1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Friday, January 13, 2023

ষড়রিপু (৬ ) : কাম অথবা

 

ছবি : দিব্যেন্দু গড়াই 

কাম অথবা 

দিব্যেন্দু গড়াই 


“সেই আমাকে অধিক পায়

যে আমাকে কামের চুলায়

কাঠের মত পুড়িয়ে দেয়। 

সেই আমাকে অধিক পায়

যে আমাকে নাড়ায় না

যে আমাকে স্বাধীন রাখে

সে আমাকে হারায় না। ”

বিয়ের ছ'বছর যেতে না যেতেই সঙ্গীতা আর পল্লবের ছোট্ট সংসারে ঢুকেছিল সন্দেহের বিষ। প্রথমে দু-এক ফোঁটা, তারপর গ্যালন গ্যালন। অথচ বিষে জর্জরিত হওয়ার কথা ছিল না। বরং উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের আগে পাঁচ বছরের প্রেম। পল্লব কলেজে আর সঙ্গীতা স্কুলে। একটি কোচিং সেন্টারে দেখা হয়েছিল দু-জনের। সঙ্গীতা স্টুডেন্ট আর পল্লব টীচার। উচ্চমাধ্যমিকের ইংলিশ ব্যাচে স্টুডেন্টের সংখ্যা ছিল কম, ছাত্রীর সংখ্যা আরও কম। মোটে দুই। সঙ্গীতা আর মোহনা। মোহময়ী মোহনাকে ছেড়ে সাধাসিধা সঙ্গীতাকে ভালো লেগেছিল পল্লবের। হয়ত নিজেও সে একটু মুখচোরা বলে। তারপর আর কি, চাকরির পরীক্ষা দিয়ে বারবার অকৃতকার্য হয়ে পাকাপাকি ভাবে টিউশনকেই ভবিষ্যতের পাথেয় করে নিয়েছিল পল্লব। আর প্রেমের পাঁচ বছর পূর্তিতে সঙ্গীতার সাথে গিয়েছিল ছাদনাতলায়। দুজনের ঘরকন্না চলছিল যেমন চলে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়িতে। পল্লবের মা-বাবা মারা গিয়েছিল আগেই। তাই ছোট্ট সংসারে সঙ্গীতার ব্যস্ত হওয়ার মত কাজ কিছুই ছিল না। প্রায় সারাদিন তিন-চারটে কোচিং সেন্টারে পড়িয়ে বেড়ানোয় পল্লবও সময় পেত না তেমন বৌ-কে সময় দেওয়ার। দুজনের মধ্যে ধীরে ধীরে  তৈরী হচ্ছিল ফাঁক। আর সেই ফাঁক দিয়েই অনুপ্রবেশ ঘটল তমালের। পল্লব যে কটি কোচিং সেন্টারে পড়াত, তার একটির মালিক ছিল তমাল হালদার। বাবার ছিল শাড়ির ব্যবসা, ছেলেকে চেয়েছিল উকিল করতে। বাপের সে আশায় জল ঢেলে, কোচিং সেন্টার খুলে বসেছিল তমাল। 

প্রথম প্রথম কোচিং-এর অনুষ্ঠানে দেখা-সাক্ষাৎ  হত। আস্তে আস্তে পল্লবের উপস্থিতিতে বাড়িতে অনুপ্রবেশ। কিছুকাল পরে পল্লবের অনুপস্থিতি সঙ্গীতা আর তমালের সাক্ষাৎ এর সময় হয়ে দাঁড়ালো। আদ্যপ্রান্ত গৃহবধু সঙ্গীতার প্রাথমিকভাবে অনিচ্ছা থাকলেও শেষ অব্দি তমালের কাছে আত্মসমর্পণ করল। বিয়ের চার-পাঁচ’বছর পড়েও সন্তান না হওয়ার সঙ্গীতা ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল মানসিক ভাবে। এদিকে পল্লবের সময় নেই। সুযোগসন্ধানী তমাল সেই সুযোগটাই নিল।

ষড়রিপুর প্রথমটি বেজায় আঠালো। একবার এর ফাঁদে পড়লে আর নিস্তার নেই। তখন আর স্থান-কাল-পাত্র কিছুই খেয়াল থাকে না। আর ঐ বেখেয়ালি অবস্থার চরম মুহূর্তে ওরা ধরা পড়ে গেল পল্লবের কাছে। 

সেদিন খুব তাড়া ছিল পল্লবের। কাশিমবাজার স্টেশনের কাছে একটা ব্যাচ পড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল খাগড়ায় আরেকটা কোচিং এ। আগের স্টুডেন্টরা দেরী করে আসায় পড়ানো শেষ  করতে এতটাই দেরী হয়ে গেল যে তড়িঘড়ি বাইক চালাতে গিয়েই বিপত্তি। খাগড়ার সোনাপট্টির সরু গলিতে সাইকেল রিক্সার সাথে মুখোমুখি ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়েছিল পল্লব। ডান হাটুঁটা বেজায় ফুলে গেছিল। ভাগ্যিস রিক্সা বা ওর বাইকের তেমন ক্ষতি হয়নি। পরের কোচিং ক্যানসেল করে কোনরকমে বাড়ি ফিরেছিল পল্লব। ঘড়িতে তখন দুপুর দেড়টা। কলিং বেল বাজানোর অনেক পরে দরজা খুলেছিল সঙ্গীতা। চেহারার অবিন্যস্ত ভাব ঢেকেঢুকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল। তার সাথে বসার ঘরে তমাল’কে দেখে মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল পল্লবের। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তমালের ওপর সর্বশক্তি দিয়ে। কিছুক্ষণ ধরে চলল তুমুল মারপিট। যার পরিণতি ঘটল একজনের মৃত্যুতে। 

যথারীতি পুলিশ এল। গ্রেপ্তার করা হল। আইন-আদালত সবকিছুই চলল নিজের মত। আর এইসময় বহরমপুর সংশোধনাগারে মনোবিদ বিশাখা বসু রায় সংস্পর্শে এসেছিল সঙ্গীতার। আত্মরক্ষার কারণে সঙ্গীতার হাতে মৃত্যু হয়েছিল পল্লবের। দাম্পত্য কলহের জেরে বউয়ের গায়ে হাত তোলা ছিল পল্লবের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার। সেদিনও মারধোর খাচ্ছিল সঙ্গীতা। কিন্তু অন্যদিনের থেকে সেদিনটা ছিল আলাদা। সেদিন  রুখে দাঁড়িয়েছিল সঙ্গীতা। মেটালের ফুলদানি দিয়ে আঘাত করেছিল নিরুপায় হয়ে। জানে মেরে দেওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না সেটা বলাই বাহুল্য, তবে দুর্ঘটনার ওপর ভগবান ছাড়া কারও হাত থাকে না। তাই পল্লবের নিষ্প্রাণ দেহ দেখে থানায় ফোন করেছিল সঙ্গীতা নিজেই। পাড়া-প্রতিবেশীকেও খবর দিয়েছিল। 

তমালের কোন চিহ্ন ছিলনা সে সময়। তাই বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের কথা তদন্তে উঠে এলেও জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া তমাল’কে কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। আর আদালতেও শেষমেষ সঙ্গীতা নিরপরাধ প্রমাণিত হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিন তমাল এসেছিল সঙ্গীতাকে সাথে করে নিয়ে যেতে। শুধু সঙ্গীতা নয়। ওর কোলে সঙ্গীতার কন্যাসন্তানও ছিল। তিন মাস বয়স। জেল থেকে ছাড়া পাবার পরেও কোন এক অজানা কারণে বিশাখা বসু রায়ের সাথে যোগাযোগ রয়ে গেছিল সঙ্গীতার। তাই তমালের সাথে সংসারী জীবনে মেতে থাকার সময় সবকথা খুলে বলেছিল সঙ্গীতা। 

সেই দুর্ঘটনার কিছু দিন আগেই সঙ্গীতা জানতে পেরেছিল তার দেহে বাসা বেঁধেছে তার আর তমালের ভ্রূণ। তমালের সঙ্গ ভালো লাগতে শুরু করেছিল ওর। তমালের মধ্যেও পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল। ওর প্রতি যত্নবান হয়ে উঠছিল তমাল। শুধু শয্যায় নয়, শয্যার বাইরেও ওকে স্পেস দিতে শুরু করেছিল তমাল। পল্লবকে ডিভোর্স দিয়ে তমালের সাথে নতুন করে সংসার পাতার প্ল্যান নিয়েও আলোচনা করেছিল দুজনে। আর এর মধ্যেই সেই দুর্ঘটনা। তমাল পল্লবের আক্রোশের চাপে ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়ছে দেখে সঙ্গীতা টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিয়েছিল মেটালের ফুলদানি। তারপর পিছন থেকে পল্লবের মাথা লক্ষ্য করে দু-ঘা। তমাল’কে দ্রুত সরিয়ে দিয়ে নিজে ধাতস্থ হয়ে পুলিশ, প্রতিবেশী সবাইকে খবর দিয়েছিল। এরপরের ঘটনা তো পুলিশ-আদালত সবাই জানে। 

প্রথম রিপু না সন্তানস্নেহ, কার মধ্যে ফেলবে এই ঘটনাকে মনোবিদ বিশাখা বসু রায় তা আজও ঠিক করে উঠতে পারেনি।

...(সমাপ্ত)...




8 comments:

  1. তরুণ চক্রবর্তীJanuary 13, 2023 at 9:55 AM

    অবশেষে বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো।দারুণ!

    ReplyDelete
  2. নিশ্চিন্ত হলাম

    ReplyDelete
  3. নিখুঁত ছোটো গল্প। শেষ হয়েও রেশ রেখে যায়, ভাবতে বাধ্য করে পাঠককে।

    ReplyDelete
  4. গল্পটি খুবই বাস্তব আজকের জীবনে। রিপু এবং রাগ দুটোকে বাগে রাখা খুবই কঠিন, নাহলে এরাই পার্শ্বচরিত্রাভিনেতা হয়।

    ReplyDelete