ছবি :দিব্যেন্দু গড়াই গগন সামন্ত'র কেস দিব্যেন্দু গড়াই |
‘ঘরকুনো এক মানুষ ছিল চার দেওয়ালে বন্দী, সঙ্গী ছিল মনখারাপ আর হরেক ফিকির ফন্দী।’...
মনখারাপের সময় গগন সামন্ত রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে। একা একা বসে থাকে পার্কে। কখনো বাদামওয়ালার কাছে ঝাল ঝাল লাল লঙ্কা গুঁড়ো দেওয়া মটরভাজা কিনে খায়, কখনো আবার শুধু চা। সেদিন পার্কের বেঞ্চে মনখারাপ নিয়ে বসেছিল গগন। একটু আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। পার্কের বৃষ্টিভেজা সবুজ ঘাসে একদল ছেলেপিলে ফুটবল নিয়ে লাথালাথি করছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে আপনাআপনি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠার কথা। কিন্তু গগন সামন্তর মুখে হাসি নেই। তার বদলে বিমর্ষ ভাব।
-‘দাদা’র কি মন খারাপ?’
ঘাড় ঘুরিয়ে গগন দেখে দোহারা চেহারার একটি লোক বসে আছে তার পাশটিতেই। কখন বসল? অবশ্য নিজের মনের ভেতর উঁকিঝুকি মারতে গেলে চারিপাশে কি ঘটছে খেয়াল থাকেনা সবসময়। লোকটির দিকে ভালো করে তাকাল গগন। এই শীতেও গায়ে কোন সোয়েটার-চাদর নেই। মাঝবয়সী লোকটির পরনে মামুলি ধরনের শার্ট-প্যান্টস। চোখে চশমা, একমাথা এলোমেলো চুল, গালে কয়েকদিনের না-কামানো দাড়ি। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ।
-‘আমার মন খারাপ না ভালো, সেটা জেনে আপনি কি করবেন?’ গগনের চোখেমুখে বিরক্তি।
-‘না না, কিছু করব না। সত্যি বলতে কিচ্ছু করারও নেই। আধুনিক মেডিকাল সায়েন্সে মনখারাপের চিকিৎসা নেই, সে ডাক্তাররা যাই বলুক। আর মন থাকলে ভালো-খারাপও থাকবে। এ আবার আশ্চর্য কি!’
-‘বাব্বা! মনখারাপ বিষয়টি নিয়ে অনেক খোঁজখবর রাখেন দেখছি!’
-‘সাধে কি আর রাখি। রাখতে হয় নইলে যে নিজেকে নিয়ে মহা মুশকিলে পড়ি।’
-‘মানে?’
-‘বলছি, তার আগে আপনার ফেভারিট ঝাল-ঝাল মটর কিনে ফেলি দু প্যাকেট। ও ভাই, দু প্যাকেট মটরভাজা দাও তো। আর যাওয়ার সময় চা-ওয়ালা’কে দেখলে এদিকে পাঠিয়ে দিও। গোড়া থেকেই বলি তাহলে। আপনার আবার তাড়া নেই তো?’
আলাপী লোকটির গুছিয়ে বসা দেখে গগন সামন্ত বুঝতে পারে চট করে এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। তাছাড়া একা বসে বসে মনখারাপ উদযাপন করার চাইতে এর গালগল্প শোনা ভালো। মুখের মধ্যে ঝাল মটরদানা ফেলে চিবুতে চিবুতে লোকটির দিকে ফিরে বসে গগন।
-‘বলুন, শুনছি।’
-‘গোড়ার কথা, মানে এক্কেবারে জন্ম থেকেই শুরু করি। আমার জন্মের দিন আমার ঠাকুরদা মারা যান বজ্রাহত হয়ে। বাজ পড়ে বাড়ির সামনের মাঠে। ঠাকুরদা তখন দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলেন। আর সেই শোকে উন্মাদ হয়ে যান ঠাকুমা।’
-‘আপনার জন্মের সময়টা ভালো নয় দেখছি।’
-‘ভালো কি বলছেন মশাই। বলুন অশুভ। ছোট থেকেই তাই শুনে আসছি।'
-‘জন্ম থেকেই আপনি তার মানে দুর্ভাগ্যের শিকার!’
-‘তা বলতে পারেন। তবে আমার ছাত্রদশা মোটের ওপর ভালোই কেটেছিল। মানে, ক্লাসের পরীক্ষা, বোর্ডের পরীক্ষা, এন্ট্রান্স পরীক্ষা সবেতেই মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করেছি। ইউনিভার্সিটি তে ডিস্টিংশনও পেয়েছি আমি।’
-‘দারুণ ব্যাপার। ভালো লাগছে জেনে আমি একজন ব্রিলিয়ান্ট মানুষের সাথে কথা বলছি।’
-‘ঠেস দিয়ে ব্রিলিয়ান্ট বললেন না তো? না, বলেননি। আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি মন থেকেই আমার প্রশংসা করেছেন। ধন্যবাদ এবং আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
-‘দুঃখিত হবার কারণ?’
-‘আরে, ওটাই আমার সমস্যা। যা যা আমি পারিনি বা পারিনা, সেসব যদি কাউকে করতে দেখি অমনি আমার মনখারাপ হয়ে যায়। আর মনখারাপ জমতে জমতে ডিপ্রেশান। ছোটবেলার অন্য পাঁচটা বাচ্চার মত আমিও আঁকার স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। রোববার সকালে বোর্ড-আঁকার খাতা-রঙ-তুলি নিয়ে ভালোই লাগত যেতে। শীতকালে বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় নামও দিতাম। টিফিনবক্স ছাড়া যদিও অন্য কোন পুরস্কার পাইনি জীবনে। সেই আমি বড় হয়ে যেই দেখলাম আশেপাশের লোকজন দারুণ দারুণ সব ছবি আঁকছে। স্কেচ, প্যাস্টেল, ওয়াটার কালার, কোলাজ.. মুুগ্ধ হওয়ার মত সব ছবি। ব্যস...তারপরেই চেপে ধরে মনখারাপ। মুগ্ধ হই কিছুক্ষণের জন্য, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারিনা। তার বদলে মন ভরে ওঠে ঈর্ষায়। আর তারপরেই মন জুড়ে নেমে আসে একরাশ বিষণ্ণতা।’
-‘ঈর্ষাপরায়ণতা মানুষের একটি সাধারণ প্রবৃত্তি। তার জন্য মনখারাপ হওয়ার তো কথা নয়।’
-‘না মশাই, শুধু ঈর্ষা নয়। ঈর্ষার কারণে কোন না কোন ক্ষতিকারক পদক্ষেপ নিয়ে ফেলি। আর সেটাই মনখারাপের কারণ। ভীষণ সুন্দর কোন ছবি দেখলে সুযোগ খুঁজি ছবিটাকে নষ্ট করে দেওয়ার। পাশের বাড়ির ছাদে সুন্দর ফুল ফুটেছে দেখলে ছাদ টপকে টবে বিষ মিশিয়ে দিয়ে আসি। আসলে সেই ছোট থেকেই এ জিনিস আমার মধ্যে রয়েছে। এই যেমন, ছোটবেলা আমার বাবার যত আদর ছিল তার পোষা টিয়াপাখির ওপর অথচ আমার বেলায় শুধু শাসন আর মারধোর। একদিন দিলাম পাখিটার গলা মুচকে...’
-‘বাপরে!’
-‘এতেই ঘাবড়ে যাচ্ছেন? তাহলে বাকিটুকু শুনলে তো অজ্ঞান হয়ে যাবেন।’
সন্ধ্যে হয়ে গেছে একটু আগে। ছেলেপিলের দল বাড়ি চলে যাওয়ায় মাঠ এখন শূণ্য। উত্তুরে হাওয়ায় ঠান্ডাটা একটু যেন অসহনীয় হয়ে উঠছে। গগন সামন্তর গা’টা একটু শিরশির করে উঠল।
-‘আমি এবার উঠি। অন্ধকার হয়ে গেছে, চোখে ভালো দেখতেও পাইনা। আপনার বাকিটুকু পরেরদিন শুনব নাহয়।’
-‘বেশীক্ষণ লাগবে না।’ হাতে ধরা চটের ব্যাগ থেকে একটা রক্তমাখা ছুরি বার করে লোকটা। ম্লান হেসে বলে,
‘ছোট থেকেই অশুভ, দুর্ভাগা, মুখপোড়া এসব বিশেষণ ছাড়া ভাগ্যে আমার কিছুই জোটেনি। তাই অল্প স্নেহ, একটু ভালোবাসার কাঙাল আমি বরাবরই। বাবা-মায়ের আদর না পেলে হিংসে হত দাদার ওপর, বাবার আদরের টিয়াপাখির ওপর। দাদাকে অনেকবার শারীরিকভাবে নিগ্রহ করেছি, দাদার অজান্তে। তবে আজ দাদা নয়, নিজের হাতে অতসীকে খুন করে এসেছি এই ছুরি দিয়ে। অতসী, যার কাছে ভালোবাসার আশ্রয় পেয়েছিলাম একসময়। ঘরকুনো এক সাধারণ মানুষ আমি, বললে বিশ্বাস করবেন না, কি যত্নে আগলে আগলে রাখত আমাকে। আর আজ তাকেই মেরে ফেললাম।’
কাঁদতে কাঁদতে বলে চলে লোকটা,
-‘কি অপরাধ ছিল তার? সারাক্ষণ ফোনে কার না কার সাথে কথা বলত, চ্যাট করত। আমার ওপর থেকে তার সমস্ত মনোযোগ সরে গেছিল। বারণ করেছি, হাতেপায়ে ধরেছি, কাকুতি-মিনতি করেছি। কোন লাভ হয়নি। আর সেই কারণে প্রথমে ভেঙেছি ঐ ফোনটা। অতসীকে মারতে চাইনি আমি। বলুন না, নিজের বৌকে কেউ মারে? কিন্তু ফোনের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখাতে আমি সব হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে যাই। হিংসে হতে থাকে আশেপাশে সবার ওপর। আমিই কেন বারবার হেরে যাব? আমি যা পাইনি, যা পারিনা বাকিরা পাবে কেন? অক্ষম রাগে ছুরি বসিয়ে দিয়েছি অতসীর দেহে...
ডুকরে কেঁদে ওঠে লোকটা।
-‘তীব্র শোকে পাথর হয়ে যাই। এ আমি কি করলাম? চরম গালাগালি দিই নিজেকে। বলি, আমি সত্যিই দুর্ভাগা। চরম শাস্তি দরকার আমার এই ঘৃণ্য কাজের জন্য। তাই এখান থেকে সোজা যাব থানায়। খুনের অস্ত্র নিয়ে এসেছি সাথে করে। সারেন্ডার করব। উঠি তাহলে।’
উঠে পড়ে গগন সামন্ত।
একরাশ ধুলোবালি উড়িয়ে উত্তুরে হাওয়া ফাঁকা মাঠে পাক খায়। আর সেই ধুলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যায় দোহারা চেহারার, মাঝবয়সী একটা লোক। এই ঠান্ডাতেও তার গায়ে কোন সোয়েটার-চাদর নেই। মামুলি ধরনের শার্ট-প্যান্টস পরা, একমাথা এলোমেলো চুল, গালে কয়েকদিনের বাসি দাড়ি আর হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে সে। চোখে চশমা পরেও কেমন যেন হাতড়ে হাতড়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে গগন সামন্ত।
পিছনে পার্কের বেঞ্চের ওপর তখন পড়ে আছে দুটো ঝালমটরের ঠোঙা। একটা প্রায় খালি, আরেকটা পুরো ভর্তি।
***
বিশাখা বসু রায়, মনোবিদ। অবসরপ্রাপ্ত, ষাটোর্ধ এই মহিলা বহরমপুর সংশোধনাগারের সাথে চাকুরিসূত্রে যুক্ত ছিলেন বহুদিন। বন্দীদের কাউন্সেলিং ও চিকিৎসায় সাহায্য করতে করতে কখন যেন বন্দীদের জন্য মনের নরম কোণে একটা জায়গা তৈরী হয়ে গেছিল। কিছু কিছু ইন্টারেস্টিং কেসহিস্ট্রি লিখে রাখতেন ডায়েরীতে। নাতনীর আব্দারে সেই ডায়েরীর পাতা উল্টোতে গিয়ে চোখে পড়ল গগন সামন্ত’র কেসটা। নাতনীর বন্ধুদের তৈরী এক ওয়েব ম্যাগাজিনের টপিক এবার ‘ষড়রিপু’। নাতনীর বায়না দিম্মার লেখা চাই, তাই…
মাৎসর্য্য দিয়েই শুরু হোক তাহলে। শেষ থেকে শুরু।
*(সমাপ্ত)*
খুব সুন্দর শুরু । পরের পাঁচ রিপুর অপেক্ষায় রইলাম ।
ReplyDeleteপরপর ৫ রিপু, কতটা কি হয় দেখা যাক।😊
Deleteখুব ভালো লাগল দিব্যেন্দু। পরেরটার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteএই সিরিজের চতুর্থ গল্প প্রকাশিত হয়েছে। মোট চারটে গল্প প্রকাশিত হল এই সিরিজের। গল্পগুলো পড়ে জানাবেন কেমন লাগল।
ReplyDelete