1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

তিরবিদ্ধ

ছবি : ইন্টারনেট

 তিরবিদ্ধ 

পলাশ দাস

পৃথিবী... 

প্রত্যেক মানুষের একটা ভিন্ন নিজস্ব পৃথিবী থাকে। আর সেই ভিন্ন ভিন্ন পৃথিবীর প্রতিষ্ঠা দিতেই প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের লড়াই। সকাল থেকে রাত আবার পরের সকালে কখনও চাপা লড়াই, কখনও বাঁধ ভাঙা হুল্লোড়ে লড়াই বাঁধে। যার উত্তাপ প্রত্যেকদিন টানটান, আকর্ষণীয় দর্শকদের কাছে। এখানেও এই পাঁচ জনের লড়াই। সকাল থেকে রাত আবার পরের সকালে বেয়ে চলে এই লড়াই। প্রতিষ্ঠার লড়াই, নিজেকে নিজের কাছে জিততে দেখার লড়াই। কখনও ইগো, ইমোশন আর কখনও নিজের অধিকার রাখবার লড়াই।  

লুডোর বোর্ডের মতো এই বিস্তৃত মাঠে চারজন ঘুঁটি আর সুরমা তাদের মধ্যে তাল রাখার অদম্য লড়াই লড়ে যায় সকাল থেকে রাত আবার পরের সকালে। ঘুঁটির মতো তারা একই ঘরের মধ্যে ঘুরে চলেছে। অজস্র হাতের দাগে ঘুঁটির গা তেলতেলে, ঘরের গায়ে থেকে খসেছে প্রলেপের রঙ। 

সুরমা সাঁকো গড়ে তুলতে চাইছে আর চাপা দিতে চাইছে প্রত্যেক ঝড়কে। কিন্তু, ঝড় কি এভাবে চাপা দেওয়া যায়? সে যখন তৈরি হয়েছে আছড়ে তো পড়বেই।  

নেম প্লেটের লেখাটা বেশ উজ্জ্বল, শান্তি ভবন। কিন্তু, অবনীর সংসারে শান্তি নামক বস্তুটি বিদায় নিয়েছে বেশ কিছুদিন। অবনী যখন চাকরি করত, তখন শান্তি ছিল বাড়িতে। এখন একটা শান্তির আবরণ অবশ্যই আছে, ভিতরে ভিতরে ঝড়, প্রবল ঝড় বয়ে যায় দিন-রাত, আর সে ঝড় প্রত্যক্ষ করে সুরমা, আর চেষ্টা করছে তাকে বাগে আনার। 

কিন্তু, সুরমা পারছে কি? মাঝে মাঝেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সুরমা, আর আক্ষেপের সুরে বলে, “তোদের জন্য সব বিসর্জন  দিলাম। তোর বাবা বলল, তোমার বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগ রাখা যাবে না, রাখলাম না। বাইরে কোথাও যাওয়া যাবে না, গেলাম না। তোদের জন্য উদয়-অস্ত প্রাণপাত করলাম। সব মা তাই করে। তোর বাবা যা বলেছে কোনদিন বলতে পারবে,করিনি? আজ এই শেষ বয়সে তোরা একটু শান্তি দে! বাঁচার জন্য একটু মুক্ত বাতাসের দরকার শান্তিতে শ্বাস নেওয়া প্রয়োজনে, সেটুকু দে... আর ভাল লাগছে না  টুসি। তোর দাদাকে বল এবার ও ক্ষান্ত দিক। ওর কাজ ও করুক। আমি তোর বাবাকে বলব কিছু বলবে না। মানুষটা দিন দিন কেমন হয়ে গেল। একবারও হাসতে দেখিস এখন আর!” একটু থেমে টুসির মুখের দিকে তাকিয়ে সুরমা আবার বলে, “আমার এ জীবনে কোনদিন একটুও শান্তি হবে না!” আজও ঠিক এই একই কথা বলে চলেছিল সুরমা।  

“মা, তুমি শান্ত হও। শরীর খারাপ করবে। নাও একটু জল খাও।” টুসির হাত চেপে ধরেছে সুরমা। চোখের কোণে জল নিয়ে সুরমা বলে, “শান্ত থাকা যায় বল ? সবসময় যুদ্ধ করছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। কি করে থাকবে এখানে একসাথে...!” 

২.

সুরমা, অবনীর দুই ছেলে আর এক মেয়ে। বড় ছেলে অরিন্দম একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। বিয়ে করে আলাদা হয়েছে। ছোট ছেলে সমর কোনো কাজ করে না, চেষ্টা করছে আর টুসি এবার কলেজ ভর্তি হয়েছে। অবনী কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর বাড়িতেই থাকে। ভরসা পেনসনের টাকা আর কিছু ব্যাঙ্ক ডিপোজিট। 

সংসারে অবনীর কথাই শেষ কথা। যতদিন ছেলেরা বড় হয় নি, ছেলের বিয়ে হয় নি, ততদিন সব ঠিক ছিল। কিন্তু, ছেলেরা বড়ো হওয়ার পর সংসারে লোক বাড়ার পর অবস্থা বদলেছে। বড় ছেলের সাথে বনিবনা না হওয়া, ছোটো ছেলের ঠিক সময়ে কাজ না জোটা, মেয়ে মাথার ওপর থাকা, সব নিয়েই সুতো জড়িয়ে পাকিয়ে গিঁট পড়েছে। সুরমা চেষ্টা করছে যদি কোনোভাবে এই গিঁট খুলে ফেলা যায়, জট পাকানো সুতোকে আবার আগের মতো করে ফেলা যায়, কিন্তু কোথায় কী! 

সেদিন তুমুল অশান্তির সময় অবনী জোর গলায় বলেছিল, “সংসারে কটা টাকা দিস তোরা? তার থেকে দুজনের তো খাওয়া খরচা বেশি। নিজেরা সংসার চালাতে হলে বুঝতে পারতিস। চালাতে তো হয় না। আমিই তো এখনো সব টানছি, বড়ো বড়ো কথা। ক্ষমতা থাকে তো বেরিয়ে গিয়ে সংসার করে দেখা দেখি।” মাথা গরম হলে মানুষে কতকিছু বলে, তার ঠিক থাকে না। বাবার কথা বৌ-এর সামনে গায়ে লেগেছিল অরিন্দমের। তার কয়েকদিন পরেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে নতুন সংসার পেতেছে।

কথাগুলো বলে অবনীর যে গা জুড়িয়েছে তা নয়। মাথা ঠাণ্ডা হলে বুঝেছিল কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছে। কিন্তু, ছেলের সামনে মাথা নোয়ান যাবে না। পাহাড়ের মতো ইগো চেপে বসেছিল অবনীর মাথায়। “ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তুমি কিছু বলবে না? বারণ তো করতে পারো!” আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সুরমা বলেছিল। “কেন আমি বলতে যাব কেন, আমি কি ভুল কিছু বলেছি? আর অত তেজের কি আছে। যাক, যাক, দেখবে কদিন পর শুর শুর করে ফিরে আসবে। যেতে দাও,যেতে দাও...” 

“তবুও, তুমি একবার বলবে না?” এবার অবনী রেগে গিয়ে সুরমার উপর অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল, “কেমন মানুষ করেছ ছেলে দেখো, অত তুলে রাখার কি ছিল। যাক যাক...” এই যাঁতাকলে পড়ে সুরমা কোনদিকে যাবে ঠিক করতে পারে না। ভরসা শুধুই চোখের জল। 

৩.

ছোট ছেলে সমরের বয়স বাড়ছে। মেয়েরও বয়স হয়েছে বিয়ে দেওয়ার। এদিকে অবনী মন দিন দিন সংসার থেকে উঠে যাচ্ছে। অরিন্দম চলে যাওয়ার পর থেকে তেমন কথা বলে না কারও সাথে প্রয়োজনটুকু বাদ দিয়ে। সমর একটু অন্য রকম খামখেয়ালি, একরোখা, নিজের মতে চলতে ভালোবাসে। আর এভাবেই সংসারে চারটে প্রাণী নিজেদের মধ্যে এভাবেই দূরত্ব বাড়িয়ে নিচ্ছে। অবনীর কথা এখন একেবারেই মেনে নিতে পারে না সমর। যা বলে তাই ওর না পসন্দ। বাবার মুখের উপর দু-চার কথা বলতেও তার কোনো দ্বিধা নেই। আর এই নিয়ে নিত্য দিন সংসারে উত্তাপ চড়ছে। 

টুসি এখনও তেমন ভাবে নিজেকে সংসারের সাথে না জুড়লেও ওর যখন তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া, দেরি করে কলেজ থেকে ফেরা নিয়ে অবনী যথেষ্ট অসন্তুষ্ট, সেই নিয়ে সুরমার সাথে কথা কাটাকটি হয়েছে। সেদিন ফিরতে দেরি হয়েছিল টুসির, সন্ধ্যার তুমুল বৃষ্টি আর ট্রেনের গোলমালে। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই অবনী কথা কানে গিয়েছিল টুসির, “দেখো কোথায় গেল, খবর রাখ? এরপর মুখে চুন কালি না মাখায়...!” “তুমি চুপ করো তো যা মুখে আসে বলে যাও। বয়সের সাথে সাথে কি মাথাও যাচ্ছে? নিজের মেয়েকে চেনও না!” সুরমা কথাগুলো বলেই অবনীর দিকে এগিয়ে এসেছিল। অবনীর গায়ে হাত রেখে বলেছিল, “তুমি এমন করো কেনও আজকাল? কি হয়েছে? বাবু চলে যাওয়ার পর থেকেই তুমি কেমন হয়ে গেলে। ওদের ডেকে পাঠাব। আবার একসাথে থাকব সবাই!” তেলে জল পড়লে যেমন আওয়াজ হয়, ঠিক তেমনই জ্বলে উঠেছিল অবনী। টুসি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখেছিল, তারপর ঘরে ঢুকতেই কথা ঝাঁপটা শুনেছিল। 

তারপর বলেছিল, “এখন তো আর বাড়ি থেকে কোথাও বেরোও না। বাইরেটা একবার দেখো,অনেক বদলে গেছে বাবা। যখন যেতে তখনকার মত নেই। আর চুনকালি আমি মাখাব না। নিজের মেয়ের ওপর এই বিশ্বাসটুকু রেখো।” সুরমাকে জড়িয়ে সেদিন রাতে খুব কেঁদেছিল টুসি। “কেমন করে বাবা এটা বলতে পারল, বাবা কি আর বিশ্বাস করে না মা?” সুরমা ওকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। ঘরের অন্ধকার কোণের ভাঁজে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে চারজন। 

৪.

অবনীর বাড়িতে এখন আত্মীয়স্বজনের আসা নেই বললেই চলে। তবে সে একটা সময় ছিল যখন বাড়িতে রবিবার বা পুজোর সময় করে আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা হতো দেখার মতো। আনাগোনা কমতেই তাদের সাথে দূরত্ব বেড়েছে। এই নিয়ে অবনী মাঝে মধ্যে বলে ফেলে, “যে কদিন দিতে পেরেছি, ডেকে দিব্য তিন বেলা খেয়ে গেছে, এক পয়সাও কাউকে দিতে হয়নি। আর এখন বাড়িতেও আসতে হবে না, একবার ফোন ঘুরিয়ে জানতেও চায় না কেমন আছি।” তবে এদেরই মধ্যে দু একজন আছে যারা মাঝে মাঝে অবনীর বলা কথা মিথ্যে প্রমাণিত করে দেয়। অবনীর ফোনে বছরে এক দু’বার ফোন আসে। সারা সংসারের শরীর চেক-আপ করে নেয় তারা এক ফোন কলেই, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার মতো। সবকিছু এখন প্যাকেজে চলছে, একটার মধ্যেই, দ্বিতীয় বারের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। অরিন্দম বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তেমনই ফোন শুকনো কিসমিসের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল অবনীর সংসারে। আর সেগুলো মোটেও মিষ্টি ঠেকেনি সুরমার।  সেইদিন থেকে তাদের উপর ভারী রাগ জন্মেছে। সুরমা ভাবতে সুরু করেছে ওরাই অবনীর কান ভারি করেছে। 

সুরমার থেকে সমরের রাগ আরও বেশি তাদের ওপর। সমর কোনো বাঁধন না রেখেই বলেছিল সুরমাকে, “একটা বয়সের পর টাকাই সব,টাকা ছাড়া কি মানুষের কোনো  মূল্য নেই? আমি টাকা দিতে পারছি না বলে বাবা এই রকম ব্যবহার করে!”  কথা শেষ হলে সুরমা আর কথা বাড়ায়নি। এমনিতেই এখন সংসারে কথা বেশি। আর এইসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগেনি সুরমার। উত্তর না পেয়ে সমর বলেছিল, “বাবার কথা বললেই তোমার রাগ হয়ে যায়। যাক আর বলব না! তুমি সব মানিয়ে নাও। রান্না করে রাখো! এই রবিবারেই আসবে, কেউ না কেউ। দাদার খবর নিতে হবে না!” যেতে যেতে আবার পিছু ফিরে বলেছিল, “তবে কী বলতো, মাঝে মাঝে কিছু কথা বলতে হয়, নাহলে নিজের কথাগুলোই হারিয়ে যায়। মাঝে মাঝে বোলো।”  

৫.  

সকাল থেকেই এক ভয় সুরমাকে তাড়া করে। সংসার যে কি, তা সুরমার খুব ভালো করে জানা হয়ে গেছে। যার দেওয়ার ক্ষমতা নেই তাকে যে মানিয়ে নিতেই হয়, না মানালে চলে না। টুসিকে বারে বারে সেই কথাই বোঝায়। সমরকে বোঝাতে পারে না। সমরের কাছে কে কি বলছে তার কোনো গুরুত্ব নেই। আর এই জন্যই অবনী আর সমরের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনার সম্পর্ক থাকে। আর সেই ভয়েই কাঁটা হয়ে থাকতে হয় সুরমাকে, কখন আবার দুজনের ঝামেলা হয়।   

অরিন্দমের জন্য খুব খারাপ লাগে সুরমার। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর আর আসে নি। ফোনও করেনি। বাবা আর  ছেলেদের এই টানা পোড়েনে সুরমা পড়েছে মহা ঝামেলায়। ছেলেরা যখন হয়েছিল কত আনন্দ ছিল দুজনার মনে, কে ভেবেছিল এইরকম দিন আসবে, যখন ঘরের মধ্যেটাই একটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠবে। টানটান অশনি সংকেত বয়ে যাবে ঘরের বদ্ধ বাতাসে। টুসিকে আঁকড়ে ধরেই সুরমা এখন একটু শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। কিন্তু, মেয়ে বড় হয়েছে। তাকে তো আর সারা জীবন কাছে রাখা যাবে না! 

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা দিন কেটেছে। শান্তিতে না হলেও অশান্তির মাত্রা তেমন ছিল না। তবে চাপা আগুন যে রয়েছে, তা যখন-তখন গনগনে হয়ে উঠতে পারে সেই ভয়ে সুরমা সিটিয়ে থাকে। আজ সন্ধ্যাবেলা অনেক দিন পর সবাই একসাথে চা খেতে বসেছে। টিভিটা বেশ জোরে দেওয়া রয়েছে। ওদের মধ্যেকার কথার শূন্যতা তা ওই আওয়াজই মিটিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় অবনীর ফোনটা বেজে উঠল, টিভির ভলিউম মিউট করে দিল অবনী। 

সুরমা কাঠের হাতল ছাড়া চেয়ারে বসে আছে। সমর বিছানার এক কোনে। পাশেই বসে আছে টুসি। অবনী টিভির সামনের চেযারে। চেয়ার থেকে উঠে ফোনটা ধরতে গিয়ে অবনী একবার সবার দিকে তাকালো। ফোনটা তখনও বাজছে পুরোনো ঘ্যানঘ্যানে টোনে...   

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment