1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

কন্যাসম্প্রদান


ছবি  : ইন্টারনেট 


কন্যাসম্প্রদান
সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

কলেজে ইংরাজী অনার্সের ক্লাস চলছে। সুন্দরী কেবি অর্থাৎ কবিতা বসু ম্যামের ক্লাস। ছেলেরা প্রচন্ড মনোযোগের সাথে পড়া শুনছে। কেবির দুধসাদা রাজহংসী গ্রীবা এদিক ওদিক ঘুরছে। জানলা দিয়ে আসা গলানো সোনার মত রোদ্দুর ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর পিঠ, বুক, চুল। ক্লাসের ছেলেগুলো ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলতেও ভয়। একটা মুহূর্তও তারা বৃথা অপচয় করতে চায়না। পৃথা অনেকক্ষণ থেকে অর্ককে ইশারায় ডাকছিলো। কিন্তু তিনিও তো বাকিদের সাথে কেবির পড়ানোয় মগ্ন। বেল বাজতেই কেবি ব্যাগ হাতে ক্লাস ছাড়লেন। ছেলেদের তখনো ঘোর কাটেনি। পৃথা উঠে এসে ধাঁই করে এক ঘা বসিয়ে দিল অর্কর মাথায়।

“তখন থেকে ইশারা করে যাচ্ছি। একবার ফিরে তাকাতেও পাচ্ছিস না?”

হঠাত এক বালতি জল ঢেলে দিলে যেমন মাতালের মাতলামি কেটে যায়, ঠিক তেমনি ভঙ্গীতে অর্ক বলল,

“দূর বাবা। দিলি তো রোমান্টিসিজম টা চটকে!”

“তোর রোম্যান্স ঘোচাচ্ছি এক্ষুনি দাঁড়া। জাস্ট একটা কল করবো কাকিমাকে। তোর খেল খতম”।

“এই প্লিস বস। এরকম করিস না। তোর কি ক্ষতি করেছি বল! কি খাবি বল। এখনি নিয়ে যাচ্ছি”।

একটু ভেবে পৃথা বলে, “ওকে। চল তাহলে অনাদির মোগলাই খাওয়াবি”।

“জো হুকুম মেরে আকা”- এক গাল হেসে অর্ক বলে।

এমন সময় বাইরে একটা শোরগোল শোনা গেলো। পার্টির মিটিং আছে বুঝি আজকে। কলেজ থেকে ছেলেমেয়ে তুলতে এসেছে। বাইরে বড় লরি দাঁড়িয়ে আছে। আজকের বাকি সব ক্লাস ক্যান্সেল। এবার সবাইকে লরি করে যেতে হবে ব্রিগেডের মিটিং এ। সবার মুখে বিরক্তি কিন্তু সবাই নিরুপায়। যেতেই হবে। নাহলে পরদিন থেকে কমনরুমে খুব দুঃখ থাকবে কপালে। যা তা বলে সিনিয়ার দাদাগুলো। অর্ক পৃথাকে বলল,

“গেলো তোর সাধের মোগলাই। চল এবার ব্রিগেড কাঁপাই”।

পৃথা বলল, “আমার বয়ে গেছে ওই মিটিং এ যেতে। তুই আমার সাথে চল। কলেজের ফ্রান্ট গেট দিয়েই আমরা বেরিয়ে যাবো। কেউ কিচ্ছু করতে পারবেনা। তুই শুধু সিচুয়েশান বুঝে কাজ করবি”।

অর্ক বলল, “কিভাবে সেটা সম্ভব”?

“তুই চুপচাপ থাক। দেখ আমি কি করি”।

গেট অবধি দুজনে গুটিগুটি পায়ে গেলো। গেটের কাছে পৌঁছেই পৃথা হঠাত, “মাগো” বলে ককিয়ে উঠলো। সবাই তখন লরিতে উঠতে ব্যস্ত। ওর গলা শুনে বেশ কয়েকজন ঘুরে তাকালো। পৃথা ততক্ষণে পেট চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়েছে। অর্ক কেস টা আন্দাজ করতে পেরে  প্রয়োজনীয় ব্যস্ততা দেখাতে শুরু করলো। দেখতে দেখতে কিছু ছেলেমেয়ে জড়ো হয়ে ওকে জল খাওয়ানো, হাওয়া করা ইত্যাদি শুরু করলো। বেগতিক বুঝে ইউনিয়ানের দাদারা বলল, ওকে তোমরা কেউ বাড়ি পৌঁছে দাও। আমাদের মিটিং এ দেরি হয়ে যাবে নাহলে। আমরা বেরোচ্ছি। ব্যস, আর কি! দেখতে দেখতে কলেজ ফর্সা। পৃথা উঠে হো হো করে হেসে উঠলো। 

“কিরে কেমন দিলাম?”

অর্ক বলল, “তুমি গুরুদেব। তোমার সাথে কেউ পারবেনা। এমন অভিনয় করলি, কেউ সন্দেহ ও করলোনা!”

“এবার চল তাহলে অনাদি কেবিন”।

“ভাবলাম ব্রিগেডের অনারে আমার পকেটটা বেঁচে গেলো”।

“আমার হাত থেকে বাঁচা অতো সোজা নয় বুঝেছো? আমি যা চাই, তা করেই ছাড়ি। তাছাড়া যেটা মন থেকে মানতে পারবোনা, সেটা করবোই বা কেন?”

অর্ক বলে, “সে তো বুঝলাম। কিন্তু সারা জীবন তোর এই মতাদর্শ গুলো ধরে রাখতে পারবি তো?”

“ঠিক পারবো। দেখে নিস। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ আমাকে দিয়ে কেউ করাতে পারবেনা”।

এই হলো পৃথা। আমাদের গল্পের নায়িকা। এ পর্যন্ত পড়ে পাঠক আশা করি আন্দাজ করে নিয়েছেন পৃথা একটু স্বাধীনচেতা প্রকৃতির, স্পষ্টবাক ও বুদ্ধিমতী মেয়ে। এবার তাহলে মূল গল্পে আসা যাক।

পৃথা এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। তার ফাইনাল ইয়ার চলছে। ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার শখ তার।  শিক্ষকতাকেই সে পেশা হিসাবে নিতে চায়। পৃথার মায়েরও খুব ইচ্ছে , মেয়ে আগে চাকরি পাবে, তবে বিয়ে। কিন্তু পৃথার মামিমা হঠাত করে একটা সম্বন্ধ নিয়ে খুব জোরাজুরি শুরু করেছেন। তাঁর বক্তব্য, একবার মেয়ে দেখাতে তো ক্ষতি নেই। ছেলের বাড়ি তাঁর বিশেষ পরিচিত। আর মেয়ে দেখা হলেই যে বিয়ে ফাইনাল হয়ে যাচ্ছে তা তো নয়! 

এতো অনুরোধ উপরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে পৃথার মা অবশেষে রাজি হলেন পাত্রপক্ষকে বাড়িতে ডাকতে। পাত্রের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্যে খুব তাড়া ছিল। তাঁরা চাইছিলেন চেনাশোনার মধ্যে একটা মেয়ে, যাতে শীঘ্রই চারহাত এক করা যেতে পারে।

অবশেষে একদিন সন্ধ্যাবেলা বড় বড় দুখানা গাড়ি করে একদল লোক এসে উপস্থিত হল তাদের বাড়িতে। সাথে অবশ্যই পৃথার মামিমা। হাজার হোক ,তাঁর পরিচয়েই তো পৃথাকে দেখতে আসা নীলাঞ্জনদের। বর্ধিষ্ণু পরিবার। তার ওপর যৌথ পরিবার। বাবা মা কাকা কাকি ঠাকুমা-সবাই এক ছাদের তলায় থাকেন। বেশ হাসিখুশি লোকজন। পৃথার মন্দ লাগলোনা মানুষগুলোকে। নীলাঞ্জন ডাবলু বি সি এস অফিসার। মুর্শিদাবাদে পোস্টেড । বড়লোকের বাড়ির আদুরে ছেলে যে,চেহারা দেখেই বোঝা যায়। নীল ফুলহাতা শার্ট আর বেজ ট্রাউসারে বেশ নজরকাড়া চেহারা। উচ্চতাও প্রায় ছয় ফিট হবে। পৃথার এরকম লম্বা ছেলেই পছন্দ। কলেজের অনেক রোমিওর প্রেমের প্রস্তাব সে নাকচ করে দিয়েছে শুধুমাত্র এই উচ্চতার কারণে।

পৃথাদের ছোট পরিবার। মা, বাবা ও পৃথা নিজে। তার বাবা রজতবাবু পেশায় অধ্যাপক এবং মা অরুন্ধতিদেবী সঙ্গীতশিল্পী। ছোট থেকেই মেয়েকে তাঁরা স্বাধীনচেতা করে গড়ে তুলেছেন।  বাড়িতে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন থাকলে সন্তানের চরিত্রে তার প্রতিফলন হবেই। এ ক্ষেত্রেও সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। পৃথা ছোট থেকেই বুদ্ধিমতী। স্কুল কলেজে কোনদিন কোনো বিষয়ে কম নম্বর পায়নি। বিশেষত সাহিত্যে তার আগ্রহ ছিল অসীম। তাই মাধ্যমিকে স্কুলের মধ্যে প্রথম স্থানাধীকারিণী মেয়ে যখন সায়েন্স নিয়ে না পড়ে আর্টস নিয়ে পড়বে ঘোষণা করলো, রজতবাবু বা অরুন্ধতিদেবী কেউই অবাক হননি। এভাবে স্কুল পেরিয়ে কলেজ, তারপর ইউনিভারসিটি – ভালই চলছিল সবকিছু। সাথে সঙ্গীতসাধনাও। মা বাবার একটাই বক্তব্য ছিলো, যেটা করে নিজে মন থেকে সুখী হবে,সেটাই করবে। তাই পৃথা ঠিক করেছিলো, সে  শিক্ষিকা হয়ে ছাত্রছাত্রীদের মনে সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা জাগিয়ে তুলবে। তার জীবনদর্শন, তার স্বাধীন চিন্তাভাবনার রসে সম্পৃক্ত করবে ওই নবীন প্রাণগুলোকে। 

যেদিন নীলাঞ্জনদের পরিবার পৃথাকে দেখতে এলো, পৃথা বাড়ির ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে শাড়িই পরেছিলো। শাড়ি পরতে এমনি তার খারাপ লাগেনা। আর অরুন্ধতিদেবী সবসময় বলেন, মানুষ সব ত্যাগ করলেও, নিজের শিকড়, নিজের অতীতকে কখনও উপেক্ষা করতে পারেনা। অন্তত করা উচিৎ নয়। 

নীলাঞ্জনের ঠাকুমা নিজেও এসেছিলেন প্রিয় নাতির জন্যে মেয়ে দেখতে। পৃথাকে দেখেই তিনি মুগ্ধ। পাশে বসে,গাল টিপে বললেন,

-“কিরে মেয়ে, আমার নাতবউ হবি?”

এই সোজাসাপ্টা কথায় পৃথার মতো আধুনিকমনস্ক মেয়েও লজ্জা পেয়ে গেল।  নীলাঞ্জনও লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর রজতবাবু প্রস্তাব দিলেন, ছেলেমেয়েকে আলাদা ভাবে একান্তে কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিৎ। সবাই রাজী হল। নীলাঞ্জনের বাবা দীপ্তরূপবাবু বললেন, “ঠিক বলেছেন দাদা। ওরা আজকালকার ছেলেমেয়ে। ওদের চিন্তাভাবনা অনেক অন্যরকম। নিজেরা কি চায় সেটা নিজেরাই ভালো বুঝতে পারে। ওরা কথা বলুক একান্তে”।

খোলামেলা বাড়িটায় দুটো ছাদ। গাছে গাছে সবুজ আর সন্ধ্যের আলোআঁধারিতে ঘেরা ছাদে গিয়ে দুটো প্রাণ যেন মন ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারল। কথা শুরু করলো পৃথা। 

-“কেমন লাগছে আমাদের বাড়ি?”

-“বেশ সুন্দর। খোলামেলা, ছিমছাম”।

-“আমিও কিন্তু খুব খোলামেলা স্বভাবের মেয়ে। আপনি কি স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন আমার সঙ্গে আলাপে”?

-“নিশ্চয়ই। আমাকে দেখে আপনার কি ধারণা হয়েছে আমি জানিনা, তবে আমিও খুব সোজাসাপ্টা কথা বলতে ভালবাসি”।

-“তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করেই ফেলি”।

-“হ্যাঁ নিশ্চই। বলুন না”।

-“আপনাদের বাড়ি থেকে বিয়ের এতো তাড়া কেন বলুন তো? কিছু কেস আছে নাকি”? পৃথার চোখেমুখে অদম্য কৌতূহল।

নীলাঞ্জন একটু চুপ করে থেকে হো হো করে হেসে উঠলো।

-“এটা বেড়ে বললে তো! কেস আছে নাকি”!-আবার হাসছে। ওর মুখটা হাসতে হাসতে লাল হয়ে গেছে। পৃথার খুব রাগ হল।

-“এতো হাসির কি আছে শুনি! আমি শুনেছি, অনেক বাড়ির ছেলেরা বাইরে গণ্ডগোল করে আসে। তারপর বাবা মা সেটাকে চাপা দিতে তাড়াহুড়ো করে তার বিয়ে দিয়ে দেয় সম্বন্ধ করে”।

নীলাঞ্জন অনেকক্ষণ হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে সব শুনল।  ঠোঁটের কোণায় হাসি। তার মনে হচ্ছিলো ওই পাগলিটার প্রেমেই পড়ে যাবে এবার। বয়সে পৃথা তার চেয়ে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট। সমবয়সী দু একটা মেয়ের সাথে ছোটখাটো ইনিংস সে যে খেলেনি এতদিনে এমন নয়। তবে পৃথার মত এত মিষ্টি মেয়ের সান্নিধ্যে সে কখনও আসেনি। ওর চোখের দৃষ্টিতে একটা স্বচ্ছতা, একটা অনাবিল সারল্য দেখতে পেল নীলাঞ্জন। পৃথা বকেই চলেছে আর সে মুগ্ধ নয়নে দেখেই যাচ্ছে পৃথাকে। হাল্কা হলুদ শাড়িতে পৃথার মাজা মাজা গায়ের রঙ আরও খুলেছে। নীলাঞ্জন নিজে এত ফর্সা বলেই হয়তো তার ফর্সা মেয়ে একেবারেই পছন্দ নয়। ছাদের রজনীগন্ধা, কামিনী, মাধবীলতার পাগল করা সুবাসে নীলাঞ্জন ধীরে ধীরে নিজের সংযম হারাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিলো এক্ষুনি পৃথাকে তার কাছে টেনে নেয়। পরক্ষণেই সামলে নেয় নিজেকে। ছি,ছি, এমন অবস্থায় সে আগে কখনও তো পড়েনি! এমন চিন্তা তার মাথায় এল কেমন করে? ততক্ষণে পৃথা ধৈর্য হারিয়েছে।

-“আপনি কি কালা”?

-“না না। দিব্যি শুনতে পাই। তবে অকারণে কেউ আপনি -আজ্ঞে করলে সাময়িকভাবে কালা হয়ে যাই”।

এবার পৃথা সামলেছে।

–“সরি। আসলে,আমিও ‘আপনি’ তে খুব স্বচ্ছন্দ নই। ভাবলাম দেখতে এসেছে আমাকে কেউ। তাকে হঠাত করে তুমি বলাটা কি শোভনীয়? তাই আপনি করে বলছিলাম”।

-“আমাকে তুমি করে বললে আমি খুশি হব। এত ফর্মালিটির কিছু নেই”।

-“সে তো বুঝলাম। কিন্তু আমার উত্তরটা তো এখনও পেলামনা।“

-“কোন উত্তর? ওহ,সেই কেস এর ব্যাপারটা?” এবার যেন একটু গম্ভীর নীলাঞ্জন। বলল,

-“আসলে,প্রায় দেড় বছর ধরে মেয়ে দেখে চলেছি। সব বাড়িতে যাই, মিষ্টি খাই,বাড়ি ফিরেই জানিয়ে দি মেয়ে পছন্দ হয়নি। আর মিষ্টি খেতে ভালো লাগছেনা। বিশ্বাস করো”।

পৃথার চোখ গোল্ গোল হয়ে গেল। 

-“মহা বদ লোক তো মশাই আপনি! বাড়ি বাড়ি ঘুরে মিষ্টি খেয়ে বেড়াচ্ছেন! ওই মেয়েগুলোর কথা কখনো ভেবেছেন? ইস, বেচারাদের কত্ত খারাপ লাগে!”

-“এই তো! শুধু ওই না দেখা মেয়েগুলোর দুঃখটাই দেখলে! আর আমি যে জলজ্যান্ত মানুষটা সামনে রয়েছি, তার কষ্টটা বুঝলেনা! তার ওপর আবার আপনি বললে আমায়”।

পৃথা একটু থমকালো।

-“ওকে, সে নাহয় তুমি বললাম। কিন্তু কোন আক্কেলে তুমি লোকের বাড়ি বাড়ি খেয়ে বেড়াও এমনি করে? লজ্জা লাগেনা?”

-“লজ্জা আমার নয়,তাদের লাগা উচিৎ যারা সত্য গোপন করে”।

-“কিরকম”?

-“এই যেমন ধরো, কোন মেয়ের ছবি দেখলাম,বেশ লম্বা,ছিপছিপে চেহারা। ওমা, সামনে গিয়ে দেখি ঠিক উলটো! আবার হয়ত কাউকে ছবিতে দেখলাম খুব ফর্সা, সামনে গিয়ে দেখি মা কালিন্দী। ভাবো একবার কেমন বিরক্ত লাগে! এই কিছুদিনে মেনকা,রম্ভা,উরবসীর সন্ধানে বেরিয়ে পেয়েছি শুধু হিডিম্বা, সূর্পনাখা, শাঁকচুন্নিদের। আমার অবস্থা ভেবে এবার কি একটুও কষ্ট হচ্ছে তোমার”?

এবার হাসি চেপে পৃথা বলল,

-“বুঝলাম। তাহলে তো সর্গের অপ্সরীর খোঁজে বেরিয়েছ দেখছি। আমাকে আর মনে ধরবে কেমন করে”?

এবার নীলাঞ্জন একটু ঘুরে পৃথার মুখোমুখি দাঁড়ালো। ঠোঁটের কোণায় টিপটিপ হাসি। দেখছে পৃথাকে। চোখের পলক পড়ছেনা। তাকিয়েই আছে। তার চোখে এমনি কিছু ছিল, পৃথাও স্থান কাল ভুলে চেয়ে রইল তার মুখের দিকে। এমন করে কতক্ষণ কেটেছে কেউ জানেনা। নীচে থেকে কেউ নাম ধরে অনেকক্ষণ ডাকছিল। হঠাত নীলাঞ্জনের খেয়াল হওয়ায় সে বলল,

-“এবারেও সাড়া না দিলে লোকে ভাববে আমি তোমাকে নিয়ে ইলোপ করে গেছি”।

এবারে পৃথা ছুটে নীচে নেমে গেল। তার মুখ লজ্জারাঙ্গা। জীবনে কখনো এরকম ভাললাগায় তার মন ছেয়ে যায়নি। ওদিকে নীলাঞ্জনও একটু চুপচাপ ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে হাসিহাসি মুখে নীচে নেমে গেল। পৃথা তখনো সেখানে যায়নি। গেলে তার মুখ দেখেই সবাই বুঝে যেতো, তাদের একান্ত আলাপচারিতার ফল কি হয়েছে। সেদিন ওই দক্ষিণের ছাদে, ফুলের সৌরভের উন্মত্ততায় দুটি হৃদয় কোন এক অজানা ডোরে বাঁধা পড়ল। সাক্ষী রইল মাধবীলতা,সাক্ষী রইল রজনীগন্ধা।

পরেরদিনেই নীলাঞ্জনদের বাড়ি থেকে খবর এল,তাদের মেয়ে পছন্দ। তারা পাকা কথা বলতে চান যদি মেয়ের বাড়ি রাজি থাকে। এদিকে পৃথাও তার মনের কথা ব্যাক্ত করেছে রজত ও অরুন্ধতীর কাছে। পৃথার মামির কাছে ছেলের পরিবার সম্পর্কে আগেই খোঁজখবর নিয়ে রেখেছিলেন রজত। মেয়ের মা বাবা হিসেবে তাদেরও বেশ পছন্দ হয়েছিল নীলাঞ্জনকে। তারা সবুজ সঙ্কেত দেওয়ায় ঠিক হল নীলাঞ্জনদের বাড়ির লোক পরের সপ্তাহে পাকা কথা বলতে আসবেন। 

এই কটা দিন কিভাবে যে কেটেছে পৃথার, তা শুধু সেই জানে। শয়নে, স্বপনে ওই এক মুখ, ওই এক কণ্ঠস্বর। রোজ ভাবতো,আজ যদি একটা ফোন আসে নীলাঞ্জনের! যদি একবার সেই ভরাট গলাটা তার নাম ধরে ডেকে ওঠে! দিনগুলো এতো বড় আগে তো কখনও ছিলোনা! এ কি হল পৃথার! আয়নায় নিজেকে দেখতে লজ্জা করে। বাবা মায়ের সাথে ভালো করে কথা বলেনা। শুধু প্রতীক্ষা, কবে আবার নীলাঞ্জনের সাথে দেখা হবে। অবশেষে সেই দিন এলো। সন্ধ্যাবেলা সে আবার একটু সেজে তৈরি হল। আজ তার পরনে আবীর রঙের হ্যান্ডলুম শাড়ি। সাথে মানানসই সুতোর কাজ করা গয়না। চোখে কাজলের ধূপছায়া। কপালে আজ ছোট্ট একটা টিপ পরেছে। নিজেকে আয়নায় দেখে ভাবলো,নীলাঞ্জনের ভালো লাগবে তো আজকের সাজ!

বাইরে গাড়ির শব্দে চমকে উঠলো। আরো অস্বস্তি হচ্ছে আজ তার সবার সামনে যেতে। কখনো তো এত সাজেনা পৃথা। একবার জানলার পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো নীলাঞ্জনকে। কিন্তু কই সে যার জন্যে এত সাজ! দীপ্তরূপ, নীলিমা , নীলাঞ্জনের কাকা আর কাকিমা এসেছেন আজ পাকা কথা বলতে। মনটা ভেঙ্গে গেল পৃথার। এক অব্যক্ত অভিমানে চোখদুটো ঝাপসা হল।  সে ভাবতেও পারেনি আজ এমন বোকা হয়ে যাবে সে। পরে শুনল, একটা জরুরী কাজে আটকে যাওয়ায় সে এই সপ্তাহে কলকাতায় আসতে পারেনি। তাও অভিমান কমেনি পৃথার। যাহোক, সেবারে বিয়ের তারিখও ফাইনাল করে গেছিলো নীলাঞ্জনদের বাড়ি থেকে। আর হ্যাঁ, কাকিমা সবার আড়ালে পৃথাকে নীলাঞ্জনের ফোন নম্বর দিয়ে গেছিলো। পৃথার নম্বরও নিয়ে গেছিলো। 

তারপর অবশ্য নীলাঞ্জন নিজেই ফোন করে নিজস্ব মহিমায় মান ভাঙ্গিয়ে নিয়েছিলো পৃথার। পৃথাও আর তার ওপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারেনি। বিয়ের দিন স্থির হল দু’ মাস পর। তার মধ্যে অনেকবার দুই বাড়ির লোকজনের মধ্যে যাওয়া আসা, আলাপ আলোচনা চলতে থাকলো। কথায় বলে লাখ কথায় একটা বিয়ে হয়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা চলতে থাকলো। কোথায় বিয়ে হবে, কি কি নিয়মকানুন মানা হবে বিয়ের সময়, কাকে কি দেওয়া হবে ইত্যাদি। নীলাঞ্জনদের বাড়ি থেকে বলেছিল তাদের কোনো দাবী নেই মেয়ের বাড়ির কাছে। তাদের একমাত্র ছেলের বিয়ে, তারা খুব ধুমধাম করেই দেবে। একইভাবে পৃথাও তার মা বাবার একমাত্র মেয়ে। তারাও তাদের যথাসাধ্য দিয়ে বিশাল আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে লাগল। অন্যদিকে পৃথার সাথে নীলাঞ্জনের কানে কানে বন্ধুতা বাড়তে লাগল। এক একদিনে চার পাঁচবার করে ফোনে  কথা হয় তাদের। দুজনে দুজনকে জানার চেনার আকর্ষণ তখন দুর্নিবার।

বিয়ের তখন আর এক মাস বাকি। মেয়ের হাতের বালা একবার পরিয়ে মাপটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিতে এলেন পৃথার হবু শশুরমশাই আর শাশুড়িমা। কথায় কথায় নীলিমা অরুন্ধতীকে বলেন,

-“দেখুন, মেয়ের দানের বাসন আপনারা কাঁসা পিতলের দেবেন না প্লিস। আজকাল ওসব কেউ ব্যবহার করেনা। স্টিলের বাসন অল্প কয়েকটা নিয়মরক্ষের মত দিলেই যথেষ্ট”। 

অরুন্ধতী বললেন,

-“আমার বিয়েতে পাওয়া কাঁসার সব বাসন আমি পালিশ করিয়ে ফেলেছি। ওগুলো তো আমি দেবই। সাথে স্টিলের সেটও দেবো। প্লিস আপনি না করবেননা”।

পৃথা বসে বসে সব শুনছিল। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-“দানের বাসন মানে কি গো? কি দান হবে”?

এ কথায় দুই মা একসাথে হেসে ওঠে। পৃথার অজ্ঞানতায় একটু লজ্জা পান অরুন্ধতীদেবী। বলেন,

-“কেন পৃথা, কন্যাদান হবে তো! তোমার বড় জেঠুমণি তোমাকে সম্প্রদান করবেন নীলাঞ্জনের হাতে। আর সেই সময় তোমার সাথে ছেলের আংটি, হার,বস্ত্র,বাসনকোসন ইত্যাদি দেওয়া হবে। এটাই নিয়ম”। তারপর তিনি নিজের হবু বেয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“কিছু মনে করবেন না। ও আসলে ছোট থেকে খুব বেশি বিয়ে সামনে থেকে দেখেনি। আমাদের বেশিরভাগ আত্মীয় কলকাতার বাইরে থাকে। উপরন্তু ও নিজের লেখাপড়ার জগত নিয়েই ব্যস্ত থাকতো  সবসময়। তাই এসব নিয়মকানুন সম্বন্ধে ওর কোন ধারণাই নেই”।

নীলিমা বললেন,

-“আমি জানি দিদি। আজকালকার ছেলেমেয়েদের কাছে এসব আশা করাও অন্যায়। আমার ছেলেও কি এসব বোঝে নাকি? শুধু ফোনে বলছে, তোমরা সব ব্যবস্থা করে ফেলো মা, আমি শুধু বিয়ে করতে যাব। বুঝুন অবস্থা!”

এমন সময় পৃথা বলে ওঠে,

-“কন্যা সম্প্রদান কেন হয়? মেয়ে কি কোন বস্তু নাকি? তাকে কিভাবে দান করা হয়?”

দীপ্তরূপ ও রজতও এবার হেসে উঠল। রজত বলে উঠলো,

-“পাগলি মেয়ের কথা শোনো। কন্যা সম্প্রদান হিন্দু বিয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার জন্যে কন্যা বস্তু হতে যাবে কেন?”

নীলিমা বললেন, 

-“তা বললে কি হয় মা? এ রীতি তো আজকের নয়। যুগযুগ ধরে কন্যাদান হয়ে আসছে। আমাদেরও তো সম্প্রদান হয়েছে। তোমার মাকে জিজ্ঞেস করো”।

পৃথা নিজের মায়ের দিকে তাকালো।

-“সত্যিই মা? তোমারও সম্প্রদান হয়েছিলো?”

অরুন্ধতী ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। তখন পৃথা আচমকা এমন একটা কথা বলে উঠল যে ঘরে মনে হল বজ্রাঘাত হলো। সে বলল,

-“কিন্তু আমার সম্প্রদান হবেনা”।

সবাই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এ মেয়ে বলে কি? বিয়ের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ নাকি হবেনা! অরুন্ধতী বলেন,

-“কি যা তা বলছিস তুই? কন্যাদান হবেনা মানে? তুই জানিস, এ নিয়ম আবহমান কাল ধরে চলে আসছে!”

-“এবার বদলাতে হবে। পুরনো নিয়ম হলেই যদি সব মেনে চলা হত, তাহলে আমাদের সমাজে অগ্রগতির পথ কবেই রূদ্ধ হয়ে যেতো! আমরা মেয়েরা, লেখাপড়া না শিখে পর্দার আড়ালে ঘোমটা টেনে বসে থাকতাম আর আট বছর বয়সে সতী হয়ে বৃদ্ধ স্বামীর সাথে চিতায় জ্বলতাম”।

নীলিমা বললেন,

“তোমার কথায় যুক্তি আছে পৃথা। কিন্তু একটা কথা ভাবো। তুমি যে ব্যাপারগুলোর দৃষ্টান্ত দিলে, সেগুলো তো সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর ছিল! কিন্তু কন্যা সম্প্রদানে তো কোন ক্ষতি নেই কারোর। তবে শুধু শুধু বিপ্লব আনার চেষ্টা কেন”!

পৃথা বলল,

“ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, বিয়ে হলে মেয়েরা নাকি পর হয়ে যায়। অন্য বাড়ির হয়ে যায়। কেন এমন হবে বলতে পারেন? যে বাবা মা তাকে জন্ম দিলো, বড় করলো, মানুষ করে গড়ে তুলল, তারাই হয়ে গেল পর! আর এইসব বস্তাপচা নিয়মগুলোর জোরে,ছেলের বাড়ি তাদের বউকে নিজেদের জায়গীর ভাবতে শুরু করে! বাড়ির বউয়ের কাঁধে চলে আসে দুনিয়ার দায়িত্ব কর্তব্য কিন্তু অধিকারের ঝুলি থেকে যায় শূন্য! আচ্ছা বলুন তো, বিয়েতে এমন কোন নিয়ম কি আছে, যা মেয়েদের তাদের স্বামীর ওপর সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে? আছে এমন কিছু? তা যদি না থাকে, তাহলে আমি নিজেকেও কারোর হাতে আমি দানসামগ্রী রূপে সঁপে দিতে পারবনা। দয়া করে কিছু মনে করবেননা”।

 রজত এবং অরুন্ধতী অত্যন্ত প্রগতীশীল চিন্তাধারা পোষণ করেন। দীপ্তরূপ এবং নীলিমাও কিন্তু প্রাচীনপন্থী নন একেবারেই। কিন্তু এনাদের সকলেরই মনে হতে লাগল, এটা পৃথা একেবারেই ঠিক বলছেনা। এভাবে একটা নিয়ম বদলানো যায় নাকি! লোকেই বা কি বলবে!

সেদিন ওনারা সবাই মিলে যুক্তি দিয়ে অনেক চেষ্টা করলো পৃথাকে বোঝাতে কিন্তু সে নিজের বিচারে অনড়। নীলিমারা চলে যাওয়ার পর সে মা বাবার কাছে বলল,

-“যদি ওনারা রাজি হলেন ভালো, নাহলে আমি বিয়েই করবনা”।

মেয়ের অনড় স্বভাব তাঁরা জানতেন। তাই আর জোরাজুরি না করে চুপ করে গেলেন। মনে মনে অশনি সঙ্কেত। কোনো বাড়ি কি সম্প্রদান ছাড়া তাদের মেয়েকে ঘরের বউ করে তুলতে স্বীকার করবে? এখন শুধু অপেক্ষা। এতদিন যেভাবে উৎসাহের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল, তাতে ভাঁটার টান এলো।

দিন তিনেক কে্টে গেছে। এর মধ্যে নীলাঞ্জনের সাথেও কথা বলেনি পৃথা। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে, কিছুতেই এই অবাস্তব নিয়মকে মেনে নেবেনা। সেদিন সকালে নীলিমার ফোন এল,তারা সন্ধ্যেবেলা আসবেন।

সন্ধ্যায় এলেন নীলিমা,দীপ্তরূপ,নীলাঞ্জন আর তার ঠাকুমা। সকলের মুখেই ঈষদ গাম্ভীর্য। প্রমাদ গুনলেন রজত অরুন্ধতী। তবে কি-


কথা শুরু করলেন ঠাকুমা। নীলাঞ্জন এসে থেকে এমন করে বসে আছে,যেন চেনেইনা পৃথাকে। ঠাকুমা পৃথাকে কাছে ডেকে বসালেন। তারপর ওর গালদুটো দুহাতে ধরে চেয়ে রইলেন অপলকে। পৃথার একটু অস্বস্তি হচ্ছে। উনি বললেন,

-“কি রে দিদিভাই? তুই কি বলেছিস? তুই নাকি চাসনা তোর সম্প্রদান হোক”?

পৃথা কি বলবে বুঝতে পারছিলনা। সে বুঝেইছে, ঠাকুমা এবার স্নেহের নাতির জন্যে তাকে বুঝিয়ে রাজি করাতে এসেছেন। মনে মনে তাই যুক্তিতে ধার দিচ্ছিল। এমন সময় ঠাকুমা সকলকে অবাক করে দিয়ে বললেন,

-“এক্কেবারে ঠিক বলেছিস রে দিদি। আমার মনের কথাখানাই তুই বলেছিস”।

ঘরে একটা বাঘ ঢুকে পড়লেও লোকে এত অবাক হতোনা, যতটা ঠাকুমার কথা শুনে অবাক হল। ঠাকুমা তখন সকলের উদ্দেশে বললেন,

“শোন বাপু তোমরা সকলে। একটা গল্প বলি আজ। একটা পনেরো বছরের ছোট্ট মেয়ের গল্প। তাকে পাঠশালা ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। সে তখন বিয়ের কিছুই বুঝতনা। তাও তাকে সম্প্রদান করা হয়েছিলো এক বেয়াল্লিশ বছর বয়সী লোকের হাতে। তার আগের স্ত্রী গত হয়েছিলেন। সেই মেয়ের নিজস্ব ইচ্ছা, অনিচ্ছার কথা কেউ ভাবেনি। সমাজ এমনি ছিল তখন। তার যখন মেয়ের বিয়ে হয়,তখন সে অনেক চেষ্টা করেছিল নিজের মনের মত পাত্র খোঁজার। কিন্তু তার মেয়েরও শেষ পর্যন্ত সম্প্রদান হয় এক অসমবয়সী পাত্রের হাতে, তার স্বামীর ইচ্ছায়। সে মেয়ে সারাজীবন তার মায়ের কষ্ট দেখেছে আর ভেবেছে,সে নিজের অস্তিত্বের জন্যে লড়াই করবে। বাঁচবে নিজের শর্তে। কিন্তু পারেনি। সেও অন্যতম দানসামগ্রীর মত সঁপিত হয়েছে কারো হাতে। মনের সুপ্ত বাসনার গলা টিপে হত্যা করেছে। আজ সময় এসেছে। মেয়েরা আর মুখ বুজে সব মেনে নেবেনা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের সুবিধের জন্যে যে নিয়মগুলো বানিয়েছিলো,আজ সময় এসেছে একটা একটা করে তাদের বদলাবার”।

সবাই চুপ করে শুনছিল ঠাকুমার কথা। তিনি আবার বললেন-

“ তোমরা জানতে চাও,কাদের গল্প বললাম এতক্ষণ? সেই পনেরো বছরের মেয়েটি ছিল আমার মা। আর অন্যটি হলাম আমি”।

সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে আছে। ঠাকুমা আবার বললেন,

“ এখানে দুই বাড়ির মধ্যে সবার বড় আমি। আমি আমার মত দিচ্ছি এ বিয়েতে। কন্যাসম্প্রদান ছাড়াই হবে বিয়ে। কোনো অসুবিধে নেই। আর আসল তো মনের সম্প্রদান। তা তো আমার দাদুভাই প্রথম দিনেই করে ফেলেছে। আর আমার এই দিদিভাইটিও তার পরম কাঙ্খিত কে খুঁজে পেয়েছে। তবে আর বাধা কোথায়?”

নীলাঞ্জন খুশী খুশী মুখে ঠাকুমাকে দেখছিল। সে বলল,

-“আমিও মনে করি এই সম্প্রদানের কোন যৌক্তিকতা নেই। আমাদের সম্পর্ক থাকবে সহজ সরল। নিয়ম দিয়ে মানুষকে বাঁধা যায় কিন্তু তার  মনকে বাঁধা যায়না  বলেই আমার বিশ্বাস”।

তখন দীপ্তরূপ বলে উঠলেন,

-“আমারও তাই মত। দ্যাখো, আবহমান কাল ধরে অনেক নিয়ম আমরা বিনা প্রশ্নে মেনে চলি। তার মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয় নিয়ম হলেও, কিছু নিয়ম এমনও হয় যা মানুষকে শ্বাসরোধ করে মারে, বাধ্য করে নিজের অস্তিত্বকে ভুলিয়ে দিতে। আঘাত হানে তার আত্মসম্মানে। কালের নিয়মে এসব অপ্রয়োজনীয় নিয়ম লুপ্ত হোক। নিয়মের বেড়াজালে নয়, প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাক কোটি কোটি পৃথা আর নীলাঞ্জন, এমনটাই কামনা করি”।

এবার অরুন্ধতী হাসিমুখে বলেন, “তবে আর দেরি কেন? মিষ্টিমুখ হয়ে যাক!”

এই কথায় ঘরের আবহাওয়া বদলে গেলো। সবাই খুশী। পৃথার বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেলো। মনে হচ্ছিলো ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে একটা হামি খেয়ে নেয়। 

আজ পৃথা আর নীলাঞ্জনের বিয়ে। গায়েহলুদের তত্ত্ব এসে গেছে। শশুরবাড়ি থেকে আসা হলুদ ঢাকাইটা পরার জন্যে ঘরে ঢুকেছে পৃথা। শাড়ি গয়নায় সেজে সে আয়নায় নিজেকে দেখছে । একটা সেলফি তুলে নীলাঞ্জনকে পাঠিয়ে দিলো। বাবুর নাহলে আবার অভিমান হবে যে! এমন সময় কেউ দরজায় ধাক্কা দিলো,-“কিরে,তোর আর কত দেরি? তাড়াতাড়ি আয়। গায়েহলুদের সময় পেরিয়ে যাবে তো!” পৃথা নিজের মনেই মুচকি হেসে বলল,

-“যাই”।

sushme72@gmail.com
কলকাতা

No comments:

Post a Comment