1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, August 15, 2022

ষড়রিপু (৫ ) : ক্রোধ

ছবি : দিব্যেন্দু গড়াই

দ্বিতীয় রিপুর বলি
দিব্যেন্দু গড়াই

‘‘রাগতে রাগতে বিস্ফোরণ, বিস্ফোরণেই নাশ
দ্বিতীয় রিপুর গর্ভে আছে চরম সর্বনাশ।’’

-‘মানিক, যা গরু দুটোকে মাঠে দিয়ে আয়। তোর আব্বার আসার সময় হয়ে এল।’
উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে ছেলের উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়ে সাবিনা। 

দুপুর হতে চলল। মাথার ওপর ঝাঁঝাঁ রোদ। আষাঢ় মাস শুরু হলেও বৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই কোত্থাও। এই রোদে ৪-৫ কিলোমিটার রাস্তা সাইকেল ঠেঙিয়ে আসতে হলে কারুর মাথার ঠিক থাকেনা। আর মানিকের আব্বার এমনিতেই গরম মাথা। রাগ তো নয়, চন্ডাল রাগ। তা নাহলে অবলা জীব দুটোকে কেউ অমন অমানুষের মত লাঠিপেটা করতে পারে! নিজেদের গরু। নিজেদের গোয়ালে থাকে। সেই গরু দুটোকে সেদিন কি মারটাই না মারল।  দোষের মধ্যে কিই বা করেছিল তারা?

গত জুম্মাবারে একটু আগে আগেই ফিরেছিল সেলিম মিঞা। প্রতি শুক্রবার যোহরের নামাজ আদায় করতে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরাটাই ওর নিয়ম। বাড়ির পেছনের দিকের ফাঁকা জায়গায় জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়ার পর  ধীরেসুস্থে বাড়ির ভেতর ঢুকছিল সে। আর তখনই চোখে পড়ল সেই দৃশ্য।

চারআঁটি মটর শাক বাঁধা ছিল সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে। দেরী হয়ে গেছে বলে, পরে শাকগুলো রান্নাঘরে রেখে আসবে এই ভেবে তড়িঘরি অজু করে নামাজ আদায় করতে চলে গেছিল। এখন দেখে গোয়ালঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা সাইকেলের পেছনে রাখা সেই শাকপাতা চোখ বুজে চেবাচ্ছে লালি গরু। চোখের নিমেষে মাথার ভেতর ফেটে পড়ল রাগের বোমা। হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে উঠোনে পড়ে থাকা লাঠি নিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে লাগল লালি আর ধলো’কে। অসহায় পশুর অার্ত চীৎকারে রান্না ফেলে ছুটে এসেছিল সাবিনা। মানিকও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ওদিকে চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কেঁদে উঠেছিল ছ’মাসের মেয়ে শাবানা,মানিকের বোন। দৌড়ে এসে আগে গরু দুটোর দড়ি খুলে দিয়েছিল সাবিনা, যাতে ওরা পালিয়ে বাঁচে। তারপর সেলিমকে আটকাতে গেছিল। দু-চারটে লাঠির বাড়ি খেয়েছিল নিজে। সেই ঘটনা ঘটার পর থেকেই সাবিনা দুপুরবেলা সতর্ক থাকে। সেলিম মিঞার খেতে আসার সময় গরু দুটোকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসতে বলে ছেলেকে।

শাদির পরপরই সাবিনা টের পেয়েছিল সেলিমের রাগ চন্ডাল। একদিন ভাত দিতে একটু দেরী হওয়ায় লাথি মেরে ভাতের থালা উঠোনে ফেলে দিয়েছিল সেলিম। খুব কেঁদেছল সাবিনা সেদিন। তখনও সেলিমের মা বেঁচে। সাবিনার চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বৃদ্ধা বলেছিল সেলিমের চন্ডাল রাগের কথা। সেইকারণে পড়াশোনাও বিশেষ করতে পারেনি। বন্ধুদের রেগে গিয়ে এমন মারত, যে বাধ্য হয়ে মাদ্রাসা থেকে সেলিমকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছোট থেকে বড় হল, কিন্তু ঐ মাত্রাতিরিক্ত রাগের কারণে বন্ধুবান্ধবও জুটল না তেমন। এ কাজ- ও কাজ করে শেষে খাগড়ায় এক কাঁসার দোকানে থিতু হয়েছিল। প্রথমে টুকটাক ফাইফরমাশ খাটত, তারপর আস্তে আস্তে বাসনকোসন চেনার কাজ, ছোটোখাটো তাপ্পি মারার কাজ শিখে নিল। এখন মোটামুটি ঐ দোকানের সে একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী। রোজ সকাল দশ’টায় গিয়ে দোকান খোলে। দুপুরে একবার খেতে আসে। তারপর একবারে সন্ধ্যেয় ছুটি। ওদের বাড়িটা গোয়ালজান গ্রামে ঢোকবার একেবারে মুখে। সাইকেল চালিয়ে গঙ্গার ঘাট, নৌকায় সাইকেলসহ নদী পেরিয়ে বাকি রাস্তা সাইকেলে পৌঁছাতে আরো তিরিশ মিনিট। সব মিলিয়ে ৪-৫ কিলোমিটার রাস্তা।

আর এই রাস্তা পেরোতে দেরী হওয়ায় সেই অভিশপ্ত দুপুরে ঘটে গেল চরম দুঃখজনক ঘটনা। 

****

কদিন ধরে বেশ ভালোই বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন সেলিম যখন দোকান খোলে তখন আকাশের মুখ ভার। একটু বেলা বাড়তেই টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। আর ঠিক ভাত খেতে বেরোনোর সময় আকাশ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল। বৃষ্টি ধরতে ধরতে আরো আধঘন্টা দেরী। এদিকে ফেরীঘাটে বৃষ্টির জন্য নৌকা কম, গঙ্গা পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় কাদার জন্য জোরে সাইকেলও চালাতে পারছিল না সেলিম। এদিকে খিদেয় পেট চুঁ চুঁ করছে।  গোয়ালজান গ্রামে ঢোকার ঠিক আগে খেলার মাঠে ছেলেকে দেখে মাথায় খুন চড়ে গিয়েছিল সেলিমের। কোন কথা না বলে কাদামাঠে খেলতে থাকা মানিকের পিঠে রদ্দা মেরেছিল সেলিম। আচমকা আঘাতে কাদামাঠে পড়ে গেছিল দশ বছরের মানিক। আর ওঠেনি। মানিকের খোঁজে একটু পরেই ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে মাঠে এসে পৌঁছায় মানিকের মা।  সাবিনার বুকফাটা কান্নায় পাড়াপড়শিরা হতভম্ব হয়ে যায় প্রথমে। গ্রামীণ হাসপাতালে ছেলেটাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তারবাবু জানায় ব্রট-ডেড।

শেষ অব্দি সেলিমের চন্ডাল রাগের বলি হল ওর নিজের ছেলে। ব্যপারটা সবাইকে প্রথমদিকে হতবাক করে দিয়েছিল। পরে তা কেটে গেল। কারণ সবাই পরিচিত ছিল সেলিমের বদরাগী স্বভাবের সাথে। সাবিনা ওর দুধের মেয়েটা কে নিয়ে কিছুদিন কোর্ট-থানা করল। কোর্টের রায়ে শেষমেষ বহরমপুর সংশোধনাগারে ঠাঁই হল সেলিম মিঞার। নির্দিষ্ট দিনগুলোতে সেলিমের সাথে দেখা করতে যেত সাবিনা। কোলে থাকত মেয়ে শাবানা। মেয়ের সাথে খুনসুটি করত বাপ, গারদের ওপার থেকে। সাবিনাও হাসত। গল্পটা এখানেই শেষ হলেই ভালো হত। দ্বিতীয় রিপু মানুষকে কতটা নীচে নামাতে পারে যে আপন সন্তানকে হত্যা করার মত ঘৃণ্য কাজও মানুষের দ্বারা সম্পন্ন হয়, সেটা সেলিমের ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছিল। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

সংশোধানাগারের মনোবিদ বিশাখা বসু রায় প্রথমে সেলিম, পরে সেলিমের সামনে সাবিনার সাথে কথা বলেছিল। কয়েকবার কথা বলার পর জানা গেল আসল সত্য। যা কোনও আদালতে কোনদিন প্রমাণিত হবে না। কেউ হয়ত বিশ্বাসও করবে না। কিন্তু বিশাখা বসু রায় বিশ্বাস করেছিল। 

সেই দূর্ঘটনার দিন দুপুরে যখন সেলিম মিঞার ফিরতে দেরী হচ্ছিল তখন সাবিনা মেয়েকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ছেলে মানিককে হাঁক দিয়ে বলেছিল গরুদুটোকে মাঠে দিয়ে আসতে। কিছুক্ষণ পর মানিকের কোন সাড়াশব্দ না পাওয়ায় মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেই গরুদুটোকে মাঠে বেঁধে রাখতে গিয়ে দেখে জলকাদায় ছেলেটা মাঠে দৌড়াচ্ছে। একএকাই খেলছে। বারদুয়েক ঘরে আসতে বলার পরেও ছেলে কথা না শোনায় সাবিনা হঠাৎ রেগে যায়। ঘরে বাচ্চাটা একা, সেলিমের আসার সময় হয়ে গেল এদিকে রান্না শেষ হয়নি। এসবের মধ্যে ছেলের অবাধ্যতা মাথা গরম করে দিয়েছিল সাবিনার। ছেলের কাছে গিয়ে জোরে কানের পাশে দু’বার মারতেই ছেলে পড়ে যায়। আর ঠিক তক্ষুণি সাইকেল নিয়ে সেলিম এসে পড়ে সেখানে। ছেলের অবস্থা দেখে, বৌয়ের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ বৌ’কে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় সেলিম। বাচ্চা মেয়েটা সেখানে একা। আর নিজেই আপনসন্তানের হত্যার দায়ভার তুলে নিয়ে নিজের মাথায়। নিজের সংসারকে ভেসে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচায়। 

নিজের দ্বিতীয় রিপুকে ভালো কাজে কাজে লাগায় প্রথমবার।

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment