1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, April 15, 2023

আঁধার রাতে

ছবি : ইন্টারনেট

আঁধার রাতে

দীপক কুমার মজুমদার


আজ আবার সেই মেঘলা দিন। সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমরা হয়ে আছে। বেলা যতই বাড়ছে গুমোট ভাবটা আরও চেপে বসেছে। বেলা গড়াবার সাথে সাথে একাকিত্ব ও যেন বাড়ছে। কাছাকাছি কয়েকজন বন্ধুকে খবর দিতে তারাও রাজি হয়ে গেল, বিকেলে আমাদের বাড়িতে আড্ডা জমাবো। সন্ধে হওয়ার আগেই একে একে পৌছে গেল পলাশ, গনেশ, ছটাই. অনিল, বিনয় আর জয়রাম।

এক এক করে যখন সবাই জড়ো হয়েছি, একথা সেকথার মাঝে মনে পড়ে গেল আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের এক ঘটনা।

তখন আমি আমার গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করি। সেদিনটাও ঠিক এরকমই মেঘলা ও বৃষ্টিভরা দিন ছিল। সন্ধে বেলায় চার পাঁচজন বন্ধু মিলে আড্ডা জমাবো । আমাদের আসরটা আরও জমিয়ে দিতে মা হাজির একথালা মুড়ি ও তেলেভাজা নিয়ে। আমরা দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে মুড়ি ও তেলেভাজা কাড়াকাড়ি করছি এমন সময় আমার দাদু আমাদের আসরটা দেখতে এসেছে। দাদু খুব সুন্দর গুছিয়ে গল্পো বলতে পারতো। তাই সবাই আব্দার করলাম দাদু আজ গল্পো বলতে হবে। দুই একবার বলতেই দাদু রাজি হয়ে গেল। ‘গল্পো শুনবি, কি ধরনের গল্পো?’ আজ যেমন পরিবেশ আমরা সবাই একসাথে বলে উঠলাম ‘ভুতের গল্পো’। দাদু শুরু করে দিলো...।

ভুতের গল্পো কিনা জানিনা তবে যেটা বলছি একদম সত্যি ঘটনা, তারপর দাদুর গল্পো শুরু।এখন এই গ্রামে নানারকম দোকান বাজার হয়েছে,  চাইলে দুচারটে কাজ চালাবার মতো ওষুধ বিষুধও পাওয়া যায়, কিন্তু তখন কোন কিছুর দরকার হলে ছুটতে হতো সাত মাইল দূরে শহরে।পিসিমার বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। বেশ শক্ত সমর্থ মানুষটা কিছু দিন হলো নাগারে ভুগছেন। দুদিন হলো বাড়াবাড়ি। শহর থেকে বড় ডাক্তার ডাকা হয়েছে। অবস্থা ভালো নয়, খুব একটা ভরসা দিলেন না। বেশ কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে মোটা টাকা নিয়ে ওনার সাইকেল চেপে চলে গেলেন। সবাই খুব শঙ্কার মধ্যে চুপচাপ আছি, বাবা ভরসা দিয়ে বললেন ‘তোমরা সবাই এত ভেঙ্গে পড়লে হবে, এখনও হাল ছাড়ার সময় আসেনি, দেখাই যাক নতুন ওষুধে কাজ হয় কিনা....’আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘কিরে পারবি না শহর থেকে ওষুধ নিয়ে আসতে?’ যদিও শীতকালের বেলা তারাতারিই নেমে এসেছে, কিছুক্ষনের মধ্যে অন্ধকার নেমে আসবে- একটা কিছু করার এই সুযোগ ছাড়তে চাইলাম না। রাজি হয়ে গেলাম তবে আমাদের বাড়ির রাখাল চরণকেও সঙ্গে রাজি করিয়ে প্রেশক্রিপশন ও টাকাপয়সা নিয়ে তৈরি হয়ে রওনা দিলাম।  

গ্রামের সীমানা যখন পেরোচ্ছি সূর্য তখন ডুবে গেলেও ততটা অন্ধকার হয়নি, চরণকে তারাতারি পা চালাতে বললাম। সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা মাঠ, শীতের বেলা মাঠের চাষীরা মাঠ ছেড়ে ফিরে এসেছে, রাখালরা গরু নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। এখন মাঠ একদম ফাঁকা। খানিক্ষণ যাওয়ার পরেই মনে হলো ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে গেলো। এমন অন্ধকার বিশ পচিশ ফুট দুরে আর কিছু ঠাওর হয়না। দূর থেকে কোন গ্রামের কারও বাড়ি থেকে ভেসে আসা জোনাকির মতো টিমটিমে আলো জীবনের অস্তিত্ত্ব জানান দিলেও আমাদের গা ছমছম করা এক অদ্ভুত পরিস্থিতি মনে হচ্ছে। 

এইভাবে দুজনে হনহন করে মাঠের আলের উপর এবড়ো খেবড়ো পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি। অনেক্ষন পর নীরবতা ভঙ্গ করে আমিই চরণকে বললাম ‘কিরে চুপচাপ আছিস যে, ভয় করছেনা তো!’ ধরা ধরা গলায় আমায় অভয় দিয়ে উত্তর দিলো ‘না না ভয় কিসের, তবে কি ভীষণ অন্ধকার নিজেদের কেও ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিনা। পাশ দিয়ে কেও চলে গেলেও বুঝতে পারবোনা।‘ এই কথা বলতে বলতে পকেট থেকে দুটো বিড়ি বের করে একটা আমায় ও আর একটা নিজে ঠোটে নিয়ে দেশলাই ধরালো। আমি বেশ বুঝতে পারছি নিজেদের মনে সাহস বাড়ানোর জন্যই এই ব্যবস্থা। বিড়ির আগুনে জমাট অন্ধকারের মধ্যে আমাদের মুখগুলো মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। একবার আমি জানতে চাইলাম “‘যা ভীষণ অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছেনা আমরা ঠিকপথ দিয়ে যাচ্ছিতো?” চরণ ভরসা দিয়ে জানলো “না না ভূল কেন হবে, এতোদিনের চেনা রাস্তা-এইতো আর খানিকটা এগিয়ে গেলেই মাঠ শেষ হবে তারপর চামটি বাগান”।

চামটি বাগান কথাটা শোনার সাথে সাথে বুকটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো। চামটি বাগান হলো প্রায় মাইল তিনেক বিস্তৃত ঘন জঙ্গল, সেরকম বিশেষ জন্তু জানোয়ার না থাকলেও সাপখোপ, শেয়াল, বাদুড়ের উপস্থিতিতো আছেই। তবে তার চাইতেও তেনাদের উপস্থিতির কথা এড়িয়ে দিতে পারলামনা। জঙ্গল পাড় করলেই নদী, রেল ব্রিজ তার নিচেই শ্মশান! ঐ অঞ্চলের সমস্ত শব দাহের একমাত্র জায়গা ঐটাই। “কিরে চরণ এই ঘন অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে এতোটা রাস্তা পার করবো কি করে, যতো এগোচ্ছি কি রকম যেনো মনে হচ্ছে”। আচমকা দূর থেকে ঝটপট আওয়াজ ভেসে এলো আর তার সাথে বাচ্চা ছেলের কান্নার শব্দ……একটু থমকে গিয়ে চরণের কাঁধে হাত রাখার চেষ্টা করাতে ও কিছুটা সাহস দিয়ে বললো “ঘাবরে যেওনা, এটাতো শকুনির ডাক, মনে হচ্ছে জঙ্গলের কাছে এসে গেছি এবার আমাদের সাবধানে চলতে হবে”। গভীর জঙ্গল বড়ো বড়ো গাছ তার নিচে ঝোপঝাড় কাটিয়ে এগোচ্ছি‌, হঠাৎ দ্রুত গতিতে কিছু একটা চলে গেলো, অন্ধকারের মধ্যেও বুঝতে পারলাম ওটা শেয়াল আমাদের উপস্থিতি জানতে পেরে দৌড় দিয়েছে।

এই ভাবে দু হাতের মুঠো শক্ত করে দুরদুর বুকে দুজনায় এগিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎই সামনে মিটমিট করা দুটো অলো দেখতে পেলাম যেনো অলৌকিক কোনো কিছুর দুটো চোখ, আর তার সাথে সোঁ সোঁ করা হাল্কা আওয়াজ। প্রথমে বিশেষ গুরুত্ত্ব না দিয়ে এগিয়ে চললাম কিন্তু যতো এগোচ্ছি ঐ চোখ দুটো আরও বড়ো হয়ে আরও প্রকট হয়ে দুলতে দুলতে একবার আমার দিকে এগিয়ে আসছে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে।  আর ঐ সোঁ সোঁ করা হাল্কা আওয়াজ আরও বাড়তে বাড়তে অট্টহাসির মতো শোনাচ্ছে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি অলৌকিক ঐ চোখ দুটো হা হা করে হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। চাইলেও আর এক পা এগোতে পারছিনা, পা থেকে মাথা অব্দি ক্রমশ বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, আগে পিছে আর কিছুই চিন্তা করতে পারছিনা। তারপর শরীর একদম অসাড় হয়ে নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ঝোপের মধ্যেই পরে গেলাম।

কতক্ষন এইভাবে পরে ছিলাম জানিনা, আস্তে আস্তে চোখ খুলতে দেখি হারিকেন ও টর্চ হাতে বেশ কয়েকজন লোক আমাকে ঘিরে রেখেছে আর চরণ আমার চোখে মুখে জলের ছিটে দিচ্ছে। সবাই কৌতহলের সঙ্গে জানতে চাইছে কিভাবে কেনো এই অবস্থা হলো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা আমার তখন কোনকিছু বলার পরিস্থিতি ছিল না। এরপর চরণই জানালো হঠাৎই গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে আমার জ্ঞান হারাতেই ও খুব ভয় পেয়ে গেছিলো, বেশ খানিক্ষন অপেক্ষা করেও কোনো উপায় না দেখে আমায় আঁকড়ে ধরে রেখছিলো আর ঠাকুর ঠাকুর করছিলো। বেশ কিছুক্ষন পর কিছু টিমটিম করা আলো আর কিছু মানুষের কথাবার্তার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এবং সেগুলো ক্রমশ আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ভয় পাবো, না ভরসা করবো বুঝতে পারছিনা। কাছের শ্মশান থেকে মৃতদেহ পুড়িয়ে একদল লোক বাড়ি ফিরছিলো, আমাদের এই অবস্থা দেখে ওরাই আমায় চাঙ্গা করতে পেরেছে। যাইহোক ঠাকুরের কৃপায় মারত্মক কিছু হয়নি। 

ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে জড়ো হওয়া মানুষগুলো সব চলে গেলো। একটু স্বাভাবিক হতেই দেখে বুঝতে পারলাম ঠিক সামনের ঝোপটায় বিশাল মাকড়সার জাল তার ওপরে বড়ো বড়ো শিশিরের ফোটা তখনো আটকে রয়েছে। দুর থেকে চলে যাওয়া ট্রেনের আলোর ছটায় ঐ শিশিরের ফোঁটাগুলো জ্বলজ্বল করে উঠেছিলো। হাওয়ায় দুলতে দুলতে সেটাই আগে পিছে হচ্ছিলো। আর হা হা শব্দে অট্টহাসি ওটা নিছকই মনের ভুল।  

...(সমাপ্ত)...



No comments:

Post a Comment