![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
কোমল-হৃদয়
অভিষেক ঘোষ
আমাদের বলরামবাবুকে দেখতে যতই হোমরা-চোমরা বলে মনে হোক না কেন, আসলে তিনি মোটেই তা নন। ওঁর ওই লম্বা, পালোয়ানের মতো বিশাল চেহারা, কটা চোখ আর পাক দেওয়া গোঁফ দেখে মনে হয় বটে উনি ডাকু বা দারোগা - এমনই কিছু হয়ে থাকবেন; কিন্তু উনি কোনোটাই নন। বরং উনি আসলে কেমন, সে কথা বললে তোমরা অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবে না। এখন আমি তোমাদের বলতেই পারি, কেবল তোমরা যদি আমায় কথা দাও, এ কথা কাক-পক্ষীতেও কোনোদিন জানবে না। ঘটনাটা যেহেতু বলরামবাবুকে নিয়ে, তাই গল্পটা যে আমি বলেছি সেটা উনি না জানলেই হল, আমায় বড্ড স্নেহ করেন কিনা!
গত বছরের কথা... নভেম্বর মাস। আমরা পাড়ার ক্লাবের সামনে আড্ডা দিচ্ছিলাম। জানি একটু পরেই ডাক আসবে, পড়তে বসার। সে'দিন আমার টিউশনও ছিল না। তখন বোধহয় বিকেল চারটে হবে, রবিবার। রনি আর হিয়া এমনিতে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী, কিন্তু হিয়া ইংলিশ মিডিয়াম আর ওর পরীক্ষার দেরি আছে বলে ওরা রাজস্থান বেড়াতে গেছে। আমার আর রনির সেই উপায় নেই। সেই ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় ওদের সাথে আমার আলাপ, তারপর থেকে ওরা আমার জিগরি দোস্ত। দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেল। এখনও মনে আছে, কার ওজন বেশি প্রমাণ করার জন্য কীভাবে আমরা তিনজন তিনটে মাটির কলশির উপর দাঁড়াতে গিয়েছিলাম! আমরা তখন থ্রিতে পড়ি, আমি আর রনি তো সোজা কলশি ভেঙে ঢুকে গেলাম, হিয়া দিব্যি দাঁড়িয়ে। আমাদের যেমন কেটে-ছড়ে গেল, তেমন মারও খেলাম। হিয়া কিন্তু আমাদের মার খেতে দেখে সে'দিন একটুও হাসে নি, বরং ভয় পেয়ে কেঁদেছিল। তখন আমি এই পাড়ায় নতুন, গঞ্জেও। ব্যাস, আমাদের ভাব হয়ে গেল।
সে যাই হোক, আমাদের বলরামবাবু আসলে হিয়াদের বাড়ির একজন ভাড়াটে, নীচের তলাতেই থাকেন। বহুকাল রয়েছেন, আমরা এলাকায় আসারও আগে থেকে, এখন ওঁরা হিয়াদের পরিবারেরই অংশ। হিয়ার বাবা মানে প্রণবকাকুদের পারিবারিক অনেক দায়িত্বও বলরামবাবু প্রায়শই বহন করে থাকেন।
তো হয়েছে কী... সেদিন অচিন্ত্য আমাদের জ্ঞান দিচ্ছিল। ও আমাদের চেয়ে এক বছরের বড়ো। তাই বোধহয় আই.পি.এল. থেকে শুরু করে জুরাসিক এজ - সব বিষয়েই ওর অগাধ জ্ঞান, সে-সব কেউ শুনতে না চাইলেও ও শুনিয়েই ছাড়ে। কথা বলছি, হঠাৎ একটা হট্টগোল শোনা গেল। ক্লাবের ভিতর থেকে দাদারা বেরিয়ে এল ক্যারাম ছেড়ে। একটু এগিয়ে গিয়ে শুনলাম, হিয়াদের বাগানে নাকি একটা চোর ঢুকে কলার কাঁদি কাটতে গিয়ে হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। প্রদীপকাকা কলার তুলে ঘুরছেন এবং সবচেয়ে বেশি হম্বি-তম্বি করছেন। দেখেই বোঝা যায়, তিনিই চোর পাকড়াও অভিযানে অধিনায়ক ছিলেন।
প্রদীপকাকা বাজখাঁই গলায় বললেন, "আমি তো গিয়েই বললাম, বলরাম কী এভাবে বসেই থাকবে নাকি! চোর যে পালিয়ে যাবে! প্রণবরা তোমার উপর একটা এত বড়ো দায়িত্ব দিয়ে গেছে! আর তুমি কিনা সব জেনেশুনে বসে আছো!"
গণেশদাদু এগিয়ে এলেন, "তা সে কী বললে?"
"কী বললে? শুনলে তোমরা অবাক হয়ে যাবে। ওই অতবড়ো চেহারা নিয়ে টিভির সামনে ইজিচেয়ারটাতে এলিয়ে বসে বললে, আহা! কী মুশকিল! তোমরা যাও, গিয়ে ধরো... এই সিরিয়ালটা ফেলে আমি এখন যাই কী করে!"
"বলল! মানেটা কী! বাগান মোনবার দায়িত্ব তো বলরামেরই, আমাদের তো নয়! সিরিয়াল দেখলেই হবে!"
"তবেই বোঝো..." - বিরক্ত প্রদীপকাকা মন্তব্য করেন।
অচিন্ত্য টুক করে বড়োদের মাঝখানে ফুট কাটে, "তাছাড়া ওই সিরিয়াল-ফিরিয়াল হটস্টারে যখন চাইবে, দেখতে পাবে... চোর ধরাটা ইজ মোস্ট ইমপর্ট্যান্ট থিং টু ডু নাও... এমন সুযোগ..." - তার কথা শেষ হয় না, সমস্বরে সবাই বলে ওঠে, "তুই থামবি?"
বেচারা! বড়োদের ধমক খেয়ে সে পিছিয়ে আসে। তারপর গম্ভীর মুখে আমাদের বলে, "চোর ধরার কিছু বেসিক নিয়ম আছে বুঝলি..." আমি আর রনিও তখন সমস্বরে বলি, "থাক্...!"
চোর যে ধরা পড়েছে আর সে যে আপাতত হাতের নাগালেই রয়েছে, সেটা জেনেও বোকার মতো ক্লাবের সামনে বসে থেকে সময় নষ্ট করে কে! আমরা তিনজনেই ছুটলাম! গিয়ে দেখি বলরামবাবুর ঘরের সামনে ততক্ষণে মেলা বসে গেছে। মূল আকর্ষণ - চোর। লোকটার কানের দুপাশ আর মাথার পিছনে চুল নেই বললেই চলে। মাথার উপরে মধ্যিখানে বড়ো বড়ো চুল, তাতে আবার সবুজ রঙ করা! চোর যে এ'রকম ফ্যাশন-সচেতন হয়, কোনো আইডিয়া ছিল না। গায়ে একটা টাইট গেঞ্জি, তাতে কালো রঙের উপরে হলুদ ডোরাকাটা বাঘের মুখ আঁকা। চোরের এক কানে ফুটো, তাতে আবার পুঁচকে মতো দুল পরেছে। লুঙ্গিটা গুটিয়েছে হাঁটু অব্দি। গায়ের রঙ্ বেশ কালো। সকলের কথায় জানা গেল, লোকটিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তবে এ তল্লাটে তার বাড়ি নয়।
তুষারবাবু এলাকার লিডার। সাধারণত এমন সুযোগ ছাড়েন না... কিন্তু যখন জানা গেল চোরটি তাঁরই দলের কর্মী, তিনি প্রদীপকাকাকেই নেতৃত্বের দায়িত্ব তুলে দিলেন... বললেন, "তোমার অমন বাজখাঁই গলা, জেরাটা তুমিই করো।" বলাই বাহুল্য কথাটা শুনে আর তুষারবাবুর হাব-ভাব দেখে, আমরা কষ্ট করেই হাসিটা চাপলাম।
অচিন্ত্য ওই সুযোগে আবার লেকচার শুরু করল, "জানিস্ উত্তর ভারতে ষোড়শ শতকে বাজবাহাদুর খান নামে একজন শাসক ছিলেন, সংক্ষেপে তিনি ছিলেন বাজ খাঁ। জোর গলায় হেব্বি গান করতেন। ওইখান থেকেই তো 'বাজখাঁই' কথাটা এসেছে! আমাদের প্রদীপকার সাথে মিল আছে, বল?"
রনি বলল, "তুই থামবি! শুনতে দে..."
বলরামবাবুর সিরিয়াল তখন শেষ, তিনি তাঁর পুরনো ইজিচেয়ারটা বারান্দায় টেনে এনে আরাম করে বসলেন।
বলরামবাবুকে দেখেই চোর হাতজোর করে বলল, "স্যার এ যাত্রা ছেড়ে দিন স্যার। ঘরমে বিবি-বহেন আউর বেটিয়া হ্যায়। হাম শ্রীঘর জায়েগা তো ঘর ক্যায়সে চলেগা!"
"এই তুম হিন্দি কাহে বোলতা হ্যায়? বাঙ্গালি হোকে দুসরা ভাষা কিঁউ বোলতা হ্যায়!" - কমলদাদু হেঁকে ওঠেন, মিলিটারিতে ছিলেন কিনা, হিন্দি ভালোই বলেন।
"তা তুমি বাপু কী চাও?" - বলরামবাবু প্রশ্ন করেন। সে-কথা শুনে সবাই হাঁ-হাঁ করে ওঠে। মলিন গোলাপি ট্রাউজারে তবলার বোল তুলে বলরামবাবু উদাসীন গলায় বললেন, "চোর বলে কী মানুষ না! আর করেছে তো কলার কাঁদি চুরি! তার কথা শুনতে অসুবিধেটা কোথায়? কী চাইছে, শোনাই যাক না।"
"মানেটা কী! চুরি করতে এসে ধরা পড়েছে, সে আবার চাইবে কী! চাইলেই বা শুনছে কে!" - এক দলা থুতু ফেলে মোটাসোটা জয়াকাকিমা মন্তব্য করেন।
বলরামবাবুর স্ত্রী মানে জ্যেঠিমা গজগজ করে ওঠেন, "আ মরণ! থুতু ফেলার আর জায়গা পেলে নাকো! আমার ঘরের সামনেই ফেলতে হবে!"
"ও বাবা! তাও যদি তোমার নিজের বাড়ি হতো!" - জয়াকাকিমা সুর টেনে মনে করিয়ে দিতে ছাড়লেন না। জ্যেঠিমাও মুখ বেঁকিয়ে, চুপ করে গেলেন।
নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে প্রদীপকাকা চোরের গয়না-পরা কানখানা আচ্ছা করে পাকিয়ে দিয়ে বললেন, "বল্ কী চাস তুই?"
"হুজুর আমারে ছেড়ে দ্যান। কালকে এসে না হয় বাগানের সব ঘাস, ঝোপ-ঝাড় সাফ কর্ দে যাবো। একটা পয়সাও লাগবে নি।"
"ওরে! এ কী বলে রে! পয়সার কথা আসছে কোত্থেকে বাওয়া! - ক্লাবের এক হোল-টাইমার, মাসলধারী দাদা বলে ওঠে।
চোর হাত জোড় করে বলে, "আজ্ঞে আপনাদের ভালোর জন্যই বলতিচি, এখন আপনারা আমারে হয়তো মারধোর করবেন! কেউ ধরেন ভিডিও করে নিল, তারপর সেটে ভাইরাল হয়ে গেল। কেস্ তো খাবেন আপনারাই, নাকি? আমার আর কী বলেন! ছোটো থেকে কম মার খেইচি! তাই বলতিচি... আমার দা-খানা অন্তত আনতে দ্যান, আপনারা আমারে এ'খেনে টেনে নে এলেন, দাখানা ফেলে এলাম! আমার অস্তর বলতে ওই একখানাই কিনা!"
চোরের কাকুতি-মিনতিতে বলরামবাবুর মন টলে। তিনি কলার কাঁদি ঘরের কোণে বসিয়ে রেখে চোরকে বলেন, "যা তোর দা-খানা নিয়ে আয়।"
"জ্বী স্যার, এই গেলাম আর এলাম। কিচ্ছুটি ভাববেন না... নাকে খৎ আমি দেবই, একশোটা উঠবোসও খাবো।" - বলে চোর উঠোনে পা দিল। পিছনে সতর্ক গোটা পাড়া। চোর শান্ত, ধীর পায়ে বাগানের দিকে চলল, গোটা পাড়া তাকে ধীর লয়ে অনুসরণ করল। সঙ্গে আমি, রনি, অচিন্ত্য, মিঠু ও আরো অনেকে।
তখন সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে। বাগানে গাছপালার ভিড়ে একেবারেই অন্ধকার। ঠিক আলোর বলয়ের বাইরে চোরটার পা পড়তেই, কী যেন একটা হয়ে গেল! একটা তুমুল চিৎকার! আমরা ঠিক ঠাহর করার আগেই গোটা পাড়া পূবের পাঁচিলের দিকে ছুটল। অন্ধকারে দু-চারজন হোঁটট খেয়ে পড়ল। প্রদীপকাকুর ডান পা মচকে গেল। আর চোর! বলাই বাহুল্য পালাল, ওই পাঁচিল টপকে। এ'ভাবেই সে'দিন গোটা পাড়াকে ফাঁকি দিয়ে চোর পালাল, এই অপমান সহজে ভোলার নয়। সবাই প্রায় সমস্বরে স্বীকার করল, যত দোষ নন্দ ঘোষ মানে বলরামবাবুর! একটা মামুলি চোর যে সক্কলের চোখে ধুলো দিয়ে পালাল, এর সম্পূর্ণ দায়ভার বলরামবাবুকেই মাথা পেতে নিতে হল। বড়োরা বললেন, তাঁর মতো অপদার্থ আর নাকি হয় না! প্রদীপকাকা বললেন, "চেহারাই সার! 'কচুবনের কালাচাঁদ' একটা!" এ'সব শুনে আমরা ভারী দুঃখ পেলাম। কিন্তু গাদা গাদা লোকের চোখের সামনে দিয়ে চোর পালানোয় পাড়ার বদনামের কথাটা ভেবে, কিচ্ছুটি বলতে পারলাম না।
সেই থেকে 'কোমল-হৃদয়' বলে বড়ো বদনাম রটে গিয়েছে তাঁর। মনের দুঃখে বলরামবাবু
বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দিয়েছেন।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment