1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

সহযাত্রী

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

সহযাত্রী
সৌরভ নাগ

মশাই কদ্দুর যাচ্ছেন?

প্রশ্নটা শুনে চোখ তুলে তাকালেন অনিকেতবাবু। তাঁর বিপরীত দিকে বসে রয়েছেন পঞ্চাশোর্ধ বয়সের এক ব্যক্তি। এই কনকনে ঠাণ্ডাতেও তাঁর গায়ে একটি শাল পর্যন্ত নেই। কিছুক্ষন আগেও এই কামরা জনশূন্য ছিল। ট্রেন কিছুক্ষন আগে পানাগড় স্টেশন ছেড়েছে। সম্ভবত সেখান থেকেই উঠেছেন ইনি।

হাওড়া। অনিকেতবাবু বললেন।

ও, মানে একেবারে শেষ স্টেশন। মৃদু হাসলেন ভদ্রলোক। আমারও গন্তব্য হাওড়া। ভালোই হল বাকি পথটা গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।

ভদ্রলোক গায়ে পড়ে আলাপ করতে চাইছেন সেটা বুঝলেন অনিকেতবাবু। অবশ্য তাতে তাঁর কোনও সমস্যা নেই। 

অনিকেতবাবু হাতজোড় করলেন, আমি অনিকেত চক্রবর্তী। আমি সাহিত্যজগতের সাথে যুক্ত।

আচ্ছা আপনিই বিখ্যাত লেখক অনিকেত চক্রবর্তী? যাঁর প্রত্যেকটি বই বেস্টসেলার?

অনিকেতবাবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।

নমস্কার। আমি ড. সুধাকান্ত তালুকদার। আপনার অনেক বই পড়েছি আমি। 'সময়ের জোয়ার-ভাঁটা', 'কালচক্র' ― আপনি তো দারুণ লেখেন মশাই।

আর দারুণ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অনিকেতবাবু। গত তিনমাসে একটিও বই বেরোয়নি আমার। কোনও প্লটই আসছে না মাথায়। সেইজন্যই ধানবাদ গিয়েছিলাম চেঞ্জের জন্য। কিন্তু কোনও লাভ হল না। এবার হয়ত কোনও বিদেশি গল্প থেকে আইডিয়া নিতে হবে।

ওহ। সুধাকান্তবাবু বললেন, যদি বলেন তো আমি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি। 

আপনি? কীভাবে? অনিকেতবাবু বেশ অবাক হলেন।

সুধাকান্তবাবু তাঁর ব্যাগ থেকে একটি বই বের করে অনিকেতবাবুকে দিলেন। 

অনিকেতবাবু সেটা দেখলেন। বইটার নাম 'সময় যখন হারিয়ে যায়'। বইটার লেখকের নাম দেখে তিনি সুধাকান্তবাবুকে বললেন, অনিকেত চক্রবর্তী নামে অন্য বাঙালি লেখকও রয়েছে তাহলে। কিন্তু এই বই থেকে আমার কি সাহায্য হবে?

এটা আপনারই বই। অনিকেত চক্রবর্তী নামে আগামী ত্রিশ বছরেও কোনও বাঙালি লেখকের আগমন হবে না।

সুধাকান্তবাবুর কথা শুনে অনিকেতবাবুর ভ্রু কুঁচকে গেল। তাঁর এরকম কোনও বই বেরিয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না। আর সুধাকান্তবাবুর শেষ কথাটার মানেও বুঝতে পারলেন না তিনি।

সুধাকান্তবাবু বললেন, ব্যাপারটা আপনার অদ্ভুত লাগছে ঠিকই, কিন্তু এটা সত্যিই। এই বইটার লেখক আপনিই। বইটার প্রকাশকাল দেখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।

অনিকেতবাবু বইটা খুলে প্রকাশকাল দেখতেই তাঁর মাথা ঘুরে গেল। যে তারিখের উল্লেখ রয়েছে সেটা প্রায় সাত বছর পরের।

সুধাকান্তবাবু বললেন, এই বই আপনিই লিখেছেন তবে সময়টাই একটু আলাদা।

অনিকেতবাবু কিছু বুঝতে পারছিলেন না। এই লোকটা কি কোনও ম্যাজিক দেখাচ্ছে নাকি।

ব্যাপারটা তাহলে সহজভাবেই বলি। আমি একজন সময়যাত্রী। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ তিন সময়েই আমি যাতায়াত করেছি। আমি একজন বিজ্ঞানী। এক জটিল গবেষণার উপর কাজ করছি। গবেষণার কাজেই আমাকে বেশ কয়েকবার ভবিষ্যতে যেতে হয়। কিন্তু আমার নির্মিত সময়যান এখনো নিখুঁতভাবে অবস্থান নির্ধারণ করতে না পারায় ফেরার সময় পেরিয়ে ফেরার সময় প্রত্যেক বার ভুল জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছি। এই যেমন আজ ফেরার সময় কলকাতার বদলে পৌঁছে গেলাম পানাগড়। সে যাই হোক, বইটা পেয়ে আপনার সুবিধা হল কিনা বলুন।

অনিকেতবাবুর সন্দেহ হল, লোকটি পাগল নয়ত?

কিন্তু তাঁর কথাবার্তা শুনে তাঁকে পাগল বলে তো মনে হচ্ছে না। আর বইয়ের উপর ওই তারিখ, ওটা কি ভুলবশত প্রিন্টিং মিসটেক?

তাই হবে নিশ্চয়ই। অনিকেতবাবু বললেন, এটা যে ভবিষ্যতের বই আমার তো সেটা বিন্দুমাত্র মনে হচ্ছে না। আর আপনার কথাবার্তাও আমার খুব একটা সুবিধের লাগছে না।

সুধাকান্তবাবু হেসে বললেন, ওটাকে আপনার প্রিন্টিং মিসটেক বলে মনে হচ্ছে, তাই তো? আচ্ছা বেশ, মেনে নিলাম ওটা প্রিন্টিং মিসটেক। তাহলে এটা দেখুন।

সুধাকান্তবাবু একটি খবরের কাগজ এগিয়ে দিলেন। সেটাতেও তারিখ সাত বছর পরের। আর সেটাতে প্রথম পাতাতেই বড় হরফে একটি হেডলাইন রয়েছে ― টাইম মেশিন আবিষ্কার করলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী ড. সুধাকান্ত তালুকদার।

খবরের কাগজটা কিছুটা দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন সুধাকান্তবাবুর কথা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি আমি রাখতে পারি?

স্বচ্ছন্দে। সুধাকান্তবাবু হেসে বললেন।

আপনি আমার বই নিয়েই কি ঘুরে বেড়ান?

বলতে পারেন। আমার একটু-আধটু সাহিত্য পড়ার অভ্যাস আছে। কল্পবিজ্ঞানের বই অনেক পড়েছি। আপনার কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলি সত্যিই অসাধারণ। এটা কয়েকদিন আগেই কিনেছি। এখনও পড়া হয়নি। আপনি এটা স্বচ্ছন্দে রাখতে পারেন। আমি পরে কিনে নেব আরেকটা।

কিন্তু যদি এটা এখন প্রকাশিত হয়, তাহলে তো ভবিষ্যতে এটার অস্তিত্বই থাকবে না। অর্থাৎ সাত বছর পরে এই বইটা হঠাৎই উধাও হয়ে যাবে। 

সুধাকান্তবাবু আবার হাসলেন, সাত বছর পরে আপনার এক ডজন বই বেরোবে। তার মধ্যে থেকে একটা উধাও হলে সেই বছর আপনার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবে না। 

অনিকেতবাবু বললেন, কিন্তু এভাবে এটা আমি বিনামূল্যে নিতে পারব না আমি। বইটার মুদ্রিত মূল্য দেখলাম সাতশো টাকা। এই মুহূর্তে আমার কাছে অত টাকা নেই। 

সুধাকান্তবাবু হেসে বললেন, এত চিন্তিত হচ্ছেন কেন। টাকা দিতে হবে না আপনাকে। আর যদি বিনামূল্যেও না নিতে চান তাহলে সময় বিনিময় করতে পারেন।

মানে? অনিকেতবাবু বিস্মিতভাবে বললেন।

চব্বিশ ঘন্টায় এক দিন হয়। তেইশ ঘন্টায় আপনার এক দিন হলে কি খুব একটা অসুবিধে হবে আপনার?

অনিকেতবাবু বললেন, তেইশ ঘন্টায় এক দিন?

হ্যাঁ। আশা করছি আপনার খুব একটা অসুবিধা হবে না। 

কিন্তু সময়ের আদানপ্রদান তো অসম্ভব।

সুধাকান্তবাবু হেসে বললেন, বিজ্ঞানের কাছে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। আজ যেটা অসম্ভব বিজ্ঞান আগামী দিনে তাকে বাস্তবে পরিণত করে।হাতটা দিন।

সুধাকান্তবাবু তাঁর হাতঘড়ির ডায়ালের পাশের ছোট্ট একটি সুইচ টিপলেন। এবং হাতটা বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের জন্য। অনিকেতবাবুও হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।

সুধাকান্তবাবু হেসে বললেন, ব্যাস। হয়ে গেল সময়ের আদানপ্রদান। 

অনিকেতবাবু বললেন, কীভাবে?

আপনি আপনার ঘড়ি দেখুন।

অনিকেতবাবু তাঁর ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে উঠলেন। সাতটা সাতচল্লিশ। তাঁর ঘড়ির সময় প্রায় একঘন্টা এগিয়ে গিয়েছে!

এবার আমার ঘড়ির সময় দেখুন। বলে সুধাকান্তবাবু তাঁর ঘড়ির সময় দেখালেন। পাঁচটা সাতচল্লিশ। অর্থাৎ তাঁর ঘড়ির সময় প্রায় এক ঘন্টা পিছিয়ে গিয়েছে।

অনিকেতবাবু বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। হুঁশ ফিরতেই বুঝতে পারলেন ট্রেন হাওড়া পৌঁছে গিয়েছে। 

সুধাকান্তবাবু বললেন, আমার বাড়ি নর্থ কলকাতায়। আশা করছি ফের দেখা হবে।

সুধাকান্তবাবু বিদায় জানিয়ে নেমে গেলেন।

অনিকেতবাবুও তাঁর ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেন থেকে নামলেন।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ডাকলেন তিনি। ট্যাক্সিতে উঠে বইটা বের করলেন। কল্পবিজ্ঞানের গল্প তাতে সন্দেহ নেই। জানালার কাচ তুলে তিনি বইটা পড়তে শুরু করলেন।


বাড়ি পৌঁছে ট্যাক্সি থেকে নামতেই দেখলেন প্রতিবেশী হরিহরবাবু অবাক হয়ে তাঁকে দেখছেন।

হরিহরবাবু তাঁর বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটে থাকেন। দোতলা বাড়িতে দুজন ব্যাচেলর মানুষ বাস করায় দুজনের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে। তাই কোথাও গেলে তিনি হরিহরবাবুকে বলে যান। চেঞ্জে যাওয়ার সময়ও তিনি হরিহরবাবুকে বলেছিলেন। শুধু কোথায় যাবেন সেটাই বলেননি। অবশ্য তিনি নিজেও তখনও স্থির করেননি চেঞ্জের জন্য কোথায় যাওয়া যেতে পারে।

অনিকেতবাবু বললেন, কাজ হয়ে গেল তাই একটু আগেই ফিরে এলাম।

হরিহরবাবু বললেন, কোন কাজে গিয়েছিলেন মশাই যে পাক্কা দুবছর পর ফিরেছেন!

অনিকেতবাবু ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির দিকেই এগোচ্ছিলেন। কিন্তু হরিহরবাবুর কথা শুনে স্ট্যাচু হয়ে গেলেন। 

হরিহরবাবু বলতে লাগলেন, আপনার প্রকাশকমন্ডলীরা তো আমাকে পাগল করে দিয়েছে। আমি যত বলি উনি কোথায় গিয়েছেন আমি জানি না, ততই আরও চেপে ধরেছে আমাকে। এরপর সাংবাদিকদের ভিড়, পুলিশের জেরা। কি জ্বালায় যে ফেলেছিলেন আমাকে!

অনিকেতবাবু বাড়িতে ঢুকে ব্যাগ থেকে ক্যালকুলেটর বের করে হিসেব করতে লাগলেন।

প্রতিদিনের থেকে এক ঘন্টা বাদ গেলে এক বছরে হয় ৩৬৫ঘন্টা। এবং ৫০ বছরে সেটা দাঁড়াচ্ছে দুবছরে। অর্থাৎ তাঁর আয়ু এখনও প্রায় ৫০ বছর।

কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন তিনি। সুধাকান্তবাবু তাঁর থেকে দৈনিক একঘন্টা করে প্রায় দুবছর নিয়েছেন। তাঁর উদ্দেশ্যটা কি সেটা বুঝতে আর অসুবিধে নেই অনিকেতবাবুর। তাঁর ব্যাগ থেকে খবরের কাগজটা কিছুটা উকি মারছে সেখানে খবরটির শেষ কয়েক লাইন চোখে পড়েছে অনিকেতবাবুর। টাইম মেশিনের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী ড. সুধাকান্ত তালুকদার সদ্য প্রয়াত।

নিজের আবিষ্কারকে মানবসভ্যতা কীভাবে ব্যবহার করবে সেটা দেখার জন্যই আরও দুবছর সংগ্রহ করেছেন তিনি। স্রষ্টা নিজের সৃষ্টির ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখে যেতে চাইছেন। 

টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে পড়লেন অনিকেতবাবু। নতুন গল্প লিখতে শুরু করলেন ― 'সময় যখন হারিয়ে যায়'।

sav811998@gmail.com
কলকাতা

2 comments:

  1. অসাধারণ একটি গল্প দাদা,😊😄 খুব সুন্দর হয়েছে রে.. তোর লেখা গল্প গুলোর মধ্যে এটাই সব থেকে বেশি ভালো লেগেছে।🤩 এরকম আরো গল্পের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।😌♥️ অনেক দূর এগো... অনেকটা ভালোবাসা রইল।❤️

    ReplyDelete