1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

বিবাহ যাত্রা

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

বিবাহ-যাত্রা
সুরশ্রী ঘোষ সাহা 
-'এই বর এসেছে সব বাইরে চল্, উলু দে, শাঁখ বাজা রে শৈল, বরণ ডালা কোই?' বলে চ্যাঁচাতে লাগে মনি। 
বরের গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে লজের সামনে। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে শৈল। আসার সময় পাশে দাঁড়িয়ে জোর হাঁচি দেয় মনির বর। 
-'ব্যস্ শুভ মুহূর্তে দিলে তো?' বলে ওঠে মনি। 
-'কেন হাঁচি হল তো, এতে তো কোন দুর্গন্ধ নেই!' 
-'বিঘ্ন ঘটে বিঘ্ন' ব'লে মনি জনা পাঁচেক মহিলার সাথে গিয়ে জড়ো হয় গাড়ির সামনে। ছুটতে ছুটতে কয়েকটা বাচ্চাও ভিড় জমায় সেখানে। জানলার কাঁচ নামিয়ে দেয় বরুণ। একটু বুক ধুকপুক করছে তার। বিয়ে করতে গিয়ে যেকোন স্মার্ট ছেলেই যেন ধুতি-পাঞ্জাবি, টোপরে ক্যাবলা হয়ে যায়। বরুণের মুখটাও ওর কপালের চন্দনের ফোঁটাগুলোর মত শুকিয়ে উঠেছে। সারাপথ এসি গাড়িতে এসেও সে টোপর কোলে রেখে রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে থাকে। বিপিন খুব ভালো গান গায়। সারা রাস্তা গান গাইতে গাইতে এসেছে, তখনও পিছন থেকে গান ধরে 'হায় হায় সাত পাকে বাধা প'ড় না! এক দুটো পা কম থাকলে মন্দ হবে না', এমন সময় এই গান শুনে বরুণ ধমকে ওঠে প্রায় 
-'এই গান বন্ধ কর, ভয় দেখাস না বলছি মাইরি, টেনশন হচ্ছে খুব'। ড্রাইভার দরজাটা খুলে বাইরে নেমে দাঁড়ায়। আর মহিলা মুখগুলো সব এগিয়ে আসে বরুণের দিকে। কিন্তু এক ঝলক দেখেই ক্ষণিকের মধ্যে আবার সরে যায়। 
-'একি! এই জামাই তো আমরা পছন্দ করিনি?' বলে ওঠে মনি। 
-'কী বলছ দিদি?' পাশ থেকে এক মহিলা সন্দিহান চোখে তাকায়। 
-'হ্যাঁ, জামাইয়ের মাথায় তো এত বড় চকচকে টাক নেই, এই ক'দিনে এত টাক পড়ল কীভাবে বাবা?' আসে পাশে কিছু ভিড় করা মানুষ হেসে ফ্যালে, কিছু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গম্ভীর হয়ে যায়। বরুণের অবস্থা হয়ে ওঠে করুণ। সে বেচারা তাড়াতাড়ি মাথায় টোপর চড়িয়ে বসে। পিছন থেকে আওয়াজ আসে - 'টাকের তুমি টাকের আমি, টাক দিয়ে যায় চেনা।' পকেটে মোবাইল হাতড়াতে থাকে বরুণ। বরণ ডালাটা পিছনের এক মহিলার হাতে তুলে দিয়ে মনি বলে 
-'যা, যা ভিতরে রেখে আয়, লাগবে না।', তীক্ষ্ণ নজরে পর্যবেক্ষণ করতেও ছাড়ে না দুয়ারে আগত এই জামাই সাজে ছেলেটি ও তার বন্ধুদের। 
-'যাহ্ শা টাকের জন্য বিয়ে ক্যান্সেল! মাসিমা, শুধু ভেজাল জানেন তো' ব'লে পিছন থেকে গলা বাড়ায় মনীশ জানলার বাইরে। ওদিকে হবু শাশুড়ির দিকে মোবাইলটা এগিয়ে ধরে বরুণ তোতলাতে থাকে
-'আপনার মেয়ে শর্মিলা তো?' 
মনি হাসতে থাকে 
-'আমার মেয়ে তো রুমি, আসলে বাবা তুমি ভুল লজে এসে পড়েছ।' 
-'আচ্ছা, আচ্ছা তাই বলুন ভয় দেখিয়েই মেরে দিচ্ছিলেন আর কী!', 
-'কিন্তু কী কর তুমি? চাকরী না ব্যবসা?' মনি প্রশ্ন করে বসে। 
একদিকে বলে ভুল লজ, অপরদিকে কী করা হয় জানতে চাইতে দেখে ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে বরুণের বন্ধু সুবিমল সাড়া দেয় 
- 'মাসিমা, যার যত টাক তার তত টাকা'। 
খোঁচাটা খেয়ে মনি হাত দিয়ে ইশারা করে 
-'সামনেই আরও লজ আছে, আগে দ্যাখো তো। এই সব চল্ চল্ ভিতরে ঢোক, খোঁজ নে আমাদের জামাইয়ের গাড়ি কদ্দুর!' সদলবলে সব ভিতরে ঢুকে যায়। 
মনীশ ক্ষেপে ওঠে 
-'ভিখারীদের যেমন করে আগে দ্যাখো বলা হয় তেমনি করে বলছে যেন আগে দ্যাখো। বরুণ এ যাত্রা তুই বেঁচে গেলি মনে হয়। ও শাশুড়ি সুবিধার হত না এ'টুকু বলতে পারি।' 
-'এ তো নয়ই। বললেই পারতিস বরুণ তোর সোনা-হীরের ব্যবসা, আমরাও দেখতাম মেয়েদের সোনার নাম শুনলে মুখটা কেমন চকচক করে'। বিপিন হাসতে থাকে। 
মনীশ আবার যোগ করে 
-'তাহলে তো হয়েই যেত, ওর রুমির জন্য পিছনের গাড়িতে যেই আসুক না কেন বরুণকেই বরণ করে নিত। বুঝলি একটা বড় ভুল হয়ে গেল, কাজের কথা যখন জানতে চাইলেন আমাদেরও মেনুটা জানতে চাওয়া উচিত ছিল। খুব ক্ষিদে পেয়েছে মাইরি!' নিজের বলা কথায় নিজেই হাসতে থাকে মনীশ।
- 'তা যার সাথে বিয়ে যার কাকা স্বয়ং আমায় আনতে গিয়েছিলেন তাঁর কোন সাড়া শব্দ নেই কেন?' বরুণ পিছনে তাকায়। 
-'ও কাকু, ও কাকু উঠুন?' বলে ঝাঁকাতে থাকে মোহিতকে, বরুণের বন্ধুরা। মেয়ের বাড়ি থেকে জামাই আনতে গিয়েছিল তার মেজকাকা মোহিত। তিনি সারা পথটাই ঘুমিয়ে এসেছেন। বিয়ে বাড়ির এত কাজের ধকল নিয়ে আর জাগতে পারেন? এদিকে কখন কোন্ লজের সামনে ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়েছে জামাই বরণের মুহূর্ত এসে হাজির হয়েছে, পিছন থেকে কিছুই টের পাননি তিনি। 
- 'এসে গেছি? এসে গেছি?' ধড়ফড় করে উঠে বসেন তাড়াতাড়ি। 
-'এসে গেছি কিনা! আপনি দেখুন? আরেকটু হলে অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যেতে বসেছিল আর কী!' 
-' বল কী? ডাকবে তো? চোখটা যে কখন লেগে গেছে, টেরই পাই নি।'
- 'শুধু লেগে নয়, ফেভিকুইক দিয়ে আটকে গিয়েছিল কাকু, গাড়ি দাঁড়াল, উলুধ্বনি শঙ্খের আওয়াজ হল, এক মহিলার আর্ত চিৎকার হল... বরুণ তাদের জামাই নয়, কিছুই টের পেলেন না? তার উপর আবার আমাদের বন্ধুকে টেকো, মোটা কত অপমান' বিরক্তির সাথে বলে চলল সুবিমল। 
-'মোটা কই বলল, না না মোটা বলেনি, ওটা তুই বানিয়ে যোগ করছিস।' বরুণ সুর নরম করে। 
-'ঠিক আছে নে ওটাই বাকি রেখেছিল চল আবার গিয়ে শুনে আসি।' 
-'এই রে, এত কিছু ঘটে গেল? কোথায় আছি ভাই?' ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে ঘুম চোখে জানতে চান কাকা। তারপর নিজেই চলন্ত গাড়ির কাঁচ দিয়ে 'কই দেখি কোন্ জায়গায় আছি' বলে বাইরে তাকান। 'এইতো এসে গেছি, এই তো নির্মলা লজ, বাহ্ ভালো সময়ে তাকিয়েছি দেখেছ, আরেকটু হলে এগিয়ে যেতাম।' বলে গাড়ি থামাতে নির্দেশ দেন। 
ফুল দিয়ে সাজানো নতুন বরের গাড়ি এসে থামে নির্মলা লজের সামনে। মোহিত পিছনের দরজা খুলে নেমে পড়েন। 
-'শোন, ভিতরে গিয়ে আমি ডেকে আনি মহিলাদের বুঝলে। কই রে, কই গেলি সব?' বলতে বলতে লজে ঢুকে যান তিনি। কিন্তু সেখানে বাড়ির কাউকেই দেখতে পান না। ঘড়ি দেখেন, সন্ধ্যা সাড়ে আটটা। বিড়বিড় করেন 'এখনও বাড়ি থেকে কেউ এসে পৌঁছয় নি? কোন কান্ডজ্ঞান নেই কারুর! সব সাজতে ব্যস্ত।' 
-'ঠিক বলেছেন' ব'লে পাশ দিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে যায় এক লোক। মোহিত শুনতে পান ভিতরে ঢুকে সেই ব্যক্তি চ্যাঁচাচ্ছে 'কী গো, সব গেলে কই? এদিকে জামাই এসে হাজির'। বোঝেন বাইরে থেকে নতুন বরের সাজানো গাড়ি দেখেই সে আসছে। কিন্তু চিনতে পারেন না তাকে। ভাবেন শর্মিলার মায়ের বাড়ির দিকের হবে কেউ। অত সকলকে আজকাল আর মনে রাখতে পারেন না, কত আত্মীয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সাতজন্মে যাদের মুখ দেখতে পান না। সবাই শুধু বিয়েবাড়ি উপলক্ষে হাজির হয়েছে। সেই যে চলে যাবে আবার কেউ না জন্মালে, না মরলে বা বিয়ে করলে তদ্দিন দেখা যাবে না। কিন্তু তিনি বাড়ির কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না কেন? খোঁজেন এদিক ওদিক। যাদেরকে আশেপাশে ঘুরতে দেখেন সবাই অচেনা। একজনকে ধরে জানতে চান 
-'এই আমার ভাই রোহিতকে দেখেছ?' 
-'কে রোহিত'?
- 'আরে, যার মেয়ের বিয়ে, তা তোমার পরিচয় কী? তোমাকেও যে চিনলুম না'।
- 'আমারই মেয়ে সুপর্ণার বিয়ে। বাইরে বরের গাড়ি এসে গেছে। বরণ করার জন্য সবাইকে ডাকতে ছুটছি। ছোটনকে পাঠালাম খবর দিতে, তাও দেরি করছে সব। তা আপনাকেও তো চিনতে পারছি না। যেই হন দাদা তাড়াহুড়োতে চিনতে পারছি না, কিছু মনে করবেন না। ভিতরে যান, বসুন, খেয়ে যাবেন বুঝলেন? হেঁ হেঁ যাই দেখি ওদিকে।'
আবার কোনো গন্ডগোল হয়েছে বুঝতে পেরেই মোহিত উল্টো মুখে ছুটতে থাকেন। আর ওঁর পিছনেই শাঁখ উলুধ্বনির আওয়াজ এগিয়ে আসে। 
-'চলো, চলো, ভুল জায়গা.. ভুল জায়গায় ঢুকে পড়েছি। গাড়ি স্টার্ট কর শীঘ্রই।' বলে গাড়িতে বসে হাঁপাতে থাকে মোহিত। গাড়ি চলতে শুরু করতেই রাস্তায় পিছনে ভিড় জমে ওঠে। 'এই বর পালাচ্ছে, ধর ধর বরের গাড়ি আটকা,গাড়ি বার কর, পিছনে তাড়া করতে হবে।' ভিড় থেকে শব্দ ভেসে আসে।
- 'আজকাল কি বাজারে বরের খুব আকাল? অমন দৌড়চ্ছে কেন!' যেন কিচ্ছু হয় নি এমনভাবে মোহিত মুখ বিকৃত করে। বরুণের অবস্থা এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে ওঠে। বন্ধুদের সব হতভম্ব মুখ-চোখ।
-'কী হচ্ছে কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আপনি আদৌ শর্মিলার কাকা তো?' বড় বড় চোখ করে তাকায় বরুণ।
- 'বিলক্ষণ বিলক্ষণ, দাঁড়াও ফোন করি বাড়িতে। নির্মলা লজেই তো বিয়ে, তাহলে কী হল আমি নিজেই যে বুঝতে পারছি না।' ব'লে কানে ফোন ধরেন। কিছু বলার আগেই ভাই রোহিতের গলা ভেসে আসে 
-'কী রে দাদা, তোরা কোথায়? এদিকে শর্মিলা যে কাঁদছে, লগ্ন তো পেরিয়ে যাবার উপক্রম! কখন থেকে ফোন করছি, ফোনটাও লাগছে না, জামাইকে করা হল তারও নেটওয়ার্ক কভারেজ সীমার বাইরে। আছিস কোথায়? কতদূরে?'
- 'ধেড়ে মেয়ে বিয়ে করবে বলে কাঁদছে, থাম তো!' ধমক দেয় মোহিত। 'কাছাকাছি এসে গেছি, কিন্তু আমাদের লজটার নাম কী রে?'
এমন কথা শুনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকে বরুণ ও তার বন্ধুরা। 
-'মানে? তুই লজের নাম জানিস না?' 
-'জানি, জানি নির্মলা তো?'
- 'নির্মলা নয়, নির্মাল্য লজ, ময়নাডাঙার মোড়ে'। 
-'আচ্ছা, আচ্ছা রাখ, আসছি। বাড়ি থেকে অত দূরে কেউ লজ করে? প্রায় একইরকম নাম দুটো লজের কেউ রাখে নাকি! যত্ত সব উল্টো পাল্টা কাজ কারবার' ব'লে গজর গজর করতে করতে মোহিত ড্রাইভারকে হুকুম দেন 'এই গাড়ি ঘোরাও, ভুল রুটে চলে এসেছি।'
বরের গাড়ি নির্মাল্য লজে ঢোকার আগে সবাই একবার করে চেক করে ঠিক নির্মাল্যই তো? 
-'ভাই তোরা ঠিক করে দেখেছিস তো? ও কাকার উপর ভরসা নেই'। প্রশ্নকর্তা বরুণের মুখ কাচুমাচু। 
-'হ্যাঁ রে কিন্তু লজটা এমন ফাঁকা কেন? নিমন্ত্রিতও তো কাউকে দেখছি না। কাকাই বা গেল কই? সেই যে ঢুকল আর পাত্তাই নেই। মনীশ চল আমরা ভিতরে ঢুকে দেখে আসি' সুবিমল প্রস্তাব দেয়। যাবার খানিক বাদেই দৌড়তে দৌড়তে ফেরে দু'জন। 
-'তোর মোবাইলের ছবিতে দেখা দেখি শর্মিলাকে?'
- 'কেন রে, কী হয়েছে?' হামলে পড়ে বাকীরা। 
-'ভিতরে বিয়ের সাজে যাকে দেখে এলাম সে তো বুড়ি একজন'। 
-'কেন এ নয়?' বরুণ মোবাইলটা সুবিমলের সামনে এগিয়ে ধরে। 
-'না!' যুগ্ম ভাবে চিৎকার করে ওঠে সুবিমল আর মনীশ। 
-'চল, চল এক্ষুনি কেটে পড়ি এখান থেকে' ব'লেই গাড়ি থেকে নেমে দৌড়তে থাকে সব। পিছনে ততক্ষণে গাড়ির কাছে আবার উলুধ্বনি ও শাঁখের শব্দ এসে পৌঁছেছে। বহু দূরে একটা জায়গায় এসে হাঁপিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে তারা। 
-'ওহ্ বলতে ভুলে গেছিলাম বরযাত্রীর বাস কিন্তু অনেকক্ষণ পৌঁছে গেছিল এখানে। তোর বিয়ে হোক না হোক তাদের সব খাওয়া সারা। আমাদেরই শুধু সারাদিন কিছু জুটল না।' ব'লে মনীশ পেটে হাত বোলাতে থাকে। 
সুবিমল চেঁচিয়ে ওঠে 
-'খালি খাওয়া আর খাওয়া তোর তাই না? ছেলেটা এদিকে লগ্নভ্রষ্ট হল! প্রাণ ভরে খোলা মাঠের হাওয়া খা। আচ্ছা বরুণ এই পাত্রীর খোঁজটা কোথা থেকে পেয়েছিলি বলবি ভাই?'
খোলা মাঠের নিস্তব্ধতা চুরমার করে যেন ইকো হয়ে ওঠে বরুণের গলা 
-'ফেসবুক থেকে,
ফেসবুক থেকে, 
ফেসবুক থেকে।'
surashree0.sg@gmail.com
হুগলি

No comments:

Post a Comment