1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, July 24, 2023

ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ

ছবি : ইন্টারনেট

ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ

অরুণ চট্টোপাধ্যায়

ভূতেরা ছোট থেকে বড় হয়। বড় থেকে বুড়ো হয়। ঠিক মানুষের মত। কিন্তু মানুষ বুড়ো হয়ে মরলেও ভূতে বুড়ো হয়ে মরে না। কেউ এর কারণ না বুঝলেও আমি বুঝি। এর কারণ খুব সোজা। মানুষ মরে ভূত হবার জন্যে। কিন্তু ভূতের মরার তাগিদ কিসের শুনি? সে আবার মরে কী হবে? তাই ভূত হয়ে বেঁচে থাকে অনাদি অনন্ত কাল।

কিন্তু সেদিন একটা ভূত মরল। কী করে মরল? মারল কে? ভূতেদের সমাজের বিরুদ্ধ এমন ঘটনা ঘটাল কে? এমনি অনেক প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হচ্ছে ভূত সমাজকে। আর অবস্থাটা বড় বেয়াড়া। উত্তর তাদের ঠোঁটের ডগায়। তবু বলা যাবে না। কারণ এটা ভূত সমাজের অনুচিত কাজের মধ্যে একটা। মানে এই ভূত কেন আর কী করে মরল সেটা সবাইকে খোলসা করে জানানো।  

কিন্তু বিশ্বস্ত কাউকে তারা ফিসফিস করে বলে দিয়েছে ব্যাপারটা। আমিও জেনেছি সেখান থেকে। যে মেরেছে সে হল শয়তান। শয়তান হল -- না মানুষ না ভূত। মানুষের থেকে মিচকে হল ভূত। আর তার থেকেও ফিচকে হল শয়তান। কোটি কোটি ভূত হলেও শয়তান কিন্তু মাত্র একজন। ঠিক ভগবানের মত। মানুষ কোটি কোটি হলেও ভগবান কিন্তু একজন। শয়তান আসলে খুব ভয়ঙ্কর একজন যার নাম মুখে তো দূরের কথা মনে এলেই ঠক ঠক করে কাঁপুনি এসে যায়। আর ভূতেরা তো কফি খায় না যে গরম কফি খেয়ে কাঁপুনি থামাবে। তাই তারা এমন কথা ভাবার কথা মনেও আনে না।  

ভগবানকে দেখা যায় না কিন্তু তার কাজ নাকি বোঝা যায়। ভাল লোকের ভাল আর মন্দ লোকের শাস্তি বিধান নাকি তিনি করেন। এটা ভুক্তভোগী সবাই বলেছে। তেমনি শয়তানকেও দেখা যায় না। বোঝা যায় শুধু তার শয়তানি। সে খারাপ লোকের ভাল করে আর ভাল লোকের খারাপ। মানে ভগবানের ঠিক উলটো। কোনও লোককে উন্নতি করতে দেখলেই, তো হিংসেয় জ্বলে পুড়ে একশা। অমনি ক্ষতি করে দেবে সেই ভাল লোকটার। কিছুতেই ভাল হতে দেবে না তার।  

কোনও ভূতকে যদি পছন্দ হয়ে যায় শয়তানের তবে সে তাকে মেরে ফেলে। মরে যাবার পরে সে হয় শয়তানের সাগরেদ। আশ্চর্যের কথা ভূতের সঙ্গে কিন্তু শয়তানি করে না শয়তান। তার যত শয়তানি শুধু মানুষের সঙ্গে। শুধু দিনরাত ফন্দি করে চলে ভাল মানুষগুলোকে কী করে খারাপ করবে। বিব্রত করবে আর বারটা বাজিয়ে দেবে। 

বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বললে অনেকের সুবিধে হবে। যেমন ধর, কোনও মানুষ দিব্বি একটা জমিতে চাষ করছে। খেটে খুটে অনেক ফসল তুলেছে। সারাটা বছর তার ভালভাবে কেটে যাবে এই ফসল বিক্রি করে। লোকটা চুরিও করে না আর জোচ্চুরিও। সৎ আর পরিশ্রমী মানুষ। নিজে খেটে রোজগার করে।  

কিংবা ধর, কেউ অন্য ব্যবসা করে বা বড় চাকরি করে বড় হয়েছে। সমৃদ্ধিশালী হয়েছে। অর্থবান হয়েছে অথবা নাম করেছে। কেউ বা লেখালিখি করে দুটো বইপত্র বিক্কিরি টিক্কিরি করছে। নাম আর অর্থ দুটোই করেছে। 

ভূতেরা এসব দেখবেও না। তাদের কাজ তো রাত্রে। শ্যাওড়া গাছ, ছাতিম গাছ, তেঁতুল গাছ, বেলগাছে বসে মারবে গুলতানি। পেঁকো পুকুর থেকে তুলবে মাছ আর নাহলে গেরস্তর হেঁসেল থেকে। কিছু না জুটলে ডাস্টবিন থেকে ফেলে দেওয়া পচা মাছ যেগুলো কুকুর বেড়াল পর্যন্ত ঘেন্নায় ছোঁয় নি। কিন্তু ভূতে বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে নেয়। কারণ তারা তো ভূত। আর ভূতেদের স্বভাব মানুষের ঠিক উল্টো। 

সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভূতেরা মানুষের বিশেষ তেমন ক্ষতি করার দিকে যায় না। বড় জোর তোমাকে কষে ভয় দেখাবে। রাত দুপুরে বিরাট একটা ছায়া হয়ে খিলখিল করে হাসবে। পোড়ো বাড়িতে মড়াকান্না কাঁদবে নাকি সুরে। সাত সন্ধেবেলা পুকুর পাড়ে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে। যেই না তুমি হাত পা ধুতে নেমেছ জলে অমনি নিজের মাথার ঘোমটা খুলে দেবে। তুমি দেখবে ঘোমটার ভেতরে মাথা বলে কিছুই নেই। বেবাক ফাঁকা। ভূতেদের কি আর মাথা থাকে ছাই? থাকলে তো তারা মাথা খাটিয়ে আরও বুদ্ধিমানের মত ভয় দেখাতে পারত। এমন ছোঁচাগিরি করত নাকি? 

কিংবা ধর একটা শুকনো গাছ হয়ে অন্ধকারে রাস্তার একপাশে বসে থাকবে। কেউ জানতেও পারবে না যে ওটা গাছ নয় একটা ছোঁচা ভূত। যেই না অফস ফেরত ক্লান্ত মানুষটা পা বাড়াতে যাবে ব্যাগ দোলাতে দোলাতে অমনি সেই ছোঁচা ভূত তার একটা পা বাড়িয়ে দেবে। মানুষটা কিছুই জানবে না। সে শুধু হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে ভাবতে থাকবে আচমকা গাছের গোড়া থেকে একটা লিকলিকে ডাল হাজির হল কী করে তার পায়ের সামনে। 

কিন্তু শয়তানের ব্যাপারটা ভিন্ন। সে ভূতের মত অতটা মোলায়েম ধরণের নয়। মানুষের উন্নতি দেখলে তার বুক ফেটে যাবে। রাগে জ্বলতে থাকবে মাথার তালু। খিদে হবে না দিনে। ঘুম হবে না রাতে। সুস্থ শান্ত হয়ে একটু শুতে বসতেও পারবে না। সব সময় অস্বস্তি শুধু। জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে সারা শরীরটা। এক পুকুর জল ঢকঢক করে খেয়েও ঠান্ডা হতে পারছে না কিছুতেই। বিরাট বড় তেপান্তরের মাঠের চারিধারে চারবার চরকির পাক ঘুরেও স্থির হতে পারবে না। 

তার মানেটা হল এই যে কারোর এতটুকু ভাল দেখতে পারবে না শয়তান। ভাল দেখলেই অমনি শয়তানি করার জন্যে ছটফটিয়ে উঠবে তার মন। কিন্তু সে তো একা বসে থাকে এক জায়গায়। তার চোখ মুখ নাক কান সব আছে। জবরদস্ত মাথাও আছে। সব অলস লোকগুলোর মস্তিষ্ক জড় করে নাকি তার মগজ তৈরি হয়। কিন্তু হাঁটার জন্যে যেমন পা নেই তেমনি কাজ করার জন্যে হাতও নেই। সে কাজ করে ভূতেদের দিয়ে। এইসব সাধারণ ভূতেরাই হল তার হাত আর পা। এরাই শয়তানের সব হুকুম পালন করে। এই সব বাজে ভূতেরাই শয়তানের সব খারাপ কাজ সামাল দেয়।   

কিন্তু শয়তানের আবার স্থানে স্থানে বেশ কিছু অংশ আছে। ভূতেদের পরিচালনা করে শয়তানের এই অংশরা। ভূত মেরে যাদের তৈরি করে শয়তান। আবার এই অংশগুলোও মাঝে মাঝে অকেজো হয়ে যায়। শয়তানের শয়তানি কাজে ঠিক মত সাহায্য করতে পারে না। তখন তাদের নিকেশ করে দেয় শয়তান। নিকেশ মারে মেরে ফেলা নয়। ভূতেদের যে মরণ নেই তা তো আগেই বলেছি। তাদের খোঁড়া করে গাছের টঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। থাক এখন মাস কয়েক ঝুলে। তারপর ভূতের রাজার যদি দয়া হয় তো মন্ত্র বলে তাকে আবার সেই ভূত করে দেয়। যেমন ছিল আগে।

তখন আবার ভূত মারতে হয় তার সাকরেদ করার জন্যে। অবশ্য এ কাজে খুব বুড়ো ভূতগুলোকেই কাজে লাগায় শয়তান। কারণ বুড়ো ভূতগুলো খুব অভিজ্ঞ হয় কিনা। হাঁ করার আগেই হাড়গিলে বুঝে যায়। মুখ দিয়ে শর শর আওয়াজ করলেই শ্যাওড়া গাছের পেত্নির কাছে এত্তেলা পাঠায় শয়তানের হয়ে।  

ভূতেদের সমাজেও নানা সামাজিক অনুষ্ঠান হয়। ভূতেদেরও তো সমাজ আছে নাকি? কিন্তু সামাজিক অনুষ্ঠান মানে বিয়ে পৈতে এসব নয়। যেমন ধর মানুষের মাথা দিয়ে মাঠে গভীর রাতে ফুটবল খেলার অনুষ্ঠান। মানুষের হাত বা পায়ের লম্বা লম্বা হাড় দিয়ে হয় হকি খেলা। সেই রকম বাস্কেট বল, ভলিবল এইসব। এমন কী ছু কিতকিত, ভূত মানুষ (চোর পুলিশের মত) এইসব। সব খেলাই গভীর রাতে হয়। কারণ দিনের বেলা মানুষের চোখের সামনে মানুষের মাথা দিয়ে ফুটবল আর হাত পায়ের হাড় দিয়ে হকি খেললে তো তারা ভয়ে ভির্মি খাবে। কেউ গিয়ে খাটের নিচে আবার কেউ আলমারির পেছনে লুকোবে। আবার কেউ কেউ সোজা ওঝা ঢেকে ফেলবে। ভূতেদের খেলা গুবলেট হয়ে যাবে। মেজাজ গরম বা নরম হলে মানুষ নাহয় ট্যাবলেট খেয়ে সামাল দেবে। কিন্তু ভূতেদের কী হবে? ওরা ছুটবে সোজা শয়তানের কাছে। কাছে তো যেতে পারবে না। ওরা মুড়ো গাছে উল্টো হয়ে ঝুলে শয়তানের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। 

আড়াল থেকেই ওদের প্রার্থনা শুনবে ভূতেদের কর্তা শয়তান। এই মানুষগুলোর বড় বাড় হয়েছে। ভূতেদের বিনোদনে বাদ সাধে! ওদের শাস্তি দিতে হবে। ভূত তো শুধু ভয় দেখাতেই পারে। কিন্তু প্রতিকার তো কিছু করতে পারে না। তাই মহামান্য শয়তানের কাছে তাদের আবেদন।   

ভূতেদের বিয়েটিয়ে হয় না আগেই বলেছি। কারণ যেসব ম্যারেজ রেজিস্টার ভূত হয়ে আসে তারা ভূতরাজ্যে পা দিয়েই ঘপাঘপ ধরে মামদো, হামদো আর পেত্নি শাঁখচুন্নীদের। জামার কলার কিংবা ওড়না বা আঁচল টেনে ধরে এনে রেজিস্টারে নাম তুলে দেয় বর বৌ হিসেবে। এদের ছেলেমেয়ে হয় না। তার দরকারও নেই। বাচ্চা ভূত যদি সাচ্চা ভূত হয় তো তার নাম রেজিস্টারে তুলে দেয় ছেলে বা মেয়ে হিসেবে। ব্যাস ফ্যামিলি কমপ্লিট।  

বিয়ে নাহয় এইভাবে হল। কিন্তু শ্রাদ্ধ হয় না বলতে গেলে। ভূত তো মরেই না। দেবতাদের মত ভূতেরাও অমর। মরেই না যখন তা শ্রাদ্ধ হবে কেন? কিন্তু শয়তানের নির্দেশে যখন মরতে হয় তখন আলাদা কথা। মানুষ মরে গেলে তার ছেলেপিলেরা খুব দুঃখ পায় কাঁদে। তার না থাকার জন্যে হা হুতাশ করে। নানা ভাবে শোক প্রকাশ করে। মানুষটা চলে যাওয়াতে অন্য মানুষের অনেক অসুবিধেও হয়। গুণী মানুষেরা মারা গেলে সমাজের অনেক ক্ষতিও হয়। তাই মানুষ মরে গেলে সবাই কাঁদে। নানা ভাবে শোক প্রকাশ করে। 

কিন্তু ভূতেদের তেমন কিছু হয় না। সমস্ত ভূতেরা শ্রাদ্ধের সময় খুব আনন্দ করে। হৈ হুল্লোড় করে। কেননা যে ভূতের শ্রাদ্ধ হচ্ছে সে এবার ভূত রাজ্য থেকে চলে যাবে শয়তানের রাজ্যে। সে হয়ে যাবে শয়তানের অংশ। নবাবের রাজ্যে যেমন অনেক সুবা থাকে আর সেই সুবাতে যেমন এক একজন সুবাদার থাকে যারা সেই সুবা শাসন করবে। শয়তানের হুকুমে ভূত আর মানুশদের শাস্তি বিধান করবে সে। মানে তার কত ক্ষমতা হবে। অর্থাৎ তার প্রমোশন হবে। এক ধাক্কায় স্ট্যাটাস অনেকটা বেড়ে যাবে। তাই একেবারে হৈ হৈ কান্ড রৈ রৈ ব্যাপার।

সেবার এক ভূতের বাবা মরার এত্তেলা পেল। সারা পাড়ায় আনন্দের ফোয়ারা ছুটল। সে যখন শুয়ে শুয়ে খাবি খাচ্ছে তখন কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে ভূতের দল নেত্য করছে। বিরাট করে শ্রাদ্ধ করতে হবে এবার। না করলে আর মান-মর্যাদা থাকবে না। ঢাক ঢোল কাঁসি এল। এল মৃদঙ্গ। এল জগঝম্প। এখন তোমরা বলবে ভূতেরা এসব পেল কী করে? আসলে এসব হল শয়তানের কারসাজি। কোলকাতার বড়বাজারে জগার খুব বড় ব্যান্ড পার্টির দোকান। নিজে বাজায় না। কিন্তু সরঞ্জাম আর বাজনদার রেখে দিয়েছে।  

দিনে দিনে তার সেই ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে। ছিল একটা পড়ো বাড়িতে। সারিয়ে সুরিয়ে সেই বাড়ি এখন তেতালা। একতলায় ব্যান্ড পার্টির হেড অফিস। মোবাইলে সবাই ভাড়ার জন্যে এখানে যোগাযোগ করে। মোবাইলেই সে খবর জগা পৌঁছে দেয় বড়বাজারে। তাকে কোথাও যেতে হয় না। 

দোতলাটা একটা ব্যাঙ্ককে ভাড়া দিয়েছে। সারাদিন গমগম করছে লোক। আর তেতালাটা রয়েছে নিজের আর নিজের পরিবারের জন্যে। দিব্বি সুখে দিনে দিনে পরিপুষ্ট হচ্ছে জগা। তার এই সুখ তো শয়তানের সহ্য না হবার কথা। তাই বড়বাজার আর তার বাড়ি থেকে সব সরঞ্জাম ভূতেদের দিয়ে উড়িয়ে এনেছে শয়তান। এসব এখন ভূতের বাপের শ্রাদ্ধে কাজে লাগবে।  

একটা বিয়ে বাড়িতে বাজাতে গিয়েছিল জগার দল। কিন্তু বাজনার তাল, সুর, ছন্দ, গান কিছুই মালিকের পছন্দ হয় নি। সে বেশ বদমেজাজি লোক। তর্ক বিতর্ক থেকে হাতাহাতি। শেষে জগার দলকে বেধড়ক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। এমনই প্রাণের মায়া যে বাজনা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারল না। পড়ে রইল সেখানে। মালিকের রাগ তাতেও পড়ে নি। সে তো সেগুলো সব একটা মজা পুকুরের ধারে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। আসলে তার মাথায় শয়তান ভর করেছিল। শয়তানের মতলব তো বোঝাই যাচ্ছে। যেন তেন প্রকারে বাজনাগুলো হাতানো। সেই ভাঙ্গা বাজনাই চলে গিয়েছিল ভূতের বাপের শ্রাদ্ধে। শয়তান বা তার সুবাদারেরা নিজে থেকে কোনও কাজ করে না। তারা শুধু মানুষের মগজের ভেতরে লুকিয়ে পড়ে। তারপর মানুষেরাই সব কাজ বা অকাজ করে। 

ভগার আছে বিরাট আড়ত। আড়ত মানে যেখানে অনেক কিছু জিনিস জমা রাখা হয়। অথবা বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেক জিনিস জড় করা হয় শহরের বাজারে বিক্কিরির জন্যে। কত লাখ লাখ টাকার জিনিস। আজকাল তো লাখ টাকায় মরা হাতিও পাওয়া যায় না। তাই লাখ এখন কোটি ছুঁয়েছে। কোটি ছুঁয়েছে তাই ভগার আমানতও। তার নিজের তো বটেই তা ছাড়া অন্যের অনেক কিছুও সে ভাড়া দিত। অনেক কষ্টে দাঁড় করিয়েছিল ব্যবসাটাকে। শয়তানের চোখ পড়েছিল অনেকদিন থেকেই। স্থানীয় সুবাদার রিপোর্ট করেই গেছে শতানের কাছে। কিন্তু সে অপেক্ষা করছিল কখন সুযোগ আসে। আজ ভূতের বাপের শ্রাদ্ধে এসব লাগবে। তাই শয়তান সুবাদার মগজে ঢুকেছে এক স্থানীয় ব্যবসায়ীর। তৈরি করেছে ঈর্ষা, হিংসা আর গাত্রদাহ। তারপর সেই দাহ দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে আড়তে আগুন। তারপর ভূতেদের দিয়েই উঠিয়ে নিয়ে এসেছে সে এই পোড়া আধপোড়া মালগুলো।  

এমনি করে নানান জিনিস, থরে থরে আনাজপাতি, চাল, ডাল, ময়দা, মিষ্টি, নতুন পোশাক, এইসব হরেক জিনিস সে ভূতেদের দিয়ে উঠিয়ে এনেছে। কোনোটাই কিন্তু টাটকা বা তাজা নয়। বাসি, পচা, পোড়া, ভাঙ্গা এইসব। ভাল জিনিস ভূতেদের মোটেই পছন্দ হয় না। ওদের সহ্যও হয় না। তাহলে শয়তানেরই বা পছন্দ হবে কী করে? আজ ভূতের বাপের শ্রাদ্ধে এসব লাগবে। 

ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ বলে কথা! এ কি আর বছরে বছরে হয়? আলেকালে হয় শয়তানের মর্জিতে। যখন হয় তখন ঝড় ওঠে প্রবল। আকাশে বিদ্যুৎ ঝলক দেয়। যেন হাজারটা ফুলঝুরি কি রংমশাল জ্বলে উঠল। একসঙ্গে এক হাজারটা বাজ ডাকতে থাকে কড়কড় করে। সেই বাজের আগুনে কটা মানুষ মারা গিয়ে ভূতেদের সংখ্যা বাড়ায়। সাগরে নদীতে ওঠে প্রবল জলোচ্ছ্বাস। সন্ধের অন্ধকারে এঁদো পুকুরের পাড় দিয়ে দুড় দুড় করে দৌড়ে যায় দশটা আলেয়ার ভূত। ফট ফট করে জ্বলে ওঠে জঙ্গলে আলো। ওই যাকে দাবানল বলে সেই আর কী। তা দাবানল কি আর সবখানে হয়? কিন্তু মরা তালগাছ নারকোল গাছের মাথায় বাজ ফেলে ফুলঝুরি তুবড়ি তো জ্বালানো যায় নাকি? নিদেন পক্ষে শর্ট সার্কিট করে কারোর কাপড়ের গুদোমে আগুন লাগিয়ে তার সব্বনাশ তো করা যায়? শয়তান আর কাকে বলে! চট করে একবার কারোর মগজে সেঁধিয়ে যাওয়া আর কী। 

আবহবিদরাও বুঝতে পারে না ঠিক কী হচ্ছে। কিন্তু কিছু একটা ভয়ংকর জিনিস ঘটে যাচ্ছে। ভূত আর শয়তান ছাড়া আর কেউ জানে না এ দুনিয়ার। আর সেটা হল ঐ ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ। সেখানে ভূতেরা এক পেট খেয়ে ঢেকুর তোলে। শব্দ ওঠে মাঝরাত্তিরে। কত খাবার। পচা মাছের কাটলেট, তিনদিনের বাসি পাঁঠার বিরিয়ানি, চার সপ্তাহের পুরোন আমানি (পান্তাভাতের জল) দিয়ে তৈরি লস্যি। আরও কত কী।  

আবার টাটকা টাটকা কিছু খাবারও আছে। যেমন পুঁটির মায়ের রান্নাঘরে রান্না করা পুড়িয়ে দেওয়া পনীরের পায়েস। পুঁটির মা খুব ভাল রান্না করে। আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশি বন্ধুবান্ধব নাকি বলে সব ‘একেবারে জাস্ট অমৃত’। তাই সকলকে খাইয়ে তার ভারি তৃপ্তি। 

শয়তানের নাকি সেটা সহ্য হয় নি। তক্কে তক্কে ছিল কখন সুযোগ আসবে। কিন্তু সুযোগ তো সবসময় আসে না। কিন্তু এই ভূতের বাপের শ্রাদ্ধের সময়টা উপযুক্ত বলে মনে হল তার। একটা ভূত পাঠিয়ে পনীরটা পুড়িয়ে দিল। কিন্তু এমন কায়দায় মাইক্রোওভেনের তাপমাত্রা বাড়িয়েছিল যে ওপর থেকে কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু ভেতরটা পুড়ে খাক। 

সবাই খেয়ে থু থু করল। রেগে আগুন তেলে বেগুন। ছ্যা ছ্যা এমন খাবার কেউ প্রতিবেশিদের জাঁক করে দেয়? বড্ড গুমোর হয়েছে। ভাল রান্না করে বলে তাই না? তারপর দিন থেকে কেউ আর কিছুই খায় না পুঁটির মায়ের হাতে। শয়তান তো ভারি খুশি। ঠিক এমনটাই চেয়েছিল সে। ভারি জব্দ হয়েছে পুঁটির মা। ভাল রাঁধে বলে  বড্ড অহংকার হয়েছে মেয়েটার। 

সেই পনীরের পায়েস সব ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল পুঁটির মা। শয়তান অমনি আর একটা ভূত পাঠিয়ে সেটা তুলে নিয়ে এল ডাস্টবিন থেকে। এই রকম নানা জিনিস যা সব শয়তানের নজরে পড়েছিল সব তুলে এনে জড় করা হল সেই শ্রাদ্ধে। 

নিধু ঘোষের তিনটে ছাগল বিনা কারণে পট পট করে মরে গেল। পশুর ডাক্তার রোগই ধরতে পারল না। সারা সকাল দিব্বি কাঁঠাল পাতা চিবুচ্ছিল। তারপর সারা দুপুর আরাম করে ঘুমোল চোখ বুজে। সেই চোখ আর খুলতেই পারল না। সন্ধ্যের সময় মুখ দিয়ে ঝরতে লাগল গ্যাঁজলা। একটু পরেই সে গিয়ে হাজির হল ভূতের বাপের শ্রাদ্ধে। 

নিধু ঘোষের বউ বড় ভালবাসত ছাগলগুলোকে। সে তো সারা রাত কপাল চাপড়ে জুড়ে দিল মড়া কান্না। আর নিধু ঘোষ কাঁদল না। সারা রাত শুধু মাথায় থাপ্পড় মারতে লাগল আর রাগে গরগর করে বলতে লাগল, কোন শয়তান এমন কাজ করলি রে। হায় হায়। এ যে হাজার হাজার টাকা লোকসান। 

এমনি করে কারোর চাষের আনাজ, শাক-সব্জি, গরুর দুধ কত কিছু। আসলে এই সব শয়তানের কীর্তি। ভূতের বাপের শ্রাদ্ধে এসব জিনিস চালান হয়ে গেল। নাহলে আর ভুতেরা এসব পাবে কী করে? তারা কি আর চাষ করে ফসল ফলাতে পারে? 

ভূতেরা খুব খুশি কিন্তু মানুষরা সব বেজার। তারা নানা জিনিস খুইয়েছে। ঝড়-ঝাপটা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, বন্যা, এই সব নিয়ে মানুষ তো একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। আবহবিদদের ভুরুতে ভাঁজ। এ সব কী হচ্ছে! কেউ বলল, ভগবান রুষ্ট হয়েছে। আবার কেউ বলল, শয়তান খুশি হয়েছে। কিন্তু এই দুই দলের কেউই এ পর্যন্ত এই দুজনকে দেখেনি। শুধু ফলাফল টের পেয়েছে। 

কিন্তু যা হচ্ছে তা আবার কিছু লোকের মতে ভালই হচ্ছে। এরা ঠিক ধরেছে ব্যাপারটা। তন্ত্র-মন্ত্র-তাক-তুক করা শিবু জ্যাঠার ডায়াগনোসিস কখনও ভুল হয় না। শিবু জ্যাঠাই তো ধরল আসল ব্যাপারটা। 

--এ তো একেবারে দিনের আলোর মত পরিষ্কার ব্যাপার। গলার রুদ্দ্রাক্ষের মালা দুলিয়ে দুলিয়ে শিবু জ্যাঠা বলেছে, এ হল শয়তানের কোপ। হোম আর যজ্ঞ করা ছাড়া রেহাই নেই মানুষের। 

বকুলের মা মুখ চুন করে বলল, তাহলে—

--শয়তানকে ঠান্ডা কর মা। সে গরম হলে যে তোমরা মারা পড়বে। পুড়ে মারা যাবে। তার চেয়ে সময় থাকতে পুড়িয়ে দাও তার লকলকে জিভটা। একটা তো ছোটখাট যজ্ঞ। যজ্ঞের আগুনে শতানের চোখ পুড়বে না কিন্তু তার দিষ্টি পুড়বে। জিভ পুড়বে না কিন্তু তার নোলা পুড়বে। 

-কী লাগবে পন্ডিত মশাই? মানে যজ্ঞের উপকরণ আর কী। 

-বিশেষ কিছু নয়। এই তো মাত্র কটা জিনিস।  শিবু জ্যাঠা নিতান্ত অবহেলায় নাক কুঁচকে বললেন। 

--হ্যাঁ ঠাকুর মশাই, আপনি একটা ফর্দ যদি করে দেন। বকুলের মায়ের কাতর প্রার্থনা।  

ছোট্ট একটা ফর্দ করেছে জ্যাঠা। বকুলের বাবার ড্রয়িং রুম ছাড়িয়ে সেটা নেমে গেছে উঠোনে। বাগান পার করে লোহার গেটে গেছে লটকে। শেষ আইটেমটা চোখে পড়ছে সকলের। সেটা হল “দক্ষিণান্ত”। 

 মাত্র একশ আটটা জিনিসের নাম লেখা। প্রত্যেকটার মধ্যে আবার পাঁচটা ছটা করে ভাগ। সব শুদ্ধ গিয়ে দাঁড়িয়েছে বোধহয় হাজার আটে। পরিমাণ? সেটা আমি নিজে মুখে আর নাই বা বললাম? বকুলের বাবার মুখেই শুনে নাও না।   

---ভূতের বাপের ছেরাদ্দ হচ্ছে যেন! এ তো কিনতেই আমার তিন মাসের মাইনে গলে যাবে বকুলের মা? বকুলের বাবা তড়পাচ্ছে আর মাথা চাপড়াচ্ছে। গলা দিয়ে কান্নার সুর কি ভূতের খনা গলার আওয়াজ সে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই কারোর। 

বকুলের মা ছলছল চোখে বলছে, কিন্তু করতে তো হবে বল? শয়তানকে ঠান্ডা করা চাট্টিখানি কথা? খরচের কথা ভাবলে হবে? ভূতের বাপের ছেরাদ্দ ফেরাদ্দ ওসব বলতে নেই। তেনারা রাগ করবেন। অপদেবতারা রুষ্ট হলে—ওরে বাবা। আমি আর ভাবতে পারছি না গো।  

তবে এই একটা ভূতের বাপের শ্রাদ্ধই কিন্তু নয়। যখনই শয়তানের সাগরেদ কমে যায় বা অকর্মণ্য হয়ে পড়ে তখনই ভূতেদের সমাজ থেকে একটা করে বুড়ো ভূতকে যেতে হবে তার কাছে। না মরলে আর তার কাছে যাবে কী করে? 

আর মরলেই তো শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধটা যে ভূতের বাপের সে খেয়াল আছে তো? 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment