1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

ছবি : ইন্টারনেট
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা 
তুষার ভট্টাচাৰ্য
যেকোনও সময় যেকোনও কালেই   কবি লেখকরা অসম্ভব দূরদৃষ্টি চেতনা সম্পন্ন হয়ে থাকেন l কবি জীবনানন্দ দাশও  শুধু  দূরপনেয় তিমির বিলাসী, নির্জনতা বিলাসী   রোমান্টিক কবিই ছিলেন না ; তিনি ছিলেন তাঁর সময়কালের একজন  আদ্যপান্ত সমাজ সচেতন কবি l তাই রূপসী বাংলার  কবি   যখন উচ্চারণ করেন 'পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন '
তখন সমগ্র পৃথিবীজুড়ে সাম্প্রতিক করোনা ক্রান্তিকালের মারণ ব্যাধির প্রকোপ যেন  অদ্ভুতভাবে মিলে যায় l

কবি জীবনানন্দ দাশকে তাঁর সমকালের সমালোচকরা ( শনিবারের চিঠির সজনী কান্ত দাস, কবিতা পত্রিকার সম্পাদক তথা বিশিষ্ট কবি লেখক বুদ্ধদেব বসু, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার প্রমুখ ) নির্জনতা বিলাসী, হতাশাগ্রস্থ  কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন l
কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ  -ঝরা পালক (১৯২৭ সালে প্রকাশিত ), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬ ), বনলতা সেন ( ১৯৪২), মহাপৃথিবী ( ১৯৪৪ ), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮) এবং কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত -  শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪),রূপসী বাংলা (১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১), অন্যান্য কবিতা (সংকলন ) প্রভৃতি  কাব্য  গ্রন্থে কবির সমকালীন  সমাজ ও তার পারিপার্শ্বিক ভাবনার চলচিত্র নিপুনভাবে চিত্রিত হয়েছে l
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরাপালক' এ 'বিবেকানন্দ' শীর্ষক কবিতায় কবি লিখেছেন - 'মহামারী ক্রন্দন ঘুচাইলে তুমি শীতল পরশে l'
'নিখিল আমার ভাই' কবিতায়  - কীটের বুকেতে যেই ব্যথা জাগে আমি সে বেদনা পাই l
'একদিন খুঁজেছিনু যাঁরে' কবিতায় -' মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি 'l
'ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল ' কবিতায়  - 'শ্মশানের পানে উড়ে উড়ে কঙ্কালের রূপ l '
'পতিতা' কবিতায় - সে যে মন্বন্তর, মৃত্যুর দূত, অপঘাত, মহামারী l

কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'তেও অনেক কবিতায় তাঁর  সমাজ সচেতনতামূলক চিন্তনের সাক্ষর  পাওয়া যায় l যেমন 'অনেক আকাশ কবিতায়' রয়েছে - আলোর চুমায় এই পৃথিবীর হৃদয়ের জ্বর কমে যায় l
'ক্যাম্পে' কবিতায় - পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে /এই ব্যথা এই প্রেম সবদিকে রয়ে গেছে l
'সুচেতনা' কবিতায় - কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে l
'জীবন' কবিতায় - আমাদের হৃদয়ের শস্য তবু মরে / জান তুমি? শিখেছ কি আমাদের ব্যর্থতার কথা ? কোন অশ্রু কোন পীড়া হতাশার গায়ে কখন জাগিয়া ওঠে /
কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস, যক্ষা রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন l
'পিপাসার গান' কবিতায় - শুধু পীড়া, শুধু পীড়া! মুকুলে মুকুলে শুধু কীট আঘাত, দংশন চায় আজ মন l 
 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থের  'সুচেতনা' কবিতায় রয়েছে আশ্চর্য পংক্তিমালা  -
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন ;
সুচেতনা এই পথে আলো জ্বেলে এপথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে / শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলই অনন্ত সূর্যোদয় l

মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থের 'স্বপ্ন' কবিতায় সমাজ সচেতন কবি লেখেন - পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন, মানুষ রবে না আর l
আট বছর আগের একদিন কবিতায় -যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা এই জেনে অশ্বথের শাখা করেনি কি প্রতিবাদ?
'জীবনের এই স্বাদ' কবিতায়  - আমরা দু'জনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার l
সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থের 'রাত্রি' কবিতায় কবি লিখেছেন - হাইড্রান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল l
'শ্রেষ্ঠ কবিতা' গ্রন্থের 'তবু' কবিতায় উল্লেখ রয়েছে - সে অনেক রাজনীতি রুগ্ন নীতি মারী মন্বন্তর যুদ্ধ ঋণ /আজ এই পৃথিবীর অন্ধকারে মানুষের হৃদয়ে বিশ্বাস কেবলই শিথিল হয়ে যায় l
'মানুষের মৃত্যু হলে'   কবিতায় - মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায় l
'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থে - তোমাদের ম্লান মুখ দেখিয়াছি /তোমাদের ক্লান্ত রক্তাক্ততা দেখিয়াছি l
রুগিরা হাঁপায় না তো, বুড়োরা কয় না কথা, থুবড়ো ব্যাথার কথা যত l
'বেলা অবেলা কালবেলা' কাব্যগ্রন্থে -
'পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে' কবিতায় -সকলেরই মৃত্যু হবে মরণ হতেছে l
'অন্যান্য কবিতা 'গ্রন্থে - মৃত্যু শীর্ষক কবিতায় কবি লিখেছেন - হাড়ের ভিতর দিয়ে যারা শীত বোধ করে মাঘ রাতে তাহারা দুপুরে বসে শহরের গ্রিলে মৃত্যু অনুভব করে l
পৃথিবী আজ কবিতায় - অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি শব কুড়িয়ে ফিরছে অন্ধকারে l
'অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ' কবিতায় - 'অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা'
আজও সমানভাবে  প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যময়  হয়ে রয়েছে l
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশকে শুধুমাত্র নির্জনতা বিলাসী কবি হিসেবে চিহ্নিত না করে, কবির সমকালীন সমাজ সচেতনমূলক কবিতাগুলি পাঠ করলেই  তাঁকে নতুন ভাবে উপলব্ধি করতে পারা যায় অনায়াসে l
তাঁর একশো তেইশতম জন্মদিবস ( জন্ম : ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯, ৬ফাল্গুন ) পেরিয়ে যাবার পরেও কবিকে নতুনভাবে জীবনানন্দ প্রেমী পাঠকরা আবিষ্কার করবেন এটা আশা করা যায় l
...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment