বিরিয়ানি
প্রাণেশ মণ্ডল
"না, আজ একেবারে বাইরে খেয়েই ঘরে ঢুকবো।" জোর গলায় একরকম বলেই দিলেন গগন বাবু। কেরানীর চাকরী আর মধ্যবিত্ত সংসারের চাপের ফাঁকে ফুরসৎ পেলেন আজ একটু। তাই আজকের দিনটা একটু অন্য ভাবে কাটাতে চাইলেন। স্ত্রী রমলা দেবী কে নিয়ে আজ পুজোর মার্কেটিং করতে বেড়িয়েছেন। সেই ছুঁতোয় আইনক্সে একটা সিনেমাও দেখে ফেললেন। এই মফঃস্বল শহরে সদ্য গজিয়ে ওঠা মাল্টিপ্লেক্সটি ছাড়া বিনোদনের খুব বেশি সুযোগ নেই। অফিস থেকে ফেরার পথে রোজ সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছেলে মেয়েদের শপিংমল বা আইনক্সে ভিড় করতে দেখে তাঁরও ইচ্ছে হয়, কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠেনি এতদিন। তাই আজ সুযোগ যখন মিলেছে, তখন তা পুরোটা উশুল করেই ছাড়তে চান তিনি।
কিন্তু রমলা দেবী পুরো উল্টো। তিনি ঘরের চার দেওয়ালের মাঝে সংসারের কাজ করতেই বেশি আনন্দ পান। আজ কেনাকাটা করতে বেরোলেও সিনেমা দেখতে একেবারেই রাজী ছিলেন না। গগন বাবুর প্রস্তাব প্রথমেই নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, "শিং ভেঙে এই বুড়ো বয়সে বাছুরের দলে ভিড় করব? বেশ তো ঘরে আয়েশ করে বসে টিভি মোবাইলে সিনেমা দেখা যায়!"
"বুড়ো? কত বয়স হল আমাদের? আর মনের কি কোন বয়স হয়?" গগন বাবু জবাব দিলেন।
রমলা দেবী আর কথা বাড়ালেন না। খুব একটা ইচ্ছে না থাকলেও গগন বাবুর সাথে একরকম জোর করেই পা বাড়ালেন। টিকিট কাউন্টারে দু একজন সমবয়সী ও বয়স্ক দম্পতি কে দেখে রমলা দেবী একটু মনে ভরসা পেলেন।
সিনেমা হল থেকে বেরোতে বেশ দেরিই হল সেদিন। দুজনেরই খুব ক্ষিদে পেয়েছে, তবে খাবারের দোকানের অভাব নেই। মাল্টিপ্লেক্সের পাশের রাস্তাটার চেহারা এই কবছরে পুরো পাল্টে গেছে। সারি দিয়ে একের পর এক ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁ। রাস্তা দিয়ে গেলেই সুগন্ধে ক্ষিদে যেনো আরও দশ গুণ বেড়ে যায়। কিন্তু এখানেও রমলা দেবীর চরম আপত্তি। রেস্তোরাঁ তে খেয়ে নিলে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি গিয়ে রান্নার ঝামেলা আর থাকে না। এই প্রস্তাব পেলে যেকোনো বাড়ির গিন্নি একবারেই লুফে নেবে। কিন্তু ওনার বাইরের খাবার একেবারেই নাপসন্দ। খাদ্য রসিক গগন বাবুর সাথে এ নিয়ে আগে বেশ কয়েকবার ঝামেলা হয়েছে।
"অত ঝাল মশলা খেলে কি আর পেট ঠিক থাকবে? আর মাংস যে কবেকার তার তো কোনো ঠিকই নেই!"
স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা যতই বলুন, স্ত্রীকে কখনোই তাঁর স্বাস্থ্য সচেতক বলে মনে হয় না। শুধু বাইরে খাবারের কথা বললেই যত নীতিবাক্য ফোটে মুখে। দিন দিন যেন নিয়ম শৃঙ্খলা আরও কড়া হচ্ছে। যে বিরিয়ানির প্রতি গগন বাবুর সেই ছোট থেকে প্রেম, আজ স্ত্রীর সামনে তার নাম উচ্চারণ করতেই ভয় পান। এর জন্য ওনাকে অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু রমলা দেবী যদি একটু বুঝতেন তাঁর মনের বাসনা!
দূর থেকে ভেসে আসা খাবারের সুগন্ধে গগন বাবুর মন টা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলো। ঠিক করলেন আজ কোনো বাধা মানবেন না, নিজের ইচ্ছেগুলোকে তিনি বাস্তবায়িত করেই ছাড়বেন। মাথায় একটা জেদ চেপে বসলো, আজ না খেয়ে বাড়িই ঢুকবেন না। তাই জোর গলায় ঘোষণা করলেন আজ বাইরে খাবেনই। গগন বাবুর জেদ দেখে রমলা দেবীও থতমত খেয়ে গেলেন। উনিও আশ্চর্যজনক ভাবে আজ খুব বেশি বাধা দিলেন না। শুধু একবার মিনমিন করে বললেন, "দিনে অনেক রান্না করা আছে, সেগুলো নষ্ট হবে।"
কিন্তু গগন বাবু কে আজ পায় কে? তিনি এরকম কোনো অজুহাতই আজ কানে তুলতে চান না।
এমনিতেও অনেক রাত হয়ে গেছে। তার ওপর এখন ঝগড়া ঝাটি করলে আরো দেরি হবে, আর বাইরের লোকজনের সামনে সেটা অভদ্রও দেখায়। অগত্যা রমলা দেবীও পা বাড়ালেন।
গগন বাবু এবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বেশ হিসেব কষে শুরু করলেন।
"বুঝলে এখানে তন্দুরী আইটেম দারুণ বানায়, আর তন্দুরী চিকেন টা তো এখানে স্পেশাল! আর গলৌতি কাবাব...মুখে দিলেই একদম মিলিয়ে যাবে, এত নরম!" স্ত্রীকে সোৎসাহে কথাগুলো বলেই রেস্তোরাঁর সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন, কিন্তু কিছুটা উঠেই থামতে হল। সামনে দশ বারোজনের বিশাল লাইন। টেবিল ফাঁকা পেতে একঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। দাঁড়ানোর জন্য ঠিকমত জায়গাও নেই। তারওপর জায়গা টা খুব গরম। পার্সেলের লাইনও বেশ লম্বা। ওদিকেও যথেষ্ট সময় লাগবে। অবস্থা বেগতিক দেখে গগন বাবু অস্ফুটে বলেই ফেললেন, এই গরমে এতখন ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনিই না শেষে তন্দুরী হয়ে যান!
"না, আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর স্টার্টার খেয়ে লাভ নেই, একেবারে বিরিয়ানিই খাবো। 'বেস্ট বিরিয়ানি' এখন দারুণ বানাচ্ছে।" বিরক্তি লুকোতে জোর করে মুখে হাসি এনে স্ত্রীকে বলেই ফেললেন গগন বাবু।
দূর থেকেই কিছু একটা গন্ডগোল আন্দাজ করতে পারছিলেন গগন বাবু। কোনোদিন এত ফাঁকা থাকে না 'বেস্ট বিরিয়ানি' এর সামনেটা। আবার ভাবলেন ফাঁকা থাকলে তো ভালই, দাঁড়ানোর ব্যাপার নেই, বেশ রসিয়ে খাওয়া যাবে। কিন্তু ভিতরে গিয়ে বুঝতে পারলেন যেটা আশঙ্কা করেছিলেন, ঠিক সেটাই হয়েছে।
"আমাদের বিরিয়ানি নটার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। তবে এখন আপনি আমাদের চাইনিজ আইটেম পেয়ে যাবেন, ওটাও আমরা দারুণ বানাই।" রিসেপশনে বসা অল্পবয়সী ছেলেটা বেশ স্মার্টলি বলে দিল গগন বাবুকে। গগন বাবুর স্বপ্নের ফানুস টা হঠাৎ ওড়ার আগেই চুপসে গেল! মর্মাহত গগন বাবুর মুখ দিয়ে শুধু একটা কথাই বের হল, "বেস্ট বিরিয়ানি তে বিরিয়ানিই নেই, আর কী খাবো!"
বিরিয়ানি খাবেন যখন বলেই ফেলেছেন একবার, তখন তিনি বিরিয়ানি ছাড়া অন্য কিছু খাবেনই না আজ। একটু দূরেই একটা পুরনো রেস্তোরাঁ আছে। একসময় কাচ্চি বিরিয়ানির জন্য ওটার খুব নামডাক ছিল। কিন্তু এখন খাবারের মান একটু পড়েছে শুনেছেন। কিন্তু বিরিয়ানি পাওয়া গেলে মন্দ কি? এরকম সাত পাঁচ ভেবে স্ত্রীকে নিয়ে আবার এগোলেন। মুখে শুধু বললেন, "বিরিয়ানির কি অভাব নাকি? কী ভেবেছে এরা... বেস্ট বিরিয়ানি মানেই কি বেস্ট?"
পুরনো হলেও বেশ ছিমছাম রেস্তোরাঁর ভিতর টা। অপেক্ষা করতে হল না, টেবিলও ফাঁকা পেয়ে গেলেন। হাতমুখ ধুয়ে বসতেই ওয়েটার অর্ডার নিতে চলে এলো। গগন বাবু মেনু কার্ড দেখার প্রয়োজনও বোধ করলেন না। সরাসরি বলেই দিলেন দুটো মাটন বিরিয়ানি।
"সরি স্যার, হবে না।" বিনম্র ভাবে ওয়েটার ছেলেটি বললো।
"ওহ্ মাটন হবে না? তাহলে চিকেন।"
"সরি স্যার, আজ কোনো বিরিয়ানিই হবে না।"
গগন বাবুর মাথায় যেনো বাজ পড়লো। তাও মাথা ঠান্ডা রেখে বলার চেষ্টা করলেন, "কেনো হবে না? রাত হয়ে গেছে বলে? ম্যানেজারকে ডাকুন...ওনার সাথে আমি কথা বলবো।"
কিছুক্ষণের মধ্যে একজন রাশভারী মধ্যবয়ষ্ক ভদ্রলোক গগন বাবুদের দিকে এগিয়ে এলেন। সম্ভবতঃ ইনিই ম্যানেজার। কন্ঠে মাখন মিশিয়ে বললেন, "কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি স্যার?"
"বিরিয়ানি হবে না কেন?"
ম্যানেজার খুব বিনয়ের সাথে বললেন, "স্যার, আমাদের যে ছেলেটি বিরিয়ানি বানাতো, সে হঠাৎ বাড়ি চলে গেছে। তার মা খুব অসুস্থ। আমরা তো কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজ করতে পারি না, তাই অন্য কাউকে দিয়ে বিরিয়ানি বানাচ্ছি না। প্লীজ স্যার, কিছু মাইন্ড করবেন না। আপনি অন্য কিছু অর্ডার করুন না... আমাদের কাশ্মীরি পোলাও টা স্যার একবার টেস্ট করে দেখতে পারেন.. আপনি ভুলতেই পারবেন না... আর আমাদের মাটন রোগান জোশ... একদম টপক্লাস! ম্যাডাম কি চিকেন প্রেফার করেন? তাহলে আমাদের স্পেশাল চিকেন..."
শেষের কথাগুলো গগন বাবুর কানে আর পৌঁছাচ্ছিলো না। যতই মাইন্ড করতে বারণ করুন, গগন বাবুর মনের যে এখন কী অবস্থা তা এই ম্যানেজারের ব্যবসায়িক মাথায় তা ঢুকবে না।
প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ক্লান্ত শরীরটাকে নিয়ে অবশেষে বাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছলেন দুজনে। বড় বড় ব্যাগগুলো এতক্ষন ধরে হাতে ধরে থাকায় ব্যথা হতে শুরু করেছে। পেটেও ক্ষিদেতে ছুঁচোর ডন দিচ্ছে। বিরিয়ানি নেই শুনে রমলা দেবী বলেছিলেন, "এসেই যখন পড়েছেন যা হোক কিছু খেয়ে নিলেই হয়"। কিন্তু গগন বাবু নাছোড়বান্দা। তিনি খাদ্য বিলাসী। মনের তৃপ্তি যদি না থাকে সে যত সুস্বাদু খাবারই হোক না কেন তাঁর জিভে তা বিস্বাদই লাগবে। তিনিও চট করে হাল ছাড়েন নি। আরও দু তিনটে রেস্তোরাঁতে ঢু মেরেছেন। কিন্তু বেশি রাত হলে যা হয়, কোথাও বললো বড় অর্ডার ছিল সব বিরিয়ানি শেষ হয়ে গেছে, তো কোথাও বললো কারিগর এতো রাতে বিরিয়ানি বানাতে পারবে না। সত্যি, কি নিষ্ঠুর লোক এরা! এদের যত খ্যাতি, যশ, নাম, প্রতিপত্তি সব তো এই গগন বাবুদের মতো ভোজন রসিকদের জন্যই, আর এরাই কিনা গগন বাবুর রসনার কথা একটু ভাবলো না! ওনার মনের বাসনাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিতে একটুও কুণ্ঠা বোধ করলো না এরা!
কলকাতায় শুনেছেন এক ফোনে দশ মিনিটে দরজায় বিরিয়ানি এসে হাজির হয়। দিনরাত বাইকে করে খাবার হোম ডেলিভারি করে বেড়ায়। কিন্তু এই মফঃস্বল শহরে সবাই যেন তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ে। কে শুনবে তাঁর কথা? তিনি তো বিশাল কিছু চান নি, শুধু ভালো বিরিয়ানি খেতে চেয়েছেন। কিন্তু সেই ইচ্ছারও কেউ মূল্য দিল না। বরং স্ত্রীর সামনে তাঁর মান সম্মান সবাই মিলে ধুলোতে মিশিয়ে দিল।
বাড়ি ফিরে খাবার টেবিলে বসে প্রায় গোগ্রাসে গিলে খেলেন সব খাবার। ক্ষিদে বেশ ভালোই পেয়েছিল। পেটটা ভরতেই মন টা একটু হালকা হল গগন বাবুর। মনে মনে ভাবলেন, "নাহ্, রমলা ঠিকই বলে! খাবার তো পেট ভরানোর জন্যই, পেট ভরে গেলেই হল, অত বিলাসিতার দরকার কি!"
"বিরিয়ানি যে এতরকমের হয়, তা তো আমার জানা ছিল না! ... হ্যাঁ, কলকাতা বিরিয়ানি, যেটা আলু দিয়ে করতে হয়, ওর রেসিপি টাই বল... অ্যা! কতটা লাগবে বললি? আরেকবার বল... আমি লিখে নিচ্ছি..."
রমলার গলাই তো! ফোনে কারও সাথে কথা বলছে মনে হচ্ছে। কিন্তু ও বিরিয়ানির রেসিপি নিয়ে... বিরিয়ানি নিয়ে এত মাথা খারাপ করলে এইসব উল্টোপাল্টা স্বপ্নই তিনি দেখবেন। গগন বাবু পাশ ফিরে শুলেন। কিন্তু আবার ফোন এলো। এবার তাঁর কানের কাছেই মোবাইলটা বাজছে মনে হচ্ছে। না স্বপ্ন না, সত্যিই তাঁর মোবাইলটা বাজছে। অতীন দার ফোন।
"সকাল সকাল একটু বিরক্ত করলাম। বলছি শরীর ঠিক আছে তো, মানে পেট...", বেশ নিচু গলায় অতীন বাবু কথা গুলো বললেন।
"হ্যাঁ, আপনি ভালো আছেন তো?"
"আরে ওই জন্যই তো ফোন করলাম! সকাল থেকে পেট গুড়গুড় করছে, দশ বারোবার তো হয়েই গেলো। কাল 'বেস্ট বিরিয়ানি' এর দিকে তোমাকে যেতে দেখলাম, তাই আর কি..."
গগন বাবু এবার আসল ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারলেন। কিন্তু তিনিও মনখারাপের কথা আর মনে করতে চান না। তাই একটু মিথ্যাই বললেন, "না না আমি তো জুতোর দোকানে গিয়েছিলাম।"
অতীন বাবু হচ্ছেন গগন বাবুর অফিসের সহকর্মী, বয়সে অনেক বড় হলেও একই পাড়ায় বাস। তাই যাওয়া আসার পথে সুখদুঃখের অনেক গল্পই করেন। উনিও গগন বাবুর মতই বিরিয়ানির খুব ভক্ত। কিন্তু ওনার আক্ষেপ একটাই। "ছোটো বেলায় পকেটে পয়সা ছিল না, আর যখন পয়সা হল তখন সুগার কোলেস্টেরোলে ধরলো। বিরিয়ানি আর খেতে পারলাম কই!" অতীন দার মুখে প্রায়ই শুনে আসতেন গগন বাবু। কিন্তু তাও তিনি যে বাড়ির লোকজনদের লুকিয়ে বেশ ভালই বিরিয়ানি সাঁটিয়ে আসেন, তা গগন বাবু ভালো করেই জানেন। আর গতকালও অতীন বাবু যে 'বেস্ট বিরিয়ানি' তে খেতে গিয়েছিলেন, সে বিষয়ে তিনি একদম নিঃসংশয়। সত্যি, সবাই এদিক ওদিক করে ঠিক জোগাড় করে ফেলছে, আর তার বেলাতেই শুধু নেই নেই... ঈশ্বরের এ চরম অবিচার!
রবিবার সকাল সকাল ঘুম টা চটকে দিল। বিরক্তি মুখে পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছিলেন গগন বাবু। এমন সময় স্ত্রীর ডাক, "আর ঘুমাতে হবে না, ওঠো বাজারে যেতে হবে। লিস্ট করে দিচ্ছি, আর মাংসের দোকানে গিয়ে বড় লেগ পিস গুলো দেখে নেবে। তাড়াতাড়ি যাও, আমি ম্যারিনেট করে রাখবো।"
"ম্যারিনেট?"
"হ্যাঁ, আজ বিজু ফোন করেছিলো। কি সব অরিজিনাল ডকুমেন্টস লাগবে তাই আজ বাড়ি আসছে।"
বিজু ওনাদের একমাত্র ছেলে। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে।
"আরে ও আবার কষ্ট করে আসছে কেন? আমিই না হয় দিয়ে আসতাম।"
"আরে থামো না! ছেলেটা আসতে চাইছে আসুক না, হোস্টেলে ঠিক করে খেতে পারে না, ওই যা রান্না!"
"হোস্টেলের রান্না তো ওরকমই হয়..."
"তাই বলে এত বাজে! এই কদিনে কত রোগা হয়েছে জানো?"
"কেন? তুমি যে বলো খাওয়া টাই জীবনের সব না।"
"সে তো তোমাকে বলি..."
"বাহ্ রে, নিয়ম কি এক এক জনের জন্য এক এক রকম?"
"সত্যি! তুমি আর বিজু এক হলে? চল্লিশের পর ডাক্তাররাই তো খাওয়া দাওয়া লিমিট করতে বলে... তাছাড়া তুমি চাইছো বিরিয়ানি, আর ওদিকে ছেলেটা যে ভাতই খেতে পারছে না, সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই... কিরকম বাবা তুমি?"
গগন বাবু চুপ করে গেলেন, রবিবারের সাতসকালে এত ঝগড়া ঝাটি পোষায় না। তারপরে যদি শোনেন অতীন বাবু কে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাহলে তো আর রক্ষে নেই!
রমলা দেবী আবার তাড়া দিয়ে বললেন,"তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও! ছেলেটা একদিনের জন্য আসছে, ভাবছি আজ বিরিয়ানি বানাবো। খেতে বড় ভালোবাসে।"
গগন বাবু নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো! মুখ দিয়ে শুধু বের হল, "বিরিয়ানি বানাবে তুমি?"
"হ্যাঁ, কেনো আমি বানাতে পারবো না?"
"না মানে, বানাতে দেখিনি তো কখনও...", আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলেন গগন বাবু।
"আজ মনে হচ্ছে সবাইকে না খেয়েই থাকতে হবে!" মনে মনে বললেও মুখ ফুটে বলার সাহস পেলেন না তিনি। রমলা দেবী এবার বললেন, "আরে, আমার বান্ধবী ময়না আছে না! ও তো দারুণ বিরিয়ানি বানায়, অনেকের মুখেই খুব প্রশংসা শুনেছি। আমি ওকে ফোন করে রেসিপি জেনে নিয়েছি। একদম দম বিরিয়ানি।"
রমলা দেবী সকাল থেকেই বেশ উত্তেজনায় ফুটছেন। সাথে একটা চাপা টেনশন তো ছিলই। তিনি কি পারবেন ছেলে ও স্বামীকে ওদের সবচেয়ে প্রিয় বিরিয়ানি খাওয়াতে? সকাল থেকেই তিনি মনপ্রাণ ঢেলে রেসিপি অনুসারে সব করেছেন। বার কতক ময়না দেবী কে ফোনও করেছেন। এখন তাঁর রেজাল্ট বেরোনোর পালা।
অনেক দিন পর গগন বাবু আজ স্ত্রী ও ছেলেকে একসাথে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারবেন। বেশ গুছিয়ে বসে অধীর আগ্রহে সেই মাহেন্দ্রক্ষনের অপেক্ষায় আছেন। যদিও একটা উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। অবশেষে এলো সেই মুহূর্ত। সুগন্ধে ভরে গেছে চারিদিক। এখন শুধু স্বাদ গ্রহণের অপেক্ষা। ধোঁয়া ওঠা হাড়ি থেকে বাসমতী রাইসের লম্বা দানা আর বড় একটা লেগ পিস পাতে পড়তেই গগন বাবু আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না। মুখে পুরেই চোখ বন্ধ করলেন। এক অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তিতে ভরে উঠলো তাঁর মন। অনেক ঝড় ঝাপটা, অপমানের পর এই অতিপ্রতিক্ষিত মুহূর্ত যেন স্বাদ আরও দশ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আজ বিরিয়ানি মুখে দিয়ে যে স্বর্গীয় সুখ উপলব্ধি করলেন, তা তিনি আগে কখনও পান নি।
ছেলে এর মধ্যে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে ফেলেছে, "মা প্রথমবারেই ছক্কা হাঁকিয়েছ। সবকিছুই একদম পারফেক্ট। লেগ পিসটাও খেতে দারুণ হয়েছে, একদম মাখনের মত নরম।"
এদিকে গগন বাবু কোন কথা না বলেই খেয়ে যাচ্ছেন। রমলা দেবী একটু চিন্তায় পড়লেন, তাহলে কি ওনার পছন্দ হয় নি? অবশেষে খাওয়া শেষ করে একটা বড় ঢেঁকুর তুলে গগন বাবু সগর্বে ঘোষণা করলেন, "আর বাইরের বিরিয়ানি নয়, এবার থেকে আমি বাড়ির বিরিয়ানিই খাবো।"
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment