1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, August 15, 2022

রজ্জু র ফাঁস

ছবি : ইন্টারনেট

রজ্জু র ফাঁস 

সোমনাথ মন্ডল

চারিদিক খাঁ খাঁ একটি মাঠ;একেবারে নিস্তব্ধ।গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে মাঠ একেবারে তপ্ত হয়ে উঠেছে।থেকে-থেকে ও বাড়ির চম্পাদের গরুটি কেবলই দুই একবার ডাক দিয়ে উঠছে হাম্বা বলে।চারিদিক ফাঁকা মাঠের মধ্যে ছিল একটি মাত্রই শিমুল গাছ।পাশেই ভেঙে পড়া হাড় জিরজিরে একটি ভগ্নপ্রায় অট্টালিকা,প্রাচীনত্বের ছাপ তার গায়ে চির দৃশ্যমান;চারপাশ দিয়ে লতাপাতা-আগাছা যেন সন্তর্পণে নিজেদের অধিকার টুকু বিস্তার করে রেখেছে ওই অট্টালিকাটির উপর,চুন সুরকির প্রলেপ ধসে পড়েছে ইটের গা থেকে।রাতের অন্ধকারে অট্টালিকাটিকে ঘিরে এক ভৌতিক পরিবেশ এর সৃষ্টি হয়।অন্ধকারের সাথে চাঁদের ক্ষীণ জোৎস্না ও পাল্লা দিয়ে অট্টালিকাটিকে আরও রোমহর্ষক করে তোলে।কেবলই গা ছমছম করে উঠে,তাই রাত্রে ওই মাঠের রাস্তা দিয়ে লোকজন খুব একটা চলাচল করত না ।দেখা যায় রাতের অন্ধকারে ক্ষুধার্ত শিয়াল গুলো বেরিয়ে পড়ে শিকারের খোঁজে।মাঝে-মাঝে ওই অট্টালিকাটির ভেতর থেকে একটা বিকট শব্দ করতে করতে ঝাঁকে ঝাঁকে কিছু বাদুড় বেরিয়ে আসে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে।আর ঐ শিমুল গাছেটির উপর গিয়ে বসে।শোনা যায় এই গাছ নাকি বহু পুরানো।অতীতে কোনো এক জমিদারের খাস জমি ছিল এটি,অনুমান করা হয় হয়তোবা তিনিই এই গাছটিকে কোন একটি সময়ে এই জায়গাটিতে রোপণ করেছিলেন।গাছটিকে নিয়ে দূর-দূরান্তের গ্রামের মানুষজনের মধ্যে একটা কৌতুহল রয়েছে।বেশ নধর হৃষ্টপুষ্ট তার চেহারা,যাকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় স্বর্গের কোন এক অপ্সরা নৃত্যের ভঙ্গিতে আপন গরিমায় আকাশপানে মাথা তুলে ভূতলে সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

          বছর পাঁচ-ছয় আগে এই জায়গাটি কে ঘিরে এক বিশাল মেলা বসতো।স্বাভাবিকভাবেই মেলার সেই দিনগুলোতে ওই জায়গাটি আলোর রোশনাই ভরে উঠত, রংবেরঙের পোশাক পড়ে দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে ছোট-বড় সবাই এসে ভিড় করত মেলাটিতে।মাঠটি কে  অনেকেই জমিদার তলার মাঠ বলেই চেনে,এক সময় এই জায়গাটিতে জমিদারের’ রাজত্ব চলত।সেদিন থেকেই ওই নাম।জাতি বর্ণ নির্বিশেষে ধনী-দরিদ্র থেকে শুরু করে মুচি মেথর সবাই ভিড় করত মেলাতে। জিলিপি,বাদাম,নিমকি-নানা দোকান পত্রে ভরে উঠত মাঠের চারিপাশটা।এই মেলার প্রথা বহুকাল আগে থেকেই চলে আসছে।গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন বিপিন ঘোষ,টাকা-পয়সা আর প্রতিপত্তির দেমাকে তার মাটিতে পা পড়ে না,তার একমাত্র কন্যা সন্তান সুরোমা।রূপে-গুণে একেবারে স্বয়ং লক্ষী।টানা-টানা পটলচেরা কালো হরিণী চোখ,সুকোমল ওষ্ঠদ্বয়,নাকটি বাঁশির মত সরু,গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, সারা মুখমন্ডলে করুন নিষ্ঠার ভাব রয়েছে!সেদিন বেনুর সাথে সুরোমার মেলাতে এসেই প্রথম পরিচয় হয়।ক্ষণিকের জন্য হলেও দুজন দুজনাকে ভালো লেগে যায়।পরে সেখান থেকে দুজনেই বাড়ি ফিরে আসে।বেনু হলো গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান।সুগঠিত তনু,গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও মুখশ্রী আছে বৈকি,কুঞ্চিত কেশ,কার্তিক ঠাকুরের মত সরু করে ছাটা সুন্দর গোঁফ—এক দৃষ্টি দেখলে তার সৌন্দর্য্যে মন বিগলিত হয়ে ওঠে। পাঁচ ভাই বোন নিয়ে তাদের সংসার।বেণুর বাবা জমিতে ফসল কাটার কাজ করে।অতি কষ্টে তাদের দিন চলে,কোন কোনদিন এমন ও হয়েছে ঘরে দানার অভাবে না খেয়েই শুয়ে পড়তে হয়েছে তাদের।জমির ফসল কেটে যা ওই দু-এক পয়সা রোজগার হতো তাই দিয়েই ওদের সংসার চলত।অভাব-অনটন!তাদের নিত্যদিনের রুজি রোজগার হয়ে উঠেছিল।তাই বেনু পুঁথিগত বিদ্যার জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি।

          ধীরে ধীরে বেনু ও সুরোমা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে। তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ এর মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলে এক স্রোতস্বিনী নদী;—কুলকুল শব্দে বয়ে চলা তার জলের স্বচ্ছ ধারা,চারিপাশের মলিন বাতাস নদী প্রান্তিরটিকে এক স্বর্গীয় বিলাসিতায় পৌঁছে দেয়।তারি তটে বেনু ও সুরোমা গিয়ে বসতো।খুব একটা দুজনের কাছাকাছি বসার সাহস তাদের মধ্যে তখনো জন্মায়নি। শুধু দুজন দুজনার চোখের দিকে চেয়ে প্রকৃতির মলয় বাতাসে নিজেদের আবেগ টুকু চোখাচোখি পৌঁছে দিত একে অপরের দিকে।এমনটি ও হয়নি যে বেনু সুরোমার হাতটি ধরতে চেয়েছে,সুরোমা স্বাভাবিকভাবেই আত্মসচেতন এক মেয়ে।পাছে তাদের একসাথে কেউ দেখে না ফেলে তাই সে সবসময় বেনুর থেকে দুরে দুরে থাকতো,কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে ছিল অগাধ ভালোবাসা,শুধু প্রকাশ্যে তার উন্মোচন ঘটাতে পারেনি কেউই। বেনু বলে

—তুমি গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তির মেয়ে,আমি সাধারন খেটে খাওয়া এক দিন মজুরের ছেলে! আমাদের এই সম্পর্ক তোমার বাবা কি মেনে নেবেন?

 সুরোমা শুধু নীরব থাকে,তার যে সঠিক উত্তর কি হতে পারে সেটি সে ঠাওর করতে পারে না।চোখের পলক দুটি মাটির দিকে নিক্ষেপ করে দুই হাতের দুই আঙ্গুল নিয়ে শুধুই যুদ্ধ-বিগ্রহ করে চলেছে;দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে আসে,পাছেই অন্ধকার নেমে আসে তাই নিজেদের বাঁসার  খোঁজে ব্যাকুল পাখিরা কিচিরমিচির  করতে করতে কেবলই এদিক-ওদিক উড়ে চলেছে।পশ্চিমাকাশে অস্তমিত সূর্যের লাল আভা পরিবেশটি কে এক মায়াময়তায় জড়িয়ে নিয়েছে।মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে চলেছে।সন্ধ্যা হবার আগেই বেণু ও সুরোমা সেখান থেকে চলে  যাওয়ার সময় বেনু সুরোমাকে শুধু একটি কথাই বলেছিল,

—কাল তাহলে আসছ তো?

উত্তরে শুধু—একটু মুচকি হাসি!

স্পষ্টতই বোঝা যায় বেনু তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।তারপর তারা দুই দিকের রাস্তার দুই মোড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।এভাবেই তাদের একসঙ্গে অনেকটা সময় কেটে যায়।

            বিপিন বাবু মেয়ের এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনে কিছুটা চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন।দিন দিন মেয়ে যেন কেমন একটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে।যে মেয়ে কোনদিনও বাবার  কোন কথায় অবাধ্য হয়নি,সে আজ বাবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে;শুধুমাত্র ওই দিনমজুরের ছেলে বেনুর জন্য।মেয়ের মতি-গতি-গতি ঠিক না দেখে বিপিন বাবু তাকে ঘরবন্দি করে রাখেন।বিপিন বাবু মনে করেছিলেন ভয় দেখিয়ে মেয়েকে আটকে রাখবেন,কিন্তু তা পারেননি।তিনি ভেবেছিলেন শুধু প্রতিপত্তির জোরে দুই ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করে দেবেন।শুধুমাত্র সামাজিক স্তরটাই ছিল বিপিন বাবুর আসল পরিচয়।এরই মধ্যে তিনি নিজের লাঠিয়াল পাঠিয়েছেন বেণুদের বাড়িতে,তাকে সচেতন করার জন্য।সেদিন বেণুর বাড়িতে মারমার কাটকাট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, বেনুর বাবা জয়দেব পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্যই ছেলের হয়ে ক্ষমা চেয়েছিল লাঠিয়ালদের কাছে।লাঠিয়াল সেখান থেকে চলে যাবার পর বাবা ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করে।

দেখ বেণু

—আমি সাধারণ খেটে খাওয়া দিনমজুর!ঠিক মতো দুবেলা দুমুঠো পেটে খাবার জোটে না আমাদের।

জয়দেব ছেলেকে আরো বলে—

বেণু শুধুই নিশ্চুপ থাকে,ধরিত্রীর বুকে সে নিজেকে একটা ভার বলে মনে করে,আর মনে মনে দগ্ধ হয় সে।বাবার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই সে সেখান থেকে ছুটে ঘরের ভিতরে চলে যায়।ছোট ভাই বোনরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলো।সেদিন একটা ভয়ানক ঘটনা আকাশ ভেঙে পড়ল দিনমজুর জয়দেব এর পরিবারের উপর,হঠাৎই গ্রামের কানাই বাবু এসে খবর দিলেন তার ছোট মেয়ে রমা ছিন্ন-ভিন্ন,রক্তাক্ত বস্ত্রহীন দেহে ও জমিদার তলার মাঠে পড়ে আছে।চারিদিকে হৈ হুল্লোড় চিৎকার-চেঁচামেচিতে শোরগোল পড়ে গেল,কে কোথায় আছো?জয়দেব,বেণু ঘর থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠে এসে পৌঁছালো।তখন প্রায় সব শেষ।কপালে হাত চাপড়াতে চাপড়াতে জয়দেব শুধুই চিৎকার করে চলেছে,মিথ্যাই সে ভগবান কে দোষারোপ করতে লাগলো।বেণুর মা’র অবস্থা অনেক শোচনীয় হয়ে পড়ে,সে বোবার মতো শুধু মেয়ের নিস্তেজ দেহের দিকে একঠায়ে তাকিয়ে ছিল।বোনের লাশ দেখে বেণুর মন, থেকে থেকে শুধু ডুগরে ডুগরে কেঁদেই চলেছে।এই বিভৎস নির্মম ঘটনায় গ্রামের ভীত-সন্ত্রস্ত জনতা এদিক সেদিক ছুটতে লাগলো;থানা থেকে দারোগা বাবু এসে হাজির হয়,কিন্তু ঘটনার আসল রহস্য কি তার হদিস পাওয়া গেল না।ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে ওঠে সে নাকি রমাকে সন্ধ্যা বেলায় ওই অন্ধকার জমিদার তলার মাঠ দিয়ে যেতে দেখেছে!ধীরে ধীরে সেই ঘটনা বাসি হয়ে উঠল;এভাবেই সব শেষ হয়ে গেল এক হতভাগ্য চাষির একমাএ মেয়ের জীবন।এরপর বেশ কয়েকটি বছর কেটে যায়।বেণু এখন উঠতি বয়সী যুবক।সুরোমাকে সে এখনো ভালোবাসে।ভাগ্যবিধাতার অদ্ভুত লীলাখেলায় একদিন বেনুর সাথে সুরোমার সামনাসামনি দেখা হয়ে যায়।এত বছর পর দুজন দুজনকে দেখে তাদের মধ্যে আনন্দের আর সীমা রইল না।এক নিমেষে তাদের চোখের ভাব বুঝিয়ে দিল এতদিনের এই যন্ত্রণা তারা কিভাবে কাটিয়ে এসেছে।বেণুকে দেখে সুরোমার বুক ভয়ে,আনন্দে ঢিপ ঢিপ করে ওঠে।নির্বাক শ্রোতার মতো তারা দু'জন দু'জনাকে কিছু যেন একটা বলতে যাবে,পাশ থেকে কে যেন সুরোমা বলে ডেকে ওঠে,গলার শব্দ শুনে মহিলাই মনে হয়েছিল।তৎক্ষণাৎ সুরোমা সেখান থেকে ভয়ে ভয়ে চলে যায়।বেণু এখন বাবার সাথেই মাঠে কাজ করে,এই পথ দিয়েই তার প্রতিনিয়ত যাতায়াত।

      একদিন তারা পড়ন্ত বিকেলে সেই নদীর পাড়ে গিয়ে বসে।আজ আর তাদের মধ্যে দূরত্বের কোনো বালাই নেই,নির্দ্বিধায় তারা একে অপরের অনেকটা কাছাকাছি আসতে পারে।বেণু সুরোমার কোলে মাথা রেখে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে।সুরমার চুল বেণুর মুখের উপর পড়ে,তার চুলের এক মাতাল করা গন্ধে বেণু বিভোর হয়ে ওঠে।সুরোমা ধীরে ধীরে বেনুর চুলে আঙুল চালনা করছিলো।তাদের মধ্যে আজ আর সমাজের ভয় নেই,কে কি বলল তারা আজ তাতে কান করেনা।তারপর দুজন দুজনাকে আলিঙ্গন করে।—এই ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তটি গ্রামের এক লোকের চোখে পড়ে।সেখান থেকে লোকটি তাড়াতাড়ি চলে এসে খবরটি বিপিনবাবু কে দেয়।সুরোমা বাড়ি ফিরলে তার বাবা তাকে কষিয়ে এক চড় মারে।এবার বিপিনবাবু নিজেই বেণুর সাথে দেখা করে,তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য।বিপিন বাবুর শাষানিতে বেণু কোন গা করে না।দুই প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে অবাধ মেলামেশা চলতেই থাকে।প্রতিবারেই তাদের সাবধান করা হয়।কিন্তু ভালোবাসা কোন বাঁধা মানে না;উন্মত্ত জলের ধারার মতো তাদের ভালোবাসার গতি অনবরত বয়ে যেতে থাকে মোহনার দিকে।সেদিন বিপিন বাবুর শরীরটা খুব একটা ভালো ছিল না।সুরোমা বিছানার সামনে বসে বাবার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল,প্রতিপত্তির দেমাক নিয়ে থাকলেও আজীবন সে মেয়ের কথা ভেবে গিয়েছে,মা মরা মেয়ের ভালো-মন্দের দিকটা এতদিন তিনিই দেখে এসেছেন।তাই সে মেয়েকে সাবধান করেন;মেয়ের সেবা শুশ্রূষায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।

        জমিদার তলায় আবারো সেই মেলা বসে।দূর-দূরান্ত থেকে দোকানিরা তাদের জিনিসপত্র জমায়েত করে নিয়ে মাঠের চারিপাশে দোকান বসিয়েছে,বাতাসে ভাজা জিলিপির গন্ধ গমগম করছে।ছোট ছোট বাচ্চাগুলো হাতে হাওয়াই পাখা উড়িয়ে ছুটে চলেছে এদিক ওদিক,তালপাতার সেপাই এর মত এক মেয়ে একটি অপরিষ্কার ফ্রক পড়ে বেলুন বিক্রি করছে,তার চোখে মুখে অভাব-অনটনের ছায়া চাঁদের কলঙ্কের মতো দাগ কেটেছে।তার শরীরের গঠন দেখে মনে হতে পারে মেয়েটি বারো কি তেরো বছরের।কতগুলো কচি কাচা তার কাছ থেকে বেলুন কিনছে,—

দিদি বেলুন ক পয়সা?

পঁচিশ পয়সা।

আমাকে একটা দাও—

আমাকে একটা দাও—

এই নাও!

বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে চেয়ে তার ছোট ছোট ভাই বোনের কথা মনে পড়ে যায়,বাবা মোদো-মাতালে,মাকে অনেকদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছে।অভাবে আর খিদের জ্বালায় তাদের রাস্তায় নামতে হয়েছে।মা লোকের বাড়ি বাড়ি ঝি-গিরি করে।যেখানে যেখানে মেলা হয়,ওরা সেখানে সেখানে গিয়েই দোকান দেয়।বেলুনের দোকান,পাঁপড়ের দোকান,মাটির পুতুলের দোকান,যখন যেমন পয়সা তখন তেমন দোকান দেয়।মেয়েটির নাম কমলা।

     বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে।সুরোমার সাথে বেণুর প্রথম দেখা এই মেলাতেই,সেদিনের সেই সুরোমা-বেনু এরা কত ছোট,চৌদ্দ কি পনেরো হবে।সুরোমা সেদিন লাল রঙের একটি সুতির সালোয়ার কামিজ পরেছিল,কপালে প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো একবিন্দু একটি লাল টিপ,যত্ন করে বেনুনী করা চুলের গোছাটি বুকের উপর ঝোলানো।ধীর স্থির তার চলাফেরা।এক নিমেষের জন্য হলেও তার রূপে মুগ্ধ হয়ে বেনু তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল।আজ তারা দুজনে মেলায়  যাবে—

সবার নজর এড়িয়ে সুরমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, ছুটতে ছুটতে পুকুর পাড়ের সামনের একটি আম গাছে হেলান দিয়ে বুকে হাত দিয়ে সে প্রাণপণে হাঁপাতে থাকে।কিছুটা গাছের আড়াল হয়ে সে দাঁড়ায়, যাতে তাকে না কেউ দেখতে পায়।বেনু তাকে এই আম গাছের গোড়াতেই এসে দাঁড়াতে বলেছিল।আম গাছের পিছন থেকে এসে  সুরোমার চোখ দুটি হাত দিয়ে চেপে ধরে বেণু।

কে?

কে বলো দেখি?

সুরমাও বেশ কিছুটা ঠাট্টা করে বলে—

কে আপনি?এভাবে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে আমার চোখ দুটি চেপে ধরেছেন যে?

উফ্!

তুমিও না সুরমা।

এই বলে সে সুরোমার সামনের দিকে এসে দাঁড়ায়।

সুরোমা দু'হাতে মুখ চেপে খিলখিল করে হেসে ওঠে।বেনু কোমরে হাত দিয়ে অভিমানের সুরে সুরোমার দিকে চেয়ে থাকে।এভাবে হাসি মজা খুনসুটি সেরে তারা মেলার পথে রওনা হয়।দুজনে একে-অপরের হাতে হাত রেখে শুধু এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।তারা আজ অন্য কোনো দিকে তাকাবে না।প্রেমের যে গভীর সাগর সামনে দুহাত বাড়িয়ে তাদের অপেক্ষা করছে,ওরা আজ তার মধ্যেই ঝাঁপ দেবে। সমাজের বাঁধন তারা আজ কিছুতেই মানবে না।অবশেষে তারা মেলায় আসে,পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে দুটি জিলিপি কেনে বেণু।খুব যত্ন করেই  নিজের হাতে সুরোমাকে খাইয়ে দিচ্ছিল সে।সুরমার গভীর কাজল কালো টানা টানা চোখের দিকে চেয়ে বেণুর সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।একটা অজানা চাওয়া-পাওয়া তারমধ্যে বারংবারই শিহরণ জাগিয়ে তুলছিলো।খাওয়া শেষ হলে তারা নাগরদোলায় চড়ে। সুরোমা বেশ ভয় পায়, চোখ দুটোকে একেবারে চেপে সে বুঁচিয়ে থাকে,আর বেণুর হাতটাকে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,যে শিহরণ ইতিপূর্বেই বেণুর মধ্যে তৈরি হয়েছিল তার মাত্রা আরও বেশি পরিমাণে বেড়ে গেল।বুকের ভিতরটা কিনকিন করতে থাকে।বেনুও সুরোমাকে আগলে ধরে বসে থাকে।আর সে বলে—

তোমার ভয় করছে সুরোমা?

হ্যাঁ খুব!

আবারো চোখ বন্ধ করে নেয় সুরোমা।

মেলাতে বেশ অনেকটা সময় কেটে যায়।অস্তমিত সূর্যের শেষ আলোর রেখাটিও পশ্চিমাকাশে বিলীন হয়ে গেছে অনেক আগেই।সে বলে—

এবার চলো,অনেকটা সন্ধ্যা হয়ে এলো।বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে।

আচ্ছা বেশ।

হ্যাঁ। 

তারপর বেনু সবার নজর এড়িয়ে সুরমাকে চুপিসারে তার বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে আসে।এই আশ্বাস দিয়ে যে, তাদের আবারও দেখা হবে।তারপর বেণু বাড়ি ফিরে আসে। সারারাত সেই কাজল কালো চোখ,হরিণীর দৃষ্টির মতো চাহনি,গোলাপের পাপড়ির মত চুলের রাশি, কেবলই তার চোখে ভেসে-ভেসে এক অদৃশ্য ছবি এঁকে দিয়ে যায়।

      বাবার সাথে মাঠে কাজ করলেও বেণুদের সংসার এখনো সচ্ছল নয়।,অভাব অনটনের মধ্য দিয়েই যায়। এরইমধ্যে বেনুর মা তাদের ছেড়ে চলে গেছেন ! মাস চারেক হল।কঠিন ব্যামো হয়েছিল তার,পয়সার অভাবে মাকে বাঁচানো গেল না;মা শুধু বলে গিয়েছিল—

দেখ বেণু!আমি আর বাঁচবেনা রে!

ভাই বোনকে তোর দায়িত্বে রেখে গেলাম।

তুই ওদের দেখিস।

এই বলেই মা চোখ বুঝিয়েছিল।

বড় মেয়ে রমাকে হারানোর পর তাদের সংসারে দ্বিতীয়বারের মতো দুঃখের স্রোত বয়ে গেল।মাস ছয়েক পর মেজো বোন অনুর বিয়ে হল।বেশ টাকাপয়সা ওয়ালা বনেদি বাড়িতেই তার বিয়ে হয়।অনু ভালোবাসা করেই বিয়ে করেছিল,চালকুরুনি ঘরের মেয়ের কপাল।

মাস খানেক হল মেলা শেষ,মাঠ সেই আগের মতো নিস্তব্ধ,নির্জন। শেয়াল ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক;ঘুটঘুটে অন্ধকারে গা ছমছম করা চারিদিকের পরিবেশ।মৃদু চাঁদের আলোয় মাঠের কচুবন গুলোকে দেখে মনে হয় কোন অশরীরী আত্মা!সাদা শাড়ি পরে গুটিশুটি মেরে ঝিমনোর ভঙ্গিতে মাঝে মাঝেই মাথা নাড়িয়ে উঠছে। ভুল করে কোন মানুষ যদি ও পথ দিয়ে যায় একে অন্যের মুখ দেখে চিৎকার করে ওঠে, ভাবে অপদেবতা তাদের উপর ভর করেতে এসেছে।গ্রামের মোড়লকে অনেকে এ বিষয়ে নালিশ জানিয়েছে,মাঠে আলোর ব্যবস্থা করে দেবার জন্য।

মোড়ল বাবু এবার আপনি কিছু ব্যবস্থা করুন! 

—আমি দেখছি।

অতি কষ্টে একটা কেরোসিন জ্বালা লন্ঠন এর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় মাঠে। কিছুটা হলেও স্বস্তি অনুভব করল গ্রামের মানুষজন। সেদিন মাঠের রাস্তা দিয়ে হেঁটে নরেন বাড়ি ফিরছিলো।দুরে যে ভাঙা অট্টালিকা টা রয়েছে তার ভিতরে দুটো ছায়া প্রবেশ করল,মৃদু আলোয় সে দূর থেকে ঠিক মতো দেখতে পায়নি। ভূত ভেবে সে রাম নাম জপ করতে করতে সেখান থেকে দ্রুত চম্পট দেয়।তার পর বাড়ি ফিরে সে বউকে শুধু বলেছিল—

—আজ গো বাঁচান বেঁচেছি ভূতের হাত থেকে।

তারপর সেই রাতের ঘটনা মিহিন ধূলোর মতো বাতাসে মিশে যায়। বিপিন বাবু এখন বৃদ্ধ হয়েছে, বয়সের আর শরীরের ভারে সে নুয়ে পড়েছে।যৌবন কালে ছিলো অতিকায় এক চেহারা। মা মরা মেয়ের কথা ভেবে শুধু চিন্তায় চিন্তায় পড়ে থাকে। একদিন মেয়েকে ডেকে বলে—

মা আমার বয়স হয়েছে! তুইও বড়ো হয়েছিস এবার তোর বিয়ে!

এই বলে চুপ করে যান।

মেয়ে ভয়ে কিছু বলতে পারেনা, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল দেওয়ালের ছবিটার দিকে,ক্ষুধার্থ এক শাবকের মুখে মা পাখি খাবার তুলে দিচ্ছে।সুরোমা ঘর থেকে এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে যায়।বিপিন বাবু প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছে,মেয়েকে বিয়ের কথা বলতে বলতে,এবার তিনি প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছেন।এমনটি হয়নি কোনদিন বাবাকে সে বেণুর কথা বলেনি,—

বাবা আমি বেনুকে ভালোবাসি—

—ওই দিন মজুরের ছেলে!

এই একটা মাএ কথা শুনে সে বাবাকে কিছু বলতে পারেনা।এভাবেই একের পর এক দিন চলে যায়।আজ অনেক দিন হল সুরোমার শরীর টা ভালো যায়না।একটা অজানা যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, কিন্তু সে তার যন্ত্রণার কথা কাউকেই বলতে পারছেনা।তার একমাত্র সখী ইন্দুরও বিয়ে হয়ে গেছে,এখন সে এক ছেলের মা।ছোট থেকেই সে তার সুঃখ-দুঃখ এর সঙ্গীনি;ইন্দুও গরিব ঘরের মেয়ে,তার বাবার অবস্থাও খুব একটা ভালো না।ভেবেছিলো বড়লোক ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন কিন্তু ভাগ্যক্রমে তা হয়ে ওঠেনি।সেদিন সেই রাস্তার মোড়ে সুরোমা বলে ইন্দুই  ডেকেছিল।অনেকদিন পর বাপের বাড়িতে এসে তার সাথে এই প্রথম দেখা।আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল ইন্দু। এরপর দুজনে গল্প করতে করতে বাড়ির দিকে চলে যায়। একমাস হলো ওর স্বামীর কোনো কাজ নেই,ঘরে চাল বাড়ন্ত,ছোট ছেলেটার মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দিতে পারছে না।তার বুকের গঙ্গাও শুকিয়ে গেছে,এখন সেই তরঙ্গায়িত গঙ্গা অনবরত তার চোখের কোনা দিয়ে বয়ে যায়। স্বামী মাঠে মাঠে মাটি কাটার কাজ করতো,ছেলে হবার কিছুদিন পর থেকেই সে যেন কেমন একটা সংসার বিবাগী হয়ে পড়ল,সংসারের প্রতি,বউয়ের প্রতি,ছেলের প্রতি তার মায়া এক নিমেষের মধ্যে গতি পরিবর্তন করল।সে ভেবেছিল এই অভাব অনটনের সংসারে আর একটি প্রাণকে বড় করে তোলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।মাঝে মাঝেই মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতো।

তুমি আজও মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছো?

হ্যাঁ বেশ করেছি।

তোমার লজ্জা করে না?ঘরে একটা ছোট ছেলে খিদের জ্বালায় ছটফট করছে আর তুমি কিনা।

তার স্বামী যতই মদ খেয়ে বাড়ী ফিরুক না কেন সে কোনদিন তার বউয়ের গায়ে হাত তোলে নি।ইন্দুর এই দুঃখের কথাগুলো সুরোমা শুধু হাঁ করেই শোনে।আর মনে মনে নিজের কথা ভাবে।বেনু আর সুরোমার প্রেমের কথা অনেক আগে থেকেই জানতো ইন্দু।সুরোমা কে বেণুর সাথে সে নদীর পাড়ে বসে কথা বলতে দেখেছে।

ওটা জয়দেব কাকার ছেলে না?

হ্যাঁ।

তুই ওকে চিনিস?

কেন চিনবো না!ওর বাবা আর আমার বাবা একইসাথে মাঠে কাজ করতো।বেণু তো আমাদের বাড়িতে যাতায়াত ও করতো।

দুই সখীর আর কথা বলার গতির শেষ হয় না।এভাবেই তারা নিজেদের মধ্যে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলে চলে। দুদিন পর বিকালে সুরোমা প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল,কারোর কথাই সে সেদিন শোনেনি।তখন শুধু তার চোখের সামনে দেওয়ালের সেই ছবি আর বেণুর মুখ ভেসে উঠছিলো,আবার সে সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘরে ফিরে এসেছিল।


     একদিন  রাতের অন্ধকারে গ্রামের অদূরের ঐ শিমুল গাছটিতে কি যেন একটা দেখা গিয়েছিল! লন্ঠনের আবছা আলোয় তা ঠিকমত বোঝা যাচ্ছিল না।সেটা চম্পা ঘরের খিড়কি থেকে লক্ষ্য করে,ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে সে চিৎকার করে সবাইকে ডাকে।অনতিবিলম্ব না করে গাঁয়ের মোড়ল নকুল মহাশয় ব্যাপারটির আসল রহস্য উদঘাটন করার জন্য গাঁয়ের লোকেদের একত্রে জমায়েত করেন।ব্যাপারটি তারা সামনে থেকে দেখে একেবারে আঁতকে ওঠে!—।               

          উন্মত্ত পাগলের মতো চিৎকার করে বেনু,— অঝোর ধারায় কাঁদে।আর একটা সাদা কাগজ কে সে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে—উড়িয়ে দিতে থাকে আকাশের দিকে।

          আর সুরোমা শান্ত,নিস্পাপ যন্ত্রণাকাতর মুখে নির্বাক শিশুর মতো চোখ বন্ধ করে নিথর দেহে শিমুল গাছে গলায় রজ্জুর ফাঁস পড়ে ঝুলে আছে।আর সবাই,তার শরীরে একটা অদ্ভুত চিহ্ন লক্ষ্য করলো।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment