1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

বিষের বাসর

ছবি : ইন্টারনেট 

বিষের বাসর

সন্দীপ বিশ্বাস 

ধীরে ধীরে চৈতন্য হয় দেবযানীর। চোখ খুলতেই ভেসে ওঠে এক সুকুমার বদন। উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে তার মুখের পানে। শালপ্রাংশু যুবাপুরুষ। ধড়মড় করে উঠে বসে তাড়াতাড়ি। দেখে শষ্পশয্যায় শুয়ে ছিলো সে। নিজের দিকে চেয়ে লজ্জায় রাঙা হওয়ার পালা তার। প্রায় নিরাবরণ দেহ। একটিমাত্র সিক্ত বস্ত্রখন্ড লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছে কোনোক্রমে।

“কে আপনি দেবী? এই অবস্থা কি করে হলো আপনার?”

মনে পড়ে যায় সব। রাজকুমারী শর্মিষ্ঠার অনুরোধে বনমধ্যস্থ ঝর্ণার জলে স্নান করতে এসেছিলো দেবযানী। সঙ্গে রাজকন্যার সখীর দল। নির্জন অরণ্যে বস্ত্রত্যাগ করে স্নানে মত্ত হয় সবাই। উচ্ছল যৌবনের কলকাকলি। অনেকক্ষণ চলে এইরকম। তারপর কাপড় পড়তে গিয়ে নিজের বস্ত্র কিছুতেই খুঁজে পায় না সে। তখন খেয়াল হয় যে খুব সম্ভব ভুলক্রমেই শর্মিষ্ঠা পরিধান করেছে তা।

রাগ হয়ে যায় দেবযানীর। মহারাজ বৃষপর্বের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা সে। ব্রাহ্মণতনয়া। সমগ্র অসুর রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মানীয় স্থান তার পিতার। কোন সাহসে সেই মহাগুরুর কন্যার বস্ত্র পরিধান করে শর্মিষ্ঠা? হলোই বা সে এই রাজ্যের রাজকন্যা! নিজের মনের ভাব পরিষ্কার ভাষায় ব্যক্ত করে সে। কথায় কথা বাড়ে। বিশেষতঃ, দেবযানী সম্পূর্ণ একা। বাকিরা সকলে মিলিত হয়ে শুরু করে বিবাদ। তারপর এক চরম মুহূর্তে মহা ধাক্কা এক। বেশ খানিকটা নীচে পতন দেবযানীর। তারপর আর মনে নেই কিচ্ছু।

“এই কূপের মধ্য থেকে আমিই উদ্ধার করেছি আপনাকে। শিকারের সন্ধানে এসেছিলাম অরণ্যে। তৃষ্ণার্ত অবস্থায় জলের খোঁজ করতে করতে নেহাতই ভাগ্যক্রমে সন্ধান পাই আপনার। পতনের সময় খুব সম্ভব মাথায় চোট লেগে জ্ঞান হারিয়েছিলেন আপনি। আমি যযাতি। চন্দ্রবংশীয় মহারাজ নহুষ পিতা আমার।”

সংক্ষেপে আত্মপরিচয় দেয় দেবযানী। তার এই অবস্থার কারণ হিসাবে জানায় দু-চার কথা। ওসব এখন মাথায় ঘুরছে না মোটে। প্রতিশোধ চাই তার। রাজদুহিতার এই আচরণের যোগ্য জবাব দিতেই হবে যে করে হোক। পিতাকে জানালেই প্রতিকার হবে কিছু। তাই তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার সর্বাগ্রে। যযাতির কাছ থেকে বিদায় নেয় সে। শুধু স্মৃতিপটে আঁকা হয়ে থাকে এক তরুণ রাজকুমারের আকর্ষক মুখচ্ছবি।

মেয়ের অভিযোগ শুনে রাগে অন্ধ হন শুক্রাচার্য। প্রতিকারের বিধানও দিয়েছে দেবযানী। আজীবন তার দাসী হয়ে থাকতে হবে শর্মিষ্ঠাকে … এর কমে কোনো কিছুতেই রাজি নয় সে। রাজা বৃষপর্বকে পুরো বিষয়টা জানান তিনি। এর অন্যথা হলে অসুররাজ্য থেকে সপরিবারে চিরবিদায় নেবেন, জানান সেকথাও। রাজা পড়েন মহা সংকটে। একদিকে প্রাণাধিক কন্যা, অন্যদিকে পরম গুরু। এই অবস্থা থেকে পিতাকে রক্ষা করে শর্মিষ্ঠা নিজেই। দেবযানীর সকল শর্তে রাজি হয় সে। জয়ের হাসি ফুটে ওঠে গুরুকন্যার মুখে। সবার আগে নবলব্ধ দাসীকে আদেশ করে তার পদসেবা করার জন্য। এবং নতমস্তকে তা পালন করে শর্মিষ্ঠা।

কিছুদিনের মধ্যে সেই অরণ্যেই আবার যযাতির সঙ্গে দেখা দেবযানীর। এবারে আর দ্বিধা করে না সে। সলজ্জ কন্ঠে প্রেম নিবেদন করে রাজকুমারকে। যযাতি দ্বিধান্বিত। পূর্বের সাক্ষাতে এই ব্রাহ্মণকন্যার অতুলনীয় রূপ দেখে আকৃষ্ট তিনি হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু আবেগে ভেসে যান নি তিনি। দেবযানীর চেহারায় এমন কিছু দেখেছিলেন যাতে তাঁর মনে হয়েছিলো যে সম্পূর্ণ অপাপবিদ্ধ নয় এই রমণী। “ক্ষত্রিয় আমি। আপনার মতো ব্রাহ্মণতনয়াকে বিবাহ করার স্পর্ধা আমার নেই দেবী।” অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু দেবযানী অনড়। “আপনার দক্ষিণ হস্ত সেদিন স্পর্শ করেছিলো আমার শরীর, সুতরাং আমার পাণিগ্রহণ করতে বাধ্য আপনি।” শেষ পর্যন্ত পিতা শুক্রাচার্যের মধ্যস্থতায় সফল হয় সে। মহা ধুমধামের সঙ্গে সম্পন্ন হয় বিবাহ। নিজস্ব খাস দাসী হিসাবে শর্মিষ্ঠাকে সঙ্গে নিয়ে পতিগৃহে যাত্রা করে দেবযানী।

বাসরশয্যায় স্বামীর আদর খেতে খেতে বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে মুখে। মনে পড়ে যায় আর এক কন্দর্পকান্তি তরুণের কথা। দেবযানীর জীবনের প্রথম এবং একমাত্র প্রেম। কত যুগ আগের কথা মনে হয় যেন। কিশোরী বয়স তখন।

সুরাসুরের অবিরাম যুদ্ধ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা সেই সময়। ভয়ানক রক্তক্ষয়ী এইসব যুদ্ধে দেবতারা দেখছেন যে অসুরের সংখ্যা কমে না কিছুতেই। যাদের বধ করে এইমাত্র আনন্দ পেলেন কিঞ্চিৎ, একটু পরেই আবার ভীষণ সংগ্রামে লিপ্ত হচ্ছে তারা পূর্ণ উদ্যমে। ফলতঃ প্রতিটি যুদ্ধের শেষে দেবপক্ষে হতাহতের সংখ্যা অনেক, কিন্তু শত্রুপক্ষের সম্বন্ধে বলা যাবে না এমন কথা। কারণ অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন তাঁরা – অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য জানেন মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র, যার বলে যুদ্ধে নিহত অসুরদের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাঁচিয়ে তোলেন তিনি। এইভাবে চললে দেবতাদের সম্পূর্ণ বিনাশ সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তাহলে উপায়?

দেবগুরু বৃহস্পতির নেতৃত্বে পরিকল্পনা বানালেন সবাই মিলে। সেইমতো গুরুপুত্র কচ হাজির হলো অসুররাজ্যে। সোজা পৌঁছলো সে শুক্রাচার্যের কাছে। প্রণাম করে পরিচয় দিলো নিজের। জানালো যে ওনার শিষ্য হয়ে শিক্ষালাভ করতে চায় সে। দেবলোকের এই তরুণের ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন শুক্রাচার্য। রাজি হলেন তিনি। সেইমতো অসুরলোকে তাঁর আশ্রমে বসবাস শুরু করলো কচ। গুপ্ত উদ্দেশ্য একটাই … যেকোনো উপায়েই হোক মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্রটি শিখে নেওয়া গুরুর কাছ থেকে। ওদিকে কিশোরবয়স্কা দেবযানী প্রায় প্রথম দর্শনেই হৃদয় দিলো এই নবাগতকে। শুধু মনের কথা মনেই রইলো তার।

দিন যায়। পরম অধ্যবসায়ের সাথে যাবতীয় বিদ্যায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে কচ। শুধু সেই গুপ্ত মন্ত্র শিক্ষার কোনো সুযোগই খুঁজে পায় না সে। বহুবার সে গুরুকে দেখেছে নিহত সৈনিকদের বাঁচিয়ে তুলতে, কিন্তু মন্ত্রোচ্চারণের কর্মটি তিনি সারেন সম্পূর্ণ নিঃশব্দে, তাই কোনোভাবেই তা শোনা হয়ে ওঠে না তার। ধৈর্য ধরে দিন কাটায় কচ। কখনো না কখনো আসবেই সেই সুযোগ … ভরসায় বুক বাঁধে সে।

ওদিকে অসুররা কিন্তু প্রথম থেকেই সন্দেহের চোখে দেখে কচকে। দেবলোক থেকে হঠাৎ কেন এই তরুণের আগমন … নিশ্চয়ই কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য আছে তার … জল্পনা করে তারা। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে তাকে হত্যা ক’রে শবদেহ ভক্ষণ করায় এক ব্যাঘ্রকে দিয়ে। ঘটনা জানতে পারে দেবযানী। তার করুণ আকুতির ফলে গুপ্ত মন্ত্র ব্যবহার করে কচকে বাঁচিয়ে তোলেন শুক্রাচার্য। আবার সুযোগ খুঁজতে থাকে অসুররা। এবারে হত্যা ক’রে কচের দেহ পুড়িয়ে দেয় তারা। তারপর সেই দেহভস্ম সুরার মধ্যে মিশিয়ে নিবেদন করে গুরুর চরণে। শিষ্যদের দান নিঃসংকোচে পান করেন শুক্রাচার্য।

আসল বিষয় জানাজানি হয় একসময়। দেবযানীর বিলাপে রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বৃদ্ধ। কচকে বাঁচাতে পারেন তিনি সহজেই, কিন্তু সে যে রয়েছে তাঁরই উদরের ভিতর। ফলে কচ বেঁচে উঠে তাঁরই পেট চিরে বাইরে বেরোবে এবং মৃত্যু হবে স্বয়ং শুক্রাচার্যের। অনেক ভেবে উপায় বার করেন তিনি। মন্ত্র উচ্চারণ করেন, কিন্তু এক্ষেত্রে উদাত্ত কন্ঠে। পুনর্জন্ম লাভ করে কচ, আর মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েন গুরুদেব। কচের কিন্ত ইতিমধ্যে শেখা হয়ে গেছে সেই মন্ত্র। তারই বলে গুরুকে বাঁচিয়ে তোলে সে।

পরের দিন গুরুগৃহ থেকে বিদায় গ্রহণ করে কচ। দেবলোকে ফিরে যেতে চায় সে। দুহাত তুলে তাকে আশীর্বাদ করেন শুক্রাচার্য। পাগলিনীর মতো ছুটে এসে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেবযানী। চোখের জলের ধারা বয়ে যায় অঝোরে … কচকে প্রেম নিবেদন করে সে। রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে কচ। “গুরুকন্যা তুমি, সুতরাং আমার ভগ্নীসম। তোমার এই প্রস্তাবে রাজি হওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে।” দলিত নাগিনীর মতো ফুঁসে ওঠে প্রত্যাখ্যাত কিশোরী। অভিশাপ দেয় – “যে বিদ্যা শেখার জন্য এখানে আগমন তোমার, প্রয়োজনের সময় তা বিস্মৃত হবে তুমি।” উল্টে শাপপ্রদান কচের – “কোনো ব্রাহ্মণ সন্তানকে পতিরূপে পাবে না তুমি এ জীবনে।” সেই তাদের শেষ দেখা।

আজ যযাতির অংকশায়িনী হয়ে সেই দিনটাই শুধু মনে পড়ে দেবযানীর। এরপর ঘটবে আরো অনেক ঘটনা … যযাতির অকালবার্ধক্য এবং নিজ পুত্রের কাছে যৌবন ভিক্ষা। কিন্তু সে অন্য এক কাহিনী।

sandip.biswas@oracle.com
ব্যাঙ্গালোর

No comments:

Post a Comment