![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
হিস্টরিকাল ব্লানডার
পল্লব পত্রকার
বিদিশা যে পাক্কা একটা শয়তানী সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই উপলের। কি কুক্ষণে যে ওকে বিয়ে করেছিল সে! জীবনটা একেবারে হেল হয়ে গেল! অনেক সহ্য করেছে উপল! আর না! যত শিগগির উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে ডিভোর্সের মামলা করবে।
খোরপোষের ঝামেলা! বুবুনকে নিয়ে টানাহেঁচড়া! সে সব যা হয় হোক! কিন্তু হেস্তনেস্ত একটা করতেই হবে! এভাবে বাঁচা যায় নাকি! এত অপমান! অশান্তি! মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা দাউ দাউ আগুন! এ তো বিসুভিয়াসকেও হার মানাবে!
বিয়ের আগের দিনগুলো অথচ কি ভালো কেটেছে! এক রাস্তায় অফিস যাতায়াতের সূত্রে আলাপ। দু জনেই সিঁথির মোড়ে বাস টার্মিনাস থেকে লাইন দিয়ে মিনিবাসে উঠত। এক জনের ডালহৌসিতে অফিস, আর এক জনের ধর্মতলায়। প্রথমে পরস্পরকে দেখে মুগ্ধতা। হাই হ্যালো। পরিচয় দেওয়া-নেওয়া। বাসের লাইনে জায়গা রাখা। ফোন নাম্বার আদান প্রদান। ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, মেসেজিং। তারপর ধীরে ধীরে চায়ের দোকান, কফিশপ, সিনেমা হল। অফিস কেটে ভিক্টোরিয়া, মিলেনিয়াম পার্ক। আলু কাবলি, ফুচকা, ঝালমুড়ি। হাতে হাত রেখে উপলের প্রস্তাব: আই ওয়ান্ট টু ওয়াক অল দ্য লাইফ উইথ ইউ। বিদিশার সলজ্জ সম্মতি: আই উড লাইক টু! তারপর ছুটি ছাটায় দু-তিন দিনের জন্যে দীঘা বা মন্দারমনি বা তাজপুর! উদ্দাম, উদ্বেল জীবন! পৃথিবী একদিকে, আর তারা দুই কপোত কপোতী আর একদিকে! আকাশটা তখন কি নীল! সমুদ্রের জল কি স্বচ্ছ! বেলাভূমি জুড়ে সোনার চাদর! ঝাউবনে গানের মূর্ছনা! উত্তাল ঢেউয়ের তালে তালে মিষ্টি রোদের ছন্দময় নাচ। কোন এক অচিনপুরে হারিয়ে যাওয়া দুটো মন...।
ছোটবেলা থেকেই বিদিশা রবীন্দ্র সংগীত চর্চা করে। গলাটাও ভালো, অস্বীকার করবে না উপল। তখন ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে শোনাতো: 'আমার পরান যাহা চায়…!' চরাচর ভেসে যাওয়া চাঁদের আলোয় ধরত: 'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…!' অমাবস্যার নিঃসীম অন্ধকারে গাইত: 'আকাশ ভরা সূর্য তারা…!' সমুদ্রের বুকে উদীয়মান সূর্যকে অভিবাদন জানাত: 'আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা…'
উপলের গলায় সুর আসে না। তবে আবৃত্তিটা একটু আধটু সে পারে। বিদিশার পীড়াপীড়িতে সেটাই করত। 'হাওয়া বয় শন শন তারারা কাঁপে/ হৃদয়ে কি জং ধরে পুরানো খাপে!...' ছদ্ম রাগে চোখ পাকিয়ে বিদিশা বলতো: 'হৃদয়ে কি জং ধরার এটাই সময়! অন্য কিছু করো! প্লিজ!' উপল তখন প্রেমেন্দ্র মিত্র ছেড়ে রবিঠাকুরে আশ্রয় নিত। 'আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি/ সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ…' অথবা 'আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরনীতে/ মুগ্ধ ললিত অশ্রু গলিত গীতে…' বিদিশা বক্ষলগ্ন হত উপলের। উপল তাকে জড়িয়ে ধরত নিবিড় আশ্লেষে। দুটো দেহ-মন খুঁজত একটু আব্রু। একান্ত নিজস্ব নির্জনতা।
আর এখন! এক ছাদের তলায় তারা নামেই আছে! সারাক্ষণ খিটিমিটি, চিৎকার-চেঁচামেচি! মাঝে মাঝে প্রায় হাতাহাতি, চুলোচুলির অবস্থা! তবে বুবুন সামনে এসে দাঁড়ালে চক্ষু লজ্জার খাতিরে থামতেই হয়! আগে সে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠত। এখন আর কাঁদে না। পিট পিট তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বোধহয় বলে, 'গো এহেড! চালিয়ে যাও ফাইট! আমি কিন্ডারগার্টেনের ছাত্র হতে পারি! কিন্তু রেফারি হিসেবে খারাপ না!'
সত্যিই ওর হাতে থাকে একটা বাঁশি! ফুরর ফুরর করে সেটা মাঝে মাঝে বাজায়। পাড়ার মেলায় উপলই কিনে দিয়েছিল।
বাঁশিটার যে এরকম ব্যবহার হবে কে আর জানত!
এই পাকামোটা নিশ্চয়ই ওর মা শিখিয়েছে! পাঁচ বছরের বাচ্চার মাথায় না হলে এই দূর্বুদ্ধি আসে কি করে! সাধে কি আর বিদিশাকে শয়তানী বলে উপল!
অথচ বিদিশার জন্যে কি না করেছে সে! মেধাবী ছাত্র হিসাবে মাস্টার ডিগ্রী করতে করতেই কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরি পেয়ে যায়। ক্লারিক্যাল পোস্ট হলেও প্রমোশনের যথেষ্ট সুযোগ। পড়াশোনা কমপ্লিট না করে হরিসভার কাছে একটা মেশ বাড়িতে থেকে কর্ম জীবন শুরু। তখনই তার পরিচয় বিদিশার সঙ্গে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে ছোটো একটা অনুষ্ঠান করে রেজিস্ট্রি বিয়ে। শহরে ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পনা আদৌ ছিল না উপলের। দেশের বাড়ি এমন কিছু দূরে নয়। হুগলিতে। সেখানেই সুন্দর করে বাড়ি বানাবে ঠিক করেছিল। কিন্তু বিদিশার উৎসাহে অফিস থেকে লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে হল।
উপলের দাদা স্থানীয় একটা কারখানায় সামান্য চাকরি করেন। বিয়ে থা করেননি। গ্রামে কিছু জমি জায়গা আছে। বাবা এখনও সক্ষম, সেসব দেখাশোনা করেন। কায়ক্লেশে সংসার চলে যায়। উপল প্রতিমাসে আগে বাড়ি যেত। মা-বাবার হাতে কিছু টাকা দিয়ে আসত। ধীরে ধীরে যাতায়াত কমতে থাকে। এখন বৎসরে একদিন কি দুদিন যেতে পারে। আর টাকা দেওয়ার অঙ্ক প্রায় শূন্য। একটা দায়িত্ব অবশ্য নিয়েছে। পাড়ার ওষুধের দোকানে কথা বলে রেখেছে। বাবা মার যখন যা ওষুধ লাগবে তাঁরা যেন তা দিয়ে দেন। উপল অন লাইনে পেমেন্ট করে দেবে। এইটুকু পেয়েই তাঁদের যে কি আনন্দ! পাড়ার লোকের কাছে ছেলের গুণকীর্তন করে করে আর হয় না!
বিদিশার বাবা একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতেন। এখন অবসর নিয়েছেন। সেখানেই বিদিশা আর তার ভাই চাকরি করে। সেই জন্যেই বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে উপল বলে, 'আমি তো আর বাপ কাকাকে ধরে চাকরি পাইনি! নিজের যোগ্যতায় পেয়েছি!'
-- হ্যাঁ! তাই মাথা কিনে নিয়েছ!
-- কারোর মাথা কেনা বা কারো কাছে মাথা বিককিরি -- কোনওটাতেই আমার আগ্রহ নেই!
-- চাকরিটাই যা কোনও রকমে পেয়েছিলে! আর কিছু করার তো মুরোদ নেই! ….
অফিসে প্রমোশন পেয়ে উপল এখন সিনিয়র ক্লার্ক। মধ্যবিত্ত জীবন নির্বাহের পক্ষে ভালোই তার আয়। বিদিশারও মাইনেপত্র খারাপ না।
তবু উপল চায় খরচ খরচার ব্যাপারে সব সময় বুঝে চলতে। নিজেদের চাহিদাগুলো যাতে ন্যূনতম হয়, সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে না! বুড়ো বয়সে যাতে কষ্ট না হয়, যথেষ্ট সঞ্চয় থাকে, তার চেষ্টা করবে না!
অথচ বিদিশা এই ব্যাপারে ঠিক তার উল্টো মেরুর!
বুবুনকে যখন কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করার কথা হল তখনই উপল বলেছিল, 'পাড়ার স্কুলটা তো খারাপ না! ওখানেই ভর্তি করা হোক!' রে রে করে উঠেছিল বিদিশা। 'তুমি ভাবলে কি করে আমার ছেলে পাড়ার এঁদো একটা স্কুলে পড়বে!'
-- কি মুশকিল! পাড়ার স্কুল হলেই এঁদো! আমিও তো গ্রামের …
-- একদম ভাট বকবে না! আমার ছেলের ব্যাপারে আমি যা ডিসিশন নেব, সেটাই শেষ কথা!
বুবুন যেন বিদিশার একারই প্রোডাক্ট! উপলের কোনও কন্ট্রিবিউশন নেই! তবু বউয়ের দাবিই শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হয়েছিল। একগাদা টাকা খরচ করে সেন্ট মার্কা একটা স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করতে হয়েছে। কিন্তু হাতী কিনলেই তো হয়না! তার খোরাকিটাও যোগানো চাই! হাজার রকম চার্জ, ডোনেশন, পুলকার ভাড়া, প্রাইভেট মিস্ট্রেসের মাইনে! সব মিলিয়ে একেবারে হিমশিম অবস্থা! এসব প্রসঙ্গ তুললেই বিদিশার রণচণ্ডী হুংকার: 'একটাই তো ছেলে! তার জন্যে এটুকু করতে পারবে না! বাবা হয়েছিলে কেন! হাড় কঞ্জুষ কোথাকার!'
উপল নিশ্চিত, এই একই কথা ছেলেও বলবে কদিন পর। যেভাবে তার চাহিদা বাড়ছে! যেভাবে বিদিশা তাকে লোভী করে তুলছে! যখন যা দাবি করে, যুগিয়ে যাচ্ছে বিনা আপত্তিতে। বাচ্চাদের জন্যে যে 'না' শব্দটাও জরুরি, খেয়াল রাখছে না কখনও!
পুরনো ফ্ল্যাটটা জলের দরে বেচে নতুন ফ্ল্যাট কেনাটাও কি খুব বিবেচনার কাজ হয়েছে! পই পই করে উপল বলেছিল, 'ভুল সিদ্ধান্ত হচ্ছে! অফিসে হাউস বিল্ডিং লোন সবেমাত্র শোধ হল! আবার ব্যাংক থেকে নতুন করে লোন নিলে মাসে মাসে ধার শোধ করতেই জীবন শেষ হয়ে যাবে!...'
কিন্তু কার কথা কে শোনে! 'জীবন তো আমাদের একটাই! একটু ভোগ করে নেব না! দু কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটেই চিরকাল থেকে যাব!'
শুধু ফ্ল্যাট বদলানো নয়, আগেকার সমস্ত আসবাবও বাতিল করে দিল। সেসব নাকি নতুন ফ্ল্যাটে মানায় না! পুরানো খাট, সোফা, টিভি, ফ্রিজ, ডাইনিং টেবিলের জায়গায় নতুন সবকিছু এলো। আলমারির জায়গায় কাবার্ড, ওয়াল ক্যাবিনেট।
কাণ্ডজ্ঞানহীন এরকম মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা আদৌ কি উচিত! কোনও বিবেচক মানুষ কি এটা মেনে নেবে! আত্মমর্যাদা আছে যার, সে কি পারবে এরকম লোকের সঙ্গে ঘর করতে!
বিয়ের আগে থেকেই উপল জানত, ওয়ার্কিং লেডি হিসেবে বিদিশা একা কিছুতেই সংসার সামলাতে পারবে না। বাজার হাট ইত্যাদি তো আছেই, বাড়ির খুঁটিনাটি কাজেও তাকে হাত লাগাতে হবে। সংসার পাতার দিন থেকেই উপল এসব করে। ঠিকে ঝি গোড়া থেকেই ছিল। বিদিশার পেটে বুবুন আসার পর রান্নার লোক রাখা হয়। তবু মাঝে মাঝে টুকটাক রান্না বান্না, বাসন মাজা, কাচাকাচি, ঘর পরিষ্কার দু'জনকেই করতে হয়। অদ্ভুত ব্যাপার উপলের কাজ নিয়ে বিদিশা টিকটিক করবেই! 'এটা কি বাসন মাজা হয়েছে! তেল চটচট করছে!' 'নিজের জামা প্যান্টটুকুও কাচতে শেখোনি! যা নোংরা ছিল, তাই রয়ে গেছে!' 'এতদিন ধরে চা করতে শিখলে না! এত দামি চা! তাও মুখে দেওয়া যাচ্ছে না!' 'ডিম সেদ্ধ যে ছ-সাত মিনিটের বেশি করা উচিত নয়, সেটাও কি তোমার জানা নেই! এইরকম ইটের মতো শক্ত ডিম কেউ খায়!' 'ওমলেট কি এতো পোড়ায়! ভেতরটা একটু নরম না থাকলে খাওয়া যায়!' 'বাথরুমটা পরিষ্কার করেছ বলে মনেই হচ্ছে না! একটু চেপে চেপে ঘষতে পারো না!'
বাজার-হাট নিয়েও সমান টিক টিক! চারাপোনা, কাটা পোনা, চিংড়ি ছাড়া কি মাছ দেখতে পাও না? পারসে, পাবদা, ট্যাংরা, ভেটকির বোধহয় নাম শোনোনি?' 'শীতের সবে শুরু! এখনই তো ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালং শাক খেতে হয়! কবে আর কিনবে! শীত চলে গেলে যখন গরু ছাগল খাবে!'
হায় হায়! কথার কি ছিরি! ওপরওলা বলে কেউ যদি থাকেন তিনিই বিচার করবেন! উপলের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন!
জামা কাপড় কেনার ব্যাপারে উপলের যে রুচির বালাই নেই, সে ব্যাপারে একশ ভাগ নিশ্চিত বিদিশা। আগে না হয় উপল সাধারণ দোকান থেকে লোকাল কোম্পানির পোশাক আশাক কিনত! এখন তো সব ব্র্যান্ডেড কেনে! তবু বিদিশা বলে, 'সালোয়ারটার কি বাজে কোয়ালিটি! একটু দেখেশুনে নিতে পারো না! ডিজাইনের তো একটা ছিরিছাঁদ থাকে! আর তোমার এই টি শার্টটা! এই রকম গাঁইয়াদের মতো কালার! পরলে ঠিক তোমাকে জোকারের মতো লাগবে! নাদা একটা ভুঁড়ি বাগিয়েছ! একটু ব্যায়াম ট্যায়াম করা বা জিমে যাওয়া -- সেসব তো কিস্যু নেই! কি আর বলব!...'
বিরক্ত হয়ে বিদিশার জন্যে পোশাক-আশাক কেনা ছেড়ে দিয়েছে উপল। জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীতে কোনও গিফটের বদলে টাকা পয়সা দিয়ে দেয়। কিছু কিনে নিতে বলে। আগে এই সব বিশেষ দিন কিছুতেই মনে রাখতে পারত না। তাই নিয়ে একেবারে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যেত। 'লজ্জা করে না তোমার! ছি ছি ছি! বউয়ের জন্মদিন মনে রাখতে পারো না! কবে বিয়ে করেছিলে সেটাও ভুলে গেছ! তোমার উচিত ছিল অজ গাঁয়ের একটা অশিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করা!'
উপল চুপ করে থাকতে না পেরে বলে, 'একা একা তো বিয়ে করা যায় না! তুমিই বা রাজি হয়েছিলে কেন?'
ব্যস! শুরু হয়ে যায় বাক্যবান ছোঁড়া! প্রায় হাতাহাতির অবস্থা! আবার রেফারি এসে যায়! আবার ফুরর ফুরর!
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে দুজনের ভিন্ন রুচি। উপল ভাজাভুজি পছন্দ করে। বিদিশা একেবারেই না। ভাজা খেলে নাকি ফ্যাট বেড়ে যায়! উপল ফল খেতে খুব ভালোবাসে। বিদিশা মিষ্টি। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার যাই হোক না কেন, শেষ পাতে তার মিষ্টি চাই-ই চাই!
-- মিষ্টিতে কি ফ্যাট নেই? প্রশ্ন তোলে উপল।
-- ছোটবেলা থেকে এটা আমার অভ্যাস!
-- আমারও ছোটবেলা থেকে একটু আলুভাজা, পটলভাজা, বেগুনভাজা ভালো লাগে! এসব আমি খেতে পারব না!
-- ছি ছি ছি! কদিন আগেই প্রেসার চেক করালে! কোলেস্টেরল টেস্ট হলো! সব হাই!
-- তুমিও তো দিনে দিনে তুলোর বস্তা হয়ে যাচ্ছ! এটা কি ভালো?
-- আমার ভালো-মন্দ তোমায় দেখতে হবে না!
-- আমারও না!
-- যত ইচ্ছা ভাজাভুজি গেলো! কিচ্ছু বলব না!...
যথারীতি দক্ষযজ্ঞ। গলা ছেড়ে দু জনের চিল চিৎকার এবং কোমরে হাত দিয়ে বুবুনের আবির্ভাব। ফুরর ফুরর। তখনকার মতো যুদ্ধ-বিরতি।
বন্ধু বন্ধুনীদের বাড়িতে ডেকে ঘন ঘন পার্টি দেবার কি আছে উপল বুঝতে পারে না। গান্ডে-পিন্ডে তাদের গিলিয়ে কি হবে! এই নিয়ে কিছু বললেই ঝাঁঝালো উত্তর: 'তোমার কেউ কোত্থাও নেই বলে আমারও থাকবে না! তুমি আনসোশ্যাল, কুঁচুটে বলে আমাকেও তাই হতে হবে!'
-- বন্ধু থাকুক না! তাই বলে বাড়িতে এনে, এইভাবে ...
-- বেশ করব! পাঁচশ বার বাড়িতে আনব! বাড়িটা তোমার একার নয়!…
দামী দামী জায়গায় গিয়ে এত খাবার কি দরকার, উপল সেটাও ভেবে পায় না! ছুটি ছাটার দিন হলেই হল। কোথাও একটু ঘুরে টুরেই চলো রেস্টুরেন্ট। কি দাম জিনিসের! ওই পয়সা খরচ করলে বাড়িতে কত তৃপ্তি করে খাওয়া যায়! হ্যাঁ, রাঁধুনি ঠিকঠাক পারে না! বিদিশা নিজে একটু হাত লাগালেই হল। রান্নার হাত তো ওর খারাপ না! কতদিন এই ব্যাপারটা নিয়ে বলেছে উপল। কোনও কথাই গ্রাহ্য করেনি বিদিশা।
তারপর শপিং! ঘরে কোনও কিছুর অভাব নেই! তবু শপিং মল দেখলেই ঢুকতে হবে! আর গাদা গাদা জিনিস কিনতে হবে! 'অমুকের সঙ্গে তমুকটা ফ্রিতে দিচ্ছে! কিনব না! সেটায় এতো পার্সেন্ট অফ করছে! নেব না? এখন হয়ত লাগবে না! কদিন পরেই কাজে লেগে যাবে!'
যখন যা দরকার প্রয়োজন মতো জিনিস কিনলেই হল! সহজ ব্যাপারটা যদি একটু বুঝত বিদিশা! তাহলে তো আর চূড়ান্ত একটা সিদ্ধান্ত নিতে হতো না উপলকে!
গরমকালে কার না গরম হয়! তবু তো এটা গ্রাম নয়, কলকাতা। সারাক্ষণ কারেন্ট থাকে। মাথার ওপর বন বন পাখা ঘোরে! নতুন ফ্ল্যাটে ঢুকেই সাত তাড়াতাড়ি দু দুটো এ সির অর্ডার দিয়ে দিল! দু দিন ছাড়া ইলেকট্রিক চার্জ বেড়ে যাচ্ছে! তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গালে চড় মেরে চরচরিয়ে মিটারও! উপলকেই তো সব মেটাতে হচ্ছে!
এই মহিলাকে নিয়ে জীবন কাটানো! কিছুতেই না! হ্যাঁ উপল ডিটারমাইন্ড! একশ ভাগ নিশ্চিত!
ছোটবেলা থেকেই উপলের সর্দির ধাত। মাঝে মাঝে হাঁপানির টানও ওঠে। পাহাড়ে বেড়ানোটা তার কাছে একটা বিড়ম্বনা। উত্তাল সমুদ্র, ধূ ধূ সৈকত রেখা, নিবিড় সবুজ বন বা পুরানো স্থাপত্যকীর্তি তাকে টানে। কিন্তু বিদিশার পাহাড় পছন্দ। বিয়ের আগেই যা সে কয়েকবার সমুদ্রের ধারে গেছে। তারপর বেড়াবার প্রসঙ্গ উঠলেই পাহাড় পাহাড় করে হেদিয়ে মরে। নতুন বউয়ের মন রাখতে প্রথম কয়েক বছর উপল দার্জিলিং, কালিম্পং, সিমলা, কুলু, মানালি -- এইসব জায়গায় গেছে। কষ্ট করেই গেছে। কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণ করতে একবারও সমুদ্র যায়নি বিদিশা। দীঘা পুরির নাম করলে তো তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে! এমনকি গোপালপুর বা গোয়ার কথা বললেও ঘাড়-মাথা নাড়তে থাকে। যতই ভালো হোটেলে থাকার প্রস্তাব দাও! দামী গাড়ি বুক করো! তবু ভবি ভোলবার নয়।
-- তোমার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া! লজ্জা করেনা, কালিম্পং-এ কি বাজে হোটেল বুক করেছিলে!'
-- দার্জিলিঙ-এর টা তো ভালো ছিল!
-- ছাতার মাথা ছিল! টয়লেট থেকে আরশোলা বেরোচ্ছিল! একটু থেমে বলে, 'কুলু মানালিতে সস্তার গাড়ি নিয়ে কি কেলো করেছিলে মনে আছে?'
-- বলছি তো! আর ও রকম হবে না!
-- ন্যাড়া বেলতলাতে বার বার যায় না; বুঝেছ!
অতএব ইদানিং বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা! যে যার মতো চলা! তুমভি মিলিটারি! হামভি মিলিটারি! কটা শাঁকচুন্নির সঙ্গে বিদিশা মাঝেমধ্যে ট্রেক করতে যায়। সান্দাকফু, সিকিম, হিমাচল। আর উপল তার অফিসের কয়েকজন পুরুষ কলিগ জুটিয়ে ছুটিছাটায় দীঘা বা মন্দারমনি ঘুরে আসে। খাওয়া দাওয়া খানাপিনা করে নিজের মতো মজা করে!
শুধু বুবুনের যা কোথাও যাওয়া হয়না। কাছেই দাদু দিদার বাড়িতে ছোটবেলা থেকে তার মাঝে মাঝে থাকার অভ্যেস। মা অ্যাডভেঞ্চার করতে গেলে কদিন সেখানে সে কাটিয়ে আসে। বাবা গেলে অবশ্য মার কাছেই থাকে।
এরকম দাম্পত্য টিকিয়ে রাখার আদৌ কি কোনো যুক্তি আছে!
কতদিন ঝগড়ার শেষে বিদিশা পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দিয়েছে, 'তোমার মতো গাঁইয়া ভূতের সঙ্গে কিছুতেই আর থাকা যাবে না!' উপলও বলেছে, 'তোমার মতো একটা স্বার্থপর, নীচ মেয়েছেলের সঙ্গে সংসার করতে আমার বয়ে গেছে!'
-- কি বললে! আমি স্বার্থপর! নীচ!
-- শুধু তাই নয়! তোমার চরিত্রেরও ঠিক নেই!
-- তাই বুঝি! তোমার চরিত্র ঠিক আছে? কাজের মাসি এলেই দাঁত বার করে কথা বলো! তার বাড়ির খবর নাও! লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে টাকা- পয়সা দাও! এসব কিছু জানিনা ভেবেছ!
-- ওর মেয়ে নতুন ক্লাসে ভর্তি হতে পারছিল না! বই কিনতে পারেনি! নিজেদের কষ্ট শোনাচ্ছিল! তাছাড়া গরিব মানুষকে সাহায্য করা কি অন্যায়?
-- অন্যায় হতে যাবে কেন! আমার হাতে টাকাটা তো দিতে পারতে! আমি দিয়ে দিতাম!
-- তোমার মনে পাপ, তাই কুচিন্তা করো!
-- আহা রে! কি সুচিন্তক! বুবুনের মিস এলে সারাক্ষণ ছোঁক ছোঁক করো! গলায় মধু ঢেলে, গায়ে পড়ে কথা বলো! গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে কি করবে ভেবেছ, মৌ? বি এডটা তো করে নিতে পারো! এসএসসিতে ভালই রেক্রুট হচ্ছে। টিচার্সশিপ মেয়েদের পক্ষে খুব ভালো প্রফেশন। আরে বাপু তোমার কাছে কি মৌ জানতে চেয়েছে! গায়ে পড়ে এত জ্ঞানদানের কি আছে! টলটলে, কচি মুখ দেখেই একেবারে গলে পড়তে হবে!
-- মুখ সামলে কথা বলবে! লজ্জা করে না তোমার! অফিসের বসের সঙ্গে যেখানে খুশি যাও!
-- কোথায় যাই?
-- এই তো সেদিন বললে, অঞ্জনদা প্রচুর টাকা খরচ করল! আর্সালানে ট্যাক্সি করে নিয়ে গেল! কি ভালো খাওয়ালো!
-- একা আমি গেছি নাকি! অফিসের আরো সাতজন ছিল। অদ্রিজা, তানিয়া, সঙ্গীতা, অন্বেষা, রূপম …
-- একা গিয়েছিলে কি দোকা গিয়েছিল আমি আর জানব কী করে! তাছাড়া জিম ইন্সট্রাক্টরের সঙ্গে কি করছ বা গান শিখতে যাবার নাম করে প্রতিটা রোববার কোথায় যাচ্ছ, কে আর দেখতে যাচ্ছে!
-- তুমি কিন্তু আমার ওপর মেন্টাল টর্চার করছ! এরপর আমি পুলিশে জানাতে বাধ্য হব!
-- আমিও পুলিশে জানাব!
-- কিস্যু করতে পারবে না! আইন এখন মেয়েদের পক্ষে!
-- আইনের বাইরেও কিছু আইন আছে! দরকার হলে…
-- তুমি আমায় থ্রেট করছ!...
লড়াই শুরু হতে দেরি হয়নি। সে লড়াই বাঁচার লড়াই! সে লড়াইয়ে জিততে হবে!
কিন্তু ... যথারীতি রেফারির আবির্ভাব... হুইসেলে ফুরর ফুরর!
বিদিশা সবচেয়ে বড় ব্লান্ডার করল, বছর দেড়েক আগে, চার চাকাটা কিনে। পই পই করে উপল তখন বারণ করেছিল, 'এটা কোরো না! আমাদের মতো ফ্যামিলিতে প্রাইভেট কার মানায় না!'
-- কি মানায়, না মানায় তোমার কাছে শিখতে হবে! আমার শখ থাকলে আমি সেটা মেটাব না?
-- মোটর গাড়ি চড়ার ইচ্ছে হলে ভাড়ার গাড়ি চড়ো ! তাতে খরচ কম, মেনটেনেন্স-এর ঝামেলা নেই! গ্যারেজের জন্যে টাকা গুনতে হবে না!
-- তোমার কোনও কথাই আমি শুনব না। গাড়ি বুক করা হয়ে গেছে। গ্যারেজ ঠিকঠাক! আপাতত ড্রাইভার রাখলেও ধীরে ধীরে ড্রাইভিংটা শিখে নেব। ব্যস!
-- আমাকে কোনও দিন এ ব্যাপারে জড়াবে না কিন্তু!
-- বয়ে গেছে তোমাকে জড়াতে!
-- মনে থাকে যেন!
-- হ্যাঁ মনে থাকবে। একটু থেমে বিদিশা বলে, 'তুমিও মনে রেখো, কোনওদিন আমার গাড়ি চড়তে পারবে না! আমার ছেলেকে নিয়ে আমি একাই ঘুরব।'
বিদিশার কথা নড়চড় হয়নি। এই আলোচনার কদিন পরেই, পাড়ার সন্টু বলে একটা ছেলে, বিদিশাকে দেখলেই যে 'বউদি বউদি' করে গলে পড়ে, টুকটাক এর ওর গাড়ি চালায়, তাকে সঙ্গে নিয়ে বিদিশা নতুন গাড়ি কিনে এনেছে। উপলদের ফ্ল্যাটের পাশের ফ্ল্যাটেই নিচের তলায় একটা গ্যারেজ খালি ছিল। সেটা ভাড়া নিয়েছে।
উপল দর্শক হিসেবে দেখে গেছে সবকিছু। টু শব্দ করেনি। আগে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে বিদিশা রোজ জিমে যেত। সেটা পাল্টে সকালে রোজ ড্রাইভিং ট্রেনিং আর বিকেলে জিমে যাওয়া শুরু করল।
অবাক হবার ব্যাপার, মাস খানেকের মধ্যে গাড়ি চালানোটাও রপ্ত করে ফেলল! ট্রেনিং কোর্স শেষ হলে সন্টুকে পাশে বসিয়ে সকালে কিছুদিন প্র্যাকটিস চলল।
মাস তিনেকও হয়নি! একদিন তার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা এনে উপলের নাকের সামনে ধরে বলল, 'হাড় কিপটে, গাঁইয়া ভূতো! তোমার দ্বারা তো কিছু হবে না! দ্যাখো আমি কি করতে পারি!'
তারপর নিজেই গাড়ি চালিয়ে ড্যাঙ ডেঙিয়ে ওর ধর্মতলার অফিসে যাতায়াত শুরু করল। ছুটি ছাটায় ছেলেকে নিয়ে বেরোতে লাগলো হাওয়া খেতে।
গাড়ি দেখে তো বুবুন প্রথম দিনেই লম্ফ ঝম্প শুরু করে দিয়েছিল। এখন মামমাম তাকে প্রায়ই বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে! আনন্দে সে আত্মহারা। হামিতে, আদরে বিদিশাকে ভরিয়ে দিচ্ছে বারে বারে।
এদিকে হঠাৎ করে গোটা পৃথিবী জুড়ে করোনার থাবা। এদেশেও কোভিড ১৯ মহামারীর প্রকোপ। লক ডাউন ঘোষণা। খেপে খেপে তার মেয়াদ বৃদ্ধি। কত্তা, গিন্নি, ছেলে তিনজনেই গৃহবন্দী। টিভিতে, খবরের কাগজে রোজ জ্যামিতিক প্রগতিতে মৃত্যু আর সংক্রমণ বৃদ্ধির খবর। লোকের মুখে মুখে কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধের ব্যাপক ব্যবহার। সোশ্যাল ডিসট্যানসিং, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, হোম কোয়ারেন্টাইন, হোম আইসোলেশন, অ্যাসিম্পটমেটিক, কো মরবিডিটি...
মাস দুয়েক পর দুজনেরই অফিস থেকে অর্ডার এলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জয়েন করতে হবে।
মেট্রো আর বাস সার্ভিস কিছুদিন বন্ধ থাকলেও আবার চালু হয়েছে। উপলের অফিস আগে ডালহৌসিতে ছিল। এখন সল্টলেকে। বরাবর সে মিনিবাসে যাতায়াত করে। কিন্তু এখন তো পাবলিক ভেইকেলস রিস্কি। যেহেতু তার হাঁপানি আছে, কি করবে সে? জানতে চাইল অফিস অথরিটির কাছে।
কর্তৃপক্ষ জানালেন, যাতায়াতের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। অফিস থেকে কিছু করা যাবে না।
অর্থাৎ আবার তাকে বাসেই যেতে হবে। অথবা রোজ কোনও ভাড়ার মোটর গাড়ি বুক করতে হবে।
চাকরি বাঁচাতে সেটাই সে করবে ঠিক করল।
কিন্তু ট্যাক্সিও কি নিরাপদ! মনের মধ্যে খিঁচখিঁচানি।
বিদিশা নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে যেত। আবার তাই যাবে নিশ্চয়ই।
মোটামুটি একই সময়ে দুজন তারা বাড়ি থেকে বেরোয়। সেদিনও বেরিয়েছিল। উপল পা বাড়িয়েছিল সিঁথির মোড়ের দিকে। বাস ধরবে। বিদিশা হঠাৎ বলল, 'দাঁড়াও!'
উপলের চোখে জিজ্ঞাসা।
-- তুমি রোজ গাড়িতে যাবে! বিদিশার গলায় আদেশ।
-- তার মানে?
-- সন্তু ড্রাইভ করবে।
-- কি দরকার! আমি বাসেই চলে যাব। বা ট্যাক্সি ভাড়া করে নেব! উপলের উদাসীন নির্লিপ্তি।
-- যা বলছি শুনবে! একদম ত্যাঁদড়ামো করবে না! তোমার না অ্যাজমা আছে! ডাক্তাররা কো-মরবিড পেসেন্টদের সাবধানে থাকতে বলছে!
-- তুমি কি করে যাবে?
-- আমি মেট্রোয় যাবো। ই-পাশ করে নিয়েছি। কোনও অসুবিধা হবে না।
-- তা আবার হয় নাকি!
-- হ্যাঁ হয় এবং হবে।
ততক্ষণে সন্টু গাড়ি নিয়ে হাজির। বিদিশা গাড়ির গেট খুলে দিল। উপল গুটি গুটি পায়ে উঠে বসল গাড়িতে।
আর হ্যাঁ! পিছন ফিরে বউকে টা টা করতেও ভুলল না।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment