1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

সুগন্ধা

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

সুগন্ধা
হিমাদ্রী শেখর চক্রবর্ত্তী 

                                  (১)

           "ওই তো লাল কুর্তি পরে আছে। চল চল অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।" রাই কে ভিড়ের মাঝেও চিনে ফেলল রুসা। সল্টলেক সেক্টর ফাইভের কাছেই নামকরা প্রতিষ্ঠান হল নিউ ড্রিম গ্রুপ অফ কলেজ। আজ সেখানেই বার্ষিক পুনর্মিলন উৎসব এর শেষ দিনে রাই, রুসা, পৃথা এবং আরও অনেক পুরানো ছাত্রছাত্রীরা এসেছে বিভিন্ন যায়গা থেকে। রাই এর বাড়ি মধ্যমগ্রাম এর বাদু রোডের কাছাকাছি এলাকায়। তাড়াতাড়িই চলে এসেছে কলেজে। এসেই ফোন করেছিল রুসা কে, রুসা তখন রাস্তায় ছিল। রুসার বাড়ি খড়গপুরে তাই আসতে একটু দেরি হয়েছে। কিন্তু পৃথা বিধাননগরে থাকে তাও ওর আসতে এত দেরী। সেই  কলেজবেলা থেকেই পৃথা লাস্ট কার। ক্লাসে স্যার আর পৃথাকে প্রায় দিনই একসাথে ঢুকতে দেখা যেত। কখনও বা স্যার ঢোকার পর কাঁচুমাচু মুখে একটা নরম গলায় জিজ্ঞেস করতো "স্যার আসবো?" সেই স্বভাব ওর এখনও যায়নি। রুসা কলেজ গেটে ঢুকেই দেখল পৃথাও সেইমাত্র এসেছে। চারিদিকে পুরানো ও নতুন ছাত্রছাত্রীদের মিলিত ভিড় আর কোলাহল জায়গা টাকে মুখরিত করে তুলেছে। প্রাক্তনরা সবাই চেনা ক্যাম্পাসে পুরানো দিনের গন্ধ অনুভব করতে ব্যস্ত। সাথে চলছে প্রিয় মুখগুলোর সাথে সোনালী দিনের স্মৃতিচারন। ওরা রাই এর দিকে এগিয়ে গেল। রাই এর সামনে গিয়ে কাঁধে হাত রাখল রুসা। আলগোছে মাথা ঘুরিয়ে ওদের দুজনকে দেখেই আনন্দে চিৎকার করে উঠল রাই। কলেজের সময় থেকেই এই তিনটে মাথা সবসময় এক যায়গায় দেখা যেত। আজ সেই ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি যেন আচমকাই প্রতিফলিত হল তিনজনের চোখেমুখে। আনন্দে জড়িয়ে ধরল একে অপরকে। এদের কে দেখে এখন কে বলবে যে এরা প্রত্যেকেই মাসকমিউনিকেশন এর একেকজন তাবড় ব্যক্তিত্ত্ব!  রাই সান্যাল থাকে দিল্লী তে। এক নামকরা খবরের চ্যানেলের ভাইস প্রেসিডেন্ট। রুসা ব্যানার্জ্জী চেন্নাই এর একটি প্রতিষ্ঠানের আর্ট ডিরেক্টর এবং পৃথা কোলকাতা বঙ্গভূমি টিভির নিউস এডিটর। তিনজন তিনপ্রান্তে থাকার ফলে দেখা হয়ই না। যদিও আজকের নীল ও সবুজ সামাজিক মাধ্যমে সবাই সবসময় একে অপরের খবরাখবর নিতে পারে তবুও এই গলা জড়িয়ে ধরা টা আর পাওয়া হয়না। তাই আজ সবকিছু ভুলে তিনজনেই ফিরে গেল সেই সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট এর দিনগুলোতে। অনুষ্ঠান শুরু হল এবং সারাটা দিন যে কিভাবে কেটে গেল বোঝাই গেল না। পড়ন্ত বিকেলে সারাদিনের আলোর মতো এই ফেলে আসা দিনগুলোয় ফিরে যাওয়া টাকে ছেড়ে যেতে তখন সবারই বুক ভারী এবং চোখ ভরে আসছে। রুসা গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল - "রাই, পিথু তোরা আয় না আমার বাড়ি। রাই তোর তো ছুটি আছে বেশ কটা দিন। সেই তো আবার যে যার কাজে ফিরে যাবো আবার কবে দেখা হবে জানিও না। আয় না তোরা। সেই কলেজের সময় থেকে একবারও যাস নি।" রুসার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, রুসার হাতটা দুহাতে চেপে ধরে বলল - "আসছি এই আসছে শনিবারেই। কি রে পিথু তোর কোনো সমস্যা নেই তো?” পৃথা কথা টা শুনেই বলল - " না ব্রো, কোনো চাপ নেই। আসছি আমরা রুসি র বাড়িতে। তুই সাবধানে যাস, পৌঁছে ফোন করিস।" একটা ঘনিয়ে আসা শূন্যতার মেঘেও যেন একচিলতে রোদের আলো খেলে গেল পৃথা আর রাই এর মুখে।
গাড়িটা সেক্টর ফাইভের গেট ছাড়িয়ে ইকোলজিকাল পার্কের পাশ দিয়ে আসছে। রুসা তখনও ডুবে আছে ফেলে আসা দিন গুলোর স্মৃতি তে। শেষ বিকেলের কমলালেবুর খোসার রঙের রোদ জানালা দিয়ে এসে পড়েছে গাড়ির ভেতর। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ফেলে আসা দিনগুলোর নানা কথা। পুরানো সুতির জামা যেমন আরামদায়ক হয় তেমনিই পুরানো স্মৃতিও বড্ড শান্তি দেয়। অবশ্যই যদি সেটা সুখের সময়কালীন হয় তবেই, নাহলে তা মনে না করাই শ্রেয়। তবু মন কি মানতে চায়! সুখের দিনগুলো মনে করেও ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। স্কুল শেষ করে তখন সবেমাত্র কলেজে এসেছে পড়তে। কোলকাতার এই কলেজটা মাস কমিউনিকেশনের জন্য বেশ নামকরা এটা শুনেই রুসার মা ভর্তি করেছেন এখানে। প্রথম দিনই রুসা এক বেঞ্চে বসেছিল পৃথা ও রাই এর সাথে। সেই থেকে শুরু ওদের বন্ধুত্ব। তারপর কলেজের দিনগুলো তে পড়াশোনা, হাসি ঠাট্টা, মজা আনন্দ সব কিছুতেই এই তিনমাথা এক জায়গায়। বন্ধুরা হাসাহাসি করে বলতো যে - "তোদের কে কোনো ছেলেই প্রপোজ করবে না। নাহলে তো তাকে তিনজনকে নিয়েই থাকতে হবে। আর সেই রিস্ক টা কোনো ছেলেই নেবে না।" এইভাবেই ওরা কাটিয়ে দিল ওদের কলেজবেলা। শুধু সব্যসাচীর জন্য একবার রুসা আর পৃথায় ঝগড়া হয়েছিল। পরে অবশ্য সেই ভুল বোঝাবুঝি মিটে যায় এবং আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। নাহ সেসব স্মৃতি আর এখন মনে করতে চায়না রুসা। সবারই স্মৃতি তে একটা না একটা ভুলে থাকতে চাওয়ার অধ্যায় থাকে যেটা মনে পড়লেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয় এটা জেনেও যে ওই ঘটনা গুলো আগে ঘটে গেছে আর নতুন করে ওগুলো নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নানা কথা ভাবতে ভাবতে একটু ঘুম ধরে গেছিল রুসার, গাড়িটা একটু জোরে ব্রেক করতে চটকা টা ভেঙে গেল। দ্বিতীয় হুগলী ব্রিজের জ্যামে আটকেছে গাড়িটা। নীচে অনন্তবহা গঙ্গা সেই কোনকাল থেকে বয়েই চলেছে নির্লিপ্ত ভাবে। একটা নদীর সাথে একটা মেয়ের জীবনের অনেক মিল খুঁজে পায় রুসা। প্রায় দেড় ঘন্টা বাদে বাড়ি পৌঁছল সে, তখন সন্ধ্যে নেবে গেছে কালো হয়ে। খড়গপুর শহর জেগে উঠেছে আলোয় সেজে। বাড়ির কলিংবেল টা বাজানোর সাথে সাথেই মা এসে দরজা খুলল মুখে স্বভাবসিদ্ধ  মিষ্টি হাসি। রুসার বাবা যখন মারা যান তখন ও মাত্র সাত বছরের। খুব ভালো করে মনেও নেই বাবার মুখটা। ছবি না দেখলে বোধকরি মনেও থাকতো না রুসার। সেই সময় থেকেই মা সামলে নিয়েছেন সবকিছু। আজ ও বাবার অভাব বোধ করে তবে মা তার অনেকটা পূরণ করে দেয়। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে এসে মা'কে বলল - "মা আজ কিছু খাব না। খুব মাথা টা ধরেছে। আমি একটু রেস্ট নি। একেবারে রাতে কিছু খেয়ে নেব।" মায়ের সায় পেয়ে নিজের ঘরে এলো রুসা। এসেই দেখল রাই মেসেজ করেছে, পৃথাও মেসেজ করেছে। তাদের উত্তর দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুতে যাবে এমন সময় ভিডিও কল এলো। রাই আর পৃথা করেছে। ফোন ধরতেই ওদিক থেকে পৃথা বলে উঠল - "ভাই শোন না, এই সপ্তাহে আমার আর সময় হবে না রে। শুক্র, শনি ও রবি আউটিং পড়েছে যেতেই হবে। প্লিজ কিছু মনে করিস না। তবে রাই যাবে, কি রে রাই যাবি তো?” রাই উত্তর দিল - "হ্যাঁ রে আমি যাবো ঠিক শনিবার বিকেল বিকেল পৌঁছে যাব।" একথা সেকথার মাঝে কখন রাত হয়ে গেছে খেয়ালই নেই ওদের কারোরই। মা এসে রুসা কে বলল - "কি রে তুই ঘুমোবি বললি, দিয়ে এসে আড্ডা দিচ্ছিস! তোরা না তিনটে পারিসও বটে। যাকগে আয় খেতে দিলাম।" বলে মা চলে গেল। ওরাও খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ল।

                      (২)

                    পরের শনিবার তখন ঠিক বিকেল ৪টে বাজে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ে তখন রুসা বিকেলের আলিস্যি মেশাচ্ছে। এমন সময় রাই এর ফোন টা আসতেই মন টা ভরে উঠলো তার। লোকাল ট্রেনে করে এসেছে রাই। মেয়েটা বরাবরই এমন অতি সাধারণ ভাবে বাঁচে। বাড়ির গাড়ি নিয়ে সহজেই আসা যায় কিন্তু না ও ট্রেনেই আসবে। খড়গপুর স্টেশনে নেবে অটো ধরেছে। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিল রুসা। ওকে আনতে যেতে হবে রাস্তা চেনে না যে। রুসা যখন কমলা কেবিনে পৌঁছল তখন উল্টোদিকে অটো থেকে নামছে রাই, ওকে দেখেই হাত নাড়ল। রুসার বাড়ি এখান থেকে প্রায় মিনিট চারেকের হাঁটা পথ। দুজনে গল্প করতে করতে হাঁটা লাগালো। জলকালীর পুকুর পেরিয়ে কিছুটা এগোলেই ডান হাতে সতীশ মিষ্টান্ন ভান্ডার এর গা ঘেঁষে একটা সরু গলি চলে গেছে। সেই পথ ধরেই এগোল দুজনে। রাস্তার একদম শেষ বাড়িটা রুসার। গেটে ঢুকতে ঢুকতেই "কাকিমা আ আ" বলে হাঁক দিল রাই। রুসার মা তিস্তা এসে দরজা খুলতেই রাই জড়িয়ে ধরল ওনাকে। বাড়িটা হঠাৎ করেই যেন আলো ঝলমলে হয়ে উঠলো। আসলে রাই মেয়েটাই এমন, যেখানেই যায় মাতিয়ে রাখে।
তখন বিকেল প্রায় গড়িয়ে এসেছে। রাই আর রুসা বেরুলো সন্ধ্যের খড়গপুর দেখবে বলে। রেলশহর খড়গপুরে সারা ভারতের বহু ভাষার মানুষ বসবাস করেন কাজের সুত্রে। তাই এই যায়গা কে অনেকে মিনি ইন্ডিয়াও বলে থাকেন। এর একদিকে যেমন আছে গ্রাম্য সরলতা অপরদিকে আবার শহুরে জটিল পরিবেশ। রুসার বাড়ির থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে ডান দিকে এগিয়ে গেল ওরা। ডিসেম্বর মাস, বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। রুসা বলল- "চল আজ তোকে দেখাব, শহরের পাশাপাশি কি সুন্দর গ্রাম্য জীবন এখানে একসাথে মিলেমিশে আছে।" দুই বন্ধু গল্প করতে করতে এগিয়ে চলল। রআই এর মনে পড়ল কাঁচরাপাড়ায় ওর মামাবাড়ির কথা। চারিদিকে মন ভালো করা সবুজের সমারোহ। হাঁটতে হাঁটতে ওরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। রাস্তার পাশেই একটা ছোট্ট মতো জমি দেখিয়ে রুসা বলল - "এই দেখ রাই, এটা এখানের শ্মশান। কাঠ সাজিয়ে এখানে দাহ করা হয়। শহরের পাশেই এমন চুল্লী বিহীন শ্মশান খুব সচরাচর চোখে পড়ে না।" কথা বলতে বলতে ওরা এগিয়ে এসেছে অনেকটাই। চারিদিকটা বেশ অন্ধকারও হয়ে এসেছে। তার ওপর কুয়াশার চাদরে কেমন যেন আরো আঁধার ঘনিয়ে রেখেছে। একটা ফাঁকা যায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল রাই। ডানপাশে ধূ ধূ ফাঁকা রেললাইনের মাঠ আর বাম পাশে কয়েকটা বড় বড় বাঁশঝাড়। রাই হঠাৎ বলে উঠলো - "উফফ পাচ্ছিস ভাই?" 
"কি রে?” একটু ভয়ে ভয়েই যেন বলল রুসা। রাই বলল - " আহহ মাতাল করা ছাতিম ফুলের গন্ধ। আহা ভেতরটা ভরে গেল রে।" তারপরেই আচমকা একটু ধরা ধরা গলায় বলল -"কিন্তু এই সময়ে তো ছাতিম ফুল ফোটে না! এখন কি করে পাওয়া যাচ্ছে এই গন্ধ?" খানিকক্ষণ থেকেই উসখুস করছিল রুসা। রাই এর এই কথা টা শুনে যেন কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো বলল - "ভাই চল এক্ষুনি এখান থেকে। একমুহূর্তও আর এখানে না।" বলেই রাই এর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল বাড়ির দিকে। কিছু বুঝতে না পেরে খানিকটা বিস্মিত হয়ে গেছে রাই। কিন্তু বন্ধুর কথা শোনা ছাড়া আর উপায়ই বা কি! রুসা একরকম ছুটতে ছুটতেই এসে বাড়ির গলির কাছে থামল। এই শীতেও তারা দুজনে ঘেমে নেয়ে গেছে। রুসা হাঁফাতে হাঁফাতে বললো - "শ্বাস নিয়ে নে। মা যেন কিছু জানতে না পারে।" রাই এর অবস্থাও খারাপ, বলল -"কি হয়েছে বলবি ফর দ্য শেক অফ গড?" রাই জড়ানো গলায় বলল -"ওখানেই পাশে একটা ছাতিম গাছ আছে। তার তলাতেই একটা কুঁড়েঘর আছে। সেই ঘরে শুনেছি আগে এক মহিলা থাকত।  কিছুটা দূরে এক আড়তদারের ঘরে কাজটাজ করত। স্বভাব চরিত্র ভালো ছিল না মহিলার। এটা সেটা সরিয়ে ফেলতো। একদিন মালিক ধরে ফেলে আর কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়। নিজের মেয়েটাকেও বিক্রি করে দিয়েছে বলে শোনা যায়। ওই মহিলা তারপর হঠাৎ করেই একদিন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আর তার পর থেকেই ওই যায়গাটায় সন্ধ্যের পর ছাতিম ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়। ওই বাড়িতে কি আছে কেউ দেখতেও যায়নি কোনোদিন মানে সাহস পায় নি আরকি। দেখলিই তো ওখানে কাছাকাছি মানুষের বসবাসও নেই। তাই তুই যেই বললি গন্ধ টা পেয়েছিস, ভয়ে দৌড়ে চলে এলাম।" দুঁদে সাংবাদিক রাই সান্যাল কোনোভাবেই এই ভূতুড়ে গল্প মেনে নিতে নারাজ, আবার সে নিজেই পেয়েছে ওই ছাতিম ফুলের গন্ধ। একটা দোটানায় যেন অস্বস্তি হতে লাগল রাই এর কিন্তু চুপচাপ চেপে গেল সে। সবে সন্ধ্যে হয়েছে তিস্তা সন্ধ্যে দিচ্ছিলেন তুলসী মন্দিরে। ওদের দেখে একবার হেসে আবার নিজের কাজে মন দিলেন। বাড়িতে ঢুকে খানিকক্ষণ বসে থাকার পর মনের ভারী ভাবটা কাটল রুসার। সে রাই এর কাঁধে হাত রেখে বলল - "ঠিক আছিস তো?” রাই ঘাড় নেড়ে সায় দিল শুধু মুখে কিছু বলল না।

                    (৩)

                  চারিদিকের অন্ধকার টা বেশ গাড় হয়েছে এর মধ্যেই। পাশের রেলমাঠ দিয়ে একটা দূরপাল্লার ট্রেন হুস হুস করে বেরিয়ে গেল। এই অন্ধকারেও যায়গা টা চিনে নিতে ভুল করলো না রাই। রাস্তা টা শ্মশানের পরেই বামপাশে বেঁকে গেছে। বাঁকের উপরেই একটা ছোট্ট কালভার্ট। আর সেই বাঁকের মুখেই বামপাশে একটা ফাঁকা অংশ। রাস্তার থেকে খানিকটা নীচু এই অংশটার পরেই বাঁশের ঝাড়।এই জমিটার শেষ অংশে একটা ছোট্ট টালির বাড়ি আর তার পাশেই একটা প্রকান্ড ছাতিম গাছ। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে জমিটায় নামল রাই। আস্তে আস্তে গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। না সত্যিই কোনো ফুল ফুটে নেই গাছে তবুও একটা তীব্র ছাতিম ফুলের গন্ধ ওকে যেন আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। এই প্রচন্ড ঠান্ডাতেও যায়গা টা যেন কেমন গরম ঠেকল ওর। দিনের উত্তাপের অহঙ্কার যেন অন্ধকারের সাথে ডুয়েল খেলছে। একটা শিরশিরে বাতাস বইছিল এতক্ষণ ধরেই সেটা যেন দুম করে বন্ধ হয়ে গেল। কিরকম যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে বুকের ভেতরটায়। গন্ধটা যেন ক্ষণে ক্ষণে আরও তীব্রতর হচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে গন্ধ টা কিছু একটা জানান দিচ্ছে। একটু ভয় ভয় ও করছে এবার ওর। অচেনা যায়গা এভানে আসা টা ওর ঠিক হয়নি। অন্তত একবার রুসা কে জানিয়ে এলে ভালো হত কিন্তু এসেই যখন পড়েছে শেষ না দেখে ও ফিরবেনা। এবার আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। সামনের মড়মড়ে দরজাটায় বাইরে থেকে শেকল দেওয়া। সেটা খুলে ও ভেতরে ঢুকল। মোবাইলের ফ্ল্যাশ এর জোরালো আলোটাও কেমন যেন আবছা লাগছে এই গাঢ় অন্ধকারে। ঘরের ভেতর কিছুই নেই তেমন। ডানদিকে দেওয়াল ঘেঁষে একটা চৌপায়া রাখা। তার ওপর ধুলোর মোটা পরত জমেছে। চৌকি টার উল্টোদিকে একটা মাটির হাঁড়ি, মাটির মেঝেতে খোঁড়া একটা কাঠের উনুন। আর কিছুই চোখে পড়ল না। চলে আসতেই যাচ্ছিল হঠাৎ চৌকির তলায় ধুলোর মধ্যে কি একটা উঁকি মারতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল রাই। একটা কাপড়ের পুতুল। খুব সুন্দর দেখতে পুতুল টা। পুতুলটা হাতে করে নিয়েই সে বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে। আর ঠিক তখনই কোথা থেকে একঝাঁক ঠান্ডা হাওয়া এসে উদ্দাম নৃত্য করতে শুরু করল যেন। কালবৈশাখী ঝড়ের মত তার গর্জন। ছাতিম গাছটার মাথা টা অস্বাভাবিক ভাবে দুলতে শুরু করেছে। রাই এর মনে হল কেউ যেন তীব্র কান্না ভরা চিৎকার মিশিয়ে দিয়েছে বাতাসে। ঠিক এমন সময় ওর মোবাইলের আলোটাও যেন কিভাবে নিভে গেল। আর সাথে সাথেই ওর সাহসও উবে গেল। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে শুরু করলো রাই। পেছনের বাঁশঝাড় আওয়াজ কানে আসতে লাগলো। কোনোদিকে না তাকিতেই কোনোমতে ছুটে রুসার বাড়ির সামনা সামনি এসে থামল। ও যখন বাড়ি তে ঢুকলো তখন প্রায় সাড়ে ন'টা বেজে গেছে। রুসা ওকে দেখেই সন্দিগ্ধ চোখে জিজ্ঞেস করল - "কিরে কখন থেকে ফোন করছি, ছিলি কোথায় তুই?" যতটা সম্ভব সচেতন ভাবে রাই বলল -"এই মার্কেট টা দেখছিলাম একটু ঘুরে ঘুরে। চল কিছু খাই, খুব খিদে পাচ্ছে।" সারাদিনের ধকলের ফলে রাতে খাওয়ার পর খুব সহজেই ঘুম এসে গেল। ওপরের দুটো ঘরে একটায় রুসা আর তার পাশের টায় রাই শুয়ে পড়ল আর তিস্তা নীচেই শুলেন।
রাত তখন কত হবে ঠিক নেই হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেল রাই এর। ঘরের ডিম লাইট টার আলোয় ঘরটা ভীষণ গা ছমছমে লাগছে। বোধহয় তেষ্টা পেয়েছে কারণ গলা টা ভীষণ শুকনো লাগছে। জিব্বটা যেন টাকরায় আটকে গেছে। কেমন যেন একটা চাপা অস্বস্তি হচ্ছে বুকের ভেতরটায়। চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখল রাই। ওর মনেও পড়ছে না জলের বোতল টা কোথায় আছে। এদিক সেদিক দেখতে দেখতেই চোখটা মাথার উপরে যেতেই কেউ যেন হৃদপিন্ড টায় ছুরির কোপ মারল। মাথার ঠিক ওপর থেকেই খাটের তাকিয়া টার ওইপাশ থেকে একজোড়া চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কি নিষ্ঠুর সেই দৃষ্টি। আর তাকিয়ে থাকতে পারে না রাই। চিৎকার করতে যায় কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। এদিকে হাত পা যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে উঠেও বসতে পারে না সে। কতক্ষণ এভাবে ছিল ঠিক মনে নেই তারপরেই জ্ঞান হারায় সে।

                    (৪)

                  সকালে চোখ খুলেই দেখল পাশে কাকিমা ও রুসা বসে আছে। কাকিমা বললেন -"ডাক্তার এসেছিলেন বলে গেছেন সাডেন শক থেকে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে। এখন কেমন আছিস মা?” "ভালো আছি কাকিমা" মিনমিনে গলায় উত্তর দেয় রাই। কাকিমা উঠে গেলে আস্তে আস্তে খাটে উঠে বসে সে। তারপর সবটা বলে রুসা কে। রুসা শুনে তো বেজায় রেগে যায়। বলে- "তোকে বারণ করেছিলাম আমি ওখানে যেতে। ওখানে যে কি আছে কেউ জানে না। তুই কেন এত বড় রিস্ক নিলি। তোর কিছু হলে আমি কাকিমা কে কি জবাব দিতাম বলতো।" আস্তে আস্তে জড়ানো গলায় রাই বলে- "তুই জানিস ওই মহিলা কোথায় থাকে?” প্রায় চিৎকার করতে যাচ্ছিল রুসা ওর হাত দুটো জড়িয়ে ধরে মিনতির সুরে বলে- " প্লিজ চল না ওনার কাছে যাই। এর শেষ না দেখলে আমি শান্তি পাবো না। প্লিজ চল না লক্ষ্মীটি।" বন্ধুর কথা ফেলতে না পেরে সায় দেয় রুসা। রেডি হয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে। মেইন রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে ট্রাফিকের মোড় থেকে ডান হাতি একটা রাস্তা পাঁচবেড়িয়ার মাঠের পাশ দিয়ে গেছে। ওই রাস্তায় খানিকটা গিয়েই বাম দিকে একটা ছোট্ট টিনের ঘর দেখিয়ে দেয় রুসা। রাই আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ওই ঘরের দিকে। টিনের দরজা টা ঠেলা দিতেই খুলে যায় আর সাথে সাথেই একটা ভীষণদর্শণা বুড়ি বেরিয়ে আসে বঁটি হাতে। সভয়ে পিছিয়ে আসে রুসা কিন্তু রাই একটুও ভয় না পেয়ে বুড়ির হাতের বঁটি টা ধরে ফেলে। তারপর মোলায়েম গলায় বলে- "তুমি ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এলে কেন মাসি?” এই কথা টা শুনে আরও রেগে যায় বুড়ি। বলে - " তোর কি রে মাগী? আমি কুথায় থাকব তুই বলে দিবি?” এমন মারমুখী পাগল একটা মানুষের সামনেও একটুও বিচলিত হয় না রাই। কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা কাপড়ের পুতুল বের করে বুড়ির সামনে ধরে বলে - "এবারেও বলবে না?” ঠিক জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন চুপ করে যায় তেমনি বুড়িও পুতুলটা দেখে কেমন যেন গুম মেরে গেল। আর আস্তে আস্তে বলল - " আমি সাধন করাতির বাড়ি কাজ করতাম। বিশ্বাস করো আমি চুরি করিনি।  তাও আমায় চোর অপবাদ দিল। আমার মেইছ্যানা টার নাম দিছলাম সুগন্ধা। বড্ড ভালো ছ্যানা ছিল আমার। সেদিন আমার মেইছ্যানা টার সাথে ওর বড় বেটা নোংরামি করছিল। আমার ছোট বাচ্চা মেয়ে কিছুই বুঝত না। সেদিন আমি দেখে ফেলি। আর এর প্রতিবাদ করতেই অরা আমাকে চোর বলে তাড়িয়ে দেয়। সেদিন একটা টাকাও ছিলনি আমার কাছে। কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম নি। ঘরে চুপ মেরে বসে বসেছিলাম। মেইছ্যানা টা সন্ধ্যা থিকেই খাব খাব করে ঘ্যানঘ্যান করছিল। কি যে হল আমার মরণ হাতের সামনে বঁঠি টা ছিল তুলে মেরে দিলম এক ঝটকা। অর মাথায় লাগলো। সুন্দর মুখটা লাল হয়ে গেছল রক্তে। যখন হুঁশ এলো তখন ছ্যানা টা আর বেঁচে নাই। অর কিছু জ্বালা ছিলনি জান তো। এই পুথুলটা লিয়েই সারাদিন থাকত। সেদিন খুব খিদা পেইছিল। আর আমি মা হয়েও রাক্ষসীর মতো অকে মেরে দিলম। সারারাত বসে ছিলাম অকে লিয়ে। ঘরের নাগালে যে ছাতিম গাছ টা আছে অটা অর বড্ড পছন্দ ছিল অর তলায়েই খেলত সারাদিন। তাই অই গাছের তলায়েই পুঁতে দিলম। শুধু অর এই পুথুল টা দিবা হয় নি। তমরা যে গন্ধ টা পাও অটা অর কান্না। অকে পুথুল টা দিয়ে দিবে দেখবে আর কিছু থাকবে নি। আমাকে শুধু অখানে যেতে বলনি গো। আমি পারবনি।" এক নিঃশ্বাসে বলেই কাঁদতে লাগল বুড়ি। রাই আর রুসা চুপচাপ ওখান থেকে বেরিয়ে এল। বাড়ি অবধি একটাও কথা বলল না দুজনের কেউই। বাড়ি ফিরে অপেক্ষা করতে থাকল সন্ধ্যে হওয়ার। 
তখন ঠিক সন্ধ্যে আট টা মতো বাজে, দুই বন্ধুতে আবার গিয়ে পৌঁছল সেই গাছের তলায়। আজ দুজনের কারুরি আর ভয় করছে না। বরং একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা যেন দুজনকেই কুরে কুরে খাচ্ছে। রাই হাতে করে পুতুল টা নিয়ে এসেছিল। আস্তে আস্তে গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। আজও বাতাস বইছে তবে তাতে কালকের রাতের সেই উদ্দামতা নেই বরং আছে একটা খুশি খুশি ভাব। বাতাসের সেই কান্না টাও যেন নেই আজকে। নীচে দাঁড়িয়ে রাই একটু উঁচু গলায় বলল - "সুগন্ধা! আমরা তোমার পুতুল ফিরিয়ে দিতে এসেছি। তুমি শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? এই নাও তোমার পুতুল" বলেই  হাতের পুতুল টা গাছ এর মাথার দিকে ছুঁড়ে দিল। মিনিট তিনেকের অপেক্ষা, কিন্তু এ কি! পুতুল টা গেল কোথায়?
himadri7384@gmail.com
পশ্চিম মেদিনীপুর

No comments:

Post a Comment