1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

ষড়রিপু (2 ) : আততায়ী

 

ছবি : দিব্যেন্দু গড়াই

আততায়ী

দিব্যেন্দু গড়াই

‘অহংকারী মনের ভেতর আগুন ছিল পোষা,

সেই আগুনেই ছাই হল তাই অহংকারীর গোঁসা।’...

শেষ ট্রেণ চলে যাওয়ার অপেক্ষা করে উমর। জনাপাঁচেক যাত্রী নামে ট্রেণ থেকে। নেমেই তড়িঘড়ি পা চালিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। আষাঢ় মাসের শেষ। বিকেল থেকেই হাল্কা বৃষ্টি হচ্ছিল। কিছুক্ষণ আগে থেমেছে। 

উমর আলির তাড়া নেই। আসলে কোনদিনই ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে কাজ করতে পছন্দ করে না সে। হাতে একটু সময় রেখে এসব কাজ করতে হয়। যতই হোক, মানুষের বাঁচামরা নির্ভর করে যে কাজের ওপর তা কি আর হুড়ুমদুড়ুম করে করলে চলে? তাই রয়েসয়ে কাজ করা পছন্দ উমরের, ফলাফলও হাতেনাতে। এখনো অব্দি ব্যর্থ হয়নি সে। ঠোটের কোণায় অহংকারী হাসি ঝুলিয়ে অন্ধকারে পিছু নেয় তার চৌদ্দ নম্বর শিকারের।

*****

নসীপুর রেলস্টেশনের দশা দুয়োরাণীর মত। আগে মুর্শিদাবাদ, আর পরে জিয়াগঞ্জের মাঝে টিমটিম করে দাঁড়িয়ে আছে। সম্বল বলতে একটা লালইঁটের বাড়ি। তার সামনে রেললাইনের ওপর দিয়ে বেশীরভাগ ট্রেণই না থেমে চলে যায়। মোট চারটে ট্রেণ থামে সারাদিনে। শেষ ট্রেণ আসার আগেই ফাঁকা স্টেশন চত্বর প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট। ওদিকে জিয়াগঞ্জ, ভগবানগোলা স্টেশনের রাস্তায় সারাদিনই লোকজনের যাওয়াআসা, তাই দোকানগুলোও চলে রমরম করে। আর এই নসীপুর রেলস্টেশন, সবসময় মনে হয় ঝিমুচ্ছে।

নামকাওয়াস্তে প্ল্যার্টফর্ম, তাতে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে আসে হরেন। হরেন সাহা, রেলকর্মচারী। স্টেশনমাস্টারের ফাইফরমাশ খাটা থেকে, দরকার হলে টিকিট বিক্রি, সিগন্যাল দেখানো, স্টেশনের ছোটোখাটো যন্ত্র মেরামতির কাজ...  সবরকমই করতে হয়। মাসমাইনের কড়কড়ে নোটগুলো হাতে পাওয়ার সাময়িক আনন্দের জন্যই চাকরিটা ছাড়তে পারেনা হরেন। নাহলে পারিবারিক শাড়ির ব্যবসায় আয় মন্দ নয়। গঞ্জের বাজারে শাড়ির দোকানে জনাতিনেক কর্মচারী খাটে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নসীপুর স্টেশন থেকে সাইকেলে চেপে দশ কিলোমিটার দূরে দোকানে গিয়ে হিসাবপত্তর বুঝে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশ’টা বেজে যায়। বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তাঘাট আজ বেশীই শুনশান। তড়িঘড়ি সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে পাকা রাস্তার দিকে এগিয়ে যায় হরেন। কখন যে উমর আলি পিছু নিয়েছে টেরও পায়না।

*****

পীরতলা গ্রামে চুল-দাঁড়ি কাটে উমর। হাতের কাজ চৌখস, তাই আজ বাজারে-কাল বটতলায়-পরশু কোর্টের সামনে যেখানেই বসুক, ওর কাজের কখনো অভাব হয়না। মানুষের চোখে উমর আলি একজন নাপিত, যদিও চোখের আড়ালের কাজটাই ওর আসল কাজ। সুপারি কিলার। ঘনঘন কাজ করে না, তাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। শেষ খুনটা করেছিল গতবছর পৌষসংক্রান্তির রাতে। সাগরদিঘি পোস্টাআপিসের পেছনের পুকুরধারে লোকটার গলায় ক্ষুর চালিয়েছিল। এই কাজে সে সিদ্ধহস্ত। তাই এ ‘কাজের’ও অভাব হয়না কোনদিন, বরং অর্ডার ফিরিয়ে দিতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। কারণ দুটো খুনের মধ্যে কমপক্ষে ছ-সাত মাসের গ্যাপ রাখে ও। 

নিশ্বাস নেওয়ার যন্ত্র হোক বা মাথায় রক্ত পৌঁছানোর মোটা মোটা শিরা, সবকিছুই থাকে মানুষের গলাতে। গুরু ঝুনু-ওস্তাদের কাছে হাতেখড়ির সময় উমর সবকিছু বেশ খুটিয়ে জেনে নিয়েছিল। প্রথমবারের পর তাই আর হাত কাঁপেনি কখনো। পেছন থেকে একহাতে শক্ত করে মুখ চেপে ধরে চোখের পলকে অন্য হাতে গলার পাশ বরাবর ক্ষুর টেনে দেয়। ধারালো ক্ষুরের চাপে গলার ধমনী কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোনো শুরু হওয়া মাত্র আরেকবার ক্ষুর চালায় সে। এবারের লক্ষ্য গলার মাঝ বরাবর, শ্বাসনালী হাঁ করে কেটে দিলে শিকার আর চেঁচাতে পারে না। তারপর মিনিটখানেকের অপেক্ষা। আহত শিকার নেতিয়ে পড়লে উমর নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করে। এইভাবে তেরো টা খুন করেও ধরা পড়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা তৈরী হয়নি আজ অব্দি। আর সেটাই উমরের ভিতর অহংকারের জন্ম দিয়েছে। কাকে খুন করতে হবে শুধু এটুকুই যথেষ্ট, কেন খুন করতে হবে, কার সাথে কি ঝগড়া এসব জানতে চায়না সে, আর তাই বেশ মোটা টাকা হাতে আসে প্রতিটি খুনের সুপারি নেওয়ার সময়। সব টাকাই পাঠিয়ে দেয় সমস্তিপুর, বিহারে। পরিবার থাকে সেখানে। বাড়ি-জমিজমা সবকিছুই করা হয়ে গেছে। আরেকটু বয়স বাড়লে, যখন ক্ষুর চালানোর ক্ষিপ্রতা কমে যাবে, তখন পীরতলার বাস উঠিয়ে ফিরে যাবে বিহারে, এরকমই ভেবে রেখেছে। 

ঝিঁঝি পোকার ডাক আর জোনাকি পোকার আলোর মধ্যে দিয়ে শর্টকাট কাঁচা রাস্তা ধরে উমর। জমাজল আর কাদায় মাখামাখি রাস্তায় দু-তিন বার পা হড়কালেও সামলে নেয় শেষঅব্দি। টর্চ থাকলেও জ্বালায় না। কাজ’টা শেষ করে বিবি’র হোটেল থেকে বিফ-বিরিয়ানি আর গোস্তভুনা কিনে আয়েস করে খাবে, এটাই ওর খুনের পরের সামান্য বিলাসিতা। এসব ভাবতে ভাবতে অন্ধকারে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলে, লুঙ্গির গোঁজায় ক্ষুরটা যথাস্থানে আছে কিনা সেটা দেখার প্রয়োজনও মনে করে না।

শর্টকার্ট রাস্তা ধরে পাকা রাস্তায় পৌঁছতেই উমর দেখে হরেনের সাইকেল গায়ের ওপর এসে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বেগে লাফিয়ে পড়ে উমর। পেছন থেকে বাঁ হাতে হরেনের মুখ চেপে ধরে ডান হাতে ক্ষুরের সন্ধানে কোমরের গোঁজে হাত দেয় উমর, আর তখনই আবিস্কার করে ক্ষুরের জায়গাটা ফাঁকা।


*******

তার পরের ঘটনাটা হরেন সাহার জবানিতেই শুনেছে মনোবিদ বিশাখা বসু রায়। ধ্বস্তাধ্বস্তিতে সাইকেল সমেত দুজনেই রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর হরেনের বুকের ওপর উঠে ওর গলা টিপে ধরে উমর। হাঁকপাঁক করতে করতে চারিদিক হাতড়াতে থাকে হরেন। আর হাতড়াতে হাতড়াতে হাতুড়ির বাঁটে হাত লেগে যায় ওর। দমবন্ধ হতে আর কয়েক মুহূর্ত বাকি। মরিয়া হয়ে গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে হাতুড়ি মারে উমরের মাথায়। এলিয়ে পড়ে উমর। পুলিশ এসে যখন তুলে নিয়ে যায় তখন দু’জনের দেহেই প্রাণ ছিল। হরেনের বেশী, উমরের কম। হাসপাতালের এমার্জেন্সীতে মরার আগে পুলিশকে নিজের কৃতকর্ম জানিয়ে যায় উমর। ক্ষুর যদি আজ স্থানচ্যুত না হত এতক্ষণে বিফ-বিরিয়ানি আর গোস্তভুনা দিয়ে রাতের আহার সারত, সেকথা জানাতেও ভোলে না। অহংকারই পতনের কারণ, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় সেই উপলব্ধিটুকু নিয়েই ধরাধাম ত্যাগ করে তেরোটা খুনের আসামী উমর আলি।

আর,

স্টেশনের যন্ত্রপাতি সারানোর জন্য চটের ব্যাগে হাতুড়ি নিয়ে ঘোরা হরেন সাহা খুনের আসামী হয়ে বহরমপুর সংশোধনাগারে জায়গা করে নেয় বছর খানেকের জন্য।

dibyendugarai.dg@gmail.com
কলকাতা

এই ধারাবাহিকের 

2 comments:

  1. তরুণ চক্রবর্তীJuly 1, 2021 at 4:35 PM

    খুব সুন্দর এগোচ্ছে । পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম ।

    ReplyDelete
  2. অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete