সাজা
অর্পিতা ত্রিপাঠী
মা মরা মেয়ে বিন্দু যখন ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয়ে শ্বশুরঘর করতে এল তখন তার বাপ জনার্দন ভেবেছিল, যাক মেয়েটা এবার অন্তত মা পাবে। বিন্দুর শাশুড়ি বিধুমুখী কিন্তু জনার্দনের সে আশা পূরণ করলেন না। উঠতে বসতে তিনি বিন্দুকে খোঁটা দিতেন। পণের টাকা না দেওয়া থেকে শুরু করে লুচি না ফোলা কোন কিছুই বাদ দিতেন না তিনি। বিন্দুর জীবন ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠল। বিন্দুর বর সীতাপতির কোন দিকেই তেমন নজর নেই, তবলা বাজানো আর চুলের কেয়ারী করা ছাড়া। তাই বিন্দু সারাদিন গাধার খাটনি খাটত আর রাতে হাপুস নয়নে নিশব্দে কাঁদত চিলেকোঠার ঘরে। রাতের কিছু সময় না কাঁদলে সে পরের দিনের অত্যাচার সহ্য করার যোগ্য নিজেকে করে তুলতে পারত না। চিলেকোঠার একটেরে ঘরে রাজ্যের ভাঙ্গা বাতিল জিনিসে ভর্তি। ওই ঘরে বসে এক রাত্তিরে বিন্দু কাঁদছিল, এমন সময় স্পষ্ট শুনল সে, “চুপ করতো বাপু! আর পারিনে! কান ঝালাপালা করে দিল এক্কেরে!”
চমকে উঠে বিন্দু দাঁড়িয়ে পড়ল। ছোট্ট জানালা দিয়ে মেঘ ঢাকা চাঁদের আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। সেই আবছা আলোতে এই প্রথম সে খেয়াল করল, কি সুন্দর একটা সাদা কালো ছবি ঘরের দেয়ালে! তারই বয়সী একটা মেয়ে মেঘের মতো চুল ছড়িয়ে বসে আছে চেয়ারে চুপটি করে, মুখে মিষ্টি হাসি।
“কে, কে তুমি?”
অনেক পরে বিন্দুর মুখ থেকে কথা বেরোয়।
“ আমি তোর শাশুড়ির শাশুড়ি রে মেয়ে! তুই আমারই ঘরে রোজ নিয়ম করে কাঁদতে আসিস। তা বলি ব্যাপারখানা কি? রোজ অমন কাঁদিস কেন? পারিস না শাউড়ি বেটিকে একটু জব্দ করতে?”
ভয় ততক্ষণে কেটে গেছে বিন্দুর। খুব দুঃখে বোধহয় ভয় বোধ তেমন থাকে না। মুখ নামিয়ে সে বলল, “গুরুজন হন যে!”
“ ও তা বেশ। তা আমি তো তোর আরও বেশি গুরুজন হই, আমি বলছি শাশুড়িকে যদি জব্দ করতে না পারিস মটকাবো তোর ঘাড়।“
বহু কাকুতি মিনতি করল বিন্দু, কিন্তু বিন্দুর দিদি শাশুড়ি নাছোড়। বলল, “ওরে মেরে তো ফেলতে বলেছি নে, কিন্তু একটু আধটু প্রতিবাদ না করলে পেয়ে বসবে যে! আচ্ছা, বুঝেছি তুই কিছু করবিনে শুরুটা তবে আমাকে করতে হবে।“
পরের দিন থেকেই শুরু হল নানা ভুতুড়ে কান্ড। বিধুমুখীর পানির ডিবে উধাও । কিছু পরেই তিনি আছাড় খেলেন শুকনো উঠোনে। ভাঙ্গা কোমর নিয়ে একেবারে বিছানায়। রাতে বিন্দু চিলেকোঠার ঘরে এসে বলল,
“এটা কি হল! এমন করতে আছে!”
বিন্দুর দিদিশাশুড়ি বললেন, “আর তোর ওপর যে অত্যাচারগুলো করে সেগুলি বুঝি করতে আছে! তুই যদি মুখ না খুলিস আরও অনর্থ করব আমি দেখিস।“
বিন্দু দেখল মহাবিপদ। পরের দিন ওষুধ খাওয়াতে যেতেই শাশুড়ি মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “এইবার তো তোমার পোয়া বারো। যা খুশি তাই করবে!
অন্যদিন হলে বিন্দু উত্তর করত না, কিন্তু কি হল কি জানি আজ মুখ নামিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে বসল, “আপনার এসব ধারণা ভুল মা, আমি কখনওই যা খুশি তা করি না।“
মুখে মুখে উত্তর শোনার অভ্যেস নেই বিধুমুখীর, রেগে উঠলেন খুব।
“কি! আমি ভুল? তবে রে!” বলে সামনে থাকা জাঁতি ছুঁড়লেন বৌমার দিকে। কিন্তু সে ব্যাটা জাঁতি কিছু দূর গিয়েও বিন্দু আর বিধুমুখীর মাঝে ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলতে থাকল। শুধু তাই নয়, কিছুসময় ওখানে থেমে হঠাৎ উল্টোদিকে ছুটে এসে সজোরে লাগলো বিধুমুখীর কপালে।
বাপরে বলে বিধুমুখী তো একেবারে অজ্ঞান। আলনার আড়ালে অন্ধকার মত জায়গায় আবছা কাউকে সরে যেতে দেখল বিন্দু।
তারপর...
জল আনো রে, বরফ আনাও রে, ওষুধ, ডাক্তার, বদ্যি, গুরুদেব, আত্মীয়, পড়শী কোন কিছু আসতে আর আনতে বাকি রইল না।
“এসব তোমার ভারী অন্যায়” খুব গম্ভীর হয়ে বলল বিন্দু। চিলেকোঠার ঘরে আজও চাঁদের আলো। ছবির মেয়েটি হেসে বলল, “আরে শোন না তোর শাউড়ি ভালো হয়ে যাবে। তুই কিছু চিন্তা করিস না। বরঞ্চ ওই গানটা শোনা, চাঁদের কপোলে শশী কলা দোলে....”
বিন্দু কোনো কথা বলল না।“ ভারী রাগ হয়েছে বুঝি তোর? তা ভালো। কান্নার থেকে রাগ ঢের বেশি ভালো।তবে বেশি সময় রাগ করিসনে ভাই, বললাম তো ঠিক হয়ে যাবে সব। আয় চল লুকোচুরি খেলি। এক্কাদোক্কা ও অনেকদিন খেলিনি। মরি যখন তোর বয়সেই তো ছিলুম! তবে যা বলিস আমি একটু খেলা দেখালুম বলেই না মুখ খুলল তোর!”
কয়েক মাস পর। বিধুমুখী ও বিন্দু একসাথে খেতে বসেছে। পায়ের কাছে পোষা বিড়ালটা ঘুরঘুর করছে।
“ বলছি বৌমা..”
বিধুমুখী একটু কেশে বললেন আবার,
“বলছি বৌমা, একটা কথা কইব!”
বিন্দু বলে, “বলুন না মা?”
----বলছি ডালে বোধ হয় একটু নুন কম হয়েছে।
___ কই তেমন তো নয় মা! কত্তারা সব খেয়ে গেলেন কিছু বললেন না তো?
----- তাহলে বোধহয় আমারই ভুল মা, বয়স হয়েছে তো।
----- উঠি মা? আমার হয়ে গেছে। উঠে খান কয় পান সেজে রাখি, আমি না সাজলে তো আপনি আবার পান খাবেন না।
---+তুমি বড় ভালো পান সাজ বৌমা!
----- কি যে বলেন মা!
হেসে উঠে চলে যায় বিন্দু।
আর বিধুমুখী আড়চোখে পানের বাটাটার দিকে তাকান, ওখানেই আছে সেই সব্বনেশে ভুতুড়ে জাঁতিটা। সেদিনের পর থেকে ওটা ছুঁয়েও দেখেন না তিনি। রোজ বিন্দুই তার পান সেজে দেয়। ভালোই পান সাজে মেয়েটা। শুধু পান সাজা কেন, রান্না বান্না ঘরকন্না দশ হাতে সামলায়। আহা, মা মরা মেয়েটার যেমন রূপ তেমন গুণ, এতদিন কেন যে বুঝতে পারেননি তিনি কে জানে....ভাবেন বিধুমুখী।
No comments:
Post a Comment