1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

প্রকৃত নাগরিক গড়ে তুলতে শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব ও গুরুত্ব প্রাসঙ্গিকতা

ছবি : ইন্টারনেট

প্রকৃত নাগরিক গড়ে তুলতে শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব ও গুরুত্ব প্রাসঙ্গিকতা

পাভেল আমান

একজন মানুষের সাফল্যের পেছনে তার শিক্ষকের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।সেই শিক্ষককে যে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। তিনি যে কেউ হতে পারেন তার অবদান থাকতে পারে জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে।তিনি কেবল পুঁথিগত শিক্ষা দেবেননা, আসল শিক্ষক তিনি যে মানুষটি জীবনে চলার পথে পরামর্শ দেয় ,ব্যর্থতায় নিঃস্বার্থ পাশে দাঁড়ায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সাফল্যের পরে নতুন লক্ষ্য স্থির করে দেয়।জীবনে শুধু সফল নয় একজন প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করেন। একটি জাতির উন্নতি ও স্বয়ংসম্পূর্ণতাতার দেশের সামগ্রিক শিক্ষা পরিকাঠামো ও পরিবেশের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। আর এই জাতি গঠনে মূল ভূমিকা পালন করেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকেরা।আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিক্ষানবিশি ধারাবাহিকভাবে চলমান। সহজভাবে  খোলসা করলে যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি। হামাগুড়ি থেকে নিজ পায়ে ভর দিয়ে সাহসী হয়ে হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা, বাংলা ও  ইংরেজি বর্ণমালার সহজপাঠ, ১ থেকে ১০০ সংখ্যা ,ছড়া ,পশু পাখিদের সনাক্তকরণ, রূপকথার গল্প, আরো রকমারি হাসি-আনন্দে ,মজা ,দুষ্টুমির ছলে অনায়াসে গোগ্রাসে গেলার মত বাড়িতেই বাবা-মার কাছ থেকে অপত্য স্নেহ, আদর ,ভালোবাসা ও অনুশাসনের অলৌকিক রসায়নে  শিখে যাই। এক কথায় আমাদের শিক্ষার প্রদীপটা তারাই প্রজ্জ্বলন করেন। সেই সুচারু দৃষ্টিতে আমাদের সকলের বাবা ও মা-ই আমাদের সর্বজনীন পরম গুরু এবং জীবনকে চালিত করার প্রিয় শিক্ষক। তাইতো শিক্ষক সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথা শিক্ষক আব্দুল কালাম বলেছিলেন"যদি একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং সুন্দর মনের মানুষের জাতি হতে হয়, তাহলে আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি এক্ষেত্রে তিনজন সামাজিক সদস্য পার্থক্য এনে দিতে পারে ।তারা হলেন বাবা ,মা এবং শিক্ষক"। আমাদের জীবনটাকে একটা পূর্ণতার অটুট ,চিরন্তন ও শ্বাশত ডোরে বেঁধে দেন - যার প্রভাব আমৃত্যু শরীরের শোণিত ধারায় বহমান। আমাদের জীবনে বহু কৌণিক ও বহুমাত্রিক ভাবে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করতে গেলে চরম আবশ্যিকভাবে বাবা- মায়ের ভূমিকা ও অবদান একজন প্রকৃত শিক্ষকের থেকে কোন অংশেই কম নেই।সেই প্রেক্ষাপটে আমাদের অর্থাৎ ছেলেমেয়েদের কাছে বাবা-মায়েরাই আবহমানকাল থেকে আদর্শ শিক্ষা রূপে বরেণ্য ও পরিগণিত। শিক্ষক দিবসের শুভ লগ্নে তাদের কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সূচনা মুহূর্তের শিক্ষক তথা সর্বোপরি ও পূজনীয় গ্রুপে স্মরণ করে যথেষ্ট গর্বিত ধন্য ও অনুপ্রাণিত বোধ করি ও মন মাতোয়ারা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।


এবারে আসা যাক ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস সম্পর্কে। ভারতের ভূতপূর্ব প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড: সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিন ৫  সেপ্টেম্বর (১৮৮৮)। মানুষটি ছাত্রকালে অতি মেধাবী ছিলেন। কোন পরীক্ষায় জীবনে দ্বিতীয় হননি। বিভিন্ন বৃত্তি লাভের মাধ্যমে অতি কষ্টে তিনি নিজের ছাত্র জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯০৫সালে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে।বেদান্ত দর্শনের বিমুর্ত পরিকল্পনা ছিল গবেষণার বিষয়। বিশ্বের দরবারে দার্শনিক অধ্যাপক হিসাবে তাঁর অপরিসীম খ্যাতি ছিল। ১৯০৯সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে।এরপর একে একে সারা জীবনে তিনি মাইসোর ,কলকাতা, শিকাগো বহু বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়িয়েছেন।সেই সময় তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।পরবর্তীকালে তিনি অন্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। ডঃ রাধাকৃষ্ণন ভীষণ ভাবে প্রভাবিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শনের দ্বারা।তাই তাঁর প্রথম বইটি তিনি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের দর্শন নিয়ে- দা ফিলোজফি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় তিনি বিখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ফিলোসফিতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এই সভিয়ভারতীয় দর্শনকে আন্তর্জাতিক স্তরে বিশেষভাবে পরিচিত করান। তাঁর রচিত বইয়ের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ইস্টার্ন রিলিজিয়ান এন্ড ওয়েস্টার্ন থট, দা ভাগবত গীতা , দা প্রিন্সিপাল উপনিষদ প্রভৃতি।এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন যার মধ্যে ছিল দ্য কোয়েস্ট ,জার্নাল অফ ফিলোসফি, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ এথিকস।।তিনি ছিলেন শাণিত বাগ্মী , অধ্যাপক ,রাজনীতিবিদ ,দার্শনিক এক কথায় বহুমুখী প্রতিভা সমন্বিত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তার দার্শনিক চিন্তা ছিল সর্বকালের সর্ব দেশের মানুষের কাছে আলোর দিশারী স্বরূপ। দীন দুঃখী ভারতীয়দের প্রতি তার ছিল অশেষ ভালোবাসা সহানুভূতি আর সহমর্মিতা। তাঁর সম্পর্কে পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর অভিধা ছিল"great philosopher ,a great educationist, a great humanist". সমগ্র জাতির জন্য তার সুদীর্ঘ জীবনের কর্মধারা আর আদর্শ এখনো চিরভাস্বর ও যুগান্তকারী। কথিত আছে তার কিছু ছাত্র ,অধ্যাপক ,বন্ধুবান্ধব ও গুণমুগ্ধ তাঁর জন্মদিন পালন করতে উদ্যোগী হলে ,রাধাকৃষ্ণন তাদের বলেছিলেন ৫ সেপ্টেম্বর আমার জন্মদিন আলাদাভাবে পালন না করে, দিনটি যদি শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয় তাহলে আমি বেশ খুশি হব। সেই থেকেই শুরু হলো ৫ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করার রীতি।ভারতের সংবিধান রচয়িতা কমিটির একজন সদস্য ছিলেন তিনি এবং এই সংবিধান রচনাতে তাঁর বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।তিনি তাঁর বর্ণময় জীবনে বহু সম্মান পেয়েছেন যার মধ্যে অন্যতম হলো নাইটহুড।যদিও ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তিনি স্যার উপাধি পরিত্যাগ করেছিলেন।পেয়েছেন ব্রিটিশ একাডেমির ফেলোশিপ, জার্মান বুক ট্রেড শান্তি পুরস্কার এবং অবশ্যই ভারতরত্ন।তিনি সারাজীবনে মোট ষোলো বার নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ও এগারোবার নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।এছাড়াও পেয়েছেন টেমপ্লেটন প্রাইজ, বৃটেনের অর্ডার অব মেরিট ,সাহিত্য একাডেমীর মতো আরোও বহু পুরস্কার।ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ বলেছিলেন-" শিক্ষার সর্বোচ্চ ফল হওয়া উচিত একজন সৃজনশীল মানুষ যিনি বিপরীত পরিস্থিতি এবং প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবেন।দারিদ্র্য সমস্যা কাউকে দমিয়ে রাখতে পারে না। অধ্যবসায় ও জ্ঞানের তৃষ্ণা মানুষকে শীর্ষে উত্তরণ ঘটাতে পারে। জ্ঞান-বিজ্ঞান হলো একমাত্র পথ যার দ্বারা জীবন আনন্দ খুশিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। সত্যিকারের শিক্ষক তারাই যারা আমাদের ভাবতে সাহায্য করেন।"তার নিজের জীবন দিয়ে তিনি এই দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন বারবার। পরাধীন ভারতবর্ষের বাস করেও স্ব-মহিমায় ইংরেজদের কাছ থেকে পেয়েছেন অনেক সম্মান গর্বিত করেছেন সমগ্র ভারতবাসীকে। ১৯৭৫ সালের১৭ এপ্রিল এই মহান জাতীয় শিক্ষকের প্রয়াণ ঘটে ।আমাদের স্বীকার ও পুনর্বার মনে রাখতে হবে শিক্ষক জাতির মেরুদন্ড। তারা মানুষ তথা আদর্শ নাগরিক গড়ার নিপুণ কারিগর। তাদের জ্ঞানশিখা থেকে লক্ষ প্রাণে অজ্ঞতানাশী জ্ঞানশলাকা হয় প্রজ্জ্বলিত। দেহ মনে প্রাণে আত্মায় পরিপূর্ণ বিকাশের দিশারী তারা।তাদের সততা ন্যায় ,নিষ্ঠা ,একাগ্রতা, সহনশীলতা ,আন্তরিকতা ,সহমর্মিতা এবং সর্বোপরি জ্ঞান তপস্যা শিক্ষার্থীকে করে অনুপ্রাণিত, উজ্জীবিত। আমরা জ্ঞাত একজন আদর্শ শিক্ষক কেবলমাত্র পড়াশোনার ক্ষেত্রে নয় তিনি ছাত্রকে জীবনে চলার পথে পরামর্শ দিবেন ,ব্যর্থতায় পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিবেন ,সাফল্যের সোনালী দিনে নতুন লক্ষ্য স্থির করে দিবেন। তিনি তাকে জীবনে সফল হওয়ার পারিপার্শ্বিক একজন ভালো মানুষ হওয়ার পাঠও শিখাবেন।


কিন্তু পরিতাপের বিষয় বর্তমান বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কে বহুরৈখিক বিমুর্ত ফাটল প্রতীয়মান। যেটা শিক্ষাক্ষেত্রে অশনি সংকেত। আমরা চাই শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আরো নিবিড়, মজবুত, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সৃষ্টিশীল হয়ে ফুলে-ফলে ভরে উঠুক শিক্ষা নামক বাগিচায়।প্রকৃত শিক্ষার মধ্য দিয়ে সমাজ থেকে অন্যায় ,অত্যাচার ,অনাচার, কুসংস্কার ,জাতিভেদ ,ধর্মীয় গোঁড়ামি ,বর্ণভেদ প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধি দূর হোক এবং এক বিজ্ঞানমনস্ক, শোষণমুক্ত ,সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে  উঠুক। পরিশেষে মহান শিক্ষক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ এর জন্মদিবসে অর্থাৎ সর্বজনবিদিত শিক্ষক দিবসে আমরা সমস্ত শিক্ষকগণ এরা মিলেমিশে একাকার হয়ে শিক্ষকতা দায়িত্বকে পেশাগত না ভেবে সৃষ্টিশীল ,কর্মমুখীন ও নির্মাণ মুখী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রকৃতার্থেই মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে নিজেদের আখ্যায়িত হতে ও মেলে ধরতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। হোক কলরব আবারো শিক্ষক মহলে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে। কেননা একজন শিক্ষক পারেন তার জ্ঞান, আদর্শ ও সঠিক পথের নির্দেশনা সবার মাঝে নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দিতে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায় "শিক্ষাকে বাহন করো, বহন করো না"। আমরা মহান শিক্ষাবিদ ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ এর জীবন দর্শনকে স্মরণ করার পাশাপাশি সমাজ,দেশ ও জাতি গঠনে যে সমস্ত শিক্ষকেরা তাদের নিরবধি শিক্ষা দানের মাধ্যমে এই মহান কর্মকাণ্ডে অখন্ড সত্তায় নিয়োজিত সেইসব কর্মযোগী ,সৃষ্টিশীল মানুষ গড়ার কারিগরদের এই বিশেষ দিনে তাদের সম্মাননা জানাই।

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment