1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

তিলোত্তমার তিল

ছবি : ইন্টারনেট

তিলোত্তমার তিল

ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

সবাই তো একটা বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েই ছিল সুকেশকে। বত্রিশ বছরে বিপত্নীক হলে মাত্র তিন বছরের ছেলেটাকে কে দেখবে এটা অবশ্যই একটা সমস্যা। কিন্তু সুদেষ্ণাকে সে এত ভালবাসত যে আর বিয়ে করার কথা ভাবে নি। সে যতই ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বলুক না কেন।

দুর্ঘটনাটা তার জীবনটাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিয়েছিল। উত্তর ভারতে ভ্রমণে বেরিয়েছিল সুদেষ্ণারা। গাড়িটা রাস্তা থেকে গড়িয়ে পাহাড়ী খাদে পড়েছিল। সুদেষ্ণা আর তার বাবা মারা গেলেও  দৈবানুগ্রহে বেঁচে গিয়েছিল বুবাই আর তার দিদা। আজ থেকে মাত্র বছর দুয়েক আগের ঘটনা। শেষ মুহূর্তে সুকেশ তার যাত্রা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল অফিসের জরুরী কাজে আটকে যাওয়ার জন্যে। তাই আজ সে এই শোক-স্মৃতির কালো ছায়া মনের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  

একা হয়ে গেল সুকেশ। কিন্তু তার তিন বছরের ছেলেকে এখন দেখবে কে? পরামর্শটা এসেছিল সেই কারণেই। সুদেষ্ণার মা-ও মেয়েকে আর স্বামীকে হারিয়ে একটা অবলম্বন চাইছিল। জামাই আর বুবাইয়ের ব্যথাটাও বুঝত। জামাইকে বলল, বুবাইয়ের একটা মা তো আনতে পারতে তুমি? ও বেচারি থাকে কী করে বল? তার চেয়ে বলি কী ও বরং আমার কাছে গিয়েই থাকুক। রুবিটার বিয়ে হয়ে গেলে আমিও তো একাই প্রায়। তুমি কী বল?  

বুবাই গেলে নিজের বড় কষ্ট হবে। সে তো তার বাবারও একটা অবলম্বন। কিন্তু ভেবে দেখল একটা বাচ্চার কাছে মায়ের কোনও বিকল্প নেই। সারাটা দিন তো সে অফিস করবে। সারাটা সন্ধ্যে আর রাত ধরে গ্রাস করবে মৃত সুদেষ্ণার চিন্তা। ছেলেকে দেখবে কখন?  

বিয়ে করার কথায় দোটানায় ছত্রিশ বছরের সুকেশ। সৎ মা যে কখনোই আসল একটা মা হতে পারে না তা সে ভাল করেই জানে। নিজে বিয়ে করে বেচারিকে আবার একটা ঝামেলায় ফেলে দেওয়া। আবার সদ্য হওয়া এক বৌয়ের সামনে তো আর বিগত হয়ে যাওয়া আর এক বৌ-এর কথা ভাবা যায় না ভাল করে। হয়ত প্রতি নিয়তই তা সৃষ্টি করবে নানা ঝামেলা। তাই আবার বিয়ে করার চিন্তা সে স্থান দেয় নি মাথায়।   

বুবায়ের মাসি ভাগ্যজোরে বেঁচে গিয়েছিল। সে বেড়াতে যায় নি। ছিল মামার বাড়িতে। সুকেশের শাশুড়ির এখন একমাত্র জীবিত সন্তান বলতে সে।

এখনও তার বিয়ে হয় নি। শাশুড়ি একবার ভেবেছিল তার সঙ্গে জামাইয়ের বিয়ে দিলে একসঙ্গে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। মেয়েটারও বিয়ে হয়ে যায় জানাশোনা একজনের সঙ্গে। আবার নাতিও একটা জানাশোনা মা পেয়ে যায়।

কিন্তু সুকেশ কিছুতেই শালিকে বিয়ে করতে রাজি নয়। এ ভাবে বুবাইকে একটা ছন্নছাড়া সংসারে ফেলে রাখা হয়ত তার ভবিষ্যতের জন্যেই বেঠিক। বুবাই তার দিদার বাড়িতে দিদা আর মাসির সঙ্গে মানুষ হতে লাগল। আর সুকেশ একটা হালভাঙ্গা নৌকোর মত এদিক সেদিক ভেসে বেড়াতে লাগল। কাটল আরও কটা বছর। তার যৌবন অপূর্ণতার দুঃখ বুকে নিয়ে কোনোরকমে করতে লাগল দিন গুজরান।  

মদ একটু আধটু খেত সে। এখন একটু বাড়িয়ে দিল মাত্রাটা এই যা। বন্ধুরা বলল, থাক যা করছে করুক। একটা তো কিছু করতে হবে মানুষকে নাকি? অফিসের কাজটা তো ঠিক করছে। দেবদাস তো আর হয়ে যায় নি।

সুকেশকে বলল, দেখিস মদ আবার তোকে যেন পুরোপুরি না খেয়ে বসে।

কথায় বলে পঞ্চ ম-কার। একটা ম এলে নাকি আর একটা আসার জন্যে বায়না ধরে। এমনি ভাবে আর একটা। মদ যখন ভালভাবে এসে জাঁকিয়ে বসেছে তখন তার ঘনিষ্ঠ একজন বলল সেই দ্বিতীয় ম-কারের কথা। বেশ ভাল দেখতে মেয়েটাকে। বয়েস পঁচিশ ছাব্বিশের মধ্যেই। কিংবা মেরে কেটে তিরিশ হবে এর বেশি না। টাকাও যে খুব বেশি লাগবে তা নয়। ও আসবে মাঝে মাঝে সন্ধেবেলা। বাড়ি তো সুকেশের একেবারে ফাঁকাই। পাড়াও এমন নয় যে সন্ধ্যের অন্ধকারে একটা মেয়ের যাওয়া আসা নিয়ে সরগরম করে ফেলবে।  

শনিবার অফিস থেকে ফিরে মদের বোতলটা নিয়ে সবে বসেছিল এমন সময় ডোর বেল।

---হাই! আমি তিলোত্তমা। আমার কথা---

হাই করল সুকেশও। তারপর বলল, হ্যাঁ আপনার কথা অনীল বলেছিল পরশুও। কিন্তু আমি সব গুলে মেরে দিয়েছিলাম। বলে একটু অপ্রস্তুত হাসল।

বেশ সুন্দরী মেয়েটি। খুব একটা ফর্সা যে তা নয়। রঙ খুব ময়লা তাও নয়। বেশ মিষ্টি দেখতে। অনীল বলেছিল এর নাম তিলোত্তমা। ব্যাচেলর কিংবা বিপত্নীকদের সঙ্গ দেয়। তা অন্তত সন্ধ্যের দিকে ঘন্টা দুয়েক তো বটেই। আর বেশি কটা টাকা গুণে দিলে বাড়তি ক’ঘন্টা। বিয়ে তুই করতে চাইছিস না যখন তখন একটা বিকল্প তো দরকার নাকি?

তিলোত্তমা ঘরে ঢুকে এগিয়ে গিয়েছিল তার মদের টেবিলের দিকে। হাত দিয়ে সব তাকে তুলে রেখে মিষ্টি হেসে বলল, এমন ভাবে রঙিন রসে সারাক্ষণ ডুবে থাকলে অন্য সব কিছুই যে ভুলে যেতে হবে ডার্লিং।   

সুকেশ ভীষণ অবাক হল এই ভেবে যে, সে কিছুতেই এ কাজে বাধা দিতে পারল না তিলোত্তমাকে। অথচ সে তো সুকেশের বৌ নয়। সামান্য একজন বারবনিতা মাত্র। টাকার বিনিময়ে সঙ্গ দিতে এসেছে এক নিঃসঙ্গ বিপত্নীককে।

একেবারে নিরাশ করল না তাকে তিলোত্তমা, খাবে খাবে। আগে এই রসে হাবুডুবু খাও দেখি।

নিজের দিকে ইংগিত করেছে সে। ওড়নাটা খুব আলগা হয়ে ঝুলছে কাঁধ থেকে। ভীষণ এক নেশাধরানো যৌবন। ঠিক বলেছিল মেয়েটা। তারও মনে হল এই মাতাল করা যৌবনের কাছে তুচ্ছ বোতলবন্দী ওই রঙিন পানীয়টা।

---আমাকে অমন আপনি আজ্ঞে করলে আর তোমায় সন্তুষ্ট করি কি করে গো? তিলোত্তমা বলল, আর দূরে নয়। এস আমরা খুব কাছে কাছে আসি। আমরা এক হয়ে যাই।

হ্যাঁ, মেয়েটি একটু শিক্ষিত টিক্ষিত মনে হচ্ছে। হয়ত আজকাল শিক্ষিত মেয়েরা এ লাইনে আসছে। হয়ত এখন এক শ্রেণীর মেয়ে এটাকে স্বাধীন পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে। আগের  মত অশিক্ষিত গরিব ঘর থেকে অথবা বিক্রি বা পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের মত বাধ্য হয়ে এরা আসে নি। কে জানে হয়ত এসব অনীল জানে। সত্যি বলতে কি সে এদের সান্নিধ্যে বিশেষ আসে নি।   

বেশ যত্নের সঙ্গে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিল তিলোত্তমা। তারপর তাক থেকে বার করল মদের বোতল আর দুটো পেগ। ঢেলে এগিয়ে দিল সুকেশের দিকে। তারপর নিজের পেগ ভরতি করে সুকেশেরটায় টাচ করে বলল, চিয়ার্স।  

এত যত্ন বারবনিতারা করে কিনা জানে না সুকেশ। অনীল তো তাকে বলে নি কখনও। মদ খেলেও মেয়েতে রুচি বিশেষ ছিল না। বিয়েও যে খুব বেশি বয়েসে করেছে তা নয়। সুদেষ্ণা চলে যাবার পর সুকেশ তো রোজ সন্ধ্যেতে বসে মদের বোতল আর পেগ নিয়ে। খায় কখনও সিপ করে করে আবার কখনও খায় ঢক ঢক করে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে মনে একটা নতুন আনন্দের জোয়ার এসে গেছে। আচ্ছা বারবনিতারা কি এমনভাবে আপন হয়ে যায়? দেহের কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে মনের কাছাকাছিও চলে আসে?

নিজের অনভিজ্ঞতার জন্যে নিজের খুব অস্বস্তি লাগল। কিন্তু কেন জানে না এই মুহূর্তে তিলোত্তমাকে তার এতটুকু ভাড়া করা মেয়ে মনে হচ্ছে না। আজ মাত্র কটা মিনিট আগে তার সঙ্গে পরিচয় অথচ তার মনে হচ্ছে এ যেন তার বহুদিনের পরিচিত।

একটা একটা করে চুমুক দিতে দিতে মেয়েটাকে দেখছিল সুকেশ। এতক্ষণে একটা জিনিস তার চোখে পড়ল। তার চিবুকে একটা ছোট্ট তিল। ছোট্ট অথচ সুন্দর। ছোট্ট একটা কালো রঙের বস্তু মুখের সৌন্দর্যকে এত বাড়িয়ে তুলতে পারে কখনও ভেবে দেখে নি। খুব সন্দেহের সঙ্গে তাকাল তিলোত্তমার মুখের দিকে। খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তার মনে একটা ভয় এসে বাসা বাঁধল। যদি এর মুখে সুদেষ্ণার মুখ ভেসে ওঠে? এই ভাড়া করা মেয়ের মুখে সেটা যে কী অস্বস্তিকর বেমানান ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।   

বুবাইকে নিয়ে প্রতি শনিবার সন্ধ্যেবেলা আসে ওর মাসি। আর রাত নটার মধ্যেই বুবাইকে বাবার কাছে পৌঁছে দিয়ে চলে যায়। আবার সোমবার সকালে এসে বুবাইকে নিয়ে চলে যায়। তিলোত্তমা আসতে শুরু করার পর থেকে তার আসা আর হয় নি। কারণ তার স্কুলের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সুকেশও তাকে আসতে বারণ করেছিল। বলেছিল সে নিজে থেকে না বললে যেন বুবাইকে এখানে নিয়ে আসা না হয়। দরকার হলে সে নিজে গিয়ে দেখা করে আসবে ছেলের সঙ্গে।   

এর মধ্যে বেশ কয়েকবার অফিস থেকে ফেরার পথে দেখা করেও আসছিল সে। যদিও আসল কারণটা জানায় নি বা জানানো সম্ভব হয় নি। কারণ এটা খুব অস্বস্তিকর বুবাই, তার দিদা বা মাসির কাছে। তখনই অনীলকে বলেছিল, নিজের বাড়ির মধ্যে এসব করা কি ঠিক হচ্ছে ভাই? জানতে পারলে কেলেংকারি হয়ে যাবে কিন্তু।

---কেউ জানতেই পারবে না। ও আমি ম্যানেজ করে দেব। তুই বলবি আমার অফিসে নতুন জয়েন করেছে। কাজ বুঝে নিতে আসে। তবে এই দিনগুলোতে তোর ছেলে বা শ্বশুরবাড়ির কেউ যেন না আসে।

কিন্তু হঠাৎ এক শনিবার তারা এসে হাজির। তারা মানে বুবাই আর বুবাইয়ের মাসি। একেবারে আচমকা কোনও ফোন না করেই। বুবাইয়ের দিদা ভালমানুষ কোনও সন্দেহ হয় নি তার মনে। মানে জামাইয়ের এই শনি রবিবার দারুণ ব্যস্ত থাকার খবরে। কিন্তু রুবির একটু হয়েছিল। জামাইবাবুকে সে একটু পছন্দও করত। আবার সেই পছন্দটা সময়ের সার পেয়ে ভালবাসায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তার সঙ্গে বিয়ের কথাটা জামাইবাবু মেনে নিতে পারে নি দেখে বেশ ক্ষুন্ন হয়েছিল। হয়েছিল একটু জেলাসও। ভাবছিল জামাইবাবুর আবার অন্য কারোর সঙ্গে লটঘট নেই তো? না হলে তার অফিসে কাজের এতই চাপ যে উইক এন্ডগুলোও ব্যস্ত থাকতে হয়? একটু ব্যাপারটা দেখার ইচ্ছায় আজ ফোন না করেই চলে এসেছে। আর এসেছে বুবাইকে সঙ্গে নিয়েই। না হলে একা আসাটা যেমন ভাল দেখায় না তেমনি বুবাইকে সঙ্গে নিয়ে এলে আসার একটা ভাল অছিলা পাওয়া যায়। তাছাড়া বুবাইয়ের পরীক্ষাও তো গতকাল শেষ হয়ে গেছে।   

তিলোত্তমাও এসেছে একটু আগে। যেমন সে আসে। এখন শুরু হবে তার সুকেশের মন ভোলানোর পালা। সেই পালার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে এমন সময় ডোর বেল। অপ্রস্তুত সুকেশ দরজা খুলতেই ওরা সটান ঢুকে পড়েছে। তিলোত্তমাও একটু অপ্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু বুবাই আর তার মাসির মুখোমুখি হয়ে ঝটপট হাসিমুখে নিজেই জবাব দিল, এই সুকেশদার কাছে এসেছিলাম। আমি কয়েক মাস হল ওনার অফিসে জয়েন করেছি। একটু কাজকম্ম বুঝে নিতে এসেছিলাম। উনি আমার ইমিডিয়েট বস হন কিনা--

সুকেশ তাড়াতাড়ি বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার কলিগ হয়। তিলোত্তমা সেন। আর এ হল রুবি। ভাল নাম সুলগ্না। আমার ছেলে বুবাইয়ের মাসি।  

রুবির চোখে সন্দেহের একটা অস্পষ্ট ছায়া কিন্তু থেকেই গেল।    

তিলোত্তমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে বুবাই। চোখ যেন আর তার ফেরে না। পড়ে না চোখের পাতাও।

আজ অবশ্য মদ খায় নি সুকেশ। তিলোত্তমা তাকে বলেছিল, মানুষ প্রথমে মদকে খায়। মদ পরে মানুষকে খায়। সামান্য একটা বোতলে ভরা পানীয় ধীরে ধীরে তোমাকে গ্রাস করুক এটা আমি একেবারেই চাই না ডার্লিং।

অবাক হয়েছিল সুকেশ। দারুণ অবাক। একটা ভাড়া করা মেয়ে কি এমন কথা বলতে পারে? কিন্তু বলছে তো। এরা তো বরং বেশি করে নেশা ধরিয়ে দেয়। নেশার ফাঁক দিয়ে ফাঁক করে নিতে চায় লোকগুলোর সব কিছু। এদের সঙ্গে সুকেশদের সম্পর্ক তো শুধু টাকা আর ফূর্তির।

তবে সুকেশের বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে যেন সান্ত্বনার সুরে আবার বলেছিল, তা না হয় খেয়ো। একটু পরে খেয়ো। না হলে হয়ত রাতে আবার তোমার ঘুম হবে না।

রুবি একটু অবাক হল। কিছু কিছু যেন মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করছিল তার মনের সন্দেহের সঙ্গে। খানিকটা যেন মিলছিল আবার খানিকটা অমিল।

জিজ্ঞেস করল, তা তোমরা কি চা টা কিছু খেয়েছ জামাইবাবু?

সুকেশ তো তো করতে তিলোত্তমা বলল, সে না হয় অন্যদিন হবে। আজ আমার তাড়া আছে ভাই। একটা প্রোজেক্টের কাজ—বুঝতেই তো পারছ? ভারি মিষ্টি করে হেসেও দিল।

---না না সেকি। আমি করে আনছি। তুমি বস ভাই। রুবি ছুটল রান্নাঘরে।   

সুকেশ উঠল। বাথরুমের দিকে যাবে। নেশাটা একেবারে চোটপাট করে দিল। মদের নেশা তো বটেই এমন কি তিলোত্তমার নেশাটাও। তিলোত্তমা চলে যাওয়ার পর এক পেগ নিয়ে সিপ করতে করতে যেটা সে উপভোগ করতে চেয়েছিল চিন্তার ঠোঁট দিয়ে। সে আশায় বাধ সাধল রুবির এই হঠাৎ আসা। কিন্তু মেজাজ দেখানো সুকেশের স্বভাব নয়। আর এক্ষেত্রে উল্টো ফলও হতে পারে। রুবি কিছু সন্দেহ করে বসতে পারে।   

খাটের ওপর বসেছিল তিলোত্তমা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল বুবাই। তিলোত্তমা তাকে দু’হাত বাড়িয়ে কাছে আসার ইংগিত করল। কাছে এল বুবাই। তবে একেবারে কাছে নয়। সামান্য দূর থেকে তেমনি করে তিলোত্তমার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? 

তিলোত্তমা খুব মিষ্টি করে হেসে বলল, ধর আমি তোমার এক মাসি হই। তোমার এক আন্টি।

---মা। অস্ফুটে বলল বুবাই।

মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন কী একটা পরিবর্তন হয়ে গেল যেটার কোনও বাহ্যিক রূপ নেই। তাকে কোলে তুলে নিল তিলোত্তমা। আর বাধা দিল না কিন্তু বুবাই। সাধারণত অচেনা কারোর কোলেই সে যায় না। তার মাসি বা দিদার কথা অবশ্য আলাদা।

ততক্ষণে বাথরুম থেকে ফিরে এসেছে সুকেশ। তিলোত্তমার কোলে নিজের ছেলেকে দেখে বেশ বিরক্ত হল। একটা ভাড়া করা মেয়ের সঙ্গে নিজের ছেলের এত ভাব ভালবাসা ভাল লাগল না তার। যদি কোনোদিন জানতে পারে তিলোত্তমার সঙ্গে তার বাবার সম্পর্ক তবে সে কী ভাববে? একটু গম্ভীর হয়ে বলল, বুবাই যাও কিচেনে তোমার মাসি আছে। যাও ও ক্যাডবেরি দেবে।  

বুবাই তো যেতেই চায় না। নামতেও চায় না কোল থেকে। সে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তিলোত্তমার গালের ঐ ছোট্ট তিলটার দিকে। একেবারে মুগ্ধ হয়ে।

এমন সময় চায়ের কাপ নিয়ে রুবী এসে ঢুকল। সুকেশ বলল, বুবাইকে ও ঘরে নিয়ে যাও তো রুবি। আমরা একটু অফিসের কথা বলে নিই।

ওরা চলে গেল। চা খেতে খেতে তিলোত্তমা রহস্যময় হাসি হেসে বলল, আজ আর বোধহয় অফিসের আলোচনা হবে না কি বল?

---হয়ত। গম্ভীরভাবে জবাব দিল সুকেশ।

---একটা কথা---

অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল সুকেশ।

---আমরা কি বিয়ে করতে পারি না? আমাকে বিয়ে করতে পার না সুকেশ? একটু নিচু গলাতেই বলল তিলোত্তমা যাতে কথাটা এ ঘরের বাইরে না যায়।

বিয়ে? একটা বাজে মেয়ের সঙ্গে? তার মত অসংখ্য পুরুষকে সঙ্গ দিয়ে টাকা রোজগার করাই যার পেশা? গা রি রি করে উঠল সুকেশের। ভাবল এত সাহস বেড়েছে মেয়েটার? এ তো তার শয্যাসঙ্গিনী। মাত্র কয়েক ঘন্টার বিলাস মাত্র। আর বিয়ে? সে তো বাকি সারা জীবনের জন্যে নৈতিক, আইনত আর হৃদয়ের বন্ধন। দুটো কি করে এক হবে? তাছাড়া সুদেষ্ণা আর  তিলোত্তমা কখনও এক হতে পারে না। সুদেষ্ণাকে সাময়িকভাবে ভোলার জন্যেই তো তিলোত্তমাকে ডেকেছিল সে। কিন্তু এই মেয়ে এখন তলার কুড়োনর পরে গাছেরটার দিকে হাত বাড়াতে চায়? সুদেষ্ণাকে জন্মের মত ভুলিয়ে দিতে চাইছে। এরা কি স্বভাব-লোভী হয়?  

গম্ভীরভাবে বলল, নেভার। এটা কিছুতেই হতে পারে না।  

কথা না বলে উঠে পড়ল তিলোত্তমা। বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে এমন সময় মাসির হাত ছাড়িয়ে ছুটে এল বুবাই। তিলোত্তমার কোলে মুখ লুকিয়ে বলল, তুমি চলে যাচ্ছ মা?

রুবি সুকেশের মুখের দিকে তাকাল। আর সুকেশ থমথমে মুখে ভ্রূ কোঁচকাল।

---মা তুমি যেয়ো না মা।  

রুবির পলকহীন চোখ সুকেশের ওপর থেকে সরেই না। সে চোখে ঘোর সন্দেহ। আর লজ্জায় যেন মাথাটা কাটা যাচ্ছে সুকেশের। সে শুধু ভাবছে কতক্ষণে বিদেয় হবে পাজি মেয়েটা। গম্ভীর হয়ে বুবাইকে বলল, উনি তোমার আন্টি হন। ছেড়ে দাও বুবাই ওনার কাজ আছে।  

তিলোত্তমা অবাক হয়ে তাকাল সুকেশের দিকে। তারপর সামান্য কাতর হয়ে বুবাইয়ের দিকে। তারপর পা বাড়াল এক রকম জোর করেই।  

এই বাচ্চা ছেলেটার কথা থাক, সে নিজেও যেন তিলোত্তমাকে কত আপন বলে ভাবত। কিন্তু যেই সে বিয়ের কথা বলল তখন থেকেই মনটায় যেন কেমন ঘেন্না ঘেন্না করছে। অনীলকে বলে দেবে আর যেন সে না আসে। কথাটা সরাসরি হয়ত তিলোত্তমাকেই বলা যেত। কিন্তু ওর সাহস দেখে নিজের ওপরেই ঘেন্না হচ্ছিল তার।    

টাকার জন্যে? টাকার জন্যেই তো মেয়েটির এই দুঃসাহসিক প্রস্তাব? সে জানে সুকেশের মত ভদ্রলোকের পক্ষে এ প্রস্তাব কিছুতেই মানা সম্ভব নয়। তাই টাকার জন্যে হয়ত ব্ল্যাকমেল করবে ভাবছে। অনীলকে জিজ্ঞেস করতে হবে কত টাকা চায় সে। অনেক ফিক্সড ডিপোজিট আছে তার। বেঁচে থাকলে আরও অনেক করতে পারবে। কিন্তু এমন প্রস্তাব মেনে নেওয়া? মরে গেলেও পারবে না।  

 অতিকষ্টে বুবাইকে ছাড়ানো গেল তিলোত্তমার কাছ থেকে। সুকেশ শাশুড়িকে বলে পাঠালো আর যেন ছেলেকে ওখানে না পাঠানো হয়। এখন সে অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত থাকবে রোজ।

অনেকদিন পরে অনীলের সঙ্গে দেখা সুকেশের। অনীল হেসে বলল, কেমন কাটছে দিনগুলো? মানে তিলোত্তমার সঙ্গে কাটানো দিনগুলো?  

---ভাল। বেশ ভাল। উত্তরটা দেওয়ার পরে সুকেশের মনে হল তিলোত্তমার ব্যাপারে একটু খোঁজ নিলে নেহাত খারাপ হয় না। সেই ঘটনার পর তিলোত্তমাকে সে আসতে বারণ করে নি। তিলোত্তমাও আসা বন্ধ করে নি। তার তো টাকা নিয়েই কাজ। ভেবেছিল সুকেশ। বলল, ভালই। তবে সি হ্যাজ হাই একপেক্টেশন। দেখতে তো বেশ ভদ্রঘরের বলেই মনে হল। শিক্ষার ছাপও দেখছি। তবে ভদ্রঘর থেকে কি এখন আসছে এরা? কিন্তু পেশাদারী মনোবৃত্তি। একটা ছিঁচকেপনা। শেষ কথাটা নাকমুখ কুঁচকে খানিকটা নিজের মনেই বলল। তবু বোধহয় শুনতে পেল অনীল। সে ঘটনার পর তাকে ফোন করেছিল সুকেশ। বেশ বিরক্ত আর উদ্বিগ্ন ভাবে জানিয়েছিল ঘটনার খানিকটা। পুরোটা নয়, শুধু ওই বিয়ে করতে চাওয়ার কথাটা।  

-- যেমন আর সব মেয়ে হয় আর কী। আর নেট দুনিয়ায় তো এখন এরা লাখে লাখে। ফোন নম্বরও এরাই দিয়ে দেয়। ভাই হয়ত দেশের বেকার সমস্যা অনেক মেয়েকেই এখন এ পথে আনছে। অনীল বলল। বলল একটু হালকা চালে।    

নেট সুকেশ করে না অফিসের কাজ ছাড়া। সে শুধু জানতে চায় তিলোত্তমার বিষয়ে। কেন জানতে চায় তা বোধহয় সে নিজেও জানে না। হয়ত জানে তার অবচেতন মনের কোনও এক অংশ।   

অনীল বলল, কী করে ও এ লাইনে এল এত ডিটেলস জানি না ভাই। তবে আসার পরের কিছু ঘটনা জানা আছে। একটা পুরুষের কৃপায় মা হয়েছিল তিলোত্তমা। কিন্তু সেই বাবু চায় নি তার সন্তান এদের ঘরে থাকুক। অনেক টাকা দিয়ে বলেছিল অ্যাবরসন করিয়ে নিতে। তিলোত্তমা রাজি হয় নি। বলেছিল আজকাল কুমারীরাও মা হতে পারে। বাচ্চারাও মায়ের পরিচয়ে বড় হতে পারে। দেশের কোনও বাধা নেই।

ডেলিভারিও হয়েছিল এক নার্সিং হোমে। কিন্তু সে বাচ্চার মুখ দেখতে পায় নি তিলোত্তমা। আঁতুড় ঘর থেকেই বাচ্চাটাকে বেচে দিয়েছিল সেই লোকটি। অনেক টাকায় নাকি বেচেছিল।

আলো থেকে অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল তিলোত্তমা। এখন হারিয়ে গেল তার বাচ্চাটাও। এই বিক্রি হয়ে যাওয়া বাচ্চাগুলোর যে কী হয় কে জানে। ভাল ঘরে পড়লে মানুষ হয় তাদের ছেলে মেয়ের মত। আর খারাপ হাতে পড়লে ছেলেগুলোকে হাত-পা খোঁড়া করে দিয়ে ভিক্ষে করায় অথবা চুরি করায়। চোর, ডাকাত, খুনী কী যে বানায় সে ওরাই ভাল জানে। আর মেয়ে হলে তো হয় আর একটা তিলোত্তমা। তার ছেলে অথবা মেয়ে কী যে হয়েছে কে জানে।

---কিন্তু বুবাইকে দেখার পর হয়ত ধারণা হয়েছে তার ছেলেই এসেছে এই ঘরে। তাই হয়ত একটু ইমোশন্যাল হয়ে গিয়ে থাকবে ভাই। আমার যতদূর মনে হচ্ছে। অনীল বলছিল, দেহের ব্যবসায় এরা যতই তিলোত্তমা হোক মনে মনে তো এরা এক একটা মানুষই। আমি না হয় একটু কড়কে--      

কিছু না বলে হঠাৎ চলে গিয়েছিল সুকেশ। কিছু বলতে তার ভালও লাগছিল না।

---আমাকে বিয়ে করতে পার না সুকেশ? পরে আরও একদিন তিলোত্তমা বলেছিল, তাহলে তোমার ছেলে একটা মা পায়? আর আমি একটা---

কিছুদিন ধরে অনিয়মিত হয়ে এসেছিল তার যাওয়া আসা। সুকেশের ঘরে নাকি মনের চোখে বুবাইকে দেখে সে। না এসে ফোন করে বলেছিল। বাচ্চার মা পাওয়ার কথা বলছে তিলোত্তমা। তার মানে এও এক রকমের ইমোশন্যাল ব্ল্যাকমেলিং। এরপর একদিন হয়ত ফোন করে টাকার কথাটা বলবে। বুবাইকে গিয়ে বলবে। বুবাই হয়ত বোঝে না। কিন্তু পাড়ার লোককে শুনিয়ে শুনিয়ে তাদের সম্পর্কের কথা বুবাইকে বললে কি হবে?    

একটা বারবনিতার সাহস দেখ? অবাক তো দূরের কথা একেবারে হতবাক হয়ে গেল সুকেশ। কিন্তু আবার ভাবল বুবাই যে তাকেই চায়। তাকে মানে তিলোত্তমাকে। সেই একদিনেই বেশ বুঝেছে সুকেশ। রুবি তাকে একদিন ফোন করে বলেছিল। পড়াশোনায় মন বসে না বুবাইয়ের। বেশ কয়েকবার ‘মায়ের কাছে যাব, মায়ের কাছে যাব’ করেছে। আর কিছু বলে নি। কিন্তু ফোনে তার গলা শুনে সুকেশ বেশ বুঝেছিল কতটা সন্দেহ এখন তার জামাইবাবুকে ঘিরে।

-ডাইনিটা তোমার ছেলেকে বশ করেছে জামাইবাবু। বেশ ব্যঙ্গ করে জানিয়েছিল রুবি।

কিন্তু বুবাই কেন চায় তিলোত্তমাকে?

সেকথা ভাল করেই জানে সুকেশ। একদিন সুদেষ্ণাকে তো সে নিজেই বলেছিল, কী মিষ্টি দেখায় তোমাকে ওই তিলটার জন্যে। ভারি মিষ্টি।

চিবুকের নিচে একটা ছোট্ট কালো তিল। ধবধবে ফর্সা সুদেষ্ণাকে যেটা উপহার দিয়েছিল এক অপরূপ স্বর্গীয় সৌন্দর্য। আর সুকেশকে উপহার দিয়েছিল এক অসাধারণ তৃপ্তি।  

--তবে আমাকে নয় আমার এই তিলটাই সারা জীবন মনে রাখবে বুঝি? হেসে বলেছিল সুদেষ্ণা।

তবে তার মতই তার ছেলেও হয়ত মনে রেখেছে ওই তিলটাকেই? ঐ তিলটার মধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছে সুদেষ্ণাকে? বুবাইয়ের মত একটা শিশু কী এত সৌন্দর্য সচেতন হতে পারে? মোটেই না। সুকেশের মনে হল। এই তিলটা তার মায়ের একটা প্রতীকের মতই গেঁথে গেছে ছোট্ট বুবাইয়ের মনে।   

তাই বুবাইয়ের কাছ থেকে তিলোত্তমাকে সরান দরকার। অবিলম্বে।  

তিলোত্তমাও আর আসে নি কোনওদিন। অনীলও দিতে পারে নি তার কোনও খবর। আজ সুদেষ্ণার কথা নয়, তিলোত্তমার কথা বড় মনে পড়ে সুকেশের। মনে পড়ে তার সেই আকুতি, আমাকে বিয়ে করতে পার না সুকেশ? তাহলে তোমার ছেলে একটা মা পায়? আর আমি একটা—  

আজ সেই তিলটার কথা খুব মনে পড়ে সুকেশের। যতই সে তার ছেলে বুবাইকে ভোলাবার চেষ্টা করুক নিজে ভুলতে পারছে কই? মেয়েটা সত্যি বাড়তি কিছু কি চেয়েছিল তার কাছে? যেটা দেওয়া তার পক্ষে খুব অসম্ভব ছিল?

আবেগ আর বাস্তবের টানাপোড়েনে এখনও ভুগে চলেছে সুকেশ।  

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment