1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

ইয়ুন

ছবি : ইন্টারনেট

ইয়ুন 

মলয় সরকার 

সেবার আমেরিকায় এসেছি মেয়ের কাছে। মেয়ে একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।জায়গাটা একটু ফাঁকা ফাঁকা। কাছেই একটা ঘর নিয়েছে। ঘরটা একটু বড়।আমাদের বলল, তোমরা ওখানে তো খালিই রয়েছ, পিছুটান নেই।ক'দিন এখানে ঘুরে যাও। ভালই লাগবে।

আমরা তো খালি আছি ঠিকই, তবুও বাড়ি ছেড়ে এতদিনের জন্য যাওয়া, নিজের বাড়ি,কিছু গাছপালাও আছে, কয়েকটা ন্যাওটা বিড়াল কুকুর আছে, রোজ খেতে আসে, এদের জন্য মায়াও পড়ে গেছে। সব দেখাশোনার ব্যবস্থা করে তবে তো যাব। বললাম মেয়েকে।যুক্তি ধোপে টিকল না, যেতেই হবে। কাজেই তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা করতে হল ঘরের সব কিছু ঠিকঠাক দেখার জন্য।

পৌঁছালাম মেয়ের বাড়ি।একটু ঢালু পাহাড়ের গায়ে বাড়ি।এখানেই বাড়ি নিয়েছে মেয়ে।একটু ফাঁকা জায়গা, তবে এখান থেকে ইউনিভার্সিটি যাওয়া আসার বাসের সুবিধা আছে।যদিও এখান থেকে একটু উঁচুতে উঠলেই দূরে ঘন নীল সমুদ্র দেখা যায়. দেখি, চলে যায় বড় বড় জাহাজ। ভালই লাগে বেশ।

একদিন সকালে দেখি বাড়ির মালিক, তার বাচ্চা মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে একগোছা ফুল নিয়ে হাজির। একগাল হেসে গুডমর্ণিং জানিয়ে চলে গেল। মেয়ে তো দেখে চোখ কপালে তুলে আশ্চর্য হয়ে বলল, ব্যাপার কি! কপাল তোমাদের! দিন রাত্তির তো ওর বৌ আমার সাথে ঝামেলা করেই আছে।

বাড়ির মালিক ছেলেটির বেশি বয়স নয়। ছেলেই বলব, কারণ খুবই অল্প বয়স।কোরিয়ান ছেলে।ওরা কর্তা গিন্নী আর বাচ্ছা পুতুলের মত মেয়েকে নিয়ে থাকে দোতলায়। বৌটিরও বেশি বয়স নয়।ছেলেটির নাম   ইয়ুন।

শুনলাম, ছেলেটিও বাড়ির মালিক নয়। আসল মালিক এখানে থাকে না।

তবে ভাড়াটা বেশ বেশি।তাই ও নিজের মত জায়গাটুকু রেখে বাকীটা 'সাবলেট' করেছে। নাহলে ওর পক্ষে এ বাড়ির ভাড়া টানা মুস্কিল।ও যা আয় করে তাতে টানাটানি  পড়ে যাবে।

ওরা নিজেরা থাকে দোতলায় আর আমাদের জন্য দিয়েছে একতলাটা।

যাই হোক, জায়গাটা আমাদের বেশ ভালই লেগে গেল।কোলকাতার ওই অত আওয়াজ, দূষিত বাতাস, প্রচণ্ড প্যাচপেচে গরম ছেড়ে এখানে এসে যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এখানে আকাশ ঘন নীল, যা কোলকাতায় পাই না। নিঃশ্বাস যেন নিজে ঠেলে ভিতরে ঢুকছে বেরোচ্ছে, কোন কষ্টই হচ্ছে না, চারিদিক পরিষ্কার ঝকঝকে, সব চলে নিয়ম মাফিক, আইনমত।খুব ভাল লাগছে সব। ক' দিন 'জেট ল্যাগ' কাটিয়ে নিয়েই বেশ তৎপর হলাম।এখানে ওখানে নিজেরাই ঘুরে বেড়াই।মেয়ে ইউনিভার্সিটি যায়। আমাদের আর কাজ কি।কখনও কাছাকাছি মলে যাই, বাজার করি, কখনও বাসে করে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে থাকি।ফিরে আসি মেয়ে বাড়ি ফেরার আগেই।সেই সকালে ও বেরোয়, ফিরে এসে স্নান করবে খাবে বিশ্রাম করে আবার পড়াশোনা নিয়ে বসবে। গিন্নী মাঝে মাঝে অল্প রান্না করে।একদিন রেঁধে দু-তিন দিন খাওয়া হয়।এই চলছে। 

মাঝে মাঝে দেখি ছেলেটি বৌ মেয়ে নিয়ে গাড়ি করে বেরোয়।আমাদের দেখতে পেলে, হেসে ছেলেটি হাত নাড়ে।বৌটি কিন্তু ফিরেও তাকায় না। 

সেদিন রাতে, দশটা কি এগারোটার সময়, ওয়াশিং মেসিন চালিয়েছি। মেয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে একগাদা কাচার জামাকাপড় দিয়েছে, কেচে রেখ, কাল লাগবে।

ওদের ওয়াশিং মেসিনটায় একটু আওয়াজ হত।সেটা ঘর নেওয়ার সময়ই বলা ছিল। হঠাৎ মেয়ের কাছে  হোয়াটস এপে টেক্সট এল, এত রাতে ওয়াশিং মেশিন চালিয়েছ কেন? 

শুনে মাথাটা গরম হয়ে গেল। মেয়েকে বললাম, আমার ঘরে ওয়াশিং মেসিন আমি চালিয়েছি, তার কৈফিয়ত দিতে হবে না কি? 

মেয়ে একটু ভদ্রভাবে উত্তর দিল, দরকার ছিল, কাল সকালে খুব প্রয়োজন তাই চালিয়েছি।

উত্তর এল, ইয়ুনের বৌ লিখেছে, আমি এই সময় ঘুমাই।আমার এই আওয়াজে খুব ডিস্টার্ব হয়।তুমি মেসিন চালালে দিনের বেলা চালাবে।

সেদিন আমরা ঘরে গজগজ করলাম, কিন্তু কথা আর বাড়াইনি অত রাতে । 

মেয়ের ইউনিভার্সিটির এই কোর্সটা এক বছরের।এর পর এটা শেষ হলে আবার কোথায় চলে যাবে। আমরাও ঠিক সেই সময়ই দেশে ফিরে যাব, এটাই মোটামুটি সাব্যস্ত হয়ে আছে।

কয়েকদিন পর একটা ছোট ঘটনা ঘটল।আমরা বাজার করতে গেছি তিনজনে। অনেক বাজার নিয়ে ফিরে এসে আর চাবী পাচ্ছি না খোলার।কি ব্যাপার! মেয়ে মনে করে বলল, সর্বনাশ হয়েছে।আমি চাবীটা সঙ্গে না নিয়ে টেনে বন্ধ করে দিয়েছি। 

আমি বললাম,  ইয়ুনকে বলে দেখ, হয় ওর কাছে ডুপ্লিকেট চাবী আছে, নয়ত ওর ভিতরে কোন দরজা আছে নিশ্চয়ই খোলার।

মেয়ে গিয়ে বলতে, অনেক কষ্ট করে দরজা খুলিয়ে যেটা জানতে পারল, ইয়ুন নেই।কোথাও বাইরে গেছে। কবে ফিরবে জানা নেই।আর চাবি আছে কি না বৌ জানে না।ওদের ঘর দিয়ে যাওয়া যায় কি না ও বলতে পারবে না। এটুকু বলেই, মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল।

আমরা বলাবলি করতে লাগলাম, এইটুকু উপকার করতে পারল না ! মানুষ তো কোন সহানুভূতিও দেখায়।

অগত্যা আমাদের ফোন করে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে, শেষে চাবী ওলা ডেকে ঘর খোলাতে হল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘর খুলে গেল অনেক টাকা, এই ছোট্ট ভুলের মাশুল, দিয়ে। সামনেই দেখলাম হুকে ঝুলছে , মূর্তিমান শত্রুর মত অভদ্র চাবীটা।এত খারাপ লাগল যে, কি বলব। একটা ছোট ভুলের জন্য কি হয়রানি আর এক গাদা টাকার শ্রাদ্ধ।এখানে এইসব কাজের জন্য এত বেশি টাকা চার্জ করে, আমরা ভারতে সেটা ভাবতেও পারব না।মিথ্যে মিথ্যে শুকনো এত টাকা খরচ হয়ে গেল মেয়েটার।অথচ, ওরা একটু সাহায্য করলেই এটা লাগত না।

পরে দেখি, আমাদের ঘরের পিছন দিকে একটা দরজা রয়েছে, যেটা দিয়ে ওদের বাড়ি থেকে আমাদের ঘরে ঢোকা যায়। এটা দেখে ওদের ওপর মেজাজটা আরও খিঁচড়ে গেল।

কয়েকদিন পর রাতে খাবার টেবিলে আমরা একটু মজা করে হাসাহাসি করছি উপর থেকে আবার হুংকার এল , আমার মেয়ে ঘুমাচ্ছে। রাত অনেক। তোমরা চুপ কর, আমার মেয়ের অসুবিধা হচ্ছে। টেক্সট করেছে সেই, ইয়ুনের বউ। 

মেয়ে বলল, আমরা এমন কিছু জোরেও হাসি নি বা চিৎকার করি নি যে নীচের তলা থেকে আওয়াজ গিয়ে তোমাদের অসুবিধা করতে পারে। এর তাছাড়া রাতও এমন কিছু হয় নি ।

উত্তর এল, তোমরা যদি না শোনো, আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।

আমি বললাম, কি জানি এখানে পুলিশ আবার এসব ব্যাপারে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে। ঝামেলায় দরকার নেই। বিদেশ বিভুঁই জায়গা। ছাড় ঝামেলা।

মেয়ে বলল, ছাড়ব কেন, দেখাই যাক না কি করে । 

আমি  আর ওর মা বাধা দিই। বাদ দাও, পড়তে এসেছ, পড়ে কটা দিন চুপ চাপ কাটিয়ে দাও। তুমি তো আর এদের নিয়ে ঘর করতে যাচ্ছ না। থাকতেও যাচ্ছ না।

মাঝে মাঝেই এরকম হুংকার আসে ইয়ুনের বৌ এর কাছ থেকে। ইয়ুন কিন্তু চুপ। ওর সাথে চোখাচোখি হলে ও হাসে, হাত নাড়ে।চলছে এরকমই। 

আমরা আশ্চর্য হই। কি ব্যাপার। যারা এরকম ব্যবহার করে, তারা কি আমাদের কাছে ভাল ব্যবহার আশা করে? ইয়ুনের বৌ এরকম মেজাজ দেখায়, আর ইয়ুন দেখা হলে হাসে। পাগল না কি এরা!

একদিন রাতে শুনি  ইয়ুন আর  ইয়ুনের বৌ , দুজনের মধ্যে লেগেছে ঝগড়া। ওরে বাবা, কোরিয়ান ঝগড়া  যে এরকম জানা ছিল না। সে তো হাতাহাতি একেবারে। এর মধ্যে মেয়ে সেই দেখে জুড়েছে  কান্না। সঙ্গে চলছে জিনিসপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি। সব মিলিয়ে একেবারে জগঝম্প ব্যাপার। 

পরদিন সকালে দেখি আকাশ নির্মল। কে বলবে কাল রাতে অত ঝগড়া হয়েছে দুজনের। সকালে দুজনেই গাড়ি করে বেড়াতে গেল।

ঠাকুর নাম করি, আর ক’টা দিন কেটে গেলে হয় । মেয়ের পড়া শেষ হয়ে এল বলে।  

একদিন দেখি অল্প বৃষ্টি হতেই কোথা দিয়ে কি জানি, আমাদের ঘরের ভিতর ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে লাগল। 

জানানো হল কমপ্লেন। ইয়ুন সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এল , জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কি ব্যাপার। ঠিক এই সময় উপর থেকে ইয়ুনকে হাঁক মারল বৌ। দৌড়ল সে পড়িমরি করে , যেতে যেতে  বলল , আসছি। 

আর দেখা নেই। কি আর করি ! আসছি, বলে, গেল তো গেলই। আর আদৌ দেখাই পাওয়া গেল না। 

একসময় স্বাভাবিক ভাবেই, জল পড়া থেমে গেল।

আমাদের যাবার দিন উপস্থিত। গোছগাছ করছি। মেয়ের পড়াও শেষ। আমরা ফিরব দেশে। মেয়ে চলে যাবে তার কাজের জায়গায়, ক্যালিফোর্ণিয়ায়। 

সকালবেলা ইয়ুন কাঁচু মাঁচু মুখে এসে হাজির একাই। 

একথা সেকথার পর বলছে, আপনারা চলে যাচ্ছেন। শুভেচ্ছা জানাই। একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না। আমার বৌ আপনাদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, এজন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত। আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে , একবছর সমানে আপনারা কোন প্রতিবাদ না করে আমার বাড়িতে ছিলেন ।

আমরা আশ্চর্য হয়ে বললাম, কেন?

ও বলছে, আমার বৌয়ের এই ব্যবহারের জন্য এ বাড়িতে ভাড়াটে কেউ থাকতে চায় না। বৌ বোঝে না যে ,  কেউ ভাড়াটে না থাকলে আমার পক্ষে টাকাপয়সার ব্যাপারে ম্যানেজ করা মুস্কিল। আমি একটা জায়গায়  অল্প পয়সায় কাজ করি। সেটা এখান থেকে কাছে।দূরে অন্য বাড়ি নেওয়া আমার পক্ষে মুস্কিল। ভাড়া আমাকে পেতেই হবে। কিন্তু আপনারা যে অন্ততঃ এক বছর ছিলেন, তাতে আমার টাকা পয়সার দিকে যেমন সুবিধা হয়েছে, আর একটা ব্যাপারেও সুবিধা হয়েছে।

বললাম, সেটা কি?

একটু ইতস্ততঃ করে বলল, বৌ ঝগড়া করতে না পেলে বা কারোর পিছনে না লাগলে সেটা আমার উপর এসে পড়ত। এটা ওর একটা মানসিক অসুখ। আমি এই এক বছর মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিলাম। ও ঝালটা  আপনাদের উপর ঝেড়ে আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিয়েছে।

বললাম, তুমি কিছু বলতে পার না?

বলল, আমি কিছু বললে আমাকেই খেতে না দিয়ে বের করে দেবে। মাঝে মাঝে আমাকেই এমন বলে আমি সহ্য করতে পারি না।

তুমি তো এটা আমাদের আগে বললে পারতে।

পারতাম, ভয় ছিল, শুনে যদি, আপনারা চলে যান। 

বললাম, তুমি এসেছ, বৌ জানে?

বলল, ও মেয়ের স্কুলে গেছে।এই ফাঁকে এসেছি।

আমরা হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না।

বললাম, তুমি আবার ভাড়াটে পেয়ে যাবে। তোমার আর কি অসুবিধা? আমরা গেলেই কেউ এসে যাবে।

ও বলল, আপনারা জানেন না,  এখানে সবাই জানে ওর স্বভাব। কেউ চট করে আসতে চায় না।এলেও কেউ টেকে না ।আমাকে আবার সেই কষ্ট করতে হবে যতদিন না আপনাদের মত কাউকে পাই।

ও বেরিয়ে যেতেই আমরা নিজেদের মধ্যে হাসতে লাগলাম, পৃথিবীতে কত কিছুই দেখার বাকী আছে। বিচিত্র এই দুনিয়া । 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment