1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Monday, August 15, 2022

কী দিন ছিলো তখন

ছবি  : ইন্টারনেট 

কী দিন ছিলো তখন
রানা জামান

মনের জোরে সবসময় শরীর চলে না। শওকত আলীর হুইলচেয়ারে চলাফেরা করার কথা। মনের জোর থাকায় হাঁটার চেষ্টা করেন। যখন তিনি হাঁটেন, তখন হুইলচেয়ারটা ওঁর পাশাপাশি চলে। ক্লান্ত হয়ে গেলে হুইলচেয়ারে বসেন। কোনো রোগ না থাকা সত্ত্বেও ওঁর শরীর হয়ে গেছে ন্যুব্জ। একসময় বয়সের ভার শরীর বইতে পারে না। শওকত আলীর বয়স নব্বই বছর পার হয় গেছে ক’দিন আগে। কিন্তু মনের জোরটা ওঁর এখনো ষোল বছরের। মনে মনে এখনো তিনি ক্ষেতে কাজ করেন, বিলে মাছ ধরেন, কালবৈশাখী এলে আম কুড়াতে ছুটেন গাছ থেকে গাছের তলে; ছুটেন প্রিয় ষাঁড়টার সাথেও।

বৃদ্ধকালে স্বামী-স্ত্রীর সংসার তরুণ কালের চেয়েও আবেদনময় ছিলো। শারিরীক চাহিদা উভয়ের প্রায় একইরকম কম থাকায় সমস্যা হচ্ছিলো না কোনো। স্মৃতিচারণ করে দিন চলে যাচ্ছিলো বিন্দাস। উভয়ের আশা ছিলো: একজন রোগাক্রান্ত হলে আরেকজন মন লাগিয়ে সেবা করবেন। বিশেষ করে স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত- এটা নিশ্চিত করার জন্য মরিয়ম বেগম মনেপ্রাণে কামনা করতেন শওকত আলী অসুস্থ হবেন একদিন না একদিন; তখন তিনি জান লাগিয়ে সেবা করে স্বামীকে সুস্থ করে তুলবেন। কোনো নার্স বাসায় আসতে দিবেন না। এ নিয়ে মাঝে মাঝে ঝগড়া লেগে যেতো উভয়ের মাঝে।
মরিয়ম বেগম চৌকির উপর স্বামীর পাশে বসে থেকে বলতেন, শোন না!
শওকত আলী চারচালা টিনের ঘরের ধন্নার দিকে তাকিয়ে থেকে বলতেন, বলো। শুনছি!
তুমি বহুদিন যাবৎ রোগে আক্রান্ত হচ্ছো না!
রোগে পড়লে খুব কষ্ট হয়, সেটা পেট খারাপ বা মাথা ব্যথা হোক! আমি সবসময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যাতে রোগাক্রান্ত না হই! মহান আল্লাহ সদয় হয়ে এখনো আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করে আসছেন। তুমিও রোগে পড়ছো না! কভিডের মহামারিতেও তোমার কিছু হলো না!
তখন মরিয়ম বেগম মুখ টিপে হাসতেন। এই হাসি দেখে স্ত্রীকে আকড়ে না ধরে থাকতে পারতেন না শওকত আলী। একদিন বুকের বামপাশে সামান্য ব্যথার কথা বলে বিছানায় লম্বা হয়ে শুলেন মরিয়ম বেগম।
শওকত আলী স্ত্রীর শিয়রে বসে ডান হাত দুই হাতে চেপে ধরে উদ্বিগ্ন চিত্তে বললেন, এ্যাম্বুলেন্স আসতে বলেছি। হাসপাতালে নিলে তুমি ঠিক হয়ে যাবে গো।
কিন্তু এ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই মরিয়ম বেগমের আত্মা চলে গেলো দেহ ছেড়ে। অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাতের কারণে শওকত আলী কাঁদতে পারলেন না। খবর পেয়ে মার লাশ দেখার জন্য দুই পুত্র স্ত্রীসহ এলো গ্রামের বাড়িতে।ওদের সন্তানেরা কেউ বাংলাদেশে নেই; তাই খবর পাঠালেও দাদিকে দেখতে আসতে পারলো না। তবে মেয়ে দুটো সন্তানসন্ততি সহ এসেছিলো। কী কান্না মায়ের খাটিয়া ধরে মেয়ে দুটোর। মেয়ে দুটোর কান্নায় উপস্থিত পাড়াপ্রতিবেশিরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারে নি। তখন মনে হয়েছে সত্যই এই বাড়িতে একজন মারা গেছেন।

দুই ছেলের ভাগাভাগির ভরণপোষণে না গিয়ে শওকত আলী রয়ে গেলেন গ্রামেই। কিন্তু গ্রামে একা সময় কাটে না, দিন যাপনেও সমস্যা হতে লাগলো। ইতোমধ্যে বড় ভাইরাও একে একে চলে গেলেন পরপারে; অনেক ভাবিও চলে গেছেন। ভাতিজারা আর কত দেখবে ওঁকে। মাঝে মাঝে বিরক্তও হয় ওরা।
একদিন গ্রামের যুবক শাহেদ আলী এসে বললো, শওকত চাচা, বাড়িতে একা একা থাকেন। রাতে ভয় লাগে না? তাছাড়া ফুটফরমাস খাটারও কোনো লোক নাই আপনার।
শওকত আলী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, কী করতাম শাহেদ। পোলা দুইটার কাছে যাইতে ইচ্ছে করে না। শহরের বাড়িতে কেমন যেনো বন্দি মনে হয়!
তাড়াইল একটা বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে। খুব ভালো। আপনি ওখানে চলে যান। আপনার মতো যাদের তিন কূলে থেকেই কেউ নেই, ওরা ওখানে থাকছে। বেশ হাসিখুশি নিয়েই থাকছে ওরা।
তখন শওকত আলী কিছু না বললেও একদিন চলে গেলেন তাড়াইল বৃদ্ধাশ্রমটা দেখার জন্য। বৃদ্ধাশ্রমের নাম মায়ের কোল বৃদ্ধাশ্রম।
একদিন শওকত আলী বেঁচে থাকা ভাবি ও ভাতিজাদের বলে চলে এলেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। শওকত আলী বিন্দাস আছেন এখানে। নিজকে আর একা মনে হয় না এখানে। এখানকার সকলেই ওঁর মতো। তত্ত্বাবধায়ক যুবক থাকায় স্ত্রীসহ এখানেই আছেন পৃথক আবাসে। ওর দুটো বালক বয়সী ছেলেমেয়ে থাকায় বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সময় খুব আনন্দে কেটে যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক ও ওর স্ত্রী সবার কাছে পুত্র ও পুত্রবধূসম এবং সন্তান দুটো নাতি হয়ে গেছে আশ্রমের সকলের। তত্ত্বাবধায়কের নাম নাসির চৌধুরী এবং ওর স্ত্রীর নাম ফারজানা কাদের। ফারজানা কাদের বৃদ্ধাশ্রমের হিসাবরক্ষণের কাজ করেন। পাশাপাশি আশ্রিতদের দেখাশোনা করেন।
সপ্তাহে একদিন প্রত্যেকে নিজ জীবনের গল্প বলেন। শওকত আলীকেও বলতে হচ্ছে। শওকত আলী বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ায় সবাই ওঁকে সম্মান করে। তিনি বৃটিশ শাসন দেখেছেন, পাকিস্তানি শাসন দেখেছেন। কত পরিবর্তন হয়েছে এই দীর্ঘ সময়ে সামাজিক আর্থিক পারিবারিক স্নেহ-ভালোবাসার।
শওকত আলীর অধিকাংশ দাঁত পড়ে যাওয়ায় ওঁর কথা সবাই বুঝতে পারে না। ফারজানা শওকত আলীর কথা বেশ বুঝতে পারেন। শওকত আলী যখন জীবনের গল্প বলেন, তখন ফারজানা পাশে থেকে মাঝে মধ্যে দোভাষীর কাজ করেন। অনেক সময় শওকত আলীর কাছ থেকে শুনে পুরোটাই বলেন।

এখন বিকেল পাঁচটা। বৃদ্ধাশ্রমের একটা ছোট অডিটোরিয়াম আছে। ওখানে অপেক্ষা করছেন বৃদ্ধাশ্রমের সকলে শওকত আলীর জীবনের গল্প শোনার জন্য। গত সপ্তাহে তিনি ভূমিকা দিয়েছেন। তাঁর জন্ম বৃটিশ শাসনামলে। সেই ১৯২০ খৃস্টাব্দে। ওঁর জন্ম সাল শুনে সবাই চমকে উঠেছিলেন। এক জীবনে তিনটি শাসন দেখেছেন: বৃটিস, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ।

শওকত আলী লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে ধীরে হেঁটে আসছেন। পাশে হুইলচেয়ারটাও হাঁটছে। বেশি কাহিল হলে হুইলচেয়ারে বসেন। ওঁর পাশে আছে এক এটেন্ডেন্ট। এরেন্ডেন্টের নাম বশির উল্যা।

শওকত আলী অডিটোরিয়ামে ঢোকার সাথে সাথে সবাই দাঁড়িয়ে সালাম জানিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন। শওকত আলী ফোকলা দাঁতে মৃদু হেসে হাত নেড়ে সালামের জবাব দিলেন। একমাত্র চেয়ারটায় বসার সাথে সাথে দর্শক-শ্রোতার সারিতে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাগণ বসলেন। শওকত আলীর ডান পাশে এসে দাঁড়ালেন ফারজানা কাদের। শওকত আলী যা বলছেন তা ফারজান বুঝে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলছেন:

আমরা বারো ভাই, চার বোন ছিলাম। সবাই একটি ঘরে থাকতাম। টিনের চারচালা বেশ বড় ঘর। বড় বড় চৌকি ছিলো। তল্লার বেড়া দিয়ে মা-বাবা ও চার বোনের কক্ষ আলাদা করা ছিলো। আমরা বারো ভাই পাশাপাশি রাখা রাখা চারটি চৌকিতে তিন জন করে থাকতাম। ক্ষেতের ফসল, পুকুরের মাছ, খোঁয়ারের মুর্গি-ডিম, গোয়ালের গরু ও গাভীর দুধ। কোনো কিছু কিনতে হতো না, উল্টো অনেক কিছু বিক্রি করতাম হাটে নিয়ে।

এতো ছেলে থাকায় বাবার কোনো কামলা নিতে হতো না। বাবাসহ সবাই গায়ে কাদা মেখে ক্ষেত-খামারে কাজ করতাম। হাল চাষ শুরু করে বীজ বোনা, ধান রোয়া, নিড়ানি, পানি সেচা, পাটগাছ কাটা,পাকা ধান কাটা সব সব। কারো কখনো কোনো ক্লান্তি স্পর্শ করতো না। তখন শ্রাবন মাসে বন্যার পানি নেমে গেলে আমন ধানের চারা রোপনের জন্য খেস কামলা নেয়া হতো। শুধু আমন ধান রোপনের সময় না, ধান কাটা পাটগাছা কাটা, পাটগাছ পঁচে গেলে পাট তোলা, এরকম বিভিন্ন সময়ে খেস কামলা নেয়া হতো।

শ্রোতাদের একজন জিজ্ঞেস করলেন, খেস কামলা কী দাদু?

শওকত আলী বললেন, খেস কামলা হলো বিনা পারিশ্রমিকে একদিন গ্রামের সবাই একজনের কৃষিকাজ করে দেয়া। কাজটা একবেলার। যার কাজ করে দিবে সে দুপুরে ভালো খাবার দেবে। মাছ মাংস মাসকলাইয়ের ডাল, চাষনি।

এরপর আগের গল্পের রেশ ধরে শওকত আলী বলতে থাকেন, প্রথমে একে একে আমাদের চার বোনের বিয়ে দিলেন বাবা। বাবা ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে বিয়ে দিলেন চার মেয়েকে। ভগ্নিপতিরা সকলেই সম্পন্ন পরিবারের সন্তান এবং সকলেই কর্মঠ। আমার বোনগুলো সকলেই সুখী হলো সাংসারিক জীবনে। আম-কাঁঠালের সময়, শীতকালে এবং মাঝে মধ্যে ঈদে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেড়াতে আসে বোনেরা। আমরাও ইচ্ছে হলেই বেড়াতে চলে যেতাম ভগ্নিপতির বাড়িতে। বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাবার সময় নিজেদের গাছের ডাব বা অন্য কোনো ফল, পুকুরের বড় মাছ বা কখনো পিঠা নিয়ে যেতাম। ভাগ্নাভাগনিগুলাকে কাছে পেলে আমারও খুব ভালো লাগতো।

আমার এগারো ভাই কোনোদিন স্কুলে যান নি। তখন আমাদের গ্রামের চারপাশে বহুদূর পর্যন্ত কোনো স্কুল ছিলো না। ক অক্ষর গোমাংস ওদের সবার কাছে। একদিন শুনতে পেলাম আমাদের পাশের গ্রাম হরিগাতিতে একটি স্কুল হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটির নাম দিয়েছে হরিগাতী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আশেপাশের গ্রাম থেকে ঐ স্কুলে পড়ার জন্য ছেলেমেয়ে পাঠাতে হবে। আমি সবার ছোট থাকায় ও বয়স কম থাকায় বাবা আমাকে পাঠালেন স্কুলে। তখন আমার বয়স দশ। স্কুলে যেতে আমার একদম ইচ্ছে করছিলো না; কিন্তু বাবার নির্দেশ অমান্য করার সাহস ছিলো না আমার। কোনো মেয়ে গেলো না স্কুলে পড়তে। আমাদের গ্রাম থেকে আমার বয়সী পাঁচজন গেলেও সাত দিনের মধ্যে ছয়জন গেলো ঝরে। আমার বন্ধুরা খেলা করে আর আমি স্কুলে যাই। বাড়িতে সকাল সন্ধ্যা চিৎকার করে সর-অ সরে-আ পড়ি। শুদ্ধ করে পড়ছি না অশুদ্ধ পড়ছি ধরার কেউ নেই। পাঁচ বছর পড়ে ফেল্লাম ঐ স্কুলে। আশেপাশের গ্রামে কোনো উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় আমার আর পড়া হলো না। এই পাঁচ বছরে আমার আরো দুই ভায়ের বিয়ে হয়ে গেলো। আমার ভাইদের একে একে বিয়ে হচ্ছে, আর একই উঠানে একটা করে চারচালা টিনের ঘর উঠছে; কিন্তু রান্নার পাতিল আলাদা হচ্ছে না- তবে পাতিলের আকার বড় হতে লাগলো।

ছয় নম্বর ভাই-এর বিয়ের পরে বাবা একদিন ভোরে টিন পিটাতে লাগলেন। বাবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিতে চাইলে টিন পিটিয়ে সবাইকে ডাকতেন। পরিবারের সবাই উঠানে নেমে সারি ধরে দাঁড়ালাম।

বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললেন, সংসারে জনসংখ্যা বাড়তাছে। রান্ধনের পাতিল আর বড় করন যাইতো না। যাদের বিয়া হইছে তাদের পাতিল আলাদা হইবো আজ থাইকা। তবে কামকাজ ও রসদ এক জায়গায়ই থাকবো। বুঝা গেছে কথাটা!

আমরা সবাই মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

অর্থাৎ এই বাড়িতে আজ হতে রান্নার সুবিধার্থে পাতিল আলাদা হলেও সবাই একান্নেই থাকবে!

বাবার একটা শখের ষাঁড় ছিলো। ষাঁড়ের গায়ের রং ছিলো কালচে লাল। খুব চমৎকার দেখতে ষাঁড়টা। ষাঁড়টা শুধু বাবার না, আমাদের সব ভায়ের সমান প্রিয় ছিলো। ষাঁড়টা দিয়ে আমরা লড়াই দিতাম। আমন ধান উঠে যাবার পরে শীতকালে পতিত জমিতে ষাঁড়ের লড়াই-এর আয়োজন করা হতো। দূর-দূরান্ত থেকে ষাঁড় আসতো ঐ লড়াই-এ অংশ নেবার জন্য। ষাঁড়টা বরাবর জিতে আসছিলো। ষাঁড়টা লড়াই-এ জেতার পরে ওর গায়ে একটা লালশালু বেঁধে ঢোল বাজিয়ে বের হতাম নিজ ও আশেপাশের গাঁয়ে। প্রত্যেক বাড়ি যেতাম ষাঁড়টা নিয়ে। প্রত্যেকেই ষাঁড়ের গায়ে বাঁধা লালশালুতে এক টাকা দুই টাকার নোট সেফ্টিপিন দিয়ে গেঁথে দিতো।
এক বছর ষাঁড়টা লড়াই-এ গেলো হেরে। অনেকেই বলাবলি করতে লাগলো প্রতিপক্ষ আমাদের ষাঁড়ের উপর যাদু করেছে; যে কারণে আমাদের ষাঁড়টা লড়াই করতে পারে নি। রীতি অনুযায়ী আমরা পরদিন ষাঁড়টা জবাই করে মাংস বিলিয়ে দিলাম গাঁয়ে এবং অনেক খোঁজাখুঁজি করে আরো শক্তিশালী ও বড় একটা ষাঁড় কিনে আনলাম।
এদিকে একে একে আমাদের এগারো ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলো। এক ঘর থেকে আমাদের উঠানে এখন বারোটি ঘর এবং ভাতিজা-ভাতিজি-এ উঠান ভর্তি থাকে সারাদিন। এতো নাতিনাতনি পেয়ে বাবা-মা খুব খুশি; সারাদিন নাতিনাতনি নিয়েই থাকেন দু'জন।

এবার আমার বিয়ের পালা। বাবা লেখাপড়া জানা মেয়ে খুঁজতে লাগলেন এবং ভাটি এলাকায় রাট্টি গ্রামের মরিয়ম বেগম নামের এক মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। মরিয়ম বেগম আমার মতো পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি লেখাপড়া জানা মেয়েদের ঠাঁটই আলাদা। আমার ঘর আলাদা হবার সাথে সাথে মরিয়ম প্রচেষ্টা করতে থাকলো আমাকে সবার কাছ থেকে আলাদা করার।

একদিন রাতে শ্রান্তক্লান্ত মরিয়ম সুযোগ নেবার জন্য আমার নগ্ন বুকে নাক ঘষতে ঘষতে বললো, এতো বড় পরিবারে থাকতে আমার ভাল্লাগছে না! বাবাকে বইলা আলাদা হয়া যাও!

আমি চমকে বিছানায় উঠে হিসহিসিয়ে বললাম, এই কথা আর কুনুদিন মুখে আনবা না! বাবা মা যদ্দিন বাইচা আছে এই সংসার ভাংবো না! পাতিল আলাদা হইছে, ওইটা নিয়া সন্তুষ্ট থাকো!

মরিয়ম বেগম সংসার ভাংতে না পারলেও একটা কাজ ও আলাদা করে ফেললো। ইতোমধ্যে আমি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা হয়ে গেলাম। রাহেলা চার ছেলেমেয়েকেই স্কুলে পাঠালো। ওর দেখাদেখি আমার কোনো কোনো ভাইও সন্তানদের স্কুলে পাঠালেন। ক্লাশ ফাইভের পরে মেয়ে দুটাকে আর না পড়ালেও মরিয়মের আগ্রহে ছেলে দুটাকে লজিং থেকে পড়ার জন্য দূরের হাইস্কুলে ভর্তি করে দিলাম। বাবার আপত্তি বা নিষেধ কানে দিলাম না। শুরু হলো সংসার ভাংগনের সূত্রপাত।

ছেলে দুটো লেখাপড়া শিখে চাকরি নিয়ে চলে গেলো শহরে। অর্থাৎ না চাইলেও অঘোষিতভাবে আমার সংসার গেলো ভেংগে। ঐ ঘটনার পরের বছর হঠাৎ বাবা মারা গেলেন। এর ছ'মাস পরে গেলেন মা। আমার মা ও বাবা ছেলে নাতি নাতনীদের নিয়েই জীবন যাপন করে গেলেন অত্যন্ত হাসিখুশি ভাবে। তখন গ্রামের হালই এমন ছিলো। যে দিন আনতে দিন খায় সেও একই উঠানে ঘর করে ছেলেপুলে নাতি নাতনি নিয়ে দিন যাপন করতো অত্যন্ত হাসিখুশিভাবে। এবং একদিন হঠাৎ মরে যেতো। তখন মানুষের এতো জটিল রোগবালাই হতো না। সর্দিগর্মি, কখনো কলেরা বা ম্যালেরিয়া হতো।

শওকত আলী হাপিয়ে উঠলে ফারজানা কাদের বললেন, দাদু আজ হাপিয়ে উঠেছেন। আজ এ পর্যন্তই। আবার দাদুর টার্ণের দিন দাদু বাকি গল্প বলবেন।

এ ক’দিন শওকত আলী বিশ্রাম নিয়েছেন এবং অন্যান্যদের জীবনের গল্প শুনেছেন। সবার গল্প প্রায় একই রকম এবং আপনজনের নিকট থেকে বঞ্চনার গল্প। আজ শওকত আলী জীবনের বাকি গল্প বলবেন। সবাই অপেক্ষা করছেন।

শওকত আলী বললেন, বয়স হয়েছে তো, সব কথা মনে থাকে না। তখন আমাদের রোগ-বালাই কম হওয়ার কারণ হলো আমরা জমিতে কখনো কেমিক্যাল সার যেমন ইউরিয়া পটাশ এসব সার দিতাম না। দিবো কোত্থেকে! তখন এসব সার ছিলোই না! প্রাকৃতিক সার দিতাম যেটাকে এখন জৈব সার বলা হচ্ছে। গোবর, ছাই, আগাছা পঁচানো সার ইত্যাদি। তখন সবার বাড়িতেই এক বা একাধিক গরু থাকতো। যার কোনো ক্ষেত ছিলো না, সেও একটা গাইগরু পালতো দুধ বিক্রি করার জন্য। কেউ কেউ ছোট বাছুর পালতো বড় করে বিক্রি করার জন্য। সবাই বাড়ির বাইরে আঙ্গিনায় গর্ত করে গোবর ফেলতো। বছর ধরে ওখানে গোবর ফেলা হতো, তাতে গোবর পঁচে শুকিয়ে সার হয়ে যেতো। সবাই রান্না করতো লাকড়ি বা খড় দিয়ে। আমন ধান তোলার পরে লম্বা খড় রান্নার জন্যই রাখা হতো। গোবরের মতো এই ছাইও জমিয়ে রাখা হতো গর্ত করে। পুকুর বা বিলের পানা আগাছাও জমিয়ে রাখা হতো। আমন ধান তোলার পরে গোবর ছাই বা আগাছার সার খলুই-এ করে ক্ষেতে স্তুপ করে রাখা হতো। প্রতিটি ক্ষেত কমপক্ষে দুইবার চষার পরে সার ছড়িয়ে দেয়া হতো। এই প্রাকৃতিক বা জৈব সারে উৎপন্ন ফসলে কারো কোনো রোগ হতো না। এখন জৈব সারের প্রয়োগ প্রায় উঠেই গেছে। অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য দেদারসে প্রয়োগ করা হচ্ছে রাসায়নিক সার এবং মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন দুরারোগ্য ব্যাধিতে। বৃটিস আমলে, পাকিস্তান আমলেও এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও মাছ ধরায় কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিলো না। কোনো বিল নদী লিজ দেয়া হতো না। উন্মুক্ত জলাশয় সবার জন্য খোলা ছিলো। যে যেখানে যত খুশি মাছ ধরতে পারতো। আমন ধান তোলার পরে কৃষকের হাতে কোনো কাজ থাকে না। তখন চলতো মাছ মারা। অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে চালডাল নিয়ে বড় বড় বিলে চলে আসতো মাছ ধরতে। দৈনিক মাছ ধরে কেটে সেখানেই শুকাতে দিতো। একদিন হতো বাইস। পনেরো-বিশ দিন বা এক মাস আগে হতে হাটবাজারে চোঙা দিয়ে ঘোষণা দেয়া হতো এই বাইসের। আমি প্রতিবার যাইতাম ঐ বাইসে। পলো দিয়া মাছ ধরতে আমার খুব ভালো লাগতো। শোল গজার রুই পুরাতন মাগুর মাছ পড়তো পলোয়। শিং মাছ পড়লে কখনো ধরতাম না। শিং মাছের গালা খুব ব্যথা করে। মাঝে মধ্যে হাত দিয়াও মাছ ধরতাম। খুব আফসোস হয় ঐসব দিনের জন্য!

এদিকে আমাদের মেয়েরা বড় হতে থাকলো। বিয়ে দেয়া দরকার। নিজেও ছেলের খোঁজ করছি, ঘটকেও খোঁজের দায়িত্ব দিলাম।

একসময় মেয়ে দুটাকে গ্রামেই ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিলাম। কিন্তু ছেলে দুটো নিজ পছন্দমতো শহুরে পরিবারে বিয়ে করলো। ছেলেদের গ্রামে আসা কমতে লাগলো। আমি মাঝেমধ্যে ছেলেদের কাছে গেলেও এক দুইদিনের বেশি থাকতে পারতাম না। শহরের চার দেয়ালের বন্দি জীবন আমার কাছে ভালো লাগতো না। দুই ঈদে ছেলেরা বাড়িতে আসতো; কিন্তু নাতিগুলো দুই দিন পরেই যাই যাই করতে থাকতো। গ্রামে বিদ্যুৎ নাই, গরম ওদের ভালো লাগে না!

আমি মরিয়মকে নিয়ে গ্রামে ভালোই ছিলাম। দুই জনে সুখদুখের কথাবার্তা বলে সময় পার করতে থাকলাম। একদিন শুনলাম এক নাতি লেখাপড়া করতে বিদেশ চলে গেছে। এভাবে সব নাতিনাতনি চলে গেলো বিদেশ। আমার দুই ছেলে আমার মতোই হয়ে গেলো একা। নাতিনাতনিরা বিদেশে লেখাপড়া শেষে চাকরি নিলো বিদেশেই। বিদেশিনী বিয়ে করে ওখানেই স্থায়ী হয়ে গেলো। নাতবৌ ও নাতনিজামাই দেখার আফসোস নিয়ে মরিয়ম বেগম একদিন হার্টএটাকে মারা গেলো।

ছেলে দুটো ওদের ছেলেদের পীড়াপীড়িতে চলে গেলো বিদেশ। কিন্তু বেশিদিন ওদের সাথে থাকতে পারলো না। বৌদের পরামর্শে ওরা ওদের মা-বাবাকে ঐসব দেশের ওল্ডহোমে রেখে দিলো।

ছেলে দুটো ঐ দেশের ওল্ডহোম থেকে মাঝে মধ্যে আমাকে ফোন করে কাঁদে। বলে, বাবা, আমাকে তোমাকর কাছে নিয়ে চলো। আমরা আবার একান্নে থাকবো!

আমি কোনো জবাব দিতে পারি না। তবে মনে মনে বলি, আমি লেখাপড়া না শিখলে শিক্ষিত বৌ ঘরে আসতো না এবং তখন আমার সংসারের এই দশা হতো না!

এক সপ্তাহ পরে শওকত আলী রাতে মারা গেলেন। সকালে এটেন্ডেন্ট ওঁকে ডাকতে গিয়ে শরীর শক্ত দেখতে পেয়ে চিৎকার দিয়ে সবাইকে জড়ো করে ফেললো। বিদেশে ছেলেদের খবর দিলে কেউ ওঁকে শেষ দেখা দেখতে বা নিতে আসতে পারলো না। শওকত আলীর মৃতদেহ হিমঘরে রেখে ওঁর গ্রামের আত্মীয়দের খবর দিলে পরদিন দুই ভাতিজা এসে অনেক কান্নাকাটি করলো। কাঁদতে কাঁদতে লাশ নিয়ে চলে গেলো গ্রামের বাড়ি পারিবারিক গোরস্তানে কবর দিতে।
...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment