ছবি : ইন্টারনেট |
ভাষার দর্শনে রবি - ভানু
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,"কোনো শিক্ষাকে স্থায়ী করতে চাইলে, গভীর করতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়।"মাতৃভাষার প্রতি চরম আবেগের নিদর্শন রবীন্দ্রনাথের সমান্তরালে নেপালের ভানুভক্ত আচার্য্য। নেপাল সাহিত্যে সুবা নন্দ দাসের পৃথ্বী নারায়ণ শাহের লেখা থাকলেও সে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ভাণুভক্ত নেপালের একটা অধ্যায়।প্রাক ভানুভক্ত যুগের সাহিত্য ছিল সংস্কৃত ভাষা কেন্দ্রিক।ফলে সাহিত্য সংস্কৃত ভাষা জানা উচ্চ শ্রেনীর মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভানুভক্ত প্রথম মানুষ যিনি সাধারণ মানুষের ভাষাকে সাহিত্যে রূপ দেন। নিজে ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সংস্কৃত ভাষা সেখানেই শেখেন। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে আসেন বেনারসে। ভানুভক্ত এমন একটি সময়ে জন্ম যখন নেপালি ছিল মৌখিক ভাষা। ফলে সাধারণ মানুষ নেপালি ভাষাতে কথা বললেও তাতে সাহিত্য ছিল না। ভানুভক্ত ১৮৪১সালে বাল্মীকির রামায়ণের অনুবাদ শুরু করেন নেপালি ভাষায়।তিনি তাঁর অনুবাদে যে সরলতা দেখিয়েছেন তা সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। পাশাপাশি,তিনি মহাকাব্যের ভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটাননি।রামায়ণের অনুবাদের পর নেপালি ভাষায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়।তিনি তাঁর অনুবাদ শেষ করেন ১৮৫৩সালে। তবে তাঁর জীবিতকালে তিনিও জীবনানন্দের মত ইতিবাচক সাফল্য পাননি। যে কষ্টের মধ্যে দিয়ে রামায়ণের অনুবাদ শেষ করেছিলেন তা বোধহয় জন মিল্টনের প্যারাডাইস লোস্টের সঙ্গেই তুলনীয়। কবি মিল্টনের মত তিনিও ছিলেন প্রতিবাদী। ভানু ভক্তের লেখায় কখনও জীবনের দাবিদাওয়া, কখনও গরীব মানুষের কথা বলেছেন। তাঁর ঘানসি কবিতায় তিনি শ্রমিকদের অসহায় জীবনের কথা বলেছেন। ১৮৮৬সালে ভানু ভক্ত তাঁর প্রথম দুটি কবিতা রচনা করেন। শুধু রামায়ন অনুবাদ করেই তিনি থেমে থাকেননি, তাঁর অনুবাদের তালিকায় রয়েছে কান্তিপুরী,নগরী, গীরিধারি লে,বালাজি দেখান, রামগীতা, বধূশিক্ষা।
ভানুভক্ত ভাষায় মাধ্যমে
জাতির মানসিকতার বিকাশ ঘটান। ভাষাকে তিনি সন্তানের মতো লালন পালন করেছেন। অনুবাদ যেমন
ভাষার দক্ষতা, তেমনি অনুবাদের মাধ্যমে
তিনি বাইরের জগতের সঙ্গে নিজ জাতির পরিচয় করিয়ে দেন। ১৮১৫সালে সৌগুলির সন্ধির দ্বারা
নেপালের পূর্ব ও পশ্চিমের এক তৃতীয়াংশ ব্রিটিশদের হাতে চলে গেলে নেপালের শিক্ষিত মানুষ
সেটাকে মেনে নিতে পারেনি। ভানু ভক্ত তাঁদের দাবি সমর্থন করেন। তিনি গণ জাগরনের ব্রত
নেন। তিনি চিরকাল ন্যায়ের পক্ষে। কখনও কোনো শক্তির কাছেই আপস করেননি। নির্ভীক ভানু
ভক্ত তৎকালীন সমাজ ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেও সরব হোন। তিনি রাজ রোষের মুখে পড়েছেন।
তাঁকে বন্দি করা হয়। পরে তিনি নিজের ও বাকি বন্দীদের মুক্তি দাবিতে প্রধানমন্ত্রী
রানার কাছে শ্লোক আকারে চিঠি দেন যার নাম প্রশ্নোত্তর মালা। তবে ভানু ভক্তকে আদি কবির
সন্মান দেওয়া থেকে শুরু করে তাঁর লেখা সংগ্রহ করে রাখার পেছনে রয়েছে মতিরাম ভট্ট।
যদিও কেউ কেউ মতিরাম ভট্টকে গুরুত্ব দিতে নারাজ।
দার্জিলিং,
সিকিম,মায়ানমার,ভুটানে ভানু ভক্তের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সিকিমের
প্রধানমন্ত্রী প্রেম সিং তামাং ভানু ভক্তের নতুন মূর্তি উন্মোচন করেন। ভানু ভক্তের
লেখার আবেদন নাড়া দিয়েছে আট থেকে আশি। নেপালের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা ভানু
ভক্ত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন,"মেছি থেকে মহাকাল ভানু ভক্তের ভাষাই জাতিকে ঐক্য বদ্ধ করেছে। ১৯৫৫সালে বাল কৃষ্ণ
শামা পরিচালিত জাতীয় কমিশন ভানু ভক্তকে রাষ্ট্রীয় বিভূতি বলে সন্মান দেন। তাঁদের
কাছে,তিনি শুধু মাত্র ভালো লেখক
নন, একজন ভালো সমাজ সেবক। ভাষাই
তাঁর অস্ত্র। ভাষার মধ্যে দিয়ে জাতি গড়েছেন, শিক্ষার রসদ সরবরাহ করেছেন। তাঁর কবিতা কখনও হয়ে
উঠেছে ঈশ্বরকে পাবার পথ, চেতনার অনুসন্ধান।
তাঁর লেখা ভক্তমেলায় তিনি যে সাধনার কথা বলেছেন তা লালনের কথা মনে করিয়ে দেয়।অন্যদিকে,
তাঁর কন্টিপুন নগরীতে তিনি
নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন কাঠমান্ডু ও সেখানকার মানুষের জীবন কথা। ভানু ভক্ত নেপালকে
বিন্দুতে সিন্ধুর স্বাদ দিয়েছেন। সময় পাল্টে যাবে ।ভাষার পরিবর্তন ঘটবে। বিশ্বায়নে
মানুষের হাতে আসবে বিকল্প। ভাষাও হবে সস্তা।জাতি তার নিজের ভাষা ছেড়ে সস্তা ভাষার
প্রতি আকর্ষণ বাড়াবে। তখনই হবে ক্ষয়।রবীন্দ্রনাথ, সারদা প্রসাদ, রাম দয়াল, ভানু ভক্ত, কুঞ্জং চোডেনরা যেভাবে তাঁদের ভাষাকে শিশু মত আগলে
রেখে সাবালক করে তুলেছিলেন, আমরা বোধহয় তাকে
নষ্ট করে ফেলেছি।
কবি ভানু ভক্ত আচার্য্য
তাঁর কবিতার ছন্দেও বৈচিত্র্য এনেছেন। ঘাসির কাছে থেকে অনুপ্রাণিত ভানু ভক্তের প্রেমে
পাগল রাজনীতির লোকেরাও। ভানু ভক্তকে হাতিয়ার করে পাহাড় রাজনীতি করতে চাইছে অনেকেই।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ভানু জয়ন্তী পালন করেন । পশ্চিমের ভাষাতে খুব বেশি
পরিচিত ছিলেন না ভানু ভক্ত। তাঁর লেখার সরলতায় মিশে ছিল ধর্মের আদর্শ আর দেশের প্রতি
ভালবাসা। পরিশেষে, নেপালি ভাষার প্রতি
ভানু ভক্তের ভালবাসা দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা মনে পড়ে যায়। ভারতী পত্রিকায়
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,"ইংরেজিতে যাহা শিখিয়াছ
তাহা বাংলায় প্রকাশ কর, বাংলা সাহিত্য উন্নতি
লাভ করুক ও অবশেষে বাংলা বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক।"রবীন্দ্রনাথেরও
বাংলা ভাষার প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা।রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,"বাংলা ভাষাকে চিনতে হবে ভালো করে, কোথায় তার শক্তি, কোথায় তার দুর্বলতা,দুই আমাদের জানা চাই।"তিনিও ভাষার জন্য লড়াই
করেছেন।রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন বাংলা গবেষকদের কাজে অখুশি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
এক প্রস্তাবে তিনি বলেছিলেন,"বর্তমানে বাংলা বানানে
যে বিশৃংখলা চলছে তার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা স্থাপন করা আবশ্যক।"তিনি শিক্ষকদের আরোও
সজাগ হবার পরামর্শ দেন। তাঁরই কথা মত তৈরি হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার
সমিতি। তাঁদের বই প্রকাশিত হয় ১৯৩৬সালে যার নাম বাংলা বানানের নিয়ম।রবীন্দ্রনাথ মনে
করতেন, সংস্কৃত ব্যাকরণ দ্বারা বাংলা
ভাষাকে শাসন করলে চলবে না।রাজশেখর বসুকে তিনি লিখেছিলেন,"বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ একেবারেই নেই।"ভাষার
মৌলিকত্ব নিয়ে তিনি ভাবতেন।জীবনানন্দও বাংলা ভাষা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তাই ভাষার
স্বার্থে ভানু ভক্ত আর রবীন্দ্রনাথ একই চিন্তার অধিকারী। মাঝখানে শুধু সীমান্ত। সাহিত্য
তো দেশ ছড়িয়ে পাড়ি দেয় তেপান্তরে নীলকন্ঠ পাখির মত। শুধু একটাই বিশ্বাস থাক মনে
যা মিলান কুন্দ্রেরা বলতেন,"মানুষ জানে তার মৃত্যু
হলেও তার ভাষার মৃত্যু হবে না।"
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment