![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
উত্তর দিনাজপুর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একটি জেলা, যার আয়তন
৩১৪০ বর্গ কিলোমিটার। উত্তরে দার্জিলিং, দক্ষিণে মালদহ ও দক্ষিণ দিনাজপুর, পূর্বে
দক্ষিণ দিনাজপুর ও বাংলাদেশ এবং পশ্চিমে মালদহ ও বিহার রাজ্য। দুটি মহকুমা ও নয়টি
থানা নিয়ে গঠিত। বর্তমানে তার জনসংখ্যা ৩০ লাখ ৭ হাজার ১৩৪ জন। এই জেলার উপর
দিয়ে এক সময় ত্রিশ একত্রিশটি নদী প্রবলগতিতে প্রবাহিত হত। এই জেলার ধর্মপ্রাণ
মানুষজনের উদ্যোগে বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
সৃষ্টি লগ্নে, মানুষকে প্রকৃতি থেকে খাদ্য
সংগ্রহ এবং হিংস্র জীব-জন্তু থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হত। এই
লড়াই থেকে খেলার জন্ম হয়। পরবর্তী কালে এই খেলা চিত্ত বিনোদন, অবসর সময়-যাপন,
মঙ্গল কামনা, শারীরিক চর্চার জন্য আয়োজন করা হয়। প্রাচীন কাল থেকে এই জেলায় নারকেল
খেলা, নৌকা বাইচ, কাদো খেলা, লাঠি খেলা, সিঁদুর খেলা, কুতকুত খেলা, দাঁড়িয়াবান্দা
খেলা, বুড়ি বুড়ি খেলা, গোল্লাছুট, কানা মাছি, হাঁড়িভাঙ্গা, ছাগুলি-পাগুলি,
লুকোচুরি প্রভৃতি খেলা প্রচলিত আছে। আড়াই তিন হাজার বছর পূর্বে রোম, গ্রীস
প্রভৃতি অগ্রগণ্য সভ্য দেশগুলিতে খেলাধুলাকে ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
নারকেল খেলা : প্রতি বছর
জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া থানার হুলাসুগছ, চাকুলিয়া থানার
শকুন্তলা, করণদীঘি থানার দরিমানপুর, মির্জাপুর, মিনাপুর এবং রায়গঞ্জ থানার
পিরোজপুরে হনুমানের পুজা হয়ে থাকে। গ্রামের মেয়েরা তিন দিন ধরে জন্মাষ্টমীর ব্রত
পালন করে। তখন বাড়িতে বাড়িতে নিরামিষ আহারের আয়োজন করা হয়। সকাল থেকে পাড়ার
মেয়েরা স্নান করে শুদ্ধ কাপড় পরে জোড়া নারকেল, কলা, আপেল, বাতাবী লেবু, শসা, আতপ
চাল, বাতাসা, ধূপকাঠি নিয়ে পূজামণ্ডপে উপস্থিত হয়। এলাকার মাহাত ঐ পূজোয় পুরোহিত
হিসেবে থাকেন। তারপর মাহাত কাদামাখা স্থানে গিয়ে পূজো করেন এবং একজন একটি নারকেল
কাদার মধ্যে পুঁতে তার উপরে শুয়ে পড়ে। ‘এসো বাচ্ছারে-পবনের
নন্দন/ বীর হনুমান’। এই
মন্ত্র তিনি উচ্চারণ করতে থাকেন। ছেলের দল তার কাছে সেই নারকেল ছিনিয়ে নেবার জন্য
লড়াই শুরু করে এবং যে নারকেলটিকে কাদার বাইরে নিয়ে যায়, সে ঐ নারকেল লাভ করে।
এভাবে কয়েকটি নারকেলকে নিয়ে লড়াই চলে। এই খেলা কোথাও নারকেল খেলা, কোথাও বা কাদাখেলা
নামে অভিহিত হয়।১
নারকেল খেলা ছবি : লেখকের তোলা |
ঐ খেলা দেখার জন্য চারপাশে বহু মানুষ ভিড়
জমায় এবং দারুণ আনন্দ উপভোগ করে। ঐ স্থানের কাদা এনে কপালে লাগায় এবং অনেকে বাড়ি
নিয়ে যায়। বাড়ির বাইরে দূরে কোথাও গেলে অনেকে এই মাটি কপালে ঠেকিয়ে নেয়। পূজো
শেষে গোটা গোটা নারকেল পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়। বহু
জায়গায় ঐ দিন তৈলাক্ত বাঁশের ডগায় একটি নারকেল ও বেশ কিছু টাকা পয়সা বেঁধে পুঁতে
দেওয়া হয়। যে ঐ তৈলাক্ত বাঁশে উঠে নারকেল ও টাকা পয়সা সংগ্রহ করে নামাতে পারে তা
তার হয়ে যায়।
নৌকা বাইচ : কোন জাতীয়
উৎসব, লোকমেলা, মনসার ভাসানে নদীতে নৌকার দাঁড় টানার বা নৌকা চালনার কৌশল দ্বারা
জয়লাভের লক্ষ্যে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৮ সালে গুলন্দরের অনিল
চন্দ্র ঝাঁ, বারডাঙ্গীর সেখ নমো এবং মালদহ জেলার রামদেবপুরের বাঘু সেখের উদ্যোগে ঐ
এলাকার নাবিকদের উৎসাহ দান এবং বারডাঙ্গী হাট জমজমাট করার লক্ষ্যে উত্তর দিনাজপুর
জেলার ইটাহার থানার বারডাঙ্গী গ্রামে মহানন্দায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
![]() |
নৌকা বাইচ ছবি : লেখকের তোলা |
এই জেলার শ্যামপুর, বাহিন, চূড়ামণ,
মুকুন্দপুর, সুবর্ণপুর, কাশিবাটি এবং মালদহ জেলার রামদেবপুর, তারাপুর, লালগঞ্জ
প্রভৃতি এলাকার নাবিকরা এই প্রতিযোগিতায় তাদের নৌকা নিয়ে যোগ দেয়। চার পাঁচ রাউণ্ড
খেলা চলে। তাদের মধ্যে তিনটি দলকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্বাচিত করে পুরষ্কৃত
করা হয়। মূল মঞ্চে এসে অতিথিরা এদের হাতে ট্রফি তুলে দেন। তার সঙ্গে পুরষ্কার হিসেবে তাদেরকে দেওয়াল ঘড়ি,
গ্যাস সিলিণ্ডারও দেওয়া হয়। বাহিন, চূড়ামণ ও মালদহ জেলার কালীগঞ্জ গ্রামের দল
বহুবার পুরষ্কৃত হয়।
নদীর দুই তীরে পাশ্ববর্তী এলাকার পাঁচ ছয় হাজার
মানুষ এই প্রতিযোগিতা দেখার জন্য উপস্থিত হয়। সেদিন এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে
সেখানে একটি মেলার আয়োজন করা হয়। রাতে লোকনাট্যের আসর বসে। ঐ আসরে মুর্শিদাবাদ,
বীরভূম ও উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার শিল্পীদের আলকাপ গান পরিবেশিত হয়। মেলা ও গানের
আসর পরের দিনও থাকে। অতীতে বহু মানুষ গোরুর ও মোষের গাড়ি করে এই মেলা দেখতে আসতো।
এই খেলা ও মেলা পরিচালনায় সাদেক মোডল, মহিম সেখ, রহিম সেখ, জহিরুদ্দিন প্রমুখ
ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। এলাকার মানুষজন বছরভর এই অনুষ্ঠানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা
করে থাকে।২
লাঠি খেলা : লাঠি খেলা লাঠি দিয়ে আত্মরক্ষা শেখায়। যে লাঠি
খেলায় এবং লাঠি দ্বারা মারামারি করতে পটু, সে লেঠেল বা লাঠিয়াল বলে পরিচিত।
ব্রিটিশ আমলে জমিদাররা তাদের নিরাপত্তার জন্য লাঠিয়াল রাখতো। এরা জমিদারের পালকি
বাহকদের পিছনে থাকতো। কখনো বিপক্ষে শত্রুদের পরাজিত করে বা কখনো দস্যুদের আক্রমন
করে তারা জমিদারকে রক্ষা করতো, কখনো পূজাপার্বণে লাঠি খেলা দেখিয়ে মনোরঞ্জন দান
করতো। আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উৎকর্ষের লক্ষ্যে ১৯৩২ সালে গুরুসদয় দত্তের উদ্যোগে
ব্রতচারী আন্দোলনের সূচনা ঘটে। তাঁর উদ্যোগে সেখানে লাঠি খেলা অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
![]() |
লাঠি খেলা ছবি : ইন্টারনেট |
পূজো ও মহরমে এই খেলা সাহস ও বিক্রম
প্রদর্শনের জন্য হয়ে থাকে। এই খেলায় চার বা পাঁচ ফুট দৈঘ্যের তৈলাক্ত লাঠি
ব্যবহৃত হত। এক সময় এই জেলায়
পূজাপার্বণে লাঠি খেলা হত। বহু দিন থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে মহরমে লাঠি খেলা
হচ্ছে। ইসলামপুর এলাকায় জন্মাষ্টমীর দিনে গ্রামের বেশ কিছু ভক্ত একটি লাঠির উপরে
ঝাণ্ডা আকারে কাপড় বেঁধে বাড়িতে বাড়িতে ঘোরে। তখন সেখানে ঐ লাঠি দুলিয়ে দুলিয়ে ̔গটে দুরাডা আন্ধেক গে নদারী চড়ুই
ঠেঙ্গাড়া যাবে বাড়ি’- এই গান গেয়ে নিত্য করতে থাকে। এটি ধেউসী খেলা বলে পরিচিত।৩
সিঁদুর খেলা : সিঁদুর খেলা বাঙালী বিবাহিত মেয়েদের একটি অন্যতম সংস্কার। পূজার প্রতিমাকে সিঁদুর দিয়ে বরণ করার পর তাদের মধ্যে এই খেলা শুরু হয়। মেয়েদের ধারণা যে, দুর্গা মায়ের মাথার সিঁদুর মাথায় ঠেকালে সধবা মেয়েদের সিঁথির সিঁদুর দীর্ঘস্থায়ী হয়। তার ফলে স্বামীরা দীর্ঘজীবী এবং নিজেরা আয়ুষ্মতী হয়।৪
সিঁদুর খেলা ছবি : লেখকের তোলা |
এই জেলার সধবা মেয়েরা দেবীর পায়ে ধান দুর্বা দিয়ে প্রণাম করে মায়ের সিঁথিতে ও কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সঙ্গে মিষ্টিমুখও করায়। দেবী দুর্গার সিঁথির সিঁদুর নিয়ে প্রথমে তারা নিজেরা পরে এবং পরে অন্যদের সিঁথিতে পরিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেরা পরস্পরের সিঁদুরের প্রলেপে রঞ্জিত হয়ে ওঠে। রায়গঞ্জ থানার সুবর্ণপুর গ্রামে প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিনে মেয়েরা সিঁদুর পরে দুর্গামণ্ডপে সামনে কাদা করে তার মধ্যে নাচানাচি করে থাকে।
হাডুডু খেলা : হাডুডু
বাংলার একটি জনপ্রিয় খেলা। শক্তি ও সাহসের খেলা বলে বহু তরুণ যুবক অংশ গ্রহণ করে।
দুটি দলে সাত থেকে দশ জন করে খেলোয়াড় থাকে। মাঠের মধ্যে সীমারেখা থেকে কোন বোল বা
ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে বিপক্ষ দলের কাউকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে। তখন যাকে
স্পর্শ করে, সে মারা গিয়ে বাদ পড়ে। স্পর্শকারীকে ধরার জন্য ঐ দলের খেলোয়াড়রা
একযোগে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে এই খেলা চলতে থাকে। তখন কোন এক পক্ষের
সকল খেলোয়াড় মারা পড়লে তাদেরকে এক পয়েণ্ট হার বলে ঘোষণা করা হয়। প্রতিযোগিতায়
বিজয়ী দলকে পুরস্কৃত করা হয়।
![]() |
হাডুডু খেলা ছবি : ইন্টারনেট |
এই জেলায় এক সময় হাডুডু খেলা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। কালিয়াগঞ্জ ব্লকে বোচাডাঙ্গা অঞ্চলের হরেশ সরকার, খঙ্গনাথ সরকার, হরেন্দ্রনাথ সরকার, জ্যোতিষ সরকার, তরুবুরু মহম্মদ্, সেরু সরকার, ধানেশ্বর সরকার, বিদ্যনাথ সরকার প্রমুখ ভালো খেলোয়াড় হিসেবে সুনাম অর্জন করে এবং তারা কালিয়াগঞ্জ ব্লকের বহু জায়গায় খেলতে যেত। তারা কেউ কেউ মুখে ̔ডোগরে কে ডোগ’- এই বোল উচ্চারণ করে খেলতো।৫
দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা : গ্রামীণ বাংলার খেলাধুলার মধ্যে
দাঁড়িবান্ধা একটি প্রচলিত খেলা। আদিম কালে মানুষ খাদ্য সংগ্রহ করত এবং ঐ খাদ্য
সংরক্ষণের জন্য লবণের প্রয়োজন হয়। তখন তারা দূর-দূরান্ত থেকে খনিজ লবণ সংগ্রহ করত।
সেই লবণের অধিকার এবং তার সংগ্রহকে কেন্দ্র করে নুনতা উৎপত্তি হয়। নুন্তা বা গাদির
মতো দাঁড়িয়াবান্ধাও লবণের সঙ্গে জড়িত বলে এই খেলা কোথাও নূনদাড়ি, কোথাও নুনচোর
নামে অভিহিত হয়। জলপথে চোরাই লবণ আমদানকারী দাঁড়িয়াগণকে বন্ধন করা হত বা বাধাদান
করা হত।৬
![]() |
দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা ছবি : ইন্টারনেট |
স্থানীয় নিয়ম অনুযায়ী এই খেলা হয়ে থাকে। সব
এলাকার শিশুরা এই খেলা পছন্দ করে। এই খেলার
মাঠের দৈর্ঘ্য বরাবর ৫০ ফুট এবং তার প্রস্থ বরাবর ২০ ফুটের প্রস্থের লাইন টানা হয়। আর তার মাঝখানে ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি এবং আড়াআড়ি সম
দূরত্বে আরও চারটি লাইন টানা হয়। প্রত্যেক দলে পাঁচজন করে খেলোয়াড় থাকে। এক দলের
সকল খেলোয়াড় ঘরের(গাদি ঘর) ভিতরে লাইনে দাঁড়িয়ে অন্য দলের খেলোয়াড়দের আটক রাখার
চেষ্টা করে থাকে। মাঠের উপর বা ঘরের ভিতর অন্যদলের খেলোয়াড়কে ছুঁতে পারলে সে
খেলায় মারা যায় বা বাদ পড়ে। তখন অন্যদল এসে খেলে।
বর্তমানে উত্তর দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন গ্রামের ছেলেমেয়েরা কখনো বিদ্যালয়ের
মাঠে, কখনো পাড়ার মাঠে এই খেলায় অংশ গ্রহণ করে থাকে। চাকুলিয়া থানার গোবিন্দপুরে
এটি শোল খেলা, রায়গঞ্জ থানার কর্ণজোড়া এলাকায় গাদাল খেলা, হেমতাবাদ থানার
বিষ্ণুপুর অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের কাছে এটি জয় জয় খেলা নামে পরিচিত। এই খেলায় তুমুল
লড়াই করে জয় আসে এবং সেই জয়ের আনন্দ থেকে জয় জয় নামের উৎপত্তি হয়।
গোল্লাছুট : গোল্লাছুট এই জেলার কিশোর কিশোরীদের
অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। তারা গোল্লা বা গোলাকার স্থান থেকে ছোটে বলে এই খেলা গোল্লাছুট
নামে অভিহিত হয়। ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, পাবনায় এই খেলার প্রচলন
সব চেয়ে বেশি। এই খেলায় দুটি দল থাকে এবং দলের পাঁচ অথবা সাতজন খেলোয়াড় থাকে।
মাঠে একটি গোলাকার(গোল্লা) স্থানে একটি লাঠি পোতা হয়। সেই লাঠিকে ঘিরে একটি বৃত্ত
এঁকে তার পঁচিশ ফুট দূরে আর একটি লাইন টেনে সীমানা স্থির করা হয়।
![]() |
গোল্লাছুট ছবি : ইন্টারনেট |
সেই সীমানার এক স্থানে আর একটি লাঠি পুঁতে
দেওয়া হয়। দলপতি একহাতে মাটিতে পোঁতা লাঠি এবং অপর হাতে একজন খেলোয়াড়ের হাত ধরে। খেলোয়াড়রা এভাবে পরস্পরের হাত ধরে কেন্দ্র স্পর্শ করে
সীমানার মধ্যে ঘুরতে থাকে। তারা বৃত্তের বাইরে ঐ
কাঠিকে স্পর্শ করার চেষ্টা করতে থাকে। ঐ কাঠি স্পর্শ করার পূর্বে বিপক্ষ দলের কোন
খেলোয়াড় তাকে স্পর্শ করলে ঐ পর্বে সে খেলা থেকে বাদ পড়ে। ঐ দলের কেউ কাঠি স্পর্শ
করতে না পারলে বিপক্ষ দলের খেলার সুযোগ মেলে। কোন খেলোয়াড় বাদ পড়লে বিপক্ষদল
আনন্দে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে।৭
কুতকুত খেলা : কুতকুত এই জেলার গ্রামীণ কিশোর-তরুণীদের অন্যতম খেলা। কোথাও কোথাও এই খেলা কিৎ কিৎ খেলা বলে পরিচিত। মাটির উপরে দুই পাশে সমান মাপের পাঁচ পাঁচ করে দশটি ঘর আঁকা হয়। শেষ মাথায় ধা নামে ঘর বানানো হয়।
![]() |
কুতকুত খেলা ছবি : ইন্টারনেট |
সেখানে দুজন মেয়ে একটি পোড়া মাটির ছোটো আকারের গুটি নিয়ে এই খেলা শুরু করে। তাদের
মধ্যে একজন কুতকুত বলতে বলতে একটি পা মাটি থেকে সামান্য তুলে অন্য পা দিয়ে গুটিয়ে
ঠেলতে ঠেলতে ঐ ধা ঘরে নিয়ে গিয়ে পা নামিয়ে ধা বলে দম ফেলে এবং তারপর অনুরূপভাবে
গুটি নিয়ে বেরিয়ে আসে।৮ তখন তার বিনিময়ে সে একটি ঘর কিনে নেয়। আর তার
গুটি যদি ঘরের কোন দাগ স্পর্শ করে, তখন তার খেলা বন্ধ হয়। তারপর অন্যজন খেলা শুরু
করে। এদের দুজনের মধ্যে যে খেলোয়াড় সবচেয়ে বেশীঘর কেনে, সে ঐ খেলায় জয়ী বলে ঘোষিত
হয়। কুতকুত খেলার ঘর বেচাকেনার বিষয়টি ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি গ্রামীণ নারীদের
সচেতনতাকে তুলে ধরে।
বউ পালোটি খেলা : বউ পালোটি
এই খেলার মেয়েদের একটি জনপ্রিয় লোকিক খেলা। পালোটি শব্দের আঞ্চলিক অর্থ পালানো।
কোথাও এই খেলা বৌচি, কোথাও বুড়ি কপাটি, কোথাও বুড়ির চু, কোথাও বুড়ি বুড়ি খেলা
নামে পরিচিত। মাটিতে একটি বৃত্ত কাটা হয়। তার বিশ পঁচিশ হাত দূরত্বে একটি গোলাকার
ঘর কাটা হয় এবং ঐ ঘরে একটি খুঁটি পোঁতা হয়। এই খেলায় দুটি দল থাকে। দলে আট থেকে
দশজন খেলোয়াড় থাকে। একজন খেলোয়াড়, যে বউ বা বুড়ি নামে পরিচিত, সে ঐ খুঁটি চেপে ধরে থাকে। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা
ঐ ঘর থেকে বউ পালিয়ে যেতে না পারে, তার জন্য তাকে কড়া পাহারা দেয়।
বৃত্ত থেকে একজন করে সদস্য এসে টি টি শব্দ করে
বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। তার ছোঁয়া যদি কারো শরীরে লাগে, তখন সে
খেলায় মারা যায়। টি টি শব্দ বন্ধ হলে বিপক্ষ দলের কেউ তাকে ছুঁয়ে দিলে সেও মারা
পড়ে। তখন বউ সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ঐ বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করতে পারলে ঐ দল জয়লাভ
করে। আর বউকে ছুঁয়ে দিলে খেলায় বিপক্ষ দল জয়ী হয়। প্রতিপক্ষের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে
বুড়িকে ঘরে আনার মধ্যে প্রাচীন কালের বিয়ের কনেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে ঘরে
আনার প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে।৯
লুকোচুরি : লুকোচুরি
এই জেলার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের একটি জনপ্রিয় খেলা। দুই থেকে চার পাঁচ জন মিলে
বাড়িতে বা পাড়ার কোন স্থানে এই খেলা হয়। প্রথমে সকলে এক জায়গায় মিলিত হয়ে তাদের মধ্য থেকে একজন চোখ বন্ধ করে
বা অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন বাকিরা লুকিয়ে পড়ে এবং কুক্ করে শব্দ করে।
সেই শব্দকে অনুসরণ করে তাদের খুজতে থাকে। খুজে পাবার পরে সে প্রথমে যাকে ছোবে, সে
পুনরায় চোখ বন্ধ করে খেলা শুরু করে। শিশুরা শৈশব কাল থেকে এই খেলার মাধ্যমে বহিরাগত
আক্রমণ ও বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল আয়ত্ত করে।১০
কানা মাছি : বাঙ্গালার
অন্যান্য জেলার মতো এ জেলাতেও দীর্ঘ দিন থেকে কানা মাছি খেলা প্রচলিত আছে। পাড়ার
খোলা জায়গায় বা বাড়ির উঠানে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা বিশেষ করে মেয়েরা এই খেলা করে।
তারা প্রথমে একজনের ছোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়। তখন সে কানা সেজে অন্যদের ধরতে
চেষ্টা করে। অন্যরা তার চার-পাশে মাছির মতো ঘুরতে ঘুরতে কানা মাছি ভোঁ ভোঁ/ যাকে
পাবি তোকে ছৌ- এই বোল উচ্চারণ করতে থাকে। তার হাতে যদি কেউ ধরা পড়ে, তখন তাকে
কানা সেজে খেলতে হয়। এই ছড়া খেলোয়াড়দের দেহ ও মনকে চাঙ্গা করে তোলে।
এই সময় এই জেলার শিশুরা সকাল থেকে বিকাল ঘরে
বাইরে মার্বেল, গুটি, ডাং হুটি, লাটু, ঘুড়ি লাটাই, ডাল চুরি, জুয়া পাট, চিলা চিলা
সহ আর এনেক খেলা করত। তখন এই জেলা প্রচুর গাছপালায় ভর্তি ছিল। ডাল চুরি খেলায়
গ্রামের ছেলেমেয়েরা গাছের ডালে উঠে খেলতো। তাদের মধ্যে এক জন চোর সেজে তাদের স্পর্শ করার
চেষ্টা করতো। এই খেলা হেমতাবাদ থানার বিষ্ণুপুর গ্রামে খুব প্রচলিত ছিল।১১
এই খেলায় দুই লক্ষ বছরের বেশী বৃক্ষবাসী মানুষের হিংস্র পশু আক্রমন থেকে বেঁচে
থাকার লড়াই ফুটেউঠে।১২
লৌকিক খেলাধুলার মাধ্যমে সঙ্ঘশক্তি, ঐক্য,
শৃঙ্খলাবোধ, উদারতা, সহানুভূতি, সততা, একাগ্রতা গড়ে উঠে এবং চরিত্রও সুদৃঢ হয়।
গ্রামের মাঠে ঘাটে, পথে প্রান্তরে খেলার ধুম আর চোখ পড়ে না। আধুনিকতার স্রোত,
মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ভিডিও গেম, স্যাটেলাইট ক্যালচারের বিকাশ যান্ত্রিক সভ্যতা,
দরিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই প্রভৃতি কারণে খেলাধুলার গণ্ডি সঙ্কুচিত হয়।
তথ্য সূত্র:-
১) পিরোজপুরে হনুমান পূজো ও কাদো খেলা, ড.
বৃন্দাবন ঘোষ, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, ২৬শ আগষ্ট, ২০১৬।
২. ড. বৃন্দাবন ঘোষ, বারোডাঙ্গীর
নৌকা বাইচ. আজকাল, শিলিগুড়ি, ৯ই নভেম্বর, ২০১৮।
৩) পাশারুল আলম, ইসলামপুর
না ঈশ্বরপুর, ২০১৯, সহজপাঠ পাবলিকেশন, ইসলামপুর, পৃ-৬৮।
৪) শিবশঙ্কর ঘোষ, বঙ্গের
শারদোৎসব ও ব্যতিক্রমী দুর্গাপূজা, ১০০৯, প্রভা প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ-৮২-৮৩।
৫) সাক্ষাৎকার –হৃদয় সরকার,
৬১ বছর, শিক্ষকতা, ধামজা, কালিয়াগঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর, ৮ই মে ২০১৮।
৬) অসীম সাহা, বাংলার
লৌকিক ক্রীড়ার সামাজিক উৎস, ১৯৯১, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃ-১২০-১২৪।
৭) ঐ, পৃ-৮০-৮২।
৮) সাক্ষাৎকার- সুচরিতা
সরকার, ৩৩ বছর, শিক্ষকতা, হেমতাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, ২৮শে মে,২০১৮।
৯) শমিত কুমার সাহা, উত্তর
বঙ্গের লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি, ২০০৬, অরুণ রায়, শিলিগুড়ি, পৃ-৪০-৪১।
১০) ড. শঙ্কর বিশাই,
বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম উপকলবর্তী লোকজীবন ও সংস্কৃতি, ২০০৪, পুস্তক বিপণি, কলকাতা,
পৃ-১৯০-১৯১।
১১) সাক্ষাৎকার – লক্ষ্মী
রায়, ৩৮ বছর, শিক্ষকতা, বিষ্ণুপুর, হেমতাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, ৭ই মে ২০১৮।
১২) অলীম সাহা, বাংলার
লৌকিক ক্রীড়ার সামাজিক উৎস, ১৯৯১, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃ-১৪।
বউ পালোটি নামে যে খেলার কথা বলেছেন , মেদিনীপুর জেলায় আমরা ওকে " বৌ বসন্ত" খেলা বলতাম । ছেলে মেয়ে সকলেই খেলেছি।
ReplyDelete