেতো।”

“হুম। ঠিক আছে আমাকে একটু সময় দিন। ভাবতে হবে। আর এই ফাইল গুলোর একটা কপি আমারা লাগবে যদি সম্ভব হয়।”

“ওকে। আমি এখনই হালদার কে বলে দিচ্ছি।”

সৌম্য কনস্টেবল হালদার কে ডাকতে যাবে তার আগেই ঘরে এসে মনমরা হয়ে প্রবেশ করলো হালদার। হালদার কে এভাবে দেখে কিছু বুঝতে না পেরে সৌম্য জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে হালদার?”

“আপনিই ঠিক বলছিলেন স্যার। আর একটা বাঁশি পাওয়া গেছে। আর এটাই সেই চার নম্বর বাঁশি।”

“ও মাই গড। কবে? কোথায়?”

“মহেন্দ্র চৌধুরী। একটা বিমা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। গত পরশু দুপুর এ শরীর টা একটু খারাপ ছিল বলে অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে বেরিয়ে পরে। কিন্তু বাড়ি ঢোকেনি। ওনার স্ত্রী থানায় জানান। তারপর থানার তরফ থেকে অফিসের সামনে লাগানো সি সি টিভি ফুটেজ চেক করা হয়।”

এতক্ষণ ঘরের তৃতীয় সদস্য চুপ করে সব শুনছিলেন। এবার মহেশ প্রশ্ন করলো, “সেখান থেকে কিছু পাওয়া যায়নি?” 

“হ্যাঁ। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা ট্যাক্সি পান তিনি, সেটা তেই চেপে সেখান থেকে চলে যান। পুলিশ গাড়িটা শিবপুরে গঙ্গার ধারে একটা বন্ধ মিলের ভিতর পায়। কিন্তু পুলিশ যে নাম্বারটা দিয়ে ট্যাক্সি টা ট্রেস করছিলো সেটা নকল। আসলে গাড়িটা ওই মিলের মালিকের। তিনি কাউকে ওই ট্যাক্সিটা কিনে দিয়েছিলেন, সেই চালাত। তারপর ট্যাক্সি ড্রাইভার মারা যাবার পরথেকে ওটা ওখানেই খারাপ হয়ে পরেছিল এতদিন। মালিকের বক্তব্য কেও গাড়ি টাকে সারিয়ে সেটাকে ব্যবহার করেছে।”

“বাঁশি টা কোথায় ছিল?”

“ওই গাড়িটার মধ্যেই। আমি কেস এর ফাইলের একটা কপি আর ওই বাঁশি টাকে আমাদের পাঠাতে বলেছি।”

“এটা কোন থানার কেস?”

“জোড়াবাগান।”

“একবার সশরীরে ঘুরে আসলে ভালো হয়।”

“আজ তো হবে না স্যার।”

“কেন?”

“আজ আপনার উপরমহল থেকে ডাক পড়েছে। আমরা যখন ছিলাম না তখন ফোন এসেছিল। আমাকে হর্ষবর্ধন বাবু বললেন।”

“ভালো। এটাই বাকি ছিল।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বিরক্তির সুরে সৌম্য বলল, “আর কিছু বাজে খবর আছে বাকি?”

“স্যার আছে, কিন্তু ভালো খবর।”

“কি শুনি?”

“স্যার প্রত্যেক ভিকটিম এর মধ্যে একটা কমন লিংক রয়েছে।”

“আর কি সেই লিংক?”

“স্যার এরা প্রত্যেকে মানে সাগর রায়, রেখা সেন, গায়ত্রী দত্তরাজ, পার্থ সরকার এবং মহেন্দ্র চৌধুরী এরা সবাই একই কলেজের এবং একই ব্যাচ এর। সাল ২০১২, এস. কে. দিন্দা কলেজ।”

“বাঃ ফাটিয়ে দিয়েছ হালদার। তুমি কালকের মধ্যে এদের কমপ্লিট ডিটেলস আমাকে এনে দাও। আমি ততোক্ষণে উপরমহলের মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করে আসি। আর এই মিস্টার দাস কে একটু সাহায্য করো,ওনার কি লাগবে দেখো। মহেশ তোমাকে তুমি বললে অসুবিধা নেই তো?”

পাশেই মহেশ দাঁড়িয়ে ছিল। সৌম্যর কথা শুনে মাথা নেড়ে বলল, “না না স্যার কোন ব্যাপার না। আমাকে তুমি বলতে পারেন।”

“ওকে। তোমার কি লাগবে হালদার কে বোলো, ও তোমাকে সাহায্য করবে। কিন্তু আমি এর একটা বিহিত চাই, খুব তাড়াতাড়ি চাই।”

মহেশ দাস মাথা নিচু করে উত্তর দিলো, “আমি সম্পূর্ণ চেষ্টা করবো।” 

পরের দিন সকালে সৌম্য আগে জোড়াবাগান গেলো। সেখানে ইন্সপেক্টর সান্যাল এর সাথে দেখা হল তার। তিনিই মহেন্দ্র চৌধুরী এর মিসিং কেসটা সামলাচ্ছেন। উনি কাজের ক্ষেত্রে খুবই পরিচ্ছন্ন। কেসের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন কিনারায় পৌঁছতে পারেননি। সেটা অবশ্য সৌম্য ও পারেনি। ইন্সপেক্টর সান্যাল এর কাছে থেকে ঘটনা টা সম্বন্ধে সমস্তটা শোনার পর সৌম্য একটু চিন্তা করে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা স্যার আপনি বলছিলেন না ওই বন্ধ মিলে একটা দারোয়ান ছিল? সে কি কিছু দেখেছে?”

চা এর কাপে শেষ চুমক টা দিয়ে ইন্সপেক্টর সান্যাল বললেন, “আরে প্রথমটা তো পুলিশ দেখেই ঘাবড়ে গেছে। বলছে আমি কিছু জানিনা বাবু। তারপর যখন ধমক দিলাম তখন বলল যে বেশ কয়েকদিন ধরে মিলের আশেপাশে একজন অচেনা লোককে বেশ কয়েকবার ঘোরাফেরা করতে দেখেছে।”

“আইডেনটিফাই করা গেছে?”

“না মুখ দেখেনি। তবে বলছিল যে লোকটা নাকি খোঁড়া।”

অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে সৌম্য বলল, “খোঁড়া!”

“হ্যাঁ। কেন চেনেন নাকি এরকম কাউকে?”

সৌম্য কিছু একটা ভেবে উত্তর দিলো, “না। আপনি কেস এর ডিটেলস পাঠিয়ে দিয়েছেন তো?”

“হ্যাঁ। এমনকি ওই বাঁশি টাও। আপনি আসবেন জানলে আপনাকেই দিয়ে দিতাম।”

“ওকে। অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। কিছু দরকার পরলে আবার আসবো। আজ বেরোতে হবে।”

“আচ্ছা। কিছু প্রগ্রেস হোলে জানাবেন। আমিও আমার মতো তদন্ত করছি।”

অনেকক্ষণ ধরে রেখার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নায় এক সময় বিরক্ত হয়ে সাগর ওকে ধমক দিয়ে বলল, "তুই একটু চুপ করবি? তখন থেকে ঘ্যানঘ্যান করছিস।"

সাগরের ধমক শুনে গায়ত্রী চেয়ার থেকে উঠে বলল, "তুই ওকে বকছিস কেন? আমাদের ফাইনাল ইয়ারের পেপার বাতিল হয়ে গেছে। এক বছরের জন্য সাসপেন্ড আমরা। কান্না তো পাবেই। কিছু বলার হলে ধার্মিককে বল। ওইতো যত নষ্টের গোড়া।"

"আমি কি করলাম?" বলে উঠলো ধার্মিক।

রেখা কান্না থামিয়ে বলল, "আমি কি করলাম মানে? তুই যদি লোভে না পড়ে, কৃষ্ণ কে পেপার টা না বিক্রি করতিস তাহলে তো এত কিছু ঘটতই না।"

"আরে আমি কি করে বুঝবো শালা গেম খেলছে? আমাকে তো প্রিয়াঙ্কা এসে বলল যে কৃষ্ণর মায়ের শরীর ভালো নেই, তাই ও গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। পড়াশোনা তেমন কিছু করে উঠতে পারিনি তাই কোশ্চেন পেপার কিনতে চায়। বেশী দাম দিতেও রাজি। আমি তাই আমাদের লাভ হবে ভেবে দিয়ে দিলাম। কি করে বুঝবো শালা আমাদের পেছনে বাঁশ দেয়ার জন্য এসব করছে?"

এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল পার্থ।সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সাগরের পাশে গিয়ে বললো, "সত্যি রে মালটা যে তলে তলে আমাদের এরকম ভাবে বাঁশ দেবে বুঝতেই পারিনি। শালা মুখটা দেখলে তো মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। ভাগ্যিস আমাদের আকাশের সাথে মেলামেশা ছিল। আকাশের বাবা না থাকলে তো আজকে এর থেকে অনেক বেশি কিছু হতে পারত। মাল টার পেটে পেটে এত শয়তানি?"

ধার্মিক বলল, "হ্যাঁ ভাই এর কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে।"

পার্থ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, "আরে ওর ব্যাবস্থা তো আগেই হয়ে যেতো, যদি এই রিয়া আর তার রোমিও আকাশ মাঝখানে না আসতো। মালটা মেয়েছেলে পেয়ে এরকম সাধু হয়ে যাবে সেটা কে জানতো?"

পার্থ কে থামিয়ে সাগর বলল, "হবে ঠিক সময় সব হবে।" সাগর এর মুখটা লাল হয়ে গেছে রাগে। দাঁত এর উপর দাঁত চেপে বলল, "ও আমাদের এক বছর বরবাদ করেছে, আমি ওর সারাজীবন বরবাদ করে দেবো। যদি রিয়া আর আকাশ কে দিয়ে ওকে এখান থেকে ভাগাতে না পেরেছি তাহলে আমার নাম সাগর রায় না।"

জোড়াবাগান থেকে ফিরে থানায় পৌঁছেই নিজের চেয়ার এ গিয়ে বসে কনস্টেবল হালদার কে ডাক দিলো সৌম্য। হালদার হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, “কি হয়েছে স্যার?”

“এরপর ও কিছু হবার বাকি আছে? তোমার ওই মহেশ্বর কিছু বের করতে পারলো?”

হালদার হতাশার সুরে বলল, “না স্যার। আজ মিস্টার দাস এসেছিলেন, এই মাত্র বাড়ি গেলেন।কিছু বিষয় জানার ছিল ওনার। আবার বিকালা আসবেন বলেছেন।”

“সব অকর্মার ঢেঁকি। কারোর দ্বারা কিছু হবে না।”

সৌম্য কে এরকম রাগান্বিত অবস্থায় দেখে নিচু সুরে হালদার প্রশ্ন করলো, “স্যার উপরমহল থেকে বাজে কিছু বলেছে?”

সৌম্য একইরকম তীব্র স্বরে উত্তর দিলো, “বলবে না কি পুজো করবে? পাঁচ পাঁচটা লোক উধাও আর আমরা এতদিন কিছুই করতে পারলাম না? ছিঃ ।”

একটু থেমে নিজের রাগ কে নিয়ন্ত্রন করে সৌম্য আবার প্রশ্ন করলো, “তোমাকে যে কাজ টা দিয়েছিলাম সেটার কি খবর?” 

"হ্যাঁ স্যার আমি আজকেই কলেজে গিয়েছিলাম এবং সেখানে আমার কয়েকজন প্রফেসর দের সাথে কথাও হয়েছে।”

“কিছু জানতে পারলে?”

“স্যার এই সাগর, রেখা, গায়ত্রী, মহেন্দ্র এবং পার্থ , অর্থাৎ যারা এখনও পর্যন্ত মিসিং তাঁরা প্রত্যেকই ওই কলেজের ছাত্রছাত্রী।এমনকি ওরা একই ব্যাচ এর। শুধু তাই না, এরা এককালে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলো।”

“আর কিছু?”

“স্যার এই পাঁচজন আর এদের আরেকজন সঙ্গী ছিল ধার্মিক সাহা, প্রত্যেককে কলেজ থেকে এক বছরের জন্য সাসপেনড করা হয়।”

“কারন?”

“ফাইনাল এক্সাম এর কোশ্চেন পেপার লিক। কলেজ অথোরিটি জানতে পারে, তারপর এদের সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়।”

“এই ধার্মিক মানুষ টি এখন কোথায়?”

“স্যার আমি কলেজের পুরানো রেকর্ড থেকে ঠিকানা বের করি। কিন্তু ওখানে এখন কেউ থাকেনা। বছরখানেক আগে বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছে ওখান থেকে।”

“থাকেনা বললে হবে না। খুঁজে বের করো। বেশি দেরি হয়ে গেলে হয়তো পরবর্তী মিসিং কেসটা এই ধার্মিক এরই হবে।”

হঠাৎ সৌম্যর কেবিনের দরজায় টোকা পরতেই ওরা দুজনেই ফিরে তাকালো দরজার দিকে। মহেশ দাস হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

“ভিতরে আসতে পারি?” জিজ্ঞাসা করলো মহেশ।

“হ্যাঁ আসুন। কি ব্যাপার? হালদার যে বলল আপনার বিকালা আসার কথা।”

হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে তা থেকে একটা ফাইল বের করে টেবিলের উপর রাখলো মহেশ। ফাইল এর দুএকটা পাতা উল্টে সৌম্যর দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে ক্রাইম সিন গুলো মার্ক করা আছে। দেখুন তো ঠিক ঠাক কিনা?”

সৌম্য ও কনস্টেবল হালদার দুজনেই দেখল, সেখানে প্রত্যেকটি ক্রাইম সিন এর ছবি লাগানো রেয়েছে এবং তাতে ঘটনার ক্রমানুসারে মারকিং ও রয়েছে।

“হ্যাঁ। এগুলই।” সৌম্য বলল।

“স্যার আমার মনে হয় এই স্পট গুলোর কোন না কোন  বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।”

“হঠাৎ এরকম মনে হবার কারন?” প্রশ্ন করলো হালদার।

“আপনি প্রথম ঘটনা টাই ধরুন। যদি ভিকটিম কে কিডন্যাপ করা হয় বা মেরে ফেলাই হয়, তাহলে তাঁর গাড়িটায় আগুন লাগানোর কারন কি? আমরা তো গাড়ি থেকে কিছুই পায়নি। আর যদিও ধরে নি যে প্রমান লোপাট করা এর উদ্দেশ্য ছিল, তাহলে যে গাড়িতে করে সাগর বাবু কে জীবিত বা মৃত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়, তার টায়ার এর দাগ আর রক্তের দাগ টা মেটাল না কেন?”

“গাড়ির মালিকের পরিচয় লোকানোর চেষ্টা?”

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সৌম্য বলল, “না হালদার। গাড়ির নাম্বার প্লেট টা খুলে নিলেই তো মিটে যেতো। এত কাণ্ড করার কি ছিল? তাও আবার পাবলিক প্লেস এ।” 

মহেশ বলল, “আবার যদি আমরা দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঘটনা দেখি। উত্তর পাড়া থেকে ডানকুনি আসার পথে অনেক সুনসান এলাকা রয়েছে, কিন্তু রেখা দেবীর গাড়িটা পাওয়া গেলো উত্তর পাড়া স্টেশন এর পাশে।আবার গায়ত্রী দেবী ফ্ল্যাট এ একাই থাকছিলেন বেশ কয়েকদিন তাহলে সেখান ছেড়ে, স্কুল থেকে কেন মিসিং হলেন?”

"ইশ এই সোজা জিনিসটা কেন আমার মাথায় এলো না?” ধিক্কার এর সাথে বলল সৌম্য।

মহেশ আবার বলল, “আরও আছে স্যার। মহেন্দ্র বাবুর ক্ষেত্রে ট্যাক্সিটা আবার শিবপুরে রেখে আসার কি কারন? আবার পার্থ বাবুকে নিয়ে যাবার সময় তার গলার লকেট টা খুলে বালিশের উপর সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখার কারন কি? স্যার আমার মনে হচ্ছে যে বা যারা এগুলো করছে তারা আমাদের সাথে খেলছে। কোন না কোন ইঙ্গিত দিচ্ছে আমাদের আর আমরা সেটা ধরতে পারছি না।”

“ধরতে হবে মহেশ আর খুব তাড়াতাড়ি এই খেলা আমাদের শেষ করতে হবে। হালদার তুমি আর দাঁড়িয়ে থেকো না ধার্মিক কে খুঁজে বের করো। আমি ততক্ষণ মহেশ কে ধার্মিক এর ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি আর দেখি এই ক্রাইম সিন গুলো থেকে কিছু পাই কিনা? এসো মহেশ কাজে বসে পরা যাক।”

রাত অনেক হয়েছে এবার বাড়ি যেতে হবে ভেবে আকাশ সাগরের বাড়িতে বসা তাসের আসর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

“আর খেলবো না ভাই। এবার বাড়ি যেতে হবে।”

পার্থ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আরে দাঁরা না। এত তাড়া কিসের? পরীক্ষা তো শেষ।”

“আমার শেষ। তোদের না। পরের বছর পাশ করতে হোলে এখন থেকে ভালোভাবে পড়। পরের বার আর এসব করিস না। এবার হোলে কলেজ আর তোদের রাখবে না আর আমিও থাকবো না তোদের বাঁচানোর জন্য।”

এবার সাগর ও উঠে দাঁড়ালো। আকাশ এর কাঁধে হাত রেখে বলল, “আরে আমাদের কথা ছাড়। তুই বল, রিয়া কিছু বলল?”

আকাশ হতাশার সুরে বলল, “কি আর বলবে? তার আগে তো আমাকে বলতে হবে।”

“তারমানে তুই এখনো কিছু বলে উঠতে পারিস নি?”

“না রে ভাই। রিয়ার ওতোটা কাছে এখনো পৌঁছতে পারিনি আর ওকে একাও পাইনা। যখন ই দেখো ওই কাবাব মে হাড্ডি কৃষ্ণ লেগে আছে ওর সাথে এঁটুলির মতো।”

“তুই এক কাজ করনা। সামনে তো তোর জন্মদিন। একটা পার্টি দে আর রিয়া কেও ইনভাইট কর। সেখানেই মনের কথাটা বলে দে রিয়াকে। আমরা আছি হেল্প করে দেবো।”

আকাশ মাথা নেড়ে বলল, “না রে রিয়া আমার সাথে এতটাও ক্লোজ না যে আমার ডাকে একা একা পার্টি তে চলে আসবে।”

“কৃষ্ণ আসলে আসবে তো? তুই কৃষ্ণ কেও ডাক ওর সাথে। তারপর আমরা কৃষ্ণ কে ঠিক সাইড করে দেবো। আর কোন তৃতীয় বাক্তি থাকবে না তোর আর রিয়ার মধ্যে। তাহলে চলবে?”

আকাশ একগাল হেঁসে বলল, “চলবে মানে? বল দৌড়বে। ধন্যবাদ ভাই।”

সাগর মিষ্টি হেঁসে বলল, “আরে ধন্যবাদ কিসের? তুই না থাকলে আমাদের আজ এক্সাম পেপার লিক করার জন্য জেল ও হতে পারতো।তুই আমাদের এত বড় বিপদ থেকে বাঁচালি আর আমরা তোকে একটা ছোটো সাহায্য করতে পারবো না? তুই শুধু একটা ভালো পাব এ তোর পার্টি টা আরেঞ্জ কর। তারপর শুরু হবে আমাদের খেলা।”

গাড়ি থেকে নেমে সৌম্য, কনস্টেবল হালদার কে জিজ্ঞাসা করলো, “হালদার ঠিকানা টা ঠিক জানো তো? কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।”

রাস্তার ধারের জরাজীর্ণ একতলা বাড়িটার দরজার সামনে গিয়ে জোরে কড়া নাড়ল হালদার। অনেকক্ষণ ডাকার পরও কেউ সারা দিলো না। বাড়ি টা একটু ভেতর দিকে। আশেপাশে তেমন কোন লোকবসতি নেই। আশপাশ থেকে লতাপাতার ঝোপ ধিরে ধিরে গ্রাস করছে বাড়ি টাকে। বাড়িটাও বেশ অনেক দিনের পুরানো। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে যাবার পর হালদার বলল, “স্যার দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। কি করবো?”

সৌম্য কিছু একটা বলতে যাবে তার আগে ওরা দুজনেই শুনল ভিতর থেকে বেশ ভারী কিছু একটা পরার শব্দ এলো। সঙ্গে সঙ্গে বলল, “হালদার চলো দরজাটা ভাঙতে হবে।”

দরজা ভেঙে ভিতরে গিয়ে ওরা দেখল বাড়িটার পিছনের দরজা টা খোলা আর তার সামনে পরে রয়েছে একটা মানুষ। মানুষ না বলে বনমানুষ বললেই ভালো হয়। বড় বড় চুল, একমুখ দাড়ি। জীর্ণ দেহে ময়লা জামাকাপড় টা হ্যাঙ্গার এ ঝোলানো পোশাক এর মতো লাগছে। সম্ভবত পিছনের দরজা খুলে পালাতে গিয়ে পাশের আলমারি টায় ধাক্কা খেয়ে আঘাত পেয়ে নীচে পড়ে জ্ঞান হারিয়াছে। চোখে মুখে জল দেবার পর কিছুক্ষণ এর মধ্যেই সম্বিৎ ফিরল লোকাটির। সৌম্য ও হালদার কে দেখতে পেয়েই চমকে গিয়ে বলল, “একি, কে আপনারা? এখানে কি করছেন?”

হালদার লোকটির পাশে একটা চেয়ার এ বসেছিল। সে বলল, “আমরা ডানকুনি থানা থেকে আসছি। আপনার থেকে কিছু জানার আছে।”

লোকটি এবার একটু ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “কি? পুলিশ। আমি কিছু জানিনা। এই আপনাদের কে পাঠিয়েছে বলুন তো?”

সৌম্য জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির পিছনের পুকুরটার দিকে তাকিয়ে ছিল। লোকাটির প্রশ্ন শুনে জানলার দিক থেকে মুখ সরিয়ে বলল, “আপনিই ধার্মিক সাহা?”

“হ্যাঁ।”

“আমাদের দেখে পালাচ্ছিলেন কেন?”

লোকটি একটা ঢোঁক গিলে ভয়ে ভয়ে বলল, “পা...পা...পালাব কেন?”

সৌম্য একটা জোরে ধমক দিয়ে বলল, “এবার আর একটা মিথ্যে কথা বললে কানের নীচে এমন লাগাবো, সব ধার্মিকতা বেড়িয়ে যাবে।”

ধার্মিক এবার প্রচণ্ড ভয়ে পেয়ে গেলো। হাত জোর করে বলল, “স্যার মারবেন না স্যার। আমি সব সত্যি বলছি। স্যার আমার একটু জুয়া খেলার সখ আছে। নেশা বলতে পারেন। এর জন্য অনেক গুলো টাকা ধার হয়ে গেছে। পাওনাদার রা তাগাদা দিচ্ছে। অনেকে প্রানে মারারও হুমকি দিচ্ছে। সেই ভয়ে পৈত্রিক বাড়ি বিক্রি করে পালিয়ে আসি এখানে। আপনারা যখন দরজায় ধাক্কা দিলেন, তখন ভাবলাম আপনারা হয়তো ওই পাওনাদার দের লোক। তাই স্যার পালাতে গিয়েছিলাম। আমি কিছু করি নি স্যার।”

সৌম্য এবার একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তাতে বসে বলল, “সাগর, পার্থ, রেখা, গায়ত্রী, মহেন্দ্র এদের আপনি চেনেন?”

“হ্যাঁ স্যার চিনি আর ওদের নিখোঁজ হবার খবর ও আমি শুনেছি। স্যার আমি জানিনা ওরা কোথায় বিশ্বাস করুন।”

পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটাতে লাইটার দিয়ে আগুন লাগিয়ে সৌম্য আবার প্রশ্ন করলো, “আপনাদের কলেজ এর লাস্ট ইয়ার এর এক্সাম দেওয়া থেকে বাতিল করা হয়, কেন?”

ধার্মিক একটু লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে বলল, “স্যার সে অল্প বয়েসের ভুল স্যার।”

প্রচণ্ড রেগে গেয়ে ধার্মিক এর গালে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে সৌম্য বলল, “পরীক্ষার প্রশ্ন চুরি করে, তার নকল বানিয়ে, সেটাকে বিক্রি করা অল্প বয়সের ভুল নয় জানোয়ার।”

ধার্মিক কাঁদতে কাঁদতে বলল, “স্যার ওটা সাগর আর পার্থ এর প্লান ছিল। আমরা তো শুধু......”

ধার্মিক এর কথা শেষ হবার আগেই সৌম্য জিজ্ঞাসা করলো, “সবাই জানতে পারলো কি করে আপনাদের প্ল্যান টা?”

“স্যার একটা ছেলে আমদের সাথে পড়তো। নাম কৃষ্ণ, পদবী টা মনে নেই। ওই কলেজ অথোরিটি র কাছে ফাঁস করে সবকিছু।”

“এই কৃষ্ণ এখন কোথায়?”

“ও তো বহুদিন আগে আত্মহত্যা করেছে।”

“কেন?”

“স্যার ওঁর জেল হয়েছিলো। অপমান সহ্য করতে না পেরেই অবশেষে।” মাথা নিচু করে বলল ধার্মিক।

খাটের পাশে রাখা একটা বড় গনেশ এর হাতে আঁকা ছবি।তারই নীচে একটা ছোটো কাঠের র‍্যাক। তার উপর থেকে একটা পোড়া ধুপ কাঠির অবশিষ্ট অংশটা নিয়ে, সেটা দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে প্রশ্ন করলো সৌম্য, “আচ্ছা ওনার জেল হল কেন?”

আজ রিয়া দারুন খুশি। এই মাত্র আকাশ তাকে পার্টীতে সবার সামনে প্রপোজ করেছে আর রিয়া ও তাকে হ্যাঁ বলেছে। সত্যি কথা বলতে কি রিয়ার প্রথম দিকে আকাশ কে একবারেই সহ্য হত না। বড়লোক বাপের বেপরোয়া ছেলে। কিন্তু তারপর যেদিন থেকে আকাশ এর সাথে পরিচয় হল, ধিরে ধিরে ওর সম্বন্ধে ধারনা বদলাতে শুরু করলো রিয়ার। বাবার যতই ক্ষমতা বা পয়সা থাকুকনা কেন, আকাশ কোনোদিন সেসব নিয়ে বড়াই করেনা। পড়াশোনায় খুব একটা মন নেই। বেশিরভাগ সময়টাই নিজের পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করে আর তার পারিশ্রমিক থেকেই নিজের আনুসাঙ্গিক খরচাপাতি চালায়। সখের মধ্যে একটাই, ছবি তোলা। সব সময় গাছপালা, পশুপাখির ছবি তুলে যাচ্ছে। ক্যামেরা এর পিছনে অনেক খরচ করে আর সত্যি বলতে কি ওঁর ছবি তোলার হাতও খুব সুন্দর। রিয়া অনেকদিনই বুঝতে পেরেছিল আকাশ ওকে পছন্দ করে, কিন্তু বলতে ভয় পায় আর রিয়া ও তেমন বলার সুযোগ আকাশ কে করে দেয়নি। আসলে রিয়া নিজের বাড়ি ছেড়ে মামার কাছে এসে থাকতো শুধুমাত্র পড়াশোনার জন্য। নিজের পড়ার বাইরে খুব একটা বেশি অন্য দিকে মন দিত না সে। তারওপর রিয়ার মামা কলেজের বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক। কলেজের মধ্যে পড়াশোনা ছেড়ে এইসব? জানতে পারলে মাম আর আস্ত রাখবে না। 

রিয়ার যেন আর একমুহূর্ত আকাশ কে ছাড়া ভালো লাগছে না। ধুর কখন বাইরে গেছে এখনো আসার নাম নেই। কৃষ্ণর ও দেখা মিলছে না।

“কি রে একা কেন? তোমার রোমিও কই?”

পাশ থেকে একটা মহিলা কণ্ঠস্বর শুনে সেদিকে তাকিয়ে রিয়া বলল, “ও রেখা তুই? আর বলিস না আকাশ এর একটা বিজনেস রিলেটেড কল এলো। এখানে শোনা যাচ্ছিলো না, তাই নীচে গেছে। অনেকক্ষণ গেছে এখনো আসেনি।”

“ও এসে যাবে চিন্তা করিস না। তারপর বল, কেমন লাগলো আমাদের হিরো?”

রিয়া মুচকি হেঁসে বলল, “কেমন আর লাগবে? ঠিকঠাক।”

রেখা কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই হঠাৎ পিছন থেকে ওকে ধাক্কা দিয়ে গায়ত্রী বলল, “কি রে আমাকে একা ফেলে তোরা এখানে গল্প করছিস?”

ওদের সকলের অজান্তেই গায়ত্রীর আচমকা ধাক্কায় রেখার হাতের খাবার টা ছিটকে গিয়ে পড়েছে রিয়ার জামায়। নিজের ভুল বুঝতে পেরে গায়ত্রী দাঁত দিয়ে নিজের জিভ কেটে বলল, “এবাবা, সরি রে রিয়া, আমি একদম বুঝতে পারিনি।”

রেখা তৎক্ষণাৎ ধমক দিয়ে বলল, “তুই কিছুই বুঝিস না। দিলি তো মেয়ে টার এতো সুন্দর ড্রেস টা খারাপ করে।”

রিয়া একটা রুমাল দিয়ে জামা টা পরিস্কার করতে করতে বলল, “আরে না না ওর কোন দোষ নেই। কোন ব্যাপার না আমি পরিস্কার করে নিচ্ছি।”

“তুই এক কাজ কর, ওয়াস রুমে যা। ওখানে জল পাবি, ইট উইল বি বেটার।” 

রেখার কথা মতো ওয়াস রুমে গেলো রিয়া। খাবার এর দাগ, তারউপর সাদা জামা। দাগ ওঠার নয়। তাও যতটা সম্ভব পরিস্কার করার চেষ্টা করলো রিয়া। হঠাৎ বেসিনের সামনে লাগানো কাঁচে চোখ যেতেই চমকে উঠলো সে।

“কৃষ্ণ তুই। ভয় পাইয়ে দিয়েছিলিস। তুই লেডিস ওয়াস রুমে কি করছিস?”

কৃষ্ণর চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে। সে এক রক্ত পিপাসু রাক্ষস এর মতো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে রিয়ার দিকে। চোখের দিকে তাকালে গা শিউরে ওঠে। রিয়ার প্রশ্নের কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না কৃষ্ণ।

রিয়া কিছু বুঝতে পেরে কৃষ্ণ কে বলল, “আচ্ছা তুই বাইরে যা এবার। আমি বেড়িয়ে তোর সাথে কথা বলছি।”

“আমি তোকে ভালবাসি।” ভাঙা ভাঙা গলায় হঠাৎ বলে উঠলো কৃষ্ণ।

“কি?”

“আমি তোকে ভালবাসি।”

হো হো করে হেঁসে উঠলো রিয়া। তারপর হাঁসি থামিয়ে উত্তর দিলো, “খিল্লি করছিস তো? আকাশ কে নকল করছিস?”

কৃষ্ণ রেগে গিয়ে উত্তর দিলো, “ওকে নকল করতে যাবো কেন? ও কে? আমি তোকে ভালবাসি আর তুই আমাকে।আমাদের মাঝে আকাশ এলো কি করে?”

“এই তুই নেশা করেছিস? কই দেখি। ইস! কি খেয়েছিস তুই?”

কোন উত্তর দিলনা কৃষ্ণ। রিয়া আবার প্রশ্ন করলো, “এই তুই সিরিয়াস?”

মাথা নিচু করে কৃষ্ণ বলল, “হ্যাঁ।”

রিয়া কিছুক্ষন চুপ করে রইল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “দেখ কৃষ্ণ আমাদের মধ্যে সেই সম্পর্ক হওয়া কোনদিনও সম্ভব না। আমরা খুব ভালো বন্ধু আর সবথেকে বড় কথা আকাশ আমাকে ভালবাসে এবং আমি আকাশ কে। তুই আমার থেকে অনেক ভালো মেয়ে পাবি।আমি নিজে খুঁজবো তোর জন্য।”

কৃষ্ণ প্রচণ্ড রেগে গেলো। দিক্বিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে, গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে রিয়া কে ঠেলে ধরল পাশের দেওয়ালে। যন্ত্রণায় রিয়া চিৎকার করে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কৃষ্ণ কি করছিস তুই? ছাড় লাগছে আমার।”

রেগে চেঁচিয়ে বলল কৃষ্ণ, “আমি না কেন? কি আছে আকাশের মধ্যে যা আমার মধ্যে নেই?”

চোখের জল সামলে কৃষ্ণর চোখে চোখ রেখে রিয়া বলল, “আকাশ কোনদিন আমার সাথে জোরজবরদস্তি করে নি, যেটা তুই করছিস।”

কৃষ্ণ এই কথা শুনে যেন আরও রেগে গেলো। রিয়ার মনে হল যেন এ তার বন্ধু কৃষ্ণ না। কোন অচেনা লোক। তারসামনে যেন এক মূর্তিমান সয়তান দাঁড়িয়ে রেয়েছে। ঠোঁটের কোনে একটা সয়তানি হাঁসি নিয়ে কৃষ্ণ বলল, “আমি কোন আকাশ কে জানিনা। আমি শুধু একটা জিনিসই জানি, আমি তোকে ভালবাসি আর তুই আমায়।”

রিয়াকে জোর করে নিজের কাছে টেনে নিয়ে কৃষ্ণ আবার বলল, “আয়, আমার বুকে আয়। জড়িয়ে ধর আমায়।”

কৃষ্ণর হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর বার্থ প্রচেষ্টা করতে লাগলো রিয়া। টানা হেঁচড়ায় রিয়া র কাপড়ের বেশ খানিকটা অংশ ছিঁড়েও গেছে। বেসিনের গোঁতা খেয়ে কোমরের কাছটা অনেকটা কেটেও গিয়েছে। নিজের হাত দুটো দিয়ে প্রানপনে কৃষ্ণ কে দূরে ঠেলতে ঠেলতে রিয়া বলল, “মাতলামি করিস না কৃষ্ণ। ছাড় আমাকে। আমার.....আমার লাগছে। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।”

“কর চিৎকার। দেখি কে বাঁচায়। কই আকাশ যখন তোকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরল, চুমু খেলো তখন তো মাতলামো মনে হয়ে নি? আয় কাছে আয় আমার।”

নিজেকে কৃষ্ণর হাত থেকে বাঁচাতে অসমর্থ হয়ে সজোরে চিৎকার করলো রিয়া, “আকাশ....আকাশ.....রেখা...গায়ত্রি........হেল্প।”

রিয়ার চিৎকার এ কাজ হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়াস রুম এর দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকল আকাশ আর সাগর। ওদের পিছন পিছন পার্টি র অন্যান্য গেস্টরা। রিয়া র এরকম অবস্থা দেখে মাথায় রক্ত চেপে গেলো আকাশ এর। দৌড়ে গিয়ে কৃষ্ণর চুলের মুঠিটা ধরে টেনে এনে ওকে সজোরে ফেললো মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল কৃষ্ণ। রিয়া এই ঘটনায় খুব আঘাত পেয়েছে। আকাশ কে দেখতে পেয়ে যেন ওর ধরে প্রান এলো, শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ওকে।

“তারপর?” প্রশ্ন করলো ইন্সপেক্টর সৌম্য রায়।

ধার্মিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো, “তারপর আর কি? রিয়ার অবস্থা সেদিন খুব খারাপ ছিল। জামা কাপড় ছিরে গিয়েছিল, কেটেও গিয়েছিলো অনেক জায়গায়। স্বাভাবিক ভাবেই আকাশ প্রচণ্ড রেগে যায়। পুলিশে দেওয়া হয় কৃষ্ণ কে। আকাশ এর বাবা বিধায়ক হবার সুত্রে ওর পুলিশ মহলে অনেক কানেকশান ছিল। জেল হয় কৃষ্ণর।”

“এই আকাশের বাবার নাম কি?”

“অম্বরিশ ব্যানার্জি।”

“শিক্ষা মন্ত্রি অম্বরিশ ব্যানার্জি?” 

“হ্যাঁ।”

“তারপর?”

“জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই কৃষ্ণ র আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। রেললাইন এর পাশে বডি পাওয়া যায় ওর।”

সৌম্য কিছুক্ষন ভাবনা চিন্তা করে বলল, “আপনি এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। বাড়ির বাইরে কোথাও গেলে আমাদের জানিয়ে যাবেন। আমি ৪ জন কনস্টেবল কে পাঠাচ্ছি, যারা ছদ্মবেশে আপনার বাড়ির চারপাশে সবসময় থাকবে। পরবর্তী টার্গেট আপনি হতে পারেন, তাই সাবধানে থাকবেন। আমরা এখন আসছি। কোন সমস্যা হোলে আমার আর হালদার এর নাম্বার দেওয়া রইল, ফোন করবেন।”

বাড়িটা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে আবার একটা সিগারেট ধরাল সৌম্য। তারপর হালদার এর উদ্দেশ্যে বলল, “চারজন কনস্টেবল এর ব্যবস্থা করো। এমনভাবে ওরা ধার্মিক কে নজর এ রাখবে যাতে কেউ যেন সন্দেহ না করে।”

“ওকে স্যার।”

“আরও দুটো কাজ আছে। ইমিডিয়েট আকাশ আর রিয়ার সাথে যোগাযোগ কর আর এই কৃষ্ণর সম্বন্ধে খোঁজ লাগাও।”

“আচ্ছা স্যার। স্যার একটা প্রশ্ন ছিল।করবো?”

“হ্যাঁ করো।”

“স্যার আপনার কি মনে হয় কে করছে এইসব।”

“জানিনা। তবে যেই হোক সে এদের সকল কে চেনে এবং কৃষ্ণর সাথে ঘটা সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।”

“কৃষ্ণর পরিচিত কেউ?”

“হতে পারে। না হবার কিছুই নেই। তুমি একবার মহেশ কে ফোন করে থানায় আসতে বলতো। দরকার আছে।”

অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ স্পট লাইট টা রিয়ার উপর পরায়, চমকে উঠলো সে। নিজের ডান হাত দিয়ে নিজের চোখ আড়াল করে ফেললো। কিছুক্ষন পরে নিজের মুখের সামনে থেকে ধিরে ধিরে নিজের হাতটা সরিয়ে দেখল, তার ঠিক সামনে হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে আকাশ। রিয়ার দিকে একগোছা লাল গোলাপ বাড়িয়ে দিয়ে আকাশ বলল, “রিয়া আই লাভ ইউ। ডু ইউ?”

রিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আকাশ এর দিকে। ওর মুখের ভাষা যেন হারিয়ে গেছে। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে ওর মুখটা। আকাশ রিয়া কে পছন্দ করে সেটা সে আগে থেকে জানতো। কিন্তু এভাবে সবার সামনে প্রপোজ করবে এটা রিয়া অনুমান করে উঠতে পারেনি। 

আকাশ আবার জিজ্ঞাসা করলো, “কি রে কিছু বলবি না?”

রিয়া কি বলবে সেটা ভেবে উঠতে পারলো না। যদিও সে আকাশ কে পছন্দ করে তবুও যেন কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারলো না। পার্টিতে উপস্থিত সবার নজর রিয়ার দিকে। রিয়া কিছুক্ষন এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে আকাশের চোখের দিকে তাকাল। তারপর মুচকি হেঁসে উপর নীচে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো আকাশের প্রস্তাব এ। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ উঠে দাঁড়িয়ে রিয়া কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। রিয়া প্রথমটায় একটু ইতস্তত করলেও ধিরে ধিরে আলিঙ্গন করলো নিজের ভালোবাসার মানুষ টাকে।

সবার মতোই দূরে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ সমস্তটা দেখছিল। যতই হোক রিয়াকে তো সেও ভালোবাসতো। মনে মনে কত স্বপ্নই না দেখেছিলো সে রিয়া কে নিয়ে। চোখের জল সামলাতে পারলো না সে। চোখের কোন দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে। হঠাৎ করে পিছন থেকে একটা ডাক শুনে চোখের জল মুছে পিছন ফিরল কৃষ্ণ।

ডানহাতে ধরে রাখা হুইস্কি গ্লাস এ একটা চুমুক দিয়ে সাগর বলল, “কি রে কাঁদছিস তুই?”

“কই না তো। কাঁদবো কেন?”

আসতে করে কৃষ্ণর কাঁধে হাত দিয়ে সাগর বলল, “কার থেকে লোকাচ্ছিস ভাই? আমিও বুঝি। সব ঠিকঠাক থাকলে আজ আকাশের জায়গায় তুই থাকতিস।”

“না রে। কোথায় আকাশ আর কোথায় আমি। আমার মতো একটা সাধাসিদে, গরিব ছেলেকে কেন পছন্দ করবে কেউ?”

“তুই না বোকাই রয়ে গেলি। এখনকার মেয়েরা তোর মতো ছেলেই বেশি পছন্দ করে। রিয়ার খেয়াল রাখবি তুই, জল এনে দিবি তুই, ব্যাগ বইবি তুই আর ওর সাথে প্রেম করবে অন্য কেউ? আকাশ তোকে ব্যবহার করে রিয়া কে নিয়ে চলে গেলো আর তুই এখন বসে বসে ওদের প্রেম দেখছিস?”

“কি আর করবো? যা হবার তা হয়ে গেছে।”

ইতিমধ্যে ওদের মাঝে পার্থও এসে উপস্থিত হয়েছে। কৃষ্ণর পাশে দাঁড়িয়ে সে বলল, “কত নেকামো দেখবো। সবার সামনে কিস করছে, জড়িয়ে ধরছে। কই কৃষ্ণ তোকে তো কোনোদিন জড়িয়ে ধরেনি রিয়া? সবমেয়েই পয়সা চেনে ভাই।”

“নারে পার্থ এতে রিয়ার কোন দোষ নেই। বড়লোক এর ছেলে গুলোই এরকম। নিজের কিছু করার ক্ষমতা নেই। বাপ দাদুর পয়সায় ফুটানি করে আর গরীব ছেলে গুলোর স্বপ্ন ভাঙে। এই আমাদের কেসটাই দেখনা। কোশ্চেন পেপার লিক করার সমস্ত পরিকল্পনা আকাশ এর, কিন্তু দেখ ফাঁসল কারা?” বলল সাগর।

কিছুক্ষন চুপ থেকে সাগর আবার বলল, “যাক বাদ দে সেসব কথা।এখনও কিছু শেষ হয়নি কৃষ্ণ। ওই দেখ রিয়া ওখানে দাঁড়িয়ে রেখা দের সাথে কথা বলছে। তুই যা ওর সাথে কথা বল।”

“আমি? না না। এ আমার দ্বারা হবেনা।” , বলল কৃষ্ণ।

“হবে না মানে? হতেই হবে। পার্থ দেখি গ্লাসটা দে।”

পার্থ র হাত থেকে মদের গ্লাস টা নিয়ে কৃষ্ণ কে দিয়ে সাগর বলল, “নে এটা খেয়ে নে।”

কৃষ্ণ গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি এটা?”

“খেয়ে নে। শক্তি পাবি।”

“আমি মদ খাই না।”

ব্যঙ্গর সুরে পার্থ বলল, “উম আমি মদ খাই না। চুপচাপ খেয়ে নে। এসব খেলেই তবে রিয়া র কাছে পাত্তা পাবি। আকাশ কে দেখেলি না? নাক টিপে এক চুমুক এ খেয়ে ফেল। তারপর ফেটে পর রিয়ার কাছে গিয়ে।”

অনেকটা ওদের জোর জবরদস্তিতেই মদটা এক নিমেষে খেয়ে ফেললো কৃষ্ণ। গলা জলে গেলো ওর। দূরে রিয়া হেঁসে হেঁসে রেখাকে কি যেন বলছে। সেদিকে তাকিয়ে কৃষ্ণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমাকে আর একটা গ্লাস দে।”

পরিকল্পনা সার্থক হয়েছে ওদের। সাগর এর দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাঁসি হাসল পার্থ। কৃষ্ণর হাত থেকে গ্লাস টা নিয়ে বোতল থেকে একটু মদ ঢেলে কৃষ্ণর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে ধর।”

এক নিস্বাস এ গ্লাসটা খালি করে ফেলল কৃষ্ণ। কৃষ্ণর চোখ লাল হয়ে গেছে। এরপর আর গ্লাস না। পার্থর হাত থেকে বোতল টা নিয়ে ঢকঢক করে গলায় ঢালতে শুরু করলো কৃষ্ণ।

পার্থর পীঠে নিঃশব্দে একটা চাপ্পোড় মেরে সাগর ওর কানে ফিস ফিস করে বলল, “সাবাস পার্থ। আমাদের কাজ হয়ে গেছে। এবার শুধু খেলা শুরুর অপেক্ষা।”

টেবিলের উপর রাখা একটা সাদা কাগজে পেন দিয়ে কিছু আঁকিবুঁকি কেটে ইন্সপেক্টর সৌম্য, মহেশ কে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। হঠাৎ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো কনস্টেবল হালদার। 

“স্যার আকাশ বাবুর সাথে কথা হয়েছে। আমি ওনাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। ঘণ্টাখানেক এর মধ্যে থানায় আসছেন।”

“গুড আর ওনার প্রেমিকা?”

“স্যার আসলে ওনারা দুজনেই একসাথে আছেন। বর্ধমান এর কোন এক আত্মীয়র বাড়ি গিয়েছিলেন, ফিরে সোজা থানায় আসবেন বলেছেন।”

সৌম্য চেয়ার থেকে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করা শুরু করলো। তারপর হঠাৎ হালদার এর দিকে তাকিয়ে বলল, “কৃষ্ণ? তার কি খবর?”

সৌম্য একটু হতাশ হয়েই বলল, “স্যার পুরো নাম কৃষ্ণ মাঝি, এদের সাথে একই ব্যাচ এ পড়তো। গানবাজনার সখ ছিল, খুব ভালো দোতারা বাজাতো। কৃষ্ণর গ্রামের বাড়ি লাভপুর। প্রপার ঠিকানাটা খুঁজতে একটু বেক পেতে হচ্ছে। তবে আমি ডাটাবেস চেক করে দেখেছি, ধার্মিক সাহা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক বলছে। জেল থেকে বেড়িয়ে কৃষ্ণ আর বাড়ি ফেরেনি। সেদিনই রেললাইন এর ধার থেকে একটা ক্ষতবিক্ষত ট্রেনে কাটা মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার কিছুটা দুরেই পাওয়া যায় একটা ব্যাগ। সেখান থেকে পাওয়া কাগজপত্র থেকে দেহ সনাক্ত করা হয়। তারপর .....”

হালদার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই তাকে প্রশ্ন করলো সৌম্য, “কাগজ পত্র থেকে কেন সনাক্ত করা হয়? বডি তো পাওয়া গিয়েছিলো।”

“আসলে স্যার মৃতদেহের অবস্থা সনাক্ত করার মতো ছিল না। কিন্তু গায়ের রঙ, পোশাক এর ধরন, এমনকি উচ্চতাও মিলেছিল কৃষ্ণর সাথে।”

“তাতে কি? মুখ তো মেলানো সম্ভব হয়েনি।”

মহেশ ও কনস্টেবল হালদার দুজনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। “তার মানে?” প্রশ্ন করলো মহেশ।

“তারমানে পরিস্কার। কৃষ্ণ এখনো বেঁচে আছে আর এখানেই আছে। হালদার আমাদের অপরাধী আর কেউ নয়, এই কৃষ্ণ নিজেই। কৃষ্ণর ছবি সমস্ত থানায় পাঠিয়ে দাও, কাল সূর্য ওঠার আগে আমার ওকে এখানে চাই।”

আজ সত্যি খুব গরম পড়েছে। খুব অস্বস্তি হচ্ছে, ঘুম আসছে না। বিছানায় উঠে বসে একটা সিগারেট ধরাতে বিছানার পাশে দেশলাই এর জন্য হাতড়াতে লাগলো ধার্মিক। একি দেশলাই বাক্সে যে একটাও দেশলাই কাঠি নেই। বিরক্তির সাথে দেশলাই বাক্স টা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, পাশের সুইচ বোর্ড থেকে আলোর সুইচ টা মেরে ধার্মিক বলল, “ধুর শালা, কারেন্ট টাও এখনই যাবার ছিল?”

ঘুম আসছে না, আবার সিগারেট এরও টান ধরেছে। অগত্যা টর্চ জ্বালিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলল ধার্মিক। সেখানে নিশ্চয়ই দেশলাই পাওয়া যাবে। সারা ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। বারান্দার জানলা টা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ধার্মিক দেখল পাড়ার সবারই কারেন্ট গেছে। গরম কালে মাঝে মধ্যেই এরকম হয়। রাত হয়েছে, রাস্তায় একটাও জনমানব নেই। শুধু দূরে দুটো ছায়ামূর্তিকে হাঁটা চলা করতে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত তারা ইন্সপেক্টর রায় এর লোক। বাকি দুজন বাড়ির পিছন দিক টায় আছে, সন্ধ্যে বেলায় একবার দেখেছিলো ধার্মিক। হঠাৎ রান্নাঘরের ভিতর থেকে বাসনপত্র পড়ার আওয়াজ পেল ধার্মিক। ইস জানলাটা বোধহয় আটকাতে ভুলে গেছে, তাই বিড়াল ঢুকেছে রান্নাঘরে। তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে ঢুকে ধার্মিক দেখল, জানলাটা হাট করে খোলা। কিন্তু বিড়াল টাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। হয়তো পায়ের আওয়াজ পেয়ে যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলো সেটা দিয়েই পালিয়েছে। জানলাটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় ধার্মিক এর মনে হল কে যেন বারান্দা দিয়ে দৌড়ে ঘরের দিকে গেলো।

“কে?”

কোন সারা নেই। জানলায় ছিটকানি টা লাগিয়ে ধিরে ধিরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ধার্মিক। তারপর এ সে যা দেখল তাতে এক নিমেষে পায়ের নীচে থেকে মাটি সরে গেলো তার। ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো সে। বারন্দায়, ঠিক তার শোবার ঘরের সামনে, তার থেকে হাত ছয়েক এর মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ছায়া মূর্তি। ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো ধার্মিক, “কে....কে ওখানে?”

কোন উত্তর এলো না। উপরন্তু ছায়ামূর্তিটা নিঃশব্দে প্রবেশ করলো ধার্মিক এর শোবার ঘরে। সারা শরীর ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, ভয়ে মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। অতি কষ্টে ধার্মিক আবার বলে উঠলো, “দেখুন আপনি যেই হন না কেন, বেরিয়ে আসুন। বাইরে কিন্তু পুলিশ আছে, আমি চিৎকার করলে তারা কিন্তু এখানে চলে আসবে।”

হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে একটা সুমধুর বাঁশির শব্দ ভেসে এলো। কি মায়াবি সেই সুর। সুরের মাধুর্যে নেশাগ্রস্থ হয়ে ধার্মিক এগিয়ে চলল তার ঘরের দিকে। কোন মন্ত্র বলে যেন এই সুর তাকে বশ করেছে। এ যেন বহুচেনা সুর। হ্যাঁ তাই তো এই একই সুর কৃষ্ণ বাজাতো কলেজে পড়ার সময় তার দোতারায়। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো ধার্মিক এর। বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে দৌড়ে বাড়ির বাইরে যেতে গিয়ে মুখ থুবরে মেঝেতে পরলো। পাড়ার সবার বাড়িতে আলো এসে গেছে। কিন্তু তার বাড়িতে এখনো আলো নেই। ধার্মিক একজোড়া পায়ের শব্দ পেল তার পিছন থেকে। যেন সেগুলো তার দিকেই এগিয়ে আসছে। পায়ের শব্দ টা কেমন যেন অন্য রকম। খুঁড়িয়ে হাঁটলে ঠিক যেমন শব্দ হয়। কিন্তু কিভাবে সম্ভব। কৃষ্ণ তো মৃত। ভুত নয় তো? শত প্রশ্ন একসাথে জমাট বাঁধল তার মাথায়। কিন্তু সবার আগে পালাতে হবে। মাটিতে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো ধার্মিক। বৃথা হল তার চেষ্টা। হঠাৎ তার ঘাড়ে ভারী একটা বস্তুর আঘাত এসে পড়লো আর সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল সে। 

“কৃষ্ণ এত গুলো মানুষকে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখছে কোথায়?”, প্রশ্ন করলো মহেশ দাস। 

সৌম্য চেয়ারে বসে মাথা টেবিলের উপর রেখে কিছু একটা ভাবছিল। মহেশ এর প্রশ্নে মাথা তুলে উত্তর দিলো, “জানিনা। তবে আমার মনে হয়না ওরা কেউ বেঁচে আছে।”

“তারমানে কৃষ্ণ ওদের সবাইকে মেরে ফেলেছে?”

“হতেই পারে। না হবার কিছু নেই। তবে আমার ....”

সৌম্য তার কথা শেষ করার আগেই একজন কনস্টেবল এসে বলল, “স্যার আপনার সাথে দুজন দেখা করতে এসেছেন। নাম বললেন আকাশ ব্যানার্জি।”

“ভিতরে আসতে বোলো আর শোনো হালদার কে একবার পাঠাও তো এঘরে।”

কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘরে প্রবশ করলো আকাশ ব্যানার্জি এবং তার পিছন পিছন ঢুকল রিয়া। আকাশ বেশ লম্বা চওড়া। গায়ের রঙ একটু চাপা, তবে পোশাকআশাক এ বিলাসিতার ছাপ স্পষ্ট। ওপর দিকে রিয়ার সাজসজ্জা ওতটা জাকজমক নয় আর দরকারই বা কি? বিনা সাজসজ্জাতেই তো বেশ দেখতে লাগছে। কি মিষ্টি মুখ। ঠিক যেন সাক্ষাৎ স্বর্গপুরীর কোন অপ্সরা। চোখ সরানো দায়।

“নমস্কার। আমি আকাশ ব্যানার্জি। আপনাদের মধ্যে ইন্সপেক্টর রায় কে?”

সৌম্য হাতজোড় করে বলল, “নমস্কার আকাশ বাবু। আমিই ইন্সপেক্টর সৌম্য রায়।”

এবার রিয়ার দিকে ফিরে সৌম্য আবার জিজ্ঞাসা করলো, “আর আপনিই কি রিয়া......?”

“হ্যাঁ। আমিই রিয়া বিশ্বাস।” মুচকি হেঁসে উত্তর দিলো রিয়া।

“দেখুন সময় খুব কম। তাই আসল কথায় আসি। আপনারা আশা করি ফোনে, হালদার এর কাছ থেকে সবই শুনেছেন।”

আকাশ বলল, “হ্যাঁ শুনেছি। আসলে আমি ইন্ডিয়া তে থাকিনা। কালই সাউথ আফ্রিকা থেকে ফিরেছি। আসলে কলেজের পর কারোর সাথে সেরকম সম্পর্কও ছিল না আমাদের।”

“আপনি বাইরে কি কাজের সুত্রে থাকতেন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“কি করেন?”

“ওয়াইল্ড লাইফ ফটো অ্যান্ড ভিডিও গ্রাফার। একটা টিভি চ্যানেল এর জন্য কাজ করি।”

“আর রিয়া দেবী আপনি? আপনিও কি ওনার সাথেই থাকেন?”

রিয়া উত্তর দিলো, “না। আমি বর্ধমান এ থাকি। তবে মাস দুয়েক এর জন্য আকাশের কাছে গিয়েছিলাম। কাল দুজনে একসাথেই ফিরেছি।”

“আপনারা কি আজ আপনার বাড়িই গিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ। তারপরই এখান থেকে ফোন এলো, তাই চলে এলাম।”

“আচ্ছা আকাশ বাবু আপনারা তো কোলকাতায় থাকেন?”

“হ্যাঁ। লেক রোড। ডানকুনিতে আগে থাকতাম।”

“কাল দেশে ফেরার বিশেষ কোন কারন?”

“হ্যাঁ। আসলে পরের মাসে আমাদের দুজনের বিয়ে। তাই আরকি।এবার একেবারে বিয়ের পর যাবো।”

“আচ্ছা রিয়া দেবী আপনি কি বর্ধমান থেকে রোজ যাতায়াত করতেন কলেজে পড়ার সময়?”

“না না। আমার মামা কলেজের প্রফেসর ছিলেন। মাম মামি এখানেই থাকতেন।আমিও থাকতাম ওনাদের সাথে।”

“আচ্ছা স্যার একটা প্রশ্ন করতে পারি?” জিজ্ঞাসা করলো আকাশ।

“হ্যাঁ করুন।”

“আচ্ছা এগুলো কে করছে?”

“নিশ্চিত জানিনা। তবে আমাদের মনে হয় এসবের পিছনে কৃষ্ণ রয়েছে।”

“কৃষ্ণ!” দুজন দুজনের দিকে অবাক হয়ে তাকাল আকাশ আর রিয়া।

ওঁদের বিস্ময়ের কারন আন্দাজ করতে পেরে সৌম্য বলল, “জানি রেকর্ড অনুযায়ী ও আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আমাদের স্থির বিশ্বাস এটা ভুল। ওর জায়গায় অন্য কেউ মরেছে।”

“এরকম কেন?” প্রশ্ন করলো আকাশ।

“কারন ওর বডি সনাক্ত করা সম্ভব হয়ে নি। শুধুমাত্র ওর কিছু কাগজপত্র থেকে ধারনা করা হয়েছিলো যে মৃতদেহটা কৃষ্ণর। এখন বদলা নিচ্ছে সে। আট বছর আগে তার সাথে যা যা ঘটেছে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে সে।”

“স্যার আট বছর আগে যা হয়েছিলো তার জন্য আমরা দুজনেই প্রচণ্ড অনুতপ্ত।” মাথা নিচু করে বলল রিয়া।

“না না। আপনাদের কোন ভুল নেই। যে দোষী তাকে শাস্তি দিয়েছেন। এটা আপনাদের জায়গায় থাকলে যে কেউ করতো। কিন্তু এখন আপনাদের সামনে বিপদ।”

“আমাদের?” আকাশ ও রিয়া দুজনেই একসাথে প্রশ্ন করলো।

“হ্যাঁ। কিন্তু ভয় পাবেন না। তার আগেই এই কলির কেষ্ট কে আমি জেলে পুড়বো।”

হঠাৎ রীতিমতো দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করলো কনস্টেবল হালদার। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “স্যার। ধার্মিক সাহা মিসিং।”

চেয়ার থেকে ধরপরিয়ে উঠে পরে সৌম্য বলল, “কি? কখন? কিভাবে? কনস্টেবল গুলো কি করছিলো?”

“স্যার ওই এলাকায় কিছুক্ষন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। খানিকক্ষণ বাদেই আবার আলো চলে আসে। কিন্তু ধার্মিক বাবুর বাড়িতে আলো না দেখতে পাওয়ায় সন্দেহ হয়। চারজন কনস্টেবল যখন বাড়ির কাছাকাছি আসে তখন একটা বাঁশির সুর শুনতে পায়। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে ওরা দেখে বারন্দা রক্তে ভেসে গেছে আর সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ে রয়েছে রান্না ঘরের খোলা জানলা টা পর্যন্ত। স্যার ওই জানলা টায় কোন গ্রিল ছিল না। ওটা দিয়েই নিয়ে যাওয়া হয়েছে ধার্মিক বাবু কে। শোবার ঘরের দেওয়াল এ যে গনেশ এর পেনটিং টা ছিল, সেখানেই আগের মতো একটা বাঁশি পাওয়া যায়, উইথ সিক্স হোল স্যার।”

“কোথায় ছিল বাঁশিটা?” প্রশ্ন করলো মহেশ।

“গনেশ এর হাতে আঁকা একটা ছবি ছিল ঘরের মধ্যে আর তার সামনে একটা ছোটো কাঠের র‍্যাক মতো। সেখানেই ছিল বাঁশিটা।”

“আর এই ভিকটিম এর নাম টা কি?”

“ধার্মিক। ধার্মিক সাহা।”

"D H A R M I K"  প্রত্যেকটা অক্ষর মুখে উচ্চারন করে করে একটি বড় সাদা কাগজে লিখল মহেশ। তারপর আবার কনস্টেবল হালদার কে জিজ্ঞাসা করলেন, "একদম প্রথম যিনি মিসিং হন তাঁর নাম টা?"

"ওই তো সাগর রায়।"

বেশ কিছুক্ষন ধরে কাগজটার উপর কিসব যেন লিখল মহেশ। তারপর হঠাৎ টেবিল চাপরে উৎফুল্লতার সঙ্গে বলে উঠলো, "পেয়েছি। উফ! কি অসাধারন মিল আর কি অসাধারন প্লানিং।

সবাই অবাক হয়ে তাকাল মহেশ এর দিকে। সৌম্য বলে উঠলো, "কি হয়েছে?"

"স্যার আপনার এই কৃষ্ণ দারুন বুদ্ধিমান আর সঙ্গীত সম্বন্ধে অসীম জ্ঞান।"

"হ্যাঁ। সে তো শুনেছি দোতারা বাজাতো খুব ভালো। কিন্তু এর সাথে প্ল্যানিং এর কি সম্পর্ক?"

"স্যার আমরা প্রথম থেকে একটা জিনিস মিস করেছি।"

"কি জিনিস?" প্রশ্ন করলো হালদার।

"ক্রাইম সিন গুলো এতো এলোপাথাড়ি কেন? মানে একবার ডানকুনি থেকে মিসিং হচ্ছে, তারপর উত্তরপাড়া, তারপর দমদম আবার ডানকুনি। প্রথমে সাগর মিসিং হল কেন? কেন সাগর এর পর পার্থ নয়? কেন ধার্মিক এর নাম্বার এত পরে এলো? এসব কি শুধুই কাকতালীয়?"

সৌম্য কিছুক্ষন মাথা নিচু করে ভেবে বলল, "তুমি বলতে চাও এখানে কোন একটা সিকুয়েন্স কাজ করছে?"

"অবশ্যই। আর সেটা আমি পেয়েগেছি।সবাই এদিকে দেখুন।" , বলে টেবিলে রাখা একটা বড় কাগজের উপর নির্দেশ করলো মহেশ।

ওরা সবাই টেবিলের উপর ঝুঁকে সাদা কাগজটির উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মহেশ একাই পেনসিল দিয়ে একটা বাঁশি এঁকে ফেললো কাগজ টির উপর দিকে। 

"আমরা প্রত্যেকটা ক্রাইম সিন থেকে একটা করে বাঁশি পেয়েছি। যার প্রতি টায় একটা করে হোল বাড়ছিলো according to the number of missing person. যেমন সাগর রায় এর ক্ষেত্রে একটা হোল, রেখা সেন এর ক্ষেত্রে দুটো, গায়ত্রী দত্তরাজ এর ক্ষেত্রে তিনটে, এইরকম ভাবে আমরা এখনো পর্যন্ত ছয়টা হোলযুক্ত বাঁশি পেয়েছি। একটা সধারন বাঁশিতে সর্বমোট ৭ টা হোল থাকে। আমরা যে বাঁশিটা শেষ পেয়েছি সেটাই একটা হোল মিসিং আর সেই হোলটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই হোলটা দিয়েই বাঁশিতে ফুঁ দেওয়া হয়ে থাকে। অর্থাৎ এখনও একজন বাকি।"

মহেশ কথা শেষ করে আবার কাগজে লেখা শুরু করলো। 

"এখানে আমি  যদি বাঁশির হোল গুলোকে প্রত্যেকটা মিসিং কেস এর সিরিয়াল নম্বর ধরি তাহলে সেই অনুযায়ী নিখোঁজ ব্যাক্তিদের নামগুলো যথাক্রমে Sagar, Rekha, Gayetri, Mahendra, Partha, Dharmik."

কাগজের উপর নিখোঁজ প্রত্যেকের নাম ইংরেজি তে পরপর লিখে ফেললো মহেশ। তারপর প্রত্যেকটি নামের শুরুর দিকের বিশেষ কিছু অংশ যেমন sagar এর Sa, Rekha র Re, Gayetri র Ga, Mahendra এর Ma, Partha র Pa এবং Dharmik এর Dha পেনসিল দিয়ে গোল দাগ করে সৌমকে জিজ্ঞাসা করলো, "স্যার কিছু বুঝতে পারলেন?"

এত কিছুর পরও না বুঝতে পারার মত মাথা সৌমর না। এক নিমেষে ধরে ফেললো সে। দু চোখ জ্বল জ্বল করে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, "সরগম!"

"একদম। শুধু এটাই শেষ না। প্রত্যেকটা ক্রাইম সিন ও যথেষ্ঠ তাৎপর্য পূর্ণ, যেটা আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি।"

"সেটা কি ভাবে?" প্রশ্ন করলো হালদার।

"সা রে গা মা পা ধা নি অর্থাৎ সপ্তসুর, এর বাইরে পৃথিবীতে কোনো মিউজিক হতে পারেনা। একরকম মিউজিক এর বেস বলতে পারেন। ওয়েস্টার্ন মিউজিক এ একেই ABCDEFG দিয়ে denote করা হয়। পৌরাণিক মতে সঙ্গীত তথা সুর এর উৎপত্তি মহাদেব এর থেকেই। তিনিই এই সপ্তসুর এবং বিভিন্ন প্রকার রাগ এর সৃষ্টি করেন। এর উল্লেখ সামবেদ এও পাওয়া যায়। মানা হয় পরে নারদ মুনির ঘাড়ে এই সপ্ত সুর এবং সমস্ত সঙ্গীত এর জ্ঞান প্রচার এর দায়িত্ব বর্তায়। এই সাতটা প্রধান সুর বা এককথায় সরগম এর আওয়াজ বিভিন্ন ধরনের পশু পাখিদের থেকে নেওয়া হয়েছিল এবং এদের প্রত্যেকের সঙ্গে বিভিন্ন পৌরাণিক দেবদেবীর সংযোগ রয়েছে।"

মহেশ এর কথা শেষ হতেই সৌম্য জিজ্ঞাসা করলো, "তার সাথে আমাদের এই কেস এর কি সম্পর্ক?"

"কথিত আছে এই প্রত্যেকটা সরগম একেকজন দেবদেবীকে উৎসর্গ করা হয়েছে। যেমন সা উৎসর্গ করা হয় অগ্নিদেব কে, রে উৎসর্গ করা হয় ব্রহ্ম দেবকে, গা উৎসর্গ করা হয়েছে দেবী সরস্বতী কে, মা উচ্চারিত হয় মহাদেব এর উদ্দেশ্যে, পা উচ্চারিত হয় লক্ষ্মী দেবীর উদ্দেশ্যে এবং ধা উৎসর্গ করা হয়েছে গনেশ এর প্রতি। এবার ক্রাইম সিন গুলোকে একটু বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথম ঘটনা সাগর রায়, যেখান থেকে আমরা প্রথম বাঁশিটা পাই সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো অর্থাৎ আগুনের দেবতা, অগ্নিদেব। দ্বিতীয় ঘটনা রেখা সেন, ওনার গাড়িতে পাওয়া যায় বাঁশি আর গাড়িটা পাওয়া যায় একটা ডোবা থেকে। এবার বলে রাখা দরকার এই ডোবায় অনেক আগে প্রচুর পদ্ম ফুল হত। তাই এর নাম দেওয়া হয় পদ্মপুকুর আর পদ্ম কাকে represent করছে হালদার বাবু? "

"ব্রহ্মা! সেই অনুযায়ী গায়েত্রি দেবীর স্কুলের নাম বাগদেবী আর বাগদেবী হলেন দেবী সরস্বতী। কি সাংঘাতিক?"  বললো কনস্টেবল হালদার।

এতক্ষন গভীর মনোযোগ দিয়ে সবকিছু শুনছিল সৌম্য। এবার সে বলল, "তাহলে মহেন্দ্র যে ট্যাক্সিটা করে অফিস থেকে ফিরছিল সেটা শিবপুরে পাওয়া যায় এবং পার্থর ঘরে ধনলক্ষির লকেট। মহাদেব এবং দেবী লক্ষ্মী।"

মহেশ বলল, "একদম ঠিক। শুধু তাই নয়, শিবপুরান অনুযায়ী মহেন্দ্র ছিলেন মহাদেব এর অন্যতম শিষ্য এবং পার্থ বাবু যে বিল্ডিং এ থাকতেন তার নামটা যতদূর মনে পড়ছে নারায়ণী এপার্টমেন্ট। সংযোগ তো এখানেও রয়েছে স্যার।"

"তাহলে ধার্মিক?" প্রশ্ন করলো আকাশ।

"গনেশ এর পেইন্টিং টা, যেখান থেকে বাঁশিটা পাওয়া যায় আর আমি যতদূর জানি গনেশের আরেক নাম ধার্মিক।" বলল সৌম।"

"একদম স্যার। আমাদের অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে এর পরের ভিকটিম এর নামের আগে নি শব্দটি থাকতে হবে। আমাদের হাতে সময় নেই স্যার। কৃষ্ণর আগে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এই NI কে।"

মহেশ এর কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো রিয়া। ওর মুখে চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

"কি হয়েছে রিয়া দেবী? আপনি চেনেন এরকম কাউকে?"  জিজ্ঞাসা করলো সৌম্য।

"নিশা" ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো রিয়া।

"কে নিশা?"

"আমি।"

সবাই চমকে উঠে তাকাল রিয়ার দিকে। রিয়া বলল, "আমার ডাক নাম নিশা। এটা আমার বাড়ির লোক ছাড়া শুধু আকাশ আর কৃষ্ণই জানতো।"

মহেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে তারপর বলল, "স্যার সরগম এর নি সুর টি represent করছে রবি অর্থাৎ সূর্য দেবকে। রিয়া দেবী যদি কৃষ্ণর পরবর্তী টার্গেট হয় তাহলে আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে।"

কনস্টেবল হালদার সৌম্যর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, "কিন্তু স্যার কিভাবে?"

"জানিনা হালদার। তবে রিয়া কে আমাদের বাঁচাতেই হবে। আচ্ছা আকাশ বাবু আট বছর আগে আপনার ওই জন্মদিনের পার্টিটা কোথায় হয়েছিলো?"

আকাশ একটু চিন্তা করে বলল, "প্রথম আলো, কিন্তু সেটা তো বছর চারেক আগে আগুন লাগার পরথেকে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।"

"তাতে কি হয়েছে। ছয় জন জলজ্যান্ত মানুষ কে তুলে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখার এর থেকে ভালো জায়গা কি হতে পারে? কৃষ্ণ কে এখানেই পাওয়া যাবে। হালদার গাড়ি বের করো।"

বিষয়টা পরিস্কার না হাওয়ায় কনস্টেবল হালদার জিজ্ঞাসা করলো, "কিন্তু স্যার আপনি এতটা নিশ্চিত কি করে?"

"ওই যে মহেশ বলল সূর্য।"

হালদার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "মানে?"

"বহুবছর আগে প্রথম আলো যখন তৈরি হয় তখন ওটাই এলাকার সবথেকে উঁচু বিল্ডিং ছিল। বিল্ডিং এর উপরে যেখানে 'প্রথম আলো' লেখাটা রয়েছে, শহরের প্রথম সূর্যের আলো সেখানেই এসে পড়তো। তাই এরকম নামকরন হয়েছে। আমাদের আর সময় নষ্ট করা উচিত নয়। এখনি বেরোতে হবে।"

গাড়ি যখন প্রথম আলোর সামনে এসে থামল, তখন প্রায় রাত তিনটে বেজে গেছে। বিল্ডিং টা বেশ কয়েকবছর ধরে খালি পড়ে থাকার দরুন সেটাকে বনজঙ্গলে প্রায় ঘিরে ফেলেছে।  অন্ধকারে বিল্ডিং টার দিকে তাকালে গা শিউরে ওঠে। বিল্ডিং এর সামনে জঙ্গল সরিয়ে যাতায়াত এর মতো রাস্তা করা রয়েছে। সৌম্য রিভলভার টা হাতে নিয়ে ধীরেধীরে প্রবেশ করলো বিল্ডিং এর ভিতর। তারপর হাতের ইশারায় বাকিদের ভিতরে ডাকল।

"আকাশ বাবু পার্টিটা কোন ফ্লোর এর হয়ে ছিল?"

"সেকেন্ড ফ্লোর।"

সৌম্যর পিছন পিছন ওরা সবাই এসে পোঁছাল সেকেন্ড ফ্লোর এ। আগুণ এখানে খুব ভয়াবহ আকার নিয়েছিলো। তাই চারদিকের অবস্থা খুবই খারাপ। সেকেন্ড ফ্লোর পৌঁছতেই একটা বিশ্রী গন্ধ ভেসে এলো তাঁদের নাকে। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে একে একে এগিয়ে গেলো তারা। যতই ভিতরে যাচ্ছে গন্ধটা যেন আরও তীব্র হচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই তারা একটা ঘরে এসে প্রবেশ করলো। এখানে গন্ধ টা বেশ চড়া। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। সৌম্য পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ফ্লাস টা জ্বালতে যাবে, এমন সময় একটা মিষ্টি বাঁশির সুর ভেসে এলো ওদের কানে। বাঁশির সুরটা যেন এই দুর্গন্ধে ভরা নরকেও স্বর্গের অনুভুতি দিয়ে যাচ্ছে। শব্দ টা আসছিলো ঠিক ওদের পিছন থেকে।সৌম্য মোবাইল এর ফ্লাস টা জ্বালিয়ে পিছন দিকে ঘুরতেই ওদের সবার চোখে পড়লো একটি টেপ রেকর্ডার। যেটা ঠিক ওদের হাত তিনেকের মধ্যে একটা টেবিলের উপর রাখা রয়েছে। বাঁশির সুর টা এই টেপ রেকর্ডার থেকেই আসছে। বেশ কিছুক্ষন এই মনমুগ্ধকর সুর বাজার পর একসময় থেমে গেলো। তারপর এক পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো রেকর্ডার টা থেকে।

"আপনারা সবাই এসে গেছেন? বাঃ, খুব ভালো। আশা করি রিয়া তুই ও আছিস। আপনাদের একটা গল্প বলি শুনুন।এক প্রবল ক্ষমতাশালী রাজার একমাত্র পুত্রের একবার পাশের রাজ্যের রাজকুমারীকে ভালো লেগে যায়। রাজকুমার ভালবেসে ফেলে তাকে। বিয়ে করতে চায় রাজকুমারীকে। কিন্তু সমস্যা হল রাজকুমারী র এক বন্ধু, সেও রাজকুমারী কে পছন্দ করে। রাজকুমার কে যদি রাজকুমারীর মনের কাছাকাছি পৌঁছতে হয় তবে তাঁর বন্ধুকে রাস্তা থেকে সরাতে হবে। রাজকুমার এর কিছু অসৎ সঙ্গী ছিল যারা রাজকুমার এর পিছনে কুকর্ম করে বেড়াত। একদিন তাঁদের এই কুকর্ম ফাঁস করে দেয় রাজকুমারীর এই বন্ধু।এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে রাজকুমার ও রাজকুমারীর চোখে অপরাধী করে তোলা হয় রাজকুমারীর এই বন্ধুটিকে। শাস্তি পায় একটা নির্দোষ ছেলে।"

এরপর বেশ কিছুক্ষন সব চুপ। সবাই একমনে সেই রেকর্ডার টির অডিও শুনছিল। হঠাৎ ওটা আবার বাজতে শুরু করলো, "একথা বলা ভুল হবে যে সেদিন আমার কোন দোষ ছিলনা। আমার সবথেকে বড় দোষ ছিল কুমন্ত্রনায় কান দেওয়া আর তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা যে বন্ধু আমাকে সবথেকে বেশি বিশ্বাস করে। হয়তো আকাশ এর থেকেও বেশি। জানিস রিয়া জেল থেকে ছাড়া পাবার পর লজ্জায় আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করেনি। ভেবেছিলাম রেললাইনে মাথা দেবো। কিন্তু পারিনি।রেললাইনের ধারে বসে বসে ভাবছিলাম কিভাবে নিজেকে কম কষ্টে শেষ করা যায়। হঠাৎ নজর পড়লো পাশের মাঠে কিছু ছেলে ফুটবল খেলছে। তাদের মধ্যে একটা ছেলের দুটো পা ই কাঠের। তাও কি অসাধারণ খেলছে। মনে হল এর থেকে ভালো তো আমি আছি। যদি এতো প্রতিকুলতা সত্ত্বেও একটা বাচ্ছা নিজের মনোবল না হারায়, তাহলে আমি কেন হারাবো। আত্মহত্যার প্ল্যান ক্যানসেল করলাম। তবে ঠিক করলাম বাড়ি ফিরবো না। অনেক কষ্টে আমার গরীব মা শহরে পড়াতে পাঠিয়েছিলো। তাঁর কাছে মুখ দেখাব কি করে? বেশ কিছুদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম। তোকেও খুঁজেছিলাম।তারপর জানতে পারি তুই বাংলাদেশ এ গেছিস পড়তে। মাঝে ভেবেছিলাম আর বেঁচে থেকে কি হবে। কিন্তু যারা আমার এরকম অবস্থা করলো তাদের শাস্তি না দিলে তো আমার আত্মা শান্তি পাবেনা। তবে এখন আমার কাজ শেষ। সব দায় থেকে মুক্ত। এবার আমি নির্দ্বিধায় যেতে পারি। কিন্তু যাবার আগে একটা কথাই বলার ছিল। রিয়া আমি তোকে খুব ভালবাসি, আগেও বাসবো। ইতি তোর অসহায় বন্ধু কৃষ্ণ অরফে নিমাই।"

খট করে একটা শব্দ হয়ে রেকর্ডার টা বন্ধ হয়ে গেলো। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্নায় ফেটে পড়লো রিয়া। ভোর হয়ে এসেছে। সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে। সেই আলোতেই তারা দেখল তাদের ঠিক পিছনে সিলিং এর হুক থেকে ঝুলছে কৃষ্ণর দেহ টা আর ঠিক তার পাশেই রাখা চেয়ার গুলিতে সাজানো রেয়েছে ছ-ছটা মৃতদেহ। সেই দৃশ্য দেখে ওরা সবাই আঁতকে উঠলো। সৌম্য নিজের ফোন থেকে থানায় একটা ফোন করে খবরটা জানিয়ে তারপর কৃষ্ণর দেহটা নামানোর ব্যাবস্থা করলো। কৃষ্ণর মৃতদেহের ডানহাতে রয়েছে একটা বাঁশি। যেটা আগের পাওয়া বাঁশি গুলোর মতোই। তফাৎ শুধু একটাই, এতে সাতটা ছিদ্রই বর্তমান।শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণর হাত ধরেই তাঁর বাঁশি সম্পূর্ণতা পেয়েছে। 

রিয়া এখনও নিজেকে সামলে উঠতে পারিনি। আকাশ এর কাঁধে মাথা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিল্ডিং নীচে।চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে এখনো। কয়েকজন সিভিক ভলেনটিয়ার ধরাধরি করে মৃতদেহ গুলোকে এ্যাম্বুলেন্স এ তুলছে। কিছুক্ষন বাদে বিল্ডিং এর মেন গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো মহেশ ও ইন্সপেক্টর সৌম্য। 

মহেশ এর কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেঁসে সৌম্য বলল, "তুমি না থাকলে হয়তো এতো কিছু সম্ভবই হত না। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে।"

মহেশ লজ্জা পেয়ে বলল, "না না স্যার আমি নিজে আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ, যে আপনারা আমাকে ডেকেছেন।"

হো হো করে হেঁসে উঠলো সৌম্য। "আচ্ছা ভালো থেকো। আবার পরে দেখা হবে। হালদার তোমাকে বাড়ি ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করে দেবে।"

মহেশ চলে যাবার পর সৌম্য এসে দাঁড়ালো রিয়া ও আকাশের সামনে। "এবার তোমরা বাড়ি যেতে পারো। সারারাত জাগা, বিশ্রামের প্রয়োজন। কিছু দরকার পড়লে আমি ফোন করে নেবো।"

রিয়া বিল্ডিং এর দিকে তাকিয়ে বলল, "সেদিন আমি খুব ভুল করে ফেলেছিলাম স্যার, নিজের এত ভালো বন্ধুকে অবিশ্বাস করে। তা নাহলে আজ এতকিছু ঘটতো না।"

কিছুক্ষন চুপ থেকে সৌম্য বলল, "দেখুন যা হবার ছিল তা হয়ে গেছে। সেটাকে ভেবে আমাদের ভবিষ্যৎ কে কষ্ট দিয়ে লাভ আছে?"

"ঠিকই বলেছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে স্যার। আমাদের আর কোন সাহায্য লাগলে বলবেন।" বলল রিয়া।

"অবশ্যই।তা আপনারা এখন কোলকাতা ফিরবেন তো?"

আকাশ বলল, "হ্যাঁ সেরকমই ইচ্ছা আছে। তবে আরেকদিন আসবো। আপনাদের নিমন্ত্রন করতে। আমাদের বিয়েতে আসতে হবে কিন্তু স্যার।"

"হ্যাঁ সে আর বলতে।"

আকাশ আর রিয়া ওদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সৌম্য পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল। হালদার কারোর সাথে একটা কথা বলছিল ফোনে। কথা শেষ হতে ফোনটা কেটে সৌম্যর কাছে এসে বলল, "স্যার সাগর বাবু ছাড়া সবার বাড়িতেই খবর দেওয়া হয়েগেছে। মিসেস রায় এর ফোন লাগছে না।"

সিগারেট এ একটা টান দিয়ে সৌম্য বলল, "বাড়ির ফোনে ট্রাই করো। খবর তো দিতেই হবে।"

"স্যার পরিস্থিতি মানুষ কে কি থেকে কি বানিয়ে দেয় না। এই কৃষ্ণ কেই দেখুন না। সাধারন একটা গ্রামের ছেলে। কেউ ভাবতে পারবে যে সে এতো নিখুঁত ভাবে ছ-ছটা খুন করবে।"

"সত্যি হালদার নিখুঁত খুনি। নিজের কাজ শেষ করে নিজেকেই শেষ করে দিলো। মহেশ না থাকলে হয়তো আমরা কেস টার এত বিশ্লেষণ ও করতে পারতাম না। দুঃখ শুধু একটাই সাত জনের একজনকেও বাঁচাতে পারলাম না।"

এরপর প্রায় সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে। হঠাৎ একদিন সকালবেলা আকাশ আর রিয়া বেড়িয়ে পড়লো লাভপুরের উদ্দেশ্যে। লাভপুরে পোঁছে প্রায় ঘণ্টা খানেক এদিক ওদিক খোঁজ করার পর অবশেষে ওরা যখন কৃষ্ণর বাড়ি এসে পোঁছাল তখন প্রায় দুপুর ২ টা বেজে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে আকাশ রিয়াকে জিজ্ঞাসা করলো, "এখানে আসা টা বাড়াবাড়ি হচ্ছে না তো?"

"না রে। যতই হোক আমরা ভুল করেছি। একজন অসহায় মায়ের একমাত্র সম্বলকে কেড়ে নিয়েছি।"

"হ্যাঁ। আমরা তো টাকা পাঠিয়েও দিতে পারতাম।" 

"সবসময় টাকা টাই সবকিছু নয়। পাশে থাকার মতোও তো চাই কাউকে। বেশি কথা না বাড়িয়ে চল।"

বাড়িটার ছন্নছাড়া অবস্থা। উঠানে শুকনো পাতায় ভর্তি। মাটির দেওয়ালের এদিক ওদিক খসে পড়েছে। দরজায় দুবার করা নাড়তেই পাশ থেকে একজন বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলো, "কে? কাকে চাই?"

মাটির দালানে একটা মাদুরের উপর বাঁশের খুঁটির গায়ে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে এক অতি কৃশকায় বৃদ্ধ। তাঁর বয়েস হয়েছে অনেক সেটা তাঁর ঝুলে যাওয়া চামড়া ও শরীর দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মাথায় যেকটা চুল রয়েছে তাঁর সব কটাই পেকে গেছে। মাঝে মধ্যে ঘড় ঘড় করে তামাক টানছে আর খুক খুক করে কাশছে।

আকাশ বৃদ্ধ র কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, "দাদু এটা কি কৃষ্ণ মাঝির বাড়ি? আমরা ওর বন্ধু।"

বৃদ্ধ মাদুরের উপর থেকে চশমাটা তুলে নিয়ে চোখে পড়লো। তারপর ওদের দুজনকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বৃদ্ধ বলল, "কে নিমাই এর বন্ধু। আমি ওর দাদু। এসো ঘরে এসো।"

বৃদ্ধ ওদের পাশের একটা ঘরে নিয়ে গেলো। ঘরে তেমন কিছু নেই। একটা জলের কুঁজো, একটা মাটির গ্লাস, একটা হ্যারিকেন, একটা চৌকি আর দেওয়ালে দু তিনটে ধুলো পরা ছবি। টালির চালের ফাটল দিয়ে এদিক ওদিক আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। ওরা দুজনে এসে বসলো চৌকিতে। বৃদ্ধ দেওয়ালে ঝোলানো একটা পুরানো ছবি নামিয়ে গামছা দিয়ে ধুলো ঝেরে ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে খানিক চেয়ে থাকলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই চোখে জল চলে এলো তাঁর। চোখের জল মুছে বলল, "তা বাবা তোমরা যদি নিমাই এর সাথে দেখা করতে আসো, সে তো সম্ভব লয়।"

রিয়া মাথা নিচু করে বলল, "না না দাদু। আমরা সবটাই জানি।"

"আচ্ছা এখানে আর কেউ থাকেনা?" প্রশ্ন করলো আকাশ।

বৃদ্ধ ছবিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে বসে বলল, "থাকতো তো। সবাই থাকতো। আমি, আমার ছেলে, আমার বউমা আর আমার দুই নাতি। নিমাই আমার বড় নাতি। আমি আর আমার ছেলে জমি চষতে গিয়া নিমাইরে কুড়ায়ে পাইছিলাম। ওই আমার বড় নাতি। এরপরে ভোলানাথের এর কৃপায় আমার আর একটা নাতি হয়ে। বহুদিন আমার বউমাটার বাচ্ছা হচ্ছিলনি। লোকে বাঁজা কইত। তারপর বউমা শিবের পূজা করায় ভগবান কৃপা করলেন। আমিই নাম রাখিছিলাম শঙ্কর। শঙ্কর ছোটো হলেও এ নিমাই ছিল সকলের নয়ন এর মনি। এটা শঙ্কর এর ভালো লাগতো না। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শঙ্কর কে সবসময় আমার কাছে রাখতেম। তারপর কিছুদিন সব ঠিকই ছিল কিন্তু যেদিন থেকে শঙ্কর জানতে পারলো নিমাই আমাদের নিজের না, তবে থেকে নিমাই ওর দুচোখের বিষ হয়ে উঠলো। আমার ছেলেটা যখন মারা গেলো তখন তো শঙ্কর উঠে পরে লেগেছিল নিমাই কে তাড়াবে বলে। কিন্তু বউমার বোঝানো তে সেবারের মতো শান্ত হয়। আসলে শঙ্কর এর মা অন্ত প্রান। যতই লাথি ঝেঁটা মারুক মা কে ছেড়ে কোথাও যেতে পারতো নি। মাকে খুব ভালোবাসতো যে।"

"এখন এই শঙ্কর কোথায়?" প্রশ্ন করলো রিয়া।

বৃদ্ধর চোখের কোনে আবার জল দেখা গেলো। মাথা নিচু করে সে বলল, "জানিনে মা। নিমাই এর রেলেকাটা পরার খবর শুনে বউমা নিজেকে সামলাতে পারেনে। আগে থেকেই ওর বুকের ব্যারাম ছিল। এই ঘটনার পর যন্ত্র একেবারেই বিকল হয়ে যায়। তারপর থেকে নিমাই রেই শঙ্কর ওর মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী ভাবে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সে ঘরে ফেরে নাই। সেই থেকেই আমি একাই থাকি এ ভাঙা বাড়িতে।"

কৃষ্ণর ছবিটা রিয়ার হাতে দিয়ে বৃদ্ধ বলল, "আমার শঙ্কর পড়াশোনা আর গানবাজনা দুটোতেই খুব ভালো ছিল। গানবাজনা, লোকগান, বাউল, গিতা, পুরাণ, রামায়ন, মহাভারত, ঠাকুরদেবতা নিয়ে সবসময় আমাকে কত গল্প শোনাত।তবে আমার নিমাই ও কম ছিল না। সেও দাদার সাথে তাল মিলিয়ে চলতো। শুধু একটাই দুর্ভাগ্য নাম কৃষ্ণ হয়েও বাঁশিতে সুর দিতে পারলো না কোনোদিন।"

ওরা দুজনেই প্রায় একসাথে প্রশ্ন করলো, "কি? কৃষ্ণ বাঁশি বাজাতে পারতো না?"

"না। ছোটো থেকে তো ওর হাঁপানির সমস্যা।"

রিয়ার মনে পরে গেলো। হ্যাঁ তো কৃষ্ণ কে সে বাঁশি বাজাতে শোনেনি কোনোদিন আর তার হাপানি আছে এটাও সে রিয়া কে বলেছিল। দেওয়ালে ঝোলানো একটা ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে আকাশ জিজ্ঞাসা করলো, "এটা কার ছবি?"

বৃদ্ধ উঠে গিয়ে ছবিটা নামিয়ে ধুলো ঝেড়ে আকাশ এর হাতে দিয়ে বলল, "এটাই আমার ছোটো নাতি শঙ্কর। আসলে একা মানুষ শরীর এর জন্য আর পরিস্কার রাখতে পারিনে।"

ছবিটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলো ওরা দুজন। বিস্ফারিত চোখে তাকাল একে অপরের দিকে। 

"এটা তো ম....." রিয়া কিছু বলতে যাবার আগেই তার হাত ধরে আকাশ বলল, "দাদু আমাদের আজ যেতে হবে। আসলে অনেক দূরে যাবো। অন্যদিন আবার আসবো।"

যাবার আগে পকেট থেকে বেশ অনেক গুলো  টাকা বের করে বৃদ্ধর হাতে দিয়ে আকাশ বলল, "এটা রাখুন। না করবেন না। এটা কৃষ্ণর ই টাকা।এখন তো সে নেই, তাই এগুলো আপনারই প্রাপ্য।"

টাকা গুলো হাতে নিয়ে চোখে জল চলে এলো বৃদ্ধর। এতোদিন বাদে ভগবান তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। কতদিন যে পেট ভোরে কিছু খাননি তিনি। মনে মনে ভগবান কে ধন্যবাদ জানিয়ে টাকা গুলো মুঠো করে ধরে মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, "বাবা তোমরা আমার কাছে স্বয়ং ভগবান এর রূপ। গরীব এর ঘরে এমন কিছুই নেই যা তোমাদের দিতে পারি। শুধু মনভরে আশীর্বাদ করি তোমরা সুখে থেকো।"

ওরা বৃদ্ধকে প্রনাম করে সেখান থেকে বিদায় নিলো।

ভিতরে জোর কদমে পার্টি চলছে। নাচগান, হইহুল্লোড় কতকিছু। সবাই রেয়েছে সেখানে শুধু এরা পাঁচ জন ছাড়া। লোকজনের একটু আড়ালে এদিকটাই একটা ছোটো ঘর রয়েছে। সেখানেই লোকচক্ষুর আড়ালে এই পাঁচজন ষড়যন্ত্রকারী শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। পার্টির দিকে একবার তাকিয়ে পরিস্থিতি টা দেখে নিয়ে সাগর বলল, "সময় হয়ে এসেছে। কাকে কি করতে হবে মনে থাকবে তো?"

সবাই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ধার্মিক জিজ্ঞাসা করলো, "আমার কাজ টা কি এখানে?"

"তোকে কিচ্ছু করতে হবেনা। যা করবো আমরা করবো। তুই শুধু একটা মদের বোতল সাইড করে আমাদের দিয়ে যা এখানে।" বলল পার্থ।

কিছুক্ষন চুপ থেকে সাগর, রেখা ও গায়ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, "তোদের কাজ সবার আগে। তোরা তৈরি তো?"

রেখা আর গায়ত্রী দুজনেই মাথা নাড়ল। সাগর আবার প্রশ্ন করলো, "গায়ত্রী তুই রেখা কে লক্ষ রাখবি। ও ইশারা করলে তবেই ওদের কাছে যাবি আর ওকে পিছন থেকে ধাক্কা দিবি। তার আগে নয়। মনে থাকবে?"

গায়ত্রী বলল, "আচ্ছা। সাগর এটা কাজ করবে তো?"

"কাজ না করলে আর একবছরের জন্য না সারাজিবনের জন্য সাসপেন্ড হবি। আশাকরি তোদের বোঝানোর দরকার নেই যে এটা করা আমার পক্ষে খুব একটা কষ্টকর হবে না।" দরজার বাইরে থেকে বলল আকাশ।

সাগর আকাশের কাছে এগিয়ে গিয়ে একগাল হেঁসে বলল, "আরে তুই কখন এলি? তুই চিন্তা করিস না সব কাজ হয়ে যাবে। একদম তোর প্ল্যান মাফিক।তুই শুধু আমার উপর ভরসা রাখ আর রিয়া কে নিজের মনের কথা টা বলে দে।"

কিছুক্ষন ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে পকেট থেকে একটা সাদা কাগজের পুড়িয়া বের করে আকাশ বলল, "এটা ওর মদে মিশিয়ে দিস। ভালো কাজ করবে।"

সবাই একে অপরেরে মুখের দিকে তাকাতে লাগলো ওরা। ওদের মনের ভাব বুঝতে পেরে আকাশ বলল, "ভয় নেই এতে মরবে না। খুব কম পরিমানে আছে।"

ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার উপক্রম করলো আকাশ। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পিছনে একবার তাকাল ওদের দিকে। আকাশের চোখ গুলো সয়তানের মতো জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁটের কোনে লেগে রয়েছে পৈশাচিক এক হাঁসি। সাগর কে উদ্দেশ্য করে বলল, "এটা মদের সাথে মিশলে নেশা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেবে, মা মাসির জ্ঞান হারিয়ে যাবে। বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। এবার বুঝবে আকাশের সাথে গেম খেলার ফল কি?"

কৃষ্ণর গ্রামের বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা পথ চলে এসছে ওরা।তাও ওদের দুজনের কারোর ফোনেই সিগন্যাল আসেনি। আকাশ বিরক্ত হয়ে ফোনটা সশব্দে ফেলে রাখল ড্যাশবোর্ড এর উপর। তারপর রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, "কি রে কি ভাবছিস?"

রিয়া ঘটনার আকস্মিকতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মাথায় হাত দিয়ে পাশের সিটে বসে ছিল। আকাশের প্রশ্নে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, "ভাবছি এই সাংঘাতিক সত্যিটা আমরা নিজেদের চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও বুঝতে পারলাম না। আট বছর আগের মতো একই ভাবে ওই নির্দোষ ছেলেটাকে খুনি ভেবে বসলাম আর আসল সয়তান ভালো মানুষের মুখোশ পরে আমাদের সামনে দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। এবারেও আমারা কৃষ্ণকে মিথ্যে অপবাদ এর হাত থেকে বাঁচাতে পারলাম না।"

"এখনও কিছু শেষ হয়নি রিয়া। মহেশ কে চাইলে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব।"

কথা বলতে বলতে হঠাৎ আকাশের নজর গেলো ফোনটার দিকে। একটা whatsapp notification এলো। তাহলে এতক্ষন বাদে সিগন্যাল এসেছে। আকাশ একহাতে স্টিয়ারিং টা সামলে অন্য হাতে মোবাইল টা তুলে নিয়ে ফোন লাগাল ইন্সপেক্টর সৌম্য কে। দু একবার রিং হবার পরই রিসিভ হল ফোনটা। ফোনের ওপার থেকে চেনা গলায় সৌম্য বলল, "হ্যালো। ইন্সপেক্টর সৌম্য রায় স্পিকিং।"

"হ্যালো স্যার আমি আকাশ। আকাশ ব্যানার্জি। আমরা কৃষ্ণর বাড়ি থেকে ফিরছি এখন। স্যার কৃষ্ণ খুনি নয়। আসল খুনি আপনাদের মহেশ দাস। মহেশ কৃষ্ণর ভাই স্যার।"

সিগন্যাল খুব একটা ভালো নয়। তাই আকাশের কথা ঠিকঠাক শুনতে পেলনা সৌম্য। ফোনের ওপার থেকে বলল, "হ্যালো আকাশ তোমার কথা শোনা যাচ্ছে না। হ্যালো।"

গলার স্বর আরও উঁচু করে আকাশ আবার বলল, "স্যার কৃষ্ণ, মহেশ এর ভাই। শুনতে পাচ্ছেন? মহেশ ই রয়েছে এসবের পিছনে। হ্যালো........."

কোন লাভ হল না। সৌম্য এখনও পর্যন্ত একটাও কথা স্পষ্ট শুনতে পেলনা। অবশেষে ফোন টা অটোম্যাটিক ডিসকানেক্ট হয়ে গেলো। আকাশ আবার ফোন লাগিয়ে কানে ধরল। এরকম ভাবে চলতে চলতে কখন ওদের গাড়ি জঙ্গলের ভিতরের কাঁচা রাস্তা ছাড়িয়ে মেন রোডে এসে উঠেছে সেটা আকাশ লক্ষ করেনি। হঠাৎ রাস্তার সামনে চোখ যেতেই চমকে উঠলো রিয়া। চেঁচিয়ে আকাশ কে বলল, "আকাশ সামনে দেখ।"

রিয়ার চেঁচানিতে সামনে দেখল আকাশ। একটা মাল বোঝাই লড়ি নিঃশব্দে দ্রুতগতিতে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। আকাশ হাত থেকে ফোন ফেলে দিয়ে শক্ত হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু দুটো গাড়ির গতি এমনই বেশি ছিল যে অবশেষে ওদের গাড়িটা সজোরে গিয়ে ধাক্কা মারল লড়িটাকে।

ডালার উপর থেকে শেষ বেলপাতা টা তুলে ঘি এর বাটিতে চুবিয়ে হোমকুণ্ডে ফেলতেই আগুনটা যেন ফোঁস করে উঠলো। লাল সেই অগ্নিশিখার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পাঠ শুরু করলো পুরোহিত মশাই। তারপর সেই আগুনের উপর একটা পানপাতা, সুপারি ও দুটো কলা দিয়ে বললেন, "অম্বরিশ বাবু এবার আপনার পুত্রের শুভনাম টা বলুন।"

হোমকুণ্ডের অপর দিকে বসে রেয়েছেন এলাকার বিধায়ক অম্বরিশ ব্যানার্জি ও তাঁর স্ত্রী। তাঁর স্ত্রী র কোলে শুয়ে রয়েছে ফুটফুটে একটা শিশু। তারই জন্য আজকের এই মঙ্গল যজ্ঞ। অম্বরিশ বাবু ছেলের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে বললেন, "আকাশ ব্যানার্জি"

তারপর আবার পুরোহিত মশাই মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষন মন্ত্র পাঠের পর পুরোহিত মশাই বললেন, "আপনার পুত্রের নামের যজ্ঞ সম্পন্ন। এবার আপনারা উঠে পরুন এবং ব্রাহ্মন ভোজনের দিকে মন দিন।"

পুরোহিত মশাই কে প্রনাম করে অম্বরিশ বাবু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলে কে জিজ্ঞাসা করলেন, "বিলু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা কতদূর?"

ছেলেটা হাত জোর করে নম্র গলায় উত্তর দিলো, "হয়ে এসছে বাবু। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ঠাকুর মশাই দের বসিয়ে দেবো।"

"ঠিক আছে আমি একটু বিশ্রাম নিতে যাচ্ছি। হয়ে গেলে খবর দিস আর রঘু কাকা কে আমার ঘরে একটু পাঠিয়ে দে।"

ছেলেটি আচ্ছা বলে চলে গেলো। 

এই রঘুনাথ সিকদার আসলে অম্বরিশ বাবুর নিজের কাকা নন।তিনি ছিলেন অম্বরিশ বাবুর বাবার ডানহাত। অম্বরিশ বাবুকে কোলেপিঠে মানুষ করেছে এই রঘুকাকা। এখন রঘু কাকা তাঁর একমাত্র রাজনৈতিক পরামর্শদাতা।

ঘরের মধ্যে ঢুকে রঘুকাকা জিজ্ঞাসা করলেন, "আমাকে ডেকেছিলে অম্বু?"

অম্বরিশ বাবু একটা ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে ছিলেন। রঘুকাকার ডাকে উঠে বসে বললেন, "হ্যাঁ কাকা এসো। তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ছিল। তোমার বুদ্ধিতে না চললে আজ যে আমার কি হত কে জানে?"

রঘুকাকা পাশের একটা চেয়ার এ বসলেন। তাঁর মুখে চোখে তেমন একটা উৎফুল্লতা না দেখতে পেয়ে অম্বরিশ বাবু আবার প্রশ্ন করলেন, "কি হল কাকা খুশি হওনি? তোমার প্ল্যান মতোই তো হল সবকিছু।"

রঘকাকা হতাশ ভাবে অম্বরিশ বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, "আদেও কি প্ল্যান মতো হয়েছে সবকিছু?"

অবাক হয়ে অম্বরিশ বাবু বললেন, "কেন? তোমার কথা মতোই তো আমি অপর্ণা কে বিয়ে করলাম। বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ে, ভবিষ্যৎ এ ওত বড়ো ব্যবসা এবং সম্পত্তি সবই তো আমার।"

"তোমার?" প্রশ্ন করলো রঘুকাকা।

"না মানে, আমার নামে না।আমার একমাত্র ছেলের নামে।"

"একমাত্র ছেলে?"

রঘুকাকার কথা বুঝতে না পেরে অম্বরিশ বাবু জিজ্ঞাসা করলো, "মানে?"

রঘুকাকা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "বড় হয়ে আকাশ যখন জানতে পারবে যে তার একটা অবৈধ ভাই রয়েছে তখন কি হবে?"

চোখ গুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেলো অম্বরিশ বাবুর। চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন, "কি বলতে চাইছ কাকা?"

"তুমি হয়তো ভুলে গেছো সপ্তাহ খানেক আগে তোমার রক্ষিতা রমা এক পুত্র সন্তান এর জন্ম দিয়েছে।"

সব মনে পরে গেলো অম্বরিশ বাবুর। হ্যাঁ এ খবর তো সে আগেই পেয়েছে। বীরভূমে এক কর্মী সভায় গিয়ে দেখা এই আদিবাসী মেয়ের সাথে। তাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় অম্বরিশ বাবুর। তারপর থেকে যতবার তিনি বীরভূম এ গেছেন পার্টির কাজে, ততবারই তাঁর গেস্ট হাউসে রাত কাটানোর জন্য ডাক পড়েছে এই রমার।রমা যে অন্তঃসত্ত্বা সেটা খবর পেতেই তাকে বাচ্চা নষ্ট করে দেবার জন্য অনেক বুঝিয়েছেন অম্বরিশ বাবু। ধমকি দিয়েছেন, টাকার লোভ দেখিয়েছেন, কিছুতেই কিছু লাভ হয়েনি। অবশেষে গত শুক্রবার এক ছেলের জন্ম দিয়েছে রমা। ছেলেটি দেখতে খুব সুন্দর। দেখলে মনে হবে কোন বড় বংশের সন্তান। দুর্ভাগ্য শুধু একটাই যে ছেলেটার একটি পা অকেজো। কিন্তু তা সে যাই হোক এ ছেলে সমাজের সামনে এলে অম্বরিশ বাবুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার একদম নষ্ট হয়ে যাবে। রেগে লাল হয়ে গেলেন অম্বরিশ বাবু। বললেন, "আদিবাসী মাগীর আস্পর্ধা খুব বেড়েছে, জাতে ওঠার সখ হয়েছে। ডানা গজিয়েছে। এখনি ছেঁটে দেওয়ার বাবস্থা করছি। মা ছেলে দুজন কেই মেরে ফেলবো।"

অম্বরিশ বাবু কাউকে একটা ফোন করতে যাচ্ছিলেন। তাকে থামিয়ে দিয়ে রঘুকাকা বললেন, "রাগের মাথায় ভুল সিদ্ধান্ত নিওনা। সামনে ভোট তারউপর বাড়িতে নতুন সদস্য এসেছে। এইসময় একটা বাচ্চাকে মেরে ফেলা ঠিক হবে না।"

ফোনটা অম্বরিশ বাবুর হাত থেকে নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করে রঘুকাকা বললেন, "সন্তোষ। আমি রঘুকাকা বলছি। মন দিয়ে শোন। রমা আর ওর ছেলে বাড়িতে একা আছে। রাতের বেলা চার পাঁচ জনকে নিয়ে যাবি আর বাড়িটা তে আগুণ লাগিয়ে দিবি। হ্যাঁ দেখবি ভিতরে যেন শুধু রমা একাই থাকে, বাচ্চা টাকে নিয়ে চলে আসবি আর ফেরার পথে রাস্তার ধারে কোথাও একটা ফেলে দিস। কাজ টা যেন ঠিকঠাক ভাবে হয়ে যায়।"

রাস্তার ধারে একটা বড়ো গাছের ছাওয়ায় দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে পরিচয় পর্ব সারছে সৌম্য আর ইন্সপেক্টর দত্ত। পরিচয় শেষ করে সৌম্য জিজ্ঞাসা করলো, "accident টা হল কি করে?"

ঘরঘরে গলায় মাঝবয়সী ইন্সপেক্টর পরিমল দত্ত বলল, "লড়ির ড্রাইভার যা বলছে তাতে তো মনে হচ্ছে ওর কোন দোষ নেই। আসলে ওই আমাদের ফোন করে খবর দেয়। চলুন না ওর থেকেই শুনে নেবেন।"

সঙ্গে সঙ্গে জোর গলায় হাঁক দিলো পরিমল বাবু, "এই পোদ্দার, মাল টাকে নিয়ে এসো এখানে।"

কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা খালি গায়ে, লুঙ্গি পড়া, ষণ্ডা মার্কা চেহারার লোককে নিয়ে এলো এক কনস্টেবল।এটাই সেই লড়ি ড্রাইভার। দেখে মনে হচ্ছে খুব ভয় পেয়েছে সে। ইন্সপেক্টর দত্ত তাকে ধমক দিয়ে বললেন, "কি হয়েছিল সব বল এই বাবুকে।"

লোকটি দুহাত জড়ো করে কাঁদো কাঁদো গলায় উত্তর দিলো, "হাম কুছু নাহি কিয়ে বাবু। হাম তো খালি লড়ি লেকে আ রহে থে। হামরা গাড়ি কা ইস্পিড ভি জাদা নাহি থা বাবু। অচানক সে ই বাবু লোগান কা গাড়ি উ কচ্চা সড়ক সে রোড পর চলা আয়া। উ গাড়ি কা ইস্পিড বহুতে থা বাবু। হাম কোশিশ কিয়ে পর বচা নেহি শকে। হামকা ছোড় দিজিয়ে বাবু। হাম কুছু নাহি কিয়ে।" 

কথা শেষ হতেই হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো সে। ইন্সপেক্টর দত্ত, কনস্টেবলকে হাতের ইশারায় তাকে নিয়ে যেতে বললেন। এতক্ষনে এম্বুলেন্স এসে গেছে। আকাশ ও রিয়ার মৃতদেহ টা স্ট্রেচার এ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এম্বুলেন্স এর ভিতরে। তাঁদের উপর চাপা দেওয়া সাদা কাপড়টা রক্তে লাল হয়ে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হল সৌম্যর। চোখের সামনে যেন ভেসে উঠছে ওদের হাঁসি মুখ দুটো। কি হাঁসি ঠাট্টাই না হচ্ছিল সেদিন, যেদিন ওরা সৌম্য আর কনস্টেবল হালদার কে ওদের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে এসেছিলো। সত্যিই ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। কিছুদিনের মধ্যেই যারা একে অপরের হাত ধরে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছিল, আজ তারাই রক্তস্নাত মৃত্যুশয্যায় শায়িত।।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment