1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 12, 2022

ষড়রিপু (৩ ) : পুনরায়

 

ছবি : দিব্যেন্দু গড়াই

পুনরায়  

দিব্যেন্দু গড়াই

“এ মোহ কদিন থাকে, এ মায়া মিলায়

কিছুতেই পারেনা আর বাঁধিয়া রাখিতে

কোমল বাহুর ডোর ছিন্ন হয় যায়

মদিরা উথলে নাকো মদির আঁখিতে।”

অন্ধ লোকটাকে রাস্তার ধারে বসে থাকতে দেখেছিল বিশাখা। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা খেতে খেতে বয়স্ক লোকটার অদ্ভুত আচরণ দেখে অবাকই হয়েছিল। বহরমপুর সংশোধানাগারের বাইরে এই একচালার ছোট্ট চায়ের দোকানে দিনের বেলা লোকজনের আনাগোণা লেগেই থাকে। সেই ভোরবেলা দোকান খুলে যায়। শুধু পুলিশ নয়, সংশোধনাগারের অন্য স্টাফেদেরও ডিউটি শিফ্ট শুরু হয় তখন থেকে। চা-বিস্কুট, বিড়ি- সিগারেটের বিক্রি তখন তুঙ্গে। একটু বেলা বাড়লে ব্যস্ততা কমে। ভীড় বাড়ে আবার বিকেলের দিকে। যখন স্টাফদের ডিউটি শেষে তারা বাড়ি ফেরার পথ ধরে। 

বেলা সাড়ে দশ’টা। সংশোধনাগারে ভিজিটের আগে বিশাখা এই চায়ের দোকানে দুদন্ড বসে যায়। এক ভাঁড় চা আর প্রজাপতি বিস্কুট নিয়ে মিনিট পনেরো কাটিয়ে তারপর কাজে ঢোকে। মে মাসের শেষ। গরমের তীব্রতা কমেনি এখনো। হরেন কাকু চায়ের দুধ গরম করছে। বেঞ্চিতে বসে ওড়না দিয়ে হাওয়া খেতে খেতে এদিক ওদিক দেখছিল বিশাখা। আর তখনই চোখ গেল লোকটার দিকে। খালি গা, খালি পা কিন্তু পরণে পরিস্কার পাটভাঙা ধুতি। একমুখ দাঁড়ি অার গোঁফের জঙ্গলের মধ্যে অন্ধ চোখদুটো যেন জ্বলজ্বল করছে। না, ভিক্ষা করছে না সে, বরং উল্টে হাতের ঝোলা থেকে টাকা বার করে পথচলতি লোকজনের উদ্দেশ্যে দিচ্ছে... ভাবখানা এমন, যেন দান করছে। সব্বাইকে বলছে টাকা নিয়ে যেতে। গরমের মধ্যে চিৎকার করতে করতে ঘেমে যাচ্ছে লোকটা। তাতে ক্লান্ত দেখাচ্ছে না একটুকুও, বরং বলিষ্ঠ শরীরে স্বেদবিন্দু ফুটে উঠে চেহারার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে খানিকটা। কৌতূহল হল বিশাখার। হরেন কাকা কে দুটো চায়ের কথা বলে সে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে...


*****

-'আমি দাদুর বাড়িতে মানুষ হয়েছি। অবস্থাপন্ন বাড়িতে জন্ম আমার। কোনদিন অভাব-অনটনের মুখ দেখিনি। অবশ্য থাকলেও দেখতে পেতাম না। কারণ আমি জন্মান্ধ। দাদু তার মেয়েকে কাছ ছাড়া করবে না বলে টাকার বিনিময়ে ঘরজামাই পুষেছিল। সে তার দায়িত্বটুকু করে, মানে আমার বীজ আমার মায়ের গর্ভে পুঁতে দিয়ে বিবাগী হয়ে চলে গেছিল। আর কখনো ফিরে আসেনি। মায়ের মুখে শুনেছি বাবা নাকি সন্ন্যাসী হয়ে যায় পরে। আর অমন কুৎসিত দেখতে সন্ন্যাসী সচরাচর দেখা যায় না বলে মায়েরও চিনতে ভুল হয়নি তাকে। কুম্ভমেলায় সেবার মা আমাকেও নিয়ে গেছিল সাথে করে। তখন আমি যুবক। চোখের অভাব পূরণ করার চেষ্টা করি অন্য ইন্দ্রিয়গুলোকে শক্তিশালী করে। শারীরিক কসরৎে আমার সাথে কেউ পেরে ওঠে না তখন। শরীরে হাতির মত শক্তি। 

সেখানে গিয়ে আলাপ হয়েছিল একটি ছেলের সাথে। আমার মতই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ছিল ছেলেটি। পোলিওতে তার একটা পা নষ্ট হয়ে যায় ছোটেবেলাতেই।’

একটু দম নিয়ে আবার শুরু করে,

-‘কপালগুণ বা দোষ যাই বলুন না কেন, ঐ ছেলেটির দিদির সাথেই আমার বিয়ে হয়। আমার স্ত্রী বড্ড আবেগপ্রবণ ছিল। আমি অন্ধ বলে সে সবসময় আমার পাশেপাশে থাকত, যাতে আমার কোন অসুবিধে না হয়। ওর গর্ভে যখন সন্তান এল, আমি খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। জন্মান্ধের সন্তান যদি জন্মান্ধ হয়? আর সেই অনিশ্চয়তার ছাপ গভীরভাবে পড়েছিল আমার সন্তানস্নেহে। না, অন্ধ হয়নি আমার দুই ছেলে। বরং নীরোগ স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল তারা।

আমি ক্রমশ পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। সে অন্ধত্বের গভীরতা জন্মান্ধের থেকেও বেশী। গাঢ় কালিমা মাখা। ছেলেদের কোন ভুল-ত্রুটি আমার চোখে পড়ত না। ছোটবেলায় অন্য বাচ্চাদের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে আসা, কারুর গরু-ছাগলকে ঢিল মারা, স্কুলে বন্ধুদের খাবারে নোংরা মিশিয়ে দেওয়া... এসব নিয়ে আমার কাছে কেউ নালিশ করতে এলে তাদের কথা তো শুনতামই না, উল্টে তাড়া করতাম। এভাবে স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠল ছেলেরা। আমার প্রশয়ে, আমার অন্ধমোহে তাদের বদমাইশি মাত্রা ছাড়াল। দূর্বলের ওপর অত্যাচার, টাকাপয়সার কেলেংকারি, মেয়েদের সাথে জোরজুলুম... কিচ্ছু বাদ রাখেনি। আর আমিও তাদের আগলে রেখেছি।

আর সেই প্রশয়ের ফল অবশেষে বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। দিন-দুয়েক আগে সামান্য কারণে আমাদেরই প্রতিবেশী পুরিন্দরের দুই ছেলেকে নৃশংস ভাবে খুন করে ওরা। জানাজানি হয়ে যেতে জনরোষ আছড়ে পড়ে আমাদের পেল্লায় বাড়িতে। টেনে-হিঁচড়ে বের করতে যায় আমার ছেলে দুটোকে। না, আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দিতে পারিনা। আমার হীরের টুকরো দুই ছেলেকে জনতা পিষে মেরে ফেলবে সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। অত কষ্ট ওরা সহ্য করবে কি করে? তাই জনতার হাত থেকে ছাড়িয়ে রেখে দিই আমার কাছে। কথা দিই, আমি নিজের হাতে ওদের পুলিশের হাতে তুলে দেব।’

-‘কোথায় তারা? থানায় আত্মসমর্পণ করেছে?

এতক্ষণ পর মুখ খুলল মনোবিদ বিশাখা বসু রায়। 

-‘থানায় পুলিশি অত্যাচারের কথা আমি জানি। ওরা সেই বীভৎস অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না। তাই নিজের হাতে খাবারে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে এসেছি দুই ছেলে ও তাদের মাকে। এতক্ষণে তারা শান্তিতে চিরনিদ্রায়। যা কিছু টাকাকড়ি ছিল হাতের কাছে নিয়ে এসেছি সাথে করে। বিলিয়ে যদি কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি আমার অন্ধ মোহের। আর সেই কারণেই থানায় না গিয়ে এই সংশোধানাগারের সামনে এসেছি। আমার সংশোধন দরকার। আদিম রিপুর কবলে আমি  মনুষ্যতর জীবে পরিণত হয়েছি।’

লোকটার দু-চোখ দিয়ে জলের ধারা নামে এবার। বিশাখা লোকটির হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবে বহু যুগ আগে এরকমই কিছু ঘটেছিল এই ভারতবর্ষের বুকে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস লিখে গেছেন সেকথা। আজ সেই মহাভারতেরই এক বহুল চর্চিত চরিত্রকেই যেন চোখের সামনে দেখতে পেল সে। ইচ্ছে করেই আর নাম জিজ্ঞেস করল না লোকটির। 

কে জানে? হয়ত ধৃতরাষ্ট্র, হয়ত বা নয়।


________________ (সমাপ্ত)_____________

dibyendugarai.dg@gmail.com
কলকাতা

এই ধারাবাহিকের 

No comments:

Post a Comment