1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, April 17, 2022

ষড়রিপু (৪ ) : কুয়ো

ছবি  : ইন্টারনেট 


 কুয়ো

দিব্যেন্দু গড়াই

“কলুষিত মনে লোভ ধোকা দেয় নিত্য,

 লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু চিরন্তণ সত্য।”

বিশাখা বসু রায় গাজীপুরের বাজার ছাড়িয়ে দক্ষিণ দিকে আরও মিনিট পনের যাওয়ার পর পোস্টাপিসের লাল বাড়িটা দেখতে পেল। রঙ যদিও চটে গিয়ে ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। তবু এদিক ওদিক লালরঙের ছোঁয়া বোঝা যায়। সেখানেই স্থানীয় একজনকে পেয়ে যাওয়ায় যখন ‘কাজলদের ইঁদারা’টার কথা জানতে চাইল, লোকটা প্রথম কয়েক সেকেন্ড বিশাখার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর দেখিয়ে দিয়েছিল রাস্তাটা। সেই রাস্তা বরাবর আরও দশ মিনিট হাঁটার পর সঠিক জায়গায় পৌঁছাল বিশাখা। কাজলের কাছে যা যা শুনেছে সেগুলো মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। তাই জায়গাটা চিনতে ভুল হল না তার।

ইঁদারার পাশে ভেরেন্ডা আর কাঁটাগাছের ঝোপঝাড় জায়গাটাকে দূর্গম করে রেখেছে। পড়ন্ত বিকেলের রোদে আলোর থেকে ছায়া বেশী। সেই ছায়া-ছেঁড়া-আলোয় জনমানবশূণ্য জায়গাটা বাস্তবজগতের বলে মনে হচ্ছে না। একচালা বাড়ি, গোয়ালঘর, বাড়ির পেছনের তালগাছ’দুটোর চিহ্ন প্রায় নেই বললেই চলে। চারিদিকে ইঁট-কাঠের ধ্বংসস্তূপের মাঝে জেগে আছে একমাত্র ইঁদারাটা। 

*****

বেলডাঙা স্টেশন থেকে বেশ কিছুটা দূরের গ্রাম এই গাজীপুর। এখানে মানুষের মূল জীবিকা বলতে চাষবাস আর গোরু প্রতিপালন। চরণ সাহার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল কোনরকমে। ঘরে মা, বৌ আর মেয়ে। সেবছর প্রবল বৃষ্টিতে চাষবাস মার খেল খুব। হাতে তখন টাকাকড়ির টান। বন্ধুবান্ধবদের দেখাদেখি সেবারই প্রথম লটারির টিকিট কেটেছিল, আর প্রথমবারেই বাজিমাত। কড়কড়ে কুড়িটা একশো টাকার নোট হাতে পেয়ে চরণ তখন লাগামছাঁড়া আনন্দে ভেসে যাচ্ছে। গাজীপুর বাজারের ‘সৌভাগ্য’ লটারি দোকানের মালিক মিষ্টি খাইয়েছিল চরণ’কে। বাজারের লোকজন চরণ’কে  তখন বেশ প্রশংসার চোখে দেখত। কিন্তু সে আর কতদিন? সময়ের চাকার ঘুর্ণিতে কাল যে রাজা আজ সে ফকির-দশা প্রাপ্ত হতে চরণ সাহা’র খুব বেশী সময় লাগেনি। কিন্তু লটারির প্রতি তার লোভটা থেকেই গেছিল। শুধু থেকে যায়নি, চারাগাছ থেকে মহীরুহ হচ্ছিল ধীরে ধীরে। ক্ষেতের কাজ ফেলে লটারির দোকানে বসে থাকত। টিকিট কেনার টাকার জন্য এদিক-ওদিক হাতটান শুরু করল, যা আগে কক্ষনো করত না। এসব নিয়ে বাড়িতে তখন নিত্যদিন অশান্তি। আর তার মধ্যেই সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটাল কালিপুজোর দিন। ঘটনা না বলে দূর্ঘটনা বলা উচিত। ‘সৌভাগ্য’ লটারির দোকানের মালিক চিনু সাঁপুইকে লোভের বশে কথা দিয়ে ফেলল চরণ। অত্যন্ত দুশ্চরিত্র, লম্পট চিনু’র শত্রুর থেকে বন্ধু ছিল কম। বাজারের কেউই তেমন পছন্দ করত না চিনু’কে। ব্যতিক্রম চরণ। যদিও মাথায় লটারির ভূত চাপার আগে চরণও চিনুর সাথে মিশত না।

সেই কালিপুজোর রাতে চিনু লটারির দোকানের টোপ ফেলে চরণ’কে হাতের মুঠোয় বন্দী করল। চরণের মেয়ে কাজলের ওপর ওর অনেকদিনের লোভ। সেইরাতেই কথাবার্তা পাকা করে ফেলল চিনু। বলল, 

-‘চরণ’দা আমি শহরে চলে যাচ্ছি। বড় দোকান কেনাও শেষ। ওখানে টিকিটের হেব্বি বিক্রি। তাই গাজীপুরে আর আসা হবে না। সময়ই পাব না। এখানকার বাস উঠিয়ে তাই পাকাপাকি ভাবেই চলে যাব। ঘরদোর যা আছে তালা মেরে যাব তবে দোকানটা নিয়েই চিন্তা। কি করব কিছু ভেবে পাচ্ছি না। তোমার মত লটারি-অন্ত প্রাণ কেউ যদি সামলাতো এই দোকানটা, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হতাম।’

চিনুর কথা শুনে চকচক করে উঠল চরণের মুখচোখ। বিগলিত স্বরে বলল,

-‘আমি সামলাবো এই দোকান। তোকে কিচ্ছু চিন্তা করতে হবে না। তুই নিশ্চিন্তে থাক। তবে... এই দোকানের বদলে তোকে কি যে দিই! কিছুই নেই আমার কাছে।’ 

একটু কুন্ঠিত স্বরে বাকি কথাগুলোও শেষ করল।

-‘আরে টাকাপয়সা কে চেয়েছে তোমার কাছে। ওসব কিচ্ছু লাগবে না। আজ থেকে তোমারই দোকান এটা। নিশ্চিন্তে চালাও। তবে একটা জিনিস চাই তোমার থেকে। কাজল, তোমার মেয়ে। ওকে বিয়ে করে শহরে নিয়ে থাকব। এখানে আর আসব না।’ 

বেশ রসিয়েরসিয়ে কথাগুলো বলে চরণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল চিনু। চরণের মাথায় তখন লটারির দোকান পাওয়ার আনন্দ। লোভাতুর মানুষের সামনে, তার হাতের নাগালে যদি লোভের সামগ্রী দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেই মানুষের যেমন অবস্থা হয়, সেরকমই লোভের নেশায় বুঁদ হয়ে গেছিল চরণ। সাথেসাথে কথা দিয়ে দিল। চিনুকে বলল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করতে।

বাড়িতে খবর পৌঁছাতেই তুলকালাম লেগে গেল। চরণ একদিকে আর বাকিরা অন্যদিকে। চরণের মাথার তখন লোভের দৈত্য ভর করেছে। ও কাজলের বিয়ে চিনুর সাথে দেবেই, কারুর কোন কথা শুনবে না। ষোলোয় পড়েছে গত বৈশাখে, সুতরাং মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। তাই সামনের সপ্তাহেই বিয়ের দিন ফাইনাল। 

ফুটন্ত আগ্নেয়গিরির মত বাড়ির আবহাওয়ার মধ্যে প্রথম লাভা উদগীরণ হল বিয়ের দিন সন্ধ্যেবেলা। এই বিয়েতে কারুর কোন সায় নেই বলে আত্মীয়/পাড়া-পড়শি কেউ আসেনি। চিনু সাঁপুই হাতেগোণা কয়েকজন ইয়ারদোস্ত কে নিয়ে যখন বিয়ে করতে হাজির হল তখনই ঘরে খিল আঁটকাল চরণে’র বৃদ্ধা মা। ছেলের জন্য একমাত্ত নাতনির বলি চোখের সামনে দেখতে পারত না বৃদ্ধা। তাই বিষ খেল। এতবড় দুর্ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখেও শ্বশুর আর জামাই, কেউই বিয়ে পিছিয়ে দেওয়ার মত দিল না। আর তখনই আসরে নামল কাজল। 

কুয়োতলার ঠিক সামনে তক্তা পেতে তার ওপর পরিস্কার চাদর বিছিয়ে বর ও বরপক্ষের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। চার পাঁচটা হ্যালোজেনের আলোয় গোয়ালঘর থেকে একচালা বাড়ির পেছনের তালগাছ ,,, সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আর সেই ফটফটে আলোর মধ্যে যখন কাজল এসে দাঁড়াল তখন তার পরণে শাড়ি। বেনারসী নয়, সাধারণ তাঁতের শাড়ি বেশ আঁটোসাঁটো করে পরা। দু’হাত পেছনে রেখে যখন সে বরের বসার জায়গার দিকে এগিয়ে গেল, তখন অবস্থা সুবিধের নয় আন্দাজ করে বরের দু-চারজন সঙ্গীসাথী সরে পড়েছে। কেবল চিনু আঁটোসাঁটো চেহারার কাজলকে দেখে লোভীর মত বসে ছিল। কাজল যে দুহাত দিয়ে শক্ত করে গোরুর খড়কাটার বঁটিটা ধরে আছে পেছনে, খেয়াল করেনি চিনু। পাশে বসে চরণও খেয়াল করতে পারেনি মেয়ের উদ্দেশ্য।  একদম শেষ মুহূর্তে ধারালো বঁটিটা যখন মাথার ওপর তুলে ধরল কাজল, ভয়ের চোটে পেছন ফিরে পালাতে গিয়ে চিনু সোজা গিয়ে পড়ল কুয়োর ভেতর। অতল জলে বেশীক্ষণ হাবুডুুবু খেতে হয়নি তাকে। কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকজনের সঙ্গ পেয়ে গেছিল সে। চরণ সাহা। দু'জনের রক্ত কুয়োর জলে মিশে যাচ্ছিল দ্রুত। ওদের আর্ত চিৎকার কেবল শুনেছিল কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাজল। কারণ বাড়ির আরেকজন সদস্য, কাজলের মা তখন মূর্চ্ছা গেছে।

পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটেছিল আইননুযায়ী। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল কাজল’কে। আদালতে কেস উঠলে কাজলের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল সেদিনের বরপক্ষের দু-চার জন। দোষী সাব্যস্ত হলেও বয়স আঠারোর কম হওয়ায় তিন বছরের জেল হয়েছিল শুধু। আর এই তিনবছরের প্রথম দিন থেকেই মনোবিদ বিশাখা বসুরায়ের নজরে পড়েছিল কাজল। কাজলের কারাবাস শুরু হওয়ার দিনকয়েকের মধ্যে ওর মা মারা যান। সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে ও। সেইসময় থেকেই ওর সাথে একটা স্নেহের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বিশাখা’র। জেলের মধ্যে থেকে পড়াশুনা করে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছে কাজল। এর মধ্যে একটা সুখবরও এসেছে। শাস্তির মেয়াদ পুরো হওয়ার তিনমাস আগেই কাজলের মুক্তির সুখবর। দু’দিন পরেই ওর ছুটি। আজ কি মনে করে বিশাখা বসুরায় একাই পৌঁছে গেছে কাজলদের ভিটের সামনে। দুই লোভীর সলিলসমাধির জায়গা, সেই কুয়োটা দেখতে।

...(সমাপ্ত)...

এই ধারাবাহিকের 



No comments:

Post a Comment