1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 12, 2022

নেকড়ের থাবা

 

ছবি : ইন্টারনেট

নেকড়ের থাবা

অর্ণব চ্যাটার্জী

ঝোপঝাড়ে ভর্তি কারখানার পিছনের জমিটাকে মানুষজন দিনের বেলাতেই এড়িয়ে চলে, আর রাতে তো কোনো প্রশ্নই নেই। কারণ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ কারখানার এই জায়গাটা সমাজবিরোধীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। ইতিউতি ছড়িয়ে আছে মদের ভাঙা বোতল, পোড়া বিড়ির টুকরো। সন্ধে হতেই ভেসে আসে হেঁড়ে গলায় গান, বিকট চিৎকার আর অশ্রাব্য গালিগালাজ। সব মিলিয়ে যেন নারকীয় পরিস্থিতি।

তা সেদিনও মদন, বাপ্পা আর পিন্টু জমিটার এক কোণে বসে আড্ডা দিচ্ছে।এদিক ওদিক আরো কয়েকজন বসে। সবার চেহারা দেখলেই বোঝা যায় এদের তথাকথিত ভদ্রলোকের পর্যায়ে ফেলা যায়না। মদের নেশায় বাপ্পা আর পিন্টু ভুল বকছে। মদন অতটা নেশা করেনি, তাই এখনো সজ্ঞানে আছে। ও ক্রমাগত বাকিদের মদ খেতে বারণ করে যাচ্ছে, যদিও তা কেউ শুনছে না। এই নিয়ে ওদের সাথে মদনের একপ্রস্ত কথা কাটাকাটিও হয়ে গেল।

বসে কথা বলতে বলতে আচমকা দূরে নজর পড়তেই মদন দেখে একটি সুন্দরী মেয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। 'এত রাতে যেখানে কোনো মানুষই আসতে সাহস করে না, সেখানে এরকম সুন্দরী একজন মহিলা কোন সাহসে এদিকে আসছে? নেশার ঘোরে ভুল দেখছি নাকি?' এটা ভেবে মদন মাথাটা ভালো করে ঝাঁকিয়ে দেখল না ঠিকই দেখেছে। তবে বাকিদের ব্যাপারটা বলতেই ওরা জোরে হেসে উঠল। পিন্টু বলল "আরে তোর তো দেখি আমাদের থেকেও বেশি নেশা হয়েছে। এত রাতে, তায় সুন্দরী!"এই বলে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল। বাপ্পাও ওর সাথে যোগ দিল।

তবে মহিলাটি যখন ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন তখন সবার হাসি উড়ে গিয়ে চোখভরা বিস্ময়। বাপ্পা আর পিন্টু একে অপরকে চিমটি কেটে দেখল ওরা জেগে আছে না কোনো স্বপ্ন দেখছে!

মহিলাটি ওদের সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে বললেন। " দেখুন না! একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। ফিরতে রাত হল, ভাবলাম শর্টকাট করি। তা করতে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছি। এখান থেকে বড় রাস্তায় ওঠার কোনো পথ আছে কি?"

" হ্যাঁ হ্যাঁ আছে। এই সামনে একটু এগিয়ে। আপনি আমার সাথে আসুন। " মদন সাগ্রহে বলল।

পিন্টু আর বাপ্পার চোখের সামনে দিয়ে মদন মহিলাক নিয়ে এগিয়ে গেল। পিন্টু একটা গালাগাল দিয়ে বলল "দেখলি? সুন্দরী দেখে আমাদের দিকে আর ফিরে তাকালোই না! আমাদের অবস্থার ফায়দাটা নিল। শালা! আসুক ঘুরে, দেখাচ্ছি মজা।" পিন্টু রেগে গেল। 

"আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা ওই হাতকাটা স্বপনের কোনো কারসাজি হতে পারে!এটা কোনো টোপ নয় তো?" বাপ্পার গলায় সন্দেহ

পিন্টু হেসে কি একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই বাপ্পার সন্দেহকে যেন সত্যি প্রমাণ করতেই দূর থেকে মদনের আর্তচিৎকার ভেসে এল। একবার নয়, দু দুবার। দুজনেই আওয়াজটা লক্ষ্য করে দৌড়ল।

আওয়াজটা যেখান থেকে আসছিল সেই জায়গাটা ঘন ঝোপে ঢাকা। ওরা এদিক ওদিক দেখছে এমন সময় ঝোপের একটা কোন থেকে গোঙানির শব্দ শুনে ওরা দৌড়ে গেল। যা দেখল তাতে রীতিমত শিউরে উঠল।দেখল মদন মাটিতে পড়ে, চেহারা ক্ষতবিক্ষত। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। বোঝাই যাচ্ছে শেষ অবস্থা। পিন্টু ওর সামনে বসে কেঁদে ফেলল। বাপ্পা হাঁফাতে হাঁফাতে বলল " আমি তখনই বলেছিলাম..." কিন্তু ওর কথা শেষ হবার আগেই পাশের ঝোপ থেকে একটা গরগর গর্জন শুনে চমকে তাকাল। দেখল একটা বড়সড় চেহারার কুকুরের মত প্রাণী ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। শ্বদন্ত দেখা যাচ্ছে, বের করা জিভ থেকে লালা ঝরছে। নাহ, কুকুর নয়। বাপ্পা এর ছবি বইতে , টিভিতে অনেক দেখেছে। এটা একটা নেকড়ে ছাড়া আর কিছুই নয়। 

কিন্তু এই বাদামপুরের মত মফস্বল শহরে এই জঙ্গলের প্রাণীটা কিভাবে এল তা চিন্তা করার মত মানসিক অবস্থা সেই মুহূর্তে বাপ্পার ছিল না। ওটা ততক্ষণে পিন্টুর উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। আর তা দেখে এমনকি পিন্টুর আর্তচিৎকার শুনেও বন্ধুকে বাঁচানো দূরে থাক, বাপ্পা নিজের প্রাণ বাঁচাতে উর্ধশ্বাসে উল্টোদিকে দৌড় দিল।একটু পরে পেছনে আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল যে প্রাণীটা ওকেও ধাওয়া করেছে। দূরে বড় রাস্তা দেখা যাচ্ছে। ও পিছন ফিরে দেখল নেকড়েটা ওর থেকে আর মাত্র হাতদশেক দূরত্বে। আর কিছু চিন্তা না করে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে বাপ্পা রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ল।  এমন সময় দূর থেকে একটা হেডলাইটের আলো ওর চোখে পড়ল। বাপ্পার আর কিছু ওর মনে নেই।

জ্ঞান হতে বাপ্পা দেখে ও থানার বেঞ্চে শুয়ে। এখানে আগেও বারকয়েক  এসেছে। তাই দেখতে পেল বেশ কিছু চেনা মুখ। চোখ মেলতেই বড়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন "কি রে? কি হয়েছিল খুলে বল তো!"

বাপ্পা পুরো ঘটনা খুলেই বলল, কিছুই বাদ দিল না। সব শুনে বড়বাবু হেসে বললেন "বুঝলাম! তা কাল ক পেগ চড়িয়েছিলি বল তো! আমি তো বলব বখরার ভাগাভাগি নিয়ে গন্ডগোল হওয়াতে তুই তোর বন্ধুদের খুন করে এখন আষাঢ়ে গল্প ফাঁদছিস। এই বাদামপুরে নেকড়ে! এরপর তো কোনোদিন বাঘ, সিংহ দেখবি!"

বাপ্পা যতই দিব্যি কেটে বলে যে ও সত্যি বলছে, কিন্তু কেউই ওকে বিশ্বাস করল না। বড়বাবু তো বলেই দিলেন "সত্যিটা না বলা অবধি তোকে কিন্তু জেলেই থাকতে হবে।" এই বলে ওকে হাজতে ভরে দিলেন।

পুলিশ মনে করল  পিন্টু আর মদনের মৃত্যুটা ওদের মধ্যে বখরা ভাগাভাগি নিয়ে গন্ডগোলের কারণে হয়েছে এরকম তো হামেশাই দেখা যায়! কিন্তু এরপর আরো দুটো খুন হল। একজন ধনী ব্যবসায়ী বিশাল সাক্সেনার ছেলে আকাশ আর একজন স্বর্ণব্যবসায়ী রতনলাল মেটা।যদিও আকাশ সাকসেনার ক্ষেত্রে কোনো সাক্ষী পাওয়া যায়নি, কিন্তু ওর পাশের সিট থেকে পাওয়া গেছিল একটি লেডিস রুমাল। আর মেটার ড্রাইভারের বয়ান অনুযায়ী মাঝরাস্তায় একটি সুন্দরী মেয়ে লিফট চায়। ড্রাইভার আপত্তি জানালেও রতনলাল ওর রূপে এতই মজে গেছিলেন যে সাগ্রহে তাকে গাড়িতে বসান। তবে গাড়ি একটু দূরে গিয়েই বিগড়ে যায়। চালক নেমে ডিকি খুলে চেক করছেন, এমন সময় রতনলালের আর্তচিৎকার শুনে গাড়ির ভিতই উকি মেরে যা দেখেন তাতে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। একটা নেকড়ে গাড়ির ভিতর রতনলালকে আক্রমন করেছে। ধারালো নখের আঁচড়ে উনার শরীর রক্তে ভেদে যাচ্ছে। । হুশ ফিরতেই ড্রাইভার চিৎকার করে ওঠে আর আগু পিছু না ভেবে গাড়িতে পড়ে থাকা একটা লোহার রড নিয়ে নেকড়েটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে নেকড়েটা ওকে পাল্টা আক্রমণ না করে দৌড়ে রাস্তার পাশের জঙ্গলে পালিয়ে যায়। রতনলালের গলায় গভীর ক্ষত, সারা শরীর রক্তাক্ত। এই অবস্থায় দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ড্রাইভার  উনাকে কাছের একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। 

 

পরপর দু দুটো খুন। তায় আবার সমাজের বেশ উঁচুতলার লোকেদের। মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়তেই প্রশাসনের উপরমহলে হইচই পড়ে গেল। এই সংকট জনক মুহূর্তে আর স্থানীয় কারুর উপর ভরসা না করে ডাকাবুকো পুলিশ অফিসার অমিত ঝাকে ডেকে পাঠানো হল।

অমিত বেঙ্গল ক্যাডারের অফিসার। পেটানো চেহারা, সজাগ দৃষ্টি। অনেক জটিল কেসের সমাধান করেছেন। যেকোনো বড় ঝুঁকি নিতেও পিছপা হয়না। একারণে উপরমহলে উনার এত নামডাক।

অমিত নিজেই মাঠে নামলেন। রাতে বিভিন্ন জায়গায় অতর্কিতে হানা দিতে লাগলেন। পুলিশ পোস্টিংয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু জায়গায় চর লাগিয়ে রাখলেন যারা সাদামাটা পোশাকে ঘুরে বেড়াবে আবার প্রয়োজন বুঝলে গা ঢাকা দিয়েও নজরদারি করবে।

কিন্তু এত সবের পরেও আরেকটি খুন হয়ে গেল। এবার শিকার একজন উচ্চপদস্থ আমলা। একইভাবে উইকেন্ডে খামারবাড়িতে ছুটি কাটাতে গিয়ে খুন এবং দারোয়ানের কথা অনুযায়ী সেই কোনো এক সুন্দরী মহিলার উপস্থিতি।

অমিত তদন্তে নেমে দেখলেন সব খুনের ক্ষেত্রেই একটি কমন ফ্যাক্টর আছে আর তা হল একটি সুন্দরী মেয়ের উপস্থিতি।কিন্তু প্রশ্ন হল ওই নেকড়ের সাথে মহিলাটির কি সম্পর্ক? নেকড়েটা কি ওর পোষা? কিন্তু নেকড়ে কেউ পোষে, বিশেষ করে এদেশে এটা অমিত কোনোদিন শোনেনি। যদিও ধরেই নেওয়া যায় যে নেকড়েটি ওর পোষা তাহলেও ওটাকে দিয়ে উনি এতগুলো লোককে খুন করতে যাবেন কেন? ওদের সাথে এই মহিলার কি কোনো পুরানো শত্রুতা ছিল? অমিতের মনে প্রশ্নের ঝড়, কিন্তু উত্তর দেবার কেউ নেই।

............……………………….

দিতির সকাল থেকেই ঘাড়ে ব্যাথা। ঘুম থেকে উঠেই টের পাচ্ছে। কিভাবে লাগল? পড়ে গিয়েছিল নাকি কাল রাতে? ভাবতে ভাবতেই ওর মনে পড়ল কালই তো ছিল পূর্ণিমার রাত। যাবনা যাবনা করেও ও কিছুতেই আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। বাইরে বেরিয়ে পড়ে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চাঁদের আলোয় যেন আত্মহারা হয়ে গেছিল। কোথায় চলে গেছিল নিজেরই খেয়াল নেই। কিন্তু এরপরই শুরু হয় প্রতিবারের মত প্রচন্ড মাথার যন্ত্রনা। তবে তারপর সেই আগের বারগুলোর মতোই কি যে হয় তা ওর মনে থাকেনা। তবে অনেকক্ষণ পরে বুঝতে পারে বিছানায় শুয়ে আছে। সারা গায়ে ব্যাথা, জ্বর জ্বর ভাব আর জিভটা কেমন তিতকুটে। অবশ্য বেলা বাড়ার সাথে সাথে উপসর্গগুলো কমতে থাকে।

 

দরজায় টোকা শুনে খুলে দেখে ওর বাড়িওয়ালা বটুকবাবু দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে একটু বিরক্তি। দাঁড়িয়েই বলতে শুরু করলেন " এত বলার পরেও কাল সেই বাইরে গেলে? বলা কওয়া নেই, মাঝেমধ্যে রাতের বেলা কোথায় যে যাও জানতে পারিনা। তোমাকে আগেও বলেছি এত রাতে একজন মেয়ের পক্ষে এভাবে বাইরে ঘুরে বেড়ানো খুবই বিপদজনক। কিছু হলে তোমার মা বাবাকে মুখ দেখাতে পারব না। একা মানুষ এই একটা কাজের লোক নিয়ে থাকি।এই বয়সে আর কোনো ঝক্কি সামলাতে পারব না বাপু! একমাস সময় দিলাম, তুমি অন্য কোনো বাড়ি দেখে নাও।" এই বলে দিতিকে আর কোনো কথা বলে সুযোগ না দিয়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন।

দিতি কি করবে বুঝতে পারছিল না। এটা ঠিক যে বটুকবাবু ওকে আগেই এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু জোৎস্না দেখলেই ওর যে কি হয়! 

এইসব শুরু হয়েছিল সেই দার্জিলিং বেড়াতে যাবার সময় থেকে। দিতির সাথে ছিল নিশা আর সীমা। তিন বন্ধু মিলে ঘুরতে এসেছে। সেদিন তখন সন্ধে হয়ে আসছে। ওরা ম্যাল থেকে ফিরছে। আচমকা রাস্তার পাশে মেয়েদের সাজগোজের জিনিস নিয়ে বসা একটা বুড়ির দিকে চোখ গেল।এইরকম তো কত লোকই বসে! কিন্ত এখানে বিশেষত্ব ছিল ওই জিনিসগুলোর মধ্যে একটি লকেট। অদ্ভুত ডিজাইন, মনে হয় কোনো হিংস্র জন্তুর দাঁত দিয়ে তৈরি। দিতি এমন ডিজাইনের লকেট আগে দেখেনি। কিন্তু ওটার দিকে হাত বাড়াতেই বুড়ি তাড়াতাড়ি বলল ওটা বিক্রি হবে না। দিতি যতই ওটা নেওয়ার জেদ করতে থাকে বুড়ি ততই বাধা দেয়। বলে ওটা পড়লে বিপদ ঘটবে, এমনকি প্রাণহানিও। কিন্তু দিতির জিনিসটা এতই মনে ধরেছে যে ও কোনো কথাই কানে তুলল না। এরকম লকেট পড়ে কলেজ গেলে সবাই ওকে কেমন হাঁ করে তাকিয়ে দেখবে ও শুধু সেই ভাবনাতেই মশগুল। তাই প্রায় দ্বিগুণ টাকা দিয়ে জোর করে লকেটটা ওই বুড়ির থেকে নিয়ে নিল। তবে যাবার আগে বুড়ি ওকে সাবধান করে দিয়ে বলল "মা! তুমি তো কিছুতেই শুনলে না। তবে পূর্ণিমায় রাতে কিন্তু সাবধানে থেকো।"

ওরা কেউই বুড়ির শেষ কথাটা বুঝতে পারল না। নিশা আর সীমা একটু গাইগুই করলেও দিতি পাত্তা দিল না।

বাড়ি ফিরেই আর থাকতে না পেরে দিতি ওটাকে পরল। পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর হঠাৎ দিতির ভীষন গরম লাগতে শুরু করল। এখন তো সবে শীত যাই যাই করছে, এত গরম লাগার তো কথা নয়! আস্তে আস্তে ওর মাথাও গরম হতে লাগল।  একসময় খুব অস্বস্তি হওয়াতে ও লকেটটা খুলে ফেলল। তবে লকেট খুলতেই আবার সব স্বাভাবিক। ও ভাবল পুরো ব্যাপারটাই মানসিক। আসলে ওই বুড়ির কথাগুলো ওর অবচেতন মন থেকে এখনো  মুছে যায়নি।

এর কিছুদিন পরেই এল পূর্ণিমার রাত। সূর্য ডুবতেই কেন জানি ওই লকেটটা পড়ার জন্যে দিতির মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। আগের বারের অভিজ্ঞতা থেকে ভাবছিল ওটা পড়বে কি না। এভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল। শেষমেষ ও আর থাকতে না পেরে লকেটটা পড়েই ফেলল। তবে লকেটটা পড়তেই সেই গা গরম করা অনুভূতি। দিতি ভাবল বাইরের খোলা হাওয়ায় ঘুরলে বোধয় অস্বস্তি কাটবে। সেইমত বাইরে চলে এল। চারিদিক শুনশান। এই মফস্বল শহরে এত রাতে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউই বেরোয় না। বাইরের ভরা জ্যোৎস্নায় দিতি যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। কিন্তু এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একটু পড়েই শুরু হল মাথা টিপটিপ করা যা শেষ হল প্রচন্ড মাথার যন্ত্রনায়। অসহ্য যন্ত্রনায় ও জ্ঞান হারাল। জ্ঞান ফিরতে দেখে বিছানায় শুয়ে। যতদূর মনে পড়ে ও একটা মাঠের মধ্যে পড়েছিল। সেখান থেকে ওকে এখানে কে আনল ও বুঝতে পারল না। তবে এটা এখানেই শেষ হল না। পরের পূর্ণিমার রাতগুলোতেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। পূর্ণিমায় ওর যে কি হয়, কেন হয় ও বুঝতেই পারেনা। এটা কি ওই লকেটটার প্রভাব? পরক্ষনেই ভাবে একজন শিক্ষিত মেয়ে হয়ে ও এসব কি ভাবছে? ওর হয়ত কোনো শারীরিক বা মানিসিক সমিস্য হচ্ছে। যদিও এ নিয়ে অনেক ডাক্তার দেখালেও তারা কিছুই করতে পারেনি।

তবে বটুকবাবুর কথাটা নিয়ে ও ভাবতে বসল। উনি তো একমাসের মধ্যে ঘর ছাড়তে বললেন। ওকে তো তাহলে এখন থেকেই ঘর খুঁজতে হবে। কিন্তু সেখানে গিয়েও তো সেই একই সমস্যা হবে। এভাবে কতদিন চলবে? এর থেকে মুক্তির পথ কি? দিতি ভাবতে বসল। কিন্তু বহু ভেবেও কোনো রাস্তা দেখতে পেলনা।

...........……………………………….

অমিত নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করে কোনো দিক থেকেই চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। নিজেও আজকাল বাড়িতে কম, রাস্তায় বেশি থাকছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অমিত হতাশ হয়ে আর কি করা যায় ভাবছেন, এমন সময় একদিন রাত দশটা নাগাদ এক সুমিত নামে অমিতের বিশ্বস্ত এক অফিসারের ফোন এল। শুনলেন এক সুন্দরী মহিলা রাস্তায় ঘুরছেন। কালবিলম্ব না করে অমিত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন। সত্যি এক মহিলা ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অমিত উনার সামনে গিয়ে প্রশ্ন করলেন "ম্যাডাম! কোথায় যাচ্ছেন জানতে পারি?"

" ঘরে ভাল লাগছে না। তাই একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরছি।" মেয়েটি জবাব দিল।

" কিন্তু এত রাতে এরকম নির্জন জায়গায় কোনো মহিলার পক্ষে ঘোরাঘুরি করা একদম নিরাপদ নয়।"

" আমার নিরাপত্তা নিয়ে আপনাকে চিন্তা কিরতে হবে না। আমার ক্ষতি করার সাধ্য কারো নেই।" কথাটা বলতে বলতেই মহিলার চোখদুটি যেন জ্বলে উঠল।

অমিতের আর কিছু বলার থাকল না। সত্যি তো! কাউকে ও বড়জোর সাবধান করে দিতে পারে, এই বেশি আর কি করবে? তার উপর আবার মহিলা! বেশি কিছু বলতে গেলে ওর নামেই হয়ত কমপ্লেন হয়ে গেল।  সুমিত সাদা পোশাকে গা ঢাকা দিয়ে আছে।অমিত ওকে ফোনে বলল আড়ালে থেকে মহিলার গতিবিধির উপই নজর রাখতে। এই বলে নিজে একটু দূরে একটা ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বসে রইল।

প্রচন্ড মশার কামড় উপেক্ষা করে অমিত বসে আছে। কতক্ষণ কেটে গেছে বোঝা যাচ্ছেনা। হঠাৎ দূর থেকে একটা  আর্তচিৎকার আর গুলির শব্দ পেয়ে অমিত দৌড়োল।বেশ খানিকটা দূরে ঝোপের মধ্যে একটা লোককে দেখল রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে কাতরাচ্ছে। তার পাশে বসে একজন অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। ওই লোকটি এবং সুমিতের কথা শুনে অমিত বুঝল এই লোকদুটি ঝোপের আড়ালে জুয়া খেলছিল। একজন মহিলা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন বলে সাহায্য চায়। তখন ওদের একজন মহিলাকে নিয়ে রাস্তা দেখাতে একটু দূরে চলে যায়। আর তারপরই এই বিপত্তি। দূর থেকে চিৎকার শুনে সুমিত দেখে একটা নেকড়ে একজন মানুষকে আক্রমন করেছে। ও লোকটাকে বাঁচাতে তড়িঘড়ি দূর থেকেই গুলি ছোড়ে। দূর থেকে ছোড়ার কারণে গুলিটা বোধয় ঠিকঠাক লাগনি। নেকড়েটা আহত হয়েই পালিয়ে যায়।

বডি মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করে অমিত সবে বসেছে, এমন সময় সুমিতের ফোন এল। ভুরু কুঁচকে চিন্তিত মুখে খানিকক্ষণ কারো সাথে কথা বলে বলল "স্যার! একেই বলে বোঝার উপর শাকের আটি! এক্ষুনি খবর পেলাম একটি মেয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। একেই এতে নাজেহাল, আবার একটা নতুন কেস জুটল। উনার বাড়িওয়ালা ওকে বাড়ির কাছে পড়ে থাকতে দেখে লোক ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ওখানে অজয় আছে। ওই খবরটা দিল।

"এটা কখন হয়েছে? মানে গুলিটা কখন লেগেছে?"

"অজয় যা বলল প্রায় ঘন্টাখানেক আগে।"

" মানে নেকড়েটাকে গুলি করার সময়।" খানিকটা স্বগতোক্তির সুরে বলল অমিত।

হাসপাতালে মেয়েটিকে দেখে ও চমকে গেল। এ তো সেই কাল রাতে দেখা মেয়েটি! ডাক্তার বলল গুলিটা কাঁধের কাছ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। শুনে ও আরেকদফা চমকে গেল। নেকড়েটাকেও তো ওখানেই গুলি করা হল না? অমিতের মনে একটা সন্দেহ ঘুরপাক খেতে লাগল। কিন্তু সেটাকে বিশ্বাস করতে মন  চাইল না

অমিত খোঁজ নিয়ে জানলেন মহিলাটির নাম দিতি ওর বাড়িটা ভালো করে দেখে রাখলেন সাদা পোশাকে সুমিতকেই ওর বাড়ির উপর নজর রাখতে বললেন। দেখতে দেখতে এসে গেল পূর্ণিমা। রাত গাঢ় হতেই দিতি বেরিয়ে পড়ল। অমিত ও তার দলবল গা ঢাকা দিয়ে ওকে ফলো করতে লাগল। দলবল বলতে অমিত, সুমিত আর লেডি অফিসার রিমা। দিতি বেশ খানিকটা যাবার পর রিমা ওকে আটকাল। রিমা বানিয়ে বলল যে ও গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একজন মেয়েকে এত রাতে একা ঘুরতে দেখে ও নেমে পড়ে।ও কোথাও যেতে গেলে রিমা ড্রপ করে দিতে পারে। দিতি বলে তার দরকার নেই, ও শুধু একটু ঘুরতে চায়। তাই শুনে রিমা বলতে লাগল জায়গাটা আদৌ মহিলাদের পক্ষে নিরাপদ নয়। আগেও এখানে এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। এইসব বলে গল্প ফাঁদল। পুরোটাই অমিতের প্ল্যান। উদ্দেশ্যে দিতিকে আটকে রাখা। কিন্তু কথা বলতে বলতে রিমা লক্ষ্য করল দিতি বেশ অধৈর্য্য হয়ে পড়ছে। একসময় তো ছটফট করতে লাগল। ও মুখের উপর রিমাকে চলে যেতে বললেও রিমা বলল এই চাঁদের আলোতে ওরও খুব ভালো লাগছে ঘুরতে। আর এও বলল দিতি না চাইলেও একজন পুলিশ হিসেবে ও একজন মহিলাকে এত রাতে কিছুতেই একা ছাড়তে পারবেনা। কারণ দিতির খারাপ কিছু ঘটলে ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা। কিন্তু দিতি মানল না। ও চেঁচামেচি জুড়ে দিল। তবে কিছুক্ষণ পরে ও  মাথা চেপে বসে পড়ল। রিমা ভাবছে ওকে মাথাব্যথার কোনো ওষুধ দেবে কিনা, এমন সময় ঘটল ঘটনাটা।

মাটিতে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর দিতির চেহারাটা একসময়  হঠাৎ ফুলতে শুরু করল।জামাকাপড় গুলো ফেটে বেরিয়ে আসল। সারা গায়ে বড় বড় রোম গজিয়ে উঠতে লাগল। হাতপায়ের নখগুলো ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগল আর সুচালো হয়ে উঠতে লাগল। আস্তে আস্তে মানুষের শরীরটা জান্তব আকার ধারন করল। বিস্ফোরিত চোখে রিমা দেখল ওর সামনে কোনো সুন্দরী মহিলা নয়, দাঁড়িয়ে আছে একটা নেকড়ে। নিজের অজান্তেই ও আর্তনাদ করে উঠল। ততক্ষনে অমিত আর সুমিত বেরিয়ে এসেছে। এতগুলো লোককে দেখেই বোধয় নেকড়েটা আর রিমাকে আক্রমনের রাস্তায় না গিয়ে দৌড় দিল সামনের জঙ্গলের দিকে। কিন্তু এর মধ্যেই অমিতের রিভলভার গির্জা উঠেছে পরপর দুবার। নেকড়েটা ছিটকে পড়ল দূরে একটা গাছের আড়ালে।

ওরা দৌড়ে গেল সেদিকে। গিয়ে তো হতবাক। নেকড়ে কই? এটা তো দিতি নামের সেই মহিলা! কাঁধ আর পেট থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, অবস্থা গুরুতর। এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ওকে তুলতে যাবে, এমন সময় রিমা বলল " দাঁড়াও, এটা কি?" বলে দিতির গলার লকেটের দিকে দেখাল।" অদ্ভুত তো!"বলে লকেটে হাত দিতেই যেন ছাঁকা খেল। এর মধ্যে লকেট থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করেছে।ও ছিটকে সরে এল। ঘটনা পরম্পরায় বাকিরাও হতভম্ব। তবে ধোঁয়া দেখে তারা দূরে সরে গেল কি কিরবে ভাবছে, এমন সময় দিতি চোখ বুজল। অমিতরা বুঝল সব শেষ। কিন্ত তারপারেই যা ঘটল তার জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। আচমকাই দিতির সারা শরীর দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। ওদের সবার চোখের সামনেই পুড়ে ছাই হয়ে গেল নেকড়ে মানবীর দেহ।

ওরা কতক্ষণ স্থাণুর মত ওইখানে দাঁড়িয়েছিল জানে না সুমিতই প্রথম মুখ খুললওয়্যারউলফ! এইসব মানুষেরা পূর্ণিমার রাতে নেকড়ে হয়ে যায় তবে এটা কোনো অভিশাপের ফলেই হতে পারেরিমি বললঅভিশাপ ছাড়াও কোনো মন্ত্রপুত জিনিসের প্রভাবেও এমনটা হতে পারে ওই লকেটটা মন্ত্রপুত তাই অমন গরম হয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছিল দেখে মনে হচ্ছে এটা ওই নেকড়ের দাঁত দিয়েই তৈরী এই লকেটের প্রভাবেই মেয়েটি প্রতি পূর্ণিমার রাতে নেকড়েতে পরিণত হত এরকম জিনিস বইতে অনেক পড়েছি, কিন্তু কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি নিজের চোখের সামনে এমন কিছু ঘটবে! সত্যিই নিজের চোখকেও বিশ্বাস করা যাচ্ছেনা“ 

অমিতও জানে আসল ঘটনা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই সুমিত আর রিমাকে এই  ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে বারণ করল নিজেও ঠিক করল চোখের সামনে যে ভয়াবহ ঘটনা দেখল তা দ্রুত ভুলে যাবে

নেকড়ের উপদ্রব থেকে মানুষকে রেহাই দিতে অমিতের নামে উপরমহলে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। প্রশাসনিক কর্তারা তো বেজায় খুশি। ওর প্রোমোশন পাকা হয়ে গেল। চারিদিকে প্রশংসা আর সম্বর্ধনার ঢেউতে ও ভেসে যেতে লাগল।

কিন্তু এর মধ্যেও একটা কাঁটা রয়ে গেল। দিতি ঘোষ নামে এক কলেজপড়ুয়ার আকস্মিক অন্তর্ধানের তদন্ত ওকেই করতে বলা হল। কারন বাকিরা এক্ষেত্রেও কোনো ক্লু পায়নি।তবে তদন্তের ভার নিলেও অমিত খুব ভালো করেই জানে যে আগে বহু ক্ষেত্রে এই ধরনের কাজে সাফল্য পেলেও এই একটি ব্যাপারে ও কোনোদিনই সফল হবে না।



arnab.garia@gmail.com

গড়িয়া 

No comments:

Post a Comment