1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Friday, January 13, 2023

ভীরু বাঙালীর গোলকদর্শন

ছবি : ইন্টারনেট

ভীরু বাঙালীর গোলকদর্শন
অর্কজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

       জায়গাটা ফ্রান্সের তুলুস প্রদেশে। গ্রীষ্মকালের একটা শনিবার। সকাল সাড়ে সাতটায় হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠল। বিছানায় হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল অভিনব, তারপর কোনোক্রমে চোখটা কচলে নিয়ে দৌড় দিল দরজা খুলতে৷ দ্বারে প্রতীক্ষারত তারই গবেষণাগারের জার্মান সতীর্থ জুনিয়ার আন্দ্রেয়াস৷ তার রাঙ্গামুখ অভিনবকে কিছুটা হতচকিত করল৷

আন্দ্রেয়াস গম্ভীরভাবে বলল, "কী ব্যাপার, তোমার দেখা নাই?" এতক্ষণে অভিনবের ঘুম ছুটে গিয়েছে, তার মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ খেলে গেল: আরে হ্যাঁ। তাদের তো আজ সকালে লন্ টেনিস খেলতে যাওয়ার কথা ছিল। সে আমতা আমতা করে বলল, ভাই আমাদের তো এক সপ্তাহ আগে কথা হয়েছিল। তারপরে আর দেখা সাক্ষ্যাৎ নেই, দুজনেই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আন্দ্রেয়াস খানিক গলা খেঁকারি দিয়ে বলল, "এটা জার্মানদের যাপনরীতি বন্ধু। কথার কোনো নড়নচড়ন হয় না৷"

এটা শোনার পর অভিনবের সেই প্রচ্ছন্ন স্বাজাত্যবোধ কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথাচাড়া দিল। মনে মনে গর্জাল, "হাম্ভি কিসিসে কম নেহি, শুধু উইকেন্ডের ছুটিটা উপভোগ করে খানিক শয্যাগত ছিলাম ৷ তাই বলে সময়ে চলার ও কথা রাখার ক্ষমতা আমারও আছে।"

তড়িঘড়ি টেনিস র‍্যাকেট ও বলের কৌটোটা হাতে নিয়ে রওয়ানা দিল আন্দ্রেয়াসের সঙ্গে টেনিস কোর্ট অভিমুখে ৷ সেখানে ইতিমধ্যেই আরও কয়েকজন সঙ্গী হাজির ৷ এদের মধ্যে একজন অভিনবের পরিচিত হরিশঙ্কর পান্ডে আর অন্যজন জুনিয়ার আরিয়েন ৷ তারপর ঘন্টাখানেক চলল তাদের টেনিস প্র্যাক্টিস ৷ মাঝেমধ্যে অভিনব ও হরি নিজেদের মধ্যে উচ্চগ্রামে হিন্দী ভাষায় কথাবার্তা চালাতে থাকায় বাকীরা বেশ ব্যাপারটা উপভোগ করছিল ৷ তারপর প্র্যাক্টিস শেষ হওয়ার পর চলল পারস্পরিক সাধুবাদ জানানোর পালা ৷ এই আদব-কায়দা অভিনব ফ্রান্সে এসেই শিখেছে ৷ যদিও ফ্রেন্চ ভাষাটা তার এখনও খুব একটা ভালোভাবে রপ্ত হয়নি ৷ সে আন্দ্রেয়াসকে কিছুটা মুচকি হেসে বলল "অয় রেভয়ের।" শুনে আন্দ্রেয়াস বলল, "ওটা অও ভা৷" মানে গুডবাই ৷ আর আওয়াজটা বেরোয় সোজা এপিগ্লটিস থেকে! যাইহোক, অভিনব মনে মনে ভাবলে ফরাসী উচ্চারণ রপ্ত করা চাট্টিখানি কথা নয় । এরপর আন্দ্রেয়াস খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবে বলে উঠল "এই যে আরিয়েন আর অভিনব । আজ ফুটবল বিশ্বকাপে জার্মানী আর আলজেরিয়ার খেলা আছে ৷ দেখতে যাবে ? সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ শুরু ৷" আরিয়েন যদিও বা সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলল, অভিনব কিন্তু একটু নিমরাজী ছিল ৷ কারণ সে জানে বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা ইউরোপীয়দের মধ্যে একটু বেশী । তাই বাড়াবাড়ির মধ্যে পড়তে চাইছিল না সে। যাইহোক, আরিয়েন আর আন্দ্রেয়াসের জোরাজুরিতে শেষপর্যন্ত রাজী হয়ে গেল ৷

তারপর, সন্ধ্যা নাগাদ বেরিয়ে পড়ল তারা তিনজন: অভিনব, আন্দ্রেয়াস আর আরিয়েন । যথারীতি ট্রামস্টেশন থেকে ট্রামে চেপে রওয়ানা দিল গন্তব্যের দিকে ৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ফরাসী দেশের সুন্দর এই শহরটিতে জুন-জুলাই মাসে কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে দশটা পর্য্যন্ত সূর্য দেখা যায়। তাই সন্ধ্যা হয়ে গেলেও চারিদিকের দৃশ্যমানতায় অভিনবের সংকোচ, সবকিছুর উপর এক অন্যরকম অনুভূতি মনে এনে দিল ৷ ট্রামের মধ্যেই আন্দ্রেয়াস বাকী দুজনকে তার খেলা দেখার সবরকম পরিকল্পনা খোলসা করে বলতে লাগল । আন্দ্রেয়াস জার্মান হলেও ফ্রান্সে মানিয়ে নিতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি এবং সেখানে তার চেনা-পরিচিতের সংখ্যাও অগুনতি ৷ বাকী দুজন মুখ বুজে তার পরিকল্পনা শুধু শুনে যেতে লাগল । 

তারা 'রু স্যাঁ ক্যাথরিন্’ নামে একটি স্টেশনে অবতরণ করে সেখানকার বিখ্যাত রেস্তোরাঁ শার্লক হোমসে ঢুকে পড়ল খেলা দেখতে ৷ বলে রাখা ভালো ইউরোপীয়রা বিশ্বকাপ চলাকালীন এই সমস্ত রেস্তোরাঁয় ভিড় জমায় ও তাদের নিজেদের দেশের ফুটবল টিমের খেলা দেখতে দেখতে প্রবল এক উন্মাদনায় মেতে ওঠে ৷ অভিনবরও ক্রিকেট বিশ্বকাপে শচীন ও ধোনির খেলা দেখতে গিয়ে এরকম একটা প্রবল উত্তেজনা যে হত না, তা কিন্তু নয় । যাইহোক রেস্তোরাঁয় ঢোকার পর অভিনবের দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটি ব্যাপার ৷ সেটি হল আন্দ্রেয়াসের পকেট থেকে বেরোনো ভাঁজ করা ছোট্ট একটি জার্মান পতাকা ৷ সেটি সে যখন আস্তে আস্তে উন্মুক্ত করল, সেটি বেশ বড় আকার ধারণ করল। তারপর আন্দ্রেয়াস পতাকাটি আপাদমস্তক নিজের ওপর জড়িয়ে নিয়ে বসে পড়ল খেলা দেখতে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত দশক পেরিয়ে গেলেও তার স্পষ্ট একটা ছাপ রয়েছে ইউরোপীয় জনগণের মধ্যে ৷ বহুজাতিক লোকেদের মধ্যে বাকবিতন্ডা তারই একটা বহিঃপ্রকাশ ৷ অভিনবেরও এসব অভিজ্ঞতা আগেই অনেক বার হয়েছে। তাই আন্দ্রেয়াসের সেই জার্মান পতাকা পরিহিত অবস্থা দেখে তার মনে একটু ভয় ভয় করতে লাগল। 

খেলা কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল এবং তাদের টেবিলে এসে পৌঁছল খাদ্য ও পানীয় । যত সময় গড়াতে থাকল তত বিশ্বকাপ ফুটবলের জার্মানি বনাম আলজেরিয়ার এই ম্যাচটি রোমহর্ষক হয়ে উঠল এবং আলজেরিয়া শক্তপোক্ত রক্ষণভাগের সহায়তায় যেভাবে শক্তিশালী জার্মান আক্রমণভাগকে আটকে দিতে থাকল, ততই গোটা রেস্তোরাঁয় আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগল। কারণটা অল্প হলেও কিছুটা স্পষ্ট অভিনবের কাছে । তুলুস প্রদেশে বহু আলজেরিয় নাগরিক কর্মসূত্রে বসবাস করছে এবং এরা ফরাসী ভাষাতেই কথাবার্তা বলে। এদের অনেকেই উপস্থিত ছিল সেই সময়ে ওই রেস্তোরাঁতে ৷ তাদের এই উল্লাসে আন্দ্রেয়াস খানিক বিমর্ষ হয়ে বলল, "জার্মানদের দেখছি লোকজন পছন্দ করে না।" এটা শোনার পর আরিয়েন মুচকি হাসি দিয়ে ঘাড় নাড়ল । অভিনব কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলের আনন্দে তখন মজে গিয়েছে । বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়রা তাদের ভেলকি ও মুন্সিয়ানার যত পরিচয় দিচ্ছে, তত সে বিস্ময়াভিভূত হয়ে অদ্ভুত আলোড়ন অনুভব করছে ৷ বাঙালী হিসাবে ফুটবলটা বরাবরই তার ভালো লাগে, এবার তার সঙ্গে মিলেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ফুটবলপ্রেমীদের ভাবাবেগ এবং তাতে অভিনব রীতিমতো আত্মহারা ।

যাইহোক ম্যাচ শেষ হতে যখন মাত্র কুড়ি মিনিট বাকী তখন অভিনব লক্ষ্য করল একদল সমবয়সী ছেলে একটা কোণে ছোট্ট একটা জটলা বানিয়ে তাদের দিকে অঙ্গুলিসংকেত করে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে৷ সে তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি ঘুরিয়ে চিত্তাকর্ষক ফুটবল খেলার দিকেই মনোনিবেশ করল ৷ কয়েক মিনিট পর একজন ফরাসীভাষী মহিলা তাদের টেবিলে এসে অভিনবকে জিজ্ঞাসা করল, "মিসিউর, পার্লে ফ্রঁসে ?"  মানে আপনি কী ফ্রেন্চ্ জানেন ৷ শুনে অভিনব এতদিন যা করে আসছে তাই করল, হালকা ঘাড় নাড়িয়ে বলল, "ন" মানে না । মহিলাটি তখন সেখান থেকে প্রস্থান করে সেই জমায়েতের মধ্যে ঢুকে গেল ও কাউকে কিছু একটা বলতে লাগল। অভিনব বুঝতে পারল মেয়েটি নিশ্চিৎ খোঁজে এসেছিল, সে কোন দেশের তথা কোন দলের সম্ভাব্য সমর্থক । 

এরপর যা হল, তা ফুটবল খেলার থেকেও রোমহর্ষক একটা কিছু ৷ খেলার অন্তিমলগ্নে নাটকীয়ভাবে জোড়া গোল করল জার্মান টিম এবং একজন গোলদাতা হল অভিনবের প্রিয় খেলোয়াড় মেসাট ওজীল ৷ জিতে গেল জার্মানি আর আন্দ্রেয়াস তার এতক্ষনের চাপা রাগ আর অপমান সহ্য করতে না পেরে সটান লাফ দিয়ে উঠল খাওয়ার টেবিলটার ওপর ৷ আরিয়েন চীৎকার করে উঠল,"এই  আন্দ্রেয়াস ! এটা কী করছ তুমি ? ডোন্ট ওভাররিয়্যাক্ট | এটা শুধু একটা বিশ্বকাপ খেলা, তার বেশী কিছুই নয় ৷" কিন্তু আন্দ্রেয়াসকে কিছুতেই সামলানো গেলনা এবং তার জার্মান পতাকাটি সেখানে জমায়েত জনতার চোখে পড়তে থাকল ৷ আসন্ন বিপদের আঁচ করতে পেরে আরিয়েন ও অভিনব তড়িঘড়ি আন্দ্রেয়াসকে নিয়ে সেই রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এল বটে, কিন্তু এখানেই গল্পের শেষ নয় । কারণ, ইতিমধ্যেই সেই একদল আলজিরিয় যুবক তাদের পিছু নিয়েছে এবং তাদের মধ্যে কয়েকজনের হাতে ধারালো অস্ত্র ৷ এটা দেখার পর অভিনব বুদ্ধিভ্রষ্ট হল আর তার ইউরোপীয় ভাড়া করা সত্তাটি বর্জন করে সোজা ভেতো বাঙালী সত্তাটিতে প্রবেশ করল । আর এরকম অবস্থায় পড়লে বাঙালীরা কী করে সেটা সবারই জানা, "হ্যাঁ, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা | " সেই অস্ত্রধারী আলজিরিয় যুবকগুলি আন্দ্রেয়াসকে ঘিরে ধরল, বলল 'ওকে মারো’ ও ‘হিটলার ' ইত্যাদি । আরিয়েন অবশ্য আন্দ্রেয়াসের পাশে থেকে ক্রমাগত বলতে থাকল, "আপনারা শান্ত হন । আমরা নিতান্তই ছাত্র, আমরা কাউকে অপমান ও অসম্মান করতে আসিনি, শুধু বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে এসেছিলাম ৷" অভিনব তখন অন্যপথে পালাবার রাস্তা খুঁজছিল এবং সামনে সাইকেল স্ট্যান্ড দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর কোনাক্রমে কার্ড টেনে সাইকেলটা নিয়ে নিল । তারপর যেই সাইকেলে প্যাডল করতে যাবে, ঠিক সেই সময় পিঠে কার একটা হালকা হাত এসে পড়ল । সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল আন্দ্রেয়াস ৷ হ্যাঁ, সেই ভয়ডরহীন আন্দ্রেয়াস, যাকে এতক্ষন ধরে আলজিরিয় অস্ত্রধারীরা ঘিরে ধরলেও সে এতটুকু ঘাবড়ায় নি, বরং আরিয়েনের সহায়তায় এবং একজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির মধ্যস্থতায় বিপদ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছে ৷ আন্দ্রেয়াস অভিনবকে জিজ্ঞাসা করল, "অভিনব, তুমি কোথায় যাচ্ছিলে ?"  অভিনব তার পৌরুষ প্রমাণে সপাট বানিয়ে বলল, "তোমাদেরকে ওদের হাত থেকে ছাড়াতেই যাচ্ছিলাম৷" এটা শোনার পর আন্দ্রেয়াস খানিকটা হতবাক! 

পরে তারা তিনজন সাইকেল নিয়ে ফিরে গেল তাদের আস্তানার দিকে ৷ যাওয়ার পথে আন্দ্রেয়াস ও আরিয়েন নিজেদের বীরত্বের কাহিনী আস্ফালন করে বলতে থাকল । কিন্তু আমাদের গল্পের নায়ক অভিনব নিশ্চুপ হয়েই সাইকেল চালাল আর মনে মনে ভাবতে লাগল, তার এই বন্ধুদের ফেলে পালাবার ব্যাপরটি কি লোকে বুঝল ৷ না পারলেই ভালো, কিন্তু তার এই আচরণ যে ভেতো বাঙালী-বুদ্ধির পরাকাষ্ঠা, তা হয়তো অনেকেই বুঝে নিতে পেরেছেন ৷

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment