1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, April 13, 2023

তুমি এলে তাই



তুমি এলে তাই

মৌসম সামন্ত (অসুর)

আজ সদ্যভোরে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ঋতজার কান্নাভেজা চোখে, গালে সোহাগ চুম্বন এঁকে দিয়ে বলেছিল, ” দূর পাগলী, আউট অফ সাইট হলেই কি আউট অব মাইন্ড হয়? আমি তো তোমার মনের মধ্যেই আছি। যখনই চোখ বুঝে আমায় অনুভব করবে, দেখবে আমি তোমায় জড়িয়ে রয়েছি আমার বুকের ওমে।”

কথাটা শেষ করেই ও ঋতজাকে বাহুডোরে আটকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। নিজে মুখ গুঁজে দিয়েছিল  ঋতজার চুলে। ভোরের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ভেসে আসা ঋতজার চুলের মিষ্টি গন্ধে বিভোর হয়েছিল ও। ঋতজা ঘাড় ঘুরিয়ে লক্ষ্য করেছিল ওর মুখের অভিব্যক্তি। পরম নির্ভরতায় আর ভালোলাগার আবেশে একাকার হয়ে  স্মিতহাস্যে ঋতজা বলেছিল, “থাক, থাক, অনেক  হয়েছে। আর ওমে জড়িয়ে রাখতে হবে না। এবারে ফ্লাইট মিস হবে কিন্তু।”

” প্লিজ, আরেকটু…”.. আসন্ন বিদায় লগ্নে কাতর আর্তি ধরা  পড়েছিল ঋদ্ধির গলায়।

ভালোবাসার অধিকার মেশানো হরেকরকম ডু’স আর ডোন্ট’স এর মৌখিক তালিকা শুনিয়ে দিয়ে আর শেষে দুই গালে পেলব ঠোঁটের  অজস্র সোহাগী চুমু উপহার দিয়ে বিদায় জানিয়েছিল ঋদ্ধিকে।

সেইসব ঘটনা মনে করতেই সলজ্জ হেসে ঋদ্ধি বলে, "আমার পাগলীটার জন্য আমায় খুব তাড়াতাড়ি ফিরতেই হবে। মিস ইউ আ লট ঋতু।”

তিনবছরের টক-ঝাল-মিষ্টি প্রেমপর্ব চুটিয়ে উপভোগ করেছিল দুজনে। এরপর ঋদ্ধির U.S.A তে চাকরির অফার আসতেই দু’বাড়ির  সিদ্ধান্তে তড়িঘড়ি দুজনের চারহাত এক হয়ে গিয়েছিল। ঋতজা শহরের এক স্বনামধন্য  হাসপাতালের ডাক্তার। স্বাধীনচেতা ও নিজের পেশার প্রতি সম্পূর্ণ সৎ ও দায়িত্ববান। ঋদ্ধি– দু’চোখে অজস্র স্বপ্নের ডালি সাজানো, উচ্চাকাঙ্খী এক তরুণ। দুজনের স্বপ্ন তাদের নিজের নিজের অভীষ্ট  পথে বেশ ভালোই এগোচ্ছিল। তখনও পৃথিবীটা বাঁচার মতো অল্প হলেও সুস্থ ছিল, তার ফুসফুসে মারণ করোনাসুর নিজের আধিপত্য বিস্তার করেনি।  সারাদিন কাজের পর বাড়ি ফিরে ঋতজার ক্লান্তি অনায়াসে দূর হতো ঋদ্ধির গলার স্বরে। সহস্র যোজন ভৌগোলিক ব্যবধান মুছে যেত দুজনের ভিতরের জমে থাকা অজস্র কথা ও অনুভূতির স্বতস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশে। শারীরিক চাহিদা অনেকাংশে প্রশমিত হত  ভিডিও কলের দুজনের হাসিমুখের মিষ্টি খুনসুটিতে।

কিন্তু নিয়তির লিখন খন্ডাবে কে? মারণ ভাইরাসের তান্ডবের জন্য দুমাস পরেই দেশজুড়ে ঘোষণা হল লকডাউন। আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল নিষিদ্ধ হওয়ায় আটকে গেল ঋদ্ধি। যেদিন কলকাতা ফিরবে বলে ঠিক ছিল, তার দুদিন আগেই আচমকা বদলে গেল গোটা পৃথিবীটা। ভীষণ অস্থির লাগছিল ঋদ্ধির। নিজের কষ্ট আর অসহায়তাকে অকপটে ঋতজার সামনে মেলে ধরে ও। দিনের পর দিন  ওয়ার্ক ফ্রম হোম এর বিশাল চাপ, বন্দীদশা, প্রিয়তমার শরীরী ঘ্রাণের অনুপস্থিতি সবকিছু মিলিয়ে হতাশাগ্রস্ত ঋদ্ধিকে খেয়ে ফেলে মনের হাজার একটা অসুখ পোকা। ও মাঝে মাঝে বলেই ফেলে, "ঋতু, আমার খুব, খুব ভয় করছে। তোমার সাথে আবার দেখা হবে তো? তোমাকে ছাড়া আর পারছি না।”

ঋদ্ধির কথায় বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলেও, হঠাৎ পেয়ে যাওয়া কান্না গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠে আসলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ও। কাজের ফাঁকের সামান্য একটু অবসরে নিজের পিপিই কিট, ফেস শিল্ড, গ্লাভস পরা চেহারাটা ফোনে ওকে দেখিয়ে বলে, "শক্ত হও ঋদ্ধি, আমাকে দেখো, কীভাবে আমি লড়াই করছি দিনের পর দিন। আমার কষ্টটা অনুভব করো, দেখবে তোমার সব কষ্ট নিমেষে দূর হয়ে যাবে। মনের অসুখের ভাইরাসকে মারা যায় না ঋদ্ধি, ওটা তোমাকেই মারতে হবে- তোমার ঋতজার জন্যই।"

সবকিছু আর ঠিক হয়নি ঋদ্ধির।  আকস্মিক ছন্দপতন ঘটে  দুমাস পরে। সকালে কাজে বেরোনোর আগে ঋতজা যখন সবে স্নান সেরে খোলা চুলে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল তখন ও অনুভব করল  ঋদ্ধি যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে তার চুলের ঘ্রাণ দুই ফুসফুস ভরে গ্রহণ করছে। সে অনুভব করল ঋদ্ধির বাহুবেষ্টনীতে পরম সুখে নিজেকে বিলীন করেছে। ঋদ্ধি যেন মুগ্ধ হয়ে দেখছে একফালি রোদ্দুর তার চুলের জলে প্রতিফলিত হয়ে সকালের শোভাটাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। আচমকা  ফোনে দুঃসংবাদ-  ঋদ্ধিকে তার ঘর থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে! একনিমিষে যেন জীবনে অমাবস্যার গ্রহণ নেমে এল।  সব রোদ্দুর মুছে গিয়ে তার পৃথিবীটা নিকষ আঁধারে নিমজ্জিত হল। মুখ ফুটে আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো মানসিক স্থিতি অবশিষ্ট রইল না। কিছু কথা কানে ঢুকল, কিছু মিলিয়ে গেল। চিত্রার্পিতের মতো শুধু ফোনের ওপার থেকে শুনে চলল, "লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়ে মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছিল ঋদ্ধি। অন্য জায়গায় আর চেষ্টাও করেনি। তবে খালি আপনার কথা বলত ও, খুব প্রশংসাও করতো। হ্যালো, হ্যালো…  আপনি শুনতে পাচ্ছেন…।"

এপারের শ্রোতার অপার নিস্তব্ধতায়,  একসময় ফোনটা কেটে গেল।  সামান্য অশ্রুবাষ্প তো দূর অস্ত, কান্নার ফোঁপানির আওয়াজও গলা থেকে বেরোলো না। কতক্ষণ এইভাবে কেটেছে তার খেয়াল রইল না।  সম্বিত ফিরল হসপিটাল থেকে আসা ফোনে- "এক্ষুনি যেতে হবে, ইমার্জেন্সিতে রোগী এসেছে। ইমিডিয়েট ওটি।"

অদৃশ্য চালিকাশক্তিতে ভর করে  ঋতজা বেরিয়ে গেল নিজের কর্তব্যপালনে।

এরপর কেটে গেল আরো কয়েক মাস।  সেবার  ব্রত পালন করতে হবে বলে নিজের দেহটাকে শুধু বাঁচিয়ে রেখেছে ঋতজা। এখন রোদ্দুর বড় অসহ্য লাগে ওর। তার মনের আকাশ জুড়ে বর্ষার কালো মেঘের আনাগোনা। যেন কতদিনের রোদ না ঢোকা স্যাঁতস্যাঁতে গুমোট পরিস্থিতি সেখানে। ঋদ্ধির ছবি দেওয়াল থেকে সরে গেছে অনেক দিন হল। আজ অনেকদিন পর একটু ছুটি নিয়েছে কর্তব্য থেকে নিজের সাথে একলা একটু সময় কাটাবে বলে। ঘরের এককোণে অবহেলায় পড়ে থাকা অতি সাধের গিটারটাকে ধূলো ঝেড়ে আবার সুর তুলল তাতে। তারের সাথে আঙুলের নিবিড় সখ্যতা গড়ে উঠল। সুরের মূর্ছনায় গেয়ে উঠল –"তোলো ছিন্নবীণা বাঁধো নতুন তারে, ভরে নাও সুর গাও জীবনের জয়গান।” ছিন্নবীণার তার নতুন করে বাঁধার চেষ্টা অন্তর্যামী ছাড়াও আরেকজন হয়তো হাসিমুখে  অলক্ষ্যে থেকে লক্ষ্য করল!

সকাল থেকে শরীরটা বিশেষ ভালো না লাগলেও টুকটাক কিছু দরকারে বেরোতেই হল ঋতজাকে। বড় রাস্তায় উঠে  ট্যাক্সি ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাথাটা টলে গেল যেন। মাথার ওপরের রোদ্দুরটা যেন জ্বালা ধরিয়ে দিল। দু’পা সামনে এগোতেই ওর গোটা পৃথিবীটাই যেন দুলে উঠল। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে অনুভব করল কেউ যেন তাকে পিছন থেকে জাপ্টে ধরল দু’হাত দিয়ে। প্রায় ঝাপসা দুটো চোখে তাকে একবার দেখে জ্ঞান হারাল ঋতজা।

"কেমন লাগছে ডক্টর? কি বিপদটাই না বাঁধাতে যাচ্ছিলেন আজ।”

জ্ঞান ফিরে পেয়ে প্রশ্নকর্তার দিকে মুখ তুলে তাকাল ঋতজা। দেখল এক যুবককে। রিমলেস চশমার ভিতরে একজোড়া  শাণিত উজ্জ্বল দৃষ্টি।  ধবধবে সাদা শার্ট আর জিন্সে হালকা ভারিক্কি চেহারাটা একটা আলাদা সম্ভ্রম জাগায় প্রথম দৃষ্টিতেই। ফর্সা মুখমন্ডলের সাথে মানানসই ঘন ট্রিমড দাড়ি ব্যক্তিত্বে আলাদা মাত্রা যোগ হয়েছে। বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই ।

ও ক্লান্ত ভাবে উত্তর দিল, "ভালো, অনেকটা ভালো। কিন্তু আমার কি হয়েছিল? আমি এই হসপিটালে!..”

"উনিই আপনাকে আজ বাঁচিয়েছেন বড় দূর্ঘটনার হাত থেকে। আপনি  মাথা ঘুরে রাস্তার মাঝে পড়ে যাচ্ছিলেন। আপনার বি.পি অনেক লো হয়ে গিয়েছিল, তার জেরেই এই বিপত্তি। আপনার রেস্ট দরকার একটু।” – কর্তব্যরত নার্স জবাব দিয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে গেলেন।

নার্সের কথাগুলো শোনার পর প্রশ্নকর্তার সামনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল ঋতজা। তাঁকে উদ্দেশ্য করে নীচু স্বরেই বলল, "সরি, ভেরি সরি আমার জন্য আপনাকে এতটা দুর্ভোগ পোহাতে হল। আমারই আজ বেরোনো উচিত হয়নি এই শরীরে। আপনার কাছে কৃতজ্ঞতার…”

"এবারে কিন্তু আমায় বড্ড লজ্জায় ফেলে দিচ্ছেন।  আমি কি এমন বড় কাজ করেছি ডক্টর? তাছাড়াও আমার সাথে আরো কয়েকজন ছিল যাদের সাহায্যে আপনাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা গেছে। যাই হোক ছাড়ুন সেকথা। পেশেন্টের কেয়ার করতে করতে নিজের কেয়ারটা ভুলে যাচ্ছেন কেন? এবার থেকে নিজের যত্ন নেবেন যেন। আচ্ছা আমি আসি এখন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

প্রথম পরিচয়েই কথার মধ্যে এমন অকৃত্রিম আন্তরিকতার ছোঁয়ায় আপ্লুত হল ঋতজা।

"একমিনিট প্লিজ। যে আমায় আজ বাঁচালো, তার নামটা কি জানতে পারি?”- একরাশ কৌতূহল আর কৃতজ্ঞতা মেশানো মুখভঙ্গী নিয়ে বেড থেকে উঠে এসে  দাঁড়াল ঋতজা। যুবকটি স্মিত হেসে বলল, "আমি নৈঋত। নৈঋত মুখার্জী।  আপনি আমায় ভুলে গেছেন অনেকর ভীড়ে। কিন্তু আমি আপনাকে মনে রেখেছি। আজ থেকে পাঁচমাস আগে যে পেশেন্টের সার্জারি করিয়েও আপনাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছিল, আমি তার হতভাগ্য স্বামী।”

বলেই মাথা নীচু করে নিল নৈঋত । লুকানো কষ্ট আড়াল করতেই হয়তো। ওর দিকে আর মাথা উঁচু করে তাকানোর সাহস পেল না ঋতজা। ওকে অস্ফুটে কিছু বলতে চেয়েও পারল না। আচমকা অপরাধবোধে বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগল। তার মনে পড়ে গেল, পাঁচ মাস আগের সেই দিনটা। ঋদ্ধির মৃত্যুসংবাদ ফোনে পেয়েও সেই শোক বুকে চেপে রেখে সেদিন সার্জারিটা করেছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।  ছাইচাপা হয়ে থাকা আগুনটা আবারও দগ্ধ করতে শুরু করল ঋতজাকে।

– সেইদিন আমি সত্যিই  নিজের বেস্টটা দিতে পারিনি। আমায় ক্ষমা করে দিন নৈঋত। আপনার স্ত্রীকে  আপনার থেকে কেড়ে নিয়েছি।

ঋতজার অলক্ষেই  ভগবান তার আর নৈঋত এর জীবন সেইদিনেই একবিন্দুতে দাঁড় সমাপতিত করেছিলেন।

"কিছু ভাবছেন ম্যাম? কিছু বলবেন? আমায় এবার যেতে হবে। আসি?” – ঋতজার ভাবনার জাল ছিন্ন করতে কথাটা বলল নৈঋত।

চিন্তার জাল কেটে ঋতজা মৃদু ও শান্ত স্বরে বলল, "আপনি এর পরেও আমায় মনে রেখেছেন? আপনার তো আমার প্রতি রাগ পুষে রাখার কথা। তার বদলে… এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। আপনি সত্যিই আলাদা, খুব ভালো আপনি।”

"ভালো! তাই বুঝি?..  কি লাভ ভালো হয়ে? আর রাগের কথা বলছেন! সেতো রেগে আছি এখনো ওর ওপরে। দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীর দিনে আমায় ফেলে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। খুব স্বার্থপর ছিল ও! জানেন? খালি নিজেরটা বুঝত। তাই তো  সধবা হয়ে চিতায় ওঠার জোরালো দাবিটা ঠিক পূরণ করেই ছাড়ল ভগবানের থেকে। ওরা বোঝে না যে, যাকে রেখে যায় সে সারাজীবন কিভাবে স্মৃতিভারে কাটাবে?…"

এরপর আর কোনও কথা বলল না নৈঋত।  তাকালো  না ঋতজার দিকেও। ঋতজা নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। আপাতকঠিন পেশাদারিত্ব মোড়কের ভিতরের মানুষটা  ভেঙে চুরমার হতে লাগল। নৈঋত এর বলা কথাগুলো ঋতজার হৃদয়ে  সহস্র ঊর্মিমালার মতো আছড়ে পড়তে লাগল বারংবার।

দুপুরে  হসপিটালে  ঢোকার সময় ঋতজা খেয়াল করল  কাঁচঢাকা একটা দুধসাদা গাড়ি তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের দিকে।  গাড়ির ভেতরের লোকটাকে একঝলক দেখেই   থমকে দাঁড়িয়ে গেল ঋতজা।

খুব চেনা মনে হল যেন,  নৈঋত এর মতো! নৈঋতই? ঠিক দেখলাম তো?…..  হ্যাঁ, হ্যাঁ,  নৈঋত। আমার চোখ ভুল হতে পারে না। আর ওই মুখটাকে তো নয়ই… নাহ্, এসব ভেবে আর সময় নষ্ট নয়।

নিজের মনেই বিড়বিড় করতে করতে কার্ডিওলজি আউটডোরে গিয়ে ঢুকল।

আউটডোর শেষ করে ওয়ার্ডে ভিজিট করতে গিয়েই চমকে গেল ঋতজা। পেশেন্টদের কেস হিস্ট্রি মনযোগ দিয়ে দেখছে নৈঋত! সারা শরীরে প্রবল বিদ্যুৎতরঙ্গ বয়ে গেল ঋতজার– ডক্টর নৈঋত! আমার সাথে একই হসপিটালে!

"গুড আফটারনুন ম্যাডাম। ভালো আছেন এখন?”

হঠাৎই ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে ঋতজার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল নৈঋত। সরাসরি ঋতজার দিকে নিবদ্ধ হল একজোড়া স্নিগ্ধ দৃষ্টি।

"অনেকটা ভালো। আপনি এখানে, মানে কবে থেকে?”

স্মিত হেসে ফেলল নৈঋত। ঋতজার সারা মুখে বিষ্ময়ের অভিব্যক্তি দেখে। "চারদিন আগে আপনার সাথে পরিচিত হওয়া এই সাধারণ মানুষটি এখন এই হসপিটালে কার্ডিও ডিপার্টমেন্ট এর প্রফেসর। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ থেকে ট্রান্সফার হয়ে সেইদিন আমি এই হসপিটালে জয়েন করতে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় আপনাকে ওই অবস্থায় ফেলে কিভাবে কাজে যেতাম বলুন?....” ঋতজা লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলছিল প্রায়। নিজেকে সামলে সৌহার্দ্যসূচক করমর্দন করে বললো, "ওয়ার্ম ওয়েলকাম ডঃ মুখার্জি।”

"ইটস্ মাই  প্লেজার ডঃ সেন।”

“স্যার, এক্ষুনি আই.সি. ইউ তে চলুন। তিন নম্বর বেডের পেশেন্ট এর কন্ডিশন ডেটোরিয়েট করছে।” – কয়েকজন নার্স তড়িঘড়ি করে ডাকতে এল ডঃ মুখার্জিকে।

"ওকে! শিয়োর।”

দৃপ্ত  ভঙ্গীতে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গেলেন ডঃ মুখার্জি। ঋতজা তাকিয়ে রইল মুগ্ধ দৃষ্টিতে।

"এভাবে আর কদ্দিন চলবে রে মা? আমাদের কাছে ফিরে চল। তোর বাবা বলে পাঠিয়েছে আজ যেন আমি তোকে নিয়ে বাড়ি ফিরি। ছেড়ে দে এই ফ্ল্যাট। চল মা, চল।”

মৌমিতা দেবী, ঋতজার মা অনুনয়ের সুরে কথাগুলো বললেন মেয়েকে। ঋদ্ধির মৃত্যু সংবাদ শোনার পরই উনি আসতে চেয়েছিলেন। থাকতে চেয়েছিলেন মেয়ের পাশে। মেয়েই বারণ করেছিল।কিন্তু ছ’মাস পর নিজেই চলে এলেন মেয়ের কাছে।  স্বাধীনচেতা মেয়ের দৃঢ় ব্যক্তিত্বের জন্য তার কাছে জোর করে কিছু বলতেও পারেন না। ছোট থেকেই মেয়ের স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন বাধা দেননি তিনি। কিন্তু আজ তিনি নিরুপায়।

 "কিরে, তোকে কিছু বলছি তো না কি? নিজের জীবনটা একা একাই কাটাবি?”

কার্ডিওভাস্কুলার সার্জারির ওপর লেখা বইতে একনিবিষ্ট মনে মুখ গুঁজে থাকা ঋতজা এবারে মুখ তুলল। যেন কিছুই শোনেনি এমন ভাব করে বলল, "হুম, বলো কি বলছিলে?”

"ভান করিস না, মামন। তুই শুনেছিস আমি জানি।”

"তুমি বাবাকে আনলে না কেন? তাহলে দুজনে মিলে বোঝানোটা জোরদার হত। একা পারবে? যাক্, ছাড়ো। তুমি বসো, আমি ব্রেকফাস্ট বানিয়ে আনি। একসাথে খেয়ে আমিও বেরোবো।”

কথাগুলোর মধ্যে এমন শীতল নির্লিপ্ততা ছিল যা বিস্ময়ে স্তব্ধ করে দিল মৌমিতা দেবীকে। উষ্মা প্রকাশ করে মেয়ের দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, "মামন!… মনে রাখিস, তুই বড় ডাক্তার হতে পারিস কিন্তু আমি তোর মা। এভাবে তুই কথা বলতে পারিস না।”

"মা, একই কথা অনেকবার শুনেছি। আমি ক্লান্ত। এই দেখ, ব্যালকনির টবে ফোটা ফুলের মধ্যে ঋদ্ধি, ডাইনিং এর অগোছালো জিনিসের মধ্যে ঋদ্ধি, ডোর কার্টেন, উইন্ডো কার্টেন, কিচেনের স্ল্যাব,.. সব সব, সব জায়গায় ঋদ্ধি। থ্রি বি.এইচ. কে ফ্ল্যাটের প্রতিটা কোণায় কোণায় আমি ঋদ্ধিকে দেখি, অনুভব করি দু’চোখ বুজলেই। আমাকে ওর থেকে আলাদা  খুঁজে পাই। এটাকে ছেড়ে গেলে ঋদ্ধিকে আমি হারিয়ে ফেলব। মা প্লিজ!”

এরপরই ঋদ্ধির উদ্দেশ্যে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে , “ঋদ্ধি, পায়ে পায়ে ছায়ার মতন ঘুড়ে ফেরে তোমারই স্মৃতি আমি আগলাতেও পারি না, ফেলতেও পারি না। কি করব আমি? বলো কি করব?” চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই লুটিয়ে পড়ল ঋতজা। ছ’মাস পর এই প্রথম এতটা কাঁদল ও। কঠোর ব্যক্তিত্বের খোলোসের ভিতরের আঘাতপ্রাপ্ত হৃদয়টা নগ্নরূপে প্রকাশিত হল মায়ের সামনে। স্থবির চিত্তে সেটা হৃদয়ঙ্গম করা ছাড়া মৌমিতা দেবীর আর কিছু করার রইল না। ” সিস্টার? ডঃসেন কে একটু ডেকে পাঠান তো আমার কেবিনে। একটা ক্রিটিকাল কেস নিয়ে ডিসকাস করব। কাল আমি আসব না। ওনাকে বুঝিয়ে দেব আজ।”– ডঃ মুখার্জি  বলল।

 "ঋতজা ম্যাম আজ আসেননি। গতকালও তো আসেননি।”

"হোয়াট!! উনি তো ইনফর্ম না করে অফ করেন না।  কি হল ওনার?”

সাথে সাথে ফোন করল ঋতজাকে। প্রায় কেটে যাওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে রিসিভ করল ঋতজা। খুব ক্লান্ত ও ম্রিয়মাণ স্বরে নিজের শারীরিক অবস্থার কথা জানাল ও।

দুশ্চিন্তার ছাপ ধরা পড়ল ডঃ মুখার্জির মুখে। ঠিক যেমনটা কোনো প্রিয়জনের জন্য হয়। সবটা শুনে গম্ভীর গলায় বললেন, “আজই কোভিড টেস্ট করান আপনি। আর দেরি নয়। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনার কমপ্লেক্সের অ্যাড্রেসটা বলুন।”

"ব্যস্ত হবেন না, আমি কালই যাচ্ছি।আজ রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কাল খুব ভাইটাল কেস আমি জানি।”

"আপনার লাইফটাও নিজের কাছে ভাইটাল। আর কোনও কথা নয়। রাখছি।”

রিপোর্ট পজিটিভ এল ঋতজার। হোম কোয়ারান্টাইন এ  বন্দী দিনগুলো হয়ে উঠল যন্ত্রণার। সেই যন্ত্রনার উপশমে সেরা ওষুধ হয়ে উঠল রোজ নৈঋত এর ফোন– কেমন আছেন আজ? জ্বর কমেছে? ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া করছেন? সবসময় পজিটিভ চিন্তা করুন। চিন্তা কি? আমি তো….আমরা তো আছি সবাই। প্রতিটা শব্দ সাজানো থাকত অনেক যত্ন আর ভালোবাসায়। যার ঝর্নাতলে আপাদমস্তক ভিজতো ও। প্রতিবার নৈঋত এর ফোন রিসিভ করার সময় হাত কাঁপত ওর। মনে মনে বিড়বিড় করত; ঈশ্বর আমায় শক্তি দাও, নৈঋত এর প্রতি কোনো দুর্বলতা যেন আমার মধ্যে বাসা বাঁধতে না পারে। যেদিন নৈঋত ফোনে জানালো, "আপনাকে খাবারের চিন্তা করতে হবে না। আমি দু’দিন ছাড়া বাজার করে পাঠিয়ে দেব। আমার লোক গিয়ে দিয়ে যাবে। জানালা থেকে ঝোলানো ব্যাগে। এরপরেও কিছু লাগলে বলবেন নিঃসংকোচে।"

ঋতজা নিরুপায় হয়ে  প্রতিবাদ করে বলল,    "প্লিজ, ডঃ মুখার্জি আর ঋণের ভার নিতে পারছি না। এমনটা আর করবেন না। এতটাই সংকোচে ফেলে দিলেন, নিঃসংকোচ আর থাকি কি করে?”

"নিজের স্বামীর স্মৃতিভার তো বয়ে বেড়াচ্ছেন। ঋণের ভার কি এর চেয়েও বেশি? মনে হয় না”।

আর উত্তর দিতে পারল না ঋতজা। শুধু দৃঢ় মুষ্টিভরে নিজের মনকে শাসন করল এই বলে যে, ঋণের ভারে ঋদ্ধির স্মৃতিভার যেন কবরস্থ না হতে পারে! ডিনার শেষ করে সবে সোফায় বসে একটা গল্পের বইতে মুখ ডুবিয়ে বসেছেন ডঃ নৈঋত। ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটা ছুঁয়েছে। কয়েকপাতা পড়ার পড়েই ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল ঋতজা নামটা। একমুহূর্ত দেরি না করে রিসিভ করলেন। ফোনের ওপার থেকে শুনতে পেলেন ঋতজার ক্ষীণ গলা। "স্যার, আচমকা আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে, খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। হাতের  কাছে ফোন অথচ অ্যাম্বুলেন্স বুক করার ক্ষমতাটুকু নেই….আমার সময় শেষ হয়ে আসছে স্যার।

"ঋতজা, ঋতজা? কি হল আপনার? কথা বলুন। কিচ্ছু হবে না আপনার। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে।”

প্রিয়জনকে হারানোর আশঙ্কায় কারুর ভিতরটা যেমন মোচড় দিয়ে ওঠে, ডঃ মুখার্জি ঠিক সেই অবস্থা অনুভব করলেন নিজের ভেতরে। নিজের অজান্তেই, আপনির বেড়া ডিঙিয়ে বলে ফেললেন, "তোমার কিচ্ছু হতে দেব না, আমি। আমার প্রাণ থাকতে তো নয়।"

দীর্ঘ  কুড়ি দিন জীবন-মৃত্যুর লুকোচুরি খেলায় অবশেষে জয়লাভ করল ঋতজা। এই কুড়ি দিন শুধু নিজের শরীরটাকেই বাঁচিয়ে রেখেছিল ডঃ মুখার্জি। আত্মা যেন বন্ধক দেওয়া ছিল ঋতজার কাছে!  সুস্থ হয়ে নার্সিংহোম থেকে যেদিন বেরোলো, সেদিন বাইরে বাবা-মা ছাড়াও আরেকজনকে হাসিমুখে ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ডঃ মুখার্জি। ফর্সা তেজোদৃপ্ত মুখে মলিনতার ছাপ। চোখের কোলে গভীর কালি। ভারিক্কি শরীরটা একেবারে ঝরে গেছে। তবুও সারা মুখে যেন যুদ্ধজয়ের প্রশান্তি, যদিও সেটা নিজের জন্য নয়। এগিয়ে গিয়ে  ঋতজার হাতে ফুলের তোড়া হাতে তুলে দিলেন। ঋতজা বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ডঃমুখার্জির।  কৃতজ্ঞতায় দু’চোখ ভিজলো ঋতজার। মাথা নীচু করে বলল,"আমায় নতুন জীবন দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করব না, শুধু এটুকুই বলব এইজন্মে আর ঋণ শোধ হবে না। আপনি এই ক’দিনে নিজের কি চেহারা করেছেন দেখেছেন আয়নায়? শুধু আমাকে রোজ পাখি পড়ার মতো বলতেন নিজের খেয়াল রাখতে, আর নিজের বেলা?”

"আপনি আছেন তো। চিন্তা কি?”

সহজ নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বললেন ডঃ মুখার্জি।

"মানে?.. “

"এর মানে! হয়তো একদিন খুঁজে পাবেন জীবনে। না পেলেও ক্ষতি নেই বিশেষ। জোর করে চেষ্টা করবেন না। ভালো থাকবেন। খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা হচ্ছে।”

কথাটা বলেই নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন ডঃ মুখার্জি। ঋতজার দিকে আর চাইলেন না। কে বলে যে, শুধু মেয়েদেরই বুক ফাটে তবু মুখ ফোটেনা?  ভালোবাসার চাতক হয়েও ডঃ নৈঋত মুখ ফুটে বলতে পারল না ঋতজাকে। শুধু অপেক্ষা, সীমাহীন অপেক্ষাই জীবনের একমাত্র সম্বল। মাঝখানে কেটে গেছে আরও কিছু দিন। মেয়েকে সেবা আর ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ না করে কাজে যেতে দিল না ওর মা। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ ও। এদিকে জীবন এগিয়ে চলল তার আপন গতিতে। তার সাথেই নিজেকে ভাসিয়ে দিল ও। একলা ভাসতে চলা জীবনের ভেলা কোন তীরে গিয়ে নোঙর করবে তা নিয়ে ও নিজেও সন্দিহান। ঋতজা ধীরে ধীরে আকর্ষিত হতে লাগল নৈঋত এর প্রতি। নৈঋত এর পাগলপারা ভালোবাসার চাপে একটু হলেও চাপা পড়তে লাগল ঋদ্ধির অসহনীয় স্মৃতিভার। যতই নৈঋত এর ভালোবাসার টান থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে ততই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়ছে ঋতজা। তাই নৈঋত-এর অনুরোধে শত ব্যস্ততার মধ্যেও একদিন মিলিত হল কফিশপে।

"বলুন কি নেবেন? আজ প্রথম আমরা একসাথে মিলিত হলাম। আজ আমই অর্ডার করব।”

"আপনি যা পছন্দ করবেন তাতেইই  আমার পছন্দ। বাই দ্য ওয়ে, আপনাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। এতদিন পরে নিজেকে খুব সুন্দর করে গুছিয়েছেন।”

মিষ্টি হেসে ঋতজা বলল, "থ্যাঙ্কু ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট। আপনাকেও সুন্দর লাগছে। লাগছে বলছি কেন, আপনি তো সুন্দরই। সুপুরুষ। তবে আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর উপলব্ধি করলাম এমন সুন্দর মনের অধিকারী পুরুষ আমি খুব কম দেখেছি।”

"আজ একটা আর্জি রাখতে পারি আপনার কাছে?”

"স্বচ্ছন্দে। বলুন।”

" ‘আপনির’ বেড়াটা কি এতটাই উঁচু যে অতিক্রম করা যায় না?”

"আমার মনে ঋদ্ধিকে অতিক্রম করে যখন একটু হলেও জায়গা করে নিতে পেরেছেন তখন এই বেড়াটা স্বচ্ছন্দে অতিক্রম করা যায়– তুমি কিন্তু এখনও বললে না কি খাবে। এবারে রাগ করব কিন্তু। বল কি খাবে?”

ঋতজার কপট শাসনে নৈঋত প্রাণখোলা হাসিতে  গড়িয়ে পড়ল।

"কি হল হাসছো কেন? আমি কি বললাম?”

"না, কিছু না। তোমার শাসনের বহর দেখে। আমি তোমার মধ্যে থাকা একটা উচ্ছল কিশোরীকে আবিষ্কার করেছি।”

"বাটারিং  করছ আমায়? আমি পছন্দ করি না।”

"তাই মনে হচ্ছে? আমাকে একটুও চিনতে পারো নি তাহলে। আমি মন রাখার জন্য কোনো কথা বলি না। এবার কিন্তু তুমিই ভুলে যাচ্ছো খাবারের কথা। বার্গার, চিকেন স্যান্ডুইচ,  কোল্ড কফি।অর্ডার দাও। তোমার পছন্দ তো?”

"আমার কথা বাদ দাও। তোমার পছন্দ হলেই হবে।  আমি খুব যে পছন্দ করি তা নয়, তবে একদিন নো প্রবলেম। তোমার খুশিতে খেয়ে নেব।”

"শুধু আমারই জন্য?”

"জানি না...কথা না বলে অর্ডার দাও।"

চুপ করে গেল ঋতজা। মাথা নামিয়ে ফেলল। বেশি জোরাজুরি করলে যদি মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, ” শুধু তোমারই জন্য!” ঋদ্ধি যে শুধুই ওর জন্য এটা কীভাবে বলবে ও? বললে যে একটা সুন্দর মনের মানুষকে অনিচ্ছাকৃত কষ্ট দেওয়া হয়।

আড্ডা-গল্পে-খাওয়া দাওয়ায় কোথা দিয়ে যে দুটো ঘন্টা কেটে গেল দুজনের কারুরই খেয়াল রইল না। পরস্পরের জীবনের নানা জানা- অজানা কাহিনীর খন্ডচিত্র উঠে এল দু’ঘন্টায়। দুজনে কখনো হাসলো প্রাণখুলে, কখনও বা চোখের পাতা ভেজাল স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশে।

বেরোনোর সময় নৈঋত জিজ্ঞেস করল, "কীভাবে মনে রাখবে আজকের এই সন্ধ্যাটা?”

"সুন্দর মানুষের সাথে কাটানো, খুব স্মরণীয় একটা সন্ধ্যা।”

 "আবার এই সন্ধ্যা  জীবনে আসতে পারে?”

"সময়কে সময় দাও নৈঋত। কে বলতে পারে যে এই সন্ধ্যা আর আসবে না? আসি, কেমন?”

রাত্রে বিছানায় শুয়ে দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না ঋতজা। এখন চারিদিক নিস্তব্ধ। রাতও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঋতজা শুধু নিশাচর হয়ে জেগে আছে।  নিজেই নিজের পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে। নিজের মনে ক্রমাগত বলে চলেছে ” আজ নৈঋত এর সামনে এত স্বচ্ছন্দ আমি কি করে হলাম? আমার ঋদ্ধিকে আমি হারিয়ে ফেলছি তাহলে? না, না, এ হতে পারে না। ঋদ্ধি আমি শুধু তোমারই, শুধু তোমারই। তুমি আমায় পথ দেখাও ঋদ্ধি।"

উত্তেজনায় কাঁপা হাতে ফোনের গ্যালারি খুলে ঋদ্ধিকে  আবার জীবন্ত করে তুলল ও। অজস্র সুখস্মৃতির কোলাজ যেন আজকের সুন্দর সন্ধ্যাটাকে ক্রমাগত ব্যঙ্গ করছে। আবার পরক্ষণেই ভেসে উঠছে মাস দেড়েক আগের সেই প্রবল শীতের রাত। প্রবল শ্বাসকষ্ট এ সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখতে পাওয়া যখন নিশ্চিত তখন সাক্ষাৎ দেবদূত রূপে নৈঋত এর আবির্ভাব  ও তার জীবনরক্ষা।   অতীত আর বর্তমানের মধ্যে এমন বিষম দ্বন্দ্ব এসে যে তার জীবনটাকে জটিল করে তুলবে তা তার ধারণারও অতীত ছিল এতদিন। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল প্রবল মানসিক অস্থিরতায়। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল–” না!..না!.. না!  আমি আর পারছি না…আমার সাথে কেন এমন হচ্ছে?”

"ঝিনুক, ঝিনুক!.. তুমি শুনতে পাচ্ছো, শুনতে পাচ্ছ তুমি? আমি তোমার নৈঋত। তোমার নৈঋত বলছি। কোথায় তুমি? রাগ করেছ বুঝি? আমায় ক্ষমা করো দাও। আমি নিজের অজান্তেই ভালোবাসেছি ঋতজাকে। আমি জানি না  সেই ভালোবাসার গভীরতা কত, নিজের মনকে জিজ্ঞেস করিনি। তবুও ভালোবেসেছি। নিজেকে কত করে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, পারিনি। শুধু পাগলের মতো প্রেমে পড়েছি। জানি সাড়া পাব না তবুও। যত, যত, যত দোষ তোমার ওই মুখ, ওই হাসি। প্রায় অবিকল ওই হাসি, আমি ঋতজার মধ্যে দেখেছি। ওর মধ্যে সারাক্ষণ তোমায় খুঁজেছি। আমার কি দোষ বল?  সত্যি বলছি  বিশ্বাস কর, ওর প্রতি আমার কোনো দাবি নেই। না মনের, না শরীরের। ওকে নিজের করে পাওয়ার বাসনা আমি মনেও আনি না। তুমি আমার কথা বুঝছো তো ঝিনুক?”

ডঃ মুখার্জিও  নিজেকে আজ সামলাতে পারছেন না। ঋতজার মতো অস্থিরতা তাঁকেও গ্রাস করেছে। বাড়ি ফিরে পেগ এর পর পেগ বানিয়ে আকন্ঠ ডুবে আছেন।  ঝিনুককে ভীষণ ভাবে আজ পাশে পেতে ইচ্ছে করছে। ওর জীবদ্দশায় যেটা সম্ভব হয়নি। আজ তাই ইচ্ছা করছে ওর কোলে মাথা রেখে পরম নির্ভরতায় শুতে– যাতে মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বের অনন্ত দহনজ্বালা নির্বাপিত হয়। দু’বছরের দাম্পত্য জীবনে ঝিনুককে খুব বেশি পাশে পাওয়ার সুযোগ হয়নি নৈঋত এর। প্রতি দু-তিন মাস  বর্ধমান থেকে কলকাতা আসত নৈঋত। তখন ঝিনুকের বুকের জমাট বাঁধা শীতল অভিমান ভালোবাসার উত্তাপ পেত। দরবিগলিত হয়ে প্রবাহিত হত শরীরের আনাচে কানাচে।  কিন্তু ভুলতে পারত না, দীর্ঘ অদেখার যন্ত্রণা। তাই তো নৈঋতের বুকে মিশে গিয়ে  বলতো, " আমি ঝিনুক আর তুমি  আমার  ভিতরের মুক্ত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দেখ ঝিনুক তার মুক্তকে কত সযত্নে লালন করে, কিন্তু তার ঔজ্জ্বল্যের দেখার সৌভাগ্য হয় না। দেখে অন্যজনে।  আমার ভাগ্যেও কি সেটাই হবে? বলো না নৈঋত, মুক্তের ঔজ্জ্বল্য এর দাবিদার আমি হব না?”

এমন দার্শনিক কথার উত্তর অনেক হাতড়েও পেত না নৈঋত। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলত, "কেন হবে না তুমি ঝিনুক? অবশ্যই হবে! এতো মুক্তোর সৌভাগ্য ঝিনুকের বুকে ঠাঁই পেয়েছে।”

"তাহলে আমায় নিয়ে চল না তোমার সাথে, একা একা গোটা বাড়িটা আর কদ্দিন যক্ষের মতো আগলে থাকব?”

ঝিনুককে নিয়ে যাব  করতে করতে যখন যাওয়ার সময় হল, তখন ওর  পরপারে যাওয়ার সময় এগিয়ে এল। বিধাতার নিষ্ঠুর পরিহাসে দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীতেই  পরপারে চলে গেল ঝিনুক। রেখে গেল তার মুক্তোকে, হয়তো অন্যের অঙ্গে সারাজীবন এর জন্য!

আলমারিতে গাদা গুচ্ছের জিনিস অতিরিক্ত ঠাসাঠাসি করে রাখা থাকলে আলমারি খুললেই  সব হুড়মুড়িয়ে সামনে চলে আসে। আবার গোছাতে অনেক বেগ পেতে হয়। নৈঋত এর অবস্থাও ঠিক তেমনি এখন। সব কিছু গুছিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যাবে ওর!  অজস্র  সুখস্মৃতি পসরা ওর দেহের প্রতিটা শিরায়-উপশিরায় প্রবল আন্দোলন তুলল। গ্লাস হাতে নিয়ে কেঁপে উঠল নৈঋত। শিশুর মতো কেঁদে উঠল চুড়ান্ত অসহায়তায়। মিছে মিছেই ঝিনুকের ‘মুক্তো’ তার ঝিনুকের মধ্যে আশ্রয় পাবার ব্যর্থ চেষ্টা করল।

"আমি যে কারুর  ‘মুক্তো’ হতে চাইনি ঝিনুক। কেন তোমার থেকে আমায় আলাদা করে দিলে?..বলো কেন?  কেন? কেন?…"

উত্তর দিল না ঝিনুক।  স্নায়ু নিস্তেজ হতে হতে নৈঋত ঢলে পড়ল ঘুমের কোলে। অনেকক্ষণ ধরেই  ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের  বাইরে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে ঋতজা। ঘন্টা দুয়েক আগেই ও.টিতে এক পেশেন্ট হার্টফেল করে মারা গেছে।  ধীরে ধীরে আওয়াজটা সামনে আসায় সেটা আরো স্পষ্ট হল।– "খুনি  ডঃ নৈঋত মুখার্জি কই গেলেন? বেরিয়ে আসুন। নিজের গাফিলতিতে  রোগী খুন করে পালিয়ে যাবেন এটা হতে পারে না। নৈঋত মুখার্জির শাস্তি চাই, শাস্তি চাই,  শাস্তি চাই….”

নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছে না ঋতজা। একি শুনছে – ডঃ মুখার্জি খুনি! ও আই.সি.ইউ তে ডিউটি সেরে সবে বেরিয়েছে। জেনারেল ওয়ার্ডে ঢুকে কর্তব্যরত এক  নার্সকে জিজ্ঞেস করল,  "সুনন্দা, ডঃ মুখার্জি কই? শিগগির বল? আর বাইরে কিসব শুনছি? ওনার গাফিলতিতে পেশেন্ট মারা গেছে! এরা কারা?”

"কি ভয়ঙ্কর অবস্থা হচ্ছে ম্যাডাম কি বলব? একটা গ্রুপ চলে গেছে হসপিটাল সুপারের ঘরে, আরেকটা গ্রুপ ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের সামনে বিক্ষোভ করছে। এই অল্প ক’মাসে এটুকু বুঝেছি ডঃমুখার্জি প্রাণ থাকতে নিজের কাজে গাফিলতি করেন না। ও.টিতে ওনাকে অ্যাসিস্ট করে বুঝি তো,উনি কতটা নিঁখুত।”

"আমি জানি সুনন্দা।  আজকে সার্জারিটা খুব কম্পলিকেটেড ছিল, ওনার সাথে আমিও ছিলাম ও.টিতে। কতটা কেয়ারফুল ছিলেন গোটা টিম দেখেছি আমরা। আফটার অল পেশেন্টের  এজটাও বেশি ছিল, এবাভ এইটটি। হার্টের কন্ডিশন এমনিতেই ক্রিটিক্যাল ছিল, বি.পি হাই ছিল খুব। তাও সব নর্মাল করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বেডেই আচমকা হার্টফেল হলে এটা তো ওনার ফল্ট নয়। তাও লাস্ট মোমেন্ট অব্দি আমরা ট্রাই করেছি।

"সুনন্দা? গতকাল যে লাস্ট ও.টিটা করা হল সেই পেশেন্ট এর ফাইলটা দেখি একবার।”

ঋতজা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফাইল দেখতে লাগল। তখনই ওয়ার্ড বয় দৌড়ে এসে খবর দিল, "আপনারা শিগগির নীচে চলুন, পেশেন্ট পার্টি ইঁট ছুঁড়ে ডঃ মুখার্জির মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন। সিচুয়েশন আউট অব কন্ট্রোল। উনি বুঝিয়েও পেশেন্ট পার্টিকে শান্ত করতে পারছেন না। মিডিয়া ব্রেকিং নিউজ করতে শুরু করলে, ওনার রেপুটেশন ধূলোয় মিশে যাবে।

রাগে দাঁত কিড়মিড় করে ঋতজা বলল, "দিচ্ছি করতে ব্রেকিং নিউজ। সুনন্দা, কালকে ওটিতে আর যারা ছিলেন তাদেরকে ডেকে নাও। কুইক। ওনার বদনাম মানে আমাদের ডাক্তার সমাজের বদনাম।”

ডাক্তার নার্স সমেত চারজনকে নিয়ে যখন নীচে নামল ঋতজা, তখন ইমার্জেন্সি চত্বরে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। উন্মত্ত রোগীর পরিজনদের নৈঋত মুখার্জির বিরুদ্ধে স্লোগান অব্যাহত। তাদের বেষ্টনীর মধ্যে দৃঢ় সাহস নিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে নৈঋত। ওঁর দিকে তাকিয়েই চমকে গেল ঋতজা।

"একি, স্যার! আপনার কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। পুরো জামা ভিজে যাচ্ছে। আপনি চলুন। সুনন্দা, স্যার কে নিয়ে যাও ফার্স্টএইড করিয়ে দাও। আমি দেখছি।”

নৈঋতকে টেনে বাকিরা বের করার চেষ্টা করতেই,  বিক্ষোভকারীদের একজন গর্জে উঠল– "যে ওনাকে বাঁচাতে আসবে, তাকেও মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব। ছেড়ে দিন আমাদের হাতে।”

"প্লিজ ঋতজা, যাও তুমি এই ঝামেলার মধ্যে কেন এসেছ? আমি সামলে নেব। যাও তুমি। কিচ্ছু হবে না আমার।”

"তোমার কত ব্লাড লস হয়েছে খেয়াল আছে? তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি যাও। আমরা আছি।”– এই বলেই নৈঋতকে ঠেলে ব্যুহ থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজে বিক্ষোভকারীদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল।

“আমি, এইতো আমি দাঁড়িয়ে আছি আপনাদের সামনে। মাথা ফাটান দেখি আমার। ইঁট, পাটকেল, লাঠি যা আছে বের করুন। ডঃমুখার্জীকে খুনি বলছেন তো, আমিও ওনার সাথে ও.টিতে ছিলাম সেই হিসাবে আমিও খুনি। নিন মারুন, মারুন আমায়!…. কার কত সাহস আছে দেখি।”

ঋতজার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে হতচকিত হয়ে সরে গেল বিক্ষোভকারীরা। ঋতজা সহ বাকি ডাক্তার ও নার্সরা সম্মিলিত তীব্র প্রতিবাদে গর্জে উঠল ওদের বিরুদ্ধে– "আর একটাও আঁচড় যদি ওনার  গায়ে লাগে, এবার আমরা পুলিশ ডাকব। পুলিশ আসলে তবে বডি পাবেন। এবারে ভাবুন কি করবেন।” 

এরপর কেটে গেল আরও চারটে ঘন্টা। বিক্ষোভ পুরোপুরি থেমে গেছে। পেশেন্ট এর বডি নিয়ে চলে গেছে বাড়ির লোকেরা। ডঃ মুখার্জির মাথায় চারটে সেলাই পড়েছে। সেলাই মাথায় নিয়ে নিজের কেবিনে বসে আছেন চুপ করে মাথা নীচু করে।

"স্যার আসব?..”

"ঋতজা, এসো এসো। তুমি বেরোওনি এখনো?”

"কেমন লাগছে শরীর?”

"ওই হালকা ব্যথা আছে। ও কিছু না। তুমি বসো।”

"স্টিচ মাথায় নিয়ে বেশি কথা বোলো না। বাড়ি ফিরবে তো আজ? দুদিন ধরে পড়ে রয়েছ।”

"আজ আর ড্রাইভ করতে ইচ্ছা করছে না। থেকে যাব তাই। কাল ক্লাস আছে দুপুরে। নিয়ে একেবারে ফিরব।”

"যা করবে, শরীর বুঝে কোরো। আসছি। নিজের যত্ন নিও… সরি, কাকে আবার একথা বলছি!”

"মানে?..”

"কিছু না…স্টুপিড!..”

শেষ কথা গুলো যেন নৈঋত এর জীবনে নববসন্তের দোলা লাগাল। নিজের যত্ন নিও। স্টুপিড!.. এই প্রথম, ঋতজার ভালোবাসা অনুভব করল ও। ভেসে গেল নিজে খড়কুটোর মতো।

ঋতজা দরজা খুলে সবে একটা পা বাড়িয়েছে, পেছন থেকে ডাকল নৈঋত। "একবার শুনবে?”

ঋতজা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ওর দিকে। একেবারে কাছে এসে সরাসরি নৈঋত এর চোখে চোখ রাখল।

"বলো।”

"আজ এতবড় ঝুঁকি কেন নিলে আমার জন্য? কোনো দরকার ছিল কি? আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। সিরিয়াসলি বলছি।”

"কেন! ওরা আমাকে মেরে ফেলত বুঝি? ফেললে ফেলত। কি আছে?”

"চুপ!…”

আচমকা ঋতজাকে নিজের কাছে টেনে  মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরল। অসীম ভালোবাসায় ভরা চোখে তাকাল ওর দিকে। কাঁপা গলায় বলল, “বোলো না এমন!… আমি শেষ হয়ে যাব। আমার জন্যে তুমি এতটা ভাবো! কেন?”

ফাল্গুনের অকাল বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়ায় ঋতজার চুলগুলো বাঁধনছাড়া খুশিতে এলোমেলো হয়ে আদর করে দিল নৈঋতের গালে। নৈঋত এর চোখের দিকে  তাকিয়ে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। ভালোবাসার অকুল সাগরে ডুব দিয়ে স্বেচ্ছামরণ চাইল ঈশ্বরের কাছে।

ও কোনো কথা বলছে না দেখে নৈঋত ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ” বলো, আমার জন্য কেন এতটা ভাবো?”

"বোঝো না তুমি? স্টুপিড আর সাধে বললাম!”

"বুঝতে পারছি…তাও তোমার মুখ থেকে কথাটা  শোনার জন্য কান দুটো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। বলবে না তুমি?”

প্রবল আকুতি ঝরে পড়ল নৈঋত এর গলা দিয়ে। চকিতে নৈঋত এর মুখের দিকে তাকালো ঋতজা। দেখল বহু জনমের ভালোবাসার চাতক আজ আকন্ঠ পান করতে চাইছে ভালোবাসার অঝোর ধারা। নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিল নৈঋত এর বুকে মিশে গিয়ে। ওর গাল বেয়ে গড়াতে লাগল কয়েকফোঁটা আনন্দাশ্রু। ঋতজার দুটো গালে হাত রেখে ওর চোখে চোখ রেখে বলল, "আজও চুপ থাকবে তুমি?”

"চুপ থেকেও তো অনেক কিছু বলা যায় নৈঋত। এই যে তোমার বুকে মিশে আছি, তাও বলতে হবে?”

"শুধু এটুকু বল, আমি তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিনের তুমি আর আজকের তুমির মধ্যে এক আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সেদিনের তোমার মুখে ছিল এক বিষন্নতার ছাপ। সেদিন তোমার মুখটা মেঘলা আকাশের মতো লাগছিল, কিন্তু আজ তোমার মুখে যেন রোদ ঝলমল করছে। আমি কি জানতে পারি এই পরিবর্তন কিসের জন্য?’

প্রশ্ন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই এক দমকা হাওয়া এসে ঋতজার চোখদুটোকে বন্ধ করে দিল আর তার মুখ থেকে একটাই কথা বেরোলো, "তুমি এলে তাই।“

"Our life is but a winter's day

 Some only breakfast and away

Others to dinner, stay and are full fed 

The oldest man but sups and goes to bed 

He that goes soonest has the least to pay."

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment