1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

আকাঙ্খিত কবিতাপাঠ

ছবি : ইন্টারনেট

আকাঙ্খিত কবিতাপাঠ

সৌরিন ভট্টাচার্য্য


(১)


জানুয়ারী মাসের এক দুপুর, কিন্তু শীতের বিন্দুমাত্র রেশ নেই, আবহাওয়া দফতরের পারদ তিনশো কেলভিন ছুঁই ছুঁই | এই সময়েও অনেকে রাস্তায় পশমী সোয়েটার পরে গলদঘর্ম হচ্ছে, কেউ কেউ স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে তা খুলে নিয়ে কোমরে বেঁধেছে | আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়িতে ফিরলো রিচা, মধুপুর আদর্শ শিশু বিদ্যালয়ের সহ-শিক্ষিকা রিচা বিশ্বাস পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মিষ্টভাষী হিসেবে খুবই সুপরিচিত, যারা তাকে তার ছোটবেলার আদুরে ডাকনাম 'বাবলি' বলেই ডাকে | বাড়ি ফিরেই সে সকল গরম জামা কাচতে দিয়ে দিয়েছে, তাছাড়া সে বাড়ির সকলের জন্য এনেছে দই ও মিষ্টি | দই, লস্যি ও অন্যান্য দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য তার বরাবরই খুব প্রিয় | দুপুরের খাওয়া শেষ করে মিষ্টি দইয়ের ভাঁড়টা চেঁছেপুছে শেষ করলো রিচা | রান্নাঘরে রাখা কালো প্লাষ্টিক জড়ানো আনাজের খোসাভর্তি বালতিতে ভাঁড়টা নিখুঁত ভাবে ছুঁড়ে দিলো, ভেতরে দু' জায়গায় টক্কর খেয়ে সেটা সেঁধিয়ে গেলো কৃষ্ণ গহ্বরে | হাতে করে একটা কবিতার বই নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো সে | ঘরটা এলোমেলো ভাবে গোছানো, এপাশে পরিপাটি করে কিছু জামা কাপড় রাখা আছে, ওপাশে ক্যাবিনেটে বইপত্র, কলম, মানচিত্র, অ্যাটলাস ও অন্যান্য সামগ্রী মোটামুটিভাবে গুছিয়ে রাখা রয়েছে, একপাশে আবার একটা ভারী কাঠের চেয়ারে কিছু পূর্ণ আস্তিন জামা, জিন্স, স্কার্ফ ইত্যাদি  স্তূপীকৃতভাবে কুন্ডলি পাকানো অবস্থায় পড়ে আছে | নিজের ইচ্ছেমতো সে ঘর গোছায়, আবার মন ভালো না থাকলে অগোছালো অবস্থায় অনেক কিছু তার বিছানাতেই পড়ে থাকে | এই করে করে তার অনেক প্রসাধন সামগ্রী, কলম, কবিতার পাতা, ঝুমকা, কানের দুল ইত্যাদি হারিয়ে গেছে অনেকবার, তার মা অথবা সকালের পরিচারিকা মাসি এসে সেসব ঝাঁট দিয়ে প্রায়শই বের করেছে ধুলোমাখা সঙ্গিন অবস্থায় | মোটামুটি জীবনের একটা খামখেয়ালি বাঁকে কখনো কখনো বিমুখ হয়ে যায় রিচা, কখনো তার রান্নাবান্না করতে খুব ভালো লাগে, কখনো কেবল গল্পের বই ও পত্রিকা পাঠ করতে, কখনওবা সোশ্যাল মিডিয়াতে অবিশ্রান্তভাবে সেলফি পোস্ট করতে | নিজে একটা কবিতার পেজ চালায় এবং প্রত্যেকটা পোস্টে নিজের একটা করে চিত্তাকর্ষক ছবি জুড়ে দেয়, বর্তমানে পেজটির অনুগামী সংখ্যা সহস্রাধিক |  গ্র্যাজুয়েশনের পর তার খেয়াল হয়েছিল যে সে খ্যাতনামা পর্বতারোহী হবে | সেই শখ পূরণ করবার জন্য এক বছর ধরে বিভিন্ন পর্বতারোহণের সংস্থার কঠোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিল ও বছরভর ট্রেকিং করে বেরিয়েছিল বিস্তৃত উপমহাদেশিক ভূখণ্ডে : সিমলা থেকে সিকিম, রূপকুন্ড থেকে ভুটান ও অন্যান্য স্থানের বিবিধ শৈলশ্রেণীতে | একটা ক্ষুদ্র দুর্ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার পর পারিবারিক ভ্রুকুটিতে সে এই বাসনা ত্যাগ করতে বাধ্য হয় |  তবে তার বেশ কয়েক বছর ধরে লেখালিখির জগৎটাকে ভালো লাগছে, সর্বদা মনের মধ্যে কবিতা ও অনুগল্প বিষয়ক চিন্তার পরিস্ফুরণ ঘটছে; দুই বছর আগে সে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুশিক্ষার চাকুরী পেয়েছে, সে থেকে তার অস্থির চিত্ত একটু ধাতস্থ হয়েছে | এখন বছরভর সে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে প্রেম, যৌবন, শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়ন প্রভৃতি বিষয়ে অনুগল্প-গল্প ও কবিতা পাঠায়, ইদানিং সে আত্মপ্ৰচেষ্টাতে কিছু বড় কাগজেও লেখা বের করেছে কোনোপ্রকার তদবির ছাড়াই, নিজের সংগ্রামের সোনালী ফসল ঘরে তুলতে পেরে সে তৃপ্ত এবং সম্প্রতি গল্প-কবিতা লেখবার অনুপ্রেরণা খুঁজে বেড়ায় জীবনপ্রবাহে বয়ে চলা নানান তুচ্ছ ও নগণ্য অলক্ষিত ঘটনার মাঝে | কতগুলো বই ও পত্রিকা নিজের কোলে সাজিয়ে নিয়ে সে এসে বসলো আরামকেদারায়, আজকের দিনটা ভালো করে 'ইউটিলাইজ' করা যাবে | এমন সময় সদর দরজার ঘন্টিটা অজান্তেই যেন বেজে উঠলো তার মনোসংযোগের দফারফা করে দিয়ে |

 (২)


দরজার ঘন্টি বেজে ওঠাতে সে প্রথমে কিছুটা বিরক্তই হয়েছিল, ঘড়িতে তখন সময় দুপুর আড়াইটে; এই সময়ে ডাকবিভাগের পিয়ন চিঠি-পত্র দিতে এলে সাধারণ তার মা দরজা খুলে অভ্যর্থনাপূর্বক যাবতীয় পৃষ্ঠা-পুলিন্দা গ্রহণ করেন | আজ তার মা একটু বেলা করেই গেছেন স্নান করতে, বাবা এই সময়ে অফিসে থাকেন, রবিবার ব্যতীত | স্টেশন চত্বর থেকে সংগ্রহ করে আনা কতগুলো পত্রিকা অলস ভাবে উল্টে পাল্টে দেখছিলো রিচা, দু'-একটা ছায়াচ্ছন্ন ভাষার দুর্বোধ্যতা প্রকাশিত হয়েছে যাকে কবিতারূপে গণ্য করার সোচ্চার দাবি রেখেছেন রচয়িতাগণ, তা সে পাঠ করে বিশ্লেষণ করবার ব্যর্থ প্রয়াস করছিলো | যাইহোক, তড়িঘড়ি করে পত্রিকায় বুকমার্ক গুঁজে দরজার দিকে পা বাড়ালো সে | দরজা খুলে দেখে যে ঘর্মাক্ত অবস্থায় উপস্থিত শ্রী অমূল্যকেশর সিংহ, বাংলা উত্তরাধুনিক সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম এক ব্যক্তিত্ব ও তার বাবার বিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী, তার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে | তাঁর রাশভারী চেহারাটাকে বরাবরই সম্ভ্রম করে চলে রিচা, খুবই বিনয়ের সাথে দরজার তালা খুলে তাঁকে ঘরে বসালো, চটপট এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত এনে দিলো সে, সেটি গলাধঃকরণ পূর্বক সিংহ মহাশয় তাঁর কেতাদুরস্ত কেশরাশি (যদিও কেশর বলাই উপযুক্ত) বিন্যস্ত করে আত্মস্থ হয়ে বসলেন | গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন উচ্চনিনাদে বাক্যালাপ | সারাঘর তাঁর কণ্ঠস্বরে গমগম করে উঠলো |

— (গম্ভীর গলায়) অনেকদিন পর তোমাদের বাড়ি আসলাম, বাবা কোথায়? সবাই ভালো আছেন তো ?

— হ্যাঁ কাকু অনেকদিন আসেননি, বাবার তো এখন অফিস, মা একটু স্নানে গেছেন, ভাইয়ের কলেজ আছে এখন, আমরা ভালোই আছি, আপনি?

— হ্যাঁ আমার সময়টা অপেক্ষাকৃতভাবে ভালোই যাচ্ছে, এইতো সেদিন একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে এলাম ত্রিপুরা থেকে; (কিছুটা বিরতি নিয়ে) যাইহোক, রিচা তুমি এখন কি করো ?

— আজ্ঞে কাকু, বেশি কিছুই না, একটা প্রাইমারি স্কুলে টিচার হয়েছি বছর দুই হলো |

— বেশ বেশ | তা আজকাল কয়েকটা বড় কাগজে লেখালেখি করছো দেখলাম, বেশ ভালোই লিখছো তো ! তোমার লেখাগুলো একেবারে মন্দ না | কবে থেকে এসবে এসেছো ?

— আপনি আমার লেখা পড়েছেন? ওহ মাই গড ! আই এম সো গ্ল্যাড ! (এক বুক শ্বাস নিয়ে)  হ্যাঁ কাকু, এই তিন চার বছর আগে কলম তুলি, কয়েকটা লিটিল ম্যাগাজিনে লেখালেখি করতাম, এরপর ফেসবুকে এক মহিলা কবির সাথে আলাপ হয়, তার পত্রিকার এডিটিংর কাজে যুক্ত হয়ে যাই, সাথে বড় বড় পাবলিকেশন হাউসগুলিতে লেখা পাঠাতে থাকি; এই করে করেই কয়েকটা বড় কাগজে দৈবাৎ পাবলিশড হই, যেদিন বাড়িতে ফার্স্ট রেজিস্টার্ড পোস্ট এসেছিলো এক্সেপটেন্স লেটার নিয়ে, সেদিন প্রায় কেঁদে দিয়েছিলুম | 

— এক্সসেলেন্ট! তোমার ক্যালিবার আছে, তোমার হবেই | লেগে থাকো | তোমার বাবারও লেখালেখির হাত ছিল বেশ ভালোই, উত্তরাধিকার সূত্রে তুমি একটা ভালো গুণ পেয়েছো | যাইহোক আমার একটা সুসংবাদ দেওয়ার আছে এখন, (দন্তবিকশিত করে) আন্দাজ করো দেখি |

— আই আবসোলুটলি হ্যাভ নো আইডিয়া এবাউট ইট কাকু, প্লিজ বলুন !

— আচ্ছা সেটা বলবার আগে জিজ্ঞাসা করে ফেলি যে তুমি বইমেলা যাও কি না ?

— অফ কোর্স যাই ! এইতো এই বছরও যাবো, পাঁচ বছর ধরে যাচ্ছি, লাস্ট দু' বছর গেলাম ওই ফেসবুক ফ্রেন্ডের সাথে, তার পত্রিকাটি লিল ম্যাগ প্যাভে সেল করলাম, কপি এখনো আছে কয়েকটা, আপনি দেখবেন ?  

— না না এখন থাক, পরে দেখিও | কথাটা মন দিয়ে শোনো আগে | কথাটা হলো যে, প্রতি বছর পরিষদের একটা বড় করে যে অনুষ্ঠানটা হয়, সেটায় এবারে তুমি আমন্ত্রিত, আমি এক্সেকিউটিভ কমিটিতে মিটিংয়ের সময় তোমার নাম রেকমেন্ড করেছি, তুমি কবিতাপাঠ করবে ওখানে, (শান্তিনিকেতনী ঝোলা থেকে একটা সুদৃশ্য খাম বের করে) ১২ই ফেব্রুয়ারী বিকেল ৪টের সময় অনুষ্ঠান শুরু হবে | 

বিস্ময়ে আত্মহারা হয়ে গেলো রিচা | চিঠিটা হাতে নিয়ে প্রায় গোগ্রাসে গিললো সম্পূর্ণ লেখাটা, উপরের নামটা পড়লো দু'-তিনবার | অজান্তেই নিজের মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট 'থ্যাংক ইউ সো মাচ" বেরিয়ে এলো | এই সময় তার মা স্নান-পূজা সেরে প্রবেশ করলেন ঘরে, অমূল্যকেশর বাবুকে এই অসময়ে দেখে কিছুটা অবাক হলেও তৎক্ষণাৎ নিজের মুখমণ্ডলে সেটা প্রকাশ করতে দিলেন না | জিজ্ঞেস করলেন যে তিনি মধ্যাহ্নভোজ করে এসেছেন কিনা ও রিচা তাকে কিছু খাবার-দাবার দিয়েছে কি না | রিচাকে ওপরের ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি  বাক্যালাপে মগ্ন হলেন | অমূল্যকেশর বাবুও নিজের লেখা-লেখি, সম্মাননা ও প্রকাশনার ব্যাপারে নানা তথ্য জ্ঞাপনে নিমগ্ন হয়ে উঠলেন |   

(৩)


ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে করে ছিটকিনিটা সজোরে তুলে ফেললো রিচা | চোখে মুখে তার একটা বিস্ফারিত আনন্দের চাঞ্চল্য, খুশির বাঁধ ভেঙে সে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিলো তাৎক্ষণিক নৃত্যে | দুইটি ধ্রুপদী ঘরানার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুনিপুণ নর্তকী সে, তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঞ্চালনে একটা সুস্পষ্ট মোহময় আবেশ আছে, এই কথা সর্বপ্রথম বলেছিলো তার ছয় বছর বয়েসের 'ডান্স স্কুল'-র শিক্ষিকা দময়ন্তী দত্ত | সেই বিদ্যালয়ের গন্ডী পেরিয়ে সে আজ এসেছে অনেক অনেক দূরে; কেরল, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড ও গুজরাটের নানা বৃহৎ নৃত্যসভায় সে নানান সম্মাননা লাভ করেছে, এছাড়া সে এখন শহরের ললিতকলা নৃত্য নাট্য একাডেমির একজন শিক্ষিকা ও উপদেষ্টা, যদিও তার কাজ সম্পূর্ণরূপে বেতনহীন | কোনো এক রেফারীড জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে আঠারো থেকে পঁচিশ বছর বয়সের কোঠায় তরুণীদের মধ্যে উত্তেজনাবশে শাস্ত্রীয় নৃত্যের বদলে অত্যাধুনিক হিন্দি ছায়াছবির নৃত্যই অধিক প্রকাশিত হয় | বছর পঁচিশের তন্বী উষসী রিচার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না | কয়েকবার শূণ্যের দিকে গৌরবান্বিত মুষ্ঠি প্রক্ষেপণ ও কিছু 'ডান্স মুভ' নিখুঁতভাবে অনুকরণ করবার পর সে কিছুটা শান্ত হলো, সারা মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এক মুঠো প্রসন্নতার রাঙা আবির | শহর তথা ভারতের সর্ববৃহৎ বইমেলায় আয়োজিত নিখিল বঙ্গ কাব্যসাহিত্য পরিষদের অনুষ্ঠানে সে ডাক পেয়েছে কবিতা পাঠের | সেখানে প্রবেশের এক্তিয়ার সাধারণত বাংলা কাব্য জগতের নক্ষত্র ও বিভিন্ন মহা-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের | প্রত্যেক বছর খুব আড়ম্বরের সাথেই এই অনুষ্ঠানটি সংঘটিত হয়, অনেক সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যম এই কাব্যযজ্ঞে ঘৃতাহুতি প্রদান করতে উপস্থিত থাকে, বিভিন্ন ক্রোড়পত্রে বিভাগীয় লেখক-লেখিকা ও আমন্ত্রিত অতিথি কলমশিল্পীরা বৃহদায়তন প্রশস্তি রচনা করে থাকেন, যা পাঠ করে পরিবহনমাধ্যমে চলমান সৌখিন সাহিত্যপ্রেমীরা বাহবা দিতে দিতে পুলকিত হয়ে যান আর মস্তিষ্কের কল্পজগতে নিজেদেরকে সেই স্থলে প্রতিস্থাপন করেন, নেহাতই দ্বিপ্রহরীয় অলীক ভাবনায় |

সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টে সে (হরেক রকমের হ্যাশট্যাগ সহ) স্টেটাস দিলো ও চিঠিটির আলোকচিত্র নানা 'ফিল্টার' দিয়ে সম্পাদিত করে পোস্ট করলো | প্রশংসা ও বাহবা পেলো প্রচুর মানুষ জনের কাছে, তবে কিছু কিছু ব্যক্তির করা ঈর্ষান্বিত বক্রোক্তিও তার নজর এড়ালো না | তবে রিচা আর ওসবে দৃষ্টিপাত করে না, সে ভালোভাবেই জানে যে গোলাপ চাষ করতে হলে টিংক্চার আয়োডিন সাথে রেখে দিতে হয় | তার ফেসবুকতুতো বান্ধবী তথা পত্রিকাটির সহ-সম্পাদিকা তাকে কল করে আন্তরিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করলো ও এবার 'সেলিব্রিটি' রিচার অনুগ্রহ করে প্যাভিলিয়নের ক্ষুদ্র টেবিলে বসবার অবকাশ হবে কিনা সেই বিষয়ে ঠাট্টা করে জানতে চাইলো | আবেগতাড়িত কণ্ঠে হালকা হেসে আশ্বাস দিলো রিচা, "কেন্দ্রীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়েও আমি 'আলোর দিশা' পত্রিকার অভিমুখ থেকে, অর্থাৎ আলো থেকে আলেয়ার দিকে ছুটে যাবোনা, তোকে প্রমিস করছি |" কথাবার্তা শেষ করে ফোনটা রাখতেই সে দেখলো একটি মেসেজিং অ্যাপের্ নোটিফিকেশন, অমূল্যকেশর বাবুর করা | সম্ভবত তার মার কাছ থেকে তিনি নম্বরটি পেয়েছেন | সংক্ষেপে লিখেছেন যে, উনি বেরিয়ে গেলেন একটু আগে, ওনার একটা প্রকাশিতব্য বইয়ের কভার ছাপানোর কাজ আছে মার্কেটপাড়ায় সেই জন্য; এবং রিচাকে ছোট্ট একটা বক্তৃতা রাখতে হবে তাঁর ওপরে, প্রসঙ্গ " নতুন শতাব্দীর তরুণ তরুণীর দৃষ্টিভঙ্গিতে অমূল্যকেশর সিংহের কবিতা : গ্রহণযোগ্যতা ও গুণগত মূল্যায়ন" | অমূল্যকেশর সিংহের কবিতা রিচার বরাবরই দুর্বোধ্য ও সাংকেতিক অর্থসম্ভার বলে মনে হতো, এবার তার ওপর এরূপ লেখার গুরুভার এসে পড়াতে একটু হতমিত হয়ে পড়লো সে | বইমেলা শুরু হতে আর কুড়ি দিন বাকি, বাইশদিনের মাথায় এরকম সময়ে তাকে মঞ্চপ্রস্তুতি নিতে হবে প্রবন্ধ পাঠের জন্য | বাতাসে একটা সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো দেওয়ালে দেওয়ালে | কোনো কারণে নিচের তলায় তার মা ডাকছেন | মোবাইল ডেটা বন্ধ করে ঘরের বাইরে অগ্রসর হলো সে |

(৪)


ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ | বইমেলার বিক্রিবাট্টা পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয়েছে | রিচার বাড়ি থেকে ঘন্টা দুয়েকের যাত্রা, প্রথমে বাসে করে কিছুটা পথ, তারপর মেট্রো করে বইমেলার মাঠের সামনের স্টেশনে নামতে হয় | যথারীতি সিংহদুয়ার খোলবার আগেই হাজির হয়েছিল সে, হালকা ফিনফিনে একটা লাল শাড়ি ও নূন্যতম মেকআপেই সে সচরাচর আরাম পায় | সারাদিনে পঁয়ত্রিশ কপি পত্রিকা সে বিক্রি করেছে বান্ধবীর সাথে, তাদের টেবিলটাকে সকলে 'দুই দির টেবিল' নামেই অভিহিত করে | পত্রিকাটির প্রচ্ছদ করানো হয়েছে এক দুঃস্থ অথচ গুণী কিশোরকে দিয়ে, বাঁধাই, ছাপা ও পৃষ্ঠার গুণমান যেকোনো পেশাদারি প্রকাশনার সমতুল্য, তবে মূল্য মাত্র ত্রিশ টাকা | ওরা কেউই 'পুশ সেল' কৌশলে বিশ্বাসী নয়, আগত পাঠক-পাঠিকাদের কেবল কমনীয় স্বরে অনুরোধ করে পত্রিকাটি একবার হাতে নিয়ে দেখবার জন্য, তবে এবারের পাঠকদের সাড়া তাদের প্রত্যাশার থেকে অনেকটাই বেশি | অপরত্র, প্যাভিলিয়নের নানা টেবিলে অমূল্যকেশর সিংহের গ্রন্থ সংকলন, মৌলিক কাব্যগ্রন্থ, সম্পাদিত পত্রিকা ইত্যাদি তার 'কাব্যশিষ্য'রা যে পন্থায় বিক্রয় করছেন, তা প্রায় নিগ্রহপদবাচ্য | এছাড়া বিভিন্ন পূর্ণাঙ্গ স্টলেও তাঁর বইগুলি অনায়াসে বিক্রীত হচ্ছে, বোধহয় তা তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের কাব্যসাধনা চেয়ে বিগত  ঊনিশ বছর ধরে কাব্যসাহিত্য পরিষদের প্রবীণ সদস্য হওয়ার ফলাফল | নিন্দুকরা অবশ্য তাঁকে নিয়ে উপহাস করে নানা কদুক্তিমূলক লেখা ছোট পত্রিকাগুলিতে বের করে, তাঁর সৃষ্টিসম্ভারকে উপহাস করে ও তাঁকে 'প্রাতিষ্ঠানিক মোসাহেব' অভিধায় ভূষিত করে আড়ালে আবডালে | 

পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া রুগ্ন, অপুষ্টিতে ভোগা চা-ওয়ালা ছেলেটার কাছ থেকে দু' কাপ চা কিনে নিলো রিচা | চুমুক দিলো সুবাসময় গরম তরলে | এমনসময় ফোনটা ঝনঝন বেজে উঠলো, হ্যাঁ, কবি সিংহ মহাশয়েরই ফোন | চায়ের কাপ নিয়ে অব্যাহতি চেয়ে সে বেরিয়ে রাস্তায় উপস্থিত হলো | বিগত তিন সপ্তাহ ধরে সে নানান ছোট-খাটো কাজ কর্ম হাসিমুখেই করে দিয়েছে কবির হয়ে, বিভিন্ন কর্মকর্তাদের ফোন করে আমন্ত্রণ, কয়েকটি পত্রিকার অফিসে গিয়ে তদারকি করে আসা, উপহার সংগ্রহ করা, বিভিন্ন পাঠক-পাঠিকাদের নিকট তাঁর নবপ্রকাশিত কবিতার বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া ইত্যাদি | তার তৈরী করা ভাষণের খসড়ায় নির্মমভাবে নানা পরিবর্তন করেছেন তিনি, অনাবশ্যক নানা মেদবহুল বিশেষণপদ যোগ করেছেন ও সর্বোপরি পুরো খসড়াটাকে চাটুকারিতায় পর্যবসিত করেছেন | ফোনটা কানে দিতে না দিতেই লাইনটা কেটে গেলো, তড়িঘড়ি করে রিং-ব্যাক করলো সে |

— হ্যালো রিচা, তুমি কি বইমেলায় আছো এখন ?

— হ্যাঁ কাকু, লিল ম্যাগ প্যাভে আছি, আপনি কি আসছেন ?

— না আজকে আসছি না | শোনো কিছু শেষ মুহূর্তের কাজ আছে, তোমাকে বলতে খারাপ লাগছে কিন্তু অন্য কাউকে পেলাম না, সেই জন্যই ...

— নানানা, আই ডোন্ট মাইন্ড এট অল, বলুন কি করতে হবে |

— আচ্ছা তাহলে শোনো, আজকে ২৭২ নং স্টলে, সর্বভারতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের সভাপতি এসেছেন, তোমায় মেসেজ করছি একটা আমন্ত্রণপত্র, সেটা একটু প্রিন্ট নিয়ে দিয়ে যেতে পারবে কি? সাথে আমার নতুন বইটা | আর কালকের জন্য কয়েকটা অতিরিক্ত পুষ্পস্তবক দরকার, সেটা আমি দোকানটায় বলে এসেছি, ওদের ঠিকানাটা তোমায় পাঠাচ্ছি, কাল আসবার সময়ে তুমি যদি একটু সংগ্রহ করে আনতে পারো তো...

— নট ইভেন এ প্রব্লেম, আমি এখনই করছি কাকু | 

— তোমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দি, তুমি না থাকলে খুবই অসুবিধা হতো | আচ্ছা ছাড়ছি এখন, কালকের অনুষ্ঠানের সময়তালিকাটা ফাইনালাইজ করতে এখন পরিষদে এসেছি তাই...

— অবশ্যই কাকু, আপনার হাতে এখন সময় কম, আপনি চিন্তা করবেন না, কাজগুলো করে রাত্রে বাড়ি ফিরে আপনাকে জানাচ্ছি |

— আচ্ছা, ভালো থেকো, ছাড়লাম |

ফোনটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রিচা | কালকের কবিতাপাঠের জন্য আজ সারাদিন সে অনুশীলন করতে পারেনি, এখনো এইসব বিরক্তিকর কাজের ভার তার স্কন্ধেই আরোপ করে দিয়েছেন উনি | ফোনটা জোরে টিপে সুইচ অফ করে দিলো সে, পরক্ষণেই ইলেকট্রনিক বার্তা আসবার কথা ভেবে অন করলো | এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে, নিজেকে সম্মোহনের আগল থেকে মুক্ত করে এগিয়ে গেলো নিজেদের টেবিলের দিকে, বান্ধবীর কাছ থেকে বিদায় চাইতে |

(৫)


পরেরদিন সকালবেলা | রিচার মা খুবই উৎসাহিত যে তার মেয়ে আজ বহুসংখ্যক জ্ঞানী-গুণী ও সুপরিচিত কবিদের মাঝে নিজের কাব্যসম্ভারের সাক্ষর রাখতে যাবে অথচ সকাল থেকেই একটু মুখ গোমড়া করে রিচা বারান্দায় পায়চারি করছে, কফির কাপ হাতে নিয়ে প্রায় আধ ঘন্টা লাগিয়েছে দুটো চুমুক দিতে | গতকাল রাত্রে সে ফিরেছিল প্রায় ১১ টার দিকে, মা-বাবা দুজনেই খুব বিরক্ত হয়েছিলেন অমূল্যকেশর বাবুর শেষ মুহূর্তে দায়িত্বের গুরুভার রিচার উপর ফেলে দেওয়ার জন্য | রিচা অল্প একটু ভাত আর মাছের ঝোল খেয়ে শুয়ে পড়েছিল বেশ তাড়াতাড়িই | আজ সকালে উঠে সে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছে কেবল একবার, অন্যমনস্ক লাগছে তাকে, উস্কো খুস্কো চুলে সে কেমন নির্জীব, আনমনা | তার ঘোর ভাঙলো সাড়ে নটার দিকে, বারান্দায় নেমে আসা দুটি শালিকের খেলা দেখতে দেখতে | তার লেখা ‘একটি আত্মসংশ্লেষিক কথোপকথন’ কবিতাটি তার কাছে বরাবরই খুব প্রিয়, কোনো পত্রিকায় এটি এখনো ছাপাতে দেয়নি সে, আটচল্লিশ পংক্তির মধ্যে যে আবেগ, আকুতি, নির্ভীক মানসিকতা ও প্রেম লুকিয়ে আছে তা তার জীবনেরই যেন এক সচেতন দর্পণ | আজকে এটি পাঠ করবে সকলের সম্মুখে, অনেক মানুষজন তার কবিতা শুনবে, বাহবা দেবে, করতালিতে তাকে ভূষিতা করবে, ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠলো | এক ঘন্টার মতো নিজের কয়েকটা কবিতা পাঠ করে সড়গড় হয়ে নিলো, বেশ একটা দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় এলো যে সে আজকে আসরে নিজের ছাপ ফেলে আসবেই | বহুবার সংস্করণের পর অবশেষে সিংহ মহাশয়ের ভাষণের চূড়ান্ত খসড়ার নোটিফিকেশন তার ফোনে প্রবেশ করলো প্রায় সোয়া এগারোটার দিকে | তাড়াতাড়ি ফাইলটা ডাউনলোড করে সে প্রাথমিকভাবে চোখ বুলিয়ে নিলো, মেদবহুল, স্থূল, বিশেষণভারে জর্জরিত একটা অতিরঞ্জিত রচনা, রচয়িতা বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি নিজের মাদলে নিজেই তান তুলতে | মনের মধ্যে একটা তিক্তভাব তৎক্ষণাৎ চলে এলেও তা সে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দিলো না |

একটা ফিকে গোলাপি কটন শাড়ি পরে নিলো রিচা, কানে চাকচিক্যপূর্ণ দুল, লিপস্টিক, মাস্কারা ও আইল্যাশ পরে সে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লো বেলা পৌনে দুটোর দিকেই | প্রথম গন্তব্যস্থল ফুলের দোকান | ছিমছাম একটা হাতব্যাগ নিয়ে নিয়েছে, তাতে রয়েছে নিজের কয়েকটি কবিতা, ভাষণের খসড়া, কিছু প্রসাধন সামগ্রী, ব্যাঙ্কের কার্ড ও অন্যান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র | ফুলের দোকানে এসে শুনলো যে পরিষদ থেকে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ফোন করে ৮টি পুষ্পস্তবক অর্ডার করেছেন কিন্তু কোনো অগ্রিম পেমেন্ট করেননি বা সে ব্যাপারে কোনো কোথাও বলেননি, শুদ্ধমতিতে তারা পেশাদারীভাবে অর্ডারটি গ্রহণ করে উচ্চমানের ফুলের তোড়া সাজিয়েছেন | অগত্যা রিচার পকেট থেকে প্রায় দেড় হাজার টাকা খরচ হলো 'প্রিমিয়াম কোয়ালিটি ফ্লাওয়ার বোকে'গুলি ক্রয় করতে | রিচা একবার ভাবলো যে এই বিষয়ে সিংহ মহাশয়ের সাথে ফোনে কথা বলে নেবে, পরক্ষণেই মনে হলো যে যখন দেখা হবে তখনি এটা নিয়ে বাক্যালাপ করে নেওয়াটা ভালো কাজ হবে | সমস্ত আনুষাঙ্গিক ক্রিয়াকলাপে যবনিকা পতন ঘটিয়ে যখন সে মেট্রোতে উঠলো তখন পৌনে তিনটে বেজে গেছে ঘড়িতে, সিংহ মহাশয় একবার মেসেজ করে তার অবস্থান জেনে নিয়েছেন | পশ্চিমাকাশে কিছু অনাবশ্যক মেঘের আনাগোনা শুরু হলো, পাতাল গহ্বরে মেট্রোটি প্রবেশ করবার ঠিক পূর্বে এই দৃশ্যটি আড়চোখে খেয়াল করলো সে | ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করে মনোযোগ দিয়ে সে বিড়বিড় করে পড়তে আরম্ভ করলো তার বক্তৃতার বাক্যগুলি | আজ তার বড়ই ‘খুশির দিন’, তার কবিসত্তা আজ পরিশেষে স্বীকৃতি পাবে বিশ্বমানবের মাঝে |

(৬)


"এবারে আপনাদের সম্মুখে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা পেশ করবেন তরুণী কবি ও শিক্ষিকা মিস রিচা বিশ্বাস" | পাবলিক এড্রেস সিস্টেমে ঘোষিত হলো সমগ্র প্রেক্ষাগৃহে শব্দের অনুরণন ঘটিয়ে | বইমেলা প্রাঙ্গণের গীতবিতান প্রেক্ষাগৃহে নিখিল বঙ্গ কাব্যসাহিত্য পরিষদের ব্যাপক বার্ষিক অনুষ্ঠান | বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, সর্বভারতীয় স্তরের খ্যাতনামা সাহিত্যিকগোষ্ঠী, পরিষদের সদস্যবৃন্দ, রাজ্যের মন্ত্রী-এম.এল.এ. ও তাদের পরিবার-পরিজনসহ প্রায় ৯০০ জন হাজির এই সহস্র আসনের রঙ্গশালায় | নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই কড়া, তিনবার করে পরিচয় পত্র ও আমন্ত্রণ পত্রের যাচাই করা হয়েছে রিচাসহ অনেকেরই, দুটি প্রবেশদ্বার সর্বসাধারণের জন্য একদমই 'সীলড অফ', মন্ত্রী- এম.এল.এ.দের প্রবেশের জন্য ওগুলি নির্দিষ্ট | একটি দিয়ে পরিষদ সদস্যদের প্রবেশ, বাকি তিনটি দিয়ে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের আগমন | প্রথম সারিতে বসে অমূল্যকেশর বাবু নিজের কেশরসদৃশ কুন্তলে অঙ্গুলিসঞ্চালন করছিলেন, সর্বভারতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের পরবর্তী বৈঠকে সভাপতি স্বয়ং তাঁর নাম সুপারিশ করবেন ভারতীয় প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য সম্মানের জন্য; তবে তার পূর্বে আজকে সভাপতি মহাশয়কে তিনি 'বঙ্গীয় বৃহত্তর কাব্য সন্মান'-এ ভূষিত করবেন; সুস্পষ্টভাবে রফা হয়ে গেছে তাঁর সাথে | এছাড়া, রিচার মতো উদীয়মান তারকাদের মুখনিঃসৃত শব্দসুধায় যে সকলেই বিগলিত হয়ে যাবে ও আগামী কাল বড় বড় দৈনিকগুলিতে তাঁরই নামের গুণকীর্তন হবে এই ব্যাপারে নিশ্চিত তিনি | তাঁর বাঁ পাশে বসে কমলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড: মানসরঞ্জন শুর মহাপাত্র, ডান পাশে এক সংবাদপত্রের সাংবাদিক তথা একটি সান্ধ্য কলেজের অতিথি অধ্যাপক ড: অর্চিনির্মোক নন্দী; দুজনকেই আজকে সম্মানিত করা হবে; পরিবর্তে আসবে আরো সুনাম, গাল ভরা তারিফ, প্রশংসাবাক্যসমন্বিত বই রিভিউ, সাক্ষাৎকার ও অনেকগুলি বই বিক্রি | তাঁর পশ্চাতে বসে আছে তাঁরই অনেক পুরোনো ছাত্র ছাত্রী, যাদের অনেকেই রিচার মতোই বিভিন্ন কাজ কর্ম করে দিয়েছে তাঁর সুনাম বিবর্ধনের জন্য | অনেক পুরোনো বইয়ের পুনর্মুদ্রণেও তারা দায়িত্ব নিয়ে প্রেসের সহায়তা করেছে | কয়েকদিন আগেই কয়েকটি বড় বড় গ্রন্থাগার তাঁর কয়েকটি বই প্রকাশ হতে না হতেই দুইশত করে কপির অর্ডার দিয়েছে প্রকাশকের কাছে | যাইহোক, রিচা ডায়াসে উঠতেই স্বস্তিতে হেলান দিয়ে বসলেন, মুখে পুরে দিলেন একটা মিষ্টি পান, প্রেক্ষাগৃহের খাদ্য-পানীয় বিষয়ক নিষেধাজ্ঞার ছয়লাপ করে | স্তবগানের পালা শুরু হবে এইবার |  

(৭)


রিচার গলার কাছটা শুকিয়ে আসছে বারবার | জল খেয়ে নিলো সে | উঠতে একটু বিলম্বেই হলো তার | মাইক্রোফোন হাতে নেওয়ার সময় হাতটা যেন কেঁপে উঠলো, মনে হলো এক্ষুণি যন্ত্রটা তার হাত থেকে পরে গিয়ে বিকট নিনাদ তুলবে তাকে সবার সামনে অপ্রস্তুত করে দিয়ে | আলগা পায়ে নিজেকে সংযত করলো, ডায়াসে দাঁড়িয়ে একবুক টাটকা তাজা অক্সিজেন সঞ্চয় করে নিলো নিজের ফুসফুসে | সম্মোহনী মন্দ্রে বক্তৃতা শুরু করলো সে | মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রোতারা নিশ্চুপ হয়ে শুনতে লাগলো তার কণ্ঠস্বর, ছন্দের ওঠা নামা, বাকপটুতার নৈপুণ্য | যতই একটা একটা করে বাক্য উচ্চারণ করা শেষ হচ্ছে ততই রিচার চোয়ালটা কেমন যেন দৃঢ় হয়ে আসছে | কেউ এখনো জানেনা কি চমক সে রেখে দিয়েছে সকলের জন্য, ধীরে ধীরে তা প্রকাশ্য হবে |  দশ মিনিটের মতন বক্তৃতা হবে তার, শেষ হওয়ার কথা অমূল্যকেশর বাবুর লেখা একটি দুর্বোধ্য অর্থহীন জটিল সাংকেতিক লিপির মন্ত্রোচ্চারণে যা ভবিষ্যতের ভাষাবিদরা বাংলা কাব্য ভাষার নবসান্ধ্যরূপ বলে আখ্যা দিয়ে ডক্টরেট, পোস্ট-ডক্টরেট ডিগ্রি ও খেতাব হাসিল করতে পারেন | কবিতাটির পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদটি প্রশংসায় পরিপূর্ণ, নানা গালভরা নামে তাঁকে অভিহিত করা হয়েছে, যার মধ্যে কতগুলি সরাসরি হাস্যস্পদ  :

"কিঞ্জলকাব্যরত্ন", "উত্তরাধুনিক পথের অগ্রদূত", "সুপ্ত মনের নবজাগরণের নবীন প্রাণ", "বার্ড অফ কলকাতা" ইত্যাদি | অনুচ্ছেদটি শেষ হলো; এবার তাঁর ঊনত্রিশ পংক্তির কবিতাটি পাঠ করবার সময়,, ৬-৬-১১-৬ পংক্তির চারটি স্তবকে বিভক্ত কবিতাটির নাম 'মরুদ্যানে ফ্যাকাশে আকাশ অথবা উপহাসের চেরা কাঁথা" | রিচা একটুক্ষণ থেকে দম নিয়ে নিলো, এবার মাহেন্দ্রক্ষণ | যন্ত্রমানবের মতো তার কণ্ঠ হতে উৎসারিত হলো :   “অতএব তাঁর কবিতার স্বকীয়তা, মহানতা ও সার্বজনীন প্রভাব পরবর্তী কবিতার মাধ্যমে ব্যক্ত করে আমার বক্তব্য শেষ করছি :

অচল কবিতা

রিচা বিশ্বাস

প্রথিতযশা এক কবি বাণিজ্যিক কাগজে

স্থান-কাল-পাত্রবিহীন দুর্বোধ্য পাংশু কবিতা

লিখে দিক ভুলে গিয়ে ক্লান্ত দেহে কবিতা

হারায় | আসে আক্রোশ; অমোঘ প্রকাশকের

লেখন প্রদানের সময়সীমা | দ্বিতীয় চেষ্টায়

গ্রোথিত হয় সে কবিতা শব্দের বিশৃঙ্খলে |

কবিতা বড়োই ছায়াবতী মায়াময়ী ;

কূটকৌশলী অধরা কোনো রোমান রমণী |

স্বদেশের বৈকল্পিক, বৈভাষিক নানা নামের

নানা গোত্রের পত্রিকায় সে কবিতা প্রকাশিত,

ভূয়সী প্রশংসা পায় সংস্কৃতি-পরিষদ ও

শূন্যগর্ভ পণ্ডিতকুলের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় |

তবু, কোথাও, অন্যত্র, কাব্যদেবী পূজিত হন

অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাব্যসাধকের অর্ঘে |”


(৮)


পাঠ করা শেষ করে সে বিন্দুমাত্র দাঁড়ালো না | সরলরৈখিক অবতরণে সে নেমে এলো মঞ্চ থেকে | গট গট করে হেটে বেরিয়ে গেলো হতভম্ব মানুষগুলির মুখের সামনে দিয়ে, বিন্দুমাত্র পলক না ফেলে | কমনীয়, সুশ্রী মুখের মেয়েটির অন্তরে এইরকম একটা ভিসুভিয়াস লুক্কায়িত ছিল সেটা কেউই কল্পনা করতে পারেনি পাঁচ মিনিট আগেও | এক ব্যক্তি মাথা হেঁট করে দিয়ে সে এই দৃশ্যের সমাপ্তি টেনে এনেছে এরূপ কাব্যবাণ হেনে | সমগ্র প্রেক্ষাগৃহে বিহ্বল করা নিস্তব্ধতা | কিছুক্ষন পরেই উঠলো বিপুল হাসির রোল ও সম্মিলিত কোন্দল | ততক্ষনে রিচা জোরকদমে হেঁটে পৌঁছে গেছে লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলে | অন্য কোনোদিকে সে তাকায়নি, বক্তৃতার খসড়া কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে সে হাতের তালুতে মুঠো করে ধরে রেখেছে, তবুও নিজের বিবেককে একটা সান্তনা পুরস্কার দিতে পেরেছে সে আজকে | আলোর দিশার সম্পাদিকা তথা প্রিয় বান্ধবী তাকে দেখে মনোরমভাবে বিস্মিত হলো | সে তার বান্ধবীকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই সে বললো : "অডিটোরিয়ামে গিয়ে অমূল্যকেশরের সাথে দেখা করতেই ও বলে ফেললো যে এই দেখো সিডিউল, ভেরি সরি, আজ তোমার কবিতাপাঠ কিছুতেই এই সময়ের মধ্যে ধরানো গেলো না ব্লা ব্লা ব্লা... (প্রচন্ড শ্লেষাক্ত স্বরে) বড় বড় লোক এসেছে সব, মঞ্চে উঠে ফাঁকায় ভাষণ দেবে; একদমই জাস্ট নিতে পারলাম না | ওর লেখা স্পিচ দেবার সময় যা করবার করেই এসেছি, চল চল একটু বাইরে থেকে আসি, পাশেই মন্দিরাদিকে একটু টেবিলের দায়িত্বটা দিয়ে দে; চল আইস ক্রীম খাবো, সব বলছি খেতে খেতে" |

পড়ন্ত বিকেলে রিচা ও তার বান্ধবী কবিতাপাঠ করলো তাদের পত্রিকার কিছু অনুগত গ্রাহকদের সাথে, আইস ক্রীম খেতে খেতে, লঘু চালের আড্ডায় | অমূল্যকেশর বাবু বার বার রিং করছিলেন, আর বার বার “যে নম্বরে আপনি ফোন করেছেন সেটি এখন ব্যস্ত আছে, অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন” পাচ্ছিলেন | শেষমেশ তিনি রাগে ক্ষোভে ফেটে বেরিয়ে পড়েন সভাপতি মহাশয়কে পুরস্কার প্রদানের পূর্বেই, তাঁর সিংহহৃদয়ের দর্প, দম্ভ আজ চূর্ণ করে দিয়েছে সেদিনের একটা পুচকে মেয়ে ! ভাবতেই তিনি মনে মনে ফেটে পড়েন | রিচা মনে মনে ভেবে দেখলো যে কাল উনি তার বাড়িতে এসে একটা ধুন্ধুমার, হুলুস্থুলু কান্ড বাধাবেন | না, ফের মনটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে, সব দুশ্চিন্তাকে মনের জানালা থেকে বার করে দেয় সে | বইমেলার বাইরে নিয়নের আলোয় তার কবিতা শোনার জন্য দশ জনের মতন এসে হাজির, পাশের দাঁড়িয়ে তার বান্ধবী | চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একবার দেখে নেয় সে, অদূরের যানজট, কোলাহল, কার পার্কিং, ভেলপুরিয়ালার হাঁকডাক, যুগলদের হাত ধরাধরি হাঁটা; সব মিলিয়ে কংক্রিটের শহরের যান্ত্রিক ও জৈবনিক মিথস্ক্রিয়ায় এক পরাবাস্তব পরিবেশ তৈরী হয়েছে, তিলোত্তমা নগরী আপন লাবণ্যে, সুঘ্রাণে, সময়মন্থিত ঘটনাতরঙ্গে মশগুল | ঠোঁটের কোণে আধ ইঞ্চি একটা হাসি ফুটে ওঠে | মুহূর্তটা ক্ষণিকের জন্য নৈস্বর্গিক মনে হয় তার | আলতো হাতে হাতব্যাগ থেকে একটি বিশেষ কবিতা বার করে সে | আজকে, এই পড়ন্ত বেলায়, সূর্যরাঙা পৃথিবীর হতমিত আবেদনে, লাল সবুজ বাতির প্রজ্জ্বলনে একটা কথোপকথনের সূত্রপাত হয়েছে, নিজের কবিসত্ত্বাকে আত্তীকরণ করবে সে, এই বহুকাল ঘূর্ণির মাঝে ক্ষনিকের স্থিতিবদ্ধতায়, সকলের অখণ্ড মনোসংযোগে সে পাবে নিজেকে, বহু আকাঙ্খিত এ কবিতাপাঠ | আনম্য কণ্ঠের মৃদু ঝংকারে বেজে উঠলো : "নীরবে রয়েছে স্বপ্ন; কাব্যপ্রাঙ্গণে রচিত কুসুম ডেকেছে শরৎশিশির..." |

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment