1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

প্রিয় পহেলগাঁ ও প্রেয়সী পাটনিটপ


ছবি : লেখকের তোলা 
মৌসুমী ঘোষ 

    ছোটোবেলা থেকে বাবার মুখে গল্প শুনে কাশ্মীর দেখা শুরু । শৈশব থেকে লালিত স্বপ্ন পূরণে বার বার বাঁধা হচ্ছিল সময় , রাজনৈতিক অস্থিরতা, তার সাথে নিরাপত্তার অভাব বোধ ।অবশেষে সব বাঁধা অতিক্রম করে , 2014 এর মার্চে বেরিয়ে পড়লাম ভূ-স্বর্গ দেখার উদ্দেশ্যে । প্রথমে জম্মু ,সেখান থেকে পাটনীটপ হয়ে পহেল গাঁ এবং ওখান থেকে শ্রীনগর, এই রকম ছিল আমাদের ট্যুর প্ল্যান । আজ মূলত পাটনীটপ আর পহেলগাঁ এর কথাই বলবো। প্রথমদিন বৈষ্ণূমাতার দর্শন সেরে, কাটরা থেকে গাড়ী নিলাম আগামী সাত দিনের জন্যে । দুপুর বারোটা নাগাদ রওনা দিলাম পাটনীটপের উদ্দেশ্যে । জম্মু থেকে এর দূরত্ব একশো বারো কিলোমিটার । ঘন্টা পাঁচেকের এই দূরত্ব পেরিয়ে বিকেল সারে পাঁচটা নাগাদ পৌছালাম এখানে । এখানকার উচ্চতা 6640 ফুট । এখানে জম্মু কাশ্মীরের ট্যুরিজমের বাংলো তে ছিলাম।পাইন আর ঝাউবনের, ঢেউ খেলানো সবুজের কার্পেট পাতানো উপত্যকা এই পাটনী টপ ।

শ্রীনগর ও পহেলগাঁ থেকে সৌন্দর্যর আতিশায্য এর কিছু কম নয় । হাল্কা ঠান্ডার আমেজ, ঝিরি ঝিরি হাওয়া ,খুব কম জনবসতি ঘেরা নিরিবিলি , মন উদাস করা জায়গা এই পাটনীটপ। যতদূর চোখ যায় পাহাড়ের গায়ে বরফ পড়ে আছে । মাঝে মাঝে সবুজের ছোঁয়া ।ঠিক ক্যালেন্ডারে দেখা ছবির মত । এক কথায় অনবদ্য । কাশ্মীর ভ্রমণের প্রথম এই ভিউ পয়েন্ট দেখে আমি তো আনন্দে মশগুল হয়ে গেলাম । বলে রাখি, ওখানে 'পাকিস্তানি সন্দেশ' নামে একটা মিষ্টি খেয়েছিলাম কড়া পাকের, মন্দ লাগেনি । দু একটা নতুন নতুন মিষ্টি ও টেস্ট করেছিলাম । পাহাড়ী এলাকা, তাড়া তাড়ি সন্ধ্যা নেমে এলো । অল্প অল্প বৃষ্টি ও শুরু হলো । সুতরাং হোটেল বন্দী হলাম সবাই । পরের দিন সকালে পাটনীটপের সাইডসিন, নান্থা টপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাতেই টের পেয়ে- ছিলাম বরফ পড়ছে অল্প অল্প কিন্তু নান্থায় পৌঁছে দেখলাম যেন বরফের উপত্যকা । প্রচন্ড হাওয়া আর অল্প রোদের আলোয় মনে হচ্চে উপত্যকা যেন রুপোর চাদরে মোড়া । ওখানে আমরা স্লেজ গাড়ি চড়লাম , মানুষে টানা । ঘন্টাদুয়েক এখানে বরফের নিয়ে মজা করে পহেলগাঁ এর দিকে চললাম । পাটনীটপ থেকে পহেলগাঁ র দূরত্ব 187 কিলোমিটার। চেনাব বা চন্দ্রভাগা নদী কে সাথে করে এগিয়ে চললাম চিরবসন্তের গাঁ দেখতে । পথে পেলাম জওহর টানেল এবং বানিহাল । জওহর টানেলের উচ্চতা 7250 ফুট । টানেল পার হতেই শুরু হলো কাশ্মীরের সব অসাধারণ সব ভিউ পয়েন্ট । 

ছবি : লেখকের তোলা 

আমাদের ড্রাইভার মোহন সিং দেখিয়ে চলেছে বিভিন্ন পাহাড়ী গ্রাম , শুটিং স্পট। আর প্রতিটি বাঁকে ই প্রকৃতির চমক । একপাশে ভয়ানক খাদ , অন্যপাশে বৈচিত্রে ভরপুর । সব মিলিয়ে এই যাত্রাপথ মানস পটে এক নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি পথ । প্রায় তিরিশ বছর আগে দেখা যে কাশ্মীরের বর্ণনা বাবার মুখে শুনেছি তার সাথে মেলানোর চেষ্টা করছি ঠিক সেইসময় মোহন সিং হটাৎ গাড়ির ব্রেক কষে দাড়িয়ে পড়ল । আর এগোনো যাবে না । কারণ সামনে গাড়ির লম্বা লাইন । খোঁজ নিয়ে দেখা গেল সামনে ধ্বস নামছে।একের পর এক পাথরের নেমে আসছে সঙ্গে আরো ছোটো ছোটো পাথর গড়িয়ে পড়ছে একটা বড় এলাকা নিয়ে।কেউ জানে না কখন বন্ধ হবে । মিলিটারি রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে । প্রায় সারেপাঁচ ঘন্টা পর ধ্বস বন্ধ হল। তারপর রাস্তা পরিস্কার করে মিলিটারি গাড়ি ছাড়ার পারমিশন দিল । এতো সুন্দর প্রকৃতি আবার নির্মম ও বটে । কখন যে কি হবে কেউ জানে না । বিগত কয়েকঘন্টা প্রচন্ড টেনশনে কেটেছে । সামনে এগোনো যাচ্চে না , পিছনে ফেরা যাবে না। কাছের জল, খাবার সব শেষ । অজানা জায়গা , দোকানপাট নেই, নেই কোনো শৌচাগার । একপাশে নদীখাদ, অন্যপাশে পাহাড়ের অশনি সঙ্কেত । দিনশেষ হয়ে অন্ধকার্ নেমেছে , ঠান্ডার প্রকোপ ও মারাত্মক । ভয়ে, চিন্তায় গলা শুকিয়ে কাঠ ।ভয়ংকর এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়ে পহেলগাঁ যখন পৌঁছালাম তখন রাত তিনটে । খালি পেট আর পথের ক্লান্তি নিয়েও ষ্ট্রীট লাইটে তখন যা দেখলাম মনে হলো এর নামই বোধহয় স্বর্গ ।চারদিকে দুধ সাদা তার মধ্যে মেঘেদের দল বেঁধে ঘোরাঘুরি।মোহময়ীএক দৃশ্য।এখানে আমরা জম্মু এন্ড কাশ্মীর ট্যুরিজমের 'হাট' এ ছিলাম । দুটো ঘর , ডাইনিং, রান্নাঘর আর বারান্দা নিয়ে একটা ' হাট '। এখানেই পেলাম ইচ্ছে লেপ, এই নাম টা আমি দিয়েছি । কারণ এটা কারেন্টের মাধ্যমে ইচ্ছে মত গরম করা যায়। প্রবল ঠান্ডা তে ভীষণ আরামদায়ক ।ঐ লেপে শরীর দিতেই ঘুম । 

ছবি : লেখকের তোলা 

সকালে চোখ খুলেই কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি বরফে ঢেকে আছে চারপাশ । হাটের সামনেই প্রায় দুই তিন ফুট করে উঁচু বরফ জমে রয়েছে । বরফের ওপর সকালের রোদ এসে পড়ায় অপূর্ব সুন্দর দেখতে লাগছে । বাইরে পা রাখতেই ঠান্ডা সুঁচ ফোটাচ্ছে । চারপাশে বরফ মাঝখানে মাঝখানে রাস্তা দারুন মনকাড়া এক দৃশ্য । ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়ে পড়লাম, ঘোড়ার পিঠে করে বৈশারন বা মিনি সুইৎসারল্যান্ড দেখতে । সবজান্তা এই ঘোড়া হেলিয়ে দুলিয়ে বরফের মাঝখান দিয়ে নিয়ে চলল , বেশ অন্যরকম লাগছিল । পাহাড়ী ঝাউ , পাইন গাছের মিশেলে বৈশারন এক অনন্য সুন্দর বুগিয়াল । সবুজের মাঝে বরফের আস্তরনে, ছবির মত লাগছিল । পরের সাইডসিন ছিল ডেবীয়ান । কাশ্মীরের রাজা এখানে একসাথে বাঘ ও হরিণকে মেরেছিল তাই এই জায়গাটি কাশ্মীরী দের মৃগয়াক্ষেত্র বলে পরিচিতি পায়, এরকম গল্প ই কথিত আছে ।। 

ছবি : লেখকের তোলা 

আসার পথে পেলাম লুকানো এক ঝর্না । যার জল ওপরে বরফ হয়ে গেছে কিন্তু নীচে কুলু কুলু শব্দে বয়ে চলেছে । প্রচুর বরফ পড়ার কারনে আমরা পহেলগাঁ এর সব সাইডসিন করতে পারিনি। অনেক রাস্তাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । একটু মন খারাপ হলেও এক অদ্ভুত ভাললাগা সঙ্গে করে ক্যামেরাতে প্রচুর ছবি নিয়ে হাট এ ফিরে রাজমা চাউল আর ঘি দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম । 

সুন্দরী রানীর মত চির বসন্তের দেশ পহেলগাঁ ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না ।মনে হচ্ছিল আরো দেখি , আরো উপভোগ করি নির্মল সুন্দর প্রকৃতির মাধুর্য্য। কিন্তূ উপায় নেই, ভাললাগার এক মোহ নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলাম শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে আর পহেলগাঁ কে স্মৃতির আঁচলে বেঁধে রাখলাম চিরকাল , চিরদিনের জন্য ।

mghoshsrp94@gmail.com
কলকাতা




No comments:

Post a Comment