1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

হিসাব

ছবি : ইন্টারনেট

 হিসাব

মৌসুমী দেবঘোষ  

এক কামরার একটা মাত্র ছোট্ট ঘর আর একফালি একটুকুন বারান্দা, এরমধ্যেই এখন আটকে গেছে নন্দুদের জীবন।এই ঘরেই দেয়াল ঘেঁষে রাখা আছে একটি মাত্র তক্তপোষ । তার নিচেই জড়ো করা রাজ্যের সংসারের জিনিস, হাঁড়ি কুড়ি থেকে আরম্ভ করে ট্রাঙ্ক -শিশি-বোতল,মায় বইখাতাও,  কি যে নেই কে জানে ! জিনিস রাখার জন্য তক্তপোষটিকে ইট দিয়ে দিয়ে এত উঁচু করা হয়েছে, যে লাফ না দিয়ে ওঠাই যায় না ! নন্দুর বছর তিনেকের ভাইটা তো উঠতেই পারে না, ওকেই কোলে করে তুলে দিতে হয়। 

    তক্তপোষে শুয়ে ছিল নন্দু ওর ভাইকে নিয়ে, নিচে বোনকে নিয়ে বাবা-মা।  শুয়ে শুয়ে মা-বাবার নিচু স্বরে বলা কথাবার্তা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল । বুঝতে পারছিল  সামনে আরও খারাপ দিন আসতে চলেছে ওদের জন্য। 

   এমনিতেই  কি বা ভালো ছিল এতদিন ! তবু তো আগে রোজ দুবেলা মা উনুন ধরাত , ভালো মন্দ না জুটুক , খিদে চেপে ঘুমাতে হতনা ওদের ।এখন একবেলা কোনক্রমে ভাতেভাত হচ্ছে,  রাত্রে স্রেফ শুকনো মুড়ি । তাও যে বেশীদিন জুটবে  বলে তো মনে হচ্ছে না। নন্দু বিছানায় কাঠ হয়ে শুয়ে সেকথাই শুনছিল ।পেটে খিদে থাকলে ঘুম আসে নাকি ?     

   সন্ধ্যেবেলায় ভাইটা যখন গরম ভাতের জন্য জিদ করছিল, মা পাগলের মত মারছিল ভাইটাকে । সহ্য করতে পারেনি নন্দু, ভাইটাকে কোলে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল পাড়ার বাইরে । পরে মাই রাগ পড়তে ওদের ঘরে ফিরিয়ে এনেছে । ততক্ষণে ভাই বেচারা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়েই পড়েছে ।   

   নন্দু কিন্তু তাও মায়ের উপর রাগ করতে পারে না।ওর মা এমন ছিল না মোটেই ।বকুনি দিত ওদের ,গায়ে হাত তোলেনি কোনদিন।এখন মা কেমন যেন হয়ে গেছে,রাগিরাগি, খিটখিটে ।মায়ের চোখের নিচে এক পুরু কালি,পরণের শাড়িটা শতচ্ছিন্ন ।বাবার কপালেও চিন্তার অসংখ্য ভাঁজ !আজকাল ভালো করে কথাও বলে না হাসে না পর্যন্ত মা, বাবাও। দুজনেই সারাক্ষণ কি যেন ভেবে যায় !ভাইবোন ছোট , ওরা না বুঝলেও নন্দু বুঝতে পারে সব।    

-----------

    আসলে গতবছর কি একটা বিচ্ছিরি রোগ এলো না,ঘর থেকে বেরানো বন্ধ,কত মানুষ মারা গেল। সব কিছু বন্ধ হয়ে গেল- স্কুল-কলেজ-অফিস –কাছারি বাস-ট্রেন।নন্দুর বাবা তো আগে ট্রেনে ঝালমুড়ি বেচত, মাও পাঁচ বাড়িতে ঠিকে-ঝির কাজ করত।চলে যেত ওদের, আনন্দেই ছিল ওরা।আর যাই হোক , খাবার কষ্ট ছিল না ওদের ।             

     কিন্তু ওই যে কি বলে না লকডাউন না কি শুরু হতেই তো বাবার কাজটাই বন্ধ হয়ে গেল।মায়ের কাজগুলোও থাকল না।ওই রোগের ভয়ে সবাই কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিল মাকে। কি ভাবে সংসার চলবে ভেবে ভেবে বাবা-মার অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে লাগল । বাবা শেষপর্যন্ত একটা রিক্সা ভাড়া নিয়ে চালাতে শুরু করল। কিন্তু রাস্তাঘাটে লোকজনই নেই তো কে রিক্সা চাপবে ?      

      নন্দুদের রেশন কার্ডও নেই যে বিনা পয়সায় রেশন পাবে।একজন বলেছিল একটা কুপনের ব্যবস্থা করে দেবে ফ্রি চালডালের । বাবা কদিন হন্যে হয়ে ঘুরেও তা যোগাড় করতে পারেনি।কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এসে ওদের পাড়ায় মাঝে মাঝে চালডাল বিলাতো।নন্দুর লজ্জা লাগলেও ও ভাই- বোনকে নিয়ে লাইন দিয়ে সেখান থেকে দু’ একবার কিছু সাহায্য পেয়েছিল। আর ছিল ওদের দু’ভাইবোনের স্কুলের মিড ডে মিলের চালডাল।এতেই যাহোক করে চলছিল আধপেটা খেয়ে , কিন্তু এভাবে যে আর  বেশীদিন চলবে না তা বোঝাই যাচ্ছিল।         

   নন্দুর কানে এলো , মা একদিন বসে বসে বাবাকে বলছিল যদি একটা ঠ্যালার ব্যবস্থা করা যায় , তাহলে একটা আলু- পেঁয়াজের দোকান দেওয়া যাবে। এতোগুলো মুখে কিছু তো দিতে হবে। ওরা মা-ছেলে মিলেই নয় চালাবে,নন্দুর তো এখন স্কুল নেই। ও দেখেছিল, মা  আঁচলে চোখ মুছে লুকিয়ে রাখা সোনার কানফুলদুটো বাবার হাতে দিয়ে বলেছিল ,কিছু একটা ব্যবস্থা করতে।        

--------

    সেই থেকে এখন নন্দু ওর মায়ের সাথে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে আলু-পেয়াজ- রসুন ডিম এসব বিক্রি করে ঠ্যালা নিয়ে।এছাড়া উপায়ও ছিল না , বাজারে ওদের বসতেই দেয়নি পুরনো দোকানদাররা ।তারজন্য নাকি  টাকা দিতে হবে। কোথায় টাকা পাবে ওরা !      

   প্রথম প্রথম ওজন করা, হিসাব করে টাকা নেওয়া, খুচরো ফেরত দেওয়া কিছুই ঠিকমত পারত না নন্দু। মায়ের সাথে সাথে থাকতে থাকতে সব শিখে নিয়েছে ও। এখন আর অসুবিধা হয় না, একা একাই পারে।  বাবা মালপত্র এনে দিয়ে রিক্সা নিয়ে বেরায়।মাও এখন আবার লোকের বাড়ির কাজে লেগেছে, মাঝে মাঝে এসে ওকে সাহায্য করে যায়।  

   নন্দুর শুধু একটাই ভয় , স্কুলের বন্ধুদের কারো সাথে যেন দেখা না হয়ে যায় ! হে, ভগবান তাহলে ওর খুব লজ্জা করবে।অবশ্য নন্দু যেদিকে ঠ্যালা নিয়ে আসে ,সেদিকে ওর বন্ধুদের থাকার সম্ভাবনা নেই এটাই রক্ষে ! তাছাড়া ওর বন্ধুদেরও অনেকে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজে লেগে গেছে। কদিন আগেই তো রাস্তায় রতনের সাথে দেখা, তখনই জেনেছিল ওকে ওর বাবা কোথায় নাকি রাজমিস্ত্রির যোগাড়ের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।  বাদল তো ওর বাবার চায়ের দোকানেই বসে আজকাল , ফাই ফরমাস খাটে । অনন্তও বাজারে মাছ বিক্রি করে, ও নাকি আর পড়বেই না।  

-------

    মাঝে মাঝে যখন কোন খদ্দের থাকে না, নন্দু ওর ঠ্যালাটা গাছের ছায়ায় রেখে নানান কথা ভাবে,   গতবছরের কথা। স্কুল তো বন্ধই হয়ে গেল হঠাৎ! আজ এক বছর পড়াশুনার সাথে কোন যোগাযোগই নেই। কে পড়াবে ? আগে তবু সন্তোষদার কোচিঙে পড়তে যেত সন্ধ্যাবেলা । সেও তো বন্ধ,কেউ আর পড়তেই আসে না । সন্তোষদা নিজেই তো এখন খাবার হোম ডেলিভারির কাজ নিয়েছে।  

   মাঝে মাঝে  পুরানো বইগুলোই নেড়ে চেড়ে দেখে, ভাইকে ছবি দেখায়। পড়াশুনা না থাকায় অবশ্য খুশিই হয়েছে নন্দু, ওর তো পড়তে ভালোই লাগত না। অঙ্কের স্যার ভূদেববাবুকে দেখলেই কেমন যেন ভয়ে পেটের মধ্যে গুড়গুড় করত ওর। কম মার খেয়েছে ও অঙ্ক না পারার জন্য, হোম ট্যাক্স না করে নিয়ে যাবার  জন্য! ভূদেব বাবুকে অবশ্য শুধু ও নয়, ওর মত আরও অনেকেই ভয় পায়, যা রাগী !ইংরাজির সুমিতস্যারকেও ভীষণ ভয় পেত, ওনার ক্লাস মানেই তো নন্দু ক্লাসের দরজার বাইরে।       

    কিন্তু নন্দুর খুব ভালো লাগতো বাংলা পড়তে । কি সুন্দর সুন্দর কবিতা ছিল, গল্প ছিল , রঙিন ছবি ছিল ওদের বইতে ! আর ভালো বাসত কাগজ কেটে নানারকমের ফুল-পাখি এসব বানাতে। ওর মন খারাপ লাগে তাই স্কুলে না যেতে পারার জন্য।   

      কত বড় খেলার মাঠ ছিল ওদের ,কত বন্ধু ছিল ওর! খেলার মাঠে ওকে কেউ কোনদিন হারাতে পারেনি। খেলার স্যার প্রীতমবাবু কত ভালোবাসতেন, বলতেন উঁচু ক্লাসে উঠলেই স্কুলের ফুটবল টিমে নেবেন ওকে । টিফিন টাইমে বা ছুটির সময়ে সেই বিলিতি আমড়ার আচার , ঘুগনি –আলুকাবলি খাওয়া -সব কেমন যেন হারিয়ে গেল ! এখন যদি স্কুল খোলা থাকত , নন্দু ক্লাস সিক্সে উঠত । কে জানে আর স্কুল খুলবে কি না, আর খুললেও ওর যাওয়া হবে কিনা  !   

    একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল নন্দু, হঠাৎ মনে হল কে যেন ডাকছে ওকে ।তাকিয়ে দেখে   একজন খদ্দের এসেছে ।উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি বলে – ‘ কি নেবেন বাবু, আলু না পেঁয়াজ --?’  

    বলে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়েই চমকে ওঠে , আরে এতো  ওদের স্কুলের অঙ্কের স্যার ভূদেববাবু ! যতই মুখ- মাথা ঢাকা থাক,ও ঠিক চিনতে পেরেছে, ভূদেববাবুও ওকে । 

     তিনিও বিস্মিত কণ্ঠে বলেন-‘ তুই ? তুই আলুর দোকান দিয়েছিস, ভালো-- ভালো । তা হিসাব টিসাব ঠিকঠাক করিস, না সবই মায়ের  ভোগে রে ?তুই তো আবার অঙ্কে মহাপন্ডিত  ছিলি কি না !’      

    নন্দু কোনক্রমে একপাশে মাথা নাড়ায় , মুখ খুলবার সাহস হয় না। তারমানে স্যার এ পাড়াতেই  কোথাও থাকেন । ও বন্ধুদের ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু স্যারও যে থাকতে পারে ভেবে দেখেনি তা ! এতো যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়- ব্যাপার হল !  

    নন্দু চুপ করে আছে দেখে স্যারই বলেন-‘ নে নে এক কিলো আলু, আধ কিলো পেয়াজ, আড়াইশ আদা আর ছটা ডিম দে ,দেখি কেমন হিসাব করতে শিখেছিস !’   

   অন্যদিন ঠিকই ওজন করে নন্দু , আজ  কেন যে হাত কাঁপছে ওর ! তবু ঠিকঠাক ওজন করে সব গুছিয়ে পলিপ্যাকে ভরে এগিয়ে দিল স্যারের দিকে।ভূদেববাবু কত হয়েছে জেনে নিয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা দিয়ে পলিপ্যাকটা নিলেন।          

  স্যার রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছেন ব্যাগ নিয়ে। সেদিকেই তাকিয়ে থাকে নন্দু, এখনো ওর বুকের মধ্যেটা ঢিবঢিব করছে যেন।  স্যারের দেওয়া টাকাটা এখনো হাতের মুঠোয় ধরা। খুলে হিসাব করতে গিয়ে চমকে যায়। আরে স্যার তো বেশি টাকা দিয়ে দিয়েছেন।      

  নন্দু আর দেরি করে না, স্যার চোখের আড়ালে যাবার আগেই ফেরত দিতে হবে। ও তো স্যারের বাড়ি কোথায় জানেই না।উনি ততক্ষণে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন,বেশ কিছুটা ছুটে তবে ধরতে পারে স্যারকে। ভূদেববাবু অবাক, বলেন –‘ কি রে কি হোল, নিশ্চয়ই হিসাবে ভুল করেছিস তো , আমি ঠিক জানতাম!তুই করবি হিসাব তবেই হয়েছে !’        

   নন্দু মাথা নিচু করে হাতটা এগিয়ে দেয়,বলে –‘ না  স্যার, আপনি দশ টাকা বেশি দিয়েছেন , তাই--- !’  

  বিস্ময়ে ভূদেববাবুর চোখ বড় হয়ে যায়। হ্যাঁ , এটা ঠিক , তিনি দশ টাকা বেশি দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা ভুল করে নয়,সহানুভূতি থেকেই।ভেবেছিলেন যে ছেলে কোনদিন ক্লাসে যোগবিয়োগটা ঠিক করে করতে পারত না , সে ধরতেই পারবে না । আশ্চর্য ,ঠিক ধরে ফেলল তো!    

   হাত বাড়িয়ে টাকাটা ফেরত নিতেই হল, বলতে পারলেন না ও টাকাটা ইচ্ছা করেই দিয়েছিলেন। যে কষ্ট করে খেটে খেতে শিখেছে তাকে আর যাই হোক ,দয়া দেখানো যায় না! ছেলেটার সততায় মুগ্ধ হলেন।     

    নন্দু ফিরে যাচ্ছে ওর ঠ্যালার কাছে ধীর পায়ে। ভূদেববাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ওর দিকেই।  একটা ঢলঢলে প্যান্ট আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরা দশ-এগারো বছরের ছেলে , যে কোনদিন তাঁর ক্লাসে ঠিকমত অঙ্ক করতে পারেনি, যাকে তিনি সাধারণ যোগবিয়োগ শেখাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যেতেন। আজ সে কি নির্ভুল ভাবে হিসেব করে ফেলল ! অঙ্কের মাস্টার হিসাবে তাঁর ধারণা যে কত ভ্রান্ত ছিল , ছেলেটা আজ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল!         

   বুঝলেন, যে অঙ্ক তিনি ক্লাসের চার দেয়ালের মধ্যে এতদিন শিখিয়ে উঠতে পারেন নি, জীবন–পরিস্থিতি নিপুণ হাতেই তা ওকে শিখিয়ে দিয়েছে আজ ! 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment