1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 25, 2022

মায়ের কোল

ছবি : ইন্টারনেট

মায়ের কোল

অর্পিতা ঘোষ পালিত

     স্টেশন যেতে বাক নেওয়ার মুখের রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গাটায় স্তূপকার জঞ্জাল। মনে হয় এই মফস্বল শহরের সমস্ত নোংরা-আবর্জনা এখানে ফেলা হয়।  নিয়মিত পথ যাত্রীদের যাতায়ত করতে দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়  সবাই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাঁটে দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পেতে। শহরের ভেতরে যাওয়ার গাড়ি, বাস চলাচলের বড় রাস্তাটা অনেকটা ঘোর পথ; একটাই শর্টকাট পথ তাই সবসময় অটো, টোটো, সাইকেল,বাইক অহরহ চলতেই থাকে।  কাছাকাছি বাড়ি যাদের তারা স্টেশনে সবসময় এই রাস্তা দিয়েই যাতায়ত করে। 

       আজ ভোর থেকে নিত্যযাত্রীরা স্টেশনে আবর্জনার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নোংরার ভেতর থেকে কচি বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। যাতায়াতের পথে একটু থমকে গিয়ে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে  বাচ্চাটার জন্মদাত্রী মায়ের উদ্দেশ্যে গালাগালি দিতে দিতে ব্যস্ততায় যে যার গন্তব্যে যাচ্ছে। কেউ বাচ্চাটাকে নোংরার থেকে তুলে আনছেনা। 

        রমা স্টেশনের ওভারব্রিজের এককোণে বসে নিয়মিত ভিক্ষা করে। কত বছর ধরে এভাবে এখানে বসে ভিক্ষা করছে সেসব হিসেব নেই ওর; তবে পঁচিশ বছর তো হবেই। রাতে ওয়েটিং-রুমের দরজার একপাশে শুয়ে থাকে। এ দুনিয়ায় ওর কেউ নেই। আবছা মনে পড়ে – ছোটবেলায় ওর বাবা ওকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে কি যেন কিনতে গিয়েছিল, সারাদিন খুঁজেও আর ফিরে পাইনি বাবাকে। তারপর থেকে স্টেশনই রমার ঘর- বাড়ি। আগে আপ-ডাউন ট্রেন স্টেশনে ঢুকলেই রমা ছুটে গিয়ে যাত্রীদের লক্ষ্য করতো, যদি ওর খোঁজে বাবা ফিরে আসে। অনেক বছর পর বুঝেছিল – আসলে ওর বাবা ওকে নিজের ইচ্ছেয় ফেলে রেখে গেছে। 

      ডাউন ট্রেনের অপেক্ষায় রমার পাশে দাঁড়িয়ে  থাকা দুজন নিজেদের মধ্যে  নোংরা-আবর্জনার ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা বলছিল।

রমা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো  – আমি একজন ভিখারিণী হয়ে আপনাদের একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, কিছু মনে করবেন না। কোথাও কি কেউ বাচ্চা ফেলে রেখে গেছে? আপনাদের আলোচনা শুনে মনে হলো।

একজন বললো – স্টেশন আসার পথে রাস্তার ধারে যেখানে নোংরা ফেলে সেখানে কেউ ছোট্ট বাচ্চাকে ফেলে দিয়ে গেছে। নোংরার ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

      শুনে রমার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো, ওকেও যে ওর বাবা ফেলে গিয়েছিল সেসব দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তড়িঘড়ি উঠে দৌঁড়তে লাগলো নোংরা ফেলার জায়গার দিকে।  নোংরা- আবর্জনার পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রথমে কিছু শুনতে বা বুঝতে পারলো না, এত নোংরার মধ্যে কোথায় খুঁজবে? কোনো কান্নার আওয়াজ তো শুনতে পাচ্ছেনা, তবে কি কেউ বাচ্চাটাকে নিয়ে গ্যাছে?  নিজেকেই প্রশ্ন করলো রমা, একটু শান্তি পেলো – যাক বাচ্চাটা তাহলে মনে হয় কোনো একটা আশ্রয় পেয়েছে। কি মনে করে তাও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। হটাৎ শুনতে পেলো কেঁদে কেঁদে গলা বসে যাওয়া বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। কয়েকটা কুকুর জটলা করে নোংরার মধ্যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, সেখান থেকেই আওয়াজ এলো মনে হচ্ছে। একটা লাঠি কুড়িয়ে  নিয়ে কুকুরগুলোকে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে দিল। কুকুরগুলো সরে যেতে দেখতে পেলো একটা কাপড়ে জড়ানো ছোট্ট শিশুকে। রমা তাড়াতাড়ি বাচ্চাটাকে  তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো। 

      পথচলতি  সানগ্লাস চোখে এক আধুনিকা রমাকে নোংরা থেকে বাচ্চা তুলে আনার দৃশ্য দেখে একটু দাঁড়ালো, লিপস্টিক রাঙানো ঠোঁট দিয়ে শব্দ ছুঁড়ে দিলো – ডিসকাস্টিং,  নিজের খাবার জোটেনা তার ওপর পোষ্য! যত্তসব আদিখ্যেতা। উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে স্কার্ফ উড়িয়ে চলে গেল।  চলে যাওয়ার পরও নিজের গায়ের নোংরা গন্ধ ঢাকতে সারা গায়ে যে সুগন্ধ মেখেছে সেটা অনেকক্ষণ বাতাসে ভেসে বেড়ালো।

       রমা বাচ্চাটাকে কোলে করে নোংরা ফেলার স্থান থেকে রাস্তায় এলো। যারা দাঁড়িয়ে ওর কাজ দেখছিল তাদের উদ্দেশ্যে একমুখ গর্বের হাসি হেসে বললো  – আমি ভিখারিণী, ভিক্ষা করে আমি যদি দুটো খেতে পাই তাহলে এই বাচ্চাটাও আমার সাথে খাবার পাবে। আজ থেকে আমি ওর মা, ওর আপদে বিপদে সবসময় আমি থাকবো। ওর খুব খিদে পেয়েছে, কেঁদে কেঁদে গলা শুকিয়ে গেছে। একটু দুধ জোগাড় করতে পারি কিনা দেখি...

     সভ্য সমাজের  দিকে একটু হেসে বাচ্চাটাকে আদর করতে করতে রমা স্টেশনের দিকে এগোলো।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment