1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, August 15, 2022

নবজন্ম ও প্রেম


ছবি : ইন্টারনেট

নবজন্ম ও প্রেম

সুদীপ ঘোষাল

এক

একটি সাজানো গোছানো গ্রামের দুটি ছেলেমেয়ে প্রশান্ত ও অনিমা। তারা পরস্পরকে ভালোবাসত।তারপর একরাতে,গঙ্গানদীর বন্যায় প্রশান্ত  ও অনিমা ভেসে গেল।কেউ সন্ধান পেল না অনেক খুঁজেও। বড়পাথরে ধাক্কা খেয়ে দুজনেরই পূর্বস্মৃতি বিলুপ্ত হল।শুরু হল তাদের নবজন্ম।

 তারপর প্রশান্ত  কাটোয়া ঘাটে একটা বাঁশের ধাক্কায় অচৈতন্য হয়ে পরে রইলো।আর  কুন্তিঘাটে নদীতীরে পাথরের ধাক্কায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইলো। কাটোয়া ঘাটে মনা বায়েন স্নান করতে এসে দেখলো, এই কি ছোটোবেলায় হারিয়ে যাওয়া আমার ছেলে।এই গঙ্গায় স্নান করতে এসেই ছোটোবেলায় তার ছেলে হারিয়ে গেছিলো।মন জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো,হে ঈশ্বর তোমার অসীম করুণা। তুমি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছো।মনা একটা ভ্যানে চাপিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে এলো।মনার স্ত্রী মায়ের যত্নে সারিয়ে তুললো ছেলেকে। মনা বললো,আমরা নতুন করে আবার আমাদের ছেলেকে ফিরে পেলাম, তাই এই ছেলের নাম দিলাম নবকুমার।ছেলেটি বললো,আমার নাম দিলেন নবকুমার।আমি কে কোথা থেকে এলাম? মনা বললো,তুমি আমাদের ছেলে। নবকুমার বললো,আমার কিছুই মনে পড়ছে না। আমি আপনার ছেলে।আমার মা কোথায়। মাকে জড়িয়ে ধরে নবকুমারের কান্না। মাথায় প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে সে ভুলে গেছে পূর্ব কাহিনী।

এদিকে  স্মৃতি হারিয়ে গেছে পাথরের ধাক্কায়। এক জমিদার স্নান করতে এসে উদ্ধার করলেন তাকে। দেখলেন এ তো এখানে থাকলে বিপদ হবে।লোকজনদের বললেন,একে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তোলো।অনেক কাজের মেয়ের মধ্যে এ বেঁচে থাকবে।বাড়িতে সুস্থ হলে মেয়েটিকে সবাই তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলো কিন্তু সে কিছুই বলতে পারলো না। তাই গিন্নিমা তার নাম দিলেন পিউ।সে মেয়ের মতই থাকবে আর যতটা পারবে বাড়ির কাজ করবে।তাছাড়া পিউ লেখাপড়াও শিখতে শুরু করলো।

পিউ দেখল ও জেনে গেল যে পূর্ব  বর্ধমান  জেলার সিঙ্গি গ্রামে ধূমধাম করে মশাল জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের পুজো হয়। কাশিরামদাসের জন্মস্থান এই সিঙ্গি গ্রামের বাজারে বহু বছর যাবৎ এই পুজো হয়ে আসছে। পাটকাঠির মশাল জ্বালিয়ে এই পুজো মহা সমারোহে পালন করা হয়। কথিত আছে জ্ঞানের আলো এই দেবি জগতে ছড়িয়ে দেন। তাই আলোময় মশাল জ্বালিয়ে দেবির পুজো করা হয়। ভিন্ন মতও অনেক আছে।

তবে মতবাদের ককচকচানির উর্ধ্বে উঠে সকল গ্রামবাসী এক হয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হন এই কটা দিন।

পাটকাঠির বোঝা বেঁধে বড় বড় মশাল তৈরি  হয়। মশালে আগুন ধরিয়ে ঢাক ঢোলের তালে তালে নাচতে থাকে ভক্তের দল। চারদিকে  আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে  পুজোমন্ডপ। মশাল জ্বালিয়ে  গ্রাম ঘোরে প্রতিমাসহ মশালবাহির দল। বড় সুন্দর  এই দৃশ্য। সব মানুষ  ভেদাভেদ ভুলে মেতে যান এই উৎসবে।

পিউ বলে,আর কোথাও এই পুজো আছে কি না জানা নেই।


দুই

 

     বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে প্রিয়া চলে গেছে অতীত বর্ষায়। ঠিক এইভাবে ভিজেছিল সুনীলের সঙ্গে ঘোর বর্ষায়। দুহাতের অঞ্জলি ভরে বৃষ্টির জল নিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছিল সুনীলের সুন্দর মুখমন্ডলে। সুনীল প্রগাঢ় ভালবাসায় জড়িয়ে ধরেছিল প্রিয়ার বৃষ্টিভেজা তনু। তারপর জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে জীবন এগিয়ে গেল  । সংসারী হল প্রেমিকযুগল। মাঠে কাজ করত সুনীল। দো ফসলি জমিতে নানারকম ফসলের চাষ করত সুনীল। ভাল চাষি হিসাবে তার নাম পঞ্চগ্রামে সুবিদিত। মাঠে জামবাটি ভরে খাবার নিয়ে যেত প্রিয়া গামছায় বেঁধে। গিঁট খুলতে খুলতে দেখে নিত সুনীল প্রিয়ার মিষ্টি হাসিমুখ। খাওয়ার পরে ভেন্ডির জমির আড়ালে চলত প্রেমের আলাপ। শেষ হতে চাইত না গল্পকথা। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামত। দুজনে হাঁটি হাঁটি পায়ে গামছায় ফসল বেঁধে চলে যেত বাসায়। চাল, ডাল আর ক্ষেতের ফসলের আস্বাদে হত তাদের ক্ষুধা নিবারণ। তারপর তাদের কন্যা সন্তান হল। সুনীল চাকরি পেল। চলে গেল শহরে। কঠিন জীবন সংগ্রামে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। প্রিয়া মেয়ের পড়াশোনার প্রতি যত্ন নিল। চলতে লাগল গড্ডলিকা প্রবাহ।

শহরে সুনীল বাসায় রান্না করে খায়। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর একটু বিশ্রাম। কলকারখানার ধোঁয়ায় হাঁফিয়ে উঠল তার মন। প্রিয়ার কাছে মন উড়ে যায় পাখির মত। আজ একবছর পরে সে গ্রামে ফিরেছে।

স্টেশনে নেমে গ্রামের একমুঠো ধুলো সুনীল সারা অঙ্গে মেখে নিল। তারপর ঘনমেঘ করে অঝোর ধারায় নামল বৃষ্টি। বাড়িতে ঢোকার সময় সুনীল দেখল তার প্রিয়া ও মেয়ে বৃষ্টি ভিজছে আর জল ছিটিয়ে হাসছে। এমন সময়ে সুনীলকে দেখে প্রিয়া আনন্দে আত্মহারা হয়ে তার চাষিকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়া বললো, জমিগুলো আমার চাষির অভাবে কাঁদছে। তুমি জমি চাষ কর। বৃষ্টিতে ভিজে জমি   চাষের উপযুক্ত হয়েছে।  সঠিক সময়ে চাষি এসেছে। চাষিও আনন্দে চাষের জমিতে নামার জন্য অস্থির হয়ে উঠল .।

তিন

 

শুরু হলো পিউ আরননবকুমারের  নতুন জীবন। দুবছর কেটে গেলো তাদের। তারপর এলো শরৎকাল। এক কাজের লোকের সাথে পিউ এসেছে ঢোলের খোঁজে।কাটোয়ার বায়েনপাড়ায় তারা পেয়ে গেলো নবকুমার বায়েনকে।তাকে নিয়ে চলে এলো কুন্তিঘাট।

বৃষ্টি পড়ছে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি। সহজে থামার নয়। আলপথে হেঁটে আসছে পিউ। তার পিছনে ঢোল কাঁধে নবকুমার বায়েন। নবকুমার নিজের বুদ্ধিতে ঢোল বাজানো শিখেছে। এবার সে জমিদার বাড়ি কুন্তিঘাটে যাচ্ছে পুজোর সময়।

পিউ স্লিপ খেতে খেতে কাদা মাড়িয়ে চলেছে। এত পিছল যে,এক পা এগোলে দু পা পিছিয়ে যাচ্ছে। পিউ বললো,আপনি আমার হাত ধরুণ।আমি পড়ে যাচ্ছি।সঙ্গের বুড়ো লোকটা পিছলে পড়েছে কাদায়।সে বলছে,পিউ তোরা চল।আমি চান করে যাচ্ছি।

নবকুমার বললো,পুজো আছে, ওখানে বাজাতে চললাম। ওরা লোক ভালো।

------ নিশ্চয়।আমাকে একটু হেল্প করুন প্লিজ। আমি পরে যাবো কাদায়।

----- ঠিক আছে,হাতটা দিন।

------আপনার নাম কি?

------- নবকুমার  বায়েন।

নবকুমার নাম বলবে কি করে। কষ্ট করে কাঁপতে কাঁপতে বললো। শরীরে শিহরণ খেলে গেলো নরম হাতের ছোঁয়ায়। কোথাও ভীষণ শব্দে বজ্রপাত হলো। পিউ ভয়ে নবকুমারকে জড়িয়ে ধরলো।  খুব খারাপ লাগছে নবকুমারের। তবু নিয়ন্ত্রিত মন। মহাপুরুষের মতো।

পিউ বললো,সরি,কিছু মনে করবেন না। বাজ পড়লেই ভয়ে আমি নিজের লোককে জড়িয়ে ধরি। আপনি আমার নিজের লোকের মতো বিশ্বস্ত। আপনার বাড়ি কোন গ্রামে। একটু চেনা চেনা লাগছে।

নবকুমার বললো,আমার বাড়ি অনেক দূর। কাটোয়া গ্রামে। তবে অফ সিজনেগঙ্গা নদীতে মাছ ধরতে আসি।তবে অনেকদিন থেকে নানা জায়গায় ঘোরঘুরি করি। আপনাকেও বেশ চেনা চেনা লাগছে। অনেকদিন পরে এদিকে এলাম তো। তাই হয়তো চিনতে পারছি না।

কথা বলতে বলতে দুজনেই চলে এলো গ্রামের কাছাকাছি। বৃষ্টি,ঝড়ে অনেক বড়ো বড়ো গাছ উল্টে পরে আছে। গ্রামে ঢুকেই ঢালাই রাস্তা। এবার পিউ বললো বাড়ি আসুন।জল খেয়ে যাবেন।

------ না না,এখন না।দেরি হলে ঘোষ মশাই বকবেন।মন্দীরে যাই।

---- ঠিক আছে, যাবার দিন কথা হবে কিন্তু।

---- ঠিক আছে দিদিমণি।

তারপর মন্দিরের পাশেই ঢুলির ঘর। মেঝেতে খড় আর সতরঞ্চি বিছানো। নবকুমার ঢোল নামিয়ে প্রথমে ঢোলটা মুছলো। ঢোলের সঙ্গে কথা বলছে, খুব ভিজে গেলি রে। এখন আওয়াজ বেরোলে হয়। তা না হলে বাবুরা বকবে। কাঁসিটা মুছতে মুছতে বললো,কাউকে বাজাতে দিয়ে দোবো। এখন আর কাউকে কাঁসি বাজাতে এনে পরতা হয় না। আলাদা কোনো টাকা নাই।

তারপর নিজের মাথা মুছলে। গা,হাত, পা সব মুছলো। গামছা দিয়ে ঢোলটা হাওয়া করতে লাগলো। বলছে,শুকো বাবা তাড়াতাড়ি শুকো। শুকনো হলেই আওয়াজ বেরোবে। বাবা,তবেই পয়সা মিলবে।

প্রায় দুঘন্টা হলো।খিদেতে নবকুমারের পেট চোঁ চোঁ করছে । এরপর আরতি বাজিয়ে তারপর খাওয়া হবে। প্রায় কুড়ি কিলোমিটার ট্রেনে এসে পাঁচ কিমি হেঁটেছে।

মন্দির থেকে পুরোহিত বললো,ঢুলি কাছে এসো। পুজোটা বাজিয়ে দাও। এরপর আরতি হবে। একটু পরেই আরতি শুরু হলো। একটা ছেলে কাঁসিটা নিজে থেকেই নিলো। ঘনা ভাবে ঢোলে আওয়াজ ভালো নেই। কাঁসিটা ভালো বাজছে। নাচতে নাচতে ঢোল বাজাচ্ছে। এমন সময়ে নবকুমারের পিউ দিদির সঙ্গে চোখাচোখি হলো। দিদিমণি নিশ্চয় আরতি দেখছে। ঢোলের তালে তালে নবকুমার গান ধরলো। পিউ ভাবছে, কি সুন্দর গলা। বাজায় ভালো। এর কতগুণ। শিল্পী লোক। পিউ জল নিয়ে মন্দিরে ঢুকলো। বাড়ি যাবার আগে বলে গেলো,দাদা যাবার সময় ভেতর বাড়ি যাবে। ঘনা বললো, নিশ্চয় যাবো। আজ রাত হয়ে গেছে।বাড়ি যান।

পরের দিন সকালবেলা বাড়ি বাড়ি ঢোল বাজিয়ে দশ টাকা, বিশ টাকা পেলো। আর গামছাভর্তি চাল,ডাল আর। মুড়ি পেলো। ভালো করে বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। তারপর ঘোষ বাবুর কাছে টাকা নিয়ে তাকে নমস্কার জানিয়ে বললো,বাবু এবার চামড়া ভিজে গেলো। তাই বাজিয়ে জুত হলো না। পরের বারে পুষিয়ে দোবো ভালো বাজিয়ে। ঘোষ মশাই বললেন, বায়েনের নামটা খারাপ কোরো না বুঝলে।

পিউ দা দা আসার পথ চেয়ে বসে আছে। সে ভাবছে, ও কি সুন্দর গান করে, আবার কত রকমের তাল জানে। পিউ পড়াশুনা করেছে। গুণী লোকের সম্মান দিতে জানে। সে কিন্তু প্রথম দর্শনে সুঠামদেহি নবকুমারকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু কি করে বলবে। এখন বাড়িতে কেউ নেই। যদি আসে বলে ফেলবো।এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরেছে।

এমন সময়ে বায়েন এসে দেখলো,দরজা বন্ধ। তবু ভাবলো, একবার দরজায় টোককা দি। যদি থাকে,একবার দেখা করে চলে যাবো।

------ ঘরে কেউ আছেন? কেউ আছেন। ঠক ঠক করে দরজায় আওয়াজ করলো ।

------ যাই, কে আপনি?

------ আমি বায়েন।

দিদিমণি বেরিয়ে এলো প্যান্ট পরে। বললো,এত দেরী কেনো,মাথা কিনে নিয়েছে নাকি?

-----; কি সব বলেছেন।

-----বোসো। এই বিছানায় বসো।

---- না, না তোমার বাবা  মা বকবেন। আমি ছোটো জাতের ছেলে। একি বলছো তুমি,না না

আপনি।

-------তুমিই বলবে আজ থেকে। আমি যা বলবো তুমি শুনবে।

------ আমার ওপর এত জোর কিসের তোমার।

---- বুঝতে পারচো না। তোমার গান,বাজনার প্রতি ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমাকে একা পেয়েও তুমি সুযোগের অপব্যবহার করো নি অসভ্যদের মতো। তোমার সহজ,সরল ব্যবহারে আমি মুগ্ধ। আমি নিজের জন্য তোমার। মতো সৎ ছেলের খোঁজে ছিলাম এতদিন। জমিদার বাবু আমাকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছেন।

এই বলে তাকে বিছানায় ফেলে খুব আদর করলো পিউ। সে বাধা দিলো কিন্তু  মেয়েটির ব্যবহারে  নির্বাক হয়ে গেলো।

পিউ বলে চলেছে,আমি তোমাকে ভালোবাসি।

সে চুপ করে রইলো

তারপর নবকুমার বাড়ি এলো। বাড়ি এসে টাকা পয়সা সব মায়ের হাতে দিলো। হাত, পা ধুয়ে নিজের ঘরে বসলো। তখনও তার হাত পা কাঁপছে। পিউকে সেও ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এ তো অসম আর্থসামাজিক প্রেম। সে  ক্লাস একটু পড়েছে। সে জানে তারা বিয়ে করলে সমাজ মেনে নেবে না। তথাকথিত শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পরবে। সে এটাও জানে সমাজের সেনাপতিরা বায়েনপাড়ার কাজের মেয়েদের বিছানায় তুলে পা চাঁটে। তবু তারা প্রকাশ্যে তার স্বীকৃতি দেবে না কিছুতেই। তাহলে তাদের মুখোশ খুলে যাবে। তাই সে মায়ের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বললো।

মা সন্তানদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। সব শুনে তার মা ছেলেকে একটা গোপন মন্ত্র শিখিয়ে দিলেন। মায়ের দেওয়া বুদ্ধিকে নবকুমার মন্ত্র বলে থাকে। এই মন্ত্র তাকে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করেছে।

তারপর ঝড়, বাদল পেরিয়ে অন্য ঋতু উঁকি মারছে। ঘরে ঘরে সোনার ধান গোলায় উঠছে। নবকুমার সকালে ঢোল বাজানো প্র্যাকটিস করে গান করতে করতে মাঠে গেলো। ধান কাটা,মাছ ধরা সব কাজ সে করে নিজের হাতে। মা কে কোনোদিন কাজ করার জন্য ধনীদের ঘরে পাঠায় না। সে ভাবে,সকলে তো নিজের কাজ নিজে করতে পারে। তাহলে একটা অবহেলিত সমাজ তৈরি হতো না। তার খুব খারাপ লাগে। অনেকে তাদের দাস পাড়াকে ঝিপট্টি বলে। ঝিপট্টি,বেশ্যাপট্টি সব নিজেদের প্রয়োজনে সৃষ্টি করে তথাকথিত সমাজপতিরা। তাদের ঝোলার জন্য গলার দড়ি জোটে না। এই ভেবে সে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো।

পিউ সাইকেল চালিয়ে বাজারে গেছিলো। কাউকে বাজার করতে দেয় না। পুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন মায়ের সমান জমিদার গিন্নি। আজ পিউ এর পায়ে একটা পাথর লেগেছে। ব্যাথা হচ্ছে। রাস্তার ঢালাই এর পাথরগুলো রাক্ষসের মতো দাঁত বের করে আছে। নামেই ঢালাই। আর হবে না কেন। যারা চেয়ার দখল করে বসে আছে তারা ঘুষ খাবে। তবে অনুমোদন দেবে রাস্তা তৈরি করার। তারপর যে তৈরি করবে সে খাবে। তারপর তলানি। এতে আর কি হবে।

ভিতরে ঢুকতেই পিউ এরবান্ধবী বললো,কি হলো পায়ে। পিউ বললো,ও কিছু না,একটু লেগেছে। সে বললো,যা করবি একটু দেখে শুনে করবি।

পিউ ব্যাগ রেখে তার প্রিয় বান্ধবী রীতাকে ফোন করলো। ওর সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একবার ওরা ভূত দেখেছিলো।পিউ এর বন্ধুদল বিরাট।

একবার ন্যাশানাল পাড়ার একটা বাড়িতে ভূত দেখেছিলো দুজনে। একটি বাচ্চা মেয়ে সামনে এসে বললো,একবার এসো আমাদের বাড়ি। আমার মা ডাকছে। রীতা বললো,তোর মা কে তো চিনি  না।

মেয়েটি বললো,একবার এসো না।

ওরা ভিতরে গিয়েছিলো। তারপর দেখলো মেয়েটা আর ওর মা হাত বাড়িয়ে নারকোল গাছ থেকে নারকোল পেরে আনলো। তারপর এক কিল মারলো। নারকোল ভেঙ্গে গেলো। তারপর রক্ত হাতে বললো,খা, খা।

ভয়ে ওরা ছুটে  বাইরে এলো। রীতা ও পিউ মামুদপুরের মেশোকে বলেছিলো ঘটনাটা। তিনিও ভয়ে পালিয়েছিলেন। মেশো তার আত্মীয় অমলকে ঘটনাটা বলেছিলো। অমল বন্ধুদের বলেছিলো। পিউ এর মনেআছে অমল ও তার বন্ধুরা সবাই আড্ডা মারছে।  এমন সময় অমল বলে উঠলো, জানিস ন্যাশানাল পাড়ার বনের ধারে যে তিনতলা লাল বাড়িটা আছে সেখানে নাকি ভূত দেখা গেছে।

মিহির বললো, তাহলে তোএকদিন সবাই মিলে গিয়ে দেখে আসতে হবে।

পিউ দোকান গেছিলো। সে বললো,টোটোনদা সত্যি আমরা দেখেছি ভূত নিজের চোখে। যা করবে সাবধানে কোরো আর পারলে ঘনাদাকে সঙ্গে নিও। ওর সাহস আছে।

টোটোন বলে উঠলো, তোরা খুব আজগুবি কথা বলিস।  আরে টোটোন থাকতে ভূতের বাপও বাড়ি ছেড়ে পালাবে। চল তাহলে একদিন দেখাই যাক।  আমরা সামনের অমাবস্যায় ওই বাড়িতে যাবো।  ফিষ্ট করবো।  মাংস আর লাল জল।  বুঝলি কিনা। জমবে ভালো।

চার


অমল বললো, শোন আসল কথাটা বলি। আমার মামুদপুরের মেশো একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো।  বিকালে ওই বাড়ির দিকে বেড়াতে গেছিলো।  একট বাচ্চা ছেলে কাঁদতে কাঁদতে মেশোকে বললো,  আমার খিদে পেয়েছে।  মামা জিলাপি কিনে ছেলেটাকে বললো, যাও খেয়ে নাও।

ছেলেটি নাছোড়বান্দা।  বললো, আমার বাবাকে দেখবে এসো।  কতদিন খেতে পায়নি।  এসো দেখে যাও।

মেশো সরল লোক।  মায়া হলো।  ভিতরে গিয়ে দেখলো বাবা নয়। এক ভয়ংকর স্কন্ধকাটা ভূত।  বললো, আমার গলা কেটে সবাইকে মেরে আমার সংসার শেষ করেছে তোর মতো একটা পাষন্ড।  আমি কাউকে ছড়বো না। কাটা মুন্ডুটা হাতে।  সেই মুন্ডুই কথা বলছে।

মেশো ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে।  এবার ভবলীলা সাঙ্গ ভাবছে মেশো।  এমন সময় ছেলেটি সামনে এসে বললো, বাবা এই লোকটি ভালো।  জিলাপি কিনে দিয়েছে। এই বলে ছেলেটি উড়তে উড়তে জিলাপি খেতে লাগলো। উড়ন্ত অবস্থায় ছেলেটির মা বললো,  এঁকে ছেঁড়ে দাঁও।  যাঁও যাঁও।  জিঁলাপি খাঁও।

তখন সুযোগ বুঝে মেশো পালিয়ে এসে বাঁচে।

টোটোন ভয় লুকিয়ে বাতেলা দিলো অনেক।  বললো, ঠিক আছে আমরা কুড়িজন একসাথে যাবো ওই বাড়িতে।  দেখা যাবে।  কত ধানে কত চাল। তবে কিছু অস্ত্র সঙ্গে নিস বাবা।

চালাক টোটোন।  তাই দল বাড়াচ্ছে। ঠিক হলো কুড়িজন বন্ধু একসাথে যাবে। অনেক ছেলের মাঝে নিশ্চয় ভূত আসবে না।

মাঝের কয়েকদিন যে যার কাজ নিয়ে থাকলো।  তারপর এসে গেলো সেই অপেক্ষার অমাবস্যা। দিনের বেলায় সবকিছু কেনাকাটা সেরে সবাই দুরু দুরু বুকে রাতের প্রতিক্ষায়।  কিন্তু কেউ ভয় প্রকাশ করছে না।  বাড়িতে কেউ বলে নি।  সবাই বলেছে, আজ একজন বন্ধুর জন্মদিন।  রাতে বাড়ি আসবো না।  ওখানেই সব ব্যবস্থা।

রাতের বেলা ন্যাশানাল সিনেমা হলের কাছে সবাই একত্র হলো।  সবাই চললো এবার সেই অভিশপ্ত বাড়িতে।  টোটন চুপ।  কোনো কথা নেই।  অমল বললো, কি রে টোটোন, চুপ মেরে গেলি কেন?  কথা বল।

টোটোন বললো, এই দেখ আমার অস্ত্র। একটা মস্ত নেপালা বের করে দেখালো।  তারপর বললো, ভূতের দফা রফা করবো আজই। 

কথায় কথায় বাড়িটা চলে এসেছে কাছে।  অমল বললো, চল ভিতরে ঢুকি। নবা বললো, তোরা যা, আমার কাজ আছে। তবে অই বাড়িতে ভূত আছে। পিউ আর রীতা আমাকে বলেছে। যাস না বাড়ি যা।  ঘনাকে কেউ রাজী করাতে পারলো না। ঘনাকে পিয়ালী আড়চোখে দেখলো। মনে মনে ভাবলো, কি সুন্দর চেহারা ছেলেটার।

দুজন লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো।  বললো, মরতে যেচো কেনে ওই বাড়িতে?  খবরদার ওই দিকে মাড়িয়ো না।  গেলেই মজা টের পাবে।

এখন আর ফেরার কোনো ব্যাপার নেই। হুড়মুড় করে সবাই ঢুকে পড়লো বাড়ির ভিতরে। তারপর মাকড়সার জাল, ধুলো পরিষ্কার করে রান্না শুরু করলো।  এখনও অবধি কোনো ভৌতিক কান্ড ঘটে নি।  ভয়টা সকলের কমে গেছে।

টেটোন বললো, অমল তোর মেশোর গাঁজার অভ্যাস আছে নাকি?

সকলের সামনে অমল একটু লজ্জা পেলো। তারপর ভাবলো, বন্ধুরা একটু ইয়ারকি মারে।  ওতে ইজ্জত যায় না।

টোটোন এক পিস কষা মাংস নিয়ে লাল জলে মন দিয়েছে।  সে এই দলের নেতা।  সবাই অলিখিত ভাবে তাকে মেনে নিয়েছে নেতা হিসাবে।  নেতা কষা মাংসতে কামড় মারার সঙ্গে সঙ্গে কষ বেয়ে লাল রক্ত।  বোতলে রক্ত ভরতি।  সবাই দেখতে পাচ্ছে কিন্তু নেতা দেখতে পাচ্ছে না।  নেতাকে রক্ত মাংস খাওয়া ভূতের মতো লাগছে। 

অমল কায়দা করে তাকে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করালো।  নেতা নিজের রূপ দেখে ভয়ে বু বু করতে লাগলো।  সবার প্রশ্ন এত রক্ত কোথা থেকে এলো?নেতা অজ্ঞান  হয়ে গেলো।

তাকে জল দিয়ে জোরে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে লাগলো বন্ধুরা।  তারপর জ্ঞান ফেরার পরে আবার ভয়ের পালা।  রাত তখন দশটা। দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেলো।  আর চার দেওয়ালের গা বেয়ে নেমে আসছে রক্তের ধারা। এত রক্ত যে মেঝে দিয়ে গড়িয়ে সকলের পা ভিজে যাচ্ছে।  নেতা এবার জোড় হাত করে বলছে, আমাদের ছেড়ে দাও, এই কান মুলছি, নাক মুলছি আর কোনোদিন এই বাড়িতে ঢুকবো না। দয়া করো আমাদের দয়া করো।

তখন আড়াল থেকে কথা শোনা গেলো, তুই তো নেপালা এনেছিস।  সবাই দেখলো নেপালা নিজে থেকেই শূণ্যে ভাসছে।  তারপর ভূত হাজির।  নেপালা একবার ভূতের মাথা কাটছে আর জোড়া লেগে যাচ্ছে।  বলছে, আমাকে কাটবি।  মাথা কাটবি।  তোর মাথা কাটি। নেতা ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে।

তখন অমল বললো, আমরা তোমার সাহায্য করবো। কে তোমাকে মেরেছে বলো।  আমরা পুলিশকে জানাবো।  সে শাস্তি পেলে নিশ্চয় তোমার আত্মার শান্তি পাবে। কথায় কাজ হলো সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেলো।  রক্ত মুছে গেলো।  আর একটা ছবি হাওয়ায় উড়ে এলো।

টোটোন ছবি দেখে বললো, একে আমি চিনি।  নিশ্চয় একে পুলিশে দেবো।  আমরা কুড়িজন সাক্ষী দেবো। তারপরে পুলিশ সব দায়িত্ব পালন করেছিলো।  সেই বাড়ি এখন পুলিশ থানা। চাকরি পেয়েছে কুড়িজন সাহসী ছেলে।  যাদের চেষ্টায় খুনী ধরা গেছে।  আর অতৃপ্ত তিনটি আত্মা মুক্তি পেয়েছে। নবকুমার পিসীর বাড়ি বেড়াতে এলেই পিউ এর সঙ্গে অনেক ধনী লোকের ছেলেদের দেখেছে।

নবকুমার ভূতে বিশ্বাস করে। ও সহজ সরল ছেলে। ঝামেলার মধ্যে ও নেই। আর ওর বাড়ি অনেক দূরে। সেদিন ঢোল সারাতে এসে ওদের সঙ্গে দেখা। নবকুমারের পিসীর বাড়ি এই গ্রামে।

নবকুমারের সাথে এই গ্রামের ছেলেমেয়েদের  দু একবার কথা হয়েছে। কিন্তু খুব বেশি নয়। তারপর পরিচয় হওয়ার পর জানতে পেরেছে দুজনেই। প্রায় এক বছর পরে ওদের দেখা। প্রথম দর্শনে কেউ বুঝতে পারে নি। পিউ হঠাৎ করে নবকুমারকে ভালোবাসে নি। ভালোবাসার সুপ্ত বীজ পিউ এর অন্তরে গেঁথে গেছিলো অনেক আগে  থেকেই। সে নবকুমারকে চিনতে না পারার ভান করেছিলো।

নবকুমার ভাবে চিনতে না পারাই ভালো। ওরা ধনী।তারপর আবার উঁচু জাত। ভালোবাসলে সমানে সমানেই ভালো। সমাজের নিয়ম আগে।পিসী আগেই সাবধান করে দিয়েছেন।

মাঝে মাঝে নবকুমার জাল নিয়ে গঙ্গা নদীতে মাছ ধরতে যায়।

পিউ তার বান্ধবী রীতাকে নবকুমারকে ভালোবাসার কথা অকপটে বলেছে। রীতা বলছে,তাই হয় নাকি? একটা বায়েনের ছেলের সঙ্গে প্রেম। ঘামের গন্ধে দেখবি বমি আসবে।

পিউ বললো,ফালতু বকিস না। ওসব আমি বুঝবো। তুই আমার সঙ্গে আগামীকাল যাবি গঙ্গার ধারে। আমিও নবকুমারকে ফোনে জানিয়ে দেবো। কাল ফাইনাল। আর দেরী নয়।

রীতা বললো,এখনও সময় আছে।সরে পরো, তা না হলে জল অনেক দূর গড়াবে। সামলাতে পারবি তো।

পিউ বলে,সময় বুঝে সব ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।

তারপর দুজনে যে যার বাড়ি চলে গেলো।

বাড়ি গিয়ে রীতা পিউ এর জন্য খুব চিন্তা করতে লাগলো।  একবার পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা  বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য।

গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম,একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি। পিউ যাবা না।

--- একটা তো, কিছু হবে না।

----- যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।

তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম আমি আর পিউ।

গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।

মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন,প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল। পিউকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের আদেশ পালন করলাম।

জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।

তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে।

বড়দা বললেন,অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ।

মানা পিসি বললেন,চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন,সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।

তামাল দা মাকে বললো,দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।

মা বললেন,যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।

মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে

তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো?  তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।

শ্মশান দেখলাম। গঙ্গার ঘাট দেখলাম। আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়।কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে।জাতিতে জাতিতে,বললেন গোপাল কাকা।

এই  মেলায় গঙ্গা এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্ম মৃত্যুর অনেক ছবি।

আমার ঈশ্বর,আমার অনুভব,ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের  শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।

দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন,থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।

তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়,স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।

সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।

তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে। আমি আর পিউ অনেক পুঁথির মালা কিনেছিলাম। সেগুলো সোনার গয়নার কাছে কোনো অংশে কমদামী ছিলো না সেই স্মৃতি আজও বাক্সবন্দী হয়ে আছে। আবার কোনো কিশোরী বন্ধবাক্স খুলে ফেললে মেলার আনন্দ নতুন করে পাবে।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন,তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে,হুট্ হুট্,,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন,বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।

হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন,ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।

তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে,আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে  নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন,অন্যায় করবি না,আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।এই বলে মা দাদুর গল্প শোনাতে শুরু করলেন। আজও মনে আছে আমার সেইসব কথা।

সেই বান্ধবী বাড়িতে  না জানিয়ে এক ভিন্ন জাতির ছেলেকে বিয়ে করবে,এই সত্যিটা সে মেনে নিতে পারছে না। ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে গেলো। আর একটু পরেই বেরোতে হবে পিউ এর সাথে আর ফিরে আসবে একা। পিউয়ের বাবা মাকে কি জবাব দেবো। এই মুখ  কি করে দেখাবো। মোবাইল বেজে উঠলো। মা কে বলে রীতা বাইরে নির্দিষ্ট জায়গায় গেলো।

দেখলো সোনা দানা পরে শাড়ি ঢাকা দিয়ে বাবা মা কে না বলে পিউ চিরদিনের মতো চলে এসেছে বাইরে।

গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে দুই বান্ধবী বসে আছে। তির তির করে জল বয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছ জলে বালি দেখা যাচ্ছে। দাঁড়কে মাছগুলো সুন্দরীদের পায়ে চুমু খেয়ে যাচ্ছে। রীতা বললো,বেজাতে বিয়ে সমাজ মানবে না রে। পিউ বললো,রাখ তোর জাতপাত। সমাজের সেনাপতিরা যখন কাজের মেয়ের পা চেটে খায় বিছনায় তখন জাত কোথায় পালায়? সমাজের প্রতি এই রাগ রীতারও আছে।

এবার ওরা জাল কাঁধে নবকুমারকে দেখতে পেলো। পিসীর বাড়ি এলেই সে আসে গঙ্গায়।কাছে এলে পিউ বললো,এই দেখো সব সোনার গয়না পরে পালিয়ে এসেছি। জমিদার গিন্নি দিয়েছেন।তিনি আমার মায়ের মত।

কেমন লাগছে আমাকে। নবকুমার বললো,তোমাকে রাজরাণীর মতো লাগছে। রীতা বললো,তুমি খালি গায়ে কি করে বিয়ে করবে?

সে জাল নামালে। শরীর তার শক্তপোক্ত। তার চেয়ে শক্ত তার মন। সে বললো,আমি একটা কথা বলতে চাই।

পিউ বললো,আবার কি কথা?

নবকুমার বললো,এই নদী সাক্ষী। আপনারা দুজনেই শুনুন। ভুলকুড়ি গ্রামের রাস্তার ধারে মীনা বলে একটা মেয়ের বাড়ি ছিলো। আমরা ছোটোলোক ঘরের। ভালোবেসে ফেললাম মীনাকে। দুদিনের মেলামেশার পরে মীনা গর্ভবতী হলো। আমি তাকে বিয়ে করলাম। মীনা মৃত সন্তান প্রসব করলো। তখন আমি কেমো থেরাপি চালিয়ে যাচ্ছি। গাঁজা,মদ কোনো কিছু বাকি ছিলো না। তারফলে মারণ ব্যাধি বাসা বাধলো শরীরে। গত পরশু পি জি হসপিটালে গেলাম। ওরা আমাকে পাঠালেন চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হসপিটালে। বাড়াবাড়ি দেখে এই ব্যাবস্থা। তারা জানিয়ে দিলেন আমার জীবনের মেয়াদ আর ছয়মাস। এখন আমি কি করি বলুন। আমি পিউকে ভালোবাসি। তাই এই ছয়মাসের মধ্যে আমি পিউ কে বিবাহিতা দেখতে চাই। আর কিছু আমার বলার নেই। পিউ কান্না শুরু করেছে। কিছুতেই রীতা তাকে থামাতে পারছে না। পিউ যখন মুখ তুলে তাকালো ততক্ষণে নবকুমার অনেক দূরে চলে গেছে।

যেতে যেতে নবকুমার ভাবছে, মায়ের দেওয়া মন্ত্রটা ভালোই কাজ দিয়েছে। গিয়ে মাকে একটা প্রণাম করতে হবে। ওই মন্ত্র ছাড়া অসম প্রেমের শক্ত শেকল ছেঁড়া যেতো না....

পাঁচ


সুনীল ও প্রিয়ার  কন্যা মানসী  ছোটো থেকে লেখা পড়ায় খুব ভালো ।যখন ও জন্মগ্রহণ করেছিলো তখন বাড়িতে তাদের আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিলো । শঙ্খ ধ্বনি আর প্রতিবেশী দের মিষ্টান্ন বিতরণের মধ্যে জন্ম পর্ব এক উৎসবের সাজে সজ্জিত হয়েছিলো ।

তারপর ধীরে ধীরে মা বাবার আদরে বড় হতে লাগলো মানসী । সাফল্যের সিঁড়ি একের পর এক পেরিয়ে মানসী সকলের মনের মণিকোঠায় স্থায়ী আসন লাভ করেছিলো ।

এবার আঠারো বছরে পড়েছে মানসী । পূর্ব স্থলী কলেজে ভর্তি হবে ।মানসী আজ খুব ব্যস্ত ।

___বাবা আমার ব্যাগটা দাও তো ।

_,ট্রেন কটায় রে মামণি

_,_,দশটা দশে ..

__তোর মাকে আজ সঙ্গে নিয়ে যা

___,না বাবা , আমি বন্ধু দের সাথে ঠিক চলে যাবো ।

মানসী বেরিয়ে যাবার পরে মা বাবার খুব চিন্তা বেড়ে গেলো । কোনোদিন এত দূরে যায় নি ।

যাইহোক ঠিক পাঁচটার সময় মানসী বাড়ি ফিরে এলো ।

____এবার ও একা সব কাজ করতে পারবে বুঝে ছো।

___হ্যাঁ ঠিক বলেছো ।

মানসীর বাবা মা কথা বলে চলেছে । মানসী ওঘরে  পড়ছে ।

বেশ সুন্দর ভাবে দিন কেটে যাচ্ছিলো । সকলের বিপদে আপ দে মানসী উদার মনে ঝাঁপিয়ে পড়তো  ।সকলেই তাকে কন্যা শ্রী বলে ডাক তো ।

ক্যারাটে চ্যাম্পিয়ন হিসাবে কন্যাশ্রী পুরস্কার ও পেয়েছে মানসী । আর এবার আঠারো বছরে পাবে সমাজ সেবার জন্য বিশেষ পুরস্কার ।

রমেন ও রজনীর মেয়েকে নিয়ে খুব গর্ব । কজনের  ভাগ্যে এমন কন্যা রত্ন জোটে ।

কিন্তু চিরদিন সুখ দুঃখ চক্রাকারে পাক খায় ।

আজ ১৫ই আগষ্ট । মানসীর কলেজে উদযাপন হবে এই দিনটি । মানসী আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান আকর্ষণ । আজ সমাজ সেবার জন্য বিশেষ পুরস্কার তাকে দেওয়া হবে । মানসীর বাবা ও মা আজ কলেজে এসেছে।

 __দেখো আমাদের মানসীকে আজ ভারত মাতার মতো লাগছে ।

 ___,হ্যাঁ ঠিক বলেছো ।

মানসীর বাবা ও মায়ের চোখে আনন্দের অশ্রু । আজ তাদের স্বপ্ন সফল । মেয়ে তাদের আজ সত্যিকার মানুষ হয়েছে ।

অনুষ্ঠান শেষে মানসী বাবা মার কাছে এসে প্রণাম করলো । মাইকে  তখন ঘোষণা হচ্ছে, এবার বক্তব্য রাখবেন মানসী হাজরা ।

মানসী স্টেজে উঠে বললো, মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে । মানুষের মত মানুষ  হতে হবে । কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করলে হবে না । প্রতিবাদ করা শিখতে হবে । সমাজ সেবার জন্য জীবন পণ করতে হবে ।...

মানসীর বাবা মা শুনছে মন দিয়ে মানসীর কথা । প্রিয়া বলছেন ,বড় ভয় হয় মেয়েটার জন্য । কি যে হবে জানি না ।

সুনীল বলে, না না দেখো ও একদিন মস্ত  বড় হবে ।

 তার পর মানসী বাবা মা কে নিয়ে  পাঁচ টা পাঁচের  লোকাল ধরতে স্টেশনের পথে রওনা হলো ।

 স্টেশন পৌঁছে তারা দেখলো মানসী পাগলের মত ছুটছে । সুনীল ডাকছে, কি হলো  , ছুটছিস কেন?

 মানসীর বাবা ও মা মেয়ের পিছু পিছু ছুটছে । তারা দেখলো আত্মহত্যা র জন্য একটা মেয়ে লাইনের উপর শুয়ে আছে। ট্রেন কাছাকাছি এসে গেছে । তাকে সরিয়ে মানসী ওপাড়ে লাফ দিলো । এই মেয়েটাকে ওরা ধরে ফেলেছে কিন্তু মানসী কোথায় ।

তারপর ট্রেন চলে গেলে ওরা দেখলো মানসীর ছিন্ন ভিন্ন শরীর । মানসী আর বেঁচে নেই । নিজে মরে গিয়ে একটা প্রাণ বাঁচিয়ে গেলো ।

মানসীর মৃত খন্ড খন্ড শরীর দেখে তার বাবা,মা দুজনেই জ্ঞান হারালেন ।

মেয়েটি চিৎকার করে লোকজন ডাকতে শুরু করলো । প্রচুর লোকজন এই মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো ।

 পুলিশ যথাসময়ে তাদের কর্তব্য সমাপন করলেন । মানসীর টুকরো শরীর দাহ করলেন এলাকার সমস্ত শোকস্তব্ধ অধিবাসী বৃন্দ ।

 মেয়েটিকে সুনীল এবার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কি?

___আমার নাম শুভশ্রী

 ____তুমি কেন মরতে চাইছো

 ____আমার কেউ নেই । দুজন শয়তান আমাকে অত্যাচার করেছে, তাই আমি আর এ জীবন রাখতে চাইছি না ।

 ____তা হলেই কি সব সমস্যা র সমাধান হবে ।

 ____না, আপনার মেয়ে আমার জীবনের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে । আমি পড়াশুনা করে বড় হয়ে এর জবাব দেবো

 তারপর সুনীল যুক্তি করে শুভশ্রীকে লিলুয়া হোমে দিয়ে এলো । সমস্ত খরচের দায়িত্ব নিলো রমেন ।

 কিন্তু বাড়িতে তাদের মন মানে না । দেওয়ালে দেখে মানসীর নাম খোদাই করে লেখা । ঘরে তার বই পত্তর, পোশাক আসাক । সবেতেই মেয়ের দেহের ঘ্রাণ ।

 আজ এক বছর হয়ে গেলো তারা দুজনেই মেয়ের শোকে চোখের পাতা বুজতে পারে নি । জীবন অর্থ হীন , ফালতু হয়ে পড়েছে । শুধু মেয়ের শেষ কথাটাই. মনে পড়ে, মানুষের জন্য জীবন পণ করতে হবে ।

 ____কি কর লি  মানসী ,,একবার আমাদের কথা মনে কর লি না__এই কথা বলে রোজ রজনী কেঁদে যায় প্রতি ক্ষণে ।

আর রমেন তো উচ্চ স্বরে কাঁদে না । তার মর্মভেদী নিঃশব্দ আর্তনাদ অন্তরের গভীরে জমা হয়ে এক শোক সমুদ্র তৈরী করে । যার তল পাওয়া সাধারণ লোকের বাইরে । লোকজন দেখলে এড়িয়ে যায় ।

 সবাই তাকে দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারে না । কালচক্র তো থেমে থাকে না । বছরের পর বছর চলে যায় কিন্তু মনের মানসী তার বাবা মায়ের মন থেকে যায় না ।

 আজ আবার স্বাধীনতা দিবস । সকাল সকাল সকলে তৈরী হয়ে স্কুল কলেজে ছুটি লাগিয়েছে ।হঠাৎ শুভশ্রী র ভিডিও কলে মনের রজনী ঘুচলো রজনীর । মোবাইলে জানতে পারলো আজ কলেজে মাননীয় মন্ত্রী মহাশয় শুভশ্রী কে কন্যা শ্রীর পুরস্কার দেওয়া হবে । তাই তাদের দুজনকেই যেতে হবে কলেজে ।

 খুব তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে দুজনেই কলেজে গেলো । মন্ত্রী মহাশয় এসে গেছেন ।ওরা দুজনেই দেখছে শুভশ্রী মানসীর সাজে সজ্জিত হয়ে বসে আছে । দুজনের মুখেই হাসির ঝিলিক ।

 রজনী বলছে, দেখ দেখ মানসী ফিরে এসেছে। ও এবার পুরস্কার নেবে । রমেন রজনীর মাথা কাঁধে নিয়ে কেঁদে চলেছে ।

ঠিক তখনই মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, এবার সমাজ সেবার জন্য শ্রেষ্ঠ কন্যার পুরষ্ককার পাচ্ছেন শুভশ্রী ।ওরা  আপন খেয়ালে তখনও শুনে চলেছে,এবারের শ্রেষ্ঠ কন্যা মানসী ।

ছয়


এদিকে অজয় তীরে নেমে এলো সন্ধ্যা চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকারে প্রকৃতি ছিল ঢাকা। কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু দেখা যায় আকাশের তারা, অগুন্তি তারা। তবু তার মধ্যেই চলে সময় প্রবাহ। আবার সকাল হয়। কলরবে মেতে যায়,গ্রাম। আর পাশের এলাকার,  পুরুলিয়ায় মুসলমানের বসতি কম। তবু কেতুগ্রাম রাউন্দী এলাকায় মুসলমান বসতি আছে। বিভিন্ন গ্রামের মুসলমান পাইকার আসে। তারা ভুলকুড়ি,  দক্ষিণ দিকে কোপা, কোমডাঙ্গা  গ্রাম থেকে গরু ছাগল নিয়ে কেনাবেচা করে।  এদিকে প্রবাহিত হয় অজয় নদ সময়ের তালে তালে।

ফলে হিন্দু মুসলমান  আত্মীয়-স্বজন এখানে। মুসলিম পাড়ার নদের জল মিলিত হয় হিন্দু পাড়ার নদের জলে।  তারা একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার সম্পর্কে।

 খুব সুন্দর পরিবেশে বড় হয়েছে নুর আলি । আর   স্বপনও নুর আলির বন্ধু।

 বাবার সঙ্গে ছোট থেকেই নুর আর স্বপন নিজেদের চাষের জমিতে যেত এবং চাষবাস দেখাশোনা করত। মধ্যবিত্ত পরিবার। অভাব থাকলেও সংসার চলে যায় কোন রকমে তাদের।

 সকালে মাঠে যাওয়ার পথে পা দিতেই স্বপনের ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে গিয়ে চনমনে লাগে ঘড়িতে তখন ভোর চারটে, সমস্ত গ্রামটা যেন নিষ্পাপ শিশুর মত লাগে।

 স্বপন হালদার বয়স 25। গ্রাজুয়েট হয়েছে হাওড়া নরসিংহ দত্ত কলেজ থেকে। টিউশানি করে চুটিয়ে।

 গ্রামে থেকে চাষবাস দেখাশোনা করা, টিউশনি করা তার পেশা। বাবা মারা গেছেন দু বছর আগে বাড়িতে মার ছোট ভাই আছে।

 স্বপনের অনেক বন্ধুর মধ্যে কেতুগ্রামের নুর আলি অন্যতম প্রধান বন্ধু। বাড়ি আসে আবার সময় পেলে ওদের বাড়ি যায় স্বপন।  আসলে নুর আলির বাবার বন্ধু ছিলেন স্বপনের বাবা।  এইভাবে হিন্দু-মুসলমানের পরিবার বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।

 কবি নজরুল লিখেছিলেন, "আমরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।"

 স্বপন আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে গিয়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গান গাইতে গাইতে।  " যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু এ জীবনে" গাইতে গাইতে যাচ্ছিল!

 হঠাৎ মর্নিং ওয়াক করতে যাওয়া সুনীলের মেয়ে শুভশ্রীর সঙ্গে দেখা।

সে বলল স্বপনদা মাঠে যাচ্ছ আজ একবার আমাদের বাড়িতে যেও ইংরেজিটা দেখিয়ে দেবে। বাড়িতে বাবা আছেন।

 বেগুনি আর মুড়ি খেতে খেতে স্বপন আর  শুভশ্রী কথা বলছিল। পাশের ঘরে তনুর বাবা-মা  জানে ওদের প্রেমের কথা।

 ওদের দুই পরিবারের মধ্যে মিলনে কোন বাধা নেই। সকালে মুড়ি খাওয়ার পর হাত ধুয়ে শুভশ্রী সামনে বসল বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে  পনেরোই কার্তিক মাস। নদীর জলে ভরা ঢেউ লাগলো, কেঁপে উঠলো শরীর বাঁশি।

 দুজনেই বিয়ের আগেই মিলনের অপূর্ব স্বাদ মিটিয়ে নিল।

বিধাতার খেলা। কখন যে কার কি হয় কেউ বলতে পারে না।

 সেদিনের সেই ঘটনার পরে স্বপন বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে।

শুভশ্রী বলল, সাবধানতা অবলম্বন না করায়  মা হওয়ার লক্ষন প্রকাশ পেয়েছে আমার দেহে, স্বপনদা চল আমরা বিয়ে করে নিই।

বিয়ে  হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তনুর দাদু মরে যাওয়ায়  বিয়ের দিন ঠিক  হল এক বছর পরে। এদিকে তো চিন্তায় পরলো স্বপন আর তনু।

তবুও স্বপন বলল,আমি মন্দিরে নিয়ে গিয়ে তোমার সঙ্গে মালাবদল করে নেব।

স্বপন খুব ভোরে মাঠে গিয়েছে।নিজে গিয়ে জমিতে আল বেধেছে। অভ্যাস নেই।তবুও চেষ্টা করছে । এবার সংসার হবে,ছেলেমেয়ে হবে।দায়ীত্ব বাড়বে।সব ঠিকই কিন্তু মুনিষ দিয়ে বেশিরভাগই কাজ করায় বলে তেমনভাবে কাজ করতে পারে না ।কিন্তু ওর ইচ্ছে সব কিছু  নিজে চাষ করে ফসল ফলানো।

তার মজাই আলাদা।একমাত্র কৃষক ছাড়া কেউ তা অনুভব করতে পারে না। কৃষকের জয় হোক।ছাত্রদের এই বাণী স্বপন শেখায়।

আল বেঁধে দেওয়ার সময় হঠাৎ কি করে কি যেন একটা কামড়ে দিলো স্বপনের আঙুলে। খুব জ্বালা করছে রক্ত পড়ছে। শব্দ না করে কেতুগ্রাম হাসপাতালে গেল স্বপন সাইকেলে চেপে। সাইকেল চালাল নুর। সে পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল।

 কিন্তু কেতুগ্রামে সাপে কাটা রোগীর কোন চিকিৎসা হয় না। সেখানে সাপে কামড়ানোর ওষুধ নেই যদি পাওয়া যেত ভালো হতো। তা শোনা মাত্রই তাকে ভ্যানে করে কাটোয়া হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই সে পথে মরে গেল বোধহয়, নুর আপনমনে বলল। সিওর হল হাসপাতালে গিয়ে। ডাক্তারবাবু  তাকে দেখে মৃত ঘোষণা করল।

 মানুষ ভাবে এক আর হয় অন্যরকম শুভশ্রী এই খবরে খুব ভেঙে পড়ল গর্ভে সন্তান আর বিয়ের আগেই স্বপন তাদের ছেড়ে চলে গেল।খুব রাগ আর অভিমান হল স্বপনের উপর একটা আম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগল ঘন্টার পর ঘন্টা বাড়ি আর ফিরে যাবে না সে আত্মহত্যা করায় ঠিক করলো সে।কুমারী গর্ভবতী।  যদিও সে জানে কুমারী গর্ভবতী সুপ্রিমকোর্টের এক রায়ে, সন্তানের একমাত্র অভিভাবিকা হতে পারে। তবু মন এখনো পুরোপুরি সংস্কারমুক্ত নয় মানুষের।তবুও সে শিবলুনে ট্রেন ধরল।  কাটোয়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে কাটোয়া গঙ্গার ধারে এল।কিন্তু গঙ্গার ঘাটে দিনের আলোয় অনেক মানুষের আনাগোনা।

 তাই শুভশ্রী অন্ধকার হওয়ার জন্য বসে প্রতীক্ষা করতে লাগল। আর চিন্তা করতে লাগল, স্বপ্নে ভালোবাসার কথা, কত ভালোবাসতো তাকে।

 সে আদরে সোহাগে ভরে তুলেছিল অন্ততর। অল্প সময়ে চলে যাবে বলে হয়তো এত তাড়া ছিল। ভাল লোকের স্বর্গীেও প্রয়োজন হয়।তাই ঈশ্বর বোধহয় ভালো লোককে বেশিদিন পৃথিবীতে রাখতে চান না কিন্তু কি দায়িত্বজ্ঞানহীন এর মত চলে গেল সে, তনু বিড়বিড় করে পাগলের মত।

 এসব চিন্তা করতে করতে শুভশ্রী ঘুমিয়ে পড়েছিল ক্ষুধায় ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে।

 হঠাৎ যখন ঘুম ভাঙলো দেখল নুরআলি সামনে দাঁড়িয়ে। চোখে অশ্রু এসেছিল।

নুর বাজার করতে এসে দেখে শুভশ্রীকে ঘুমিয়ে আছে।আর গঙ্গার ধারে নুরের  এক আত্মীয় বাড়িতে দেখা করে করে একটু বেড়াতে এসছিল এদিকে। তাই দেখা হল,এই মুহূর্তে।।

 বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগল নুর কিন্তু কিছুতেই রাজি নয় শুভশ্রী। সে লাফ দিতে চেষ্টা করছে গঙ্গায়।  অবশেষে বাধ্য হয়ে  থাপ্পড় দিল তার গালে, নুর।

 শুভশ্রী বলল, আমি স্বপনের সন্তানের  মা হতে চলেছি

,এই খবর নুরকে জেনে বলল, তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে আমি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারি। আমার এক বন্ধু রাজি হবে আশা করি।সমস্ত সংবাদ জানিয়ে তনুর বাবাকে একটা ফোন করল।

তনু বলল, আমি কাউকে ঠকাতে পারব না।

নুর বলল,তাহলে আমি নিজে স্বইচ্ছায় ঠকতে রাজী।

 চল আজ আমরা বহরমপুরে যাব। ঘরভাড়া নেব। সংসার করব চুটিয়ে।

আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী হলে। তনু বলল, এটা কি করে সম্ভব। তুমি ভাল ছেলে। আমার কলঙ্ক তুমি বইবে কেন? 

নুর বলল, এ কলঙ্ক কালো নয়। আমি তোমার মধ্যে আলোর বিজুলি দেখেছি। তুমি মা হও স্বপনের স্বপ্ন পূরণ কর।

তনু ভাব আকাশে দেখল, নুর আলি আর স্বপন একসাথে পাশাপাশি তার সাথে ছাতা ধরে চলেছে কঠিন জীবনের চড়াই  উৎরাই পথে...

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment