1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

তিন্নি

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

তিন্নি
স্নেহা আদক

১.


"ডাক্তারবাবু, এখন কেমন আছে আমার মেয়ে।", উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করে অদ্রিজা।

"দেখুন পেশেন্টের কন্ডিশন মোটেই ভালো নয়। আমাদের ইমিডিয়েট লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে দিতে হবে পেশেন্টকে। কনসেন্ট লাগবে আপনার।", ডক্টর শান্ত গলায় বললেন।

অদ্রিজা তার স্বামীকে ফোন লাগায়," ডক্টর বলেছেন তিন্নির কন্ডিশন ভালো নয়। লাইফ সার্পোট সিস্টেমে রাখতে হবে।"

ওপাশ থেকে উত্তর আসে, " আপাতত তাই করো। আমাদের হাতে এখন কোনো উপায় নেই।"

"ঠিক আছে",বলে ফোন রেখে দেয় অদ্রিজা।

                                                                         ---

"হ্যালো, আমি কি ঈশান মুখার্জীর সাথে কথা বলছি?",ফোনের ওপাশ থেকে এক নারীকণ্ঠ প্রশ্ন করে ওঠে।

— হ্যাঁ বলুন ,আমিই ঈশান মুখার্জি।

— আমি অদ্রিজা দাস বলছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার ফটোগ্রাফির বিজ্ঞাপনটা দেখে ফোন করেছি।

— আচ্ছা। আপনি কি ধরনের ফটো চান।

— আমার মেয়ের সাথে আমার কয়েকটা ছবি বানিয়ে দিতে হবে। আপনি পারবেন তো?

— হ্যাঁ! হ্যাঁ! নিশ্চয়ই পারবো আপনার মেয়ের কোন ফটো নিশ্চয়ই আছে আপনার কাছে।

— হ্যাঁ আছে। আপনি কবে কোথায় ফটোশুটটা করতে চান যদি একটু বলতেন।

— এই রবিবার, দুপুর বারোটা নাগাদ ময়দানে চলে আসবেন। 

— আচ্ছা। টাকাপয়সার ব্যাপারটা….

— টাকা-পয়সার ব্যাপার নিয়ে আমরা পরে কথা বলতে পারি আগে ফটোশুটটা হোক।

— আচ্ছা ধন্যবাদ।

মহিলার জন্য বেশ কষ্টই লাগলো, মেয়ে হারিয়েছেন মহিলা। অবশ্য ওর কাজটাই এত এরকম মানুষদের নিয়ে, যারা নিজেদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে। তাদের প্রিয়জনদের ছবি সুপারইম্পোজ করে ফটোশুট করা ছবির মধ্যে ফুটিয়ে তোলা। যাতে তাদের মনে হয় যে প্রিয় মানুষটা তাদের আশপাশেই আছে।

প্রত্যেকবারই টাকার ব্যাপারটা নিয়ে ওর কথা বলতে ভালো লাগেনা। নিজেকে কেমন স্বার্থপর লাগে। টাকার জন্য তো ও কাজ করে না। শখে করে।

২.


"এইটা আমার মেয়ে, তিন্নি। ওর বয়স দুই বছর ছিল। কিছুদিন আগেই আমাদেরকে একা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে ও।"

একটু আগেই ময়দানে এসে পৌঁছেছে ঈশান আর অদ্রিজা। অদ্রিজাকে দেখেই ঈশানের মনটা কেমন যেন ভারাক্রান্ত হয় গেলো। মহিলাটির শুকনো মুখে ক্লান্তি এসে ছাপ ফেলেছে। মেয়েটির ছবি দেখতে চাইতেই অদ্রিজা এই কথাগুলো বলল। অদ্রিজার কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় ঈশান।

" এত্ত ছোট্ট মিষ্টি একটা মেয়ে এত কম বয়সে চলে গেল।", মনে মনে ভাবলো," বাবা মায়ের ওপর দিয়ে কি কষ্ট বয়ে যাচ্ছে। মা তাই জন্যই হয়ত মেয়েকে কাছে অনুভব করার শেষ চেষ্টা করছে।"

কিভাবে মারা গেছে আপনার মেয়ে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করলেও চুপ করে যায় ঈশান।

"ম্যাডাম আপনি আমাকে একটু বলুন যে আপনার কি ধরনের ছবি চাই।", অদ্রিজাকে জিজ্ঞেস করে ঈশান।

"আমার মেয়েকে ঘুমনোর সময় এই বইটা পড়ে শোনাতেই হতো নয়তো ও ঘুমোতেই চাইতো না।", একটু থেমে গিয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে অদ্রিজা," আমি চাই আপনি এমন একটা ছবি তুলুন যেটাতে আমি আমার মেয়েকে এই বইটা পড়ে শোনাবো।"

ঈশানের মনে হলো অদ্রিজার গলাটা একটু কেঁপে কেঁপে উঠলো। অদ্রিজার হাতের দিকে তাকিয়ে ও দেখলো একটা বই ধরা, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড।

নিজের মনে একবার কল্পনা করলো ঈশান এই গল্পটা শুনতে শুনতে কিভাবে ঘুমিয়ে পড়ত তিন্নি। নিশ্চই অনেক মায়া জড়ানো থাকতো ওই মুখে।

"ঠিক আছে আমরা তবে এই ছবিটা দিয়েই শুরু করি। আপনি ওইখানে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসবেন।"

                                                   ---

"আচ্ছা! আরেকটা শেষ ফটো তুলবো আমি। আপনার যদি প্রবলেম না থাকে ম্যাডাম।", বলে ওঠে ঈশান।

— আর একটা? ঠিক আছে অসুবিধে নেই। কিভাবে বলুন?

— হ্যাঁ আপনি ওই যে ঐদিকটাতে হাঁটু মুড়ে বসুন, মাথাটা নিচে ঝুঁকিয়ে।

— হ্যাঁ হ্যাঁ! আরেকটু সামনে ঝুকুন। হাত দুটো চোখের ওপর চাপা দিন। ব্যাস! ব্যাস! ঠিক আছে, এমনই থাকুন।

"ধন্যবাদ! আপনার ফিসটা যদি বলতেন….", পার্স খুলতে খুলতে প্রশ্ন করে অদ্রিজা।

এখন ঈশানের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ক্লান্ত মা, যে তার সন্তানকে হারিয়ে বিপর্যস্ত হয় পড়েছে। এরকম একটা মানুষের কাছ থেকে ও কি করে টাকা নিতে পারে?

— টাকা লাগবে না ম্যাডাম। এই কাজটা আমি নিজের মন থেকেই করলাম।

— কিন্তু…!

— না ম্যাডাম আমি টাকা নিতে পারবো না। আপনি এই ছবিগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে পেয়ে যাবেন।

— ধন্যবাদ, কিন্তু…!

— হ্যাঁ, আপনি শুধু আমাকে একটা অনুমতি দিন। আপনার এই ছবিগুলোর একটা ছবি আমি আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে চাই, যদি আপনার কোনো অসুবিধে না থাকে।

— আচ্ছা। আমার কোনো অসুবিধে নেই।

ঘরে ফিরে নিজের ল্যাপটপে ছবিগুলো খুলে বসে ঈশান। কিভাবে ছবিগুলো এডিট করবে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে যেন। তিন্নিকে না চিনেই একদিনের মধ্যেই অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে, মায়া পড়ে গেছে বাচ্চা মেয়েটার ওপর।


৩.


"নমস্কার ডাক্তারবাবু আমি পেশেন্টের বাবা। আমার মেয়ে কেমন আছে এখন?", জিজ্ঞেস করে তিন্নির বাবা।

"দেখুন মিস্টার দাস, জানিনা আপনারা মেয়ের দিকে কেমন নজর রাখেন। এরকম কেয়ারলেস কেউ কি করে হতে পারে। বাচ্চা কি করে একটা কলা খেতে গিয়ে চোকড্ হতে পারে। নিশ্বাস না নিতে পেরে বাচ্চার বডি নীল হয়ে যাচ্ছিল। পেশেন্টের কন্ডিশন ভালো না বরং আরো খারাপ হচ্ছে। আমি আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না"

ডক্টরের কথা শুনে তিন্নির মা-বাবা কিছুক্ষণ কিছু একটা আলোচনা করে। ডক্টরের কাছে গিয়ে তিন্নির বাবা বললো," আমরা আর আমাদের মেয়েকে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে রাখতে চাই না।"

ডক্টর কিছুক্ষন অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন," আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?"

— হ্যাঁ।

— আপনাদের সন্তান মারা যাবে।

— জানি, কিন্তু আমাদের হাতে আর টাকা নেই। তাই আমরা চাইছি যে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম খুলে নেওয়া হোক।

— আরেকবার ভেবে দেখুন….।

— আমরা অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

— ঠিক আছে! ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।

                                             ---

"হ্যালো, ম্যাডাম! ঈশান বলছিলাম।", পাঁচদিন পর অদ্রিজাকে ফোন করলো ঈশান।

— হ্যাঁ, বলুন।

— আপনার ছবিগুলো তৈরি হয় গেছে। আমি কুরিয়ার করে দেবো হার্ডকপিগুলো আর সফ্টকপিগুলো মেইল করে দেবো।

— আচ্ছা। মেইল আইডিটা লিখে নিন।

— দুদিনের মধ্যে আপনি ছবিগুলো পেয়ে যাবেন। আমি সফ্টকপিগুলো এক্ষুনি সেন্ড করে দিচ্ছি আপনি দেখে নিন।

ল্যাপটপ খুলে সব ছবি মেইল করার সময় ছবিগুলো আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেয়। নিজের সবথেকে প্রিয় ছবিটা ওর চোখে পড়ে যেখানে অদ্রিজা হাটুমুড়ে সামনে ঝুঁকে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে আছে আর পিছন থেকে ছোট্টো তিন্নি ওর কাঁধে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। এই ছবিটাই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে ও। এই ছবিটা যেন না বলেও অনেক কথা বলে যায়।

৪.


ডিউটিতে থাকা নার্স ডক্টর বোসকে ডেকে বললো,"ডক্টর, এই বাচ্চা মেয়েটার বাবা মায়ের ব্যবহার আমার সুবিধের মনে হচ্ছে না। বাচ্চাটার গলায় আঙুলের ছাপ দেখা যাচ্ছে। আর আজকেই দেখলাম মেয়েটার গায়েও অনেক জায়গাতে কালশিটে। আমার ব্যাপারটা গন্ডগোল লাগছে। পুলিশকে ইনফর্ম করা উচিত।"

"আমারও তাই মনে হচ্ছে সিস্টার। ঠিক আছে আমি দেখছি।"

পুলিশ যতক্ষণে এলো তিন্নি মারা গেছে। তিন্নির শরীরের বিভিন্ন জায়গাতে গভীর আঘাতের চিহ্ন। পুলিশ ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত করতে শুরু করলো। উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়া অবধি তিন্নির বাবা মাকে কাস্টডিতে নেওয়া সম্ভব নয়।

                                        ---

সকাল সকাল ফোনটা বেজে উঠতে বেশ বিরক্তই হয় ঈশান। ঘুম চোখে দেখে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসছে। ফোনটা বাজতে বাজতে একসময় কেটে যায়। ঈশান আর মাথা না ঘামিয়ে ফোনটা রেখে দেয়। কিন্তু কিছুক্ষন পর আবার সেই একই নম্বর থেকে ফোন আসায় বিরক্তি ভরে ফোনটা তোলে। ওপাশ থেকে একটা গলা ভেসে আসে।

— নমস্কার, আমি কি ঈশান মুখার্জীর সাথে কথা বলছি?

— হ্যাঁ বলুন।

— আমি বরানগর পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি।

— কি সাহায্য করতে পারি আপনাদের?( একটু ভয় পেয়ে প্রশ্নটা করে ঈশান। ওর ঘুম উড়ে গেছে দুচোখ থেকে।)

— ক-দিন আগে অদ্রিজা দাস বলে একজন মহিলা আপনার কাছে ফটোশুটের জন্য এসেছিলো?

— হ্যাঁ স্যার! আমি তো ওনার সমস্ত ছবি চারদিন আগেই ওনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।

— আপনি কি ওনার কোনো ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আপলোড করেছিলেন?

— হ্যাঁ স্যার, কিন্তু আমি তো অনুমতি নিয়েছিলাম আগেই।

— ওই ছবিগুলো ডিলিট করে দিন এক্ষুনি। 

— কেন স্যার? কিছু অসুবিধে হয়েছে?

— ওই মহিলা নিজের মেয়ের ওপর অত্যাচার করতে করতে বাচ্চা মেয়েটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। আপনার ছবিগুলো উনি শুধুমাত্র ব্যবহার করেছেন যাতে সবার মনে হয় উনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন ওনার মেয়ের মৃত্যুতে। শুধুমাত্র নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। উনি জানতেন যে ওনাদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছিলো।

— কিন্তু কেন? কোনো মা তার সন্তানকে….?

— ওনাদের মানসিক অবস্থা ঠিক নয়। মেয়েটাকে অনেকদিন ধরেই মারধোর করতেন। 

গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয়না ঈশানের। পুলিশ অফিসার বলে চলেন,

" আপনার তোলা এই ছবি অনেকের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে, তাই যত তাড়াতড়ি সম্ভব ছবিগুলো মুছে ফেলুন। আশা করছি আপনি বুঝেছেন।"

ফোনটা রেখে দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়ে ঈশান। মানুষ চিনতে খুব বড়ো ভুল হয়ে গেলো ওর।

ছবিটা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মুছে দেওয়ার আগে শেষবারের মতো একবার ছবিটার দিকে তাকালো ঈশান।

ওর মনে হলো তিন্নি যেন ওর মাকে বলছে," কেন তুমি এরকম করলে মা?"

snehaadak012@gmail.com
হাওড়া

3 comments: