1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

আশ্রয়

ছবি : ইন্টারনেট

আশ্রয় 

কৃশানু কুন্ডু 

সকাল থেকেই বেজায় চেঁচামেচি দত্তবাড়িতে। দত্তবাবু চেঁচাচ্ছেন তাঁর জামাকাপড় পাওয়া যাচ্ছে না, দত্তগিন্নি চেঁচাচ্ছেন তাঁর বাজার আসতে দেরি হওয়ায় এখনও রান্না হয়নি, দত্তবাবুর মেয়ে চেঁচাচ্ছে তার স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না বলে আর ছোট্ট বাবলু চেঁচাচ্ছে এমনিই, তার পাঁচ মাস, তার তো চেঁচানোরই বয়েস। ওদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে বাড়ির আশ্রিত ভাইপো বিলু আর অবাক চোখে সব কিছু প্রত্যক্ষ্য করছে বিলুর সাত বছরের বোন, ভেবলি। বিলুর হাজার ব্যস্ততা, সকালে উঠে চৌবাচ্চায় জল ভরা, দুধওয়ালার কাছ থেকে দুধ নেওয়া, চা বানানো, কাকিমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা, চা বানিয়ে সবাইকে দেওয়া, তারপর বাজার করে নিয়ে আসা, টাকা পয়সা বুঝিয়ে দেওয়া, রান্নায় কাকিমা আর রান্নার লোককে সাহায্য করা। সকাল বেলাতে তার একটুও সময় থাকেনা, শুধু দৌড় দৌড় দৌড়। ছোট্ট ভেবলিকে দেখারও তার সময় নেই, খিদেতে সেও কান্না জুড়ে দিলো বলে। এই নানান রকম আওয়াজে বেশ একটা রাগ ভৈরবী বেজে উঠেছিল দত্তবাড়ির উঠোনে।

ছোট্ট ভেবলি মুখ দিয়ে শুধু নানান রকম আওয়াজ বের করতে পারে। ভাষা তার মুখে ফোটে নি। অবুঝ মেয়েটা বসে থাকে বারান্দার বা উঠোনের এক কোনায়। ভেবলি খিদে পেলে কাঁদে, অকারণে নিজের মনে হাঁসে। গাছ থেকে যখন বকুল ফুল টুপ্ করে খসে পড়ে মাটিতে, গন্ধে ম ম করে ওঠে চারদিক, তখন এক স্নিগ্ধ আধো হাসি দেখা যায় তার ঠোঁটে। আবার বাড়ির বেড়াল পুসি যখন তার গায়ে গা ঘষে তখন সে খিল খিল করে হাঁসে। সন্ধেবেলা যখন গোধূলি আলোয় আকাশে বকের ঝাঁক উড়ে যায় এক প্রান্ত থেকে একপ্রান্তে, তখন সে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকে আর দিনের এমন সময়ে যখন কারও এক মুহূর্ত নেই তাকে সময় দেওয়ার, তখন সে নিজের মনে খেলা করে। ত ত আওয়াজ ফোটে তার গলায় আর মাঝে মাঝে কারও আসা যাওয়ার পথে তার কাছ দিয়ে কেউ গেলে সে আঁকড়ে ধরতে চায় তাদের পা। কেউ তার আকুতি বোঝে না, সবাই বলে ভেবলিটা পাগলী।  

বিলু আর ভেবলি দত্তবাড়িতে আছে আজ প্রায় দুবছর। দুবছর আগে এক মেঘলা দিনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন তৎকালীন কর্তা, বিলুর বাবা ও তাঁর স্ত্রী, বিলু আর ভেবলির মা। দুর্গাপুরে কাজে যাচ্ছিলেন তাঁরা কিন্তু আর পৌঁছতে পারেননি । পথেই হয় ভয়াবহ দুর্ঘটনা, দুজনেই একসাথে যাত্রা করেন মহাপ্রস্থানের উদ্দেশ্যে। রেখে যান নাবালক ভাই ও বোনকে। তাদের ঠাঁই হয় বিলুর বাবার ছোটভাই, দত্তবাবুর বাড়িতে। বড়ভাইয়ের ছেলে মেয়েকে ফেলে দিতে পারেননি দত্তবাবু। তবেকি তার অবস্থা এমন যে তিনি না তাদের গিলতে পারেন, না ওগরাতে। মানে ওদের বাড়িতে রেখে রোজ দত্তগিন্নির কাছে কথা শোনেন, আবার মন শক্ত করে না ওদের ফেলে দিতে পারেন। দত্তগিন্নির গলার কাঁটা, চোখের বিষ এই দুজন। কর্তার খামখেয়ালিপনায় এদের বাড়িতে রাখতে হয়েছে কিন্তু এই নিরুপায় ভাই বোনকে দু চক্ষে দেখতে পারেন না তিনি। তার বড়ো ভয় একদিন সম্পত্তির ভাগ চাইবে এই দুজন। এমন সাধের দেশের বাড়ির ভাগ দিতে হবে এই দুজনকে। তার চেয়ে দিই বার করে, যাক ভেসে দুজন। কত লোকই তো ভেসে যায় এরকম। তাহলে আর সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার প্রশ্নই নেই। সেইজন্যই শেওড়া গাছে চড়া পেত্নীর মতন বসে আছেন তাদের কপালে আর তাদের ভাগ্যরেখায় নৃত্য করছেন ধেই ধেই করে। কি করে দুজনকে বার করবেন এই তাঁর একমাত্র চিন্তা। আসলে শুরু থেকেই তিনি এই দুজন অসহায় বালক, বালিকাকে দেখেছেন গলগ্রহ হিসেবে। বিলুর আর ভেবলির পিতা, মাতা গত হওয়ায় দত্তবাড়ির সমস্ত সম্পত্তি এখন তাদের হস্তগত হওয়ার মুখে, পথে বাধা একমাত্র সেই বিলু আর ভেবলি। আর কি তাদের সহ্য করা যায়? ওদিকে দত্তবাবু রঙে ঢঙে সাক্ষাৎ শিবঠাকুর। উনি নিজের ধ্যান জ্ঞান নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। মাঝে মাঝে তার স্ত্রীর বিলু, ভেবলির প্রতি ব্যবহার তার চোখে বাঁধে বটে কিন্তু তার গিন্নির সাথে ঝামেলায় কে জড়াবে? মুখে না মানলেও একথা সত্যি যে তিনি গিন্নিকে ভয় পান তাই অনেক সময় অন্যায় হতে দেখলেও তার মুখ দিয়ে রা সরে না। বিলু আর ভেবলি যেই তিমিরে ছিল, থেকে যায় সেই তিমিরেই। 

সেদিনও অন্যথা হচ্ছিলো না। বাজার থেকে ফেরার পর থেকেই দত্তগিন্নি গজ গজ করছিলেন। বাজার গিয়ে, জিনিসপত্র কিনে, বোঝা বয়ে বাড়ি ফিরে আসতে এটুকু সময় তো লাগারই কথা কিন্তু তাও বিলুর কাকিমা তাকেই দোষ দিচ্ছিলেন দেরি হওয়ার জন্য। বাড়ির সবাই যে উঠতে দেরি করেছে এবং সে দোষ বিলুর দেরিতে চা দেওয়ার নয় সে কে কাকে বলবে? বাজার থেকে ফিরতে কোন দেরি হয়নি বরং সবাই দেরিতে ওঠায়, সবাইকে চা দিয়ে বিলুর বাজার যেতে দেরি হয়েছিল। বিলুর অবশ্য এতদিনে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। সে মাথা পেতে তার কাকিমার দেওয়া সমস্ত দোষ মেনে নিতো। সে শুধু চাইছিলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দোষারোপ পর্ব শেষ হয় যাতে সে বেচারি ভেবলিকে একটু খেতে দিতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? দোষারোপ পর্ব চলছে তো চলছেই। বিলুর কাকিমা হাতে গুনে দেখিয়ে দিলেন বিলুর আর ভেবলির কত দোষ এবং কতভাবে তারা দত্তবাড়ির জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে কণ্টকময়। 

তখনই হন হন কর বাড়িতে ঢুকলেন খগেনদা। খগেনদা সম্পর্কে দত্তগিন্নির ছোটভাই। কাছেই বাড়ি হওয়ায় উনি সুযোগ পেলেই দিদির বাড়ি চলে আসেন আর কেউ চাক না চাক, সব ব্যাপারে নাক গলান। বলাবাহুল্য বিলু আর ভেবলির ব্যাপারেও তিনি নানান মতামত পোষণ করেন যা জানাতে তিনি কখনও পিছপা হন না।  আজকেও তার কোন তারতম্ম হলো না। বাড়িতে ঢুকেই তিনি বলে উঠলেন,"ফিরতে তো দেরি হবেই। বাজারের মুখে তো দেখলাম বিলু ওর মতো বাজার করতে যাওয়া অন্য লোকেদের সাথে গুলতানি করছে। আরও দেখলাম ওরা যেন ওর কাছ থেকে কিছু নিলো। কি নিলো রে? নিশ্চই টাকাপয়সা? দেখে নে দিদি, টাকা পয়সার ফেরত ঠিক করে দেখে নে।  দেখ কোন কাজের জন্য নিশ্চই বিলু ওদের পয়সা দিয়েছে। কি কাজ রে? নেশা, ভাঙ করছিস নাকি আজকাল। ওদের কাছ থেকে মাল নিস নাকি? সব পাকা চোর, গুন্ডা, বদমাইশ। কি রে তোদের প্ল্যান কি? ডাকাতি করতে আসবে না তো ওই ডাকাতের দল? তুই টুক করে খুলে দিবি বাড়ির দরজা আর তোকে ওরা বখরা দেবে। দিদি, সাবধানে থাক। তোদের কিন্তু শিয়রে সমন। তোদের ধন সম্পত্তি সব লুঠ করার ফন্দি এঁটেছে এ ছেলে। এবার বাদ্ধ হয়ে ছুটে এলো বিলু। বলে উঠলো,"এ আপনি কি বলছেন দাদা? আমি কেন এরকম কাজ করতে যাবো? নিজের বাড়িতে কেউ ডাকাতি করায়?" খগেন বলে উঠল, "করায়, সব করায়। তোদের মতো মানুষকে আমি খুব ভালো করে চিনি। যে হাত তোদের খাওয়ায় সেই হাতেই তোরা কামড়াস।" এবার ছুটে এলেন দত্তগিন্নি, বললেন," বেরিয়ে যা হতচ্ছাড়া ভাই বোন। আমাদের খেয়ে আমাদেরই খতম করার মতলব।"খগেনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,"কবে থেকে তোর দাদাকে বলছি, এই দুই আপদকে গলা থেকে নামাতে কিন্তু কে শোনে কার কথা। লোকটাও হয়েছে কুঁড়ের হদ্দ, কোনো কাজ একদিনে হয়না। বের করো এই দুজনকে বাড়ি থেকে।" দত্তবাবুর আপিস যাওয়ার তাড়া আছে আর তাছাড়া এসব ঝামেলায় তিনি পড়তেও চান না। উনি তাও মানে মানে করে বললেন,"বাপ্ মা মরা ছেলে মেয়েদুটো যাবেই বা কোথায়? তাছাড়া আইনত আমাদের ওদের দেখাশোনা করার কথা।" কিন্তু তাঁর কোন যুক্তি ধোপে টিকল না তাঁর স্ত্রীর সামনে। দত্তগিন্নি বলে চললেন,"রাখো তোমার আইন। কে বলবে আমাদের যে ওদের বার করে দিয়েছি। খেতে, পড়তে দিলাম এতদিন আর সেই কিনা আমাদেরই খুন করার মতলব করলো।" এসব শুনে বিলু আর কিছু বললো না। এতো অপমান সে আর সহ্য করতে পারছিল না। নেহাত ছোট বোনটাকে নিয়ে কোথায় যাবে তাই। নইলে অনেক দিন আগেই সে এই বাড়ি ছেড়ে দিতো। রাগের মাথায়, নিজেদের কোন ভালো মন্দ চিন্তা না করে, এক কাপড়ে, ভেবলিকে নিয়ে বাড়ির দরজা ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল সে। খগেনের মুখে তখন যুদ্ধজয়ের হাঁসি, দত্তগিন্নির মুখে শোনা গেলো,"যাক বাবা, বাঁচা গেলো, এখন ওদের বাড়িটার ভাগ দিতে হবেনা" আর দত্তবাবু বললেন "হুম"। বলে হন হন করে আপিস বেরিয়ে গেলেন। 

প্রায় অপরাহ্ন, কলকাতা শহর। একটা বছর চোদ্দোর ছেলে একটা সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। দুপুর রৌদ্রের তেজে আস্তে আস্তে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে হাঁক দিয়ে যাচ্ছে কোন অজানা ফেরিওয়ালা। দুপুরের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিচ্ছে নিঃসঙ্গ ট্রাম। একটু জলের আশায় ছটফট করে মরছে কাক, পায়রা। একটা গলির মুখে চুপ চাপ বসে ছিল দুজন, বিলু আর ভেবলি। যে কটা টাকা বিলুর কাছে ছিল তার মধ্যে থেকে কিছুটা নিয়ে বোনের মুখে তুলে দিতে পেরেছে একটু পরোটা তরকারি। রাগের মাথায় যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বিলু তখন ভেবে দেখেনি কি করে জোগাড় হবে আশ্রয়, দুমুঠো খাবার। আস্তে আস্তে মনের মধ্যে উদয় হচ্ছে নানান প্রশ্ন যার কোন উত্তর বিলুর কাছে নেই। রাস্তার কোনায় বসে বসে সে ভেবে পাচ্ছিলো না সে এবার কি করবে, কোথায় যাবে? তার চোখ পড়লো ভেবলির উপর। সে বেচারার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই মাথার উপরে গনগনে সূর্যটার দিকে। নিজের মনে পথের দুটো পাথর নিয়ে খেলা করছে সে। 

ঠিক এমন সময়ে যমদূতের মতো দেখতে একটা লোক এসে দাঁড়ালো বিলুর সামনে। কালো, ষন্ডামতো লোকটার ঘাড় বলে কিছু নেই। চর্বিতে স্থুল বিশাল পেট আর বুকের উপর যেন মাথাটা বসানো। গায়ের রং শ্যামলা। মুখে একগাল দাড়ি। পরনে একটা ময়লা গেঞ্জি আর লুঙ্গি। মোটকথা দেখে মনে বেশ ভয়ের উদ্রেক হয়। দানবরূপী লোকটা উত্তরের টানে বাংলা বলে উঠলো। বললো,"কি খোকা, তোমরা এখানে কি কাজ করতে আছো। দেখে তো মনে হচ্ছে পেটে কিছু পড়েনি। তা খাবার ব্যবস্থা করবে না কি?" বিলু এবার লোকটার কথা শুনে উঠে দাঁড়ালো। জিজ্ঞাসা করলো,"খাবার ব্যবস্থা, মানে।" "মানে আর কি? কাজ আছে, করবে? করলে পাঁচশো টাকা দেবো। তা দিয়ে তোমাদের আজকের খাবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।" বিলু সন্দেহের গলায় বললো,"কি কাজ?" "কাজ আবার কি? মাল তুলতে হবে ভাই, মাল। রাজি আছো? ওই, ওদিকে, গলির মধ্যে আছে গুদামঘর। ওর সামনে টানা গাড়ি আছে আমার। মালগুলো গাড়ি থেকে গুদামে তুলতে আছে। আমার পিঠে ব্যাথা আছে, আমি মাল তুলতে পারবো না। তুমি তুলে দাও আমি তোমায় পাঁচশো টাকা দেবো।" বিলু আর আপত্তি করলো না। তার মনে হলো এই তার ভবিষ্যৎ। এই করেই তাকে তার ছোট বোনকে বড়ো করতে হবে। এতো ভাবলে চলবে না। সে ভেবলিকে কোলে তুলে নিলো। বললো,"পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো, আমি মাল তুলে দেবো।" লোকটা আগে আগে চললো আর পিছনে ভেবলিকে কোলে নিয়ে এগিয়ে চললো বিলু। একটু পরেই তারা পৌঁছে গেলো একটা গুদামঘরের সামনে। শাটার তোলা একটা বেশ বড়ো ঘর গলির মধ্যে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ঠেলা গাড়ি। গাড়ি থেকে একে একে বাক্সগুলো নামিয়ে গুদামে তুলতে হবে। ভেবলিকে পাশের একটা চাতালে বসিয়ে কাজে লেগে গেলো বিলু। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে একে একে বাক্স উঠে যেতে লাগলো গুদামের ভিতর। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে যেতে লাগলো বিলু। নিজের মধ্যে একটা আনন্দ অনুভব করছিল সে। নিজের চেষ্টায় এই তার প্রথম উপার্জন। কষ্ট হলেও মনের জোরে কাজ চালিয়ে গেলো সে। কিছুক্ষনের মধ্যেই সব বাক্স তোলা হয়ে গেলো। এবার পাওনা গন্ডা বুঝে নেওয়ার পালা। কিন্তু বিলু গুদাম থেকে বেরিয়ে দেখলো, ভেবলিকে ঘিরে বসে আছে ওই লোকটা আর তার সাথে আরও দুই ষণ্ডা মতো লোক। না বলতেই লোকটা বিলুর দিকে কিছু টাকা এগিয়ে দিলো। টাকা গুনতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলো বিলু। এ তো অনেক বেশি টাকা, পাঁচশোর বদলে একহাজার টাকা দিয়েছে লোকটা। লোকটা বললো,"টাকা নিয়ে চলে যা, বাচ্চাটা আমাদের কাছেই থাকবে।" এক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিল বিলু কিন্তু মুহূর্তে এদের মতলব তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। কিছু না ভেবেই সোজা একটা ঘুষি চালিয়ে দিলো বিলু লোকটার নাকের ডগায় আর লোকটা "আঁক" শব্দ করে নাক চেপে পিছিয়ে গেলো আর বাকি কজন কিছু বোঝার আগেই বিলু ভেবলিকে তুলে নিয়ে সোজা দৌড়ালো রাস্তার মোড়ের দিকে। পিছনে পদশব্দ বুঝিয়ে দিলো যে তাড়া করছে গুন্ডার দল। ভেবলি এই হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতে ঘাবড়ে গিয়ে কান্না জুড়ে দিলো আর বিলু ছুটতে লাগলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে পৌঁছেও গেলো গলির মুখে। সামনে দিয়ে তখন ছুটে যাচ্ছিলো একটা মিনিবাস। কোনোরকম কিছু না দেখে বিলু ছুটে গিয়ে উঠে পড়লো বাসে আর গুন্ডাদের সামনে দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলো বাসটা। 

ভেবলি কেঁদে জড়িয়ে ধরলো বিলুর গলা আর ভয়ে বার বার পিছনে দেখতে লাগলো বিলু। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটা সেই এলাকা ছেড়ে এগিয়ে গেলো। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো বিলুর। কিছু বোঝার আগেই চোখের জলে ভিজে গেলো দুগাল। বেচারা ভেবলিটার দুগালে চোখের জলের দাগ পড়ে গেছে। সেই সকাল থেকে কেঁদেই চলেছে মেয়েটা। দুপুর পেরিয়ে গেছে। খিদেও পেয়েছে বেজায়। বিলু একজায়গায় দেখলো রাস্তার পাশে কালীপুজো হচ্ছে। কারা যেন দলবেঁধে কালীপুজো করেছে পথের পাশে। সে ভেবলিকে নিয়ে নেমে পড়লো বাস থেকে। দুপুরবেলা, এই সময় তো ভোগ হয়ে যাওয়ার কথা, প্রসাদ কি পাওয়া যাবে না একটু? প্ৰসাদ খেয়ে নিলে এখনকার মতো পেটটা ভরে যাবে। যেটুকু পয়সা আছে তার থেকে আর খরচ করতে হবেনা। বিলু ভেবলির হাত ধরে এসে ঢুকলো প্যান্ডেলের ভিতর। বড়ো করে কালীপুজো করা হয়েছে। কি সুন্দর লাগছে মায়ের মুখখানা। অবাক হয়ে দেখছিল বিলু। মাটিতে গোড় হয়ে বসে মা কে প্রণাম করলো বিলু। তার দেখাদেখি ছোট্ট মেয়েটাও প্রণাম করলো মাকে । কি যেন একটা বলতে চাইলো ভেবলি। হয়তো মায়ের স্নেহশীল মুখটি দেখে কিছু বলতে ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু কোন ভাষা বার হলো না তার মুখ দিয়ে কয়েকটি অগুছালো ত ত শব্দ ছাড়া। পরম স্নেহে ভেবলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো বিলু। অনেকক্ষণ পরে সেই মিষ্টি হাঁসিটা আবার দেখা গেলো ভেবলির মুখে।

দলবেঁধে প্রসাদ নিচ্ছিলো সবাই। বিলু আর ভেবলিও দাঁড়িয়ে গেলো প্রসাদ নিতে। শালপাতার বাটিতে খিচুড়ি প্রসাদ, সঙ্গে আলুর দম। খিদের পেটে দুজনের মনে হচ্ছিলো যেন অমৃত। ওরা চেয়ে দুবার প্রসাদ নিলো। খেয়ে দুজনের পেটের খিদে আর মনের শান্তি দুইই হলো। ওরা যখন দ্বিতীয়বারের প্রসাদ প্রায় শেষ করে এনেছে তখন যারা প্রসাদ বিলি করছিলো তাদের একজন এগিয়ে এলো ওদের দিকে। এসে বললো,"এই তোরা কোন পাড়া থেকে এসেছিস রে? কোন পাড়া? চাঁদা দিয়েছিস তোরা? খুব তো বার বার করে প্রসাদ খাচ্ছিস। কি নাম তোদের? তোদের তো দেখিনি কোনদিন। এই চাঁদু, তুই চিনিস এদের? চাঁদা দিয়েছিলো?" ওপাশ থেকে চাঁদুর গলা ভেসে,"না দাদা, এদের চিনি না, এরা চাঁদা দেয়নি। সঙ্গে সঙ্গে গামছা আর জামা পড়া ছেলেটা চেপে ধরলো বিলুর কলার, চোখ রাঙিয়ে বললো,"ভালো মজা পেয়েছিস না রে। ভেবেছিস চাঁদা না দিয়ে খেয়ে জাবি। তুই নিশ্চই চালকলের ওদিক থেকে এসেছিস।" বলেই গায়ে ধাক্কা দিতে লাগলো বিলুর। সজোরে ধাক্কা লাগে ভেবলির হাত খসে গেলো বিলুর হাত থেকে। ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে ভেবলির কান্না শুনতে পেলো বিলু কিন্তু দাঁড়াতে পারলো না। আরও কজন এসে ধাক্কা দিতে লাগলো তাকে আর ধাক্কা খেয়ে এবার প্যান্ডেলের বাইরে ছিটকে পড়লো বিলু। কাঁদতে কাঁদতে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে এলো ভেবলি। বিলুর হাতের প্রসাদ ছত্রখান হয়ে পরে রইলো মাটিতে। বিলু ভাবতে পারছিলো না মায়ের প্রসাদেরও দাম দিতে হবে তাদের। কিন্তু মায়ের প্রসাদ তো সবার জন্য? মা কি সন্তানের কাছে দাম চায়? তাহলে এরা দাম চাইছে কেন? পড়ে গিয়ে হাঁটুর কাছটা ছিঁড়ে গিয়েছিলো তার, গড়িয়ে পড়ছিলো গরম রক্ত। অবাক হয়ে মাটিতেই বসে রইলো বিলু। ভেবলি এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে আর তখনই ঝম ঝম করে নামলো বৃষ্টি। 

বৃষ্টির ফোঁটা নাকে, কপালে পড়লেও কিছুক্ষণ সম্বিৎ ফিরে পেলো না বিলু। প্যান্টের হাঁটুর কাছটা ছিঁড়ে গেছে। কোনোরকমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠে দাঁড়ালো সে। বৃষ্টি এসে পড়ছিলো ওদের গায়ে, মাথায়। তবুও যেন ঘোর কাটছিল না বিলুর। আস্তে আস্তে নিজেকে কোনরকমে একটু গুছিয়ে নিয়ে ভেবলিকে কোলে তুলে নিলো বিলু, তারপর ছুটে এগিয়ে গেলো রাস্তা ধরে। কিছুটা পরেই একটা উড়ালপুল। উড়ালপুলের তলায় কোনরকমে আশ্রয় নিলো ওরা দুজন। নিজের জামা খুলে নিংড়ে নিয়ে তাই দিয়েই ভেবলির মাথা পরম যত্নে মুছিয়ে দিলো বিলু। না, নিজের হাঁটুর ব্যাথা সে আর টের পাচ্ছিলো না। তার এই ছোট্ট বোনটিই তার ধ্যান জ্ঞান। নাক দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিলো ভেবলির। সেটা মুছিয়ে দিতেই খিল খিল করে হেঁসে উঠলো ভেবলি। 

ওদিকে ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। মনে হচ্ছে আকাশ কালো করা মেঘ যেন আজকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে পৃথিবীকে। কলকাতা শহরটাকে আজ যেন মনে হচ্ছে জলছবি। জলরং করা দিন যেন ধুয়ে নামছে রাস্তায়। মাঝে মাঝে একটা, দুটো করে বাস অথবা ট্রাম চলে যাচ্ছে জল কেটে। চাকার তলা থেকে ছিটকে উঠছে জল। ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই যাতায়াত করছে ব্যস্ত শহর। রাস্তার দুপাশ দিয়ে বিরাট বিরাট বাড়ি। বৃষ্টি মাথায় করে লোকগুলো যাচ্ছে নিজেদের কাজে অথবা নিশ্চিত, শান্তির আশ্রয়ে। বিলুর মনে হলো এই এতবড়ো শহরে সব মানুষেরই আছে শান্তির আশ্রয়। আশ্রয় নেই শুধু তাদের দুজনের, এক অবুঝ শিশুর আর তার। বিলুর হঠাৎ চোখ পড়ে গেলো একটা কাকের উপর। আকাশে উড়ে উড়ে ক্লান্ত কাকটা উড়ে এসে বসলো রাস্তায়। দু পা হেঁটে আবার গেলো উড়ে। আবার এসে বসলো একটা দোকানের টিনের চালায়। অক্লান্ত বৃষ্টিতে ভিজছিলো কাকটা। কিন্তু এবার সে হঠাৎ উড়ে গিয়ে বসলো একটা গাছের ডালে। বিলু অবাক হয়ে দেখলো সেই ডালে একটা বাসা। কাকটা উড়ে গিয়ে বসলো সেই বাসায় যেখান তার জন্য অপেক্ষা করছে তার বাচ্চারা, নিরাপদ আশ্রয়। হু হু করে উঠলো বিলুর মনটা। বুকের মাঝখানটা মুচড়ে উঠল তার। কি করে সে জোগাড় করবে নিরাপদ ঠিকানা, শান্তির নীড়? কোথায় যাবে সে ভেবলিকে নিয়ে, কি খাবে? এই শহরে কে দেবে তাদের আশ্রয়? কিভাবে সে রক্ষা করবে ভেবলিকে? ভেবলি কি বড়ো হয়ে উঠবে পথশিশু হয়ে? কি করে বাঁচবে সে? সে যে অবোধ, জ্ঞান যে হয়নি তার। কি হবে তাদের ভবিষ্যৎ?

কোথা থেকে হঠাৎ ভেসে এলো শিশু কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ। বিলু তাকিয়ে দেখলো তাদের একটু পাশেই মাটিতে ছেঁড়া কাপড় পেতে বসে রয়েছে একটি পরিবার। একটি ত্রিপলের টুকরো দিয়ে বৃষ্টির অবুঝ জলের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে একজন মা তার শিশুকে। হওয়ার ঝাপটায় উড়ে যাচ্ছে ত্রিপল। জলের ছিটে গিয়ে পড়ছে শিশুটির উপর আর তার ফলেই কেঁদে উঠছে সে। সে তাকিয়ে দেখলো কি অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করছে সেই মা, নিরুপায় সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির খেয়ালের বিরুদ্ধে। শত চেষ্টাতেও জল আটকাতে পারছে না সে। হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে গেলো সেই মায়ের সাথে বিলুর। সেই অসহায় দৃষ্টির থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না বিলু। ঠিক তখনই একটা বিশাল গাড়ি এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। গাড়ির কাঁচ খুলে বৃষ্টির অঝোর ধারায় ভিজছিলো দুটি মেয়ে। সেই অসহায় মায়ের নিরুপায় প্রচেষ্টা দেখে হা হা করে হেঁসে উঠলো তারা। যেন বিনোদনের এর চেয়ে ভাল নজির তারা আর দেখেনি। শিউরে উঠলো বিলু ওদের হাঁসি দেখে। তার মনে হলো,"এ কেমন শহর যে অন্যের দুঃখ দেখে হাসে, যাদের কাছে মানুষ অসহায় অবস্থা আনন্দের খোরাক। এ শহর বড়োই নির্দয়, নিষ্ঠূর। তার মনে হলো সে এখনই ছুটে যায় এ শহর থেকে বহু বহু দূরে, এই নির্মম সত্যিগুলোর হাতের বাইরে, কোন অন্য দেশে যেখানে মানুষের হৃদয় আরও নরম, অন্যের প্রতি সহিষ্ণু, সহানুভূতিশীল, মমতাময়। 

কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি থেমে গেলো। কান্নাভেজা শহরে আর ভালো লাগছিলো না বিলুর। একটা বাস দেখে ভেবলিকে নিয়ে উঠে পড়লো সে। একটু পরে পৌঁছেও গেলো হাওড়া স্টেশন। কোথায় যাব তার ঠিকানা নেই তাই ভাবার কিছু ছিল না। যেটুকু টাকা বাকি ছিল তাই দিয়ে দুটো টিকিট কিনে উঠে বসলো একটা অজানা ট্রেনে। ট্রেন যাবে দিল্লি অবধি তাই টাকায় যেটুকু কুলায় ততদূর অবধি টিকেট কেটেছিল বিলু। তার কাছে আর এক বার খাওয়ার মতো টাকা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ট্রেনের মধ্যে জায়গা না পাওয়ায় একটা কামরার বাথরুমের সামনে মেঝেতেই বসে পড়লো বিলু আর ভেবলি। ভেবলি নিজের মনে খেলা করছিলো আর বিলু দূরে, দিগন্তবিস্তৃত শূন্যতার দিকে তাকিয়ে ছিল। ঝমাঝম শব্দে ছুটে চলেছিল ট্রেন আর কেঁপে কেঁপে উঠছিল বিলুর বুক। কি আছে তাদের সামনে? কি ভাবে বেঁচে থাকব তারা? এই চিন্তা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। 

বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তন্দ্রা এসে গিয়েছিলো বিলুর। কে যেন কাঁধে ঝাকুনি দিয়ে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। বিলু ধর মর করে উঠে বসে দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে টিকেট পরীক্ষক। বিলু উঠে বসেছিল সংরক্ষিত কামরায় কিন্তু তার টিকিট ছিল অসংরক্ষিত। সেটা দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন টিকেট পরীক্ষক। তিনি সোজা বলে দিলেন হয় তাদের জরিমানা দিতে হবে নয়তো পরের স্টেশনে নেমে যেতে হবে অসংরক্ষিত কামরায়। বিলু বার বার বোঝানোর চেষ্টা করলো যে ছোট্ট ভেবলিকে নিয়ে সে ভিড়ে ঠাসা অসংরক্ষিত কামরায় টিকতে পারবে না কিন্তু টিকিট পরীক্ষক নাছোড়বান্দা। তিনি বিলুকে প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে আদেশ দিলেন যে তারা যেন এখনই শেষ সংরক্ষিত কামরায় চলে যায় যাতে যে কোন উপায়ে স্টেশন এলে অসংরক্ষিত কামরায় যেতে পারে। বাদ্ধ হয়ে ভেবলিকে কোলে তুলে নিলো বিলু। এগিয়ে গেলো কামরা ধরে। একের একের পর এক কামরা পার হতে হতে চলেছিল তারা আর তাদের পিছনে লেগেছিল সেই টিকেট পরীক্ষক। কিন্তু বিলু মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল যে সে অসংরক্ষিত কামরায় যাবে না। একটু পরেই এলো স্টেশন কিন্তু বিলু কোনোরকমে একটা বাথরুমের মধ্যে ঢুকে পড়ে নিজেকে বাঁচাল। তারপর থেকেই শুরু হলো লুকোচুরি। ট্রেনের এপাশ থেকে ওপাশ অবধি আসা যাওয়া এবং পরীক্ষককে দেখলে বাথরুমে ঢুকে প্রাণ বাঁচানো। 

এইভাবে কেটে গেলো বেশ কয়েক ঘন্টা। দিনের গন্ডি পেরিয়ে তখন গুটি গুটি এসে পড়েছে রাতের কালো। গাঢ় অন্ধকার চিরে প্রচন্ড বেগে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। বাইরে অন্ধকার যেন নিজেই একটা প্রাচীর, অভেদ্য, নিরেট। পরবর্তী স্টেশন আসতে দেরি প্রায় কয়েক ঘন্টা। পালিয়ে পালিয়ে হাঁপিয়ে গিয়েছিলো বিলু। সারাদিনের ধকল ও একটা সাত বছরের মেয়েকে কোলে করে ট্রেনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেরিয়ে সে হয়ে পড়েছিল অতিশয় ক্লান্ত। এমন সময়ে এ সি কামরার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় তার কানে ভেসে এলো এক বয়স্ক বৃদ্ধের কাশির আওয়াজ। প্রচন্ড কাশছেন ভদ্রলোক কিন্তু কেউ তাকে জলটাও এগিয়ে দিচ্ছে না। লোকটা হাতড়ে হাতড়ে জলের বোতলটা ধরার চেষ্টা করছেন কিন্তু দমকে দমকে এতো কাশি উঠছে যে তিনি বোতলটাকে আঁকড়ে ধরতে পারছেন না। বাকি কামরার লোক তাকে নিয়ে বিশেষ বিরক্ত। চারপাশ থেকে আওয়াজ উঠছে," উফফ জ্বালালো। " কেউ বা বলে উঠছেন,"এখানেই মরে যাবে না তো"। কথা বলছেন অনেকেই কিন্তু কেউ উঠে সাহায্য করছেন না ভদ্রলোককে। বাদ্ধ হয়ে বিলুই এগিয়ে এলো। শুধু জলটা এগিয়ে দিলো না, ভদ্রলোকের কাঁপা হাত ধরে সেই জল খেতে তাকে সাহায্যও করলো। ভদ্রলোক অবাকনয়নে চেয়ে রইলেন ওর দিকে। বিলু জিজ্ঞাসা করলো,"আপনার কাছে কি কোন ওষুধ আছে?" ভদ্রলোক বললেন,"তা আছে বাবা, তবে নিচে ওই সুটকেসের বাইরের পকেটে কিন্তু এতো ভারী সুটকেস কুলিতে রেখে দিয়ে গেছে, আমি তো বার করতে পারবো না। কাশির দমক এমনিতে আমার লাগে না তবে আজ মনে হয় হাঁপানির টানটা হঠাৎ আবার উঠেছে। ভেবেছিলাম কাউকে বলবো বার করে দিতে কিন্তু সেরকম কাউকে পেলাম না। একটু দেখো না বাবা, প্রাণটা বেরিয়ে যাবে মনে হচ্ছে।" বিলু সঙ্গে সঙ্গে নিচু হয়ে সুটকেসটা টেনে বার করলো, এক নিমেষে খুঁজে বার করলো ওনার ওষুধ। পরম মমতায় ভদ্র্লোককে খাইয়ে দিলো ওষুধ। কাশির দমক সহজে থামে না কিন্তু তবুও সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে কমে এলো কাশি। ভদ্রলোক একটু দম নিয়ে বললেন,"তুমি কে বাবা, দেখলাম তোমাকে কয়েকবার এই মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া আসা করতে। সিট্ কি পাওনি? কোথায় নামবে?" কিছু উত্তর দিতে যাওয়ার আগেই ঘনিয়ে এলো চরম বিপদ। সামনে সেই টিকিট পরীক্ষক যে কিছুক্ষন আগেই ঝাঁঝিয়ে বলেছিলেন এবার না নামলে রেল পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবেন। বিলুকে দেখা মাত্র চিৎকার করে উঠলেন তিনি,"তুই আবার, এবার তোকে আর ছাড়বো না। পিছনেই আসছে পুলিশ। হয় জরিমানা দে নয়তো জেলে যা"। সোজা বিলুর কলার চেপে ধরলেন ভদ্রলোক। গলাধাক্কা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন দরজার দিকে। বিলু শুধু শুনতে পেলো ভেবলির অসহায় কান্না। ঠিক তখনই শোনা গেলো এক দুর্বল কণ্ঠস্বর। কাশির দমকের মাঝখানে কোনরকমে জিজ্ঞাসা করলেন সেই ভদ্রলোক,"কি ব্যাপার?" টিকিট পরীক্ষক কোনো জবাব দেবে তার আগেই আবার উঠলো কাশির দমক। কাশতে কাশতে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলেন ভদ্রলোক। বিলু ছুটে গিয়ে কিছু না ভেবেই তার বুকে মালিশ করে দিতে লাগলো। একটু একটু করে গলায় দিতে লাগলো জল। এতটা অসুস্থতা দেখে টিকিট পরীক্ষকও একটু ঘাবড়ে গেছিলেন। তিনি বিলুকে ছেড়ে এগিয়ে গেলেন আগে। এর পর যত রাত গড়ালো ততটাই ভদ্রলোকের কাশি আর শাসকষ্ট বাড়তে লাগলো। একটা সময় এমন এলো যে বিলু বুঝতে পারলো ডাক্তার ছাড়া আর চলবে না। পরের স্টেশনে বাধ্য হয়েই ভদ্রলোককে নামতে হলো। সাথে নামলো বিলু আর ভেবলি। সেই গভীর রাতেই অনেক কাকুতিমিনতি করে জোগাড় হলো কয়েকজন লোক। ভদ্রলোককে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতাল। বিলু ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলো ওনাকে। ডাক্তারদের চেষ্টায় এবং বিলুর সহযোগিতায় সকালের দিকে একটু সুস্থ হলেন ভদ্রলোক। জানতে চাইলেন বিলু কে? কি তার পরিচয়? এক অজানা, অচেনা মানুষের জন্য সে এতটা করলেই বা কেন? বিলু নিজের পরিচয় দিলেও কেন সে তাকে এভাবে আগলে রেখে তার শুশ্রুষা করলো, এর কোনো সদুত্তর দিতে পারলো না। বিলুর নিজের কাছেও এর কোনো উত্তর ছিলোনা। হয়তো মানুষের বঞ্চনা দেখতে দেখতে বিলু নিজের মনের গভীরে ঠিক করে নিয়েছিল যে সে এরকম হবে না। সে হবে প্রকৃত মানুষ। 

এর পরের বৃত্তান্ত মায়ের মহিমা। সব কথা শুনলেন ভদ্রলোক বিলুর কাছে। বিলু ভেবলির চেয়ে অনেক বড়ো হলেও বয়েসে নাবালক। কেউ যখন দরদিয়া হয়ে তাদের কষ্টের কথা জানতে চাইলো তখন সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। দুকূল ভাঙা নদীর মতো উথলে উঠলো তার চোখের জল। সব কথা শুনে ভদ্রলোক বললেন,"জানো আমার কেউ নেই। আমি প্রতিষ্ঠিত উকিল, কিন্তু আমার স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় দশ বছর আর আমার ছেলে তার পরিবার নিয়ে আমেরিকায় থাকে, তাদের এদেশে ফেরার সময় নেই। এই বৃদ্ধের একাতিত্ব কি তোমরা ঘোঁচাবে, সঙ্গে থাকবে আমার?" নাবালক বলেই বোধহয়, কোনো সন্দেহ হলো না বিলুর। ভদ্রলোক একটু সুস্থ হয়ে উঠলে, বিলুরা ওনার সাথেই গেলো ওনার বাড়িতে। প্রাসাদোপম বাড়ি কিন্তু জনশূন্য। দেখতে দেখতে কেটে গেলো দিন। বিলুর যত্নে আর ভেবলির হাসিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো সে বাড়ি। বিলু ভর্তি হলো আল্লহাবাদের মহাবিদ্যালয়ে। আস্তে আস্তে সে সম্পূর্ণ করলো তার পড়াশোনা। সে পড়াশোনা করলো আইন নিয়ে আর একদিন কাজ শুরু করল তার আশ্রয়দাতার সঙ্গেই। ভেবলিও ভর্তি হলো স্কুলে, যদিও তাকে স্কুলে রাখা গেলোনা। তার জন্য থাকলো একজন সবসময়ের দেখাশোনার লোক ও শিক্ষিকা। ধীরে ধীরে সেও হয়ে উঠলো আগের চেয়ে অনেক ভালো। 

বেশ কবছর পরের এক দিন। সকালবেলা খুব চেঁচামেচি চলছে দত্তবাড়িতে। বাড়ির কাজের জন্য রাখা লোকটা নাকি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এই নিয়ে দত্তগিন্নি রেগে আগুন তেলে বেগুন। এমন সময় টিং টং করে সদরদরজার ঘন্টা বাজলো। দত্তবাবু গিয়ে দেখলেন দরজায় একজন একটা কাগজের খাম নিয়ে হাজির। খাম খুলে কাগজটা কিছুটা পড়ে মাথায় হাত দিলেন দত্তবাবু। বাড়ি থেকে বেরিয়ে লোকটাকে খোঁজার চেষ্টা করলেন। পাশের বাড়ির কোনা থেকে দত্তবাবুর অস্থির অবস্থা দেখে হাঁসলো বিলু। কোর্টের নোটিশটা তার কাজ যথার্থভাবে করেছে। দত্তবাবুর কথা ভেবে হাঁসতে হাঁসতে উল্টোদিকে হাঁটা দিলো সে। 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment