1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

মায়াদের দেশে

 

ছবি : ইন্টারনেট

                                                                                               কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

        দুর্ভেদ্য ঘন জঙ্গল। গাছ, লতা-পাতা গা ঘেঁষাঘেষি করে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে সূর্যের আলো সব জায়গায় মাটিতে পৌঁছায় না। একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ সেই জঙ্গলের ভিতরে কীসের যেন খোঁজ করছেন। ভেসে আসছে বন্য জন্তুর ডাক, ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ঝিঁ ঝিঁ শব্দ। আকাশে চক্কর দিয়ে গাছের ডালে নেমে আসছে পাখির দল। কল্পনায় পরিবেশটা রোমাঞ্চকর হলেও বাস্তবে তা ছিল থমথমে। কে জানে কোথায় যে বিপদ লুকিয়ে আছে? বন্য জন্তুর আক্রমণ, সাপের ছোবল এসব তো আছেই, পাশাপাশি আছে বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড়, অসুখ-বিসুখের আতঙ্ক। কে জানে সামনের ওই ঘন ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে উল্কি আঁকা বা মুখোস পরা একদল বন্য মানুষ, হাতে বল্লম বা তীর-ধনুক? তাই প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এগোচ্ছেন অতি সন্তর্পনে। যে মৃত নগরীর দিকে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন সেখানে দু-চারটি বন্য জন্তুর দেখা পেলেও কোনো মানুষের যে দেখা পাওয়া যাবে না সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিৎ। কারণ তারা অনেকদিন আগেই হারিয়ে গেছে। ঘন জঙ্গলের ভিতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তাদের উন্নত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদির নিদর্শনগুলি। বহির্জগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না তাদের। তা সত্ত্বেও কী ভাবে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা? সত্যিই এ যেন এক মায়া। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বারবার সেখানে ছুটে যাচ্ছেন এই মায়া সভ্যতার রহস্য উদ্ঘাটনে।

     জঙ্গলাকীর্ণ সরু একফালি ভূখণ্ড। দু’পাশে দু’টি মহাসাগর— প্রশান্ত মহাসাগর আর আটলান্টিক মহাসাগর। ভূখণ্ডটির দুটি প্রান্ত জুড়ে আছে দু’টি মহাদেশের সঙ্গে। একদিকে উত্তর আমেরিকা আর আর অন্যদিকে দক্ষিণ আমেরিকা। বর্তমানে এর নাম মেসো আমেরিকা হলেও মেক্সিকো নামেই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের অনুমান 200 খ্রিস্টাব্দ থেকে 900 খ্রিস্টাব্দ সময়কাল এই সভ্যতার স্বর্ণ যুগ। সময়ের সাথে সাথে এই জনজাতি যেমন একদিন সভ্যতার উন্নতশিখরে পৌঁছেছিল তেমন একদিন কালের নিয়মে এর পতন ঘটেছিল। এরপর বহুদিন লোকচক্ষুর আড়ালে অরণ্যের ভিতরে পড়েছিল এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ।

     ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে এই মায়া রাজত্বের খোঁজ পাওয়া যায়। এরপর থেকেই চলছে ধারাবাহিক অনুসন্ধান ও গবেষণা। এখনও পর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে তাতেই আধুনিক পৃথিবীর লোকেরা বিস্ময়ে হতবাক। মায়াদের ক্যালেন্ডার, পিরামিড আজও অপার রহস্য। এরা যে ক্যালেন্ডার বানিয়েছিল তা থেকে অতীত ও ভবিষ্যত উভয় বছরেরই হিসেব পাওয়া যেত। এরা ধাতুর ব্যবহার জানতো না। তা সত্বেও শুধু পাথরের সাহায্যে এরা কৃষি-নির্ভর এক উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলেছিল— কীভাবে তা আজও রহস্যে ঘেরা। জানা নেই এই রহস্যের উত্তর কবে কবে খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে একথা অস্বীকার করা যাবে না যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গণিতে মায়াদের যথেষ্ট দখল ছিল। তা না হলে, ক্যালেন্ডার তৈরি করা, কৃষিকাজ করা, নিখুঁত মাপজোক করে পিরামিড তৈরি করা সম্ভব হত না। মায়াদের গণিত ও ক্যালেন্ডার তথা জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে তাই আমার এই নিবন্ধে তাদের বিজ্ঞানের অন্য দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব। তবে তার আগে জেনে নেব এরা এসেছিল কোথা থেকে। ওই জঙ্গলের মধ্যে এমন একটি উন্নত সমাজ যারা গড়ে তুলেছিল তারা কি ভিন গ্রহের বাসিন্দা ছিল, নাকি পৃথিবীরই মানুষ ছিল

কোথা থেকে এসেছিল মায়ারা?

     প্রায় বারো হাজার বছর আগেকার কথা। পৃথিবীতে সবে শেষ হয়েছে সর্বশেষ হিমযুগ। বরফ অনেকটা সরে গেছে দুই মেরুর দিকে। সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে বরফহীন ভূখন্ড। বাতাসের ধাক্কায় ঢেউ উঠছে সমুদ্রের জলে। উত্তর-পূর্ব চিন, মঙ্গোলিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে কয়েকটি আদিম জনগোষ্ঠী বেরিয়ে পড়ল শিকারের খোঁজে। বেরিং ব্রিজ ধরে তারা এগিয়ে চলল উত্তর আমেরিকার দিকে। যাযাবর জীবন। তাই কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করা এদের স্বভাবে ছিল না। যখন যেখানে শিকার পাওয়া যেত তখন সেই জায়গাই হত এদের অস্থায়ী ঠিকানা। শিকার কমে এলেই আবার ঠিকানা বদল। বহু বাধা বিপত্তি এড়িয়ে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে একসময় এরা উপস্থিত হয় অধুনা মেসো আমেরিকা এলাকায়। অপরূপ প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরপুর এই এলাকায় কোথাও রয়েছে বরফে ঢাকা আগ্নেয়গিরি, কোথাও আছে নির্জলা মরু এলাকা আবার কোথাও রয়েছে বর্ষণমুখর অরণ্য। জীব বৈচিত্রে ঠাসা এইসব অরণ্যে শিকারের অভাব নেই। যাযাবর জনজাতির কোনো এক গোষ্ঠীর ভাল লেগে গেল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই অঞ্চলটি। তারা থেকে গেল এখানে। ধীরে ধীরে শিকার ছেড়ে এরা শিখে নিল কৃষিকাজ। গড়ে উঠল এক সভ্যতা। এই প্রাচীন সভ্যতার নাম ওলমেক সভ্যতা। প্রায় 1150  খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মেক্সিকোর দক্ষিণ অঞ্চলে সাগর তটের সমতল এলাকায় এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

     ওলমেকদের চিন্তা ভাবনা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর উপরও প্রভাব ফেলে। আর তারই ফলে 900  খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আরেকটি জনগোষ্ঠীর সভ্যতার উত্থান ঘটে। এই সভ্যতার নাম জাপোটেক সভ্যতা। আধুনিক মেক্সিকোর ওয়াকসাকা অঞ্চলে এরা বসবাস করত। সম্ভবত এরাই এই অঞ্চলে লিপি ও লিখন পদ্ধতির সূচনা করেছিল।

     জাপোটেক জনগোষ্ঠীর সভ্যতার পরের অধ্যায়ের উন্নত সভ্যতার নামই মায়া সভ্যতা। এই সভ্যতা আধুনিক মেক্সিকো শহর থেকে প্রায় 50 কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে তিয়োতিহুয়াকান এলাকায় গড়ে উঠেছিল। এলাকাটা ছিল জঙ্গলে পরিবেষ্টিত। মায়ারা এই জঙ্গলের বাইরে আত্মপ্রকাশে বিশেষ ইচ্ছুক ছিল না। কেন ছিল না তা আজও রহস্য। এছাড়াও মেক্সিকোর তাবাস্‌কো ও চিয়াপা অঙ্গরাজ্যের কিছু এলাকায়, গুয়াতোমালা ও বেলিজ-এ এবং হণ্ডুরাস, এল সালভাদরের পশ্চিমাংশের যেসব এলাকায় এই সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছিল সেসব এলাকাও ছিল ঘন জঙ্গলে পরিবেষ্টিত। সম্ভবত এরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিল না, নয়তো অনীহা ছিল। তাই আত্মরক্ষার তাগিতে জঙ্গলের ভিতরে এই আত্মগোপনের পথ হয়তো তারা বেছে নিয়েছিল।

কৃষিকাজে মায়ারাঃ

     মায়া সভ্যতা গড়ে উঠেছিল ঘন জঙ্গলের মধ্যে। শিকারের অভাব ছিল না। শুধু শিকারের উপর নির্ভর করলে যাযাবর জীবন জাপন করতে হয়। মায়ারা তা চায়নি। তারা চেয়েছিল এক জায়গায় স্থায়ী বসবাস করতে। না হলে চিন্তার উন্মেষ ঘটে না। তাই তারা শিকারের পাশাপাশি কৃষি জীবন বেছে নিয়েছিল। ধান চাষ সম্ভবত তারা জানতো না। তেমন কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় নি। মূলত তারা ভুট্টা, স্কোয়াশ, বিন, লঙ্কা, তুলো এবং নানা ধরনের ফল চাষে অভ্যস্ত ছিল। নিম্নবিত্ত মায়াদের মূল খাদ্য ছিল ভূট্টা। এর দানা গুঁড়ো করে তাতে লঙ্কা মিশিয়ে এক ধরনের খাবার তৈরি করা হত। একে বলা হত ‘আতোল’। মায়ারা প্রাতরাশ হিসেবে এই খাবার খেত। ভূট্টার গুঁড়ো জল দিয়ে মেখে আটার তালের মতো তৈরি করা হত। একে বলা হত ‘পোসল’। খেতে একটু টোকো হত। এটা ছিল মায়াদের মধ্যাহ্ন ভোজের খাবার। এছাড়াও আরও নানা ধরনের খাবার তারা পাকাতো। যেমন, তামালেজ, তরতিল্লা ইত্যাদি। তবে এসব খাবারের চল কৃষিজীবী মায়াদের মধ্যেই বেশি ছিল। উৎসব অনুষ্ঠানে মাংস-র সঙ্গে নানা ধরনের সব্জি মিশিয়ে সুপ তৈরির চল ছিল। সুস্বাদু করার জন্য তাতে শুকনো লঙ্কা আর স্কোয়াশের বিচি মেশানো হত। ধনী মায়াদের মধ্যে খাওয়া দাওয়ার অভ্যাস কিছুটা অন্য ধরনের ছিল।

     মায়ারা প্রচুর কোকা গাছের চাষ করত। এই গাছ থেকে পাওয়া যেত চকোলেট বিন। এ থেকে তৈরি হত পানীয় যা মায়াদের অতি প্রিয় ছিল। এই পানীয় গ্রহণ আভিজাত্যের পরিচয় বহন করত। এছাড়াও এই চকোলেট বিন মায়া সমাজে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত। এক ধরনের গাছের ছাল থেকে মায়ারা ‘বালচে’ নামের এক প্রকার ঝাঁঝালো সুরা তৈরি করত। এই সুরা বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত। বার্নিশ গাছ থেকে পাওয়া রজন থেকে এরা রবার ও মিষ্টি চিউয়িংগাম তৈরি করত। সুগন্ধী ধূপ ও ধুনো তৈরির প্রযুক্তিও এদের জানা ছিল।

যানবাহন প্রযুক্তিতে মায়াদের অবদানঃ

     মায়া সাম্রাজ্যে এখনও পর্যন্ত 120 টি শহরের খোঁজ পাওয়া গেছে। শহরগুলির মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু কীভাবে? এটাই বিশেষজ্ঞদের সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। কারণ মায়া সভ্যতায় এখনও কোনো যানবাহনের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় নি। যান চলাচলের উপযুক্ত কোনো রাস্তাও শহরগুলিতে পাওয়া যায় নি। বরং বলা যায় রাস্তাঘাট তৈরিতে মায়াদের কোনো ইচ্ছাই ছিল না। অনেকে বলে থাকেন যে আজটেক বা ইনকাদের মতো মায়ারাও চাকার ব্যবহার জানত না। ধারণাটা যে কতটা সত্যি তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। ছোটদের জন্য তৈরি কিছু খেলনা গাড়ি পাওয়া গেছে যাতে চাকা লাগানো আছে। এদের ক্যালেন্ডারের আকৃতি চক্রাকার। এইসব নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় যে মায়াদের চক্রাকার বস্তু এবং তাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারণা ছিল। তাহলে এরা যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রাস্তাঘাট ও চাকা লাগানো শকট তৈরি করল না কেন? এটা সত্যিই এক রহস্য। তাহলে কি এরা আকাশ পথে যাতায়াত করত? তারও কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় নি। এই রহস্য থেকেই কারও কারও ধারণা মায়ারা ভিন গ্রহের মানুষ। ইউফো ছিল তাদের যাতায়াতের বাহন। তাই সড়ক পথে কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন তাদের হয় নি। এই তত্ব মেনে নিতে হলে একটা খটকার নিরসন আগে করতে হবে। ‘উড়ন্ত চাকি’র নিয়মিত ওঠানামার জন্য বিমান বন্দর বা হ্যালি প্যাডের মতো পরিকাঠামো দরকার। মায়ারা ভিন গ্রহের মানুষ এই তত্ব প্রবক্তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন, ‘এমন কোনো পরিকাঠামো কি মায়া সভ্যতায় খুঁজে পাওয়া গেছে? তাই অনুমানের উপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক নয়। সত্যকে জানার জন্য প্রয়োজন আরও গবেষণার। মায়া লিপি এখনও সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করা যায় নি। যেদিন যাবে সেদিন হয়তো সব সত্য জানা যাবে। অতরব আমাদের সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত আর কোনো পথ নেই।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে মায়ারাঃ

     মায়ারা সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছিল গণিতে ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে। তুলনায় চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাদের তেমন কোনো অবদান ছিল বলে মনে হয় না। আদিম জনজাতিগুলির মধ্যে সংক্রামক রোগের প্রকোপ খুব বেশি ছিল। কখনও কখনও এই রোগ মহামারি আকারও ধারণ করত। মায়াদের সমসাময়িক আজটেক ও টোলটেক জনগোষ্ঠীগুলিতে এই ধরনের রোগের প্রকোপে বহু লোক মারা যেত। মায়ারা এই ধরনের রোগকে খুব ভয় পেত। কারণ এই রোগ প্রতিহত করার মতো জ্ঞান তাদের ছিল না। তাই কি তারা অন্যান্য জনগোষ্ঠিগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গভীর জঙ্গলে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল? জঙ্গলের ভিতরেই ছিল তাদের সাম্রাজ্য। বহির্বিশ্বের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ স্থাপনে তাদের অনীহা ছিল। সংক্রামক রোগের (বসন্ত, হাম ইত্যাদি) চিকিৎসা পদ্ধতি তাদের জানা না থাকলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যে এই ধরনের অসুখ-বিসুখ অনেকটাই প্রতিহত করতে পারে সেটা তাদের জানা ছিল। তাই মায়াদের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি ছিল। প্রত্যেক দিন এরা স্নান করত। একবার তো বটেই, কখনও কখনও একাধিকবারও। বিশেষ করে কাজের শেষে বাড়ি ফিরে গরম জলে স্নান করা এদের সমাজে প্রথা ছিল বলা যায়। পুরুষদের জন্য জল গরম করে রাখার দায়িত্বে থাকত বাড়ির মেয়েরা— বিশেষ করে স্ত্রীরা। এ ব্যাপারে সমাজে কড়া আইন ছিল। কেউ আইন লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধানও ছিল।

মায়া স্থাপত্যঃ

    মায়াদের পরিত্যক্ত শহরগুলির মধ্যে পাওয়া গেছে নাগরিক ও ধর্মীয় স্মৃতিসৌধ, মন্দির, বিচার ব্যবস্থা ও আলোচনা কক্ষ আর নাগরিকদের বাসস্থান। শহরের সীমানা শেষে গ্রাম। সেখানে সাধারণত কৃষকরাই থাকত। কৃষকদের বাড়ি ঘর ছাড়া বড় বড় ডাবা ও গোলা থাকত যেখানে শস্য মজুত করে রাখা হত। মাটির নিচে নানা মাপের কুঠুরি তৈরি করে তাতেও শস্য রাখার রেওয়াজ ছিল। মায়াদের সবচেয়ে বড় শহরের নাম ছিল ‘টিকাল’। যদিও এটা প্রাচীনতম বা প্রধান শহর ছিল না। এদের প্রধান শহরের নাম ছিল ‘চিচেন ইৎজা’। এই শহরে একটি সৌরক্রান্তি নিরীক্ষণ মন্দির ছিল। এদের সবচেয়ে ছোট শহরের বিস্তৃতি ছিল 2 থেকে 3 মাইল ব্যাসার্দ্ধের অঞ্চল জুড়ে। মায়া সভ্যতায় এখনও পর্যন্ত 5 টি মন্দির পিরামিড পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়টির উচ্চতা 75 মিটার। চিচেন ইৎজা শহরে যে সৌরক্রান্তি নিরীক্ষণ মন্দির ছিল সেটা পিরামিড মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম। এই মন্দিরের সামনে ছিল একটি সর্প দেবতার মূর্তি। মায়াদের কাছে এই মন্দির শহর ছিল অত্যন্ত পবিত্র। বহু তীর্থযাত্রীর সমাগম হত এখানে। এখানে একটি বড় প্রাকৃতিক কূপেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। মায়াদের পিরামিডগুলি সবই ধাপ কাটা। অধিকাংশ পিরামিডই ছিল মন্দির পিরামিড। মিশরীয়দের মতো মমি রাখার নিদর্শন এদের কোনো পিরামিডে পাওয়া যায় নি। তাই অনুমান করা হয় পিরামিডগুলি ব্যবহার করা হত মূলত মন্দির হিসেবে এবং মূল্যবান সামগ্রী সংরক্ষণ করার জন্য।

     মায়ারা চাকার ব্যবহার জানত না। যে বড় বড় পাথর দিয়ে এই পিরামিডগুলি তৈরি করা হয়েছিল সেগুলি পাওয়ার কোনো উৎস কাছাকাছি এলাকায় পাওয়া যায় নি। তাই ভাবতে অবাক লাগে এই বড় বড় পাথরের চাঁইগুলি তারা দূর দূরান্ত থেকে কীভাবে সেখানে বয়ে এনেছিল? এর উত্তর আজও পাওয়া যায় নি। যেকোনো স্থাপত্য নির্মাণে নিঁখুত মাপজোখের দরকার হয়। আর এর জন্য দরকার হয় গাণিতিক হিসেব নিকেষ। পিরামিডগুলির নির্মাণ কার্য দেখলে বোঝা যায় যে এ ব্যাপারে তারা যথেষ্ট দক্ষ ছিল।

     পিরামিড বলতে যে ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কারাকোল পিরামিড ঠিক সেরকম নয়। এই পিরামিডটি যেন দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম ভাগের উপর অনেকগুলি স্তম্ভ (pillar) সার দিয়ে বসানো আছে। তার উপরে দ্বিতীয় ভাগটি যেন ছাদের মতো করে বসানো আছে। এটা যেন পিরামিড তৈরির একটি ব্যাতিক্রমী ধারা। মায়াদের আর যে পিরামিডগুলি ছিল সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আল্‌ তুন্‌হা পিরামিড, কালাকমুল পিরামিড, তেওটিহুয়াকান্‌-এ সূর্য পিরামিড ইত্যাদি।

উপসংহারঃ

     মায়াদের দেশ গুয়াতেমালা, বেলিজ ও মেক্সিকো পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে তারা কোনো একটি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল না। বিভিন্ন শহরে বিভক্ত হয়ে তারা বাস করত। প্রত্যেক শহরে একজন পুরোহিত থাকতেন। তিনিই হতেন সেই শহরের নেতা। প্রত্যেক শহরের বসবাসকারীদের সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্ম এক ছিল। অন্যান্য সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘন জঙ্গলের আড়ালে বাস করলেও মায়ারা যে এক উন্নত জাতি ছিল সে ব্যাপারে এখন সকলেই নিঃসন্দেহ। গণিতে এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে তারা অসামান্য অবদান রেখে গেছে। শূন্য আবিষ্কারের কৃতিত্ব প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতদের। মায়াদেরও যে  শূন্য এবং অসীমের ধারণা ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মায়ারা জানতো যে 2329 দিনে 81 টা অমাবস্যা পাওয়া যায়। এর থেকেই তারা নির্ণয় করেছিল যে চান্দ্রচক্র (Lunar Cycle) তা ছিল 29·53086 দিনের। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এটা তাদের এক বিরাট কৃতিত্ব। এমন একটি উন্নত জাতি কীভাবে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেল তা আজও রহ্স্যাবৃত।

*******

 

তথ্য সূত্রঃ

1.       Gallenkamp P. C : Maya, The riddle and rediscovery of a lost Civilisation, University New York, Viking 1985.

2.       Andrew G.P : Maya cities; Placemaking, and Urbanization, Oklahoma Press 1977.

3.       Benton E. : Maya Iconography, Princeton, 1988.

4.       সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ লাতিন আমেরিকার তিন সভ্যতা (মায়া, ইনকা ও আজতেক), কোডেক্স, কলকাতা, জানুয়ারি  2011 (তৃতীয় সংস্করণ )

 

kbb.scwriter@gmail.com
কলকাতা


 

 

 


No comments:

Post a Comment