![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
কলকাতা খাদ্যরসিকের
শহর। বাঙালি সিনেমায়, সাহিত্যে, দৈনন্দিন কথাবার্তায়, চুটকিতে খাবারের অনুসঙ্গের ছড়াছড়ি।
যদিও সেই অর্থে মিশেলিন স্টার পাওয়া রেস্তোরাঁ বা ডেলি কলকাতায় নেই, কিন্তু এই শহরের
অলিতে গলিতে “হিডেন জেম” এর ছড়াছড়ি। মোটামুটি কলকাতা যবে থেকে রেনেসাঁর শহর হয়ে উঠেছে
এবং বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়েছে, তবে থেকেই কলকাতায় নানা দেশের খাবারের ছড়াছড়ি। সেটা ওড়িশা
হতে পারে, চীন হতে পারে, মোগলাই, অর্থাৎ তুর্ক-আফগান হতে পারে। আবার, এইসব নানা দেশের
খাবারের সংমিশ্রণে কলকাতায় সৃষ্টি হয়েছে নিজস্ব কিছু পদ। এবং আজও হয়ে চলেছে কলকাতার
এই খাবারের এক্সপেরিমেন্ট। যেমন, এখন দক্ষিণ কোরিয়ার খাবার এখানে খুব জনপ্রিয়। সেই
খাবারের মধ্যে আবার বাঙালি উপাদান মিশিয়ে নানা নতুন পদ সৃষ্টি হচ্ছে। মোমো একটি পাহাড়ি
স্ন্যাক্স। সেটা নিয়ে কলকাতায় কী না এক্সপেরিমেন্ট হয়! চকলেট মোমো থেকে শুরু করে ভেটকি
মোমো। সুতরাং কলকাতার “ফুড সিন” ভীষণভাবেই ডায়নামিক একটি জগৎ।
আমি কিছুদিন
আগে এক রবিবার সকাল থেকে দুপুরে উত্তর কলকাতার একটি বিশেষ জায়গায় ফুড ট্রেইলে গিয়েছিলাম।
কোনও গ্রুপের সাথে নয়। পুরোপুরি নিজে নিজে গুগল দেখে এবং কিছু ব্লগ পড়ে আমি আমার রুট
ঠিক করেছিলাম। এপ্রিল মাসে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে যাওয়া। তাই বেশি ঘোরাঘুরির ইচ্ছে ছিল
না। কিন্তু কম পরিশ্রমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পট কাভার করব এবং রসনার পরিতৃপ্তি
করব, এটাই ছিল আমার লক্ষ্য। এর জন্য আগের দুদিন খাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে সব কটা
দোকানের অন্তত একটা খাবার টেস্ট করার জায়গা পেটে থাকে।
প্রথমেই
আমি গিয়ে নামলাম কলেজ স্ট্রিট পেরিয়ে হাতিবাগানের অজন্তার দোকানের মোড়ে। এই সিগন্যালে
শ্যামবাজারের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডানহাতে একটা গলি পড়বে, শিবদাস ভাদুড়ি স্ট্রিট।
এই রাস্তাটা গিয়ে পড়ছে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র স্ট্রিটে। সেটা দিয়ে ঢুকলেই ডানহাতে
প্রথম দোকান হল অমৃত। ছোট্ট মিষ্টির দোকান। কিন্তু এই দোকানের দই একবার খেয়ে দেখুন।
তারপর বুঝবেন যে মিষ্টি দই বলে এতদিন যে সব খাবার খেয়েছেন, সব তুচ্ছ। আমি কোচবিহারে
যখন গিয়েছিলাম, তখন সম্রাট বলে একটা দোকানে “ক্ষীরদই” খেয়েছিলাম। ওখানকার খুব বিখ্যাত
খাবার। এই অমৃতের দই অনেকটা সেরকম। খুব মিষ্টি, বোধহয় ক্ষীর দেওয়া। তাই একবারে বেশি
খেলাম না। ইচ্ছে তো করছিল অনেকটা খেয়ে নিতে। কিন্তু আমার তো প্ল্যান ছিল আরও কয়েকটা
মিষ্টির দোকান কভার করব। তাই প্রথমেই পেট ভরে গেলে চলবে না। একশো দই খেয়ে আমার ফুড
ট্রেইলের শুভ মহরৎ হল। আমি নানা ব্লগে এই দোকানের দইয়ের কথাই পড়েছিলাম। অন্য কোনও মিষ্টির
নাম দেখিনি। কিন্তু দোকানের শোকেসে আরেকটা মিষ্টি দেখে বেশ আকর্ষণীয় লাগল। নাম জিজ্ঞাসা
করলাম---বাদশাভোগ। সেটাও একটা টেস্ট করলাম। দারুণ খেতে। নীচে রইল তার ছবি।
এই রাস্তায় অমৃত
ছাড়িয়ে জাস্ট দুটো বাড়ি পেরোলেই ওই একই ফুটপাথে রয়েছে আরেক ঐতিহ্যশালী বাঙালি মিষ্টির
দোকান---সেন মহাশয়। একশো বছরের বেশি পুরনো। অমৃত ছাড়িয়ে এবার গেলাম সেখানে। এখানে আরেকটা
ইন্টারেস্টিং জিনিস চোখে পড়ল। এই দুই দোকানের মধ্যে রয়েছে একটি বাঙালি লন্ড্রি। বোধহয়
একশো বছরের পুরনো। নামটা বেশ অন্যরকম---ধৌতাগার! এই নামটা কেন যে বাংলা ভাষায় সেভাবে
পরিচিত নয়, সেটাই অবাক করার মত। আমি ঠিক করলাম যে এবার থেকে লন্ড্রি নিয়ে কারও সাথে
কথা বলতে গেলে এই শব্দটা ব্যবহার করব।
যাই হোক, সেন
মহাশয়ে ঢুকলাম। অমৃত যেমন ছোট দোকান, রাস্তায় দাঁড়িয়েই খেতে হয়, সেন মহাশয় সেরকম নয়।
বেশ বড়। দোকানের মধ্যে কিছু চেয়ার দেওয়া আছে। যদিও টেবিল দেখলাম না। সেন মহাশয়ের মিষ্টি
দক্ষিণ কলকাতাতেও দেখেছি। কিন্তু এখানের বেশিরভাগ মিষ্টিই অচেনা মনে হল। এইসব মিষ্টির
আবার নানারকম নাম আছে। যদিও সেইসব নাম আমার জানা নেই। আর সব মিষ্টির সামনে নাম লেখাও
নেই। তবে আমি থাকতে থাকতেই একজন এসে কী একটা অদ্ভুত নামের মিষ্টি অর্ডার দিলেন। অপরূপা
বা ওইরকম কিছু নাম। বুঝলাম যে, সেন মহাশয়ে খেতে এলে শুধু শোকেসের মিষ্টি দেখলে হবে
না। একটু নাম জেনেও আসতে হবে।
একটাই নাম জানা
ছিল—রটবি সন্দেশ। রবীন্দ্রনাথ নিজে নাকি এই নাম দিয়েছিলেন। সেটাই কিনলাম (ছবিতে বাঁদিকের
প্লেটে, আম সন্দেশের নীচে)। এটা আবার সামনের কাঁচের তাকে ছিল না। পেছনের ঘর থেকে এনে
দিল। সেই সাথে নিলাম মিহিদানা আর আম সন্দেশ। আম সন্দেশটা আমার সবথেকে ভালো লাগল। ভেতরে
আমের জেলি দেওয়া। মিহিদানাও দারুণ। গড়িয়াহাটের সেন মহাশয়ে একটা সবুজ রঙের কাঁচা আমের
স্বাদের কড়াপাকের সন্দেশ ছোটবেলায় অনেক খেয়েছি। সেটা এই দোকানে দেখলাম না। কিন্তু এই
দোকানের আম সন্দেশ আবার অন্যরকম স্বাদ, এটা নরম পাকের। এদের সব মিষ্টি আসল ফলের রস
দিয়েই তৈরি হয়। সীতাভোগ একটু খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অন্য আরও কিছু দোকানে যেতে হবে।
এরপর সীতাভোগ খেলে সেইসব দোকানে ইনজাস্টিস হবে। তাই এবারের মত এটা বাদ দিলাম।
সেন মহাশয়ের
পর মুখ ঘোরালাম বিধান সরণির অপর দিকে। কিন্তু গুগল ম্যাপ দেখলেও সেদিকে গেলাম না। আরেকটা
বিশেষ রাস্তা ধরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। তাই গুগলে যেটা সোজা রাস্তা দেখাল, সেটা ছেড়ে হাতিবাগানের
মেইন রাস্তা ধরে একটু হেঁটে, দর্পনা পেরিয়ে ডান দিকে ঢুকলাম শ্যামপুকুর স্ট্রিটে। আরেকটা
মিষ্টির দোকানে তো যাবই। কিন্তু তার আগে একটা বিশেষ বাড়ি দেখব। সেটা হল এই শ্যামপুকুর
স্ট্রিটে রামকৃষ্ণ মিশনের বাড়ি, যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। তাছাড়া
একটু হাঁটতেও হবে। মিহিদানা খেয়ে পেট তো ভরে গেছে। পরের দোকানে যাওয়ার আগে একটু খালি
করতে হবে তো!! তাই বলরাম ঘোষ স্ট্রিট না ধরে শ্যামপুকুর স্ট্রিট।
সেই রাস্তা দিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে সেই বিখ্যাত বাড়ি তো দেখাই হল। সেই সাথে পুরনো কলকাতার আরও কিছু ঝুলবারান্দা
দেওয়া বাড়ি দেখা হল। মানে, যেরকম ডিজাইন আস্তে আস্তে উঠে গেছে। এখন শুধু ফ্ল্যাট হওয়ার
অপেক্ষায় দিন গুনছে। সেই রাস্তা দিয়ে মিনিট পাঁচেক হেঁটে এসে পৌঁছলাম একটা তিন মাথার
মোড়ে। সেখানেই রয়েছে “চিত্তরঞ্জন”।
চিত্তরঞ্জনে
বিখ্যাত হল “মধুপর্ক”। ছোট ছোট বাটিতে দইয়ের মত একটি অপূর্ব খাদ্য। দই নয়, বোধহয় দই,
মধু আর ঘি মিলে বানানো। একটা প্রথমে কিনে খেলাম। তারপর মনে হল যে এত কষ্ট করে এখানে
এসে মাত্র একটা বাটি খেলে পরিশ্রম বৃথাই যাবে। তাই আরেকটা এলাচি ফ্লেভারের মধুপর্ক
খেলাম। তিন চারটে ফ্লেভারে এটা পাওয়া যায়। তবে চকলেট বা ভ্যানিলার থেকে শুদ্ধ বাঙালি
স্বাদই ভালো লাগলো আমার। এটাও ছোট দোকান। রাস্তায় দাঁড়িয়েই খেতে হয়।
চিত্তরঞ্জনের
ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে “দ্বারকা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার” এবং তার পাশেই ছোট্ট একটা দোকান—ভবতারিণী
সুইটস। প্রথম দোকানটি পাশেরগুলোর তুলনায় বয়সে একদম শিশু। যদিও মিষ্টি ভালো। আর পরেরটি
ছোট হলেও তার বৈশিষ্ট্য হল ভ্যানিলা রসগোল্লা। এছাড়াও বেশ কিছু চকলেট সন্দেশ পাওয়া
যায়। আমার দুর্ভাগ্য যে, সেইদিন ভবতারিণীতে ভ্যানিলা রসগোল্লা ছিল না। ফলে সেটা বাদ
গেল। কিন্তু দোকানটা চেনা রইল।
এরপরের দোকানের
দিকে এবার পা বাড়ালাম। চিত্তরঞ্জন সুইটস থেকে বাঁদিকে একটু গেলেই শ্যামবাজার এ ভি স্কুলের
সামনে বাসরাস্তা---যতীন্দ্র মোহন এভিনিউ। এটা হল চিৎপুর রোডের সমান্তরাল রাস্তা। সেই
রাস্তা পেরোলেই জগৎ মুখার্জি পার্কের গায়ে নবীন চন্দ্র দাস। রসগোল্লার আবিষ্কর্তা।
হলুদ সাইনবোর্ড
দেওয়া দোকান। সামনে কাঁচের দেওয়াল। এপ্রিল মাসের সেই দুপুরে আমার তখন বেশ গরম লাগছে।
ঢুকে একটু বসে নিলাম প্রথমে। ছোট দোকান হলেও বসার জায়গা আছে। এই দোকানে এসে রসগোল্লা
না খেলে আর কি খাব? সুতরাং রসগোল্লা অর্ডার দিতেই হল। কিন্তু শুধু রসগোল্লা খেলে তো
আর হবে না। সেই সাথে ছানার টোস্ট খেলাম। আর ঠিক সেই সময়েই গাড়িতে করে টাটকা খাবার ডেলিভারি
এল। ফলে একটা শিঙাড়াও খেলাম। এদের শিঙ্গাড়া কিন্তু দারুণ। এছাড়াও রয়েছে আরও কিছু সন্দেশ----ডাব
সন্দেশ, গোলাপভোগ, কেশর রসমালাই ইত্যাদি।
সুতরাং নবীন
চন্দ্র দাস মানেই যদি শুধু রসগোল্লা খেয়ে চলে আসেন, তাহলে ভুল করবেন। আমি আবার মিষ্টি
খেতে খেতে দোকানের ভদ্রলোকটির সাথে সেই রসগোল্লার জি আই ট্যাগ পাওয়া নিয়ে ওড়িশার সাথে
দশ বছর আগের লড়াইএর গল্প করলাম।
মোটামুটি এই
পাঁচটি দোকান দেখে এবং খেয়েই আমার সেদিনের মত মিষ্টি খাওয়ার শখ শেষ হল। বাড়ির জন্য
কিছু মিষ্টি নিলাম। এরপর ইচ্ছে ছিল হাতিবাগান দিয়ে শ্যামবাজারে গিয়ে গোলবাড়িতে রুটি
মাংস খাব। কিন্তু পেটের অবস্থা দেখে সেটা বাদ দিলাম সেদিনের মত। তাও শ্যামবাজার মোড়
অবধি গেলাম। হরিদাস মোদকের দোকানটা চিনে রাখলাম। এখানকার খাবারের জন্য আরেকদিন আসতে
হবে। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে। এবার শিয়ালদহ হয়ে বাড়ি।
আরও একটু ঘুরলে আরও কিছু দোকান দেখাই যেত। কিন্তু শুধু ছবি তোলা তো আর আমার উদ্দেশ্য ছিল না। তাই আর সেদিনের মত ঘোরাঘুরি করলাম না। আমার উদ্দেশ্য তো সফল হয়েই গেছে----কম পরিশ্রমে বেশি ভালো খাওয়া। আমি যে চত্বরটায় ঘুরে এইক’টা দোকান দেখলাম, সেটা একজন সাধারণ গতিবেগে হাঁটা লোকের ঘুরতে আধঘণ্টার বেশি লাগবে না। আবার আরেকদিন হবে।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment