1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

ভালোবাসার বৃত্ত

ছবি : ইন্টারনেট

ভালোবাসার বৃত্ত

সাবিতা রায় বিশ্বাস

(১)

‘প্রতীতি তাঁত সেন্টারের’ একটা শাড়ির প্যাকেট নিয়ে সৌরিক বাড়ি ঢুকতেই সুদীপা চিলের মতো ছোঁ মেরে প্যাকেটটা নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। সুদীপা, কি হচ্ছে কি? দাঁড়াও, প্যাকেটটা খুলোনা। যতক্ষণে সৌরিক জুতো খুলে ঘরে ঢুকল ততক্ষণে শুধু প্যাকেট নয়, শাড়িটাও খোলা হয়ে গেছে সুদীপার, শুধু তাই নয় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা বুকের পরে ফেলে দেখছে নিজেকে। সৌরিক সুদীপার হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে বিরক্তভাবে বলল, বারণ করলাম, তবু প্যাকেট খুললে? একটুও ধৈর্য নেই তোমার, প্যাকেটটা ছিঁড়েও ফেলেছ? মা কি ভাববে বলতো?

 সুদীপা খুব অবাক হয়ে বলল। এর মধ্যে মা আসছে কোথা থেকে? আমার জন্যই তো এনেছ, যাই বলো তোমার পছন্দ কিন্তু দারুণ! এইরকম লাল ঢাকাই জামদানির খুব শখ ছিল আমার। বিয়েতে লাল শাড়ি পেয়েছিলাম, কিন্তু এই জামদানিটা দুর্দান্ত। হাত থেকে নিয়ে নিলে কেন? দাও, মাকে দেখিয়ে আসি।

এই লাল জামদানিটা আমি মায়ের জন্যই এনেছি।

মানে? তোমার কি মাথা খারাপ? মা এই শাড়ি পরবে?

পরবে, আমি মাকে পরিয়ে দেবো। আজ মায়ের জন্মদিন। একটা প্লেট নিয়ে এসো, মায়ের পছন্দের মিষ্টি এনেছি।

সৌরিকের মা মণি ছেলের গলা পেয়ে চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই লঙ্কা ফোড়ন দেবার মত ঝাঁঝিয়ে উঠল সুদীপা, ও আড়ি পেতে শোনা হচ্ছিল সব, শাড়ি বেহাত হবার ভয়ে চায়ের বাহানা করে চলে এসেছেন! লজ্জা করেনা আপনার! যখন তখন ছেলে বৌয়ের ঘরে ঢুকে পড়তে?

এসব কি বলছ বৌমা? শাড়ি? কিসের শাড়ি? আমি বুঝতে পারলাম না | আমি এলাম খোকাকে চা দিতে | তুমিই তো বলেছ, আপনার ছেলে সারাদিন খেটে খুটে আসে, আসার সঙ্গে সঙ্গেই ওকে চা দেবেন।

সেই তো! আমি না বললে আপনি আবার কিছুই বোঝেন না!

বেশ আমি চলে যাচ্ছি, খোকা এই নে চা।

 দাঁড়াও মা, যেও না।

না রে খোকা, যাই। গ্যাস কমিয়ে আসতে ভুলে গেছি, তরকারি ধরে যাবে। তুই চা খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে নে। তোর বাবার জন্য চিঁড়ের পোলাও করেছিলাম সকালে, এক বাটি তুলে রেখেছি। রান্নাঘরে এসে নিয়ে যাস বাবা |

শ্বাশুড়ি বেরিয়ে যেতে মুখ বেঁকিয়ে টিপ্পনী কাটল সুদীপা, আদিখ্যেতা! বুড়ো বয়সে প্রেম উথলে উঠছে। খোকা তোর বাবা চুনো মাছের ঝাল খেতে ভালবাসে, নলেন গুড়ের পায়েস খেতে ভালোবাসে, মা বলছে অমনি ছেলে এনে হাজির করছে। আমি বেশ জানি সব তোমার মায়ের চালাকি। বুড়ি নিজে রসিয়ে রসিয়ে খেতে ভালোবাসে, বুড়োর নামে চালায়। সেদিনই তো দেখলাম চুনো মাছের ঝালের বাটি একেবারে সাপটে সাফ করেছে। আমি ভেবেছিলাম বিকেলে একমুঠো ভাত দিয়ে খাবো, তা বুড়ির যা নোলা! আমার কপালে আর জুটলো না।

সৌরিক আর সহ্য করতে না পেরে চীৎকার করে উঠল, থামো দীপা। আর কত মিথ্যে কথা বলবে? আমি সব জানি।

ঝাঁঝিয়ে উঠল দীপা, কি জানো তুমি? তুমি কি বাড়ি থাকো?

জানার জন্য বাড়ি থাকতে হবে এটা তোমায় কে বলেছে? আমাকে কি খুব বোকা মনে হয় তোমার?

তাহলে কি বলতে চাইছ? আমি মিথ্যেবাদী?

আমি কিছুই বলতে চাইছি না, শুধু এটুকু বলছি তুমি যেদিনের কথা বলছ সেদিন ছিল রবিবার। আর রবিবার আমি বাড়ি থাকি।

মিথ্যে ধরা পড়ে যাওয়ায় মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করলো সুদীপা, চীত্কার করে কাঁদতে বসল।

সুদীপার কান্না শুনে সৌরিকের মা ছুটে এল। বাবার আসবার ক্ষমতা নেই, বিছানায় শুয়ে শুয়েই বলতে লাগলো, কি হল? বৌমা কাঁদছে কেন?

সুদীপার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো সৌরিকের মা, এখন এই অবস্থায় এমন করতে নেই, ক্ষতি হয়ে যাবে, শান্ত হও মা।

ফুঁসে উঠল সুদীপা, আপনারা তো তাই চান, আমার সন্তান জন্মালে আপনাদের ভাগ কমে যাবে যে!

বৌমা! এসব কি বলছ তুমি? এসব বোলোনা। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মণি |

ঢাকাই জামদানি আর দেওয়া হল না মাকে । সৌরিক জানে মায়ের খুব শখ ছিল টুকটুকে লাল ঢাকাই জামদানির | চটকলে কাজ করা বাবার সে ক্ষমতা ছিলনা | তারপর তো অ্যাক্সিডেন্টে পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন সাত সাতটা বছর!

মায়ের শখ মেটাতে পারল না সৌরিক | এর আগেও যতবার ভেবেছে, হয়ে ওঠেনি | এখন কোনোরকম উত্তেজনা ভালো নয়, ডাক্তারের কথা মেনে বৌয়ের মন ভালো রাখতে লাল জামদানি পরা সুদীপাকে নিয়ে পরেরদিন মাসি শ্বাশুড়ির বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যেতে হল সৌরিককে।

কিন্তু এভাবে কত দিন? একবছর নয়, এগারো মাসেই হাঁফিয়ে উঠেছে সৌরিক। ছোট থেকেই শান্ত পরোপকারী ছেলে, কখনো কারো মনে কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেনা। বাবা, মা তো দূরের কথা, পাড়া প্রতিবেশী এমনকি ভুলো কুকুরটাকেও কোনদিন তেড়ে বলেনি, পালা এখান থেকে। এখন মাঝে মাঝেই সেই ছেলের গলা শোনা যায়। পাঁচিলের ওপাশেই রীনা কাকিমাদের বাড়ি, তাই তিনি সবটা জানেন। অন্যরা সুদীপার কান্না শুনে চাপা গলায় ফিসফিস করে, দেখেছো মা ব্যাটা মিলে বউটাকে কেমন অত্যাচার করছে! আহা গো! কি লক্ষ্মীমন্ত বউ, তার কপালে এত কষ্ট! তাদের আর দোষ কি! পারুলের মা কাজে এলেই বউ লাগানি ভাঙানি করে শ্বাশুড়ির নামে। ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে।

(২)


দিদি আপনার নাতনি হয়েছে। এক্কেবারে সুদীপার মতো, মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল, তবে চোখ দুটো আমাদের জামাইয়ের মতো মায়াভরা।

এই কথাগুলো বলার জন্য সুদীপার মাসি সৌরিকের মাকে ফোন করেছিলেন, কিন্তু ফোন বেজে গেল, কেউ ধরলো না |

এটা কেমন হল? ওরা কি আগেই জেনে গেছে সুদীপার মেয়ে হয়েছে | কিন্তু জামাইয়ের মা তো এমন লোক নন, ঘর আলো করে লক্ষ্মী আসুক তাই-ই চেয়েছিলেন তিনি।

মাসির কাছে সেকথা শুনে নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে সুদীপা বলল, দেখলে মাসি দেখলে? দেখলে ওদের কাণ্ড? শ্বশুর না হয় বিছানা থেকে নামতে পারেনা, মা ছেলে কেঊ এলোনা? আমি বললে বিশ্বাস করোনা এখন নিজেই সাক্ষী থাকলে। তবুও মাসির মন কিছুতেই সায় দিচ্ছেনা, হ্যাঁরে দীপা তোর শ্বশুরের কিছু হয়নি তো!

ছাড়ো ওদের কথা। কি আবার হবে? চার বেলা গাণ্ডে পিণ্ডে খাচ্ছে আর উঁহু, আহা করছে। সব নাটক, আমি বুঝি না কিছু!   

সুদীপা সত্যিই বোঝেনা কিছু, বোঝেনা নাকি বুঝতে চায়না। এসব নিয়ে ওকেও খুব দোষ দিয়ে লাভ নেই। জন্মের পরেই মাকে হারিয়েছে, বছর না ঘুরতেই সুদীপার বাবা আবার বিয়ে করেছিল। তাই ছোটবেলাটা সুখের হয়নি, যদিও সবাই বলে নতুন মা খারাপ ছিলনা, সুদীপাকে ভালবাসত খুব | কিন্তু সুদীপা ছোট্টবেলা থেকেই বড় জেদী, নতুন মাকে সহ্য করতে পারেনি | মাসি থাকত আন্দামানে, সেখানকার পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে রাঘবপুর আসতে আসতে কেটে গেছে পাঁচ বছর। সুদীপার কথায় জীবনের বিভীষিকাময় পাঁচ পাঁচটা বছর। সুদীপাকে অনেক বুঝিয়েছে মাসি কিন্তু কাজ হয়নি কিছুই। ছোটবেলায় মাকে হারানো, বাবার দ্বিতীয় বিয়ে ওকে হিংস্র, অমানবিক, মিথ্যেবাদী করে গড়ে তুলেছে।

আত্মজার মুখ দেখতে পরের দিন, তার পরেরদিন ও আসতে পারলো না সৌরিক। যেদিন এলো, সেদিন মেয়ের ষষ্ঠীপুজো। দরজার বাইরে থেকে ওঁ গঙ্গা লেখা নিমন্ত্রণ কার্ড দিয়ে চলে গেল।

এই জন্যেই দীপার মাসির সন্দেহ হয়েছিল | এখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হল | সুদীপার সিজার ডেলিভারি হবে সকাল ন’টায়। তাই রাত থাকতেই বিছানা ছেড়েছিলেন মণি, বাথরুমে আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখেন আলো জ্বলছে না। রাস্তার আলো তেরছাভাবে এসে পড়ছিল জানলা দিয়ে, তাতেই কোনোমতে হাতড়ে হাতড়ে কল খুলতে গিয়ে মাথায় জোর ধাক্কা। সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারানোর ফলে ডাকতেও পারেননি ছেলেকে। সৌরিক যখন মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় দেরী হয়ে গেছে অনেক। ডাক্তার বললেন, ‘ট্র্যোমাটিক ব্রেইন ইনজুরি’ | আঘাত লাগার পনেরো বা তিরিশ মিনিটের মধ্যে এলে কিছু করা যেত, ‘সরি’ |

সৌরিক মাকে নিয়ে ছোটাছুটি করছে তার মধ্যেই এল দ্বিতীয়বার সুনামির আঘাত | জোড়া আঘাতের অভিঘাত এতই তীব্র যা সৌরিক কখনো কল্পনাতেও আনতে পারেনি | রীনা কাকিমার ফোন পেয়ে বাড়িতে এসে দেখে বাবাও মায়ের পিছু পিছু সব কিছু ছেড়ে চলে গেছে নতুন দেশে, যেখানে বিউলি ডাল, আলু পোস্ত খেতে চাইলে কেউ বলবে না, বুড়োর লোভ বলিহারি | অমন লোভের গলায় দড়ি |

একদম একইভাবে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সৌরিক অনাথ হয়ে গেল | সুদীপার উপলব্ধির বাইরে এসব, সে চেষ্টাও করেনি সৌরিক | শ্বশুর শ্বাশুড়ি নেই, রাজ্যপাট সবই সুদীপার তবুও দিন দিন দূরত্ব বেড়ে চলেছে স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে |

নাঃ সুদীপার সঙ্গে একই ছাদের তলায় থাকা দিনকে দিন অসহ্য নয়, অসম্ভব হয়ে উঠছে | ট্রান্সফার অর্ডার বেরোতেই সৌরিক বাক্স গোছাতে বসল, সুদীপা সঙ্গে না গিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে গেল মাসির বাড়ি |

মাসির ছেলের বৌয়ের হাতে সংসার, সুদীপা দেখে আর অবাক হয় | মেসো, মাসি যা খেতে ভালোবাসে নিজে হাতে অনন্যা সব করে দেয় | সবসময় পারেনা, একটা স্কুলে পড়ায় অনন্যা | কিন্তু মাসি, মেসোকে দেখাশোনা করার জন্য যে থাকে তাকে বলে দেয় যেন ওদের কোনো অসুবিধা না হয় | এমনকি সুদীপার দিকেও সমান নজর, নতুন শাড়ি কিনে শ্বাশুড়িকে দেখায়, সুদীপাকে বলে, তুমি আগে পরো তারপর আমি পরবো | আর দীপার মেয়ে তিন্নি তো অনন্যার কাছ ছাড়া হয়না |

অনন্যাকে দেখে একটু একটু করে নিজের ভুল বুঝতে পারে সুদীপা | সত্যিই তো নতুন মা ওকে খুব ভালবাসত, কিন্তু যতবার ওকে আদর করতে গেছে, ততবার আঁচড়ে, কামড়ে দিয়েছে, বাবাকে মিথ্যে বলেছে | যেমন বলেছে সৌরিককে, শ্বশুর শ্বাশুড়িও তো খুব ভালবাসত ওকে, নিজের মেয়ের মতো | আর সৌরিক! অমন স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার | ওকে পড়াবে বলেছিল, বলেছিল নিজের পায়ে দাঁড়ালে হীনমন্যতা কেটে যাবে | বলেছিল আগে নিজেকে ভালোবাসো তবে তুমি সবাইকে ভালবাসতে পারবে | আর সুদীপা কি করেছে? প্রতিদানে শুধু অপমান করে গেছে | মাসি কত বুঝিয়েছে, কারো কথা শোনেনি | সবাইকে নিয়ে নয় একা একা সুখী থাকতে চেয়েছে |

অনন্যা খেয়াল করে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে সুদীপা | ভালবাসার আকুলতা ফুটে উঠছে চোখে, মুখে | অনন্যা সেতু বাঁধল | একদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতে সুদীপা দেখল সৌরিক এসেছে | দীপা দ্বিধা, লজ্জা, ভয় ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সৌরিকের বুকে | এমন একটা দিনের জন্যই অপেক্ষা করে ছিল সৌরিক, সমস্ত রাগ, দুঃখ, মান অভিমান ভুলে দীপাকে গ্রহণ করল | পূর্ণ হল ভালোবাসার বৃত্ত |

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment