1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 12, 2022

ভাগাড়

 

ছবি : ইন্টারনেট

ভাগাড়

ডাঃ শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়


আজ স্কুল থেকে ফিরে অবধি রুমকি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে | মনীষা বার বার জিজ্ঞাসা করেছে, আদর করে, ভালোবেসে, আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে, কিন্তু কোনো সদুত্তর পায় নি | মনীষা আর ঋত্বিকের আড়াই কামরার ফ্ল্যাটে আড়াই জন বাসিন্দা | সাত বছরের রুমকিকে ঘিরেই ওদের সব স্বপ্ন |এমনিতে রুমকি খুব হাসিখুশি, আর পাঁচটা শিশুর মতোই প্রাণবন্ত | আঘাত পেলে কাঁদে, বাবা বকলে  ঠোঁট ফোলায়, কিন্তু এ তো কোনো চাপা কষ্টে গুমরে গুমরে কান্না! ঐটুকু শিশুর মনে এত কিসের ব্যথা?   তবে কি স্কুলে টিচাররা কিছু বলেছেন? না কি বন্ধুদের সঙ্গে মন কষাকষি? অনেক চেষ্টা করেও মনীষা কিছু বের করতে পারলো না মেয়ের পেট থেকে |


 বিকেলে এই সময়টা রুমকি পার্কে খেলতে যায় | আগে গৌরীর সঙ্গেই যেত | গতমাসে গৌরী বাড়ি গিয়ে আরফিরে আসেনি |ওর মা ফোন করে বললো,  "দু হাজার টাকা বাড়াও, তা না হলে গৌরীকে পাঠাবো না |"  "এক বারে দু হাজার? তোমার কি মাথা খারাপ? এই তো কমাস আগে টাকা বাড়ালাম | তুমি কি আমাকে টাকার মেশিন পেয়েছো? আমাদেরও খেটে রোজগার করতে হয়, বুঝলে?" মনীষা বিরক্ত হয়ে জবাব দিয়েছিলো| "কি করবো বলো বৌদি? দিল্লীতে একটা ভালো কাজ পেয়েছে, অনেক টাকা দেবে | তোমরা অন্তত কিছুটা বাড়ালে মেয়েটাকে অত দূরে পাঠাতাম না |” কথা শুনে মনে হলো না গৌরীর মা সহজে দমবে | গৌরী মেয়েটা এমনিতে ভালো ; বেশ বুদ্ধিমতী, চটপটে, সুশালীন | মেয়েটা রুমকির দেখাশোনা ভালোভাবেই করতো | কিন্তু পুরো পরিবারে কেউ কোনো কাজ করে না, সকলের চোখ ওই ছেলেমানুষ মেয়েটার রোজগারের দিকে | বাড়ি গেলেই মার এই টেলিফোনে ব্ল্যাকমেল করে টাকা বাড়ানো, এটা এখন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে | এবার একটু কড়া না হলে মাথায় চড়ে বসবে | তাই অসুবিধা হবে জেনেও মনীষা টাকা বাড়াবে না বলে ফোন রেখে দিলো | দিন পনেরো আগে ঘটনাটা ঘটেছে, তারপর থেকে গৌরী বা তার মায়ের কোনো সাড়াশব্দ নেই |


 রুমকির হাত ধরে পার্কে যেতে যেতে মনীষার মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো একটা চিন্তা খেলে গেলো - আচ্ছা গৌরীর জন্য রুমকির মন কেমন করছে না তো ? কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে কেমন যেন সাহস হলো না - যদি বলে বসে গৌরী মাসিকে এক্ষুনি ডেকে আনো | তার থেকে চুপচাপ থাকা ভালো | আগে রাত্রে ঋত্বিকের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া উচিত| শিশুর মন- দুদিনেই সব ভুলে স্বাভাবিক হয়ে যাবে |


রাত্রে ডিনার টেবিলে রুমকি ভালো করে খেলো না | ওর মনপসন্দ বাটার চিকেন একবার ছুঁয়েও দেখলো না | চোখ ছলছল, মুখে কথা নেই, কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব | অন্যদিন এই মেয়ের হুটোপাটি আর বকবকানিতে বাড়ি সরগরম | অনেক রাত অবধি রুমকি বিছানায় জেগে শুয়ে রইলো, অন্যদিন তো সারাদিনের ধকলের পর বিছানায় পিঠ পড়তে না পড়তে ঘুমের  দেশে পাড়ি | মনীষা ব্যাপারটা ঋত্বিকের সঙ্গে আলোচনা করলো- " কি হতে পারে বলো তো ? গৌরীর চলে যাওয়াটা মন থেকে মানতে পারছে না?"  ঋত্বিক দু দিকে মাথা নাড়ালো, " আমার তা মনে হয় না, গৌরী বাড়ি গেছে প্রায় এক মাস হলো | তা ছাড়া রুমকি তো জানে গৌরী আবার ফিরে আসবে | হঠাৎ এতো দিন পরে তার জন্য চুপচাপ হয়ে যাবে? আমার তো অন্য কথা মনে হচ্ছে |"" কি মনে হচ্ছে তোমার? "- উৎসাহ নিয়ে মনীষা জিজ্ঞাসা করে |ঋত্বিকের কপালে ভাঁজ,একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল তাকে | একটু ইতস্তত করে বললো, " তুমি একবার কাল স্কুলে চলে যাও, ক্লাস টিচারকে জানাও ব্যাপারটা | নিউসপেপারে, টি.ভি তে দেখো নি বাচ্চা মেয়েদের ওপর আজ কাল কত রকমের শারীরিক নির্যাতন হয়, স্কুল ও আজকাল আর আগের মতো নিরাপদ নয় |" মনীষা আর শুনতে পারলো না | ঘুমন্ত রুমকির মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরটা তোলপাড় হতে লাগলো | কোনো রকমে ঋত্বিককে হাতের ইশারায় থামতে বলে সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো আর মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো যেন ফুলের মতো সরল ওই একরত্তি শিশুর জীবনে এতো বড় অঘটন না ঘটে |


ক্লাস টিচারের কাছ থেকে খুব একটা কিছু উদ্ধার হলো না | শ্ৰেয়া অর্থাৎ রুমকি কদিন ধরে চুপচাপ হয়ে গেছে, কেমন যেন একটা মনমরা ভাব, এটা উনিও লক্ষ্য করেছেন - এর বেশি আর কিছু বলতে পারলেন না | কটা দিন একই ভাবে পার হয়ে গেলো | রুমকির ব্যবহারে খুব একটা কিছু পরিবর্তন দেখা গেলো না | সবথেকে বড় সমস্যা হলো মেয়ে মুখে কিছু তোলে না | দুবেলা মাংস-ভাত যে মেয়ে গপ্ গপ্ করে খেত, সে কোন রকমে মাখন-ভাত খেয়ে উঠে যায় |মনীষা ভাবলো, রুমকির বোধ হয় ঘরের খাবার একঘেয়ে লাগছে | আগে গৌরী তেল-মশলা দিয়ে রান্না করতো, এখন মনীষা বাড়ির  সকলের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে সহজপাচ্য খাবার বানায়, হয়তো মেয়ের মুখে রুচছে না | সাত-পাঁচ ভেবে মনীষা বললো, " রুমকি, চল, আমরা আজ রেস্টুরেন্টে ডিনার করবো |" এর ফলাফল এমন হবে তা মনীষার আশাতীত ছিল | খুশি হওয়া তো দূরের কথা, রুমকি থর থর করে কেঁপে উঠলো, হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললো, " আমি যাবো না মা, আমি কিছুতেই যাবো না |"


ঋত্বিক বললো, " ওকে মনে হয় ডাক্তার দেখানো উচিত | আমি ডক্টর সেনের এপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি | উনি একজন নামকরা পেডিয়াট্রিসিয়ান, তা ছাড়া রুমকিকে জন্মের থেকে দেখছেন, উনিই একমাত্র বুঝতে পারবেন কি হয়েছে |" মনীষার কথাটা বেশ মনঃপুত হলো | ঠিকই বলেছে ঋত্বিক, নিশ্চয়ই ওর কোনো শারীরিক সমস্যা হচ্ছে যা ওরা ঠিক ধরতে পারছে না |


ডক্টর সেনের এপয়েন্টমেন্ট পেতে দেরি হলো না | নির্দিষ্ট দিনে মেয়ের হাত ধরে দুজনে মিলে উপস্থিত হলো চেম্বারে | ডক্টর সেন রুমকিকে খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করলেন, তারপর বললেন, " দেখুন, আমি তো তেমন কিছু শারীরিক সমস্যা দেখছি না, তাও কিছু রক্ত পরীক্ষা লিখে দিচ্ছি, এগুলো করিয়ে নিন | তবে আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা মানসিক | কোনো কারণে ওর শিশুমনে আঘাত লেগেছে, যার ফলে এই অস্বাভাবিক আচরণ |" " কি এমন হতে পারে ডাক্তারবাবু ?" মনীষা আকুল হয়ে প্রশ্ন করলো | ডক্টর সেন বললেন, " সে তো আপনারা আমার থেকে ভালো বলতে পারবেন |""কিন্তু আমরা যে কিছু বুঝতে পারছি না|" মনীষার স্বর কাঁদো-কাঁদো | ডক্টর সেন জিজ্ঞাসা করলেন," আচ্ছা, আগে কোনো দিন ও এরকম কান্নাকাটি করেছে?" মনীষা বললো, " না ডাক্তারবাবু, ও খুব হাসিখুশি মেয়ে, বিশ্বাস করুন | তবে গত বছর জুলি মারা যাওয়ার পর ও খুব কান্নাকাটি করেছিল |" " জুলি কে?"- পাকা গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করলেন ডক্টর সেন | " জুলি আমাদের পেট ছিল ডক্টর সেন | সোনালী লোমওয়ালা গোল্ডেন রিট্রিভার, ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে ঘুরে আসা পশমের মতো লোম দেখে মনে হতো যেন সিংহের কেশর | মাত্র সাত বছর বয়সে মারা যায় সেপ্টিসিমিয়া হয়ে | ওর মৃত্যুটা আমাদের খুব দুঃখ দিয়েছিলো, আর রুমকির সেই প্রথম অভিজ্ঞতা কাছের কাউকে হারানোর | ও খুব ভেঙে পড়েছিল |কিন্তু সে তো এক বছর আগের কথা |"


ঋত্বিক কি ভেবে মনীষাকে রুমকিকে নিয়ে একবার বাইরে যেতে বললো | তারপর গৌরীর প্রসঙ্গ তুলে জিজ্ঞাসা করলো, " আচ্ছা ডক্টর সেন, আমাদের বাড়িতে একটি অল্পবয়সী মেয়ে কাজ করতো,মানে ওর দেখাশোনাও করতো আর কি, নাম গৌরী, সে  মাস খানেক আগে বাড়ি চলে গেছে, আর ফিরে আসে নি, আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না সেটাই রুমকির মন খারাপের কারণ কি না |" ডক্টর সেনের কপালে ভাঁজ পড়লো | একটু ভেবে বললেন, "কোয়াইট পসিবল ! মেয়েটির সঙ্গে ওর সখ্যতা হয়েছিল, হয়তো ওর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল, ওর চলে যাওয়াটা হয়তো মেনে নিতে পারছে না | আপনি এক কাজ করুন, মেয়েটিকে বরং বাড়ি থেকে ডেকে পাঠান | হাতে জমানো পয়সা ফুরিয়ে গেলে দেখবেন ঠিক চলে আসবে | হয়তো নিজে থেকে বলতে পারছে না |"


রক্তের রিপোর্টে কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লো না, কিন্তু রুমকির আচরণ কিছুতেই স্বাভাবিক হলো না |গৌরীর বাড়িতে অনেক বার ফোন করে ধরা গেলো না | ওর মা হয়তো মেয়েকে অন্য কোথাও কাজে লাগিয়ে দিয়েছে, তাই আর ফোন ওঠাবার প্রয়োজন বোধ করছে না |হঠাৎ একদিন রুমকির ক্লাসমেট সৃজার মা মনীষাকে ফোন করলেন- " হ্যালো মনীষা! কাল সন্ধ্যায় শ্রেয়াকে নিয়ে আমার বাড়ি চলে এসো প্লিজ! কাল সৃজার জন্মদিন, বাড়িতেই সেলিব্রেট করছি, ঘরোয়া অনুষ্ঠান, তোমরা এলে খুব ভালো লাগবে | " মনীষা মনে মনে খুশিই হলো, হয়তো বন্ধুর বাড়িতে আনন্দ করতে করতে মেয়েটার মনের ভার লাঘব হবে | যাবার ব্যাপারে রুমকির যে বিরাট উৎসাহ দেখা গেলো তা নয়, অথচ আগে মনীষা লক্ষ্য করেছে এই জন্মদিনের অনুষ্ঠানগুলোতে রুমকি কি আনন্দই না করতো! এবার যেন কেমন একটা ভয়-ভয় দ্বিধাগ্রস্থ ভাব |


 সৃজাদের বাড়ি যাওয়ার পর বন্ধু-বান্ধবীদের পেয়ে প্রথমটা রুমকি বেশ খুশিই ছিল | কেক কাটা পর্ব শেষ হতে না হতেই হাসি-গান-নাচ-হুল্লোড় শুরু হলো | সবার সাথে তাল মিলিয়ে রুমকিও হৈ চৈ করতে লাগলো | অনেক দিন বাদে মেয়ের স্বাভাবিক আচরণ দেখে মনীষাও যেন একটু নিশ্চিন্ত হলো | এরপর এলো খাওয়া-দাওয়ার পালা | সৃজার মা ডাক দিলেন, " বাচ্চারা সব চলে এস | ফ্রাইড রাইস আর মটন কারি, সকলে গরম গরম খেয়ে নাও, তার পর অপেক্ষা করছে টু -ইন- ওয়ান আইসক্রিম |" সব বাচ্চারা এক সাথে হৈ হৈ করে উঠলো | রুমকি হঠাৎ মনীষার আঁচল ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো, " মা, আমি খাবো না, বাড়ি চলো |" মনীষার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো, কোনোরকমে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, " কি বলছিস? না খেয়ে চলে যাবি মানে ?আন্টি কি ভাববেন?" রুমকি গোঁ ধরে রইলো, সে কিছুতেই খাবে না | একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হলো, সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো, কেউ বা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো, " কি হয়েছে?" মনীষার মনে হলো সে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাবে | হাজার বুঝিয়েও রুমকিকে টলানো গেলো না | বাধ্য হয়ে মনীষা বললো, "ওর শরীরটা খারাপ লাগছে, আমি বরং ওকে নিয়ে বাড়ি যাই, প্লিজ কিছু মনে কোরো না |" কারো কারো সমর্থন মিললো, কেউ বা বললো, " মনে করার কি আছে? বাচ্চার শরীর খারাপ তো হতেই পারে, ওকে নিয়ে বাড়ি যাও|" মনীষা একরকম পালিয়ে বাঁচলো |


সেদিন বাড়ি ফিরে মনীষার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো | পোশাক বদলে শোবার ঘরে গিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো | বালিশে মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন অঝোর ধারায় গিয়েছে বালিশ ভিজে | রুমকি পাশেই শুয়ে ছিল | মাকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি কখনও রুমকি | আস্তে আস্তে মায়ের পিঠে হাত রাখলো সে | রুমকির হাতের ছোঁয়ায় মনীষার সম্বিৎ ফিরলো | তাকিয়ে দেখলো, কখন মেয়ের চোখেও নেমে এসেছে বাঁধ ভাঙা জল |মনীষা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে একবার শেষ চেষ্টা করলো, " কি হয়েছে তোর মা? কেন অমন করে চলে এলি সৃজাদের বাড়ি থেকে?" রুমকি মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদলো ভালো করে,তারপর মুখ তুলে বললো, " ওরা যদি আমাদের জুলির মাংস খাওয়াতো?" এরকম একটা যুক্তি মনীষার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল | অবাক হয়ে সে প্রশ্ন করলো, " জুলি এক বছর আগে মারা গেছে রুমকি! কি বলছিস তুই পাগলের মতো?" কান্না থামিয়ে রুমকি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো. "আমি জানি, আমি সব জানি; টি.ভি তে দেখেছি, স্কুলে মিস রা বলেছে, তুমি আর বাবাও বলাবলি করছিলে | আমরা যে মাংস খাই সেগুলো ভাগাড়ের মাংস | ভাগাড় থেকে মরা কুকুর তুলে এনে রান্না করে খাওয়ায় রেস্টুরেন্টে | মা, ভাগাড় কি মা? বাবা কি জুলিকে ভাগাড়ে পুঁতে দিয়ে এসেছিলো?" কোনোক্রমে একসাথে এতোগুলো কথা বলে রুমকি হাঁফাতে লাগলো, তারপর মনীষার গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে বললো, "মা, আমরা জুলিকে খেয়ে ফেলিনি তো?" মেয়ের মুখ থেকে এমন অভাবনীয় প্রশ্ন শুয়ে মনীষা বিহ্বল হয়ে পড়লো ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর সরে গেলো | অন্তত রুমকির মন খারাপের কারণটা তো বোঝা গেলো এতো দিনে |মনীষা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলো, " দূর পাগলী, এই কথা ভেবে তুই মন খারাপ করছিস! আমাদের জুলি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু ও তো ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে আকাশের তারা হয়ে গেছে | আর যারা এই সব কাজ করেছে, তারা সবাই দুষ্টু লোক; তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, আর কখনও তারা এই কাজ করতে পারবে না!" "মা, তুমি ঠিক বলছো?" কাঁদতে কাঁদতে রুমকির গলার স্বর বসে গেছে | মনীষা আবার ভরসা দেয়, "হ্যাঁ রে! ঠিক বলছি| বোকা মেয়ে! আমাকে আগে বলবি তো! শুধু শুধু এতো কষ্ট পেলি!" রুমকি যেন কথাগুলো বিশ্বাস করলো |ডক্টর সেনের সঙ্গে আলোচনা করে একজন সাইকোলোজিস্টের কাছে রুমকিকে নিয়ে যাওয়া হলো | ওনার কাছে বেশ কয়েকবার কাউন্সেলিং এর পর ধীরে ধীরে তার আচরণ স্বাভাবিক হতে শুরু করলো | মনীষা আর ঋত্বিক অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো |


কিন্তু কিছুদিন বাদে এক নতুন উপসর্গ শুরু হলো | জুলির কথা মাথা থেকে বেরোতেই সে গৌরীর জন্য উতলা হয়ে পড়লো |" গৌরীমাসি আসছে না কেন? ও তো বলেছিলো চলে আসবে | মা তুমি ফোন করো না"- মুহুর্মুহু এই ধরনের প্রশ্নে মনীষা জর্জরিত হয়ে উঠলো | গৌরী আর আসবে না- এই কথাটা বলতেও সে কেমন যেন দ্বিধা বোধ করছিলো, আবার যদি রুমকির অস্বাভাবিক কোনো প্রতিক্রিয়া হয়! মনীষা ভাবে, তার মেয়ে কি একটু বেশি অনুভূতিপ্রবণ? না কি সব বাচ্চা এমনিই হয় কে জানে!


আজ তিনমাস হয়ে গেছে গৌরী চলে গেছে | গৌরীর মা তো ফোন তোলা ছেড়ে দিয়েছে | হঠাৎ মনে হলো দীপ্তির কথা | দীপ্তি মনীষার বান্ধবীর বাড়িতে কাজ করে | গৌরী ওদের গ্রামের মেয়ে | দীপ্তিই মনীষাকে গৌরীর কাছে এনে দিয়েছিলো | কি ভেবে মনীষা দীপ্তির মোবাইলে ফোন করলো, " দীপ্তি, গৌরী আজ তিনমাস হলো বাড়ি গিয়ে আর ফিরে আসে নি | আজকাল ওর মা ফোনও ধরে না | তুমি ওর সন্ধান দিতে পারবে?" দীপ্তির গলার স্বরটা যেন কেমন অন্য রকম হয়ে গেলো | একটু চাপা স্বরে বললো," ওর কথা আর মুখে এন  না বৌদি | তোমার লোক লাগলে আমি খুঁজে পেতে অন্য মেয়ে এনে দেব |" মনীষা যেন কেমন একটা অশুভ কিছুর আভাস পেলো | দীপ্তিকে চেপে ধরলো, " কেন? অন্য মেয়ে কেন? গৌরীর কি হয়েছে?" দীপ্তি একটু আমতা আমতা করে বললো, "তোমাকে আর লুকিয়ে কি হবে বৌদি! সত্যি কথাটা হলো ওর মা ওকে দিল্লী পাঠিয়ে দিয়েছে |" দীপ্তির এসব ভনিতা মনীষার এতটুকু পছন্দ হলো না | একটু রাগত স্বরেই বললো, "এতে আর লুকোবার কি আছে? ওর মা তো বলেইছিলো মাইনে না বাড়ালে ওকে বেশি টাকার কাজ দিয়ে দিল্লী পাঠাবে | আমার আর কি করার আছে বলো তো? আমি তো আমার সামর্থ্য অনুযায়ী লোক রাখবো | সব বায়না তো মেনে নেওয়া যায় না |"দীপ্তি একটু থামলো, তারপর বললো,"সে তো তুমি ঠিকই বলেছো বৌদি! তবে কি না দিল্লীতে তো আর ওকে এমনি পাঠায়নি | ভাগাড়ে পাঠিয়েছে গো ভাগাড়ে!" "কি বলতে চাইছো তুমি বলো তো?" মনীষা এবার স্পষ্ট রাগ দেখালো | 'ভাগাড়' শব্দটা আজকাল তাকেও পীড়া দেয় | দীপ্তি এবার ব্যাখ্যা করে বললো, " ওই আমাদের গ্রামে একটা ছেলে আছে গো, মোটা টাকা নিয়ে ওদিকে মেয়ে পাচার করে, মেয়ের বাপ্-মাকেও কিছু ধরায় আর কি | আর গৌরীর মা'ই বা কি করে বলো? মিনসে তো কিছু করে না | মেয়েটার নিচে তিনটে ছেলে | পেট চালাবে কোথা থেকে এতো জনের?" মনীষার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো, কোনোরকমে বললো, "কি বলছো তুমি? দেশে কি আইন-কানুন নেই? সবাই জানে একজন মেয়ে পাচার চক্রে জড়িত, কেউ তাকে ধরছে না?" অতি বিজ্ঞের মতো দীপ্তি বোঝালো, "কি করে ধরবে বলো বৌদি, যদি মেয়েদের বাপ্-মায়েরা স্বীকার না করে? পয়সা পেলে সবাই মুখে কুলুপ এঁটে দেয় গো! তুমি বাপু যেন এসব কথা পাঁচকান কোরো না | আমার প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে | এরা ভারী সাংঘাতিক লোক |"


মনীষা ধীরে ধীরে ফোনটা রেখে সোফায় এসে বসলো | জুলিকে কেউ কবর থেকে তুলে এনে জবাই করেছিল কি না সে জানে না | জুলি তাদের বড় আদরের ছিল, কিন্তু সে মৃত | মৃত সারমেয়-মাস ভক্ষনে কেউ অসুস্থ হোক বা না হোক, জুলি কোনোদিন ফিরত না | তাও তো অপরাধীদের নিয়ে হৈ চৈ হয়েছে, মিডিয়া সরগরম হয়েছে| কিন্তু এক জীবন্ত মনুষ্যকন্যাকে যারা ভাগাড়ে নিক্ষেপ করলো, আর যারা যারা জীবন্ত মনুষ্য-মাংস খুবলে খেয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো তাদের জন্য রইলো  না কোনো আইন-আদালত | কাল যদি রুমকি প্রশ্ন করে, " গৌরীমাসি ফিরছে না কেন"- সে কি উত্তর দেবে? সে কি বলতে পারবে তোর মাসিকে রাক্ষসেরা খেয়ে ফেলেছে?  যদি মেয়ে জিজ্ঞাসা করে কোন রাক্ষসেরা, সে কার নাম বলবে আর কাকে বাদ দেবে? আয়নায় নিজের মুখটার দিকে হঠাৎ চোখ পড়লো মনীষার | মনে হলো এ যেন তার মুখ নয়, নিজের মুখটাকে যেন কেমন অচেনা লাগলো, যেন কোনো রাক্ষসীর মুখ | মনীষার হঠাৎ খুব ভয় করতে লাগলো- তারও কি সাইকোলোজিক্যাল কাউন্সেলিং দরকার? না কি মানসিক বিকারগ্রস্ত সমগ্র সমাজটারই কাউন্সেলিং চাই?

drsarmishtha67@gmail.com
কলকাতা 

No comments:

Post a Comment